নিন্দা-তত্ত্ব

নিন্দা কাকে বলে জিজ্ঞাসা করলেই লোকে বলে, পরের নামে দোষারোপ করাকে নিন্দা বলে। লোকে তাই বলে বটে, কিন্তু লোকে তাই মনে করে না। কে এমন আছে বলো দেখি যে, সে তার জীবনের প্রতিদিনই পরের নামে দোষারোপ না করে? পর যত দিন দোষ করতে ক্ষান্ত না হবে, তত দিন দোষারোপের মুখ বন্ধ হবে না। যে হিসেবে সকল মানুষই স্বার্থপর, সে হিসেবে সকল মানুষই নিন্দুক। প্রতি মানুষের জীবনের সমস্ত কাজ তুমি রাশীকৃত করে পরীক্ষা করে দেখো, দেখবে, যে খনিতে জন্মেছে তার গায়ে তার মাটি লেগে থাকবেই থাকবে। স্বার্থ যখন স্বার্থপরতার সাধারণ সীমা ছাপিয়ে ওঠে, তখনই আমরা তাকে স্বার্থপরতা বলি। নিন্দাও ঠিক তাই।

যদি বল যে, মিথা দোষারোপ করাকেই নিন্দা বলে, তা হলে নিন্দার অর্থ অসম্পূর্ণ থেকে যায়! মিথ্যা নিন্দা নিন্দার একটা অংশ মাত্র। কে না জানে, এমন অনেক সময় আসে, যখন পর-নিন্দা শোনবার কষ্ট আমাদের নীরবে ধৈর্য ধরে সহ্য করতে হয়, কেননা আমাদের কোনো কথা বলবার থাকে না, নিন্দুক ব্যক্তি প্রতি মুহূর্তে বলছে “সত্য কথা বলছি, তার আর কী!’ কিন্তু সে সহস্র সত্য কথা বলুক-না কেন, তবুও নিন্দুক বলে তার উপর কেমন এক প্রকার ঘৃণা জন্মে।

কিন্তু কেন? সত্যি কথা বলছে, তবু কেন তাকে নিন্দুক বল? তার একটা কারণ আছে। সত্য হোক, মিথ্যা হোক, আমরা উদ্দেশ্য বুঝে নিন্দার নিন্দা করি। সকলেই স্বীকার করেন পরের প্রশংসা করা মাত্রকেই খোশামোদ বলে না। যখন কারও সদ্‌গুণ দেখে আমাদের উচ্ছ্বসিত হৃদয় থেকে প্রশংসা বেরোয় তখন, অবিশ্যি তাকে কেউ খোশামোদ বলে না। কিন্তু যখন তুমি তোমার নিজের স্বার্থ বা অন্য কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রশংসা কর, সে প্রশংসা সত্য হলেও তাকে খোশামোদ বলে। নিন্দার সম্বন্ধেও ঠিক এই কথাগুলি খাটে। তুমি একজনের কুকার্য দেখে ঘৃণায় অভিভূত হয়ে যদি বজ্রকণ্ঠে তার বিরুদ্ধে তোমার স্বর উত্থাপন কর, তা হলে নিন্দিত ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ তোমাকে নিন্দুক বলবে না। কিন্তু যখন দেখছি নিন্দা করতে আমোদ পাচ্ছ বলে তুমি নিন্দা করছ, কাল যদি পৃথিবীতে সমস্ত কুকার্য রহিত হয় তা হলে তোমার জীবনের সুখের একটা উপাদান বিনষ্ট হয়, তা হলে তুমিও হয়তো অকাতরে তাদের সঙ্গে সহমরণে যাবার আয়োজন করতে পারো, তখন তুমি যুধিষ্ঠিরের চেয়ে সত্যবাদী হও-না-কেন, নিন্দুক বলে আমি তোমার সঙ্গে কথাবার্তা রহিত করি। যখন তুমি সত্য কথা বলবার জন্য নিন্দা কর না, কেবল নিন্দা করবার জন্য সত্য কথা বল, তখন তোমার সে সত্য কথা নীতির বাজারে মিথ্যা কথার সমান দরেই প্রায় বিক্রি হবে। অতএব নিন্দার যদি একটা বাঁধাবাঁধি ব্যাখ্যা স্থির করতে যাও, তা হলে বলা যেতে পারে যে, বিনা উদ্দেশ্যে বা হীন উদ্দেশ্যে পরের নামে সত্য বা মিথ্যা দোষারোপ করাকে নিন্দা বলে।

