নিনি, কল্যাণীয়াসু

নিনি, কল্যাণীয়াসু

নিনি, কল্যাণীয়াসু,

তুইই একদিন বলেছিলি যে, তোর মা তোকে বলেছিল যে, আমি কীসব বিটকেল বিটকেল লেখা লিখি৷ মায়ের সব কথাই কি শুনতে আছে! তুই এও আবদার করেছিলি যে কোথাওই বেড়াতে গেলে সেখান থেকে যেন তোকে চিঠি লিখি৷

আমি তো দার্জিলিং, শিলং, কুলু-মানালি, কেদার-বদ্রী, সিকিম-হিমালয় এসব জায়গা নিয়ে লিখব না৷ ওসব জায়গাতে যে বেড়াতে যাইনি এমন নয়৷ শুধু স্বদেশেই নয়, পৃথিবীর বহু দেশেই ছেলেবেলা থেকে আমার পা পড়েছে৷ কিন্তু সকলেই যেখানে যায়, যা নিয়ে লেখে, সেখানে যেতে বা সেইসব জায়গা নিয়ে লিখতে আমার ভালো লাগে না কোনোদিনই৷ অ্যামেরিকান কবি Robert Frost-এর একটা বিখ্যাত কবিতা আছে : ‘The Road not taken’.

সেই কবিতার শেষে আছে, ‘‘I had taken the other road and that had made all the difference.’’

মানে বুঝলি রে নিনি-বোকাই? এখন না বুঝলেও বড় যখন হবি তখন নিশ্চয়ই বুঝবি৷

ওড়িশার সুন্দরগড় জেলার গভীর জঙ্গল-পাহাড়ঘেরা একটি জায়গার নাম মহুলসুখা, ম্যাঙ্গানিজ মাইনের জন্যে বিখ্যাত৷ ওড়িশার এই সুন্দরগড় জেলা ও বিহারের সিংভূম জেলাতে বেশ কয়েকটি জঙ্গুলে জায়গা আছে যেখানে লাল-নীল নদী বয়ে যায় ঘন জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে৷ ম্যাঙ্গানিজ-এর খনি বা খাদান যেখানে আছে, বৃষ্টিতে পাহাড় থেকে নেমে-আসা মাটি-ধোওয়া জল যখন পাহাড়ি নদীতে এসে পড়ে তখন সেই জলের রং লাল দেখায়, আবার যেখানে লোহার খনি বা খাদান থাকে সেখানের পাহাড় থেকে মাটি ধুয়ে নিয়ে আসা জলের রং নীল৷ তাই নদীর রং লাল বা নীল৷

এই মহুলসুখাতে এসেছি, এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি কয়েকদিন হল৷ এসেছি নিছকই জঙ্গলের মধ্যে থাকব বলেই৷ বড় ভালো লাগছে৷ জঙ্গলের মধ্যে সময় কাটালে তোদেরও ভালো লাগবে কারণ প্রকৃতিই যে আমাদের দ্বিতীয় মা৷

মহুলসুখা মাইনস-এর আরেকটা নাম ভুতরা মাইনস৷ কালো জলরাশি বুকে নিয়ে ম্যাঙ্গানিজ আকর-এর গুঁড়ো বয়ে নিয়ে ছিপছিপে নদী চলেছে বনবিতানের মধ্যে দিয়ে৷ নদীর নাম কুড়াড়ি৷ তবে জল এখানে লাল নয়, কালোই৷

মহুলসুখা ম্যাঙ্গানিজ মাইনস-এর গেস্ট হাউসটি একটি পাহাড়ের উপরে৷ খুবই সাদামাঠা বন্দোবস্ত৷ সঙ্গে বাবুর্চিখানা নেই বলে আরোই অসুবিধের৷ নীচের স্টাফ ক্যান্টিন থেকে চা থেকে শুরু করে অন্যান্য খাবারদাবারও সব বয়ে নিয়ে আসে চৌকিদার, ফলে ঠান্ডা হয়ে যায়৷ তবে জঙ্গলে যেতে পারলে ও থাকতে পারলে এইসব ছোটখাটো অসুবিধা গায়ে মাখলে চলে না৷ খাওয়া না হয় একটু কমই হল, আরাম-বিলাসও না হয় নাই হল কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে তো থাকা হল৷ সেটাই তো মস্ত লাভ৷

আমি মহুলসুখাতে গেছিলাম বড়বিল থেকে, বড়জামদা হয়ে জিপে করে৷ রাউরকেল্লা থেকেও আসা যায়৷

বাংলোর বারান্দাতে বসে তোকে চিঠি লিখছি৷ হাওয়াটা ঝড়ের মতো বইছে৷ বিহার ওড়িশার পাহাড়ে জঙ্গলে এপ্রিল মাসে যেমন বয় আর কী! হাওয়াটা ক্রমশই জোর হচ্ছে৷ লোহা আর ম্যাঙ্গানিজের আকরের গুঁড়ো-মাখা লাল মাটির মিহি আস্তরণ উড়ে চলেছে প্রচণ্ড বেগে মাইক স্যাটোর ফরমুলা রেসিংকারের মতো৷ আর উপরের স্তরে উড়ে চলেছে পাতারা, ছোটকি ধনেশ কী টিয়ার ঝাঁকের চেয়েও অনেক বেশি গতিতে৷ নানারঙা পাতা, শাল গাছের পাতা, আমের পাতা, শিমুলের পাতা, পলাশের ঝরা পাপড়ি, বয়েরের পাতা, জংলি কাঁটালের পাতা, কুসুম গাছের পাতা ঝাঁক ঝাঁক তিরের মতো উড়ে চলেছে৷ আর তারও উপরে উড়ছে ডিগবাজি খেতে খেতে, গিলিরি আর মুতুরি আর না-নউরিয়া ফুলেদের ফিনফিনে পাপড়ি৷ আঃ কী ভালো যে লাগে!

এই মহুলসুখা ছাড়িয়ে, কুড়াড়ি নদী পেরিয়ে অনেক পাহাড়ে উঠে এবং নেমে জিপে করে প্রথমদিনই খান্ডাধারে গেছিলাম৷ তখনও কোথায় যে শেষ পর্যন্ত থাকব সে সম্বন্ধে মনস্থির করিনি৷ মহুলসুখার ম্যাঙ্গানিজ মাইন বেসরকারি কিন্তু খান্ডাধারের লৌহ আকরের খাদান সরকারি৷ ম্যানেজারের নাম বিশ্বল সাহেব৷ ক্রিমসন-রঙা হাওয়াইন শার্ট পরে অফিসে কাজ করছিলেন৷ তিনি নাকি বড়বিলের বাংলা বইয়ের লাইব্রেরি থেকে বই আনিয়ে নিয়মিত পড়েন৷

শিক্ষিত ওড়িয়াদের মধ্যে অধিকাংশই বাংলা পড়তে পারেন যে শুধু তাই নয়, বাংলা সাহিত্যর খুবই ভক্ত৷ এই কথা জানলে তাঁদের উপরে বাঙালি হিসেবে আমার ভক্তি বাড়ে এবং আমাদের নিজেদের উপরে কমে৷ আমরা কি কেউই ওড়িয়া বা অহমিয়া সাহিত্য পড়ি? হিন্দি বা উর্দুতেও অনেকই ভালো সাহিত্য রচিত হয়, যদি বিহারি সাহিত্য বলে তেমন কিছু নাও থাকে৷ তবে ওড়িয়া আর অহমিয়া ভাষার সাহিত্যর মান বেশ ভালো৷ আমরা জাত হিসেবে কোনো বিশেষ কারণ ছাড়াই এতটাই উচ্চমন্য যে, আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের সম্বন্ধে কোনোদিনই তেমন উৎসাহ পোষণ করিনি, তাঁদের জানবার চেষ্টা করিনি, ভালোবাসার তো নাইই৷ উলটে অকারণেই আমাদের ঘোর অজ্ঞতাতে তাঁদের নানাভাবে অপমান করেছি৷ অবশ্য আজকে সেই অপরাধের পাপ কড়ায় গণ্ডায় স্খালন করছি আমরা এবং হয়তো আমাদের পরের প্রজন্মেরও তা করতে হবে৷ আমরা জাত হিসেবে কূপমণ্ডূকও বটে৷ কুণ্ডু স্পেশাল বা বিভিন্ন রাজ্যের পর্যটন দপ্তরের নানা ট্যুওরে সেই সব রাজ্য বুড়ি ছোঁওয়ার মতো করে ছুঁয়ে এসে আমরা মনে করি আমরা দারুণ ভ্রমণমনস্ক৷ কিন্তু ভ্রমণ কাকে যে বলে, সেটাই আমাদের মধ্যে কম মানুষ জানি৷ শারীরিকভাবে কোথাও না গিয়েও বাড়ি বসেও মানসভ্রমণ করা যায় কিন্তু ভ্রমণ কী করে করতে হয় তা শিখতে হয়৷ কোনো স্কুল-কলেজে এই বিদ্যা শেখানো হয় না, হয়তো হবে কোনোদিন৷ কিন্তু ভ্রমণের এই ওরিজিনাল কায়দাতে আমি রপ্ত হয়েছি আমার ছেলেবেলা থেকে৷ এ কথা জেনে আহ্লাদবোধ করি, গর্ব বোধ না করলেও৷

এই খান্ডাধারে খুব সুন্দর একটি জলপ্রপাত আছে৷ অনেক দূর দূর থেকে মানুষ চড়ুভাতি করতে আসেন এখানে৷

যেদিন আসি এখানে, সেদিনই মালপত্র জিপ থেকে না নামিয়ে সোজা খান্ডাধারেই চলে গেছিলাম৷ যেখানে মন করবে সেখানেই থাকব বলে৷ খান্ডাধার-এই থাকতে পারতাম আমি৷ কারণ এখানের সরকারি অতিথি-ভবনটি ছোট হলেও অনেক আরামদায়ক৷ কিন্তু ভেবে দেখলাম যে মহুলসুখাতেই থাকা ভালো অসুবিধে সত্ত্বেও৷ কারণ মহুলসুখা অনেকই জংলি মালভূমির খান্ডাধারের চেয়ে৷ সেই কারণেই বড়বিলের মিত্র এস. কে. লিমিটেডের ব্যানার্জি সাহেব আমাকে মহুলসুখা মাইনস-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার মিশ্র সাহেবের জিম্মাতে এই পাহাড়চুড়োর বাংলোতে সন্ধের মুখে মুখে গরমে কাতর, তৃষ্ণায় চিঁক-চিঁক-চিঁক করে শিস তুলে ডাকা ঝুড়িভর্তি মুরগিদের এবং আমাকেও মহুলসুখাতেই নামালেন৷

তখন আমদের অবস্থাও কাঁচা লাল পথে দীর্ঘ ভ্রমণের পর লাল ধুলোর আস্তরণে বিজয়া দশমীর বিকেলে সিঁদুর খেলা সধবাদের মতো৷ ব্যানার্জি সাহেব আমাকে এক মুঠো ম্যালেরিয়া-নিবারণী বড়ি দান করে চলে গেলেন৷ জিপের লাল টেইল লাইট দুটো অন্ধকারের মধ্যে চড়াই-উৎরাই করতে করতে হারিয়ে গেল৷

এখান থেকে বড়জামদা বা রাউরকেল্লা যেতে হলে, যাদের জিপ নেই, তাদের যেতে হবে কইরা অথবা বারসূঁয়া৷ বারসূঁয়া মহুলসুখা থেকে প্রায় সতেরো-আঠারো মাইল ঘন জঙ্গলের মধ্যের পথে৷ এই বারসূঁয়াতে হিন্দুস্থান স্টিল-এর লোহার খাদান আছে৷ মালগাড়ির বড় বড় ওয়াগনের রেক ভর্তি হয়ে লৌহ-আকর চলে যায় এখান থেকে রাউরকেল্লাতে৷ টাটানগর-গুয়ার এই রেলপথটির দৃশ্য ভারী সুন্দর, বারকাকানা-ডালটনগঞ্জের রেলপথেরই মতো সুন্দর৷ এই পথেই পড়ে বাদামপাহাড়৷ সুন্দর নাম নয়? একটি ছোট গল্প পড়েছিলাম অনেকদিন আগে, নাম ‘‘বাদামপাহাড়ের যাত্রী’’৷

মহুলসুখাতে আসতে হলে, জিপে করে বড়বিল বা রাউরকেল্লা বা বড়জামদা থেকে, পথে একটি ভারী সুন্দর উপত্যকা পড়ে, সুন্দর পাহাড়ি নদী কুড়াড়ি বয়ে গেছে তার বুকের উপর দিয়ে৷ জায়গাটির নাম সারকুন্ডা৷ বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি খাদান আছে এখানে৷ ম্যাঙ্গানিজের৷

এখানের অধিকাংশ আদিবাসী, যারা এইসব খাদানে কুলি-কামিনের কাজ করে, জাতে মুন্ডা এবং হো৷ বেশ উঁচু একটি পাহাড়ের উপরে তাদের মুখ্য বাসস্থান ভুতরা বস্তি৷ যে বস্তির নামেই মহুলসুখার আরেক নাম ভুতরা মাইনস৷

চৈত্র শেষে বা বৈশাখে এলে দেখতে পাবি পাহাড়ে দাবানলের মালা৷ লাল ফুলে গাঁথা৷ এই সময়ে কোন পাহাড়ের সঙ্গে যে কোন পাহাড়ের মালা বদল হয় তা এই বন-পাহাড়ের দেবতারাই জানেন৷

যখনই সময় বা সুযোগ হবে তখনই এই মহুলসুখা বা খান্ডাধার বা বারসূঁয়া বা সারকুন্ডার বা কইরার মতো জায়গাতে চলে আসবি বেড়াতে৷ যে সব জায়গাতে সকলেই যায়, ভ্রমণ-সংক্রান্ত পত্রপত্রিকাতে যে সব জায়গা বহু বিজ্ঞাপিত এবং বহু আলোচিত, সেই সব পথ, জায়গা এমনকি বন বাংলোও এড়িয়ে যাবি৷ বনে আসতে হয় একা৷ একেবারেই একা৷ এবং কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে নয়৷ তবেই না বন তোর কাছে মন খুলবে!

‘মহুলসুখার চিঠি’ নামের একটি বইও আছে৷ প্রাপ্তবয়স্কদের বই৷ আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত৷

প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রাপ্তমনস্ক হয়ে সেই বইটি অবশ্যই পড়বি৷

ইতি—তোর বিটকেল কাকু

কলকাতা ২৮/৭/২০০০



Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *