নিত্যানন্দ পালের খোঁজে
আচ্ছা মশাই, মহেশ চাটুজ্জের বাড়িটা কোন দিকে বলতে পারেন?
মহেশ চাটুজ্জের বাড়ি খুঁজছেন? কেন মশাই, এ শহরে এত বাড়ি থাকতে মহেশ চাটুজ্জের বাড়িই খুঁজছেন কেন? মহেশ কিন্তু বজ্জাতের ধাড়ি। আপনি কি পাওনাদার নাকি?
আজ্ঞে ঠিক তা নয়। আসলে মহেশ চাটুজ্জের সঙ্গে আমার চেনাজানাও নেই। তবে তাঁর বাড়িটা খুঁজে পেলে শ্যামবাবুর খোঁজ পাওয়া সহজ হত আর কী! মহেশ চাটুজ্জের বাড়ির উলটোদিকে নীলমণি লেন। সেই নীলমণি লেন ধরে ঠিক একশো চুয়াল্লিশ পা হাঁটলে বাঁ হাতে চারু ঘোষের বাড়ি পড়বে। চারু ঘোষকে চেনেন কি?
চারু ঘোষ! তাঁকে চিনতে চাইছেন? তা এত মানুষ থাকতে হঠাৎ চারু ঘোষকেই বা চিনতে চাইছেন কেন? ওরকম হাড়কেপ্পনকে কেউ চিনতে চায়?
আজ্ঞে না, চারু ঘোষকে না চিনলেও ক্ষতি নেই। তবে তার বাড়িটা খুঁজে পেলে, বাড়ির দক্ষিণদিকে পুবমুখো রাস্তাটাও পাওয়া যাবে কিনা। আর ওই রাস্তাতেই দিকপতি ঘোষালের বাড়ি। চারু ঘোষের বাড়ি থেকে বড়োজোর এক ফার্লং হবে।
দিকপতি ঘোষালের সঙ্গেই বা আপনার কীসের দরকার মশাই? ষণ্ডাগুন্ডা লোক। ওর সঙ্গে মাখামাখি না করাই তো ভালো।
না না, দিকপতি ঘোষালকে আমার মোটেই দরকার নেই। আসলে দিকপতি ঘোষালের মামাতো ভাই হলেন ভবেন লাহিড়ী।
সর্বনাশ, এর মধ্যে আবার ভবেন লাহিড়ীকেও এনে ফেললেন! না মশাই, আপনি তো বিপদে পড়বেন দেখছি! এই তো চার মাস জেল খেটে এল! আপনি যদি পুলিশের লোক হয়ে থাকেন তাহলে অন্য কথা, নইলে ভবেন লাহিড়ীর খোঁজ করাটা ঠিক কাজ হবে না।
ঠিকই বলেছেন, আসলে ভবেন লাহিড়ীর ঠিকানাটার হদিসটা জানতে পারলে একটু সুবিধে হত আর কী! শুনেছি ভবেন লাহিড়ী তিরানব্বই—এর এক বাই দুই বাই তেইশ নম্বর বলভদ্র নস্কর স্ট্রিটে থাকেন। আর ও—বাড়িরই পিছন দিককার রাস্তা ধরে সাতচল্লিশ পা এগোলে নকুল নাগের ভূষিমালের দোকান, তাই না?
ভূষিমালের দরকার হলে নকুল নাগ কেন, বিস্তর নাগ—নাগিনী আছে। নকুল নাগের দোকান থেকে ভূষিমাল কিনতে হবে এমন কোনো মাথার দিব্যি দেওয়া আছে কি? নকুল নাগ দিনে—দুপুরে লোক ঠকায়।
আজ্ঞে না। কেনাকাটার জন্য আসিনি মশাই। কেনাকাটার ব্যাপার নয়। আসলে নকুল নাগের দোকানের পরই পরেশবাবুর গোডাউন, সেটা ছাড়িয়ে বিশ পা হাঁটলেই অন্নপূর্ণা পাইস হোটেল, আর ওই পাইস হোটেলের ডান ধার ঘেঁষে বাঞ্ছা ঘোষ লেন গোঁত্তা খেয়ে ঢুকে গেছে।
খাওয়া—দাওয়া করতে চান তো! তার জন্য এখানে বিস্তর হোটেল আছে! অন্নপূর্ণা পাইস হোটেলেই খেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। অতি রদ্দি দোকান মশাই, পচা মাছ, বাসি ভাত, ময়লা বাসন।
খাওয়া—দাওয়া মাথায় উঠেছে মশাই, মহেশ চাটুজ্জের বাড়ি খুঁজে না পেলে যে সমূহ বিপদ!
বিপদ! বলেন কী মশাই? এ তো ভারি ভালো খবর! কারও বিপদ—আপদের কথা শুনলেই আমার মনটা ভারি নেচে ওঠে। তা কীরকম বিপদ আপনার?
আজ্ঞে সমূহ বিপদ। ওই মহেশ চাটুজ্জের বাড়ির নিশানা ধরে চারু ঘোষের বাড়ি খুঁজে বের করে, সেই বাড়ির খুঁটি ধরে দিকপতি ঘোষালের—
আহা, ও তো একবার হয়ে গেছে! আপনি ইতিমধ্যে অন্নপূর্ণা হোটেলে পৌঁছেও গেছেন। আসলে যেতে চাইছেন কোথায়?
আজ্ঞে সেটাই তো ফেঁদে বলছিলাম। অন্নপূর্ণা হোটেল পেয়ে গেলে আর কোনো চিন্তা নেই। ওখান থেকে হেলেদুলে হাঁটলেও দুলাল বিশ্বাসের বাড়ি পাঁচ মিনিটের পথ।
ওরে বাবা! দুলাল বিশ্বাসের মতো প্যাঁচালো লোক যে ভূ—ভারতে নেই! ভালো কথারও এমন বাঁকা মানে করবে যে হাঁ হয়ে যেতে হয়। তা দুলাল বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করার কী দরকার আপনার মশাই?
সে তো বটেই, দুলাল বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করার তেমন কোনো ইচ্ছেও নেই আমার। তবে কিনা দুলাল বিশ্বাসের বাড়ির উলটোদিকে যে মাঠটা আছে সেটা কোনাকুনি পেরোলেই রামরতনের গোয়াল। চেনেন নাকি?
আর বলবেন না মশাই, রামরতনকে তল্লাটের সবাই হাড়েহাড়ে চেনে। দুধ না খড়িগোলা জল তা বুঝবার উপায় নেই। সেই দুধ থেকেই তো তিনতলা বাড়ি করে ফেলল মশাই। খবরদার, ওর কথায় ভুলে আবার দুধের বন্দোবস্ত করে ফেলবেন না।
না, দুধের তেমন দরকারও নেই আমার, ছেলেবেলা থেকেই আমার দুধে অরুচি।
আমার আবার একটু দুধের সর না হলে রাতের খাওয়াটাই পুরো হয় না। কিন্তু রামরতনের দুধে সর খোঁজার চেয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের জলে সর খোঁজা ভালো, তা রামরতনকে আপনার কীসের দরকার?
না না, রামরতনের সঙ্গে আমার কোনো দরকারই নেই, তবে তার গোয়ালঘরটা চিনে নেওয়াটা ভালো। কারণ ওই গোয়ালঘর থেকে ঈশানকোণে কয়েক পা এগোলেই মদনবাবুর হলুদ দোতলা বাড়ি বলে শুনেছি।
ওঃ, মদন আবার বাবু! আর হাসাবেন না মশাই, মদন যদি বাবু হয় তাহলে তেলাপোকাও পক্ষী। মদনকে লোকে কি নামে চেনে জানেন? মারু মদনা। অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায়। ওই মদনের পাল্লায় পড়লে সর্বনাশের আর দেরি নেই জানবেন।
সে তো ঠিকই, মদনবাবুর পাল্লায় পড়ে আমার কাজটাই বা কী বলুন! মদনবাবুকে নয়, তার বাড়িখানা পেয়ে গেলে আর চিন্তা নেই। ওই বাড়ির সামনে একটা ল্যাম্পপোস্ট আছে না?
তা থাকতে পারে, ল্যাম্পপোস্টের অভাব কী এখানে। সর্বত্র ল্যাম্পপোস্ট পাবেন।
আজ্ঞে, তা তো বটেই। তবে ওই ল্যাম্পপোস্টটার একটা আলাদা ব্যাপার আছে।
কী ব্যাপার বলুন তো! ওই ল্যাম্পপোস্টের নীচে কিছু পোঁতা—টোঁতা আছে নাকি?
তা থাকতেও পারে, তবে আমার সে খবর জানা নেই।
তাহলে ল্যাম্পপোস্ট দিয়ে কী হবে মশাই, আপনি তো আর বিদ্যাসাগরের মতো ল্যাম্পপোস্টের আলোয় লেখাপড়া করবেন না!
আজ্ঞে না, লেখাপড়ার পাট কবেই চুকেবুকে গেছে।
তবে?
আসলে ওই ল্যাম্পপোস্টটাকে এক নম্বর ধরে পশ্চিম দিকে এগোতে—এগোতে বারো নম্বর ল্যাম্পপোস্টের লাগোয়া বাড়িটাই হচ্ছে সনাতন সরখেলের বাড়ি।
আ মোলো! সনাতন সরখেল যে মাথা—পাগলা লোক। দিনরাত আপনমনে বিড়বিড় করে, বাতাসে আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি কাটে। অঙ্কের মাস্টার ছিল, বুঝলেন? অঙ্কে ভারি পাকা মাথা। আর ওই আঁক কষে কষেই তো মাথাটা গেল। তা আপনি কি অঙ্কে কাঁচা?
বেজায় কাঁচা মশাই, বেজায় কাঁচা। তবে সেইজন্য নয়, সনাতন সরখেলের বাড়ির লাগোয়া নরেন ঘড়াই লেন, আর ওই নরেন ঘড়াই লেনের সাতচল্লিশ বি বাড়িটা হল খগেনবাবুর।
খগেনবাবু! খগেনবাবুর সারা গায়ে চুলকুনি মশাই। দিনভর কেবল ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস করে সারা শরীর চুলকে যাচ্ছেন, কথা কইবার ফুরসত নেই। বড়ো ছোঁয়াচে রোগ, খগেনবাবুর ধারে—কাছে যাবেন না, আপনার ভালোর জন্যই বলছি।
চুলকুনিকে আমিও বড়ো ভয় পাই। তবে রক্ষে এই যে, খগেনবাবুর সঙ্গে আমার কোনো দরকার নেই। তাঁর বাড়ি ছাড়িয়ে গিয়ে বাঁহাতি তিন নম্বর রাস্তাটা ধরে এগোলেই গিরীশ বাগের বাজার।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই তো কাছেই।
আজ্ঞে, আর সেই গিরীশবাবুর বাজার পেরিয়ে ছাতুওলা গলির মুখেই নিত্যানন্দ পালের বাড়ি।
তা তো বটেই। আর আমিই নিত্যানন্দ পাল। কিন্তু নিত্যানন্দ পালের সঙ্গে আপনার কাজটা কী?
আসলে হরিপদ বৈরাগী হল বন্ধু মানুষ। তা তার সঙ্গে আমার একটা বাজি হয়েছে। একটা কাজ করতে পারলে সে আমাকে পঞ্চাশটা টাকা দেবে।
অ, তা কাজটা কী?
হরিপদ নিত্যানন্দ পালকে একদম পছন্দ করে না। নিজের ভায়রাভাই হওয়া সত্ত্বেও সে সর্বদাই বলে যে, নিত্যানন্দ পালের মতো এমন হাড়ে হারামজাদা নাকি তল্লাটে দুটো নেই। নিত্যানন্দ নাকি সাংঘাতিক ঝগড়ুটে, ধার নিয়ে শোধ দেয় না, হাড়কেপ্পন, লাগানি—ভাঙানি করে বেড়ায়, জলের মতো মিথ্যে কথা বলে, কথা নিয়ে কথা রাখে না, ওঃ সে বলতে গেলে মহাভারত—
তাই বুঝি! হরিপদর এত সাহস!
যে আজ্ঞে। তাই সে আমাকে বলেছে নিত্যানন্দের পেটে যদি একটা রামচিমটি কেটে পালিয়ে আসতে পারিস তবে তোকে পঞ্চাশ টাকা দেব। তাই আপনার কাছে আসা।
অ্যাঁ!
আজ্ঞে হ্যাঁ।