পরের নামে দোষারোপ করতে ও পরের নিন্দা শুনতে সাধারণত লোকের কেন অত ভালো লাগে? এক-এক সময়ে ভেবে দেখতে গেলে আশ্চর্য হতে হয়। মানুষের মনে সৌন্দর্যপ্রিয়তা সর্বদাই জেগে রয়েছে। বীভৎস-আবর্জনা-রাশি দেখতে তো আমাদের আমোদ বোধ হয় না, তবে পরের নিন্দে শুনতে কেন অত তৃপ্তি? অনেক দূর পর্যন্ত অনুসন্ধান করে এর মূল দেখতে গেলে আত্মশ্লাঘায় গিয়ে পৌঁছিতে হয়। নিন্দে শুনলে অলক্ষিত ভাবে আমাদের মনে হয় যে, আমি হলে এ কাজটা করতেম না, কিংবা আমি যে দোষ করে থাকি, অমুক লোকেরও তা আছে, অমুক লোকের চেয়ে আমি ভালো কিংবা আমি একলাই কেবল দোষী নই, এই দুটো কথা অজ্ঞাতসারে আমাদের মনে এক প্রকার গর্ব-মিশ্রিত তৃপ্তি জন্মিয়ে দেয়। সকল মানুষের মনেই সৌন্দর্যপ্রিয়তার ভাব রয়েছে বটে, কিন্তু শিক্ষা ও চর্চায় যে তার উন্নতি হয়, সে বিষয়ে তো আর কোনো সন্দেহ নেই। তুমি হয়তো চর্মচক্ষে একটা কুশ্রী জিনিস দেখতে পার না, কিন্তু তোমার হয়তো সৌন্দর্যপ্রিয়তা এত দূর প্রস্ফুটিত হয় নি, যে কুগুণ কুনীতির মতো একটা নিরাকার পদার্থের অসৌন্দর্য বা কুশ্রীত্ব তোমার মনে তেমন আঘাত দেয়। সুশিক্ষার গুণে সৌন্দর্যপ্রিয়তা যখন তোমার মনে যথেষ্ট বিকসিত হবে, তখন একটা কদাচরণের কথা শুনলে ঘৃণায় তোমার গা শিউরে উঠবে কিংবা লজ্জা ও সংকোচে তোমার মাথা হেঁট হয়ে যাবে বটে কিন্তু সেই কথা শুনে তোমার আমোদ বোধ হবে না, বা সেই কথা নিয়ে অবকাশের সময় বৈঠকখানায় বসে দশ জনের কাছে দশটা রসিকতা ও হাস্য-পরিহাস করতে রুচি হবে না। কিন্তু সৌন্দর্যের ভাব কজন লোকের মনে এমন প্রস্ফুটিত?

নিন্দা বিশ্বাস করবার দিকে আমাদের কেমন একটা টান আছে। একটা নিন্দা শুনলে আমরা প্রায় তার প্রমাণ জিজ্ঞাসা করি নে, আসল কথা হচ্ছে জিজ্ঞাসা করতে চাই নে। বোধ হয় আমাদের মনে মনে এক প্রকার সূক্ষ্ম ভয় থাকে, পাছে তার ভালো প্রমাণ না থাকে। নিন্দা বিশ্বাস করবার দিকে সাধারণের এত অনুরাগ যে, চণ্ডীমণ্ডপের বিচারালয়ে নিন্দিত ব্যক্তি অপেক্ষা নিন্দুকের সাক্ষী অধিকতর প্রামাণ্য বলে গৃহীত হয়। তুমি রাধামাধবের নামে আমার কাছে একটা দোষোত্থাপন করলে, আমি কোনো প্রমাণ না জিজ্ঞাসা করেও তা বিশ্বাস করলেম, তার পরে রাধামাধব যদি বলতে আসে যে, আমি কোনো দোষ করি নি, তা হলে আমি হয়তো প্রমাণ না পেলে তা ঝট্‌ করে বিশ্বাস করি নে। নিন্দিত ব্যক্তির অত্যন্ত সংকটের অবস্থা। আমরা সহজেই মনে করি, যে দোষী ব্যক্তি তো স্বভাবতই আপনার দোষ ক্ষালন করতে চেষ্টা পাবেই। সুতরাং আমরা তার কথায় কান দিই নে। অনেক সময়ে “দোষ করি নি’ ছাড়া আমাদের আর কিছু বক্তব্য থাকে না, আমরা অনেক সময়ে বিশেষ কতকগুলি গোপনীয় কারণে নির্দোষিতার প্রমাণ থাকতেও তা আমরা প্রমাণ করতে পারি নে। এ রকম অবস্থায় দায়ে পড়ে “দশচক্রে ভগবান ভূত’ হয়ে পড়েন। আমরা যে নিন্দা বিশ্বাস করতে ভালোবাসি তার আর-একটা প্রমাণ এই যে, মনে করো হরিহর রামধনের নামে তোমার কাছে একটা নিন্দা করেছে, তুমি সেটা বিশ্বাস করেছ ও সেই অবধি পরম আমোদে আছ, এবং দু-দশ জন বন্ধুর কাছে গল্প করেছ; আমি যদি আজ এসে তোমাকে বলি যে, হরিহর লোকটা অত্যন্ত নিন্দুক, তার কথা বিশ্বাস করবার যোগ্য নয়, তা হলে তুমি কোনোমতে তা বিশ্বাস কর না, তুমি বলো, “না, না, তা কি হয়? লোকটা কি একেবারে খাঁটি মিথ্যে কথা বলতে পারে?’ কী আশ্চর্য! হরিহরের মুখে তুমি যখন রামধনের নিন্দের কথা শুনেছিলে, তখন তো তুমি প্রশংসনীয় উদারতার সঙ্গে বল নি যে, “না, না, তা কি হয়! সে লোকটা কি এমন কাজ করতে পারে?’ একটা নিন্দা তুমি অতি সহজে গলাধঃকরণ করলে, কিন্তু আর-একটা সেই শ্রেণীর নিন্দেই কেন তোমার গলায় হঠাৎ বাধল? এর কারণ অবশ্য সকলেই বুঝতে পারছেন। তিনি পরম আনন্দে একটি সুস্বাদ নিন্দা উপভোগ করছিলেন, আর তুমি কি না আর-একটি নীরস নিন্দা তাঁর হাতে দিয়ে সেটি তাঁর মুখ থেকে কেড়ে নিতে চাও? যে নিন্দুকের মুখ থেকে তিনি অমৃত পান করেন, তাকে তুমি আর যা খুশি বলে নিন্দে করো, কিন্তু মিথ্যেবাদী বলে খবরদার নিন্দে কোরো না, তা হলে তুমিই মিথ্যেবাদী হয়ে দাঁড়াবে।

বিশ্বাস-পরায়ণতা মনের সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থা। যাঁরা পরনিন্দা শুনলে অতি সহজেই তা বিশ্বাস করেন, তাঁদের হয়তো তুমি বিশ্বাস-পরায়ণ বলবে। আমি তো ঠিক তার উল্টো বলি। যেমন তুমি যখন বল, আমি চার দিক অন্ধকার দেখছি, তখন তার অর্থ বোঝায়, আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি নে, অর্থাৎ অন্ধকার দেখা, কিছু না-দেখার ভাষান্তর মাত্র, তেমনি নিন্দা-বিশ্বাসিতা, অবিশ্বাসিতার অন্য একটি নাম। তুমি দেখতে পাবে, সন্দিগ্ধ ও কুটিল হৃদয়েরাই নিন্দা নিয়ে লেনা-দেনা করে থাকেন। তুমি যথার্থ সরল ও অসন্দিগ্ধচিত্ত ব্যক্তির কাছে কারও নিন্দা উত্থাপন করো, তিনি বলে উঠবেন, “না, না, এমনও কি মানুষে করতে পারে।’ মানুষের চরিত্রের উপর তাঁর এত বিশ্বাস যে, তিনি, কেহ যে খারাপ কাজ করেছে, তা শীঘ্র বিশ্বাস করতে পারেন না। মনে করো, তোমার এক পরিচিত ব্যক্তি অত্যন্ত ধার্মিক, তাঁকে তুমি প্রত্যহ দুই সন্ধে দেবপূজা করতে দেখ, আমি তোমাকে একদিন কানে কানে ফুসফুস করে বললেম যে, চক্রবর্তীমশায় বৃহস্পতিবারে গোমাংস খেয়েছেন, অমনি তুমি তা বিশ্বাস করলে; তুমি কতদূর সন্দিগ্ধহৃদয় বলো দেখি! তুমি প্রত্যহ নিজের চক্ষে তাঁর ধার্মিকতার প্রমাণ পাচ্ছ, আরেকদিন একটা কানে কানে কথা শুনেই সে-সমস্ত তুমি অবিশ্বাস করলে? চণ্ডীমণ্ডপে গুটিপাঁচেক বৃদ্ধ গৃহস্বামী বসে ধূম-সেবন করছেন, চাণক্যের শ্লোক পাঠ করে ও বয়ঃপ্রাপ্তি অবধি চণ্ডীমণ্ডপের তাম্রকূটধূমাচ্ছন্ন ও নস্যগন্ধী পর-চর্চা শুনে সংসারের বিষয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা অসাধারণ পক্বতা প্রাপ্ত হয়েছে; রামশংকর খুড়ো তাঁদের এসে বললেন যে, মণ্ডলদের বাড়ির ছোটো বউ সমাজ-বিরুদ্ধ কাজ করেছে, তাঁরা অতি অল্প পরিশ্রমে সমস্ত সিদ্ধান্ত করে মহা বিজ্ঞভাবে বললেন যে, “কিছু আশ্চর্য নয়, কারণ, “বিশ্বাসং নৈব কর্তব্যং স্ত্রীষু রাজকুলেষু চ”।’ তাই তো বলি, নিন্দা বিশ্বাস করা সন্দিগ্ধ হৃদয়ের লক্ষণ। তবে কেউ কেউ আছেন, যাঁরা দূর অপেক্ষা আশু, অনুপস্থিত অপেক্ষা উপস্থিত, ও নিজের চোখের দেখা অপেক্ষা পরের মুখের কথা অধিক বিশ্বাস করেন। এখন তুমি তাঁকে একটি খবর দেও, তা বিশ্বাস করতে তাঁর যত পরিশ্রম ও সময় ব্যয় হবে, দু ঘণ্টা পরে আর-এক জন ঠিক তার বিপরীত খবর দিলে, তা বিশ্বাস করতে তাঁর তার চেয়ে কিছু অধিক হবে না। এমন লোকের শিশু-প্রকৃতির একটা ঘোরতর ভ্রমের ফল। এ দলের সম্বন্ধে আমার অধিক কিছু বক্তব্য নেই। নিন্দা অবিশ্বাস করবার ঝোঁক অনেকটা শিক্ষা ও অভ্যাস -সাপেক্ষ। এ বিষয়ে বিশেষ অভ্যাস ও বিবেচনা আবশ্যক। যে নিন্দা শুনলে তোমার মনে কষ্ট হয়, তা তুমি না বিশ্বাস করতেও পার, কিংবা যে নিন্দায় তোমার কষ্ট বা সুখ কিছুই না জন্মায়, তা তুমি বিশেষ প্রমাণ না পেলে অবিশ্বাস করতে পার, কিন্তু স্বার্থজড়িত কতকগুলি বিশেষ কারণে যে নিন্দা শুনলে তোমার আমোদ জন্মাবার সম্ভাবনা, তা বিশেষ প্রমাণ না পেয়ে বিশ্বাস না করা শিক্ষিত মনের লক্ষণ। আর-এক অবস্থায় আমরা নিন্দা অতি সহজে বিশ্বাস করি। আমরা একজন লোককে খারাপ বলে জানি, তার নামে একটা নিন্দা শুনবামাত্রেই আমরা অনায়াসে বিশ্বাস করি, আমরা মনে করি এটা কিছুই অসম্ভব নয়। সুতরাং আমরা তার আর প্রমাণ জিজ্ঞাসা করি নে কিন্তু শিক্ষিতমনা ব্যক্তিরা তখন বলেন যে, “সমস্ত সম্ভব ঘটনা পৃথিবীতে ঘটে না।’ একটা জিনিস সম্ভব হতে পারে কিন্তু সত্য নাও হতে পারে। এক ব্যক্তি এসে যখন আমাদের কাছে একটা প্রিয়-নিন্দা উত্থাপন ক’রে বলে যে, “এইরকম তো সকলে বলছে!’ তখন আমরা আর কিছু বিচার করি নে, মনে করি “সকলে বলছে’, এর চেয়ে সুদৃঢ় প্রমাণ আর কিছুই হতে পারে না! কিন্তু, এই “সকলে বলছে’ কথাটি অত্যন্ত শূন্যগর্ভ। একজন তোমাকে এসে বললেন, সকলে বলছে অমুকে অমুক কাজ করেছে। সেখেনে “সকলে’ অর্থে তিনি যে ব্যক্তির মুখে শুনেছেন, তুমি তাঁর ধুয়ো ধরে আমাকে বললে যে, সকলে অমুক কথা বলছে। আমি অকাতরে বিশ্বাস করি যে, যখন “সকলে বলছে” তখন অবিশ্যি সত্যি! আমাকে একজন এসে যদি জিজ্ঞাসা করে যে, “তুমি যে বলছ “সকলে বলছে’, আচ্ছা, কে কে বলছে বলো দেখি?’ আমি ভেবে ভেবে একজনের বেশি নাম করতে পারি নে, অবশেষে অপ্রস্তুত হয়ে আমি তোমাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি– “ওহে, কে কে বলছে বলো দেখি?’ তুমিও তথৈবচ। মূল অন্বেষণ করতে যতদূর পর্যন্ত যাও-না কেন, দেখবে তোমার চেয়ে এ বিষয়ে কারও জ্ঞান অধিক নয়। “সকলে বলছে’ কথাটা একটা সংক্রামক পীড়া। প্রথমত একজনের মুখ থেকে কথাটা বেরোয়, তার পরে দিবসান্তে সকলেরই মুখে শুনতে পাবে “সকলে বলছে।’ সকালবেলায় যে কথাটি সম্পূর্ণ অলীক ছিল, সন্ধেবেলায় সেটা সম্পূর্ণ সত্য হয়ে দাঁড়ায়। আমি একটা বিশেষ নিয়ম করেছি যে, “সকলে বলছে’ কথাটি যখনি শুনব, তখনি জিজ্ঞাসা করব “কে কে বলছে?’

শিক্ষিত ব্যক্তিরা যখন একটা নিন্দা শোনেন তখন অনেক রকম বিচার করেন। আমরা তিন রকম ব্যক্তির কাছে নিন্দা শুনি : ১| বিখ্যাত নিন্দুক অর্থাৎ যাদের আমরা নিন্দুক বলে জানি। ২| যাদের বিষয়ে আমরা কিছুই অবগত নই। ৩| যাদের আমরা সত্যবাদী বলে জানি। প্রথমোক্ত ব্যক্তিদের মুখ থেকে যখন শিক্ষিতমনা ব্যক্তি কোনো নিন্দা শোনেন তখন তা অবিশ্বাস করতে তাঁর বড়ো পরিশ্রম হয় না। দ্বিতীয়োক্ত ব্যক্তির মুখ থেকে যখন শোনেন তখন তাঁর একটা ভাবনা আসে; হয়তো মনে করেন যে, “এ লোকটার কথা অবিশ্বাস করবার আমার কী অধিকার আছে?’ কিন্তু এ ভাবনা কোনো কাজের নয়, কেননা তখন আমাদের দুটো বিরোধী কর্তব্যের সংঘর্ষ উপস্থিত হয়। আর-এক জনের সচ্চরিত্রে অবিশ্বাস করবার আমার কী অধিকার আছে? এ রকম অবস্থায় তিনি বিশ্বাসও করেন না অবিশ্বাসও করেন না। বিশ্বাস ও অবিশ্বাস দুইয়েরই অধিকার-বহির্ভূত একটি দাঁড়াবার স্থান আছে। তিনি তখন সে নিন্দুককে বলেন যে, “তোমার কথা সত্য হতে পারে, কিন্তু যতক্ষণ প্রমাণ না পাব ততক্ষণ তা বিশ্বাস করব না।’ কিন্তু তৃতীয়োক্ত ব্যক্তির মুখে যখন তিনি নিন্দা শোনেন তখন তিনি যে-সকল যুক্তি অবলম্বন করেন সে বিষয় পরে বলছি।

যাকে তিনি নিন্দুক বলে জানেন তার মুখ থেকে কোনো নিন্দা শুনলে তিনি এই-সকল বিবেচনা করেন যে, “প্রথমত এ ব্যক্তির কোনো অভিসন্ধি থাকতে পারে, কিংবা নিন্দার অভ্যাস থাকা বশত নিন্দা করছে। দ্বিতীয়ত, একটা সত্য কথার কিয়দংশ বাদ দিলে তা মিথ্যে হয়ে দাঁড়ায়, তুমি আমাকে এসে বললে যে, অমুক মদ খেয়েছে, কিন্তু তুমি হয়তো বাদ দিলে যে, তাকে ডাক্তারেরা মদ খেতে পরামর্শ দিয়েছিল; তুমি সত্য কথা বললে বটে কিন্তু এ মিথ্যার রূপান্তর মাত্র, অতএব একটা কথার সমগ্র না শুনলে সে বিষয়ে বিচার করা যায় না। যাঁকে তিনি সত্যবাদী বলে জানেন তাঁর কাছ থেকে যখন তিনি কোনো নিন্দা শোনেন, তখন তিনি প্রথমত মনে করেন, “ইনি হয়তো একটা গুজব শুনে তাই বিশ্বাস করছেন। বিশ্বাস করবার কী কারণ জানি না, কিন্তু হয়তো সে কারণগুলি ভ্রমাত্মক।’ দ্বিতীয়ত, “ইনি হয়তো কতকগুলি কার্য দেখে একটা নিজের অনুমান করে নিয়েছেন, সে কার্যগুলি সমস্ত সত্য হতে পারে কিন্তু সে অনুমানটা হয়তো সমস্তই অমুলক।’ তৃতীয়ত, “তিনি হয়তো তাঁর নিজের কতকগুলি বিশেষ সংস্কারবশত একটা কাজ এমন খারাপ চক্ষে দেখছেন যে, তার তিল-প্রমাণ দোষ স্বভাবতই তাঁর সুমুখে তাল-প্রমাণ আকার ধারণ করছে।’ চতুর্থত, অনেক সময় অনেক জিনিস যা আমাদের কল্পনায় সত্য বলে প্রতিভাত হয়, তা আসলে সত্য নয়। মনে করো, একজন হিন্দু একদিন রবিবারে গির্জে দেখতে গিয়েছেন, সেইদিনকার বক্তৃতায় পাদ্রি সাহেব দৈবক্রমে Heathen-দের বিরুদ্ধে দুই-এক কথা উল্লেখ করেছিলেন। সেই হিন্দু কল্পনা করলেন যে, পাদ্রি তাঁর প্রতি লক্ষ্য করেই ওই বক্তৃতাটি করেন। এই কল্পনায় তাঁকে এমন অভিভূত করে তুললে যে, তাঁর মনে হল, যেন, বক্তা একবার তাঁর দিকে বিশেষ করে চেয়ে দেখলেন ও সেই সময়েই Heathen কথাটা বিশেষ জোর দিয়ে বললেন। সেই হিন্দুটি সত্যবাদী হতে পারেন, পাদ্রি যে সেদিন হীদেনদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করেছিলেন সে বিষয়ে আমি তিল মাত্র সন্দেহ করি নে, কিন্তু তিনি যে তাঁর দিকে চেয়ে হীদেন কথাটি বিশেষ জোর দিয়ে বলেছিলেন, সে বিষয়ে আমার ঘোর সন্দেহ রয়ে গেল। এইরকম কত শত বিচার করবার জিনিস রয়েছে। আমার কাছে একবার একজন আমার এক পরিচিত ব্যক্তির নামে নিন্দা করেন, আমি তা বিশ্বাস না করাতে তিনি বলেন যে, তিনি সেই ব্যক্তির এক বাড়ির লোকের কাছে শুনেছেন। আমি তাঁকে বললেম, “তাতে বিশেষ কিছুই প্রমাণ হচ্ছে না। বাড়ির লোক বলেছে বলে বিশ্বাস করবার একটা প্রধান প্রমাণ দেখাচ্ছ এই যে, বাড়ির লোক কখনো তার আত্মীয়ের নামে নিন্দা করে না। আচ্ছা ভালো। কিন্তু যখন দেখছ, এক-একটা “বাড়ির লোক” তার “বাড়ির লোকের” নামে নিন্দা করছে, তখন তার বাড়ির লোকত্ব পরলোকত্ব প্রাপ্ত হয়েছে! খুব সম্ভব, নিন্দিত ব্যক্তির সঙ্গে তার কোনো কারণে মনান্তর হয়েছে, তা যদি হয়ে থাকে তবে তার নামে অলীক অপবাদ রটাতে আটক কী? বাড়ির লোক যখন তার আত্মীয়ের নিন্দা করে, তখন তাকে আমি সর্বাপেক্ষা কম বিশ্বাস করি।’ অনেক লোক আছেন, তাঁরা পরের অনিষ্ট করব বলে নিন্দে করেন না। তাঁরা ভদ্রলোক, তাঁরা পরের মনে কষ্ট দিতে চান না। তাঁরা যখন নিন্দা করেন তখন তার ফল বিবেচনা করে দেখেন না। তাঁরা কৃষ্ণকান্তবাবুর নামে একটা নিন্দা শুনেছেন, তাই জহরীলালের কাছে গল্প করে বললেন, “ওহে, শোনা গেল, কৃষ্ণকান্তবাবু অমুক কাজ করেছেন।’ জহরীলালের সঙ্গে কৃষ্ণকান্তের কোনো আলাপ-পরিচয় যোগাযোগ নেই, সুতরাং হঠাৎ তাঁদের মনে ঠেকতে পারে না যে, এ নিন্দায় কোনো দোষ আছে। দৈবক্রমে দূরত তার একটা কুফল ঘটতে পারে, তা তাঁরা ভেবে উঠতে পারেন না। তা ছাড়া অনাবশ্যক কারও নিন্দা করব না, এমনও একটা নিয়ম তাঁরা বাঁধেন নি। যখন দশ জন বন্ধু দশ রকম কথা কচ্ছ, তখন জিব অত্যন্ত পিছল হয়ে ওঠে, মনের কপাট আলগা হয়ে যায়, তখন বিশেষ একটা হানি না দেখলে একটা মজার কথা সামলে রাখা তাঁদের পক্ষে দায় হয়ে ওঠে। তখন তাঁদের মনে করা উচিত যে, তাঁরা রোষে একেবারে অধীর হয়ে ওঠেন কি না? তখন তাঁরা কেন মনকে বোঝান না যে, “আমরা কেই-বা? আমাদের এক মুহূর্তের একটা কাজ একটা মানুষ কতক্ষণই বা মনে রাখতে পারবে বলো? আমরা আমাদের নিজের মনে সর্বদাই এমন জাগ্রত রয়েছি যে অন্য একটা অপরিচিত বা অল্পপরিচিত মানুষ আমাদের বিষয় কত কম ভাবে, তা আমরা ঠিক মনে করতে পারি নে!’ তখন তাঁরা কেন ভাবেন না যে “একজন অপরিচিত ব্যক্তি আমার দোষ জানলেই বা তাতে কী ক্ষতি?’

খবর দেবার বাতিক অনেক লোকের আছে। একটা নতুন খবর দিতে পারলে একজন যত গর্ব অনুভব করেন, একজন লেখক তাঁর মনের মতো রচনা শেষ করে ততটা অনুভব করেন না। খবর দেবার অতৃপ্ত পিপাসা তাঁদের একটা রোগ। এঁদের অনুগ্রহেই নিন্দার বাজারে যথেষ্ট মালের আমদানি হয়। একজনের ঘরের খবর ফাঁকি দিয়ে জানতে পারলে লোকের ভারি আমোদ হয়। তুমি পর্দার আড়ালে খেমটা নাচছ, তুমি মনে করছ আমি দেখতে পাচ্ছি নে, অথচ আমি দেখে নিচ্ছি তাতে আমাদের অত্যন্ত তৃপ্তি হয়। একটা কাজ যতই দুর্জ্ঞেয় ও গোপনীয়, তার প্রকাশ বক্তার ও শ্রোতার মনে ততই আমোদ হয়। একজন লোক একটা করতে গেল, কিন্তু আর-একটা হয়ে পড়ল; সে মনে করছে এ কাজটা গোপন রইল, অথচ সেটা প্রকাশ হয়ে পড়ল, তাতে আমাদের ভারি একটা মজা মনে হয়! হাস্যরসের বিষয়ে এমার্সন বলেছেন যে, “সমুদয় কৌতুক ও প্রহসনের মূল ও সার হচ্ছে, উদ্দেশ্যের অসম্পূর্ণতা– যা সিদ্ধ হবার কথা ছিল তার অসিদ্ধি; বিশেষত এক ব্যক্তি যখন সিদ্ধ হবার বিষয়ে উচ্চৈঃস্বরে আশা প্রকাশ করছে তখন তার নিরাশ হওয়া। বুদ্ধির অসামর্থ্য, আশার হতসিদ্ধি ও একটা কার্য-সূত্রের হঠাৎ মাঝখানে ছেদ হওয়ার নাম comedy।’ গুপ্ত নিন্দা শুনতে আমাদের এইজন্যেই ভালো লাগে। একে তো নিন্দা, তাতে আবার গুপ্ত! এইজন্যেই যারা লোকের পরিবার সংক্রান্ত কোনো খবর দিতে পারে, তারা আপনাকে কৃত-কৃতার্থ ও পূর্বজন্মের অনেক পুণ্যের অধিকারী মনে করে।

অনেকের বাড়িয়ে বলা স্বভাবসিদ্ধ। অনেক সময়ে তারা নিজে বুঝতে পারে না যে, তারা বাড়িয়ে বলছে। আমি জানি, গোবিন্দবাবুর বাড়িয়ে বলা একটা বদ্ধমূল রোগ। তাঁতে আমাতে দুজনে মিলে যা দেখেছি, তাও আমার সাক্ষাতেই আর-এক জনের কাছে এমন বাড়িয়ে বলেন যে, আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। তিনি যাকে পণ্ডিত বলে প্রশংসা করতে চান, তাকে বলেন তার মতো পণ্ডিত ভারতবর্ষে নেই, এই রকম করে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তিনি নিদেন ভিন্ন ভিন্ন পঞ্চাশ জনকে ভারতবর্ষের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম পণ্ডিতের যশ অর্পণ করেছেন। তাঁর প্রধান রোগ হচ্ছে (অনেক ঐতিহাসিকের এই রোগটি আছে।), যে একটা সত্য ঘটনা বলা তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য নয়, সেই কথাটি বলে শ্রোতার মনে তাঁর অভিপ্রেত একটি ফল জন্মিয়ে দেওয়াই তাঁর মুখ্য অভিপ্রায়। যদি তিনি অসংলগ্ন দুই-একটা কথা দৈবাৎ শুনতে পান, তা হলে নিজের ট্যাঁক থেকে দু-চারটে কথা যোগ করে সেটা সংলগ্ন করে দেন, কেননা জানেন, নইলে শ্রোতাদের মনে কোনো ফল হবে না। যদি তিনি জানতে পারেন, একটা ঘটনা একটু মুচড়ে, ইতস্তত একটু ছেঁটে-ছুঁটে দিলে শ্রোতাদের মনে অধিকতর ফল হবে, তা হলে সে পরিশ্রমটুকু স্বীকার করতে তিনি কিছুমাত্র অসম্মত নন। সর্বদাই তাঁর শ্রোতৃমণ্ডলীকে হাঁ করিয়ে রাখা, তাঁর জীবনের প্রধান চেষ্টা। “ভয়ানক’ “অসাধারণ’ “আশ্চর্য’, এই-সকল বিশেষণে তাঁর তহবিল পূর্ণ রয়েছে। এঁরা যে-সকল নিন্দা ও মিথ্যে কথা বলেন, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, দশ জনকে তাক করে দেওয়া। এঁদের দল সংখ্যায় কম নয়।

এইরূপ যেমন নানা শ্রেণীর নিন্দুক আছে, নিন্দা করবার প্রথাও তেমনি শত সহস্র। এক দল নিন্দুক আছে, নিন্দা করাই যে তাদের উদ্দেশ্য তা স্পষ্ট বোঝা যায়। কিন্তু আর-এক দল আছে, নিন্দা করা যেন তাদের বাসনা নয় এই রকম প্রকাশ পেতে থাকে। বলা বাহুল্য যে, শেষোক্ত দলই অধিকতর ফল-জনক। তাঁদের নিন্দা করবার পদ্ধতি নানাবিধ। তাঁদের নিন্দের দু-চারটে নমুনা দিই।

অনেক সময়ে নীরবে নিন্দা করা যায়। পাঁচ জনে একজনের খুব প্রশংসা করছে, তুমি সেখানে এমন রহস্যপূর্ণ ভাবে চুপ করে বসে আছ, কিংবা তোমার ঠোঁটের এক কোণে এমন এক রত্তি হাসি উঁকি মারছে, যে খানিকক্ষণ তোমার এইরকম ভাবগতিক দেখে তাদের মুখের কথা মুখে মরে আসে, তারা মনে করে তুমি না জানি তার নামে কী একটা গুপ্ত সংবাদ জান, তোমাকে পাড়াপীড়ি আরম্ভ করলে তুমি বল যে, “নাঃ, কিছু না।’ এমন স্বরে বল যে, তার অর্থ এই হয়ে দাঁড়ায় যে, “সে অনেক কথা!’ আর-এক রকম নিন্দে আছে, তাকে বাজে নিন্দে বা উপরি নিন্দে বলা যেতে পারে। সে হচ্ছে, পাঁচ কথা বলতে বলতে এক কথা বলা। রামধনবাবুর কাল রাত্রে অত্যন্ত কাশি হয়েছিল, এই গল্পটি বলবার সময় একটু সুবিধে, অবকাশ ও ছিদ্র পেলেই, সুদক্ষ নিন্দুক যেন বিশেষ কোনো কথা নয় এমনি ভাবে হরকুমার যে মদ খায় সেই কথাটা সংক্ষেপে বলে যান। গানের পক্ষে যেমন তান, গল্পের পক্ষে এরকম নিন্দাও তাই। যেমন গানের সুর ও তাল বজায় রেখে দুই-একটা বাজে তান দিলে হানি নেই, গানের সুর বিগড়ে বা তাল মাটি করে একটা অসংলগ্ন তান দিলে শ্রোতাদের কানে ভালো শোনায় না, তেমনি গল্পের তাল বজায় রেখে ঠিক জায়গায় একটা উপরি কথা তুললে শ্রোতাদের মন্দ লাগে না; এরকম স্থলে বক্তার নিন্দুক বলে বদনাম রটে না; মনে হয় পাঁচ কথা বলতে এক কথা দৈবাৎ বেরিয়ে পড়ল। বেকন-এ আছে, যে, এক-একজন বাজে কথায় চিঠি পুরিয়ে কাজের কথা পুনশ্চ নিবেদনের মধ্যে লেখেন। অনেক নিন্দুকও তাই করেন, সমস্ত কথার মধ্যে যে নিন্দাটা তাঁর বিশেষ বলা উদ্দেশ্য সেইটেকে তিনি এমন অপ্রাধান্য দিয়ে বলেন যে, মনে হয় যেন, সেটা বলবার জন্যে তাঁর বিশেষ মাথা-ব্যথা পড়ে নি। আবার অনেকে ভান করেন যেন, দৈবাৎ তিনি এক কথা বলে ফেললেন, আধখানা বলেই জিব কামড়ান, তার পরে পাড়াপীড়ির পর অতি আস্তে আস্তে সব বের করে ফেলেন। লোকে বলবে তিনি ইচ্ছে করে পারতপক্ষে কারো নিন্দে করেন নি। কেউ বা, যেন তিনি মনে করছেন যে তুমি তো জানোই, এমনিভাবে তোমার কাছে একটা কথা বলে ফেলেন; তার পরে যখন শোনেন যে, তুমি জানতে না, তখন ঘোরতর অনুতাপ আফসোস করতে আরম্ভ করেন। আবার অনেকে নিন্দে করবার সময় এইরকম ভাব দেখান যে, যেন “সকলেই এ কথা জানে, তুমি জান না, এ ভারি আশ্চর্য!’ এ-সকল নিন্দে নিন্দের নামে সংসারে গণ্য হয় না। সংসারে আর-এক প্রকারের নিন্দা আছে, তাকে আত্ম-নিন্দা বলতে গেলে সকল সময়ে বিনয় বোঝায় না। অধিকাংশ আত্ম-নিন্দা গর্ব থেকে উত্থিত হয়। তুমি সমস্ত সমাজকে উপেক্ষা করে বলতে থাকো যে, আমি পৃথিবীর নিন্দা গ্রাহ্য করি নে! আমি অমুক অমুক পাপাচরণ করেছি, এখন সমাজ! তুমি আমার কী করতে পারো করো। সমাজের উপর মহা খাপা! কেন? না সমাজের শক্তি আছে বলে। পাপাচরণ করলে সমাজ বলপূর্বক শাসন করেন বলে। সমাজের দুই-একটি আদুরে ছেলে ছাড়া আর কেউ বিপথে গেলে সমাজ তাকে স্নেহের স্বরে উপদেশ দেন না, তাকে কান ধরে সিধা পথে আনেন। আদরের ও স্নেহের দানা দেখিয়ে তিনি ছিন্ন-রজ্জু ঘোড়াকে আস্তাবলে ফেরাতে চেষ্টা করেন না, তাঁর নিয়ম হচ্ছে চাবুকের ভয় দেখানো। কিন্তু এক-একটা মানুষ আছে, যাদের মন্দ কাজ না করতে অনুরোধ করো, শুনবে, কিন্তু আদেশ করো, অমনি তার বিরুদ্ধে তারা কোমর বেঁধে দাঁড়াবে। আত্ম-নিন্দুক দলেরা অধিকাংশ এই শ্রেণীর লোক। বায়রন তার একটি বিখ্যাত আদর্শ। পর-নিন্দুকদের মতো আত্ম-নিন্দুকদের সকল কথাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। আত্মনিন্দা যখন গর্ব থেকে উত্থিত হচ্ছে, তখনও তা অনেক পীড়াপীড়িতে দায়ে পড়ে স্বীকার করা হয়, তখন যে তার অনেক কথা বাড়ানো থাকা সম্ভব, তা বলাই বাহুল্য। এইরকম সমাজের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করে তারা দুর্দান্ত বলিষ্ঠ-হৃদয় লোক। কিন্তু একটা দেখা যায়, এক ব্যক্তির সমাজ-বিদ্রোহিতা যতই বলবান হোক-না কেন, তবু এতটুকু আত্মশ্লাঘা ও নিন্দা-ভীরুতা তার মনে অবশিষ্ট থাকবে যে, কতকগুলি ছোটোখাটো দোষ সে সমাজের কাছে কোনো মতেই প্রকাশ করতে রাজি হবে না। একজন মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতে পারবে যে, সে ডাকাতি করেছে, কিন্তু চুরি করেছে স্বীকার করতে সে কুণ্ঠিত হবে। কিন্তু এমন যদি কেউ থাকে যে, তার হৃদয়ের-বীভৎসতম স্থান পর্যন্ত লোকের চক্ষে অনাবৃত করে দিতে পারে, এমন কোনো পাপ পৃথিবীতে নেই যা সে প্রকাশ্যভাবে আপনার স্কন্ধে না নিতে পারে, তবে সে নরকের এক খণ্ড। পাপ যে করে সে বিকৃত-চরিত্র, কিন্তু যে প্রকাশ্যভাবে পাপ করে সে সে-বিশেষণের অনধিগম্য। আত্ম-নিন্দা ও বিনয় কেউ যেন এক পদার্থ মনে না করেন। বাংলা এক মহাকাব্যে মহাকবি রামের মুখে অনেক স্থলে “ভিখারী’ বলে আত্মপরিচয় বসিয়েছেন। যেমন “ভিখারী রাঘব; দূতি, বিদিত জগতে!’ বোধ হয় কবি রামকে বিনয়ী করবার অভিলাষে এইরকম করে থাকবেন, কিন্তু আমরা একে বিনয় বলতে পারি নে। “আমি দরিদ্র’ এ কথা বিনয়ে বলা যেতে পারে, কিন্তু আমি ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করি এ কথা বিনয়ের কথা নয়। দারিদ্র্য দোষের নয়, কিন্তু পরমুখাপেক্ষী হয়ে ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করবার রুচি মনের একটা বিকৃত অবস্থা। কেউ কখনো আমি মিথ্যাবাদী বা আমি জুয়াচোর বলে বিনয় প্রকাশ করে না।

আত্ম-নিন্দার ছলে অনেক সময়ে আমরা আত্ম-প্রশংসা করি। একজন নানা প্রকার ভূমিকা করে বললেন যে, “দেখুন মহাশয়, আমার একটা ভারি দোষ আছে, আমি তা কোনো মতেই ছাড়াতে পারি নে, আমার যা মনে আসে আমি তা স্পষ্ট না বলে থাকতে পারি নে, আমি যা বলি তা মুখের সামনে বলি।’ একে বিনীতভাবে অহংকার করা বলে।

আমরা আর-এক সময়ে আত্ম-নিন্দা করি। আমরা যখন মনে মনে জানি আমাদের একটা গুণ আছে, আমরা তখন কখনো কখনো আমাদের সেই গুণ নেই বলে বাইরে প্রকাশ করি; তার তাৎপর্য এই যে শ্রোতা আমার কথার বিরুদ্ধে নিজের মত ব্যক্ত করুক, সেইটে আমাদের শোনবার ইচ্ছে। আমরা এক-একজনকে দেখেছি, তাঁরা বন্ধুমণ্ডলীতে “লোকটা তো বড়ো খোলাখালা!’ এই প্রশংসাটুকু পাবার জন্য আপনার কতকগুলি ছোটোখাটো দোষের কথা হাসতে হাসতে উল্লেখ করেন, তাঁর নিন্দার মূল্যে প্রশংসা ক্রয় করতে চান।

এইরকম যত আত্ম-নিন্দা দেখা যায় প্রায় দেখবে যে, বিনয়ের জমি থেকে তার চারা ওঠে নি। গর্বই তার মূল। পরনিন্দার মূলেও গর্ব, আত্ম-নিন্দার মূলেও গর্ব। পরনিন্দাও যেমন দোষ, আত্ম-নিন্দাও তেমনি। পরহত্যা ও আত্মহত্যার মধ্যে নীতিশাস্ত্রে যেমন কম তফাত লেখে, পরনিন্দা ও আত্ম-নিন্দার মধ্যেও তাই।

ভারতী, আশ্বিন, ১২৮৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *