নিমেষ

নিমেষ

অন্ধকারের রহস্য যবনিকা এইমাত্র পৃথিবীর ওপরে নেমে আসা সাঙ্গ হল। কঠিন রজনী। অমানিশা। কালো আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে তারা বেরিয়ে আসছে। জ্বলজ্বল করে জ্বলছে একেকটা।

অর্যমা বলল—দেখো রঙ্কা সবগুলি তারা মিটমিট করে না। কয়েকটি নিষ্পলক থাকে। ওই দেখো লালচে তারাটি, ওর দীপ্তি আছে। অস্থিরতা নেই। দেখো রঙ্কা চাঁদ উঠলে এত তারা দেখা যায় না। কেন বলো তো! চাঁদের আলো তীব্রতর, তাই তারাদের অল্প আলো হারিয়ে যায়, যেমন রঙ্কার আলোয় আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে নিমেষ… মধুরা…।

চট করে ফিরে চাইল রঙ্কা—এ কথার মানে? রঙ্কা কোথাও চন্দ্র হতে চায় না। কাউকে ঢাকার ইচ্ছে তার নেই। এমন কথা আর বোলো না অর্যমা। মধুরার হাতে প্রাণনাশের ইচ্ছেও আমার নেই।

অর্যমা শব্দ করে হাসল—কথাটা তুমি বুঝতে পারো তা হলে! আমি ভেবেছিলাম তুমি কিছুই বোঝে না।

রঙ্কা কথা বলল না। দুজনে চুপচাপ বসেই থাকে, বসেই থাকে, তারাদল মৃদু আলো বর্ষণ করতেই থাকে, করতেই থাকে। ধন্যা ছলচ্ছল বলতেই থাকে, বলতেই থাকে।

রঙ্কা আসলে অনেক অনেক দূর পর্যন্ত মনে করতে পারে। ভাবতে পারে। নিমেষের ওপর তার প্রকাণ্ড একটা রাগ হয়েছিল। বিশ্বাসঘাতক, আত্মগর্বী, আক্রমণাত্মক মানুষদের সে পছন্দ করে না। আবার সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করবে, একটু কৃপার জন্য কেন্নোর মতো করতে থাকবে— এরকমও তার পছন্দ নয়। তার পছন্দ ভগর মতো মানুষ। আলোর মতো। যেখানে যাবে নিয়ে যাবে শুশ্রূষা, আরোগ্য, আশ্বাস। গভীর চোখ, কেমন উদাসীন। ভাবুক-ভাবুক। যখন রঙ্কার কাছে আসে, আসে দেবতার মতো, দেবতা যেন প্রসাদ দিচ্ছেন ও অর্ঘ্য নিচ্ছেন। অর্যমা থাকলে সে কখনও আসে না, তার জন্য রঙ্কা কৃতজ্ঞ। তারা তো আর বনের পশু নয় যে সবার সামনে মিলিত হতে বাধবে না। সে অন্তত নয়। অর্যমাকেও সে আলিঙ্গন দেয়। কিন্তু তাতে ততটা সুখ থাকে না, আবেগ থাকে না, যতটা থাকে প্রীতি। সে যাই হোক, নিমেষকে ওই ভাবে অস্ত্র প্রহার ও আহত অবস্থায় বনের গভীরে ফেলে আসা তার পছন্দ হয়নি। হিংসা, বলপ্রয়োগ— এসব তাকে পীড়িত করে। তার সবচেয়ে প্রিয়পাত্রকে মধুরা এমন শাস্তি দিল কেন? মধুরার মুখ ক্রোধে রক্তবর্ণ হয়ে গিয়েছিল, মুখভাব কুটিল। সে দলে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছিল। ঠিক আছে। কোনও একজন দল-সদস্যের অযথা অপমানের বিচারও করতে চাইছিল। ঠিক আছে। কিন্তু অতিরিক্ত কিছু একটা ছিল, সেটাই সে মনে করবার চেষ্টা করছে। কী? কী? কী? তার কথার উত্তর দিল অর্যমা—প্রতিধ্বনির মতো।

—মধুরা তোমার গুণ বোঝে, কিন্তু হিংসাও করে।

—হিংসা? তুমি ঠিক জানো? অর্যমা, আমি মাতঙ্গীর মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও তো মধুরার নেত্রীত্ব মেনে নিয়েছি।

—মানা না মানার কথা নয়। কথা হল ক্ষমতার। রঙ্কা তুমি যখন চলো ফেরো, যখন কোনও আশ্চর্য কাজ করো—লক্ষ্যভেদ, কি রন্ধন, ভগর কথামতো সেবা, বা আমার কথামতো চন্দ্রসূর্য গণনা, তখন সবাই আশ্চর্য হয়ে, মুগ্ধ হয়ে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে। দলের পুরুষগুলি সব তোমাকে চায়।

রঙ্কা আশ্চর্য হয়ে বলল—তুমি তো সর্বদা আকাশমুখো হয়ে থাকো, এত কখন দেখলে? বুঝলে?

