নিদ্রাহীন রাত – শুভম ভট্টাচার্য্য

নিদ্রাহীন রাত – শুভম ভট্টাচার্য্য

রিমোট জব করার সূত্রে, সারাজীবন আমেরিকার টাইমিং এ মেলাতে হয়েছে। ফলে রাতের ঘুমটার দফারফা অনেকদিনই হয়ে গেছে। রিটায়ারমেন্টের পরেও তাই অভিমানী রাতের ঘুম আমায় ত্যাগ করেছে। এতটা বেইমানি সেই বা মানবে কেন।

রাতের বেলা স্নায়ুকে বোকা বানিয়ে ঘুমোনোর অভ্যেসটাও চলে গেছে আমার। অবশ্য ঘুমের ওষুধ-টষুধ অনেক করেছিলাম। কিন্তু এই বুড়ো হাড়ে কিছু কাজে দেয়নি। আর তারপর থেকেই রাতটুকু কে আর অছেদ্দা না করে, বরং উপভোগ্য করে তোলার চেষ্টা করেছি।

সামান্য একটু ভোদকা গ্লাসে ঢেলে বাড়ান্দায় বসে রাতে স্নিগ্ধতা উপভোগ করছিলাম। শহুরে রাত তখন বেশি না। সবে এগারোটা বেজেছে। তবে দূরদূরান্তে কোন শব্দ পাওয়া যায়না। গিন্নিরই ইচ্ছা তে এখানে ফ্ল্যাট কেনা। রাতে ওকে একা থাকতে হয় বলে, আমি অনেক বারন করেছিলাম সে সময়। কিন্তু তাঁর কথায় ভিড়ভাট্টায় ক্ষতির আশঙ্কা বেশি। আর শান্ত জায়গায় নাকি ক্ষতি কম। যদিও সে ক্ষতির ডেফিনেশনে আমি আর যাইনি। জীবনে দুটো মানুষের কথার ওপর আমি অবাধ্য হইনি। ছোটবেলায় আমার মা, আর বিয়ের পর আমার গিন্নি। তারা যা বলেছে, সব আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার চেষ্টা করেছি।

কিন্তু আজ এক পেগ খেয়েই কেমন যেনো মাথাটা করে উঠলো। হালকা আচ্ছন্নতা এলো শরীরে। অনেকদিন যে ঘুমের ধারেকাছে যাইনি, সেই ঘুম এর প্রাথমিক রুপ এরকম হয় কিনা সেও বলতে পারিনা। তবুও বাড়ান্দা থেকে ঊঠলাম না। বসে রইলাম ওখানেই। যে মানুষটার এত দিনেও ঘুম এলো না। তাঁর ঘুম আসবে হঠাৎ করে এটা ভাবা যায়না। কিন্তু বেশ কিছুক্ষন বসার পরে যখন, আচ্ছন্নতা আরও বেশি করে গ্রাস করতে থাকলো আমায়, তখন আর পারলাম না। বিছানায় গিয়ে শরীরটা এলিয়ে দিলাম। এ এক অদ্ভুত আচ্ছন্নতা। আজ অভিমানী ঘুম যখন আমার সাথে সখ্যতা চাইছে, তখন আমার শরীরের প্রত্যকটা অঙ্গ আমার থেকে ছুটি নিচ্ছে যেনো। হাত-পা সব যেনো অভিমান করে নেতিয়ে পরছে।

কখন ঘুমিয়ে পরেছি জানিনা। যখন ঘুম ভাঙলো, ঘড়িতে তখন রাত এক টা। ঘুমটা ভাঙলো কলিং বেলের আওয়াজে। এতরাতে কে আসতে পারে সেটা আমি জানিনা। দরজা খোলা টা কী ঠিক হবে? কিন্তু যে শরীর এতক্ষন আমার সাথে বেইমানি করছিলো। নেতিয়ে পরছিলো হাত-পা। তারাই যেনো এবার উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। তাদের স্বাভাবিক ভার যেনো আমার গায়ে আর লাগছেনা। মনে হচ্ছে তারা নিজেরাই যেনো উঠে পরছে। পা গুলো নিজে নিজেই হাঁটতে শুরু করেছে। আর আমাকে টানতে টানতে এগিয়ে নিয়ে চলেছে দরজার দিকে। দরজার কাছে পৌঁছতে নিজে থেকেই আমার হাত উঠে গেলো দরজার ছিটকিনির দিকে। তারপর পরিচিত ভঙ্গিতে খুলে দিলো ছিটকিনি। তারপর নিজে থেকেই দরজার নবটা ঘুরিয়ে দিলো। এবার দরজাটা খুলে যাবে।

আমার মনের ভেতর তখন উথাল পাতাল চলছে। আগন্তুকের উদ্দ্যেশ্যে এক অদ্ভুত ভয় সৃষ্টি হয়েছে আমার মনে। নিজের শরীর কে আমি অবিশ্বাস করতে শুরু করেছি তখন। সারা শরীরে ঘাম দেওয়ার কথা। কিন্তু সেও আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে আজ। শরীর অদ্ভুত রকমের ভিজে অনুভব হচ্ছে। কিন্তু কই ঘামের চিহ্ন টুকু শরীরে নেই আমার।

দরজা খুলে যেতেই আমি থমকে গেলাম। এতক্ষন যা ভয় পাচ্ছিলাম সে ভয় কে এই ভয় ছাড়িয়ে যায়। বহুমাত্রায়। আমার সামনে এমন একজন আগন্তুক যে থাকবে তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। সামনে যে মানুষটি দাঁড়িয়ে আছে, সে আর কেউ নয়। সে আমার গিন্নি।

গিন্নি যেদিন আমায় ছেড়ে চলে গেলো, সেদিনকেও তাঁর গায়ে এই পোশাকই ছিলো। একটা ঘিয়ে রঙের শাড়ি। আর লাল ব্লাউজ। শাড়ি তে সব জায়গায় ছিটে ছটে রক্ত লেগে। আর সবচেয়ে ভয়ানক ওই মাথাটা। মাথার পিছন দিকের খুলি টা, খুলে বেড়িয়ে এসেছে। বীভৎস। যেদিন গিন্নি ছাদ থেকে পরে গেলো। সেদিনও গিন্নিকে এইভাবেই দেখেছিলাম আমি। কিন্তু এতটা বীভৎস লাগেনি। কিন্তু আজ সেই রুপ দেখে আমার সারা শরীর হিম হয়ে গেলো।

বেশ কিছুক্ষন নিস্তব্ধ ছিলাম আমরা। আসলে আমার কথা বলা সাজেনা। তবুও কিছু বলতে গেলাম আমি। কিন্তু মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বেড়োলো না। তারপর গিন্নিকে দেখলাম, সে কাঁদছে। আমি ভেবেছিলাম ওঁর চোখে হয়তো কোন প্রতিশোধের আগুন দেখতে পাব আমি। কিন্তু তাঁর পরিবর্তে এই কান্নার মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিশ্বাসঘাতকতার তীড় এসে লাগলো আমার বুকে।

শরীরে জোয়ান বয়সের আগুন ফুরিয়ে গেছে। তাই হয়তো আজ অনেক না বোঝা গুলো বুঝতে পারছি। গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করলো আমার। কিন্তু পারলাম না। কেউ যেনো আমার গলা টিপে ধরে আছে। আমার যেনো শ্বাস-প্রশ্বাস চলছেনা। তাহলে কি যখন গিন্নিকে আমি ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলাম, ওরও এরকম কষ্ট হয়েছিলো। না-না আরও বেশি কষ্ট হয়েছিলো। আমার মিথ্যে সন্দেহের জন্য, আমি ওকে এতটা কষ্ট দিতে পারলাম? আজ যেনো আমার কাছে সব পরিষ্কার হতে থাকলো। আমি বুঝতে পারলাম। আমার অনুপস্থিতে গিন্নির কাছে কেউ আসতো না। সে নিজের স্বার্থ ছাড়াই আমাকে ভালোবেসে এসেছিলো এতদিন ধরে। আমি সেই সময় বুঝে উঠতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম, রাতের বেলায় স্বামী ছাড়া মেয়ে মানুষ থাকলেই বেলেল্লাপোনা করবে। আর সেই সন্দেহতেই…

আর ভাবতে পারলাম না আমি। ততক্ষনে গিন্নি পিছিয়ে যেতে শুরু করেছে। অদ্ভুত ভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে আমার দিকে ফিরেই। আমি নিজেকে সামালাতে পারলাম না। ছুটে গিয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করলাম। ক্ষমা চাইতে গেছিলাম বোধহয়। কিন্তু পারলাম না। একটা ঝটকা আমায় পিছনে ঠেলে ফেলেদিলো। তারপর সব অন্ধকার। বেশকিছুক্ষন অন্ধকারের পর আবার ফুটে উঠলো আলো। এক অন্তহীন আলো।

অনেকবার বেল বাজানোর পরেও যখন বাবা দরজা খুললো না। তখন দরজা ভেঙেই ঢুকে এলো অনিমেষ। যা ভেবেছিলো তাই। বাবা আর নেই। বিছানায় নিঃসাড় দেহ পরে আছে। চোখটা খোলা। চেয়ে আছে উলটো দিকের দেওয়ালে মায়ের ছবিটার দিকে। মনে হলো, ছবি থেকে মা-ও যেনো চেয়ে আছে, বাবার দিকেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *