নিধিরামের ইচ্ছাপূরণ
কোনো মানুষই তার নিজের অবস্থা সম্পর্কে ষোল আনা সন্তুষ্ট বোধ করে না। কোনো-না-কোনো ব্যাপারে একটা খুঁতখুঁতেমির ভাব প্রায় সবার মধ্যেই থাকে। রাম ভাবে তার শরীরে আরো মাংস হল না কেন—হাড়গুলো বড্ড বেশি বেরিয়ে থাকে; শ্যাম ভাবে—আমার কেন গলায় সুর নেই, পাশের বাড়ির ছোক্রা ত দিব্যি হারমোনিয়াম বাজিয়ে গলা সাধে; যদু বলে—আহা, যদি খেলোয়াড় হতে পারতাম!—গাভাসকার ব্যাটা কত রেকর্ড করে কী নামটাই করে নিল! মধু বলে—যদি বোম্বাইয়ের ফিল্মের হিরো হতে পারতাম!—যশ আর অর্থ দুইয়েরই কোনো অভাব হত না।
তেমনি নিধিরাম মিত্তিরের মনেও অনেক অপূর্ণ বাসনা আছে। শুধু অপূর্ণ বাসনা নয়; ঈশ্বর তাঁকে যেভাবে সৃষ্টি করেছেন তাতেও তাঁর আপত্তি। এই যেমন, বেশির ভাগ লোকই ফল খেতে ভালোবাসে। আম জাম লিচু আঙুর আপেল এসব ফলের কত সুনাম; লোকে কত ভালোবেসে এসব ফল খায়, আর তা থেকে পুষ্টি লাভ করে। নিধিরামের কিন্তু কোনো ফলেই রুচি নেই। বিধাতা তাকে এমন বেয়াড়া ভাবে সৃষ্টি করলেন কেন?
তারপর নিধিরাম নিজের চেহারা সম্পর্কেও সন্তুষ্ট নয়। দেখতে সে খারাপ নয়, কিন্তু মাথায় খাটো। ১৯৭৩এ সে একবার নিজের হাইট মেপেছিল। পাঁচ ফুট সাড়ে ছ’ ইঞ্চি। তার আপিসের লোকনাথ গুঁই ছ’ ফুট লম্বা। নিধিরাম তার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে আর তার মন ঈর্ষায় ভরে যায়। যদি আরেকটু লম্বা হওয়া যেত!
তার ক্ষমতা অনুযায়ী যতদূর সম্ভব ততদূর নিধিরাম করেছে। মুখার্জি বিল্ডার্স অ্যাণ্ড কনট্র্যাকটরস কোম্পানিতে আজ চোদ্দ বছরের চাকরি তার। তার কর্তা তার উপর খুশিই আছেন। মাইনেও সে যা পায় তাতে স্ত্রী আর দুটি ছেলেমেয়ে নিয়ে তার দিব্যি চলে যায়। কিন্তু আসল কথাটা হচ্ছে কি, চাকরি ব্যাপারটাই নিধিরামের পছন্দ নয়। কত লোক আছে যারা স্রেফ লিখে পয়সা করে—গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক। তাতে তাদের খাটতে হয় ঠিকই, কিন্তু চাকুরেদের মতো দশটা-পাঁচটা ডেস্কের উপর ঘাড় গুঁজে বসে থাকতে হয় না। আর শিল্পী, সাহিত্যিক, গাইয়ে, বাজিয়ে হলে বাজারে যে নাম হয়, আপিসে চাকরি করে ত তা হয় না। পাবলিককে খুশি করে যে আনন্দ পাওয়া যায়, সে আনন্দ নিধিরাম কোনদিন পাবে না। এটা তার একটা বড় আপসোসের কারণ। তার এক বন্ধু আছে, মনোতোষ বাগচী, সে থাকে পাইকপাড়ায়। অভিনয়ে সে রীতিমতো দক্ষ। সে পেশাদারী থিয়েটারে যোগ দিয়ে খুব নাম করেছে। হিরোর পার্টই করে বেশির ভাগ। নিধিরাম মনোতোষকে অনেকবার বলেছে, ‘ভাই, আমাকে অ্যাকটিং-এ একটু তালিম দিয়ে দে না। আমার বড় শখ। অন্তত ক্লাবে-টাবেও যদি দু-একটা পার্ট করতে পারি তাহলেও ত পাঁচজনে আমাকে চেনে।’
মনোতোষ বলেছে, ‘সকলের মধ্যে সব গুণ থাকে না। অ্যাকটিং যে করবি তার গলা কোথায় তোর? লোকে পিছনের সারি থেকে তোর কথা শুনতে না পেলে এমন আওয়াজ দেবে যে অভিনয়ের বারোটা বেজে যাবে।’
এবার পুজোর ছুটিতে পুরীতে গিয়ে নিধিরাম এক সাধুবাবার সাক্ষাৎ পেল। ভদ্রলোক সমুদ্রতটে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁকে ঘিরে জনা বিশেক মেয়ে-পুরুষ ভক্তের দল। সাধু-সন্ন্যাসীর দেখা পেলে নিধিরাম কৌতূহল চেপে রাখতে পারে না, বিশেষ করে এঁর মত তেজিয়ান চেহারার সাধু হলে ত কথাই নেই।
নিধিরাম ভীড় ঠেলে একটু কাছে যেতেই বাবাজির দৃষ্টি তার উপর পড়ল। ‘কী বাবা নিধিরাম,’ বলে উঠলেন বাবাজি, ‘যা নয় তাই হবার শখ হয়েছে?’
নিধিরাম সাধুর মুখে নিজের নাম শুনেই তাজ্জব বনে গেছে; খাঁটি সিদ্ধপুরুষ না হলে এ ক্ষমতা হয় না। সে আমতা-আমতা করে বলল, ‘আজ্ঞে কই, না ত।’
‘না আবার কী?’ বলে উঠলেন বাবাজি, ‘স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোর দেহ দুভাগে ভাগ হয়ে রয়েছে; একটা তোর বাস, আর একটা বাসনা। বাসনাটাই যে প্রবল হয়ে উঠেছে তার কী হবে?’
‘কী হবে তা আপনিই বলে দিন বাবাজি।’ কাতর কণ্ঠে বলল নিধিরাম। ‘আমি মুখ্যু মানুষ, আমি আর কী বলব?’
‘হবে হবে’, বললেন বাবাজি। ‘মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে। তবে এখনই নয়, সময় লাগবে। একেবারে মূল উপড়ে ফেলতে হবে ত। তারপর আবার নতুন করে শেকড় গজাবে, আর সে শেকড় নতুন জমিতে ভূঁয়ের নিচে প্রবেশ করবে। চাট্টিখানি কথা নয়। তবে ওই যা বললাম—তোর হবে।’
এই ঘটনার কিছুদিন পরেই কলকাতায় ফিরে এসে একদিন নিধিরামের কলা খেতে ইচ্ছে করল। বেণ্টিঙ্ক স্ট্রীটের মোড়ে কলা বিক্রি হচ্ছে; নিধিরাম একটা কিনে খেয়ে দেখল—দিব্যি স্বাদ। ঊনচল্লিশ বছর বয়সেও তাহলে মানুষের রুচি পালটায়! এটার সঙ্গে সাধুবাবার কোন সম্পর্ক আছে কিনা সেটা নিধিরামের খেয়াল হয়নি, তবে এই দিয়েই তার পরিবর্তনের সূত্রপাত।
সেদিন আপিসে নিধিরামের কাজে মন বসল না। কদিন থেকেই সে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে, পুরীর বাবাজির কথা মনে পড়ছে, ফলে তার কাজে ব্যাঘাত হচ্ছে। তার পাশের টেবিলের ফণীবাবু টিফিন টাইম হয়েছে দেখে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, ‘আজ মিত্তির মশাইকে অন্যমনস্ক দেখছি কেন? কিসের এত চিন্তা?’
কথাটা বলে সিগারেটে একটা টান দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছাড়লেন ভদ্রলোক, আর সেই ধোঁয়া নিধিরামের নাকে মুখে প্রবেশ করে হঠাৎ তাকে বিষম খাইয়ে দিল। অথচ নিধিরাম নিজেই বিড়ি-সিগারেট খায়, ধোঁয়ায় সে সম্পূর্ণ অভ্যস্ত। আজ হঠাৎ তার এমন হল কেন? তার নিজের পকেটে এক প্যাকেট উইল্স রয়েছে; খেয়াল হল যে এগারোটার সময় চায়ের পর সে সিগারেট ধরায়নি। এটা নিয়মের একটা বিরাট ব্যতিক্রম। এখানেও তার একটা বড় পরিবর্তন সে লক্ষ করল। এই নিয়ে সে ফণীবাবুকে কিছু বলল না।
এর পর থেকে নিধিরামের নানারকম দ্রুত পরিবর্তন হতে লাগল। সে লুঙ্গি ছেড়ে ধুতি, আমিষ ছেড়ে নিরামিষ, অ্যালোপ্যাথি ছেড়ে হোমিওপ্যাথি ধরল। মাথার টেরি বাঁ দিক থেকে ডান দিকে নিয়ে এল। তার গোঁফ ছিল না, এখন একটি সরু গোঁফ গজালো, মাথার চুলটা বেড়ে গিয়ে ঘাড় অবধি ঝুলে এল।
এর মধ্যে এক শনিবার নিধিরাম গিন্নীকে নিয়ে ‘মর্যাদা’ নাটক দেখতে গেল রঙমহলে। হিরোর পার্টে ছিল বন্ধু মনোতোষ বাগচী। নিধিরাম বুঝল তার বন্ধুর অভিনয় ক্ষমতা। দর্শককে সে ধরে রাখে হাতের মুঠোর মধ্যে, দর্শকও বার বার করধ্বনি করে তাদের তারিফ জানিয়ে দেয় নায়ককে।
নিধিরামের আবার নতুন করে ইচ্ছা জাগল অভিনেতা হবার। নাটকের শেষে ব্যাকস্টেজে গিয়ে সে বন্ধুর অভিনয়ের প্রশংসা করে এল মুক্তকণ্ঠে। আর নিজের আপসোসটা জানিয়ে এল। মনোতোষ তাকে পিঠ চাপড়ে বলে দিল, ‘সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়, তাই না? থিয়েটারে কী? আজ আছি, কাল নেই। তোদের চাকরিতে ঢের বেশি নিরাপত্তা।’
নিধিরাম ম্যাটিনিতে গিয়েছিল নাটক দেখতে; ফেরার পথে কলেজ স্ট্রীট থেকে কিছু নাটকের বই কিনে নিল। স্ত্রী মনোরমা জিজ্ঞেস করল, ‘এসব কী হবে?’ ‘পড়ব’, ছোট করে জবাব দিল নিধিরাম! স্ত্রী বললেন, ‘সাত জন্মেও ত নাটক পড়তে দেখিনি তোমায়।’ ‘এবার দেখবে’, বলল নিধিরাম।
স্বামীর মধ্যে কিছু পরিবর্তন কদিন থেকেই লক্ষ্য করেছে মনোরমা। কিন্তু সে সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য করেনি। আজ তাকে জিগ্যেস করতেই হল, ‘তোমার কী হয়েছে বল ত?’ স্বামীর সঙ্গে পুরী যায়নি মনোরমা, কারণ সে সময়ে সে ছিল বাঁশবেড়ে; অসুস্থ বাপের পরিচর্যা করতে হচ্ছিল তাকে। তাই সাধুবাবার ভবিষ্যদ্বাণী সম্বন্ধে সে কিছুই জানত না, নিধিরামও ঘটনাটা গিন্নীর কাছে প্রকাশ করেনি।
তবে চেপে রাখলেই বা কী?—এত পরিবর্তন হয়েছে নিধিরামের এ ক’ মাসে যে সেটা স্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারে না। এখানে এটাও বলা দরকার যে স্বামীর রূপান্তরে মনোরমা খুশিই আছে, কারণ পরিবর্তনগুলো সবই ভালোর দিকে।
বড়দিনের ছুটিতে নিধিরাম নাটকের বইগুলো পড়ল। একটাতে হিরোর পার্টের বেশ খানিকটা মুখস্থ করে সে স্ত্রীকে অভিনয় করে দেখাল। মনোরমার চোখ কপালে উঠে গেল। স্বামীর মধ্যে যে এমন একটা ক্ষমতা লুকিয়ে ছিল সেটা সে কল্পনাই করতে পারেনি।
ঊনচল্লিশ বছর বয়সে মানুষ দৈর্ঘ্যে বাড়ে না; বছর পঁচিশ থেকেই বাড়া বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সার্ট-পাঞ্জাবির হাতাগুলো খাটো মনে হচ্ছে দেখে নিধিরাম নতুন করে হাইট মেপে দেখল এবার হল পাঁচ ফুট ন ইঞ্চি। এই তাজ্জব ঘটনাও নিধিরাম কারুর কাছে প্রকাশ করল না, তবে গিন্নীকে বলতেই হল, আর নতুন মাপের কিছু জামা তৈরি করতে খরচও হয়ে গেল কিছু। ঘটনাটা এতই অস্বাভাবিক, আর নিধিরামের পক্ষে এতই আনন্দের যে খরচটা সে গ্রাহ্যই করল না। তার শুধু যে হাইট বেড়েছে তা নয়; গায়ের রঙও বেশ কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে, আর শরীরে বল হয়েছে আগের চেয়ে অনেকটা বেশি।
একদিন নিধিরাম আপিস থেকে ফিরে শোবার ঘরের আলমারির বড় আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ নিজের চেহারার দিকে দেখে মনে মনে একটা ব্যাপার স্থির করে ফেলল। শ্যামবাজারের থিয়েটার পাড়াতে একবার যাওয়া দরকার। সম্রাট অপেরা কোম্পানিতে যে হিরোর পার্ট করত, সেই মলয়কুমার সম্প্রতি থিয়েটার ছেড়ে দিয়েছে। সম্রাটের ম্যানেজারের সঙ্গে একবার দেখা করা দরকার।
যেমন কথা তেমন কাজ। ম্যানেজার প্রিয়নাথ সাহার সঙ্গে সোজা দেখা করল নিধিরাম।
‘অভিজ্ঞতা কী?’ জিগ্যেস করলেন ম্যানেজার মশাই।
‘একেবারে নেই’, অকপটে স্বীকার করল নিধিরাম—‘তবে অভিনয় করে দেখিয়ে দিতে পারি। আপনাদের “প্রতিধ্বনি” নাটকে মলয়কুমার যে পার্টটা করেছিল সেটা আমার মুখস্থ আছে।’
‘বটে?’
প্রিয়নাথবাবু এবার ‘অখিলবাবু!’ বলে একটা হাঁক দিলেন। একটি টাক মাথা প্রৌঢ় ভদ্রলোক পর্দা ফাঁক করে ঘরে ঢুকলেন।
‘আমার ডাকছিলেন?’
‘হ্যাঁ’, বললেন প্রিয়নাথবাবু। ‘এঁকে একবার বাজিয়ে দেখুন ত। ইনি বলছেন মলয়ের পার্টটা নাকি এঁর মুখস্থ। দেখুন ত এঁকে দিয়ে কাজ চলে কিনা।’
বেশিক্ষণ পরীক্ষা করতে হল না। মিনিট পনেরর মধ্যেই নিধিরাম বুঝিয়ে দিল যে সে মলয়কুমারের চেয়ে কম ত নয়ই, বরং অনেক ব্যাপারে তার চেয়েও বেশি দক্ষ।
পয়লা জানুয়ারি নিধিরাম চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সম্রাট অপেরায় যোগ দিল। মাইনে শুরুতে আড়াই হাজার, তবে কাজ ভালো হলে, আর লোকে তাকে পছন্দ করলে, আরো বাড়বে।
মুখার্জি কোম্পানির চাকরি যে নিধিরাম কোনোদিন ছাড়বে এটা কেউ ভাবতে পারেনি। নিধিরাম দার্শনিকের ভাব করে তার সহকর্মীদের বলল, ‘মানুষের জীবনে পরিবর্তন আসবেই। চিরকাল জীবনটা যে একই পথে চলবে এটা ভাবাই ভুল।’
তবে নাটকে যোগ দিয়েও পুরনো আপিসের সঙ্গে সম্পর্কটা চট করে ছাড়তে পারল না নিধিরাম। এক সোমবার টিফিন টাইমে সেখানে গিয়ে শুনল যে তার জায়গায় নতুন লোক এসেছে। খবরটা দিলেন ফণীবাবু। বললেন, ‘যিনি এসেছেন তিনি আবার আপনার ঠিক উলটো। ইনি আগে থিয়েটার করতেন।’
নিধিরামের কৌতূহল হল।
‘কী নাম বলুন ত।’
‘মনোতোষ বাগচী। বললেন পুরীতে এক সাধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তিনি নাকি বলেছিলেন তাঁর জীবনে অনেক চেঞ্জ আসবে। ভদ্রলোকের থিয়েটারে বিতৃষ্ণা ধরে গেছে। বললেন চাকরি পেয়ে তাঁর অনেক বেশি নিশ্চিন্ত লাগছে।’