নিভৃতে একাকিত্বে নারী

নিভৃতে একাকিত্বে নারী

নিভৃতি আর একাকিত্বের প্রধান পার্থক্য বোধহয় প্রথমটি পরিবেশগত, দ্বিতীয়টি মনোজাগতিক। প্রথমটি স্বেচ্ছাকৃত, পরেরটি আরোপিত। আগেরটি বাঞ্ছিত, অন্যটি অনাকাঙ্ক্ষিত। প্রথমটি মানুষকে উজ্জীবিত করে, দ্বিতীয়টি করে ক্লান্ত— পরাস্ত।

নিভৃতি

জীবন ও সংসারের প্রাত্যহিক কোলাহল, দাবিদাওয়া, কর্তব্য মিটিয়ে প্রতিটি মানুষ কখনও কখনও নিজের জন্যে নিভৃতি খোঁজে। এক একটি দুর্লভ মুহূর্তে নিজের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় সে। একটি একটি করে সকল মুখোশ, প্রসাধন, পরিধেয় খুলে নিজেকে তন্নতন্ন করে দেখে। আত্ম-আবিষ্কারের চেষ্টা করে। কোনও প্রবোধ, ছলনা, চাতুরী, কোনও অভিনয় নয়- নিজের একান্ত আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখা কেবল। জগৎজীবনে যতগুলো ভূমিকা পালন করে সে, সব ভুলে নিজের আসল রূপটা দৃশ্যমান হয় তখন। অথবা পরিপূর্ণ রূপ তখনও প্রকাশ পায় না। পায় সেই মুহূর্তের বাস্তবতা— সত্তার খণ্ডাংশ।

কখনও কখনও অবশ্য সে নিভৃতি এতটা অন্তর্গত, এতটা ব্যাপক অথবা এতটা গভীরে পৌঁছোয় না। তখনও মানুষ চারপাশের লোকজন, হইহুল্লোড় পাশ কাটিয়ে কেবল একটু একা সময় কাটাতেই পছন্দ করে। আত্মোপলব্ধি, আত্ম-অবলোকন বা আত্ম-আবিষ্কারের জন্যে নয়, শুধু নিজের শ্রান্তি ঘুচাতে— নিজেকে সজীব করতে— বিশ্রাম নিতে। প্রকার যা-ই হোক, নিভৃতির প্রয়োজন বড় বেশি অস্বীকৃতি আমাদের সমাজে। ভালোবাসার নামে, আন্তরিকতার দোহাই দিয়ে, কর্তব্য-দায়িত্ব মেটাতে অথবা খেয়াল বা নজর রাখার অজুহাতে আমাদের সমাজে অন্যের প্রাইভেসিতে বড়-বেশি হস্তক্ষেপ করে ফেলি আমরা। এটা করে কখনও কখনও নিজেদের ওপরও বেশি ঝক্কিঝামেলা নেওয়া হয়, যার জন্যে করা হয় তাকেও উত্যক্ত করা হয়। কিন্তু একটা অদ্ভুত গোলকধাঁধার ভেতর পড়ে যাওয়ার ফলে এর থেকে যেন মুক্তি নেই আমাদের। যেমন ধরুন কারও অসুখ হল বা কারও পা ভাঙল। যারা সত্যিকার অর্থেই তার জীবনের কাছাকাছি—ব্যক্তিগতভাবে বা কর্মোপলক্ষে—তারা এল তাকে দেখতে, গল্পসল্প করল। ভালো কথা। কিন্তু আমাদের সমাজে পরিচিত সকলেই যেন আশা করে অসুখের খবর পেলেই ছুটে যেতে হবে দেখতে। যত ব্যস্ততাই থাকুক। যার অসুখ সেও তাই মনকে সেভাবেই তৈরি রাখে অহরহ লোক আসবে। বাড়ির সকলকেও সেরকম প্রস্তুতি নিতে হয়। রোগীর সেবা-শুশ্রুষা ছাড়াও অতিথি আপ্যায়ন একটা বড় কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় তখন।

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে অথবা জরুরি অস্ত্রোপচারের পরে মরণাপন্ন রোগীকেও রেহাই দেয় না কেউ। নিজেদের বাহবা দিতে অসুস্থ ব্যক্তির জীবনের ঝুঁকি নিতেও পিছপা হয় না তারা। অথচ অনেকেই বোঝে না, রোগীর মঙ্গলের জন্য, তার নিরাপত্তার খাতিরেই তাকে হয়তো একা থাকতে দেওয়া দরকার। রোগী বা তার আত্মীয়স্বজনের জন্যে সত্যিকার অর্থেই যদি কিছু করার ইচ্ছে থাকে, সেটা অন্যভাবেও করা যায়। সাক্ষাৎ দিয়েই নয় কেবল। ছোট বাচ্চাটাকে ঘরে এনে রেখে, যাতে তার মা রোগীর সেবা করতে পারে। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের জন্যে রান্না করে, বাজার করে, তাদের অফিস, বিল বা ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত ছোটখাটো কাজ করে দিয়ে।

শুধু অসুস্থ সময়ের কথা নয়, মৃত ব্যক্তির বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের দলে দলে গিয়ে শোকপ্রকাশ সবসময় বাঞ্ছিত কি না সেটাও যাচাই করা দরকার। কেউ কেউ চাইতেই পারে তাদের শোক, দুঃখ বা রোগভোগের সময়টা নিরালায় একান্তে কাটাতে। এমন মানুষও রয়েছে, যারা সত্যিকার অর্থেই সংকোচ বোধ করে তার শরীরের জরা নিয়ে বা ব্যক্তিগত দুর্ভোগে লোকজনের অতিশয় দুশ্চিন্তা বা.মনোযোগে। তাদের সেই নিভৃতি, তাদের সেই ইচ্ছার স্বীকৃতি দেওয়া দরকার।

আমার মনে আছে—ষোলো বছরের এক ফুটফুটে মেয়ে, দোলা, ক্যান্সারের ভয়াবহ আক্রমণ ও কিমোথেরাপির প্রতিক্রিয়ার কয়েক মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ কেশবিহীন ও কংকালসার হয়ে পড়ল। মেয়েটি চাইত না কেউ তাকে এ অবস্থায় দেখুক। নিজের প্রাক্তন রূপ সম্পর্কে সচেতন এই কিশোরী পরিচিত কাউকে সামনে দেখলেই বিছানার চাদর বা বালিশ দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে রাখত। সংবেদনশীল প্রিয়জনের উচিত ছিল তার এই অন্তিম ইচ্ছাকে মূল্য দেওয়া— সম্মান করা—তার যন্ত্রণাময় মৃত্যুকে সহনীয় করে তোলা কিছুটা সমীহ দেখিয়ে। কিন্তু কার্যত তা ঘটেনি। মৃত্যুপথযাত্রী এই মেয়েটিকে ক্রমাগত দর্শন দিতে হত অতিথিদের, পুরোপুরি তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে— প্রচণ্ড ক্ষোভ ও মনঃকষ্টের সঙ্গে। আত্মতুষ্টির জন্যে এমন করে অন্যের প্রাইভেসি হরণের কোনও অধিকার আমাদের নেই।

একইরকমভাবে কোনও সমব্যথী বন্ধু বা স্বজনও প্রিয়জনের মৃত্যু, অসুখ অথবা বিবাহবিচ্ছেদে তার প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ব্যক্ত করতে পারে! সে যদি মনে করে কাছে গিয়ে দেখা করার চাইতে দূরে বসেই এমন কিছু করা যেতে পারে যা তাকে নিজেকে এবং তার প্রিয়জনকে বেশি সান্ত্বনা দেবে, তা হলে সে সেটাই করবে। ঘনিষ্ঠভাবে সবচেয়ে বড় কাজ বোধহয় দুর্যোগ অথবা দুঃখজনক ঘটনার শিকার ব্যক্তিটির মনে এই বোধের জন্ম দেওয়া—এই বিশ্বাস স্থাপন করা যে তার প্রতি সহমর্মিতা সম্পূর্ণ অটুট রয়েছে, লৌকিকতা ও বাহ্যিক আচরণ যেমনটিই করা হোক না কেন, সেই প্রিয়জনের ওপর সর্বদা পরিপূর্ণ নির্ভর করতে পারে এ ব্যক্তি এবং যে-কোনও অবস্থাতে এই প্রিয়জন এসে পাশে দাঁড়াবে।

ফলে কারও মৃতমুখ দেখতে অনাগ্রহী হওয়া, জানাযায় অংশগ্রহণ না করা অথবা শ্রাদ্ধে খাদ্যগ্রহণে বিরত থাকা মৃতের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানো বা মৃতের আত্মীয়ের প্রতি সমব্যথী না হওয়ার দৃষ্টান্ত নাও হতে পারে। দুঃখের দিন অতিবাহিত করার অথবা প্রিয় ব্যক্তির দুর্দিনে পাশে থাকার ব্যাপারটা একেকজন একেকভাবে দেখে— একেকভাবে মোকাবিলা করে। এই আপেক্ষিক মূল্যবোধ—অনুভূতি প্রকাশে জনে জনে তারতম্য অস্বীকার করে লাভ নেই। কোনও বিশেষ ফর্মূলায় সকলকে ফেলে কাউকে কাউকে এর বিচ্যুতির জন্যে প্রকাশ্যে সামাজিক বিচার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কাজ নয়। সহমর্মিতার অভাবই প্রকাশ পায় কেবল।

একাকিত্ব

একাকিত্ব কাম্য নয়। সঙ্গ যখন প্রয়োজন, কারও উষ্ণ অস্তিত্ব, পরিচিত কণ্ঠস্বর যখন প্রত্যাশিত, তখন হিমশীতল একাকিত্বে নিজেকে নিক্ষেপণ বড় বেশি যন্ত্রণার। তবু আসে এই একাকিত্ব। পঙ্গু করে আমাদের অনুভব, বেঁচে থাকার স্পৃহা, স্বপ্ন দেখার বাসনা। নিজেকে যতই কেন না সবচেয়ে ভালোবাসি আমরা, আত্মপ্রেম ও প্রায় অবধারিতভাবে অন্যের আগ্রহ, অন্যের মনোযোগ নিজেতে আবিষ্কারের মাধ্যমেই। যেই মুহূর্তে মানুষ মনে করে, তার জন্যে ভাবনার কেউ নেই, তার সঙ্গলাভে কেউ উন্মুখ নয়, তার প্রয়োজনে বা বিপদে পাশে এসে কেউ দাঁড়াবে না, সে মুহূর্তে জীবনের সকল আনন্দ ঝরে পড়ে। একাকিত্ব মানুষের আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে। মানুষকে জীবনবিমুখ করে তোলে। ঘড়ির কাঁটা তখন খুব ধীরে চলে, সেকেন্ডের শব্দ উচ্চস্তরে বাজে। সূর্যের উত্তাপ তখন খুব প্রখর মনে হয়; শালিকের কিচিরমিচির থামতেই চায় না আর, বাথরুমের আধখোলা কলের গড়িয়ে পড়া জলের শব্দ তখন অসহনীয় একটানা কানে বাজে। টেলিফোনের পাশে উন্মুখ কর্ণদ্বয় কলের গানে তন্ময় হতে পারে না। পুরোনো ও পঠিত চিঠি বারবার পড়ে লোকে— অ্যালবামের পাতা চোখের সামনে খুলে ধরে। প্রিয় বইয়ের পাতা উল্টিয়ে মনোযোগ দিয়ে পুনরায় পড়ার চেষ্টা চলে। একটানা বৃষ্টির শব্দ শোনে, ফাল্গুনী হাওয়ায় গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কলম, কালি, রং, ক্যানভাস, ফুলের চারা, কুঁড়ি বড় বেশি প্রিয় হয়ে ওঠে তখন, মানুষ যখন একা হয়ে পড়ে। তানপুরা, হারমোনিয়ম অথবা তবলায় টুংটাং টোকা পড়লেও, ধুলিই জমে কেবল। নিত্যব্যবহারে তারা চকচকে হয়ে ওঠে না। তখন সন্ধ্যায় ঘরে আঁধার জমলেও আলো জ্বলে দেরিতে, খাবারে অরুচি অথবা নিষিদ্ধ খাবারে দুর্বার আগ্রহ বেড়ে যায়; অসময়ে ঘুম আসে অথচ গভীর রাতে চোখ খোলা। জানলার বাইরের গাছগাছালির ঝিরঝিরে পাতার ছায়া এলোমেলো হাওয়ায় পূর্ণিমার আলোতে ঘরের মেঝেতে খেলা করে।

একাকিত্ব মানুষকে কাবু করে, পরাজিত করে, কাতর করে, দুর্বল করে তোলে। জীবনের শুভ ও সুন্দর দিকগুলো হঠাৎ করে আড়াল হয়ে যায় তখন, ‘গভীর কষ্ট, বঞ্চনা আর হতাশা প্রবলভাবে গ্রাস করে। রাতের দৈর্ঘ্য প্রলম্বিত হয়। সকালে উঠতে কষ্ট। শরীরে ব্যথা, মাথায় যন্ত্রণা, সব কিছু কীরকম অর্থহীন— নিরানন্দ। মৃত্যু যদি জীবনের অন্তিম মুহূর্ত হয়, একাকিত্ব জীবনের নিঃশেষিত মুহূর্ত। হৃৎপিণ্ডের ধুপধাপ না থেমেও জীবন যখন নিথর হয়ে আসে— সব আলো নিভে যায়— যন্ত্রণায় নীল হয় তখন মানুষ, শিরা-উপশিরায় উষ্ণ বহমান রক্তধারা নিয়েও। সান্ত্বনা শুধু একটাই। একাকিত্ব স্থায়ী হয় না। স্বাভাবিক মানুষ কোনও না কোনওভাবে ব্যক্তি, বস্তু, নেশা, শখ অথবা বিনোদনে এ একাকিত্ব একদিন কাটিয়ে ওঠেই। জীবন এগিয়ে চলে এভাবেই।

নিভৃতির অভাব ও একাকিত্বের যন্ত্রণা নারী এককভাবে যতটা অনুভব করে, পুরুষ হয়তো তা করার সুযোগ পায় না। নারীর শারীরিক গঠন, বিকাশ ও প্রকৃতির জন্যেও তার জীবনের প্রায় প্রতিটি দশকেই কোনও না কোনওরকম নিভৃতির প্রয়োজন হয়। বয়ঃসন্ধির নানান পরিবর্তন—যথা স্তনের আবির্ভাব ও ঋতুস্রাব, পোশাক পালটানো, স্নান করা, প্রেমের অনুষঙ্গ, স্বামী সোহাগ, সহবাস ও তার ঠিক পরবর্তী পর্যায়, গর্ভকাল, সন্তান প্রসব, স্তন্যদান, ঋতুবন্ধ— প্রতিটি পদেই নারী সংসার আর সমাজের কোলাহল থেকে একটু নিভৃতি খোঁজে। খুঁজে হন্যে হয়। পায় না। নিভৃতি খোঁজে সে ঘর-সংসার, রান্না, আত্মীয়-পরিচর্যা আর বিবিধ লৌকিকতা কর্তব্যের পর নিজের কথা আলাদা করে একটু ভাবার জন্যেও। সে সুযোগও হয় না।

আর একাকিত্ব সবসময় মনুষ্য-পরিজনের অনুপস্থিতিই নয়। এটা যতটা না পারিপার্শ্বিকতার, ততটা বোধের। সাগরের অসীম জলরাশিতে অবস্থান করেও ডুবে যাওয়া জাহাজের নাবিক যেমন পিপাসার্ত, অনেক নারীই সহস্রের সান্নিধ্যে থেকেও সারাজীবন তেমনি একাকী ঘুরে বেড়ায়। জনারণ্যে এক নারী প্রার্থিত সঙ্গ খোঁজে। তবে এরই ভেতর— সমগ্র নারীকুলের ভেতর—একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে যদি আলাদা করে চিহ্নিত করতে হয়, যাদের একাকিত্বের বোঝা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি ভারী অথচ যার সন্ধান মেলে না অথবা যা দৃশ্যমান হয় না প্রাত্যহিক জীবনে। যাদের স্বাবলম্বিতা, স্বাধীন চিত্ত ও সাহস তাদের অনুভূতির জগতটাকে পার্থিব নানান উপকরণ দিয়ে আড়াল করে রাখে, সে সম্প্রদায় যত শিক্ষিত, কর্মজীবী, বিবাহিত, শহুরে নারী (শিকবিশনা)। এই শিকবিশনাদের সোজা হয়ে পথ চলা, পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রচেষ্টা, আবার একইসঙ্গে ঘর-সংসার, স্বামী, সন্তান ও সামাজিক লৌকিকতার বিষয়ে নজর দেওয়া এতখানিই ক্লান্ত করে যে নিজেদের একাকিত্বের কথা তাদের আলাদাভাবে ভাবারও সবসময় অবসর হয় না। তাদের মানসিক চাহিদা, একাকিত্ববোধ, বিনোদন বা আড্ডার প্রয়োজনীয়তা পুরোপুরি অস্বীকৃত যদি নাও হয়, অধিকাংশ সময়েই তা সীমিত থাকে বা মেটানো হয় নিজের বা স্বামীর কর্মোপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে—কর্মসংক্রান্ত লোকজনের সঙ্গে। শিকবিশনাদের যে ব্যক্তিগত বন্ধুর প্রয়োজন হতে পারে, ব্যক্তি, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাদের ভাবনার আদান- প্রদানের যে স্পৃহা রয়েছে, তাদেরও যে নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ ভালোলাগা মন্দলাগার বিষয়গুলো সমমনা লোকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করার ইচ্ছে জাগতে পারে, সেরকম সম্ভাবনা বা বাস্তবতাকে অনেকেই মানতে পারে না।

অশিক্ষিত শহুরে বা গ্রাম্যবধূ যার বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচিতি খুবই কম, জীবন থেকে যার প্রত্যাশা নগণ্য, যে প্রাত্যহিক দুঃখ-কষ্ট অপমানের ভার বিনা দ্বিধায় প্রতিবেশিনীর সঙ্গে খোলাখুলি ভাগাভাগি করে, প্রয়োজনে কান্নাকাটি করে লাঘব করতে পারে, তার সঙ্গে শিকবিশনাদের তুলনা হয় না। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সঙ্গে পরিচয়ই শেষোক্ত সম্প্রদায়কে ক্রমাগত একাকী ও কোণঠাসা করে দেয়। জীবনের চেহারা অন্যরকম এবং উন্নততর হতে পারে এ সম্পর্কে ধারণা রয়েছে তাদের, সে জীবন আস্বাদের পদ্ধতিও জানা রয়েছে, তবু সবসময় সেখানে পৌঁছোতে পারে না তারা।

শিক্ষিত কর্মজীবী বিবাহিতা নারী তার একাকিত্বের কথা পুরুষ বন্ধু বা সহকর্মীকে বলতে দ্বিধান্বিত। নানান জটিলতা, ভুল বোঝাবুঝি ও মানসিক চাপ সৃষ্টি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা সেখানে। আর অনুভবটা উভয় পাক্ষিক না হলে মেয়েদের কাছে বলতে গেলেও নিজের ব্যর্থতাই প্রমাণিত হয়—সহানুভূতির নামে পাওয়া যায় করুণা। কেন না এ সম্প্রদায়ের একাকিত্ব সমাজ স্বীকৃত নয়। অনেকেই ধারণা করতে পারে না মানসিক নির্ভরতার জন্যে শিকবিশনারাও খুঁটি খোঁজে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাবলম্বিতা এবং স্বাধীনতা অর্জন করার পরও তারা যে অন্য সকল স্বাভাবিক মানুষের মতোই স্নেহের, আদরের, মনোযোগের কাঙাল এ কথা অনেকেই ভুলে যায়!

আমার মনে আছে, আমার ছেলেমেয়েরা দুটোই তখন ছোট। আমার মাতৃতুল্য মেজদি আমার অন্য বোনদের ছেলেমেয়েদের জন্যে নিজের হাতে রাত জেগে জেগে উলের সোয়েটার, মোজা, টুপি বুনে আমারই হাতে তাদের কাছে পৌঁছে দিত। আশ্চর্য, দিদির একবারও মনে হত না আমার সন্তানদের কথা। কেন না ওর ধারণা আমার বাচ্চারা ভালো এবং দামি শীতের পোশাক পরতে পারে। ওদের ঘরে-বোনা উলের সোয়েটারের প্রয়োজন নেই. অথচ দিদি জানে না জীবনে বহু সুন্দর পোশাক পরার পরও আমি ছোটবেলায় মার হাতে এম্ব্রডারি করা গোলাপি অর্গেন্ডির সেই জামাটার কথা আজও ভুলতে পারি না। আমার চার বা পাঁচ বছর বয়সে আমাকে ও ছোড়দিকে দুটো অর্গেন্ডির জামা নিজের হাতে বানিয়ে দিয়েছিল মা। আমারটায় গোলাপির গায়ে ছিল বিভিন্ন রঙের সুতো দিয়ে কাজ করা একটা মুরগি, যার হাতে আধখোলা একখানা ছাতা। আর ছোড়দির জামাতে ছিল একটি ফুলের পাশে উজ্জ্বল এক প্রজাপতি। আমি আজও চোখ বুজলেই মায়ের উষ্ণ স্নেহের স্পর্শ অনুভব করি। মুরগি আর ছাতাসহ সেই অর্গেন্ডির গোলাপি জামা স্পষ্ট চোখে ভাসে। জামার গায়ে আজও যেন লেগে আছে মায়ের পরিচিত গন্ধ।

শিক্ষিত, কর্মজীবী, বিবাহিত, শহুরে পুরুষদের মতো শিকবিশনাদের না আছে কোনও স্থায়ী ক্লাব, না আছে কফি হাউস, চায়ের দোকান অথবা রাত করে রাস্তায় দল বেঁধে ঘুরে বেড়াবার ব্যবস্থা। এই রাজধানীতে শিকবিশনারা শুধু পড়ার জন্যে, কান্নার জন্যে, মৃত্যুর জন্যেই নয়, নেহাত একাকিত্ব ঘোচানোর জন্য, প্রিয় সঙ্গী বা সঙ্গীদের সঙ্গে নির্মল সময় কাটানোর জন্যে নিজের বাড়ির বাইরে একটা জায়গা খুঁজছে। এ জায়গায় বসে তারা চা খাবে, গল্প করবে, হাসবে, পরস্পরের কাঁধে মাথা রেখে চোখের জল ফেলবে, তাস খেলবে, গান শুনবে, গলা ফাটিয়ে তর্ক, ঝগড়া, আলোচনা করবে। কোথায় সে জায়গা?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *