০৯. নিরস্ত্রীকরণ

নিরস্ত্রীকরণ

সাধারণ নিরস্ত্রীকরণ ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বাঞ্ছিত ঠিকই, কিন্তু স্থিতিশীল শান্তিকে সুরক্ষিত করার জন্য সেটুকুই যথেষ্ট নয়। যতদিন বৈজ্ঞানিক কলাকৌশলসমূহ মানুষের আয়ত্তে থাকবে, ততদিন যেকোনো বড় মাপের যুদ্ধ শুরু হলে উভয় পক্ষই পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের পথে পা বাড়াবে। শান্তির পর্যায়ে যে সব ভয়ংকরতর অস্ত্রের কথা ভেবে রাখা হয়েছিল, সেই সব অস্ত্রও তখন নির্মাণ করে ফেলবে তারা। কাজেই শুধুমাত্র নিরস্ত্রীকরণ এ ব্যাপারে যথেষ্ট নয়। তবে যথেষ্ট না হলেও এটি একটি অত্যাবশ্যক পদক্ষেপ এবং এই পদক্ষেপটিকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো ব্যবস্থাই কার্যকরী হতে পারে না।

নিরস্ত্রীকরণের সমর্থকরা বলেন-গণহত্যার অস্ত্রগুলো অনৈতিক। কথাটা নিঃসন্দেহেই সত্য, কিন্তু সেই অর্থে বললে তীরধনুকও তো অনৈতিক। হ্যাঁ, দুটোর মধ্যে এক বিশাল মাত্রাগত পার্থক্য আছে: একজন মানুষকে হত্যা করা যদি অন্যায় হয়, তাহলে কুড়ি কোটি মানুষকে হত্যা করাটা তার থেকে কুড়ি কোটি গুণ বেশি অন্যায়। তবে অনৈতিকতা কিন্তু আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের প্রকৃত অভিনব বৈশিষ্ট্য নয়। এইসব অস্ত্রের সব থেকে অভিনব বৈশিষ্ট্য হলো যে যুদ্ধে এইসব অস্ত্র ব্যবহৃত হবে, সে- যুদ্ধে দুপক্ষেরই পরাজয় সুনিশ্চিত। আর ঠিক এই বৈশিষ্ট্যটিই আজকের দিনের যুদ্ধ সংক্রান্ত যাবতীয় চিন্তাভাবনাকে হাস্যকর এবং একইসঙ্গে ক্ষতিকর ব্যাপারে পরিণত করেছে। পূর্ব বা পশ্চিমের যে সব মানুষরা যুদ্ধাভিমুখী পলিসিকে বরদাস্ত করে চলেছেন, তারা আসলে ভ্রান্তির শিকার হচ্ছেন। কিছু কিছু লোক যুদ্ধের সীমা পর্যন্ত যেতে আগ্রহী। মিউনিখের ঘটনার পর হিটলারও ঠিক এটাই ভাবত এবং হিসেবের এই গরমিলই তার পতনের কারণ হয়ে উঠেছিল। আজকের দিনে সেই একই পরিস্থিতি দেখা দিলে তার পাশাপাশি তার শত্রুদেরও পতন ঘটত।

একদল যুদ্ধবাজ আরও বিপদজ্জনক। জাতীয় বা মতাদর্শগত অহমিকায় এরা এমনই আচ্ছন্ন যে যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ হাতে পাওয়ার পরও বিশ্বাস করে যুদ্ধে তাদের পক্ষই জয়ী হবে। রাশিয়া ও আমেরিকা উভয় দেশেই এ ধরনের ভিত্তিহীন বিশ্বাস ব্যাপকভাবে চালু আছে, আর আলাপ আলোচনা চালানোর সময় বাড়তি সুবিধা পাওয়ার জন্য উভয় দেশের সরকারই এই সব বিশ্বাসকে আরও উসকে দেয়।

তৃতীয় গোষ্ঠীতে আছে আত্মোৎসর্গকামী কট্টরপন্থিরা। এঁরা মনে করেন কোনো শুভ উদ্দেশ্যের জন্য লড়াই করা এবং মৃত্যুবরণ করা এক মহান ব্যাপার আত্মোৎসর্গ করলে যে পৃথিবী গড়ে উঠবে তা যদি আত্মোৎসর্গ না করলে যে পৃথিবী থাকবে তার চেয়ে অনেক খারাপও হয়, তাতেও কিছু যায় আসে না।

দুর্ভাগ্যবশত, হিরোশিমার ঘটনার পর থেকে এই তিনটি গোষ্ঠীই একযোগে কাজ করে চলেছে এবং পারমাণবিক যুদ্ধের বিপদ কমানোর যে কোনো প্রচেষ্টাকে রুখে দিতেও আজ অবধি সক্ষম হয়েছে। কোনো কোনো গোষ্ঠীর কাজকর্মে মাঝেমধ্যে কাণ্ডজ্ঞানের কিছু আভাস পাওয়া গেছে ঠিকই, কিন্তু উভয় পক্ষ একই সময়ে এই অভ্যাসগুলোকে কখনো উপলব্ধি করেনি।

হিরোশিমার পর থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনগুলোর ইতিহাস মানবজাতির ইতিহাসের সব থেকে হতাশাজনক উপাখ্যানগুলোর অন্যতম। হিরোশিমা ও নাগাসাকির ওপর পরমাণু বোমা নিক্ষেপের পর সকলেই অনুভব করেছিলেন, এমনকি আমেরিকাও (যারা তখন পরমাণু বোমার একচ্ছত্র অধিকারী ছিল), যে পারমাণবিক শক্তির আন্তর্জাতিককরণ দরকার। আমেরিকান সরকারের বিবেচনার জন্য পেশ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রস্তাবটি সত্যিই প্রশংসার যোগ্য ছিল, তবে সেটিকে অবিকৃত অবস্থায় অন্যান্য দেশগুলোর সামনে উপস্থাপনের উপযুক্ত বলে মনে করা হয়নি। আন্তর্জাতিক স্তরের যে প্রস্তাবটি উপস্থাপিত করা হয়েছিল সেটা হলো বারুচ প্রস্তাব। আগের প্রস্তাবটির সঙ্গে কয়েকটি বিষয় যোগ করে এই প্রস্তাবটি রচনা করা হয়েছিল এবং আশা করা হয়েছিল রাশিয়া এ প্রস্তাব কিছুতেই গ্রহণ করবে না। আশাটা সত্য হিসেবেই প্রমাণিত হয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরবর্তী বছরগুলোতে বিরোধ নিষ্পত্তির যাবতীয় প্রয়াসকে ব্যস্তবায়িত হতে না দেওয়ার জন্য স্তালিন যে যথাসাধ্য প্রচেষ্টা করেছিলেন, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরই আমেরিকা তার প্রচলিত যুদ্ধাস্ত্রের পরিমাণ প্রচুর কমিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু স্তালিনের দিক থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। স্তালিন ইয়াতায় বলেছিলেন যে পূর্ব গোলার্ধে রাশিয়া বাদে অন্য দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক সরকারই থাকা উচিত, কিন্তু বাস্তবে রাশিয়ার অনুগত সবকটি দেশে অত্যন্ত কঠোর সামরিক ও পুলিসি একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। এর সঙ্গে যখন বার্লিনের অবরোধ চালু হলো আর রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্রের অধিকারী হয়ে উঠল, তখন পশ্চিমী দুনিয়াও কঠোর রাশিয়া বিরোধী মনোভাব ও পলিসি নিয়ে ঠাণ্ডাযুদ্ধে নেমে পড়ল। স্তালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষ থেকে উত্তেজনা প্রশমনে অনুকূলে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়, কিন্তু সেইসব উদ্যোগকে সন্দেহের চোখেই দেখে পশ্চিমী দুনিয়া। ইতিমধ্যে বেশ কিছু নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন রয়েছে, পারমাণবিক অস্ত্রপরীক্ষা বন্ধ করার সম্মেলন হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হিয়নি, শুধু অস্ত্রপরীক্ষা সংক্রান্ত সম্মেলন যতদিন ধরে চলবে ততদিন অস্ত্র পরীক্ষা বন্ধ রাখার জন্য একটি স্থগিতাদেশ জারি করা গেছে। ১৯৫৪-র ঠিক পরবর্তী বছরগুলোতে এই প্রচেষ্টায় ব্যর্থতার প্রধান দায়ভার অবশ্যই রাশিয়ার, কিন্তু স্তালিনের মৃত্যুর পরবর্তী বছরগুলোর সম্বন্ধে সে কথা প্রযোজ্য নয়। ক্রুশ্চেভ যখন সার্বজনীন ও সর্বাঙ্গীন নিরস্ত্রীকরণের প্রস্তাব দেন, তখন তাঁর সেই প্রস্তাবকে চালবাজি হিসেবে ধরে নিতে প্রত্যাখ্যান করে পশ্চিমী দুনিয়া। প্রকাশ্যে না বললেও পশ্চিমী কর্তৃপক্ষের অন্তরস্থ ভাবনাটা ছিল এ রকম, ক্রুশ্চেভ এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন নিরস্ত্রীকরণের ব্যবস্থা করাই নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনের উদ্দেশ্য। ক্রুশ্চেভ খুব ভালো করেই জানে যে কোনো পক্ষই নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে মাথা ঘামায় না। দুপক্ষেরই উদ্দেশ্য হলো স্রেফ একটা প্রচারের খেলা চালিয়ে যাওয়া, যে খেলায় দু-পক্ষই নিরস্ত্রীকরণের সমর্থক হওয়ার ভান করে যাবে কিন্তু কিছুতেই সেটা হতে দেবে না। সার্বজনীন নিরস্ত্রীকরণের কথা বলছে ক্রুশ্চেভ, কিন্তু সত্যিই সেটা করা হচ্ছে কি না তা যাচাই করবে কে? এই অজুহাতেই প্রস্তাবটা বাতিল করে দেব আমরা। এ আপত্তিটা এড়ানোর জন্যে ক্রুশ্চেভ তার প্রস্তাবে কিছু সংশোধন করতে রাজি হয় কি না তা দেখার কোনো দরকার নেই, তার আগেই খারিজ করে দিতে হবে প্রস্তাবটা। অতএব, আবারও ফল হলো শূন্য।

উভয় পক্ষই স্বীকার করে, প্রথম আঘাত যে হানতে পারবে, সে প্রচুর বাড়তি সুবিধা পেয়ে যাবে। কোনো পক্ষ যদি অপ্রত্যাশিতভাবে পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র সমেত আক্রমণ হানতে পারে তাহলে প্রতিপক্ষের এত ক্ষতি হবে যে কার্যকরী প্রতি-আক্রমণ চালানো তাদের পক্ষে খুবই কঠিন হয়ে উঠবে। থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়ার গ্রন্থে কাহন যে সব প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করেছেন, এটি তার অন্যতম। জনমানসে প্রভাবসম্পন্ন বহু আমেরিকান এবং পশ্চিম ইউরোপের একই ধরনের বহু ব্যক্তি মনে করেন, সোভিয়েত রাশিয়া যে কোনো মূহূর্তে এ রকম অপ্রত্যাশিত আক্রমণ চালাতে পারে। ধরেই নেওয়া যায় যে রাশিয়াতেও একই ধারণা চালু আছে এবং পশ্চিমী দুনিয়ার মতো তারাও প্রথম আঘাতের বিপদ সম্পর্কে যথেষ্টই সচেতন। এই পারস্পরিক আশঙ্কা বিরোধ নিষ্পত্তির সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে তো বটেই, সেই সঙ্গেই অনভিপ্রেত পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনাকেও অনেক বাড়িয়ে তুলছে। অত্যন্ত মূল্যবান একটি গ্রন্থের (ইনসপেকশন ফর ডিসআর্মামেন্ট, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৫৮) সম্পাদক সিমুর মেলম্যান এই বিপদের কথা স্বীকার করেছেন এবং অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন (পৃঃ ১০):

পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্রের নির্মাতারা এইসব অস্ত্রের মধ্যে এমন কিছু যান্ত্রিক রক্ষাকবচ রাখার চেষ্টা করেছেন যাতে করে আকস্মিক বিস্ফোরণকে প্রতিহত করা যায়। যেমন, এই ধরনের অস্ত্র ক্রিয়াশীল হওয়ার আগে তাকে চালু করার একটা বন্দোবস্ত রেখেছেন তারা। কিন্তু মানবীয় ভুলত্রুটির সম্ভাবনা থেকেই যায় এবং তাকে পুরোপুরি প্রতিহত করার উপযোগী কোনো রক্ষাকবচ নেই। পারমাণবিক অস্ত্র প্রচুর সংখ্যায় বানানো হয় কিন্তু তা ব্যবহার করার কাজে নিযুক্ত থাকে তার থেকেও বেশি সংখ্যক মানুষ, সুতরাং এইসব মানুষদের কারুর ভুলে বিশ্বব্যাপী বিপর্যয় নেমে আসার সম্ভাবনাও থেকেই যায়। কোনো বিপথগামী, মনোবিকারগ্রস্ত লোক কিংবা সাময়িকভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা কোনো ব্যক্তি যত্রতত্র অথবা কোনো জনবহুল এলাকার ওপর পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিতে পারে। কৃত্রিম উপগ্রহকে বোমাবাহী ক্ষেপণাস্ত্র বলে ভুল করা হতে পারে।

সামরিক কৌশল ও প্রযুক্তিকে দ্রুত প্রতিশোধ গ্রহণের উপযোগী করেই গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে কোথাও একবার হিসেবের ভুল হলেই সর্বনাশা পারমাণবিক যুদ্ধের আক্রমণ প্রতি-আক্রমণ শুরু হয়ে যেতে পারে। পারমাণবিক অস্ত্রসমূহ এখন আগের থেকে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে এবং বেশ কয়েকটি দেশের হাতে পৌঁছে গেছে বলে এই ধরনের দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও অনেক বেড়ে গেছে। বর্তমান লেখকের মতে, এই ধরনের সম্ভাবনা সামরিক শক্তিধর দেশগুলোর যুক্তিসম্মতভাবে পরিকল্পিত সেইসব প্রয়াসকে দুর্বল করে দেয় যে সব প্রয়াস পারস্পরিক ভীতি থেকে অস্ত্রত্যাগের সাহায্যে শান্তি স্থাপনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে থাকে।

শেষত, বহু দেশ পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হয়ে উঠলে পারস্পরিক ভীতির কারণে অস্ত্রত্যাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আমূল বদলে যাবে। কোনো শহর থেকে একটি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করা হলে আক্রমণকারীকে চিহ্নিত করা অসম্ভব হয়ে উঠবে, কারণ বহু দেশই পারমাণবিক বোমার অধিকারী এবং সেইসব বোমা লক্ষ্যস্থলে নিক্ষেপ করারও বহু রকম পদ্ধতি আছে। আক্রমণকারীকে চিহ্নিত করা না গেলে প্রতিশোধের হুমকিটুকু দেওয়াও সম্ভব হবে না। ফলে পারস্পরিক ভীতির দরুন পারমাণবিক আক্রমণ পরিত্যাগ করার পন্থা হিসেবে আতঙ্কের ভারসাম্য সংক্রান্ত নীতিটিও অকেজো হয়ে যাবে।

এই মতের বিরোধিতা করার মতো বিশেষ কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যাদের নেই, তারা প্রত্যেকেই এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত। এমনকি অন্য অনেকেও এই বক্তব্য সমর্থন করেছেন, যেমন আমাদের দেশের বিজ্ঞানবিষয়ক মন্ত্রী লর্ড হ্যাঁলিশ্যাম বলেছেন যে আজ নয়তো কাল যুদ্ধ বাধবেই (ডেইলি স্কেচ, ১১ আগস্ট ১৯৬০)। সি.পি স্নো আরও স্পষ্টভাবে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, আর বড়জোর দশ বছরের মধ্যেই কিছু বোমা বিস্ফোরিত হবে। হবেই। কথাগুলো তিনি লিখেছেন দ্য মরাল আননিউট্রালিটি অব সায়েন্স শীর্ষক এক নিবন্ধে (মান্থলি রিভিউ, ফেব্রুয়ারি ১৯৬১, পৃঃ ১৫৬)। এ রকম আরও অনেকের একই ধরনের বক্তব্য এখানে উদ্ধৃত করা যায় যারা কেউই চরমপন্থী নন।

মানুষের জীবনের ক্ষেত্রে এর অর্থ কী? প্রতিপক্ষের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রাশিয়া অথবা আমেরিকা হঠাৎ প্রথম আঘাত হেনে বসবে এমন সম্ভাবনা আজ বা কাল খুব বেশি না হলেও সম্ভাবনাটা দিন দিনই বাড়ছে এবং পলিসির পরিবর্তন না ঘটলে তা এক নিশ্চয়তায় পর্যবসিত হবে। সি.পি.স্নো-র বক্তব্য যদি সঠিক হয় (বেঠিক বলে মনে করার কোনো কারণই নেই) তাহলে আগামী দশ বছরের কোনো এক দিনে রাশিয়ার দিকে নিক্ষিপ্ত হবে হাইড্রোজেন বোমা এবং প্রত্যুত্তরে হাইড্রোজেন বোমা নিক্ষিপ্ত হবে পশ্চিমের দিকেও, অথবা প্রথম বোমাটি নিক্ষিপ্ত হবে পশ্চিমের দিকে এবং তার প্রত্যুত্তরে রাশিয়ার দিকে। ব্রিটেনে বসে আমরা হয়তো ঠিক চার মিনিট আগে জানতে পারব কী ঘটতে চলেছে। আমেরিকা হয়তো পঁচিশ মিনিট আগে জানতে পারবে। কী জানতে পারব আমরা? জানতে পারব যে আমাদের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ মুহূর্তের মধ্যে মারা যাবে, বাকিরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবে এক যন্ত্রণাময় মৃত্যুর দিকে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সেই ঘটনার পর ব্রিটেনে একজন মানুষেরও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই।

তাৎক্ষণিক প্রতিশোধ-এর বর্তমান নীতি যতদিন কার্যকরী থাকবে, ততদিন অনেক ঘটনাকে রাশিয়ার পারমাণবিক আক্রমণ বলে ভুল করার সম্ভাবনা থেকে যাবে। সে রকম ক্ষেত্রে আমরা যাকে প্রতিশোধ বলে ভুল ভাবব, প্রতিপক্ষের কাছে তা বিনা প্ররোচনায় আক্রমণ হিসেবেই প্রতিভাত হবে এবং শুরু হয়ে যাবে সর্বাত্মক পারমাণবিক যুদ্ধ। ইতিমধ্যেই কয়েকবার এ রকম ঘটনা ঘটতে চলেছিল। সোভিয়েত বোমারু বিমানের আগমনের আগাম ইঙ্গিত পাওয়ার জন্য গ্রিনল্যান্ডের উত্তরে থলে-তে একটি শক্তিশালী রাডার কেন্দ্র বসানো হয়েছে। হাইড্রোজেন বোমাবাহী বিমানের চালকরা এত ভালো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যে সঙ্কেত পাওয়ার দুমিনিটের মধ্যেই আকাশে পাড়ি দিতে পারেন তাঁরা। বেশ কয়েকবারই সঙ্কেত পাওয়ার শেষ মুহূর্তে দেখা গেছে যা দেখে সঙ্কেত পাঠিয়েছিল রাডার তা আর কিছুই নয়, স্রেফ কিছু রাজহাঁসের ওড়াউড়ি। অন্তত একবার আকাশে চাঁদ ওঠাকেও রাশিয়ান আক্রমণ বলে ভুল করা হয়েছিল। সে যাত্রায় একটি হিমশৈল আকস্মিকভাবেই মাঝপথে এসে পড়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। করে দিয়েছিল বলে প্রতিশোধমূলক আক্রমণের ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। এই সবকটি ক্ষেত্রে সঙ্কেত পাওয়া মাত্রই বোমারু বিমানের দল ডানা মেলেছিল ধ্বংসযাত্রার লক্ষ্যে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, কোনো আকস্মিক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় যুদ্ধ বাধবে না। খুব সম্ভবত উপরোক্ত ঘটনাগুলোর কথা তার জানা নেই। ইউনাইটেড নেশনস অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক ১৯৬১ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত নিরস্ত্রীকরণ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে আরও বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি অভিব্যক্ত হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে (পৃঃ ১৯), নিরস্ত্রীকরণ ব্যক্তিরেকে ভবিষ্যতে পৃথিবী বলে কিছু থাকবে কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ আছে। একটা আতঙ্ক আমাদের সর্বক্ষণ তাড়া করে বেড়ায়: তুষারশুভ্র উত্তর মেরুর আকাশ চিরে নিঃশব্দে উড়ে যাচ্ছে একদল বন্য রাজহাঁস এবং কোনো রাশিয়ান বা আমেরিকান রাডারের পর্দায় ছায়া পড়ছে তাদের। সেই উড়ন্ত রাজহাঁসদের ক্ষেপণাস্ত্র বলে ভুল করেছে রাডার। আমেরিকান অথবা রাশিয়ান সরকার (অর্থাৎ ভুলটা যাদের রাডার করবে তারা) তৎক্ষণাৎ প্রতিশোধমুলক পারমাণবিক আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। শুরু হচ্ছে পারমাণবিক যুদ্ধের তুফান। আকাশ চিরে উড়ে যাচ্ছে বিষণ্ণ এক ঝাঁক রাজহাঁস–শেষ বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর শেষ কয়েকটি জীবিত প্রাণী। এই ছবিটি অবাস্তব মনে হতে পারে, কিন্তু সম্ভাবনাটা আদৌ অসম্ভব নয়। এর মধ্যে বর্তমান মেকি শান্তির যাবতীয় যুদ্ধহীনতা ও অমানবিকতাটুকু অন্তত মূর্ত হয়ে উঠেছে। পারমাণবিক যুদ্ধের চূড়ান্ত যুক্তিহীনতার একটা প্রতীক দরকার। ওই রাজহাঁসের দলটিকেই সেই প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করা যাক। বহুদিন আগে জুপিটারের মন্দিরে রোমানদের সামনে ধ্বনিত হয়েছিল একদল রাজহাঁসের কান্না। তাদের সেই কান্নার মতোই বিপদের সঙ্কেত হয়ে থাকুক আজকের এই রাজহাঁসরা।

মনুষ্যকৃত ভুলের পাশাপাশি যান্ত্রিক ত্রুটি-বিচ্যুতির সম্ভাবনাও থেকেই যায়। বোমা সংক্রান্ত পুরো বিষয়টিতে রীতিমতো জটিল যান্ত্রিক কলাকৌশল ব্যবহৃত হয়।

ভুল সঙ্কেত পেয়ে বোমারু বিমানগুলো যাত্রা শুরু করার পর ফিরে আসার নির্দেশ পাঠালে সে নির্দেশ যে তাদের কাছে ঠিক সময়ে পৌঁছবেই, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। যদি না পৌঁছায়, মানবজাতির ধ্বংস হবে। এ ধরনের ঝুঁকির কি আদৌ কোনো ন্যায্যতা আছে?

তা সত্ত্বেও পশ্চিম ও পূর্বের আলোচকরা নিজেদের গদাই লশকরি চাল বজায় রেখে চলেছেন আর ভাবছেন-শত্রুকে সামান্য কিছু ছাড় দেওয়ার থেকে নিজেদের দেশের সমস্ত মানুষের মৃত্যুও কম দুর্ভাগ্যজনক। একে পাগলামির রাজনীতি ছাড়া কী-ই বা বলা যায়! যে কোনো তরফের আলোচকরা যদি সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন হতেন কিংবা ছোটখাটো ব্যাপারে আকণ্ঠ ডুবে না থাকতেন, তাহলে তাঁরা উপলব্ধি করতেন যে এইসব ভয়াবহ ফলাফলসম্পন্ন পারমাণবিক যুদ্ধের থেকে বড় কোনো বিপদ মানবজাতির সামনে আজ পর্যন্ত আসেনি। সেই সঙ্গেই তারা উপলব্ধি করতেন যে স্থিরচিত্ততা বা মানবিক অনুভূতির জন্য অথবা আমাদের নিজেদের, আমাদের সন্তানদের, বন্ধুদের এবং আমাদের গোটা দেশকে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য একমাত্র উপায় হলো ভিত্তিতে একটি যুক্তিসম্মত ঐকমত্যে পৌঁছানো। অহমিকা, ক্ষমতালিপ্সা আর অসংখ্য ভাওতাবাজিতে বিশ্বাসের দরুণ পূর্ব ও পশ্চিমের দেশনেতারা মানবতার প্রতি তাঁদের দায়িত্বের কথা বিস্মৃত হয়ে অবাধে মরণখেলা চালিয়ে যাচ্ছেন।

যে সব দেশের হাতে এখনও পারমাণবিক অস্ত্র নেই তারাও এ অস্ত্রের অধিকারী হয়ে উঠলে পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা যে অনেক বেড়ে যাবে, সে ব্যাপারে সকলেই একমত। প্রথমে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী ছিল একা। আমেরিকা, তারপর আমেরিকা আর রাশিয়া, তারপর আমেরিকা, রাশিয়া আর ব্রিটেন। খুব সম্ভবত ফ্রান্সও ইতিমধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ করে ফেলেছে। কিছুদিনের মধ্যে ইজরায়েলও হয়তো এ অস্ত্র বাণিয়ে ফেলবে, আর সেক্ষেত্রে সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। পরমাণু শক্তিধর দেশ হয়ে ওঠার ব্যাপারে কমিউনিস্ট চীনও খুব বেশিদিন পিছিয়ে থাকবে না। যেকোনো দুটি পরমাণু শক্তিধর দেশ কোনো কারণে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে মৈত্রীসূত্রে সারা পৃথিবীই তাতে জড়িয়ে পড়বে এবং বিশ্বযুদ্ধ নিশ্চিত হয়ে উঠবে। পরমাণু শক্তিধর দেশের সংখ্যা যত দ্রুত বাড়ছে, তার চেয়ে অনেক দ্রুত বেড়ে চলেছে সংঘর্ষ জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাসম্পন্ন পরমাণু শক্তিধর দেশযুগলের সংখ্যা। যখন মাত্র দুটি দেশ পরমাণু শক্তিধর ছিল, তখন এরকম দেশের সংখ্যাও ছিল। মাত্র এক জোড়া। যখন তিনটি দেশ পরমাণু শক্তিধর হয়ে উঠল, তখন এ রকম দেশের সংখ্যা দাঁড়াল তিন জোড়া। চারটি পরমাণু শক্তিধর দেশ মানে সংঘর্ষের সম্ভাবনা থাকছে ছজোড়া দেশের মধ্যে, পাঁচটি দেশ মানে পনেরো জোড়া ইত্যাদি। শুধুমাত্র এই কারণেই যে নতুন নতুন দেশের হাতে হাইড্রোজেন বোমা পৌঁছে যাওয়া বিপজ্জনক, তা নয়। কোনো কোনো দেশের সরকার একেবারে

বেপোরোয়া বা মতান্ধ অথবা উন্মাদ হতে পারে, সেই কারণেও নতুন নতুন দেশের হাতে হাইড্রোজেন বোমা পৌঁছে যাওয়া বিপজ্জনক। কিছুদনি আগেও একটি বৃহৎ শক্তির নিয়ন্তা ছিল একজন উন্মাদ। সে রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়া আদৌ অসম্ভব নয়। সিমুর মেলম্যান বলেছেন, এই মুহূর্তে বহু দেশই পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হয়ে উঠতে পারে বলে নিরস্ত্রীকরণ বিষয়ক পরিদর্শনের প্রায়োগিক সম্ভাব্যতার প্রশ্নটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মানব প্রজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার উপকরণগুলো পৌঁছে যাচ্ছে ছোট বড় বহু দেশের সরকারের হাতে (পৃঃ ৯)।

অস্ত্ৰপরীক্ষা মুলতবি রাখার ব্যাপারটা দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে, ফল আউট সারা পৃথিবী জুড়েই তেজস্ক্রিয় বিষ ছড়িয়ে দেয়। এর মধ্যে কয়েকটি নিউকেমিয়া ও ক্যানসার সৃষ্টি করে, অন্যগুলো জননতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং জড়বুদ্ধি বা বিকৃতাঙ্গ শিশুদের জন্মের পথ প্রশস্ত করে। অস্ত্র পরীক্ষা নিষিদ্ধ করার আর একটি কারণও আছে। এই কারণটি হলো অস্ত্র পরীক্ষা বন্ধ থাকলে যে সব দেশ এখনও পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকার হতে পারেনি তারা এ অস্ত্র তৈরি করতে যথেষ্ট সমস্যায় পড়বে। বেশ কিছু বছর ধরে আলাপ আলোচনা চলার পর সকলেই অনুভব করেছিলেন, অস্ত্র পরীক্ষা নিষিদ্ধ করার জন্য একটি চুক্তি সম্পাদনা করা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু ঠিক তখনই ক্রুশ্চেভ তার ত্রিপক্ষ (troika) প্রস্তাব হাজির করেছিলেন। এই প্রস্তাবের মর্মার্থ ছিল। পরিদর্শনের দায়িত্ব থাকবে তিন জনের ওপর, একজন পূর্বের, একজন পশ্চিমের অন্যজন কোনো নিরপেক্ষ দেশের। তাঁর বক্তব্য ছিল, সর্বসম্মত ঐকমত্যের ভিত্তিতেই কাজ করতে হবে এঁদের। সর্বসম্মত ঐকমত্যের ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত তিনি অটল থাকতেন কি না বলা মুশকিল, কিন্তু তার এই প্রস্তাবে পশ্চিমী দুনিয়া এতই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে যে অস্ত্রপরীক্ষা নিষিদ্ধ করার জন্য কোনো চুক্তি সম্পাদন অসম্ভব হয়ে পড়ে। অস্ত্রপরীক্ষা বন্ধ হওয়ার আশা এই মুহূর্তে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, কারণ আবার অস্ত্র পরীক্ষা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাশিয়া এবং তার অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকাও। নিরস্ত্রীকরণ সংক্রান্ত অন্য যাবতীয় বিষয়ের মতো এই ঘটনারও প্রায় নিশ্চিত ফল হলো–অদূর ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে কিছুই করে ওঠা যাবে না আর তার ফলে পারমাণবিক বিপর্যয়ের বিপদ দিন দিন বেড়েই চলবে।

নিষ্ক্রিয়তার বিষণ্ণ চিত্র থাক। আমরা বরং দেখার চেষ্টা করি মানবজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে কি কি করা দরকার।

প্রথম পদক্ষেপ হলো নতুন নতুন দেশের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র পৌঁছে যাওয়া বন্ধ করা। এই মূহুর্তের পরমাণু শক্তিধর দেশগুলো একমত হলে এ কাজটা অনায়াসেই সম্পন্ন করা যায়। শক্তিসাম্যের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে করার কোনো সঙ্গত কারণ নেই। কমিউনিস্ট চীন হাইড্রোজেন বোমার অধিকারী হয়ে উঠলে পরিতাপ করতে হবে পশ্চিমী দুনিয়াকে, ফ্রান্স আর। পশ্চিম জার্মানি হাইড্রোজেন বোমার অধিকারী হয়ে উঠলে পরিতাপ করতে হবে প্রাচ্যকে। কিন্তু কোনো বিশেষ পক্ষের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোই শুধু এ অস্ত্রের অধিকারী হতে পারবে এমনটা হওয়া একান্তই অসম্ভব, কাজেই এ অস্ত্র যাতে আর কারুরই হাতে না পৌঁছায় তার ব্যবস্থা করলে কোনো পক্ষেরই ক্ষতির সম্ভাবনা নেই।

পরবর্তী দুরূহ পদক্ষেপটি হলো, পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ বন্ধ করার জন্য একটি চুক্তি সম্পাদন করা। এর জন্য অবশ্যই পরিদর্শনের এক পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা থাকা দরকার আর সে ব্যবস্থাকে কার্যকরী ও নির্ভরযোগ্য করে তোলাও খুব একটা কঠিন নয়। পূর্বোক্ত ইনসপেকশন ফর ডিসআর্মামেন্ট গ্রন্থটির লেখকও। ঠিক এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছেন। আমার মতে (মেলম্যান অবশ্য তাঁর গ্রন্থে এ কথা বলেননি), পরিদর্শকদের মধ্যে নিরপেক্ষ দেশগুলোর প্রতিনিধিরাও থাকলে ভাল হয়। কোনো বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দিলে নিরপেক্ষ দেশের প্রতিনিধিরা সর্বসমক্ষে তাঁদের অভিমত ব্যক্ত করবেন।

পরিদর্শনের ব্যাপারে একটা সমস্যা দেখা দেবে মজুত অস্ত্র নিয়ে। মজুত অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রাখা খুবই সহজ এবং কোনো পরিদর্শনকারী দলের পক্ষে সেই লুকানো অস্ত্রভাণ্ডারের হদিশ পাওয়াও অসম্ভব। তবে এ সমস্যা সমাধানেরও উপায় আছে। শত্রুর এলাকায় নিক্ষেপ করার উপকরণ না-থাকলে হাইড্রোজেন বোমা কোনো কাজে লাগবে না আর তার জন্য প্রয়োজনীয় উৎক্ষেপন কেন্দ্রগুলো যতদিন এক একটি জায়গায় স্থায়ীভাবে থাকবে ততদিন তাদের হদিশ পেতেও কোনো অসুবিধে হবে না। পোলারিস ডুবোজাহাজের মতো চলমান উৎক্ষেপণ কেন্দ্রগুলোর ব্যাপারে অবশ্য এ কথা প্রযোজ্য নয়। হাইড্রোজেন বোমা বহনের উপযোগী ডুবোজাহাজ কোথাও নির্মাণ করা হয়েছে কি না, একটু চেষ্টা করলেই তা জানা যাবে।

সম্ভাব্য একটি সংস্কারের ব্যাপারে বিভিন্ন দেশকে রাজি করানো গেলে বিপুল সুফল পাওয়া যাবে। এই সংস্কারটি হল কোনো দেশের ভূখণ্ডে বিদেশি সেনাবাহিনীর উপস্থিতি নিষিদ্ধ করা। তবে সার্বজনীন নিরস্ত্রীকরণের ব্যবস্থা ছাড়া এ কাজ করা যাবে বলে মনে হয় না। ন্যাটো জোট মনে করে ব্রিটেনে আর পশ্চিম ইউরোপে আমেরিকান সেনাবাহিনীর উপস্থিতি একান্তই জরুরি (যদিও আমেরিকান কর্তৃপক্ষের যোগ্যতম ব্যক্তিরা তা মনে করেন না-দ্রষ্টব্য, কাহন অন থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়ার), আবার হাঙ্গেরি আর পূর্ব জার্মানির মতো দেশকে নিজের অধীনে রাখতে চাইলে রাশিয়াকেও ওইসব দেশে তার সেনাবাহিনী মোতায়েন রাখতে হবে। তথাপি শান্তি অর্জনের পথ পরিক্রমার সুদূর লক্ষ্য হিসেবে এই বিষয়টির কথা মাথায় রাখা দরকার। ভবিষ্যতে কখনও অবস্থা অনুকূল হলে এই লক্ষ্যটিও অর্জন করতে হবে আমাদের।

সর্বাঙ্গীন ও সার্বজনীন নিরস্ত্রীকরণের যে প্রস্তাব ক্রুশ্চেভ দিয়েছেন, পশ্চিমী দুনিয়া তাকে গুরুত্ব না দিলেও প্রস্তাবটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করা উচিত। এর আগেও রাশিয়ার বিভিন্ন প্রস্তাব সম্বন্ধে পশ্চিমী দুনিয়া যে আপত্তি তুলেছে, এক্ষেত্রেও তারই পুনরাবৃত্তি করে তারা বলেছে– পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিদর্শনের সুযোগ দিতে সম্মত হবে না সোভিয়েত সরকার। প্রথম ক্রুশ্চেভ বলেছিলেন–নিরস্ত্রীকরণের পর যে কোনো ধরনের পরিদর্শন মেনে নেবেন তিনি, কিন্তু তার আগে কিছুতেই নয়। তিনি খুব ভালো করেই জানতেন পশ্চিমী দুনিয়া এ প্রস্তাব মেনে নেবে না। পশ্চিমী দুনিয়া যদি নিজেদের নিরস্ত্রীকরণ সমাধান করে ফেলত এবং অনেক দেরিতে আবিষ্কার করত যে রাশিয়া সে পথে হাঁটেনি, তাহলে পরিদর্শকরা রাশিয়ায় গিয়ে যা কিছু দেখে আসতেন তা আর কোনো কাজে লাগত না। তবে ক্রুশ্চেভ এ-ও বলেছিলেন যে সর্বাঙ্গীণ ও সার্বজনীন নিরস্ত্রীকরণের সিদ্ধান্ত যদি গৃহীত হয়, তাহলে ঐকমত্যে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই যে কোনো ধরনের পরিদর্শন মেনে নেবেন তিনি। পরিদর্শনের ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত ঠিক কি কি মেনে নিতেন ক্রুশ্চেভ, তা জানার আকাঙ্ক্ষা পশ্চিমী দুনিয়ার ছিল না। প্রস্তাবটি যথেষ্ট আন্তরিক নয়–এই অজুহাতে ব্যাপারটা খারিজ করে দেয় তারা। নিরস্ত্রীকরণের ব্যাপারে পশ্চিমী দুনিয়ার সত্যিকারের আগ্রহ থাকলে এত বড় দুঃখজনক ভুলটা ঘটতে পারত না। ক্রুশ্চেভের প্রস্তাবটির যথার্থ্য যাচাই করার বদলে পশ্চিমী দেশগুলো তাদের নিজেদের প্রস্তাব হাজির করে, আর তার সাহায্যে উতোর-চাপানের এই নিষ্ফল প্রতিদ্বন্দ্বিতা জিইয়ে রাখে।

আর একটি বিষয়ও আগামী এক দশকের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছে। পৃথিবীর কক্ষপথে পরিক্রমণরত কৃত্রিম উপগ্রহগুলোর কথাই বলছি আমি। এই উপগ্রহগুলো মাঝেমাঝে শত্রুর ভূখণ্ডের ওপর দিয়েও ছুটে যাবে এবং অনেক উঁচু থেকে শত্রুর ভূখণ্ডে বোমা নিক্ষেপ করতেও সক্ষম হবে। উপগ্রহগুলো ভূ-পৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে থাকলে তাদের ওপর পাল্টা আঘাত হানা যাবে না, নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে অনায়াসেই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়ে দিতে পারবে তারা। এই আতঙ্কজনক পরিস্থিতিকে প্রতিহত করার কোনো ব্যবস্থা না করা হলে কিছুদিনের মধ্যেই এইসব কৃত্রিম উপগ্রহে ছেয়ে যাবে মহাশূন্য এবং নিচের দেশগুলোর ওপর নেমে আসবে মৃত্যু আর ধ্বংসের স্রোত। সেই অবস্থাটা এখনও দেখা দেয়নি, অতএব এখনও চেষ্টা করলে সেই সম্ভাবনাকে ঠেকানো যেতে পারে। এমন এক চুক্তি সম্পাদন করা যেতে পারে যাতে করে পৃথিবীর কক্ষপথে বা তার থেকে দূরতর অঞ্চলে উপগ্রহ পাঠানোর ব্যাপারটা কোনো দেশ অথবা জোটের হাতে থাকবে না, থাকবে আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে। এ বিষয়ে এই মুহূর্তে আমেরিকার থেকে রাশিয়াই বেশি দক্ষ হয়ে উঠেছে বলে রাশিয়ার আত্মবিশ্বাস এবং আমেরিকার আহত অহমিকা পারস্পরিক বোঝাঁপড়ার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। আমরা আশা করি কিছুদিনের মধ্যেই রাশিয়া আর আমেরিকা এ ব্যাপারে সমকক্ষ হয়ে উঠবে। রাশিয়ার বর্তমান শ্রেষ্ঠত্ব এক দুঃখজনক ঘটনা, তবে সেটা রাশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব বলে দুঃখজনক নয়, ঐকমত্যের প্রতিবন্ধক বলে দুঃখজনক। আমেরিকা এই শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হলে সেটাও একইরকম দুঃখজনক হত।

বর্তমান শতাব্দী শেষ হওয়ার আগে পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপিত কৃত্রিম উপগ্রহগুলো বাদে আরও কিছু দেখতে হবে আমাদের। প্রথমে চাদে, তারপর মঙ্গলে ও শুক্রে মানুষের অবতরণও বাস্তব হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়। কথাগুলো হয়তো আজগুলো কল্পনার মতো শোনাচ্ছে, কিন্তু বাস্তব সত্যটা হল– আমেরিকার সামরিক কর্তৃপক্ষ এবং খুব সম্ভবত রাশিয়ার সামরিক কর্তৃপক্ষও এই সম্ভাবনাগুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করছেন। জনৈক বিশিষ্ট সামরিক অধিকর্তাকে যখন প্রশ্ন করা হয় রাশিয়ানরা আগে চাদে পৌঁছে গেলে কি হবে, তখন তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন-ওটা কোনো ব্যাপার নয়, রাশিয়া চাঁদে পৌঁছে গেলে আমেরিকাও মঙ্গল আর শুক্রে পৌঁছে যাবে। অদূর ভবিষ্যতের এইসব সম্ভাবনার কথা মাথায় রাখা দরকার বলে মনে করি আমি। যে পৃথিবীতে আজ আমরা বাস করছি, ১৯৪৫ সালের আগে সে এই পৃথিবীর কথা ভাবাও আতঙ্কজনক ছিল। আজ থেকে আরও ষোল বছর পর, যদি তখনও আমরা বেঁচে থাকি, ১৯৬১ সালের এই পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে হয়তো আমাদের মনে হবে– যে পৃথিবীতে আজ আমরা বাস করছি তার তুলনায় সেই পৃথিবী ছিল সুখের স্বর্গরাজ্য।

কোথায় চলেছি আমরা? ভাবতে গেলে চিত্রটা এ রকম দাঁড়ায়: রাশিয়া আর আমেরিকার যুযুধান বাহিনী বিপুল অর্থব্যয় করে ছুটে চলেছে চাঁদের দিকে, সেখানে পৌঁছে কয়েকদিন ধরে পরস্পরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তারা, খুঁজে পাওয়ার পর একে অপরকে ধ্বংস করে দিচ্ছে আর পৃথিবীতে বসে পরস্পরের ধ্বংসের খবর শুনে সেই গৌরবময় বিজয় উদ্যাপনের জন্য সরকারি ছুটি ঘোষণা করছে উভয় পক্ষই। এই ধরনের হাস্যকর মহাজাগতিক পরিণতির দিকেই আমাদের টেনে চলেছেন পৃথিবীর রাজনীতিবিদরা। কল্পনায় মহাশূন্যে বিচরণ করার সময় কখনও হয়তো বাস্তববুদ্ধির অথবা মানবিকতার এক-আধটা টুকরো তাঁদের চিন্তায় ছায়া ফেলে যাবে।

তখন হয়তো তাঁরা একমত হবেন যে আমাদের জাগতিক বিবাদ-বিসম্বাদ মহাবিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে অন্য কোনো সুখি সুন্দর গ্রহের প্রাণীদের কাছে আমাদের মূর্খতা আর নষ্টামির প্রমাণ পেশ করা উচিত নয়।

এই বিষণ্ণ অধ্যায়ের শেষে আমরা বলতে পারি: এই পারস্পরিক ঘৃণা, ধ্বংসাস্ত্র নির্মাণের জন্য সময়-অর্থ-মননের এই বিপুল অপচয়, এই পারস্পরিক ভীতি এবং মানুষের এতদিনের অর্জিত সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার এই প্রতিদিন প্রতিঘন্টার আশঙ্কা–এটা ভাগ্যের বিধান নয়, এর সবকিছুই মানুষের মূর্খতাপ্রসূত। প্রাকৃতিক অবস্থা থেকে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। এ পাপ উঠে এসেছে মানুষের মনের গভীর থেকে, যার উৎস নিহিত আছে অতীতের নিষ্ঠুরতা আর কুসংস্কাররের গহনে। সুদূর অতীতের বন্য গোষ্ঠীগুলোর পক্ষে সেই নিষ্ঠুরতা আর কুসংস্কার হয়তো স্বাভাবিকই ছিল, কিন্তু আজকের যুগে তা ধ্বংস করে দেবে আমাদের যাবতীয় সুখকে, তারপর, খুব সম্ভবত, যাবতীয় জীবনকেও। এই নরককে স্বর্গে পরিণত করার জন্য একটি মাত্র পদক্ষেপই যথেষ্ট: পূর্ব আর পশ্চিম উভয় পক্ষকে পারস্পরিক ঘৃণা আর ভীতি ত্যাগ করতে হবে এবং বুঝতে হবে মিলেমিশে কাজ করতে সম্মত হলে কি বিপুল সুখশান্তির অধিকারী হতে পারে তারা। অশুভের উৎস নিহিত আছে আমাদের অন্তরের গভীরে, অন্তরের সেই অন্তঃস্থল থেকেই উপড়ে ফেলতে হবে তাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *