এক
আমি একটা বিয়ে করেছিলুম। একবারই। মনে মনে অনেকবার অনেককে করেছি। তারা অবশ্য কেউ জানে না। অনেকেই অন্যের বউ হয়ে আমার আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। একদম বুঝতেই পারে না, যে আমি তার বর। বরণ করে ঘরে তোলা হয়নি। একটা লোক কটা বিয়ে করতে পারে? সেকালের কুলীনরা আড়াইশো, তিনশো বিয়ে করত। সে যুগ আর নেই। এখন আইন খুব কড়া। প্রথম বউকে আইনমোতাবেক ছাড়তে হবে, তারপর আর একজনকে ধরতে হবে। আমার পরিচিত একজন, সে গোল হয়ে ঘোরে। বিশ্রীরকমের বড়োলোক। আর পয়সা ও ব্লাডসুগার সমগোত্রীয়। চেষ্টা করলেও কমতে চায় না। বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে। রক্তে চিনি আর বড়োলোকের ঝুলিতে টাকা; হু হু করে আসে।
আমি যার কথা বলছি, তার নাম চন্দন। আমরা একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি। বিকেলে গঙ্গার ধারে বসে আড্ডা মেরেছি। তখন কিন্তু বোঝাই যায়নি যে চন্দন এইরকম বিপুল বড়োলোক হয়ে যাবে। মানুষ অনেকটা গাছের বীজের মতো। কোনটার ভেতর কত বড়ো গাছ আছে প্রথমে বোঝাই যায় না। চারাগুলো সব খুদদুর, খুদদুর, তারপর কেউ হল বট, কেউ বাবলা।
স্কুলের বন্ধুরা হারিয়ে যায়। কলেজের বন্ধুরাও তাই। চন্দন কী করল কোথায় গেল জানি না। একদিন কাগজে ছবি দেখলুম। চেম্বার অফ কমার্সে বক্তৃতা দিচ্ছে। রোগা চন্দন বেশ গাবলুগুবলু। ঘ্যাম আদমি।
তখনই জানতে ইচ্ছে করল, সামান্য চন্দন কোন শিলে ঘষাঘষির পর এমন অসামান্য হয়ে গেল। যারা বড়ো হয় তাদের খবর পেতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। আমাদের বন্ধুমহলের একজন—সুমন তার চামচা হয়েছিল, গোমস্তাগিরি করত। চন্দনের ঢাকিও বলা চলে। ঢাক বাজাত। আমাদের পাড়াতেই থাকত। সদাব্যস্ত। অথচ কোনো জীবিকা নেই; কিন্তু নতুন বাড়ি, গাড়ি। হৃষ্টপুষ্ট বউ। ফুলুফুলু, ফুলকো লুচির মতো, নরমপাক সন্দেশের মতো তুলতুলে ঘি ঘি একটা ছেলে। বন্ধু কিন্তু বিয়েতে আমাদের বলেনি। দুর্জনে বলে, সেকেন্ড হ্যান্ড বউ। সম্বলপুর থেকে লটকে অথবা সটকে এনেছে। সে যা করে করুক, আমাদের জানার দরকার নেই। চন্দনের খবরটা পেলেই হল। সে এক আশ্চর্য কাহিনি। ইংরিজি কাগজে ছবি—টবি দিয়ে লিখেছিল, ‘ফ্রম র্যাগস টু রিচেস—স্টোরি অফ চন্দন বোস।’
চন্দন বিদেশে দেশি গাছগাছড়া রপ্তানি করে, গাঁদাল পাতা, কালমেঘ, নিমপাতা, কুলেখাড়া, কেশুত—এই সব। এখন সে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ। প্রচুর টাকা।
প্রথমে এক বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করেছিল। দু’বছর পরে তাকে ছেড়ে পাঞ্জাবিকে, তিন বছর পরে এক দক্ষিণীকে, দু’বছর পরে এক মারাঠিকে। আবার ফিরে গেছে সেই প্রথম বাঙালি মেয়েটির কাছে। দুটি ছেলে, একটি মেয়ে, কে যে কার হিসেব রাখা কঠিন। তবে বাবা একটা, মা চারটে, এই সুবিধে। মায়েরা যার যার সন্তান চিনে নেবেন। কে কোন ভাষায় কথা বললে? মায়ের থেকেই তো মাতৃভাষা!
আমরা এইসব গবেষণা করে দিন কাটাতুম আর চন্দন দিনকে দিন বড়োলোক হতে থাকল আর তার চামচা দিন দিন আমাদের চোখের সামনে হাতা হয়ে গেল। আমাদের তেমন আর পাত্তাই দিত না। আমেরিকা থেকে ঘুরে এসে আমাদের আর চিনতেই পারলে না। অন্যরকম সব লোকজন সদাসর্বদা তাকে ঘিরে থাকত। চামচারও অনেক চামচা জুটে গেল। দুনিয়াটা বহুত মজার।
এদিকে আমাদের পাড়া খালি হয়ে যাচ্ছে। যে কটি সুন্দরী ছিল একে একে শ্বশুরবাড়ি হাওয়া। বিয়ের নাম শুনলেই হল। বেনারসি, মুখে চন্দন, পিঁড়েতে বসল, পোঁ সানাই, ভোঁ গাড়ি। নিজের পাড়ার প্রতি, পাড়াতুত দাদাদের প্রতি কোনো কর্তব্যবোধ নেই।
গেল দুজন। পরের জামাইষষ্ঠীতে এল তিনজন। বুকের কাছে তোয়ালে মোড়া একটা প্যাকেট। এদিকে কচি কচি গোলাপি দুটো পা, ওদিকে বেরিয়ে আছে ছোট্ট টেনিস বলের মতো লাল একটা মাথা। প্লাস্টিকের ঝুড়ি ব্যাগে জলের বোতল, দুধের বোতল, পাট পাট করে কাঁথা।
আইবুড়ো বেলার মতো ফচকেমি নেই, ঢংঢাং নেই, কলকল করে কথা নেই। গম্ভীর, থমথমে মুখ। সামনাসামনি হয়ে গেলে একটাই কথা, কি কেমন ভালো তো! মাসিমা ভালো আছেন? আমার মাও নেই মাসিও নেই। এমন দায়সারা কথা না বললেই কি নয়। বিয়ের পর মেয়েদের এইরকম অধঃপতন দেখলে দুঃখ হয়। আর দু’বছর পরে ভোঁস ভোঁস করে ফুলে একটা মোষের মতো চেহারা হবে, তখন বিয়ের আগে তোলা ছবির চোখেও জল আসবে।
বাদলের বউদি আমাদের পাড়ার বউদি। ভেরি মাই ডিয়ার। ভীষণ খোলামেলা। মাঝে মাঝে বিয়ের রাতে তোলা ছবি দেখিয়ে বলে, একসময় কীরকম দেখতে ছিলুম দ্যাখো। ডিভাস্টেটিং। যে একবার তাকাত মাথা ঘুরে যেত।
বউদি এখনও সুন্দরী। মনটা সাদা বলে যৌবনটা পালায়নি। আমরা মাঝেমধ্যে আড্ডা মারতে যাই। আজকাল অধিকাংশ বাড়িতেই যেতে ইচ্ছে করে না। এত তাদের সমস্যা। সবচেয়ে বড়ো সমস্যা ছোটোদের লেখাপড়া! সে যে কি অশান্তি! যার মাথায় ঘিলু নেই, তাকেও স্টার পেতে হবে। তারপর, এই ব্যাঙ্কের ইন্টারেস্ট কমে গেল। ওই বিদ্যুতের দাম বেড়ে গেল। আড্ডা আর মারবে কে? অলওয়েজ ফাইট।
এর মধ্যে বাদলদের বাড়িটা একেবারে অন্যরকম। ভবিষ্যৎ নিয়ে, সঞ্চয় নিয়ে, সুদ নিয়ে, দাম বাড়া নিয়ে একদম ভাবে না। বাদলের দাদা, কমলদা দিলখোলা মানুষ। কমলদা বলে, দূর শালা! চলে গেলেই হল। ভবিষ্যৎ ভেবে বর্তমান নষ্ট করি কেন! দুই ভাইয়ে ভীষণ ভাব। রাম, লক্ষ্মণ নাম হওয়া উচিত ছিল। বউদির নাম সীতা হয়ে দরকার নেই। শ্রীরামচন্দ্র পাতাল প্রবেশ করিয়ে দিত। কেয়া নামটাই ভালো। বর্ষায় কেয়া ফুল।
কেয়া গাছ আজকাল আর দেখাই যায় না। তবু একটা বউদির গায়ে কেয়া নামটা লেগে আছে।
পাড়ায় আর একটি মেয়ে ছিল, ছায়া। উগ্র সুন্দরী। আমাদের সঙ্গে একটা—দুটো কথা বলত। তারপর হঠাৎ খুব স্মার্ট হয়ে গেল। বড়ো বড়ো চুল ছিল। হয়ে গেল বব ছাঁট। সাজপোশাক অন্যরকম হয়ে গেল। তারপর হঠাৎ বিয়ে করে ফেলল এক পাইলটকে। পাড়ায় ওরা একটু আপস্টার্ট ধরনের ছিল। পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া বাড়িটাও বেশ ভালো। পাড়ার বেস্ট বাড়ি। বাবা বিলেতফেরত ডাক্তার। মাঝে মাঝে দামি একটা গাড়ি চেপে বাপের বাড়িতে আসে। কারও দিকে তাকায় না। একবার আমার চোখে চোখ পড়েছিল। পরে ভুলটা বুঝলুম, ছায়ার চোখ আমার চোখে পড়েনি, আমার চোখ ছায়ার চোখে পড়েছিল, যে চোখ তাকিয়ে আছে বটে কিন্তু কিছু দেখছে না। ভেকান্ট লুক। অথচ এই ছায়াকে আমি আর প্রবীর বাঁচিয়েছিলুম। বেশ একটু বেশি রাতে কোথা থেকে ফিরছিল। দুটো রাস্তার কুকুর অকারণে তাড়া করেছিল। আমরা ইট—পাটকেল ছুড়ে কুকুর দুটোকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলুম। এত চালিয়াত মেয়ে একটা কথাও বললে না। যেন আমরা করপোরেশানের লোক। কুকুর তাড়াবার জন্যেই দাঁড়িয়ে আছি।
প্রবীর আস্তে আমার পিঠে একটা চাপড় মেরে বললে, ‘অবাক হওয়ার কিছু নেই বস, মেয়েরা এইরকমই। দুখীর দোকান এইবার বন্ধ হয়ে যাবে, চলো, রাতের ডিনারটা সেরে আসি।’
আমার কেউ নেই। প্রবীরের সব থেকেও কিছু নেই। বনেদি বাড়ির ছেলে। বাবা দুবার বিয়ে করেছিলেন। প্রথম পক্ষে একটিই ছেলে, প্রবীর। সৎমায়ের তিনটি। তিনটিই মাস্তান। পাড়ায় তাদের নাম, ডম ডম ডিগা ডিগা। ছোটোটার বাঁ হাতের মুঠোর দিকটা নেই। বোম বার্স্ট করেছিল। হাতের টুকরোটা পরের দিন পাওয়া গেল বস্তিবাড়ির টিনের চাল থেকে। একটা চালকুমড়োয় হাত বোলাচ্ছিল। এতে তার দুঃখ নেই, বরং বীরত্ব আরও বেড়ে গেছে। প্রবীরের বাবা যদ্দিন ছিলেন বাড়িতে প্রবীরের একটু স্থান ছিল। বাবা ফট, প্রবীরও ফট। এটা প্রবীরেরই কথা।
যাই হোক, প্রবীর পোস্টাপিসে একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়েছে। রাত্তির বেলা আমরা দুজনে দুখীর ফাইভস্টারে ডিনার সারি। চারখানা মোটা আধকাঁচা রুটি। ভীষণ ঝাল, তেল গরগরে একটা তরকারি। প্রবীরের থিয়োরি, ঝাল খেলে ‘মেমারি’ খুলে যায়। পূর্বজন্মের কথা স্মরণে আসে। প্রবীর পূর্বজন্মে ভিখিরি ছিল। ট্রেনে খোলামকুচি বাজিয়ে গান গাইত। রাতে শ্মশানের ধারে একটা শিবমন্দিরে শুত। সামনের বেলগাছে এক ব্রহ্মদৈত্য ছিল। প্রতি শনিবারে সারারাত তাঁকে গান শোনাতে হত। কখনো কখনো ষাঁড়ের পিঠে চেপে স্বয়ং শিবঠাকুর এসে হাজির হতেন। বেলতলায় ষাঁড়টাকে পার্ক করে তিনি আসরে বসতেন বাঘছাল বিছিয়ে। তখন ধ্রুপদ গাইতে হত। আর ব্রহ্মদৈত্য প্রভুর পদসেবা করতে করতে একই প্রশ্ন বারেবারে—বাবা! আর কবে উদ্ধার পাব!
শিব বলেছিলেন, বেশ আছো। জন্মালে গলায় দড়ি দিয়ে মরতে হবে। তখন ভূত হয়ে শ্যাওড়া গাছে দোল খাবে। পেতনিরা এসে বিয়ে করার জন্যে ডিসটার্ব করবে।
ব্রহ্মদৈত্য প্রশ্ন করলে, বাবা! গলায় দড়ি কেন দোবো?
শিব বললেন, মাধ্যমিকে বেরোলেও উচ্চমাধ্যমিকে ধেড়াবে। তখন হয় তোমার মা গলায় দড়ি দেবে, না হয় তুমি। যদ্দিন পারো এইভাবেই থাকো। মানুষের বাজারে কোনো চাকরি নেই। আমাকে সারা দুনিয়া ঘুরতে হয়। আমার ক্যাপিটালে যারা আমার মাথায় মণ মণ দুধ ঢালতে আসে বেশিরভাগই দু’নম্বর, টাকা—ঝাড়া পার্টি। সব ডিগবাজি খাচ্ছে। রামচন্দ্র রাজনীতির পাল্লায় পড়ে খবরের কাগজে বেধড়ক গাল খাচ্ছে। আমাদের হিরোইন দুর্গা ব্যবসাদারদের পাল্লায় পড়ে ‘প্যান্ডেল মাতা’। আবার প্রতিযোগিতা! এই একদল এক্সপার্ট এল তো, ওই আর একদল। গম্ভীর মুখে প্যান্ডেল দেখছে, প্রতিমা দেখছে, ম্যানেজমেন্ট দেখছে, আলোকসজ্জা দেখছে। কত রকমের কম্পানি। গয়নাঅলা, রঙঅলা, কসমেটিকঅলা।
‘মা দুর্গা আসেন কেন? না এলেই পারেন। কৈলাসে থাকলেই হয়। কোনোবার দোলায় আসছেন। কোনোবার ঘোড়ায়, নৌকায়, গজে, অশ্বে।’
‘ওরে ব্রহ্মদত্যি! না এসে উপায় আছে! পটুয়ারা মূর্তি তৈরি করবে। বারোয়ারির বাবুরা নিয়ে গিয়ে প্যান্ডেলে খাড়া করে দেবে, পুরোহিত প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে দেবে, তেড়ে হিন্দি গান বাজবে। ব্যস, মা দুর্গা অমনি বাটনা বাটা, কুটনো কোটার মতো অসুর কাটতে বসবেন। এই দ্যাখো না, এরা এখানে কবে একটা শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছিল, আমাকে সেই কৈলাস থেকে তেল পুড়িয়ে আসতে হয়। ব্রহ্মা এত কষ্ট করে একটা বাগান তৈরি করেছেন, মাঝেমধ্যে না এলে বেদখল হয়ে যাবে।’
দুখী বললে, ‘গাঁজাখুরি গল্প না করে খেয়ে দেয়ে বাড়িতে গিয়ে শুয়ে পড় না। আজ ‘তড়কা’ করেছি। মালটা যা নেমেছে না, আঁরে তেড়দেনি।’
প্রবীর বললে, ‘জানো! মেয়েরা খুব অকৃতজ্ঞ হয়।’
‘ছেলেরাও কিছু কম যায় না। আমাকেই দ্যাখো না, আমার একটা প্রেম ছিল।’
‘তা বিয়ে করলে না কেন?
‘শালা, নিজেরই ভাত জোটে না, তার আবার বিয়ে!’
‘তখন?’
‘বললুম ডার্লিং অপেক্ষা করো।’
‘তারপর?’
‘বুড়ো হয়ে গেলুম।’
‘সে?’
‘বুড়ি হয়ে গেল। এপারে আমি, গঙ্গার ওপারে সে।’
‘দেখা হয় না?’
‘কবিতা লিখি। তিন খাতা হয়ে গেল। মরার সময় ক্যুরিয়ার সার্ভিসে পাঠিয়ে দেবো।’
রাত বাড়ছে জোয়ারের জলের মতো। সাতটা নাগাদ পাড়ায় ঢুকেছি। দেখতে দেখতে এগারোটা। একালের কোয়ার্জ ঘড়ি, সেকালের পেন্ডুলাম ঘড়ির মতো টক টক আওয়াজ করে না। শুধু খিচ খিচ।
প্রবীর জিজ্ঞেস করলে, ‘তুমি কী করে প্রেমে পড়লে? তোমার চেহারাটা অবশ্য সুন্দর, রোমান্টিক।’
‘তোমরা তো হিন্দি সিনেমার প্রেম দ্যাখো। ভালো পোশাক, লম্বা চুল, নাচাগানা। প্রেম করার জন্যে কাশ্মীর যেতে হবে। কুলুমানালি, সুইজারল্যান্ড। পাইস হোটেলের একটা লোকের জীবনে প্রেম আসতে পারে না, তাই তো? পুকুরপাড়েও প্রেম হয়!’
হুড়মুড় করে এক ভদ্রলোক দোকানে এসে ঢুকলেন। কপালের একটা পাশ কেটে গেছে, রক্ত গড়াচ্ছে। তিনি বিপরীত দিকের বেঞ্চিতে বসলেন। মুখে কোনো কথা নেই।
দুখীরা ব্যস্ত—সমস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল যোগেশদা? এত রাতে কপালটা কাটলেন কী করে?’
‘তোমার কাছে কিছু আছে? রক্ত বন্ধ হচ্ছে না।’
দুখীরা একটা টিউব বের করল। দূর থেকে দেখেই বুঝলুম পোড়ার ওষুধ। খুব যত্ন করে ভদ্রলোকের কপালে লাগাতে লাগাতে মৃদু গলায় বলল, ‘থেঁতলে গেছে।’
‘ফেটেও যেতে পারত। ছোটো স্টিলের গেলাস। অল্পের ওপর দিয়ে গেল।’
‘আবার বেড়েছে?’
‘এই তো বাড়ের সময়। বসন্ত গিয়ে গ্রীষ্ম আসছে।’
‘কার কাছে রেখে এলেন?’
‘আমাদের তো একজনই আছে ভাই, ভগবান। তোমার এখানে কিছু কি আছে এখনও?’
‘আপনার জন্যে সবসময় আছে। আমি আমার জন্যে ভাত, ডাল, আলুভাতে, ঢেঁড়শের তরকারি করে রেখেছি। দুজনে সপাসপ মেরে দোবো।’
আমাদের পাড়ার এই যোগেশবাবুর জীবন বড়ো অদ্ভুত। জমিদারের ছেলে। সুশিক্ষিত। বিজ্ঞানী। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া কোথায় না গেছেন। তিন—চার বছর বয়সের সময় বাবা মারা গেলেন। মা আর ছেলে। পেল্লায় এক বাড়ি। এ—পাশ ও—পাশ ভেঙে ভেঙে পড়ছে। বটের ঝুরি ডাইনির জটার মতো ঝুলছে।
মা ছেলেটিকে বুকে করে মানুষ করলেন। নিজে পছন্দ করে অতি সুন্দরী শিক্ষিতা একটি মেয়েকে পুত্রবধূ করে নিয়ে এলেন। এইবার শুরু হল খেলা। মা বললেন, ‘রাতে আমরা তিনজনে একই বিছানায় শোবো। মাঝখানে আমি, তোমরা দুজন দু’পাশে।’
এই আবদার একটি বড়ো ঘরের শিক্ষিতা মেয়ে কতদিন সহ্য করবে! বছর না ঘুরতেই বাপের বাড়ি ফিরে গেল, ‘তুমি তোমার মাকে নিয়ে থাকো ভাই, আমি চললুম। খুব শিক্ষা হল আমার।’
যোগেশবাবু সেই থেকে মাকে নিয়েই আছেন। মায়ের সেবা। ধীরে ধীরে, একটু করে মা—টি পাগল হতে থাকলেন। আছেন আছেন, বেশ আছেন, হঠাৎ উগ্রমূর্তি। হাতের কাছে যা পাবেন ছুড়ে ছুড়ে মারবেন। তখন ছেলে যোগেশের মধ্যে নিজের স্বামীকে দেখতে পাবেন। অতীতের যত ক্ষোভ উন্মাদিনী উগরে দিতে থাকবেন নিজের ছেলেকে। এসব কথা আমরা দুখীদার কাছে জেনেছি।
এই পাড়ায় আমাদের এই টিমটা—আমি, প্রবীর আর দুখীরা—সবচেয়ে ভালো। রাত্তির বেলা, একটু বেশি রাতে, রোজই আমাদের মজলিশ বসে। তখন কত কী যে বেরিয়ে পড়ে।
আজকে খাবার আয়োজনটা বেশ জমপেশ। কী মনে হয়েছে কে জানে, দুখীদা আজ চিকেন লড়িয়েছে।
‘কারণটা কী গো?’
‘আজ আমার বউয়ের জন্মদিন।’
‘তোমার বউ?’
‘উড বি ওয়াইফ।’
‘তা এবারে তো হবে না।’
‘নাই বা হল। তোরা দেয়ালে ঝোলা ক্যালেন্ডার দেখিস। দেয়াল ঘড়ি দেখিস। বছর আসে, বছর যায়। চুলে পাক ধরলেই বলিস, যাঃ শালা, যৌবন গন। আরে সময় পাতকুয়ো, না পুকুর! সময় অনন্ত! বোল রাধা? হোগা, হোগা, হোগা। আসা—যাওয়াটা থাকলে হবেই হবে।’
‘আসা—যাওয়া মানে?’
‘পৃথিবীতে আসবি, বারেবারে আসবি, দেখবি এ জন্মে যাকে পেলি না, পরের জন্মে, কী তার পরের জন্মে পেয়ে গেছিস।’
‘চিনবে কী করে?’
‘মনে কর তুই মেলায় গেছিস। রাত্তিবেলা। আলোয় আলো। রকম রকম দোকান। নাগরদোলা। এই উঠছে, এই পড়ছে। প্যাঁ পোঁ বাঁশি। জিলিপি ঘুরছে গরম তেলে পাঁপড় গতর ছাড়ছে। কড়ার ঝলসা পোড়া বালিতে চিনেবাদাম ছুটোছুটি করছে। সুন্দরীরা এত বড়ো বড়ো হাঁ করে কপাত কপাত করে ফুচকা খাচ্ছে বোয়াল মাছের মতো। হুসহাস ঝালের শব্দ। ডানহাতের কবজি দিয়ে কপালের ওপর উড়ে পড়া চুল কানের পাশে ঠেলে দিচ্ছে। দুল দুলে উঠছে আলোর ঝিলিক মেরে। কে কটা খেয়েছে, সংখ্যা নিয়ে বচসা। তুই ঘুরছিস একটা ভ্যাগাবন্ডের মতো।
‘তারপর! তুই দাঁড়িয়ে পড়েছিস। অবাক হয়ে দেখছিস—যেন স্বপ্ন! সার সার স্টল। সব চুড়ি। গুজরাট, দক্ষিণ ভারত, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান। চুড়ি। নানা রঙের চুড়ি। ঝলমল, ঝলমল। স্বপ্নের আলো। তুই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিস। বেশি কাছে যাবি না। খদ্দের তো সব মেয়ে। নানা রকমের মেয়ে। তুই তাদের ঘাড়ের ওপর দিয়ে পড়বি না কি?
‘হঠাৎ তোর চোখ আটকে গেল একজনের ওপর। মাথাটা সামনে ঝুঁকে আছে। সুন্দর একটা ঘাড়। এলো খোঁপা ঝুলে আছে। পাশ থেকে তুই মুখটা দেখছিস। পাতলা, খাড়া নাক। পাথর বসানো ছোট্টো একটা নাকছাবি ঝিলমিল করছে। পাতলা পাতলা দুটো ঠোঁট, লাল, টুকটুকে। ধারালো একটা মুখ। ভরাট, ঢালু কাঁধ বেয়ে নেমে এসেছে হাত। নরম, গোল, নিটোল। ভরাট কবজি। ওপর বাহুতে কাপ হয়ে বসে গেছে গোলাপি রঙের ব্লাউজের হাতা। গায়ের রঙ যেন দুধে অল্প বেসন গোলা। কোমরটি সরু। তারপর দেহের আয়তনে শাড়িটা ভারী হয়ে নেমে গেছে নিচে। সেখানে আলো—আঁধারির রহস্য। মেয়েটি হাসছে। কথা বলছে। বিক্রেতা নরম হাতের লম্বা লম্বা আঙুলগুলো এক জায়গায় চেপে ধরে একের পর চুড়ি কবজি পার করে ওপর দিকে ঠেলে তুলে দিচ্ছে। যখন অনেক চুড়ি পরা হয়ে গেল, তখন সে তার হাতটি ওপর দিকে তুলে একবার নাড়াল। যেন রঙের জলতরঙ্গ বেজে উঠল। এইবার সে মুখ তুলে এ—পাশে, ও—পাশে তাকাল। ঠোঁটে চাপা হাসি। যেন চাইছে, কেউ বলুক, বাঃ, ভারি সুন্দর!
‘তুমি সঙ্গে সঙ্গে একটুও দেরি না করে ওই কথাটাই বলে ফেলবে, ‘বাঃ, ভারি সুন্দর!’ কথাটা যেন অসাবধানে তোমার মুখ ফসকে পড়ে গেল। সে চমকে তোমার দিকে তাকাবে। চোখে চোখ রাখবে। সে চোখ ঝেড়ে ফেলে দেবে না। তোমার ঠোঁটে আঁকবে একটু হাসি। যেখানে ছিলে সেইখানেই তুমি থাকবে। এগোবার চেষ্টা করবে না। মেয়েটির সঙ্গে তুমি বদমাইশি করতে চাও না। তুমি তোমার প্রেম দিয়ে পুজো করতে চাও।
‘দাম মিটিয়ে সে বেরিয়ে আসবে। তোমার পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে সে একটু থমকে দাঁড়াবে। তুমি তখন হাসিমুখে স্পষ্ট করে বলবে, ‘চুড়িগুলো ধন্য হল।’ তখনই তুমি লক্ষ করবে, মেয়েটির মুখ বদলে যাচ্ছে। আরও সুন্দর আরও অপূর্ব হয়ে উঠছে। বিভিন্ন দিক থেকে টুকরো টুকরো আলোর তবক উড়ে এসে গায়ে লেগে গেছে। নাগরদোলা ঘুরছে। বেলুন ফাটছে। নানা রকমের শব্দ আসছে। চট দিয়ে ঘেরা একটা জায়গায় মাচার ওপর দাঁড়িয়ে একজন চোঙা নিয়ে চিৎকার করছে, মাকড়সা সুন্দরী, দেখে যান, দেখে যান।
‘সেই মুহূর্তে তোমার মনে হবে, জীবনের সবচেয়ে আপনজনের দেখা তুমি পেয়েছ। তখনই হাত ধরবে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। অনুভব করবে অদৃশ্য একটা তরঙ্গ তোমাদের দুজনকে কেমন সাপের মতো জড়িয়ে ধরছে।
‘তারপর এক পা, এক পা করে, অনেকটা ব্যবধান রেখে মেলার আলো আর শব্দ থেকে দূরে সরে আসবে। অন্ধকার। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের অসমতল রাস্তা। দূরে দূরে একটা একটা কম পাওয়ারের আলো। মেলা—ফেরত ছেলে, মেয়ে, বুড়ো, বাচ্চারা গজর গজর করতে করতে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে।
‘ক্রমে তোমরা কাঁসাই নদীর বাঁধের ওপর এসে যাবে। অনেক নিচে জল। মেয়েটি একবারও বলছে না, তুমি কেন পেছন পেছন আসছ। মেয়েটি বাঁধের একটা জায়গায় এসে তোমার খুব কাছে সরে আসবে। বলবে, ‘এই জায়গাটায় এলে আমার খুব ভয় করে।’ ‘কেন, ভয় করে কেন?’ ‘ওই যে বাঁ পাশে কাপুড় গাছের তলায় শ্মশান। ইট, কাঠ, ছাই, সব পড়ে আছে।’
‘নদীর বাতাসে তার শাড়ির আঁচল উড়ছে। তোমার গায়ে এসে লাগছে। তোমার শরীরের ওজন কমে যাবে। তুমি একটা রঙিন পালক যেন। এখন তুমি খুব আলতোভাবে হাতের কবজির কাছটা ধরবে। বলবে, ‘এই হাতে চুড়িগুলো যা মানিয়েছে!’ সাবধান! এই সম্পর্কের মাঝখানে বিলিতি সেক্স আনবে না।
‘আর কিছুটা গেলেই দেখতে পাবে দূরে ফোঁটা ফোঁটা আলো জ্বলছে। একটি পল্লির ইশারা। বাঁধের রাস্তা একটা বড়ো রাস্তাকে কেটেছে। বড়ো রাস্তায় ওঠার পর মেয়েটি লাজুক লাজুক গলায় বলবে, ‘আমাদের বাড়িতে আসবেন, মা তাহলে খুব খুশি হবেন। মা, আমি আর আমার দাদা, এই তিনজন। বাবা মারা গেছেন এক বছরও হয়নি। মা খুব খুশি হবেন। কালকের নাটকে আপনার অভিনয়ের প্রশংসা করছিলেন। আজও করেছেন।’
‘আপনি আমাকে চেনেন?’
‘চিনব না? আপনি তো দীপক। শেষ দৃশ্যে আমাদের কাঁদিয়ে ছেড়েছেন।’
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দুখীদা বললে, ‘যাঃ বারোটা বেজে গেল।’
প্রবীর বললে, ‘তুমি লেখক হলে না কেন? যেটা বললে, লিখে ফেলা।’
‘লিখে ফেলব কি রে! আরও অনেকটা লিখেছি। প্রায় শেষ হয়ে এল।’
‘এ কি তোমার জীবনের ঘটনা?’
টেবিলে ডিশ সাজাতে সাজাতে দুখীদা পালটা প্রশ্ন করল, ‘আমার জীবনে এইরকম একটা কাহিনি থাকতে পারে না? সবই গল্প!’
‘তোমার কতটুকুই বা জানি? কোনোদিন তুমি কি কিছু বলেছ? নিজেকে ঢেকে রেখেছ। আমাদের দোষ কি বলো! কিন্তু আমরা তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।’
‘তাহলে, আজকে তোদের ছোটো করে বলি। খেতে খেতে বলি। থেমে থেমে বলি। বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করি। বাবার ইচ্ছে ছিল, এম.এ. পাশ করে অধ্যাপক হই, কী বড়ো কোনো চাকরি করি। আমার বাবা খুব অহঙ্কারী মানুষ ছিলেন। আমার মাথায় নাটকের ভূত চাপল। বড়ো অভিনেতা হব। অল্প—অল্প নামও হল। দলের সঙ্গে এখানে যাই, ওখানে যাই। বাবা একদিন সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন, বোতল ধরেছ? আজ্ঞে না। কবে ধরবে? জানি না। মেয়েছেলে জুটেছে? আজ্ঞে না। জুটে যাবে, তা বাপের হোটেলে এসব কতদিন চলবে? ক’পয়সা রোজগার করো?
‘সেই রাতেই গৃহত্যাগ। ভেবেছিলুম বংশের বড়ো ছেলে, কেউ—না—কেউ মান ভাঙিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। কেউ এল না। মা হয়তো চেষ্টা করতেন, বাবার দাপটে সাহস পাননি। শুরু হল আমার ভবঘুরে জীবন। একসময় বুঝতে পারলুম, সংসারে টাকাটাই সব। একটা কেরানিগিরির চাকরি পেয়েছিলুম। ভালো লাগল না, ছেড়ে দিলুম।
এইরকম একটা অবস্থায় নন্দীগ্রামে থিয়েটার করতে গিয়ে দিয়াকে খুঁজে পেলুম। বি.এ. পড়ছে। সুন্দরীরা অহঙ্কারী হয়, দিয়া কিন্তু ভারি সরল ছিল। পরিবারটা বড়ো ভালো ছিল। খোলামেলা, আমুদে। আনন্দ করতে জানে। দিয়াকে ভীষণ ভালোবেসেছিলুম বলেই দূরে সরে এলুম। আমার বউ হলে দুঃখে, কষ্টে, অভাবে থাকতে হত। দিয়া বড়ো ঘরের ভালো ছেলেকে বিয়ে করবে। বিদেশে যাবে।’
‘তুমি বিয়ে করলে না কেন?
‘এই লাও, সাতকাণ্ড রামায়ণ শুনে, বলে সীতা কার বাপ? মানুষ ক’বার বিয়ে করে?’
‘তুমি হলে রোমান্টিক। স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে চাও। আজ যদি তোমার বউ থাকত!’
‘আমাকে আত্মহত্যা করতে হত। আমার মতো একটা অপদার্থকে উঠতে বসতে ঝ্যাঁটাপেটা করত। আমার এই স্বাধীনতায় কেউ হাত দিলে সহ্য হত না। আমি একদিন একা মরে পড়ে থাকব। তোরা সবাই মিলে নিয়ে গিয়ে উনুনে ঢুকিয়ে দিবি। সাধে আমার আসল নাম পালটে দুখী রেখেছি!’
প্রবীর বললে, ‘ধুর! তুমি মানুষকে ভীষণ হতাশ করে দাও। পৃথিবীতে মানুষ আসে কেন তাহলে? প্ল্যাটফর্মে মানুষ যেমন ট্রেনের অপেক্ষায় গালে হাত দিয়ে বসে থাকে, ভাঁড়ে চা খায়, সেইরকম মৃত্যুর অপেক্ষায় আমরা বসে থাকব?’
‘বসে থাকবি কেন? ফুটবল খেলবি।’
‘ফুটবল খেলব কেন? সে বয়েস আর নেই।’
‘কথাটা বুঝলি না। হয় গোল খাবি, না হয়ে গোল দিবি। হয় হারবি, না হয় জিতবি। হারজিতের খেলা। গানটা শুনিসনি? হারজিতের এই খেলাতে জীবনটাকে মেলাতে। যাবার সময় কিছু নিয়ে যেতে পারবি?’
‘না, সঙ্গে কিছু নেওয়া যাবে না।’
‘পরনের ট্যানাটাও টেনে খুলে নেবে। যে বাড়িতে জন্মেছিলুম, তিন বিঘে জমি। আটচল্লিশখানা ঘর। সেকালের চক মেলানো বাড়ি। বড়ো বড়ো বারান্দা। দাঁড়ে বসে বিদেশি কাকাতুয়া বিলিতি গান গাইছে। রোজ সকালে দিঘি থেকে বড়ো বড়ো মাছ উঠছে জালে। গোটা কুড়ি বেড়াল ইতি—উতি শুয়ে বসে, খেয়ে খেয়ে মোটা হচ্ছে। লোকের চেয়ে কাজের লোক বেশি। গেল কোথায়? এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা, মধ্যিখানে চর, তার মাঝে বসে আছেন শিব—সদাগর।’
খাওয়া শেষ, গল্প শেষ। থালা—বাসন ধোয়া যাবে না। সকালে একটি মেয়ে আসবে। দুখীদাকে সে আবার বাবা বলে। বয়েস কম নয়। কুড়ি—পঁচিশ হবে। বক বক করে বকবে। ফর ফর করে ঘুরবে। ঠ্যাং ঠ্যাং আওয়াজ করবে। আমরা তখন ভোরের চা খেতে আসি। তার নাম মায়া। দেখতে শুনতে ভালোই টিপ টপ। সরস, আমুদে। কামনা, বাসনা। সে যে মেয়ে এই কথাটাই ভুলে বসে আছে। ফ্রি। ভীষণ ফ্রি। দুখীদার কাজ হল লোকের নজর থেকে মায়াকে সামলে রাখা।
আমরা জিজ্ঞেস করলুম, ‘যার জন্মদিন করলে, সে এখন কোথায়?’
‘আমার বুকের ভেতর।’
‘দূর, বলো না কোথায়?’
‘কোথাও—না—কোথাও আছে। শেষ চিঠি দশ বছর আগে। নো ঠিকানা। শুধু বলা আছে জীবনের শেষে পুরীতে দেখা হবে। তীরে বসে ঢেউ গুনবো, ঝিনুক কুড়োবো। বালি দিয়ে ঘর বানাবো, ঢেউ এসে ভেঙে দেবে। আয় না আজ আমরা তিনজনে শুয়ে শুয়ে গল্প করি। রাত আর কতটুকুই বা বাকি আছে!’
পরিচ্ছন্ন ঘর। সামান্য আসবাব। ধূপের মৃদু গন্ধ। মা কালীর ছবি। পবিত্র পরিবেশ। মেঝেতে মোটা কার্পেট টাইপের শতরঞ্জি। দুখীদা বললে, ‘নে একটু করে জোয়ান খা। সব হজম হয়ে যাবে।’
বাইরে একটা বাতাস উঠেছে। জানলায় টোকা মারছে। ওপাশে পোড়ো একটি জমি। এখনও বাড়ি উঠছে না কেন কে জানে! রাতের অনেক শব্দ থাকে। পৃথিবীর কান্না শুনতে পাওয়া যায় কান পাতলে।
দুখীদা ছোট্ট একটা বাক্স বের করল, ‘এর ভেতর কিছু স্মৃতি আছে। আগলে থাকার কোনো মানে হয় না। ওই লেখা আসে। একা একা থাকি তো! স্মৃতিই তখন বন্ধু। এই দেখ।’
দুখীদা একটা আংটি তুলে ধরে বললে, ‘এই দ্যাখো, আমাদের বিয়ের আংটি। সোনাটোনা নয়। মেলা থেকে কিনে আমার আঙুলে পরিয়ে দিয়েছিল। বয়েস কম, বুদ্ধি পাকেনি। তাই চাঁদের আলো, নদীর জল, প্রেম এই সব আর কি! বোকামি। আর এই একটা স্মৃতি।’
‘এটা কী?’
‘ওই যে রে, মেয়েরা খোঁপায় জাল লাগায়, সেই জাল। চুলের গন্ধ লেগে আছে। মেয়েদের কখনো মানুষ ভাবতে নেই, ভাববি দেবী। তাহলে পবিত্র হয়ে যাবি। আর পবিত্র হলেই দেখবি, এই বিশ্রী পৃথিবীটা একটা মন্দির। যা কিছু হচ্ছে সবই পূজা। মাথার ওপর অতবড়ো একটা আকাশ, অনন্ত। চন্দ্র, সূর্য, তারা। কত রকমের মেঘ। নিচে নদী, সমুদ্র, গাছ, ফুল, পাখি, সরোবর, হাঁস।’
দুখীদার চোখ চিক চিক করছে। জল এসেছে। আমরা দুজনে স্তব্ধ হয়ে আছি। আজকের রাত দুখীদার রাত। অতীতের অনেক কথা আসছে, ‘জানিস তো, আমার মাকে সংসার বহুত কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলেছে। মেয়েদের কষ্ট আমি দেখতে পারি না। পুরুষরা মেয়েদের কষ্ট দেওয়ার জন্যেই জন্মায়। আমার বাবা সংসারের কথা একেবারেই ভাবতেন না। কেমন একটা স্বার্থপরের মতো মানুষ। ইচ্ছে করলে বাবা মাকে সুখী করতে পারতেন। আমি ইচ্ছে করলে কোনো অফিসে—টফিসে একটা চাকরি জুটিয়ে, রঙচটা সরকারি ফ্ল্যাটে সংসারমতো একটা কিছু করতে পারতুম। আমি আর মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক হতে চাই না। ওপরতলাটা হল লাশ—কাটা ঘর। পারলে আমি আরও নিচে নামব। ভদ্দরলোক আমি অনেক দেখেছি।’
আলো নিভল। আমরা তিনজন পাশাপাশি। মিষ্টি পানের মতো মিষ্টি ঘুম।