—অর্যমার চোখ আকাশে থাকে বটে, কিন্তু সারা পৃথিবী, সমস্ত মানুষ তাদের কর্ম, উদ্দেশ্য তার কাছে সহজে প্রতিভাত হয়। রঙ্কা, চন্দ্রমা উদিত হয়েছে। তার আলোয় হারিয়ে যাচ্ছে মধুরা। অনেক চন্দ্রসূর্য তো পার করল। আমি যখন জন্মেছি তখন মধুরা নিশ্চয় বাকল পরা শুরু করে দিয়েছে।

পেছনে শব্দ হল, দুজনে চমকে তাকায়। ভগ দাঁড়িয়ে। বলল— নিমেষ গভীর বনে পরিত্যক্ত, বিক্ষত। আমি সেবক, যাচ্ছি, আহত মানুষকে পশু ছিঁড়ে খাবে, ভগ তা সইতে পারবে না। অর্যমা তুমি তির-ধনু নিয়ে আমার সঙ্গে এসো।

রঙ্কা বলল—আমিও যাব। আমি জল, কিছু খাদ্য নিয়ে যাই।

ভগ বলল—রঙ্কা আমি সুখী। তোমার মধ্যে আস্তে আস্তে মহত্ত্বের সঞ্চার হচ্ছে।

যারা মধুরার কথা মেনে নিমেষকে নির্বাসনে রেখে এসেছে, তারা দয়া করে তাকে উন্মুক্ত স্থানে রাখেনি। রেখেছে একটি ঘন বৃক্ষ ও লতা দিয়ে আচ্ছাদিত স্থানে। প্রথমটা নিমেষের সংজ্ঞা ছিল না। কিন্তু সে অমিতবল পুরুষ। শিগগিরই তার জ্ঞান ফিরে আসে। তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছিল তার দুই বাহুতে। তার মনে পড়ছিল আবছা আবছা সেই দৃশ্য। অনিচ্ছুক রঙ্কাকে সে চুল ধরে বাইরে টেনে আনছে। প্রহার করছে যথেচ্ছ। একবার তার ক্রোধ হয়, আরেকবার করুণা। মধুরা? শেষ পর্যন্ত যে মধুরা তাকে অশেষ প্রশ্রয় দিয়েছে, তার অন্তত ৬/৭টি সন্তান তারই, এ কথা স্বীকার করেছে, সেই মধুরা তাকে নির্বাসন দিল? সে যেন কেমন বিশ্বাস করতে পারছে না। হাত দুটি অসাড়। তার পাশ দিয়ে সাপ চলে গেল একটা। ওপরে বানরের কিচিমিচি। এই ভাবেই আস্তে আস্তে অন্ধকার নেমে আসে। লতাজালের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে তারায় ভরা আকাশ। নিমেষের শিশুকালের কথা মনে পড়ে। সে ও মধুরা কাড়াকাড়ি করে বর্ণার দুধ খাচ্ছে, মধুরা বড়, তার বল বেশি। সে এক ঝটকায় তাকে সরিয়ে দিল। বর্ণা বলছে—বীর্য কোথায় তোর, ছেলে? যার বীর্য বেশি সে পাবে, কেড়ে খাবে। গাছের ওপর এক ডাল থেকে আরেক ডাল, এক গাছ থেকে আরেক গাছ অনায়াসে ছুটে, লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে পার হত মধুরা, তাকে ডাকত, আয়। আয়রে নিমেষ, আমাকে অনুসরণ কর। এই ভাবেই সে বানরের মতো বৃক্ষচারী হতে শিখেছিল। ফোঁস করে উঠেছে সাপ। ফণা ধরেছে। টুক করে তার গলা বজ্রমুঠিতে ধরে ফেলল মধুরা। সাপটা লেজ আছড়াতে আছড়াতে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। এবার ছুরি দিয়ে সাপের মুন্ডুটা সে কেটে ফেলে দিল, তারপর গাছের তলায় আগুন করে সাপটি পুড়িয়ে খেল। সাপ-পোড়া মধুরার বিশেষ প্রিয় ছিল। একটি বিরাট বানরের চড় খেয়েছিল সে একদিন, মুন্ডু ঘুরে গিয়েছিল। মধুরা দু গালে চড় মেরে মেরে মুন্ডুটাকে ঠিক জায়গায় নিয়ে আসে। কুট করে একটা শব্দ। যন্ত্রণার অবসান। সেই বানরটাকে তির দিয়ে মেরে ফেলেছিল মধুরা। অশ্ব আবিষ্কার কিন্তু নিমেষই প্রথম করে। বিস্তীর্ণ ঘাসে ঢাকা মাঠে চরছে! আরে! বড় বড় গাধার মতো—এগুলি কী? সে গাছের ওপর থেকে লাফ দিয়ে একটার ওপর চড়ল। সজোরে আঁকড়ে ধরেছে চুল! ছুটছে ছুটছে। লতাপাতা মাড়িয়ে, মাঠ পার হয়ে অবশেষে ঘন বনের ধারে এসে থমকে গেছে। নাক দিয়ে ঝড়ের মতো নিশ্বাস বেরোচ্ছে।

নিমেষ, নিমে-ষ, তুমি কোথায়? নিমে-ষ, তুমি কি বেঁচে আছ? সাড়া দাও নিমে-ষ! —কে ডাকে? ভরাট গম্ভীর পুরুষ কণ্ঠ। নিমেষ! নিমেষ…

প্রাণপণে বল সঞ্চয় করে সাড়া দেয় নিমেষ।

—আমি এখানে—এ-এ-এ। আমি এখানে-এ-এ।

ক্রমশ পাতা মাড়ানোর খড়মড় মচমচ শব্দ কাছে, আরও কাছে আসতে থাকে। সে দেখে একটি আলোর মতো মুখ। মুখটি নিচু হয়ে তাকে বলে —ওষধি দিচ্ছি, নির্ভয়ে খাও নিমেষ, যন্ত্রণা চলে যাবে।

নিমেষ হাঁ করে। আস্তে আস্তে আবছা হতে হতে হারিয়ে যায় স্মৃতি। বর্তমান, বনভূমি, রাত, আলো, অন্ধকার সব।

তির দুটি একটানে তুলে ফেলে ভগ। তিনফালা হাঁ করা গর্ত। তার মধ্যে পুঁটলি করে ওষুধ পোরে অর্যমা, রঙ্কা পরিষ্কার জল ফোঁটা ফোঁটা ফেলে ঈষৎ হাঁ করা জ্ঞানহীন মুখে। দেহটি পরিষ্কার করে। তারপর তিনজন মিলে খাটুলি বানায়। সাবধানে তোলে।

—কোথায় নিয়ে যাব?

—আমাদের কুটিরে।

—সে কী? ওর যে নির্বাসন!

—তা-ও বটে। এক কাজ করো, —অর্যমা বলে—আমি একটি গুহা জানি, তার দুদিকই খোলা। লতাপাতা দিয়ে খোলা জায়গাটা বন্ধ করে…।

অর্ধেক রাত কেটে যায় নিমেষের জন্য আশ্রয় তৈরি করতে। ভেতরে মাটির পাত্রে জল রাখে, পাতার ওপর মাংস রাখে, খুব নরম করে ঝলসানো খরগোশের মাংস। ভোরের দিকে তিনজনে চুপচাপ চলে আসে। এমনই চলে দিনের পর দিন। যত দিন না নিমেষের ক্ষত শুকোয়। যত দিন না সে বল পায়। উঠে দাঁড়াতে পারে।

নিমেষ সম্পূর্ণ সেরে গেলে ভগ বলে—এ ভূমি ছেড়ে অন্যত্র কোথাও চলে যাও নিমেষ। তোমার নির্বাসন। জীবন ফিরিয়ে দিয়েছি। এরপর সে জীবনের দায় তোমার। ঘোর কুটিল দৃষ্টিতে মুখ তুলে তাকাল নিমেষ। তারপরে বলল—তোমার করুণা চাই না ভগ। আমার ইচ্ছার ওপর নিজের ইচ্ছা চাপিয়ো না। চলে যাও, নিমেষ যা মন চায় করবে।

সূর্য ঢলে, চাঁদ ওঠে। চাঁদের পর চাঁদ চলে যায়। মধুরা গোষ্ঠীর দিনকাল ক্রমশ আরও, আরও ঋদ্ধ হয়। ধান্য ফলে, কন্দমূল হয়, গাছে গাছে ফল ধরে। রঙ্কার গর্ভকাল শেষ হয়ে সুপ্রসব হয়। একটি চাঁদের কণার মতো কন্যা জন্ম নেয়। চারিদিকে হর্ষধ্বনি ওঠে। ‘কন্যা এসেছে, কন্যা এসেছে। এ পৃথিবীতে আরও শিশু আনবে, বক্ষে অমৃতধারা, বাহুতে শক্তি, হৃদয়ে প্রেম, মস্তিষ্কে, বুদ্ধি।’ মধুরার কাছে দীর্ঘদিন অস্ত্রশিক্ষা চলেছে রঙ্কার। সে এখন তির, বর্শা, কুঠার— তিনটিতেই পারদর্শিনী হয়ে উঠেছে। তার অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ দেখে চমৎকৃত হয়ে যাচ্ছে সবাই। সেই সঙ্গে সে রপ্ত করেছে ভগর বিদ্যা, অর্যমার অঙ্ক। কন্যার জননী, পূর্ণযৌবনা রঙ্কার দিকে আশা ও মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে সবাই।

সেদিন সূর্য উঠে গেছে, পাড়া খালি। রঙ্কা ওষধি মেলানোর কাজ করছে আপন মনে, দরজায় আড়াল পড়ল। রঙ্কা মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে মধুরা। মধুরা অতি দীর্ঘকায়া, ক্ষিপ্রগতি, তন্বী শরীর ইদানীং একটু ভারী হয়েছে। মধুরার মুখশ্রী দৃঢ়তাব্যঞ্জক, ওষ্ঠাধর কঠিন, কপাল ছোট, দীর্ঘ চোখ দুটি।

—মধুরা—

রঙ্কা উঠে দাঁড়াল।

—বোসো রঙ্কা, ওষধি প্রস্তুতির কাজটি ভাল করে করো। এই প্রথম আমরা এমন একজনকে পেলাম যে একই সঙ্গে যুদ্ধ ও সেবা, শিকার ও চন্দ্র সূর্য, জল, হাওয়ার রহস্য ভেদ করতে শিখেছে। রঙ্কা তুমি ধন্য।

রঙ্কা আস্তে বলল— আমার মা মাতঙ্গী পারত। মাতঙ্গী ছিল অসাধারণ।

মধুরা বলল— এখনও মাতঙ্গীকে ভোলোনি, মেয়ে?

—না, মধুরা তুমি কি বর্ণাকে ভুলে গেছ। যে মেয়ে মাকে ভুলে যায় তার কোনও বিদ্যা কাজে লাগে না।

অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে মধুরা নিশ্বাস ফেলে বলল— আমরা ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী যদি মিলতে পারতাম! কত বীরপুরুষ, বীরনারী, গুণীজনকে গোষ্ঠীর স্বার্থে আমরা …

নীরবে নিজের কাজ করতে লাগল রঙ্কা। একটু পরে মৃদু গলায় বলল— তুমি কি নিমেষের কথা বলছ?

মধুরা মাথা নাড়ল।

—নিমেষ বেঁচে আছে।

চমকে উঠল মধুরা। —তুমি কী করে জানলে? সে কি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করে? বাঁচল কী করে?

—শূন্য যদি মানুষকে না নেয়, মানুষটি যেমন করে হোক থেকে যায়। না, নিমেষের সঙ্গে কোনও যোগ আমার নেই। আমি নিমেষকে ইচ্ছা করি না। আমি ভগ ও অর্যমাকে ইচ্ছে করি। ভগ মহান, অর্যমা বুদ্ধিমান।

—আর আমি? আমাকে কি তুমি এখনও ঘৃণা করো, রঙ্কা?

—না তো! তুমি আমাকে শিখিয়েছ, রক্ষা করেছ, তুমি নেত্রী, আমি তোমাকে মান্য করি। —একটু ইতস্তত করে রঙ্কা বলল— কিন্তু তুমি আর মাতঙ্গী এক নও। আমার কাছে মাতঙ্গীর চেয়ে বড় আর কেউ নেই। তারপর … তার … পর ভগ।

—রঙ্কা তোমাকে বলতে এলাম আগামী গোল চাঁদের দিনে আমি তোমাকে নেত্রী করব।

—অ্যাঁ? রঙ্কা বিস্ময়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।

—হ্যাঁ, কিছু দিন পাশে পাশে থাকব। তারপর তুমি নেত্রী। আমি তোমায় মান্য করতে বাধ্য থাকব।

—কিন্তু কেন, মধুরা!

মধুরা হাসল। বলল— এমন দিন আসতে পারে, যেদিন তুমিই আমাকে পরাজিত করে নেত্রী হয়ে বসবে। তেমন হবার আগেই আমি সরে যেতে চাই। আমি আর বৎস ধারণ করতে পারি না।

—নাই পারলে! সে তো মাতঙ্গীও পারত না। তার শেষ বৎসটি তো তরক্ষুর পেটে গেল। আমি নেত্রী হতে চাই না মধুরা।

—তুমি না চাইলেও, অন্যরা চায়। নেতৃত্ব আপনিই তোমার ওপর বর্তাবে। ভয় কোরো না রঙ্কা, আমি আছি, আর … আর … একটা কথা … যখন শূন্যও নেবে না, মাটি জল বনও নিতে চাইবে না, তখন আমাকে আশ্রয় দিয়ো, রক্ষা কোরো। —বলে মধুরা বসে পড়ল। কলকল শব্দ করে তার গলা থেকে কান্না বেরোতে লাগল।

গোল চাঁদের দিন। আকাশ থেকে ঝরঝর করে আলো ঝরছে। বাতাসে সুন্দর গন্ধ। সহস্র ফুল ফুটেছে বনে। মাতাল করে দিচ্ছে সব। গাছগুলি আলোয় চান করে যেন হাসছে। ধন্যাকে নদী বলে মনে হচ্ছে না, সে যেন গোল চাঁদের ছবি বুকে নিয়ে এক বহতা আলো। মানুষগুলি সেজেছে, গলায় ফুল গেঁথে পরেছে, কানে ফুল গুঁজেছে। কোমরেও ফুলের মালা। আগুন জ্বালানো হচ্ছে মহাসমারোহে। আজকের শিকার শুধু রঙ্কা ও মধুরার। তিনটি বরাহ, চারটি বিশাল হরিণ। কাটাকুটি চলছে। আজ বিশেষ ভোজ। ভারে ভারে ধান্য সিদ্ধ হচ্ছে।

চাঁদ মধ্য গগনে উঠলে, একটি টিলার ওপর উঠে মধুরা ঘোষণা করল— আজ থেকে রঙ্কা তোমাদের নেত্রী, সে তোমাদের রক্ষা করবে, তোমরা তাকে মান্য করবে। সকলে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল। মধুরা তার নিজের বল্লম রঙ্কার হাতে দিল। রঙ্কা সেটি হাত পেতে নিল, তারপর সে চন্দ্রালোকিত একটি গাছ লক্ষ্য করে ছুড়ে দিল তার বল্লম। নির্ভুল লক্ষ্যে গাছে গেঁথে গেল বর্শা।

আবার হর্ষধ্বনি।

ভোজ শেষ হল। বেড়া আগুনের ধারে তিনজন প্রহরায় রইল, বাকি নরনারীরা পরস্পরের মধ্যে মিলনের আনন্দে মাতোয়ালা হয়ে উঠল। শুধু কুটিরে স্তব্ধ বসে রইল মধুরা। তার আর আজকে কাউকে পেতে ইচ্ছে করছে না। জীবনভর বহু স্মৃতি। স্মৃতিতে মথিত হচ্ছে সে। বুকে কেমন অচেনা কষ্ট। তার ভাই, তার দোসর নিমেষকে সে নিজের হাতে বিদ্ধ করেছিল। নির্বাসন দিয়েছিল। সে বেঁচে আছে শুনে পর্যন্ত এক অদ্ভুত স্তব্ধতা অভিভূত করছে তাকে। আগেও ছিল এক বিস্বাদ বিষাদ, নিমেষ গিয়ে পর্যন্ত। এখন সে বেঁচে আছে শুনেও সে স্বস্তি পাচ্ছে না। কেন কে জানে! হর্ষ, তুমি এই গোষ্ঠীর সবাইকে আজ মথিত করছ, আমাকে ফেলে গেলে কেন? শূন্যকে প্রশ্ন করে সে। এই শূন্য থেকেই প্রাণ আসে। এখানেই প্রাণ লয় পায়, এই শূন্য থেকে মানুষের বুকে নামে আনন্দ, দুঃখ। মধুরা ঘুমিয়ে পড়ে, স্বপ্ন দেখে— বিশাল বনভূমির গাছ থেকে গাছে ডাল ধরে ধরে ছুটে চলেছে মধুরা। ছুটে চলেছে নিমেষ। নিমেষের পা ফসকাল। হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে ফেলল মধুরা। মধুরার পায়ে কাঁটা ফুটেছে। সে বসে পড়েছে। নিমেষ আর একটি তীক্ষ্ণ শক্ত কাঁটা দিয়ে কাঁটাটিকে তুলে ফেলল। স্বপ্ন আরও দূরে চলে যায়। হরিণছানা নিয়ে খেলছে দুজনে। এক পাত্র থেকে খাচ্ছে। দুর্বার মিলনের রাত। তীব্র হর্ষে চিৎকার করছে দুজনে। মধুরা স্বপ্ন বলে জানে না। শুধু স্মৃতিতে ডুবে থাকে, ভুলে যায় সে এখন অবসৃত নেত্রী। সে শৈশবে, কৈশোরে, যৌবনে বাঁচে, ডুবে থাকে।

ভস্মবর্ণ ভোর। আগুন নিবে গেছে। প্রহরীগুলিও ঘুমিয়ে পড়েছে, চতুর্দিকে গভীর শান্তি ও ক্ষান্তি বিরাজ করছে। কোথাও কি কোনও শব্দ হল? কোনও বন্যপশু? না তো! সারারাত অক্লান্ত চারণ। শিকারের পেছনে ধাওয়ার পর পশুগুলিও ঘুমে ঢলেই তো পড়েছে। কোথায় কে যেন নিশ্বাস ফেলল? এতগুলি মানুষ তো নিশ্বাস ফেলছে! আবার কী? আবার কে? কুটির ভেদ করে তীক্ষ্ণ একটি বল্লম বিঁধে গেল মধুরার বুকে। নিঃশব্দে শূন্যে চলে গেল মধুরা। একবার আর্তনাদ করার সময়ও পেল না। ঠিক যখন স্বপ্ন তাকে নিমেষের সঙ্গে বর্ণার বুকে ফিরিয়ে দিয়েছে তখন।

বনের ভেতর থেকে হাতে লতাতন্তু নিয়ে কাঁধে ধনুর্বাণ রাশি রাশি মানুষ নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে। ঘুমন্ত নারীগুলিকে বাঁধে, হত্যা করে পুরুষগুলিকে। এবং উত্থিত আর্তনাদ কানে ঘুম ভেঙে রঙ্কা দেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে নিমেয— এক হাতে অর্যমার, অন্য হাতে ভগর কাটা মুন্ডু থেকে ধারাবর্ষণ হচ্ছে। রক্তে ভিজে যাচ্ছে রঙ্কার সর্বাঙ্গ। তিন-চারজন লাফিয়ে পড়ে। নিমেষ তাকে লতা দিয়ে শক্ত করে বাঁধে। তারপর টানতে টানতে নিয়ে যায় পাড়ার মাঝখানে। মাটিতে ফেলে দিয়ে বলে— সবাই দেখে রাখো এ আমার নারী। একমাত্র আমার। শুধু আমার বৎস ধারণ করবে এ। আর তোমরা, আমার দলে বীররা, যে যে নারী চাও, তাকে নিয়ে কুটিরে ঢোকো। সেই সব নারী হবে সেই সেই পুরুষের। তারা আর কারও সন্তান ধারণ করতে পারবে না। আমরা জানব কে আমাদের সন্তান, কে আমার ধারা রক্ষা করবে। এই আমার অনুশাসন। সাবধান, যে না মানবে— কেটে ফেলব। আর রঙ্কা তুমি ইচ্ছে করো বা না করো— বলে সজোরে রক্তমাখা রঙ্কার মধ্যে প্রবেশ করে নিমেষ। তখনই। সেখানেই। দুধারে অর্যমা ও ভগর মুণ্ডে রক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে যায়। ধড়গুলি সব গুলিয়ে গেছে। খালি ভগর সর্বশ্বেত দেহটি পরিষ্কার চেনা যায়। সকালের আলোয় মুন্ডুহীন পড়ে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *