৪
ইট ইজ এগেইন নিতু। প্যারেন্টস কমপ্লেইন-এর পরও!
স্যরি স্যার।
হোয়াট টু সে স্যরি? ইট ইজ নাউ গোইং টু বি আ ক্রাইম।
আই অ্যাম রিয়্যালি স্যরি, স্যার। আই ওয়াজ আনডান।
আমি মাথা নিচু করলাম। একেবারে চিলডাউন।
স্যার চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়ালেন।
ইট্স ওকে। সিট ডাউন।
থ্যাংক ইউ স্যার।
চেয়ার সরিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় আমি বসে পড়লাম রেজা স্যারের সামনে। ঘরে আমি আর স্যার। শুধু দু’জন। মুখোমুখিভাবে। আমার ডিটেনশন চলছে। অথবা হয়তো-বা চলবে। একটু পর।
কারণ, আজ ক্লাসে ঢুকতেই শাকচুন্নি মিস নোটিশ করেছেন। থার্ড পিরিয়ডে প্রিন্সিপাল স্যার কল করেছেন আমাকে। আমি জানি, এমনটা হবেই। আমিও যে এর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
.
রেজা স্যার চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী চায়ের কাপে ঠোঁট রাখতে রাখতে ভ্রু কুঁচকালেন।
আমার কী ধারণা জানো নিতু? আমার ধারণা, এবারের কাজটা তুমি ইচ্ছে করেই করেছ।
আমি খুব নিচু গলায় মাথা নামিয়ে উত্তর দিলাম।
জি স্যার।
কেন? ফিল্মের ব্যাপারে কথা বলতে চাও?
জি স্যার।
লিসেন নিতু, ইনফ্যাক্ট আমিও চাই। তোমরা তোমাদের হিডেন প্রবলেমস্ অ্যান্ড থট্স আমাদের সাথে শেয়ার কর। কিন্তু এভাবে কেন?
কিভাবে করব স্যার?
স্যারকে হাল্কা চিন্তিত মনে হল। যথারীতি চায়ের কাপ থেকে চুমুক দিয়ে আইডিয়া ধার নিয়ে, আমার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে মারলেন।
ঠিক আছে। আমি ভিপি মিসকে বলে রাখব। তুমি চাইলেই যেন পারমিট দেয়া হয়। কিন্তু এর বিনিময় একটা প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।
জি স্যার। নিয়মিত হোমওয়ার্ক করব। আর মিসিং হবে না।
স্যার চোখ তুলে আমার চোখের দিকে তাকালেন।
আহ্! কী অপূর্ব সে চাহনি! সম্ভবত এমন চোখের দিকে তাকিয়েই কৃষ্ণরূপ বর্ণনায় বডুচন্ডী দাস বলেছিলেন, ‘কাজলেঁ উজল নয়ন যুগল, খঞ্জনকে উপহাসে; ঈষত হসিত ভুবন মোহন, যেহ্ন কমল বিকাশে।’
স্যার বলতে লাগলেন।
ইউ আর জিনিয়াস নিতু। তবে মনে রাখবে, বুদ্ধি সঠিক জায়গায় ব্যবহার করতে হয়। বুদ্ধির ভুল প্রয়োগে হিরোসিমা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। হিটলারের হাতে শত সহস্র প্রাণ চলে যায়। তৈমুর লং মাইলের পর মাইল লাশের পাহাড় বানায়। ভুল চিন্তা মানুষের মাথায় আসতেই পারে। কিন্তু তাকে প্রশ্রয় দেয়াটা আরও বড় ভুল। বুঝতে পারছ?
আমি মাথা ঝাঁকালাম।
ঠিকই বলেছেন স্যার। যেমন আপনি করছেন। এই মুহূর্তে আমাকে প্রশ্রয় দিয়ে। জানেন তো, বেড়ালকে প্রশ্রয় দিলে, কোলে চড়ে বসে। আর নিতুকে দিলে মাথায় উঠে! মগজ খামচে ধরে।
কথাগুলো অবশ্য মুখে নয়, মনে মনে বললাম আমি। দেখি, পিসু পীর মনের কথা ধরতে পারে কি-না। মুখে বললাম অন্য কথা।
স্যার, আমার আরেকটা উপকার করবেন প্লিজ?
কী, বল?
রাফিয়াকেও এই পারমিটটা দিতে হবে।
স্যার হাসলেন।
কেন, সে তোমার ফিল্মের কো-অ্যাক্ট্রেস না-কি?
না স্যার, সি ইজ ডাইরেক্টার। অ্যান্ড ফান্ড রেইজার।
স্যার আবারও চা চাবালেন। এরপর সেই ভুবনভোলানো বিখ্যাত মুচকি হাসিটি দিলেন।
ওকে ডান। পারমিটেড। তারপর, আসল কথা বল। কী ব্যাপার জানতে হোমওয়ার্কের এই বাহানা?
স্যার, হিরোকে নিয়ে সমস্যা।
অভিনয়ে রাজি হচ্ছে না?
ঠিক তেমনটা নয়। আসলে তাকে আমরা, বিষয়টা জানাতেই চাচ্ছি না।
ব্ল্যাকমেইল! নো, নো। ইট্স নট ফেয়ার।
সুযোগ বুঝে আমি অতিদ্রুত খেলার চাল একটু ঘুরিয়ে দিলাম। মুখে একটা কপট হাসি ফুটিয়ে সরাসরি স্যারের চোখের দিকে চোখ ফেললাম।
কিন্তু স্যার, সরাসরি বললে, সে কি রাজি হবে? আফটার অল, হি ইজ আ ভেরি হ্যান্ডসাম অ্যান্ড ইয়াং গাই। একটু প্রতিষ্ঠিত পরিবারের ছেলে। মনে মনে বললাম, দেখি রাজা, চেক সামলাতে তুমি কতটা পারদর্শী! পারবে তো কম্পিটিটর ফেইস করতে? না-কি হিংসার আগুনে জ্বলে উঠবে আপন রূপে।
স্যার আগের ভঙ্গিমাতেই বলতে লাগলেন।
সো হোয়াট! অফকোর্স হি উইল বি এগ্রিড। আমার তো মনে হয় উল্টো আনন্দিত হবে। তোমাদের মতো দু’টো সুন্দরী মেয়ের প্রস্তাব ফেলতে পারে, এত বড় বদ-সাহসী ছেলে আছে নাকি এদেশে? রাজি না-হবার প্রশ্ন তো অনেক দূরের কথা, লোভ সামলানোই মুশ্কিল। তাছাড়া ছেলেটা একটু ভাবলেই একবাক্যে সম্মত হবে পুরো খেলায়। কারণ, সে বুঝতে পারবে যে, ইট ইজ আ কিটেন গেইম। বিড়ালছানার তেলাপোকা-তেলাপোকা খেলা। হাত দেয়া এবং ছেড়ে দেয়া। মোর ওভার, হি উইল ক্লিয়ারলি আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট, ইউ আর নট বি অ্যাল টু রিলিজ্ দ্যা ফিল্ম। তাছাড়া…
স্যার চেয়ারটা একটু ডানে-বামে বাঁকা করে চায়ের কাপে মনোযোগ দিলেন। ওনাকে দেখতে এই সময়, ঠিক ‘টুমোরো নেভার ডাইজ’ ছবির জেমসবন্ড চরিত্রের পিয়ার্স ব্রসনানের মতো লাগছে। আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম।
উনি আবারও বলতে শুরু করলেন
…তাছাড়া আমারও ধারণা ওই একই রকম। ছবি তোমরা রিলিজ্-ই করতে পারবে না।
কেন স্যার! হঠাৎ এমন ধারণা কেন?
ভেরি ইজি। তোমার কথা অনুযায়ী, তোমাদের ছবির হিরো একটু বুদ্ধিমান। তাহলে সে সামান্যতেই বিষয়টা ধরতে পারার কথা। ইউ আর টেকিং রিভেঞ্জ, নট্ ফিল্ম। ইনফ্যাক্ট, যে কেউ-ই একটু ভাবলে বুঝতে পারবে পুরো বিষয়টা। তোমরা যা করছ, তা হচ্ছে এডোলেশন পিরিয়ডে এক ধরনের ইনফাচুয়েশন। সাইকোলজির ভাষায় …
দাবার চালে এ দফায় আমি পুরো মন্ত্রীসহ নৌকা খোয়ালাম। পিসু’র বক্তব্যে আমার মেজাজ সর্বোচ্চ চরমে উঠে গেল।
কী! আমরা সাইকো পেসেন্ট! আর তুই সাইকিয়াট্রিস্ট! তরুণীদের হার্ট থ্রব সাইকিয়াট্রিস্ট মিস্টার মোহিত কামাল!
মনে মনে গালি দিতে গিয়েও থেমে গেলাম। মাথা ঠাণ্ডা করলাম। নিজে নিজে নিজেকে বোঝালাম, রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।
স্যার, রিলিজ করা না-করা সময়ের ব্যাপার। পৃথিবীর সব নতুন কাজেই সমালোচকরা এমনটা বলেন। এটা নিয়ে আমরা চিন্তিত না।
গুড, গুড লজিক। তাহলে এগিয়ে যাও। গো আহেড। হোয়াই সো ওয়ারিড? সমস্যা কী? নায়ককে বলে ফেল।
আমি আবারও নতুন চাল চালোম।
সমস্যা আরেকটা আছে। আমাদের একটা ভালো প্লট দরকার স্যার। সেনসেশনাল। নিউ প্লট।
ওয়েবে যাও। সার্চ দাও। আজকাল বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো দেখছ না। চাইনিজ, জাপানিজ, স্প্যানিশ সব বিদেশি নাটকের প্লট ভেঙে ছারখার অবস্থা। এক বিদেশি নাটক ভেঙে হাজার হাজার পাইকারি নাটকে ছয়লাব। তোমরাও পারবে।
না স্যার, ট্রেডিশনাল না। আমাদের দরকার একটু নিউ আইডিয়া। আই মিন, ডিফারেন্ট অ্যান্ড ব্র্যান্ড নিউ টাইপ। একজন বিখ্যাত বাংলা শর্ট ফিল্ম প্রডিউসার আমাদের সাথে আছেন। তিনি আমাদের বলেছেন, ফিলা মানেই হল ডিফরেন্স অ্যান্ড ডিটেন্স। যেমন, কমেডি-অ্যাকশন। অ্যাকশনের সময় কমেডি থাকতে হবে। আবার, নায়ক-নায়িকা। নায়ক রিক্সাওয়ালা হলে, নায়িকা হতে হবে ধনীর একমাত্র কন্যা।
প্রিন্সিপাল স্যার হো হো করে হেসে উঠলেন 1
তাহলে, তোমরাও প্লট বানাও। নায়িকা ষোড়শী হলে, নায়ক হবে ষাটদশী। বুড়ো নায়ককে জোর করে ধরা হবে। রেইপ করা হবে। অ্যান্ড পাবলিক উইল এনজয় দ্য ডিফরেন্স অব দ্যাট কাইন্ড অব মুভিজ।
স্যার হাসতেই থাকলেন।
আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। প্রচণ্ড উত্তেজিত ভঙ্গিতে সরাসরি বলে বসলাম স্যারের মুখের ওপর।
রেইপের কী দেখানো হবে! বুড়োটার জন্য দুই নায়িকাই অস্থির! একজন প্রেগন্যান্ট! অন্যজন রাস্তার প্রস্!
আমার হাত-পা থর থর করে কাঁপতে লাগল।
পিসু হাসি থামালেন।
তুমি অযথাই উত্তেজিত হচ্ছ। ইউ রিকোয়ার আ ডিফারেন্ট স্টোরি। আই গেভ। অ্যাজ ইট উইল সল্ভ ইয়োর আনাদার প্রবলেম অসো। অনেকটা এক ঢিলে দুই পাখি মারা। তাছাড়া এর মাধ্যমে ইয়াং হিরোকেও আর কষ্ট করে ব্ল্যাকমেইল করতে হবে না তোমাদের। আফটার অল, হি ইজ আ হ্যান্ডসাম গাই!
আমি চোয়াল শক্ত করে ফেললাম।
আমাদের কষ্ট নিয়ে আপনাকে ভাবতে বলিনি স্যার। শুধু স্টোরিটা দিতে বলেছিলাম।
অ্যান্ড ইয়েস, আই ডিড ইট। আমার দেয়া প্লট ভালো না লাগলে, জাস্ট ন্জি ইট অফ। সিম্পলি নাক ঝাড়া দাও। পারলে শব্দ কর, ওয়াক থু। এতে মাথাগরমের কিছু নেই।
আমি বিশাল বড় নাক ঝাড়লাম। শব্দ করে বললাম, ওয়াক থু
স্যার হাসলেন, রাজাদের মতো হাসি। এমন হাসি, যা দেখলে মার্গারেট থ্যাচার, ইন্দিরা গান্ধী, কিংবা ঝাঁসি-কা-রানি লক্ষীবাই-এর মতো আয়রন লেডিরাও সব অভিমান ভুলে নিশ্চুপ বসে থাকবে। আমি নির্বাক চেয়ারে বসে রইলাম। এমন হাসি তিনি কোত্থেকে শিখেছেন কে জানে!
স্যার ঘড়ির দিকে তাকালেন।
ওহ্ স্যরি। তোমাকে একটু বসতে হবে। আমি এসএসসি ব্যাচের এক্সাম কপিটা তুলে আনি। একটু পরই বেল পড়বে। ততোক্ষণে তুমি একটা কোক নিয়ে নাও। পিওনকে বলছি।
বলেই স্যার চট করে উঠে দাঁড়ালেন। যেন, রাজার যুদ্ধজয় শেষ হয়েছে। এখন প্রাসাদে ফেরার পালা।
অপমানে, ক্ষোভে, পরাজয়ে, প্রতিহিংসায় আমি তীব্রভাবে পুড়তে লাগলাম। একা-একা। পুরো হৃদয় জুড়ে। আমার ইচ্ছে করছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে ‘স্টপ’ বলে পৃথিবীর সব ঘড়িকে বন্ধ করে দেই। চিৎকার করে বলি-
না, আপনি যাবেন না। আপনি বসুন। আপনাকে আরো কিছু কথা শুনতে হবে। শুনতেই হবে। আজ। এক্ষুনি। কারণ ফিল্ম নিয়ে কথা বলতে আমি এখানে আসিনি। আমি শুধু এটুকু বলতে এসেছি যে, আপনাকে ছাড়া…
.
রেজা স্যার চলে গেলেন।
পিওন কোক দিয়ে গেল। সাথে বিস্কিট।
আমি ইচ্ছে করেই গ্লাস ফেলে পুরো কোকটা স্যারের টেবিলে মাখা মাখি করে দিলাম। বিস্কিট ফেলে পা দিয়ে কার্পেটে গুঁড়িয়ে দিলাম ঘরময়।
শুধু যাবার সময় ভিপি মিসকে বলে গেলাম, স্যরি মিস্, কোক ফেলে পুরো টেবিল ভিজিয়ে ফেলেছি।
শাকচুন্নি হাসল। বিচ্ছিরি পেত্নী-মার্কা হাসি। ইট্স ওকে। স্যার কি খুব বেশি ধমক দিয়েছেন?
আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকালাম। পেত্নী তার বিশাল বড় মূলাসদৃশ্য দাঁত দু’টো বের করল।
ডোন্ট বি ডিসহার্টেড। স্যার একটু এমনিই। পরে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। মন দিয়ে লেখাপড়া কোরো। আই নো, ইউ আর আ ভেরি সুইট গার্ল।
আমি শাকচুন্নির দিকে তাকিয়ে তিনটা গালি দিলাম। রাফিয়ার শেখানো তিনটা বিখ্যাত ইংরেজি গালি।
বা…
সা…
না…।
শাকচুন্নি আবারও হাসল।
.
বাসায় ফিরে ‘তীব্র মাথা-ব্যথা’ এমন একটা ভাব ধরে সরাসরি বিছানায় শুয়ে পড়লাম আমি। তা-ও কিছু মুখে না-দিয়ে।
মা তেল হাতে মালিশের জন্য এগিয়ে এল একবার।
আমি সরাসরি নিষেধাজ্ঞা জারি করলাম।
উহ্ মা! মাথা-ব্যথায় চুলে হাত দিও-না তো আমার। ব্যথা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
বয়সের একটা পর্যায়ে মা’রা সম্ভবত মেয়েদের বানানো অজুহাত অতি দ্রুত ধরতে পারেন। এবং লড়তে না-চেয়ে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন। এক্ষেত্রে মা-ও তাই বাড়তি কিছু করলেন-না। একগ্লাস দুধ আর একটা ডিম সাইড টেবিলে রেখে, চলে গেলেন আপন মনে বলতে বলতে।
মন চাইলে একটু পর খেয়ে নিস্। ভালো লাগবে।
যথারীতি মা’র কথা অনুযায়ী, মিনিটখানেক পরেই আমি জানালা দিয়ে সবকিছু ফেলে দিয়ে, মনে মনে একটু ভালো লাগাতে লাগলাম।
বিকেল নাগাদ রাফিয়া ফোন করল।
কীরে! আর কত দেরি?
আমি উল্টো প্রশ্ন করলাম।
তুই কোথায়?
কোথায় আবার, বদনা বাবুর গলির মাথায়। তাড়াতাড়ি আয়। ফা পোলাপাইন ড্যাব ড্যাব করে তাকাচ্ছে।
গুড। ভেরি গুড। তুই তাহলে আরও মিনিট পাঁচেক খাদ্যবস্তু এনজয় কর। আমি আসছি।
বলেই লাইন কেটে দিলাম আমি। কারণ, আমি জানি, রাফিয়া এখন গালি দেয়া শুরু করবে।
শুরু হচ্ছে আমাদের আজকের সেকেন্ড মিশন
ফাহাদ বিন ফারুকের স্পেশাল সুটিং স্পট, লালমাটিয়া পরিদর্শন। ফিল্ম মেকিং শর্ট কোর্সের প্রথম সেশন।
যথারীতি আশীর্বাদস্বরূপ থাকছে, বদনা বাবুর প্রাইভেট ফাঁকি দেয়ার তিরস্কার। বাসায় না-জানিয়ে বাইরে ঘোরার অভিসম্পাত।
.
ফ্রেম কী বোঝ? ফ্রেম হল, ফিল্ম লাইনের ফার্স্ট অ্যান্ড ফান্ডামেন্টাল কনসেপ্ট। ছোটবেলায় আমরা একটা খেলা খেলতাম, মনে আছে! ‘আমি যা দেখি, তুমি কি তা দেখ’? ফ্রেম হচ্ছে অনেকটা সেরকম খেলা। অর্থাৎ তুমি যা দেখাতে চাচ্ছ কিংবা যতটুকু দেখাতে চাচ্ছ, তাকে ক্যামেরায় বন্দি করা। আ ফ্রেম ইজ ওয়ান অব দ্যা মেনি স্টিল ইমেজেইস্ উইচ কম্পোজ দ্যা কমপ্লিট মুভিং পিক্চার।
আমি আর রাফিয়া অবাক হয়ে শুনছিলাম এফ.বি.এফ মাল্টিমিডিয়ার অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর ওমর রশীদ সাহেবের কথাগুলো। এ তো রীতিমতো লেখাপড়া!
সত্যি কথা বলতে কী, সেই শুরু থেকেই হতবাকের মধ্যে আছি আমরা দু’জন। ক্যামেরা, ফিল্ম আর অ্যাক্ট্রেস থাকলেই যে ছবি হয়-না, বিষয়টা আজ জানতে পারলাম প্রথমবার। এখানে শেখার অনেক ক্ষেত্ৰ আছে। আছে অনেক জটিল বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপনা।
তাই প্রতিটি বিষয় অত্যন্ত যত্ন দিয়ে বুঝিয়ে যাচ্ছেন রশীদ সাহেব।
স্পটে এসে প্রথমে উনি আমাদের নিয়ে গেছেন অ্যাপারেটাস চেনাতে। মনিটর প্যানেল, লাইটিং কিট্স, ডিজেআই ইন্সপায়ার কোয়াড্রঙ্কপটা, ইত্যাদি, ইত্যাদি চিনিয়ে দিয়েছেন একটা একটা করে। পুরো খুলে খুলে দেখিয়েছেন থ্রি-সিক্সটি ডিগ্রি গিয়ার বক্স, বিভিন্ন রকম লেন্স, আরও অনেক কিছু। এরপর বসিয়েছেন একটা প্রজেক্টরের সামনে। এবং সাবলীলভাবে বলে যাচ্ছেন জটিল কথাগুলো।
হুঁ! যা বলছিলাম। ফ্রেম। এবার ফ্রেম থেকে কিভাবে একটা আস্ত ফিল্ম কিংবা সিনেমা বা নাটক তৈরি হয়, সেটা বলছি। একটু মনোযোগ রেখ দু’জন। মনে রাখবে, কতগুলো ছোট ছোট ফ্রেম নিয়ে তৈরি হয় একটি শট। তেমনি কতগুলো শটকে মিলিয়ে বানানো হয় একটি সিকোয়েন্স। আবার অনেকগুলো সিকোয়েন্সের সম্মিলিত যোগফল হল একটি সিন। আর বেশ কিছু সিন মিলে তৈরি করা হয় একটি অ্যাক্ট। সবশেষে একটির একটি, অ্যাক্ট-এর পর অ্যাক্ট জোড়া লাগিয়ে তৈরি হয় একটি কমপ্লিট প্লে, আই মিন পূর্ণাঙ্গ ছায়াছবি।
কথার এইখানে হঠাৎ ওমর রশীদ সাহেব প্রজেক্টর থেকে পেছনে মুখ ঘোরালেন। এবং যথারীতি সটাং হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
স্যার স্লামালাইকুম।
আমরা ওনার কথায় এতটাই তন্ময় ছিলাম যে, স্বয়ং ডিরেক্টর সাহেব কখন পৌঁছেছেন এখানে, টেরই পাইনি। আমরাও মিডিয়া জগতের ঈশ্বর- দর্শনের মতো দাঁড়িয়ে পড়লাম। এবং বললাম, স্যার স্লামালাইকুম।
ফাহাদ বিন ফারুক সাহেব হাসলেন।
তোমরা আবার স্যার বলছ কেন? ইউ ক্যান টেল মি ‘ভাইয়া’। এই লাইনে এটাই প্রচলিত। আফটার অল, ক’দিন বাদে তোমরা নিজেরাই ফিল্ম তৈরি করতে যাচ্ছ। শুনলাম, তোমাদের প্লট নাকি অ্যানিমেল প্ল্যানেট বেইজ্ড্। বার্ডস লাইফ! চমৎকার! চমৎকার আইডিয়া।
রাফিয়া উল্টো-হাসি হাসল।
কে বলেছে, ভা-ই-য়া! বাবা না-কি?
ডিরেক্টর সাহেব আধো-বিগলিতভাবে বললেন।
হ্যাঁ। আজ সকালেই তো গিয়েছিলাম তোমার বাবার অফিসে। আহ্। কী অভিজাত রুচি তোমার বাবার! ইন্টেরিয়র দেখলে কেলি হপেন, উইয়ার স্টেলারদের কথা মনে হয়। হোয়াট আ কমবিনেশন!
সেদিনের মানুষ আর আজকের ফাহাদ! আকাশ-পাতাল পার্থক্য। কোথায় যেন, কী যেন, কিছু একটা ঘটে গেছে হয়তো। আমি রাফিয়াকে চিম্টি কাটলাম।
কী-রে, ডোজ কি বেশি পড়েছে না-কি তোর বাবার কাছ থেকে?
রাফিয়া ফিসফিসিয়ে বলল।
দুই লাখ। টু ল্যাক্ ফর সেভেন ডেইজ অলি!
আমি কানে তালা-লাগার মতো আওয়াজ শুনলাম।
বলে কী!
ভদ্রলোক আমাদের ইতঃস্তত ভাব দেখে রশীদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে নিজে নিজেই বলতে লাগলেন।
বাই দ্যা ওয়ে, শুধু কি শেখানই হচ্ছে, না-কি ওদের কিছু এন্টারটেইন করেছেন? ওরা তো আবার বোরিং ফিল্ করবে।
আমরা আগ্ বাড়িয়ে বললাম।
না, না। ইট্স ওকে। আমরা এনজয় করছি।
আহা! মনের আনন্দের পাশাপাশি পেটের আনন্দও-তো দরকার। ঠিক আছে, চল, দোতলায় আমার অফিসে বসি কিছুক্ষণ। খেতে খেতে নিরিবিলিতে কিছু গল্পও করা যাবে না হয়।
রশীদ সাহেব কথার মাঝখানে প্রসঙ্গ ওঠালেন
স্যার, আমি শুধু ফ্রেম পর্যন্ত বলেছি আজ। শট-এর ব্যাপারটা কিন্তু আলোচনা করতে পারিনি।
ডিরেক্টর সাহেব হেসে উঠলেন আবারও।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। শটের বিষয়গুলো আমি না হয় প্র্যাকটিকালি বুঝিয়ে দিব ওদের। আপনি ততোক্ষণে কিছু খাবার দিতে বলুন উপরে।
কথা শেষ করেই ভদ্রলোক আমার দিকে চোখ ফেরালেন। সেই পুরনো দৃষ্টি! খাদ্যবস্তুর দৃষ্টি!
আমি মনে মনে বললাম।
এটাই তো চাই ফাহাদ। জনাব ফাহাদ বিন ফারুক। এটাই চাই।
.
দোতলার ছাদের উপর আড়াই তলায় একটা ছোট্ট চিলেকোঠার মতো ঘর। অত্যন্ত পরিপাটি।
ছাদ জুড়ে অসংখ্য ফুলগাছ। দোলনা। একটা রকিং চেয়ার। একটা গার্ডেন সোফা। একপাশে রাজকীয় রেলিং। সিনেমায় দেখানো পুরো রাজপ্রাসাদ। আশে-পাশে বড় কোনো ঘর-বাড়ি গড়ে ওঠেনি এখনও। একটু ফাঁকা ফাঁকা পরিবেশ।
ভদ্রলোকের লোলুপ দৃষ্টি আর পরিবেশের মোহময়তা আমার ভেতর এক ধরনের তীব্র প্রতিহিংসাবোধ জাগিয়ে তুলল। আমি খাবার শেষে অপেক্ষা করতে লাগলাম সেই সময়টির জন্য। কখন আসবে সেই মাহেন্দ্ৰক্ষণ!
দেরি করতে হল-না বেশিক্ষণ। সম্ভবত তিনি নিজেই সহ্য করতে পারছিলেন-না আর। অতিদ্রুত জাল বুনতে লাগলেন শিকারি মাকড়সার মতো।
ইয়েস্ ইয়াং গাইজ্! তোমাদের কাজে আসি এবার। লেসন অ্যাবাউট ‘শট্’। এভি প্রোডাকশনের সবচেয়ে মজার বিষয়টাই হল শট্। দি মোস্ট ইম্পরটেন্ট অ্যান্ড সেনসেশনাল পার্ট অব দ্যা ফিল্ম। তুমি একটি বিষয়কে শটের তারতম্যের কারণে দর্শকের কাছে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রভাব ফেলতে পার। ওয়াইড শটে যে দৃশ্যকে ভৌতিক বলে মনে হতে পারে, ক্লোজ-আপে সেটাকেই আবার অত্যন্ত রোমান্টিকভাবে দেখানো যায়। একই দৃশ্য এক্সট্রিমে চলে গেলে, তা দেখানো যায় ক্রেইজিভাবে। শটের সংজ্ঞা অনুযায়ী এ.ভি-তে প্রায় চৌদ্দটা ফান্ডামেন্টাল ক্লাসিফিকেশনস্ ক্লাসিফিকেশনস্ আছে। ই.ও.ডব্লিউ.এস। এস.ডব্লিউ.এস। ডব্লিউ.এস। ই.এল.এস। এল.এস। এম.এল.এস।…
রাফিয়া প্রায় হাই তুলতে যাবার মতো অবস্থায় পৌঁছে গেছে।
ভদ্রলোক যে নিশ্চিত একজন অভিজ্ঞ প্রডিউসার, তা অতিদ্রুত প্ৰমাণ করতে লাগলেন এরপর। দর্শকের জ্ঞান গ্রহণে অনীহা দেখে, সরাসরি উদাহরণে চলে গেলেন। সিনেমার ভাষায় বর্ণনা থেকে কাহিনী।
একটা মেয়ের কথাই চিন্তা করা যাক। ধর, তোমার ফ্রেমে একটি মেয়ে আছে। আসো, মেয়েটির মাথা থেকে শুরু করি। মাথা থেকে পা পর্যন্ত অর্থাৎ পুরো আপদমস্তক শটে ধরলে, তাকে বলা হবে এফ.এস বা ‘ফুল- শট্’। কিন্তু হাঁটু পর্যন্ত নিলে তা হয় এম.এফ.এস আর থাই পর্যন্ত এম.এস। ঠিক কোমর পর্যন্ত নামলে তাকে বলে ওয়েইস্ট শট। আর যদি আমরা তার ব্রেস্টের নি পর্যন্ত নেই, তবে বলতে হবে মিডিয়াম ক্লোজ আপ।
কথার এই অংশ বলেই প্রডিউসার সাহেব জায়গামতো তাকালেন আমার দিকে। শট্ নেবার জন্য ড্রাগনের জিভ লক্ লক্ করছে তার
রাফিয়া ইঙ্গিত বুঝে বাথরুমে যাবার বাহানা তুলল। কারণ, ও জানে শিকার এখনই পা ফেলবে ফাঁদে। সুতরাং রশিতে অতিদ্রুত টান দেয়াই হবে আমার দায়িত্ব।
অবশেষে ভদ্রলোক আমাদের পরিকল্পনায় সার্থকতা দিলেন। রাফিয়া ঘর থেকে বাথরুম বরাবর পা বাড়াতেই, চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি অনেকটা উঠে এসে দাঁড়ালেন আমার চেয়ারের সামনে। তার টেবিল বরাবর হেলান দিয়ে।
যা বলছিলাম রিতু, স্যরি, প্রবালি নিতু! রাইট?
আমি মাথা ঝাঁকালাম। এবং একটা রহস্যময় হাসি হাসলাম।
ভদ্রলোক হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলতে লাগলেন এ দফায়।
ইয়েস্, নিতু। শোন। এ.ভি-র সবচেয়ে মজার শটা সম্পর্কে এবার বলি। ই.সি.ইউ অর্থাৎ এক্সটিম ক্লোজ-আপ। ধর, তোমার চুল থেকে ঠিক গলা, আই মিন, টপ অব দ্য ব্রেস্ট পর্যন্ত নেয়া হবে…
ঠিক এই পর্যন্ত বলেই ভদ্রলোক হাত বাড়ালেন লক্ষ্যবস্তুর দিকে।
আমিও যথারীতি প্রস্তুত।
চেয়ার থেকে হাল্কাভাবে দাঁড়িয়ে উঠলাম ওনার সুপার ক্লোজ-আপ শট্ বরাবর। ন্যাতানো ভঙ্গিতে হাল্কা জড়িয়ে ধরে বললাম।
শুধু হাত দিলেই চলবে? না-কি, আরও মেগা ক্লোজ-আপে যেতে হবে ভাইয়া! তবে সাবধান, রাফিয়া কিন্তু তার মোবাইলটা অন করেই চলে গেছে ভুলে। আপনার টেবিলের কর্নারে। লক্ষ করেননি হয়তো। এবং সে নিজেও দাঁড়িয়ে আছে ঠিক দরজার ওপাশে। ফিল্মের শেষ অংশটুকু দেখার জন্য।
বলামাত্রই ঠাস্-ঠাস্ করে দু’গালে দু’টো কষে চড় বসালাম আমি।
ভদ্রলোক কিছু বুঝে উঠবার আগেই রাফিয়া ঢুকে পড়ল ঘরে। হাসতে হাসতে বলতে লাগল।
এবারের মতো মাফ করে দিলাম, যান! বাবাকে কিছু জানালাম না। আশা করি পরবর্তীতে এই শিক্ষাটা মনে রাখবেন, জনাব ফাহাদ বিন ফারুক। দি ডিরেক্টর অ্যান্ড প্রডিউসার, এফ.বি.এফ ফিল্মস্।