নিরলঙ্কার

নিরলঙ্কার

একটি লোকের কাছে আমি নানাদিক দিয়ে কৃতজ্ঞ ছিলুম। মাসাধিক কাল আমি যখন টাইফয়েডে অজ্ঞান, সে তখন আমার সেবা করে বাঁচিয়ে তোলে। ভালো করেছে কি মন্দ করেছে, সে অবশ্য অন্য কথা। আর শুধু আমিই না, আমাদের পার্ক সার্কাস পাড়ার বিস্তর লোক তার কাছে নানান দিক দিয়ে ঋণী। মাঝারি রকমের পাস-টাস দিয়েছে পরীক্ষার ঠিক আগে তার জোর চাহিদা। বেশ দু পয়সা কামায়– ধার চাইতে হলে ও-ই ফার্স্ট চইস। আর বললুম তো, রুগীর সেবায় ঝানু নার্সকে হার মানায়।

তার যে কেন হঠাৎ শখ গেল সাহিত্যিক হবার বোঝা কঠিন।

একটা ফার্স লিখেছে। তার বিষয়বস্তু : ধনী ব্যবসায়ী তার ম্যানেজারের ওপর ভার দিয়েছে, কলেজ-পাস মেয়ের জন্য বিজ্ঞাপন দিয়ে ইন্টারভ নিয়ে বর বাছাই করতে। নাটকের আরম্ভ ইন্টারভ্য দিয়ে। কেউ কবি, কেউ গবিতা লিখে গবি, কেউ ফিলিম স্টার আরও কত কী?

পড়ে আমার কান্না পেল। দুই কারণে। অত্যন্ত প্রিয়জনের নিষ্ফল প্রচেষ্টা দেখলে যেরকম কান্না পায়, এবং দ্বিতীয়ত ওই কথাটি ওকে বলি কী প্রকারে? ওটা কিছুই হয়নি, ওকে বলতে গেলে আমার মাথা কাটা যাবে। শেষটায় মাথা নিচু করে ঘাড় চূলকে বললুম, বুঝলে মামা, আমি ফার্স-টার্স বিশেষ পড়িনি, দেখিনি আদপেই অথচ এ-সব জিনিস স্টেজে দেখার এবং শোনার।

মামা সদানন্দ পুরুষ। একগাল হেসে বললে, যা বলেছিস। আমি ঠিক তাই ভাবছিলুম।

সোয়াস্তির নিশ্বাস ফেললুম।

ওমা, কোথায় কী। হঠাৎ পাড়ার চায়ের দোকানে শুনি মামার ফার্স ট্যাংরা না বেনেপুকুরে কোথায় যেন রিহার্সেল হচ্ছে। সর্বনাশ। বলি, ও চাটুয্যে, এখন উপায়?

সোমেন যদিও নিকষ্যি, তবু কথা কয় কলকাতার খাস বাসিন্দা বনেদি সোনার বেনেদের মতো। অর্থাৎ আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহারে হুতোম আলালকে আড়াই লেন্থ পিছনে ফেলে। দাঁতের মাড়ি পর্যন্ত বের করে বললে, উপায় নদারদ। দেখি নসিবে কী কী গর্দিশ আছে?

তার পর মামা একদিন ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকে ফার্স-অভিনয়ের লগ্ন রাঁদেভু বাতলে গেলেন। ট্যাংরা, গোবরায় নয়! রাজাবাজারের কোনও এক গলির ভিতরে।

চাটুয্যের বাড়ি মসজিদবাড়ি স্ট্রিটে। ওখানে কখনও যাইনি। ভাবলুম, সেদিন ওখানেই আশ্রয় নেব। মামা সময় পেলেও আমাকে খুঁজে পাবে না।

চাটুয্যে তো আমাকে দেখে অবাক। ব্যাপার শুনে বললে, তা আপনি চা পাঁপর খান। আমাকে তো যেতেই হবে। চাটুয্যে চাণক্যের সেই আইডিয়াল বান্ধব–রাজদ্বারে শ্মশানে ইত্যাদি। আর এটা যে মামার ফুরেল সে বিষয়ে আমার মনে কোনও সন্দ ছিল না।

ঘণ্টা দুই দাঁত কিড়মিড়ি দিয়ে বার বার রাজাবাজারের দৃশ্যটা মনক্ষু থেকে তাড়াবার চেষ্টা করলুম। কিছুতেই কিছু হয় না। কোথাকার কে এক কবি বলেছে, সদ্য লাঞ্ছিতজন যেরকম বার বার চেষ্টা করেও অপমানের কটুবাক্য মন থেকে সরাতে পারে না।

এমন সময় চাটুয্যে এক ঢাউস প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে উপস্থিত। তার সর্বাঙ্গ থেকে উত্তেজনা ঠিকরে পড়ছে। মুখে শুধু এলাহি ব্যাপার, পেল্লায় কাণ্ড। বুঝলুম, মামাকে উদ্ধারে সত্ত্বার্যে, কিংবা নিমতলার সকারে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু চাটুয্যে ঢাউস গাড়ি পেল কোথায় পায় তো কুল্লে পঞ্চাশ টাকা, খাদি প্রতিষ্ঠানে।

গলির বাইরে থেকে শুনতে পেলুম তুমুল অট্টরব। বুঝলুম, গর্দিশ পেল্লায়।

ওমা, এ কী? কোথায় না দেখব, মামা লিনচট হচ্ছে– দেখি, হাজার দুই লোক হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে, হেথা হোথা কেউ কেউ পেটে খিল ধরেছে বলে ডান দিকে চেপে ধরে কাতরাচ্ছে, আরেক দঙ্গল লোক হাসতে হাসতে মুখ বিকৃত করে কাঁদছে। সে এক ম্যাস হিস্টিরিয়ার হাসির শেয়ারবাজার কিংবা এবং রেসের মাঠ। ইস্তেক চাটুয্যে হেঁড়ে গলায় চেঁচাচ্ছে চাক্কু মারছে, চাক্কু মাইরা দিছে!

ইতোমধ্যে ফার্স শেষ হয়েছে। মামাকে স্টেজে দাঁড় করানো হয়েছে। মামা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, এ সম্মান সম্পূর্ণ আমার প্রাপ্য নয়। বস্তুত সবটাই পাবেন, সুসাহিত্যিক আকাঁদেমি কর্তৃক সম্মানিত শ্ৰীযুত গজেন্দ্রশঙ্কর সান্যাল। একমাত্র তাঁরই পরামর্শে আমি এটা স্টেজ করি। পাড়ার আর সবাই বলছিল, এটা সাপ ব্যাঙ কিছুই হয়নি।

বুঝতেই পারছেন, আমার নাম গজা সান্যাল। তখন আরেক ধুন্দুমার। আমার গলা জিরাফের মতো হলেও অত মালার স্থান হত না। নিতান্ত রঙ্গদর্শী গৌরকিশোর সেখানে সেদিন উপস্থিত বুদ্ধি খাঁটিয়ে আমাকে সময়মতো না সরালে, বঙ্গীয় পাঠকমণ্ডলী উল্লিখিত কলকাতার কাছেই কবির মহাপ্রস্থান, বই থেকে বঞ্চিত হত।

বাড়ি ফেরার পরও আমার মাথা তাজ্জিম মাজ্জিম করছিল। নল ছেড়ে দিয়ে তলায় মাথা রেখে মনে মনে বললুম, অয়ি বাগেশ্বরী, তোমার সৃষ্টিরহস্য আমাকে একটু বুঝিয়ে বল তো। মামার ওই ফার্স পড়ে এ-পাড়ার সক্কলের তো কান্না পেয়েছিল। তবে কি পাড়ার মেধো ও-পাড়ার মধুসূদন?

বিস্তর অলঙ্কারশাস্ত্র পড়ে আমার মনে একটা আত্মম্ভরিতা হয়েছিল, আমি বলতে পারি কোন রচনা রসোত্তীর্ণ হয়েছে, কোনটা হয়নি। এখন দেখি ভুল।

ভারত, বামন, ক্রোচে, বেৰ্গসো, তাহা হোসেন, আবু সঈদ আইয়ুব সবাইকে পরের দিন বস্তা বেঁধে শিশি-বোতলওলার বাড়িতে পাঠিয়ে দিলুম।  

আমি জানি, আমার পাঠকমণ্ডলী অসহিষ্ণু হয়ে বলবেন, তোমার যেমন বুদ্ধি! পার্ক সার্কাসের রদ্দি বই পেল রাজাবাজারের সম্মান। আর তুমি তাই করলে বামন ভামহকে প্রত্যাখ্যান! জৈসকে তৈসন, শুঁটকিসে বৈগন- যার সঙ্গে যার মেলে– শুঁটকির সঙ্গে বেগুনই তো চলে। রাজাবাজার পার্ক সার্কাসে গলাগলি হবে না?

কথাটা ঠিক। ফারসিতেও বলে,

স্বজাতির সনে স্বজাতি উড়িবে মিলিত হয়ে
পায়রার সাথে পায়রা শিকরে শিকরে লয়ে?
The same with same shall take its flight,
The dove with dove and kite with kite.
কুনদ হম্‌-জিনস ব হম-জিন্স্ পরওয়াজ
কবুতর ব কবুতর বাজ ব বাজ।

এসব অতিশয় খাঁটি কথা। কিন্তু প্রশ্ন, শেক্সপিয়র মলিয়ের জনসাধারণের রাজা-উজির গুণীজ্ঞানীর কথা হচ্ছে না– চিত্ত জয় করেছিলেন যে রস দিয়ে সেটি কি খুব উচ্চাঙ্গের রস? মাঝে মাঝে তো রীতিমতো অশ্লীল। এবং শেকসপিয়র যে আজও খাতির পাচ্ছেন তার কারণ জনসাধারণ তিনশো বছর ওঁর নাটক দেখত চেয়ে চেয়ে ওগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছিল বলে। শুধুমাত্র গুণীজ্ঞানীর কদর পেলে ওঁর নাট্য আজ পাওয়া যেত লাইব্রেরির টপ শেফে– সেটা উচ্চমান হলেও অপ্রয়োজনীয় বই-ই রাখা হয় সেখানে।

আরেকটা উদাহরণ দি : ওস্তাদ মরহুম ফৈয়াজ খানের শিষ্য শ্রীমান সন্তোষ রায়ের কাছে শোনা। রাস্তায় এক ভিখিরির গাইয়া গান শুনে ফৈয়াজ তাকে আদরযত্ন করে বাড়ি নিয়ে গিয়ে, তার সেই গাঁইয়া গানের এক অংশ শিখে নিয়ে তাকে গুরুদক্ষিণা দিয়ে বিদায় দিলেন। কয়েকদিন পরে সেই টুকরোটি তার অতিশয় উচ্চাঙ্গ ওস্তাদি গানে বেমালুম জুড়ে দিয়ে বড় বড় ওস্তাদের কাছে শাবাশি পেলেন–ওরকম ভয়ঙ্কর অরিজিনাল অলঙ্কার কেউ কখনও শোনেনি!

আরেকটি নিবেদন করি : মেজর জেনরল স্লিমান গেল শতাব্দীর গোড়ার দিকে একরাত্রি কাটান দিল্লি থেকে মাইল দশেক দূরের এক গ্রামে। রাত্রে শোনেন ইঁদারা থেকে বলদ দিয়ে জল তোলার সময় এক চাষা অন্য চাষাকে মিষ্টি টানা সুরে হুশিয়ার, খবরদার, সবুর বলছে। পরদিন সে-কথা এক ভারতীয় কর্মচারীর সামনে উল্লেখ করাতে সে বললে, তানসেন মাঝে মাঝে এখানে এসে এসব সুর শিখে নিয়ে আপন সৃষ্টিতে জুড়ে দিতেন।

মামার ফার্সটা চেয়ে নিয়ে আবার নতুন করে পড়লুম। নাঃ! আমি ফৈয়াজ নই, তানসেনও নই। এর কোনও বস্তুই আমার কোনও কাজে লাগে না। মামাকে দোষ দেওয়া বৃথা।

সমস্তটা ডাহা অনরিয়েল, কোনও প্রকারের বাস্তবতা নেই কোনওখানে।

তখন মনে পড়ল ওস্কার ওয়াইডের একটি গল্প। তিনি সেটি তার সখা এবং শিষ্য আঁদ্রে জিকে বলেছিলেন। তিনি সেটি ওয়াইল্ড সম্বন্ধে লেখা তার ইন মেমোরিয়াম, (সুনির), পুস্তকে উল্লেখ করেছেন। নিজের ভাষায় গল্পটা বলি– ও বই পাই কোথায়?

গ্রামের চাষাভূষোরা এক কবিকে খাওয়াত পরাত। কবির একমাত্র কাজ ছিল সন্ধের পর আড্ডাতে বসে গল্প বলা। চাষারা শুধোত কবি আজ কী দেখলে? আর কবি সুন্দর সুন্দর গল্প শোনাত। রোজ একই প্রশ্ন। একদিন যখন ওই শুধোলে, তখন, কবি বললে, আজ যা দেখেছি তা অপূর্ব। ওই পাশের বনটাতে গিয়েছিলুম বেড়াতে। বেজায় গরম। গাছতলায় যখন জিরোচ্ছি তখন ওমা, কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ দেখি, একটা গাছের ফোকর থেকে বেরিয়ে এল এক পরী। তার পর আরেকটি, তার পর আরেকটি, করে করে সাতটি। আর সর্বশেষে বেরুলেন রানি। মাথায় হীরের ফুলের তৈরি মুকুট, পাখনা দুটি চরকা-কাটা বুড়ির সুতো দিয়ে তৈরি। হাতে সোনার বাঁশি। সাতটি পরীর চক্করের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাজাতে লাগল সেই সোনার বাঁশি। তার পর নাচতে নাচতে তারা এগিয়ে চলল সাগরের দিকে। আমিও ঘাপটি মেরে পিছনে পিছনে। সেখানে গিয়ে এরা গান গেয়ে বাঁশি বাজিয়ে কাদের যেন ডাকলে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে এল সাত সমুদ্রকন্যা। সবুজ তাদের চুল তাই আঁচড়াচ্ছে সোনার চিরুনি দিয়ে। সন্ধ্যা অবধি, ভাই, তাদের গান শুনলুম, নাচ দেখলুম– তার পর তারা চাঁদের আলোয় মিলিয়ে গেল।

সবাই বললে, তোফা, খাসা, বেড়ে।

 কবি রোজই এরকম গল্প বলে।

একদিন হয়েছে কী, কবি গিয়েছে ওই বনে, আর সত্য সত্যই একটা গাছের ফোকর থেকে বেরলো সাতটি পরী, তারা নাচতে নাচতে গেল সমুদ্রপারে, সেখানে জল থেকে বেরিয়ে এল সমুদ্রকন্যা। কবি একদৃষ্টে দেখলে।

সেদিন সন্ধ্যায় চাষারা নিত্যিকার মতো শুধোলে, কবি, আজ কী দেখলে বল।

 কবি গম্ভীর কণ্ঠে বললে, কিচ্ছু দেখিনি।

অর্থ সরল। যে বস্তু মৃন্ময়রূপে চোখের সামনে ধরা দিল, সেটাকে নিয়ে কবি করবে কী? কবির ভুবন তো চিন্ময়, কল্পনার রাজ্য। বাস্তবে যে জিনিস দেখা হয়ে গেল তারই ঠাই কল্পনা রাজ্যে, কাব্যের জগতে আর কোথায়? চার চক্ষু মিলনের পর বধূকে আর কল্পনা কল্পনায় তিলোত্তমা বানিয়ে বেহেশতের হুরী-পরীর শামিল করা যায় না।

প্রকৃতির বিরুদ্ধে ওয়াইলডের আরেকটি ফরিয়াদ, সৃষ্টিতে আছে শুধু একঘেয়েমি। প্রকৃতি বিস্তর মেহন্নত করে যদি একটি ফুল ফোঁটায় (রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, তত লক্ষ বরষের তপস্যার ফলে/ ধরণীর তলে ফুটিয়াছে এ মাধবী,) তবে বার বার তারই পুনরাবৃত্তি করে অপিচ কবির সৃষ্টি নিরঙ্কুশ একক, সৃষ্টিকর্তারই মতো একমেবাদ্বিতীয়ম, এক জিনিস সে দু বার করে না, অন্যের নকল তো করেই না, নিজেরও কার্বনকপি হতে চায় না।

ওয়াইলডের বহুপূর্বে জর্মন কবি শিলার বলেছিলেন, প্রকৃতি প্রবেশ করা মাত্র কবি অন্তর্ধান করেন।

আর রবীন্দ্রনাথ এ সম্বন্ধে কী বলেছেন, সেকথা অন্যত্র বলার সুযোগ আমার হয়েছে। পুনরাবৃত্তির ভয় বাধ্য হয়ে বর্জন করে বলছি, তিনি প্রকৃতির সওগাত কদম ফুল দেখে বলেছেন, ওটা ঋতুস্থায়ী, আর আমার সৃষ্টি অজরামর,

আজ এনে দিলে হয়তো দেবে না কাল
 রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল
এ গান আমার শ্রাবণে শ্রাবণে
তব বিস্মৃতি স্রোতের প্রাবনে
ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে তরণী
বহি তব সম্মান।

এ আবার কীরকমের সম্মান!

প্রকতিকে সব কবি হেনস্তা করার বর্ণনা দেবার পর, আবার ক্ষণতরে ওয়াইলডে ফিরে যাই।

আচ্ছা মনে করুন, ওয়াইডের সেই গ্রাম্য কবি যদি চাষাদের একদিন বলত, আজ ভাই, আবার সেই বনে গিয়েছিলাম। দেখি গাছতলায় বসে এক পথিক তার সঙ্গীকে বলছে, সে তার পুরনো চাকরকে নিয়ে তীর্থ করতে যায়, সেখানে চাকরটা মারা যায়; তাই নিয়ে সে বিস্তর আপসা-আপসি করছিল।

চাষারা নিশ্চয়ই ঠোঁট বেঁকিয়ে বলত, এতে আবার বলার মতো কী আছে– এ তো আকছারই হচ্ছে।

কিন্তু মনে করুন, তখন যদি কবি, পুরাতন ভৃত্য কবিতাটি আবৃত্তি করত? বিষয়বস্তু উভয় ক্ষেত্রে একই।

কবিতাটিতে যে অতি উত্তম রসসৃষ্টি হয়েছে সে সম্বন্ধে এ-যাবৎ কেউ কখনও সন্দেহ করেনি।

অথচ ওয়াইলড বর্ণিত কবির পরী-সিন্ধুবালা অবাস্তব, পুরাতন ভৃত্যের বিষয়বস্তু অতিশয় বাস্তব। পুরাতন ভৃত্য মনে না ধরলে দেবতার গ্রাস নিন। সেটা তো অতিশয় বাস্তব আইন করে বন্ধ করতে হয়েছিল, পরীর নাচ বন্ধ করার জন্য আইন তৈরি হয় না।

তা হলে দাঁড়াল এই, বাস্তব হোক, কাল্পনিক হোক– প্রাকৃত হোক, অতিপ্রাকৃত হোক– যে-কোনও বিষয়বস্তু রসোত্তীর্ণ হতে পারে যদি–

এইখানেই আলঙ্কারিকদের ওয়াটারলু। কী সে জিনিস, কী সে যাদুর কাঠি, কী সে ভানুমতীর মন্ত্র যার পরশ পেয়ে পুরাতন ভৃত্য বনের পরী কাব্যরসাঙ্গনে একই তালে, একই লয়ে চটুল নৃত্য আরম্ভ করে? কিংবা বাস্তবে না নেচেও কাব্যেতে নাচা হয়ে যায়? যথা–

জোন বললে– চ্যাটার্জি, এই আনন্দের দিনে তুমি অমন গ্রাম হয়ে বসে থেক না, আমাদের নাচে যোগ দাও।

বললুম মাদার লক্ষ্মী, আমার কোমরে বাত। নাচতে কবিরাজের বারণ আছে।

 (শুনুন কথা! পৃথিবীর উপরে হাউ অন্ আর্থ-কবিরাজ কী করে কল্পনা করতে পারে যে, ষাট বছরের বুড়া গাইয়া চাটুয্যের বলড্যান্সের অভ্যাস আছে; আগে-ভাগে বারণ করে দিতে হবে)!

ভানুমতী বলে ভালোই করেছি। ম্যাজিকের জোরেই শরঙ্কালে আম ফলানো যায়। দীপক গেয়ে আগুন ধরানো যায়, মল্লার গেয়ে বৃষ্টি নামানো যায়। কিন্তু সত্য সঙ্গীতজ্ঞ নাকি তাতে কণামাত্র বিচলিত না হয়ে বলেন, তার চেয়ে ঢের বেশি সার্থক হবে সঙ্গীত যদি সদ্য-বিধবাকে সান্ত্বনা দিতে পারে, স্বাধিকারপ্রমত্তকে শান্ত করতে পারে। এবং কিছু না করেও যে সার্থক সঙ্গীত হতে পারে সে তো জানা কথা।

আর্টে এই ম্যাজিক জিনিসটির সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ :

গাহিছে কাশীনাথ নবীন যুবা
ধ্বনিতে সভাগৃহ ঢাকি,
 কণ্ঠে খেলিতেছে সাতটি সুর
সাতটি যেন পোষা পাখি।
 শাণিত তরবারি গলাটি যেন,
নাচিয়া ফিরে দশদিকে,
 কখন কোথা যায় না পাই দিশা,
বিজুলি হেন ঝিকমিকে!
আপনি গড়ি তোলে বিপদজাল
আপনি কাটি দেয় তাহা।
 সভার লোকে শুনে অবাক মানে,
সঘনে বলে, বাহা বাহা ॥

এখানে বিশেষ করে লক্ষ করবার জিনিস, সভার লোকে বাহা বাহা বলছে, কেউ কিন্তু, আহা আহা বলেনি।

পার্থক্যটা কোথায়?

দড়ির উপর নাচ দেখে বলি বাঃ, জাদুকর যখন চিরতনের টেক্কাকে ইসকাপনের দুরি বানায় তখন বলি বা রে–কাশীনাথ যখন গানের টেকনিকাল স্কিল (ম্যাজিক) দেখায় তখন বলি, বাঃ, কিন্তু যখন কবি গান,

তোমার চরণে। আমার পরাণে,
লাগিবে প্রেমের ফাঁসি—

 তখন মনে হয়, যেন আমারই বিরহতপস্যা শ্রান্ত ভালে প্রিয়া তার আপন কণ্ঠের যুথীরমালে আমার সর্ব দহনদাহ ঘুচিয়ে দিলেন। চরম পরিতৃপ্তিতে হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে বেরিয়ে আসে, আ আহ।

আশ্চর্য হলে বলি বাঃ, পরিতৃপ্ত হলে আহ্। ম্যাজিকে বাব্বাবাব্বা আর্টে, আহাহা!

হ্যাঁ-কে না করা, না-কে হ্যাঁ করা কঠিন নয়, কিন্তু উভয়কে মধুরতম করাই আর্ট, সেইটি কঠিন, ওইটেই আলঙ্কারিকদের ওয়াটারলু। এবং সবচেয়ে কঠিন, মধুরকে মধুরতর করা। ফুল তত সুন্দর, তাকে সুন্দরতম করা যায় কী করে। স্বয়ং খৃস্ট বলেছেন, লিলিফুলকে তুলি দিয়ে রঙ মাখায় কে?

অথচ জাপানি শ্ৰমণ রিয়োকোয়ান রচলেন–

কি মধুর দেখি রেশমের গাছে
ফুটিয়াছে ফুলগুলি
কোমল পেলব করিল তাদের
ভোরের কুয়াশা তুলি।

কি সে ভোরের কুয়াশা তুলি যা সবকিছুকে মধুর মেদুর, কোমল পেলব করে দেয়? দৃষ্টান্ত দিই :

প্রাচ্য ভূখণ্ড হইতে পবন আসিয়া আমাকে দোদুল্যমান করাতে আমি মুগ্ধ হইয়া আ মরি, আ মরি বলিতেছি–

কবির তুলির পরশ পেয়ে হয়ে যায়; পূব হাওয়াতে দেয় দোলা মরি-মরি—

 আমি বললুম, সব বনে ছায়া ক্রমে ক্রমে ঘন হইতে ঘনতর হইতেছে—

 কবির তুলি লাগাতে হল, ছায়া ঘনাইছে বনে বনে।

কিংবা আমি বললুম, শুক্লপক্ষের পঞ্চদশী রাত্রে পথ দিয়া যাইবার সময় যখন চন্দ্রোদয় হইয়াছে, তখন তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হইয়াছিল; তাহাকে কি শুভ লগ্ন বলিব, জানি না।

যেতে যেতে পথে পূর্ণিমা রাতে
চাঁদ উঠেছিল গগনে।
 দেখা হয়েছিল তোমাতে আমাতে
কী জানি, কী মহা লগনে।

 পাঠক হয়তো বলবেন, তুমি বলেছ গদ্যে, সে যেন পায়ে চলা; আর কবি বলেছেন ছন্দে, সে যেন নাচা।

উত্তম প্রস্তাব। ছন্দে বলি,

পথিমধ্যে তোমার সঙ্গে
পূর্ণিমাতে দেখা
 বলব একে মহা লগন
ছিল ভালে লেখা।

 কবিতা হল, কিন্তু রসসৃষ্টি হল না।

আর নিখুঁত, নিটোল ছন্দ মিল হলেই যদি কবিতা হয় তবে নিচের কবিতাটি নোবেল প্রাইজ পাওয়ার কথা :

হর প্রতি প্রিয় ভাষে কন হৈমবতী
 বত্সরের ফলাফল কহ পশুপতি!
কোন গ্রহ রাজা হৈল কেবা মন্ত্রির
প্রকাশ করিয়া তাহা কহ দিগম্বর!

অলঙ্কারের দিক দিয়ে কবিতাটি দিগম্বরই বটে।

এই যে তুলি সবকিছু মধুময় করে তোলে, কী দিয়ে এ বস্তু তৈরি, কী করে এর ব্যবহার শিখতে হয়? এ কী সম্পূর্ণ বিধিদত্ত, না পরিশ্রম করে এর খানিকটে আয়ত্ত করা যায়?

ঘটিতে টোল দেখলে চট করে পাই, কিন্তু নিটোল ঘটি বানাই কী করে?

আর এই তো সেই তুলি সে যখন আপন মনে চলে তখন সে গীতিকাব্য লিরিক মেঘদূত। যখন ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাত চরিত্রের ক্রমবিকাশের ওপর এর ছোঁয়া লাগে সে তখন কাব্য- রঘুবংশ। যখন ধর্মকে ছুঁয়ে যায় সে তখন গীতা, কুরান, বাইবেল।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *