নিতু বলছি – তৌহিদুর রহমান
প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
উৎসর্গ
নোশিন শারমিলি হৃদি।
আমার দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে এই প্রথম কোনো
ছাত্র বা ছাত্রী যাকে, যাকে আমি কোনো বই উৎসর্গ করছি।
(মহাকাব্য সাইজের একটা বিশাল উৎসর্গপত্র পাওনা রইল তোর, পরে দেব)
১
আমি নিতু। বেশ কিছুদিন ধরে আমি একটা গোপন সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। শুধু গোপন নয়। গোপন এবং ভয়াবহ। সমস্যাটা শারীরিক। উহুঁ! শরীরঘটিত। কিছুটা আবার মানসিকও। তাই আমি অন্য আর একটা ভয়ংকর সমস্যাজনক ঘটনা ঘটানোর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি। অনেকটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো।
আমি একটা ফিল্ম বানাব। এক্স-রেটেড। যাকে বলে ব্লু-ফিল্ম। সানি লিওন স্টাইল। ফিল্মের নাম হবে ‘লাভ, ইউ ওল্ড জিপসিম্যান।’ বাংলা করলে দাঁড়ায়, ভালোবাসা, তুমি সেই বৃদ্ধ যাযাবর। এমন ছবির এত সুন্দর নাম! কারণ নামটা দিয়েছেন আমাদের রেজা স্যার। অবাক হচ্ছেন! ভাবছেন সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা আছে। তবে সেটা একটু পরে বলি। আগে নিজের পরিচয়টা আরও একটু স্পষ্ট করে দিয়ে নেই।
নিতু আমার ডাকনাম। জেএসসি সার্টিফিকেট অনুযায়ী পুরো নাম মাসুমা আক্তার। ফেইস বুকে অবশ্য ভিন্ন। মাসুমা নিতু। এঞ্জেল নিতু। এবং নিশিকন্যা নিতু। প্রথমটা রিয়েল। বাকি দু’টো? ফেইক। কেন এমনটা? ফেইসবুক চালানো লোকজন সবাই বোঝে। ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। ও, ভালো কথা। আমার তো বয়সই বলা হয়নি এখনও। আমি চৌদ্দ বছর, এগারো মাস, সাতাশ দিন। আগামী পনেরো জুলাই আমার জন্মদিন। তিনদিন বাকি 1 জন্মদিন নিয়ে আমার একটা বিশেষ পরিকল্পনা আছে। ওই দিন আমি শাড়ি পড়ব। টকটকে লাল। ঠোঁটেও তিনশত বিশ কোডের লিপস্টিক। ক্রিমসণ রেড। কারণ? কারণ, ওই দিন আমার ছবির শুভ মহরত করা হবে। ডামি টেক। রেজা স্যারকে ধরে।
হুঁ, রেজা স্যার হচ্ছেন আমাদের স্কুলের প্রিন্সিপাল। বুড়ো এবং বাঁচাল। বয়স চল্লিশ। যথারীতি জ্ঞানের ডিব্বা। পৃথিবীর খুব কম বিষয়ই আছে, যা তিনি জানেন না। হোক তা ভালো, হোক তা মন্দ। তার একটি ভয়াবহ গুণ হল, তিনি দেখতে সুন্দর। অসম্ভব রকমের। দেবদূতের মতো, রবীন্দ্রনাথের মতো বিচ্ছিরি রকমের সুন্দর। চোখের দিকে তাকালেই পিতলা মনের মেয়েরা প্রেমে পড়ে যায়, এমন টাইপ সুন্দর।
তার সবচেয়ে বড় এবং মারাত্মক গুণটা এবার বলি
মনে আছে, শুরুতে বলেছিলাম, আমার একটা সমস্যা হল মানসিক। আর এই মানসিক সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুই হচ্ছে তার এই অতিজাগতিক গুণটি। তিনি মন বুঝতে পারেন। স্যরি, মনের কথা। আই মিন, গোপন ভাবনা। কারণ, আমার এক্স-রেটেড ফিল্মের আইডিয়াটা তিনিই প্রথম এবং তিনিই একমাত্র আবিষ্কার ও উন্মোচন করেন। তা-ও সরাসরি। ফেইস টু ফেইস ডিসকাশনে। কীভাবে? বলছি।
.
রেজা স্যার সেদিন তার রুমে আমাকে স্পেশাল কল করেছিলেন।
স্পেশাল কল হল প্যাদানি কল। মানে, অতিদোষে দুষ্ট ছাত্রীদের প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে ডেকে নিয়ে কমপ্লেইন এন্ড থ্রেটিং। আমার দোষ! টানা তিনদিন হোমওয়ার্ক জমা দেইনি। নো সাবজেক্ট।
স্যার আমাকে ঠাণ্ডাভাবে বললেন, খুব টেনশন?
আমি নির্বাক। কারণ আমি জানি এটা হলুদ বাতির সিগনাল৷ মানে অভিভাবককে কমপ্লেইন দেয়া হবে।
স্যার চেয়ারটার দিকে তাকালেন।
বসো নিতু।
আমি স্যারের দিকে তাকালাম। এটা সম্ভবত রেড সিগনাল। সময় নেয়া হচ্ছে। কমপ্লেইন ইনস্ট্যান্টও দেয়া হতে পারে। গরম গরম। সরাসরি টেলিফোন। অভিভাবককে।
আমি সাহস নিয়ে বসলাম। স্যারের সামনে আমার পাঁচটা বিষয়ের বাড়ির কাজ খাতা। যার প্রতিটিতে লাল সিল, ‘হোমওয়ার্ক নট সাবমিটেড’। স্যার আমার দিকে না তাকিয়ে, খাতা বরাবর চোখ রেখে বলতে লাগলেন। যেন প্রশ্নটা খাতাগুলোকেই করা হচ্ছে।
তারপর, বল নিতু! হোমওয়ার্ক না-করার পিছনে প্রধান কারণটা কী! ফিল্ম, না টেনশন?
যথারীতি এসি’র আঠারো ডিগ্রি টেম্পারেচারের মধ্যেই ঘামতে শুরু করলাম আমি।
ইট্স ওকে। লেট্স হ্যাভ সাম ডিসকাশন অ্যাবাউট ইয়োর ফিল্ম। ফিল্মের কোন দিকটা তোমার কাছে লেস ইম্পর্টেন্ট। কারেক্টার, অর স্টোরি!
আমার বলা উচিত, পানি! স্যার, ওয়াটার। স্যার, ওয়াটার ইজ মোর ইম্পরেটেন্ট দ্যান অ্যানিথিং অ্যাট দ্যা মোমেন্ট।
কারণ ততোক্ষণে আমার গলা শুকিয়ে একদম কাঠ। সাহিত্যের ভাষায় যাকে বলে চৈত্রের দাবানলে জ্বলন্ত কাষ্ঠ। হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। ফিল্মের কথা স্যার জানলেন কিভাবে! কেবলমাত্র তার আগেরদিন রাতেই এই আইডিয়াটা আমার মাথায় আসে প্রথম। তা-ও আবার তিনরাত তিনদিন প্রায় নির্ঘুম কাটানোর পর। আমি মানসিকভাবে তীব্র ধাক্কা খেলাম।
বেশ কিছুদিন আমার ভেতরে একটা তীব্র প্রতিশোধের স্পৃহা কাজ করছে। আর সেখান থেকেই আসলে এই ছবি তৈরির পরিকল্পনা। কিন্তু সেটা তো আমি কাউকে বলিনি। কাউকে না। অথচ উনি হড়বড় করে বলে গেলেন কথাটা! ভাবখানা এমন যেন ফিল্ম তৈরি নিয়ে গল্প করার জন্যই এখানে ডাকা হয়েছে আমাকে, হোমওয়ার্কের কমপ্লেইন দিতে নয়।
কী ভাবছেন! এরপর স্যার আমাকে প্রচণ্ড বকাঝকা করলেন? কিংবা সরাসরি প্যারেন্টস কমপ্লেইন!
জি না। লোকটার এই আরেকটা ভালো অভ্যাস অবশ্য আছে। কারও ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না-করা। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডেকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিলো, তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ আবিস্কার কী? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন। আইনস্টাইন ইজ মাই গ্রেটেস্ট ইনভেনশন। আমি মনে মনে প্রচণ্ড সাহস সঞ্চয় করতে লাগলাম। দেখা যাক, তিনি শিক্ষক হলে, আমিও তার ছাত্রী। সুতরাং তিনি ফ্যারাডে হলে, আমাকেও আইনস্টাইন হতে হবে।
স্যার, আমার ফিল্মে শুধু চেহারা থাকলেই হবে। গল্প, চরিত্র, দৃশ্যায়ন এসব মুখ্য নয়।
উনি হালকা হাসলেন। এবং একটা বড়সড় জ্ঞানের ড্রাম খুলে বসলেন।
লিসেন নিতু (স্যারের মুদ্রাদোষ), অ্যাকটিং ইজ মোর ইম্পরটেন্ট দ্যান দ্যা অ্যাকট্রেস। অভিনয় দিয়ে চেহারাকে, আই মিন চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে হয়। সিনেমা জগতে ‘ফাইভ-সি’-এর বিষয়টা জানো? ‘সি’ ফর ক্যামেরা। ‘সি’ ফর কারেক্টার। ‘সি’ ফর কম্পোজিশন, কন্টিনিউইটি, এন্ড কাট। ক্যামেরা, কারেক্টারদের কম্পোজিশনে ধরবে এবং যাবতীয় কনটিনিউটি বজায় রেখে কাট-এর পর কাট করে শুটিং অর্থাৎ সিনেমা প্রডিউস করবে।
স্যার, আমি কী টাইপের ফিল্ম বানাব সেটা হয়তো আপনি জানেন না।
আমি অসীম সাহস নিয়ে জ্ঞানওয়ালার ওপর আরেকটু অজ্ঞানের চাপ বাড়ালাম। দেখি উনি কতদূর যেতে পারেন?
লিসেন নিতু, বিষয়গুলো সব ছবির ক্ষেত্রেই সমানভাবে ধর্তব্য। তাছাড়া আমার মনে হচ্ছে, যেসব ফিল্মের কথা তুমি ভাবছ, সেখানে সাউন্ডস এন্ড অ্যাক্টস নিয়েই মেইন ফ্যালাসি খেলা হয়। দেহ একটা উপলক্ষ মাত্র।
আমি এ দফায় পুরোপুরি ঘাবড়ে গেলাম। স্যার আবারও স্বভাবসুলভ বাঁচালের ভঙ্গিমায় বলতে লাগলেন।
এসব ফিল্ম দেহ নয়, মস্তিস্ক নিয়ে কাজ করে। অনুভূতি শুরু হয় মস্তিস্ক থেকে। তারপর তা ছড়িয়ে যায় দেহে। এরপর দেহ উত্তেজনা পাঠিয়ে দেয় সেক্স অরগ্যানে। নতুবা একবার ভেবে দ্যাখো; সানি লিওনি, কেইডেন ক্রস, লেক্সিবিলি– এদের ছবি হিট্ করে। কিন্তু জয়নব বিবির করা নোংরা ভিডিও কেউ খুলেও দেখে না।
এত জ্ঞানী মানুষ! অথচ এত পচা কথা বলতে পারে! ভাবতেই পারিনি প্রথমে। ছি! তাই বলে আমিও কিন্তু এরপর নিশ্চুপ থাকিনি সেদিন। এমন সুযোগ হাতছাড়া করা যায়?
.
এতক্ষণ তো আমার প্রথম সমস্যা নিয়েই বললাম। এবার আমার দ্বিতীয়টার কথা শুরু করি। শরীরঘটিত।
বিষয়টায় অবশ্য আমি একা নাই, রাফিয়াও জড়িত। রাফিয়া, আমার বান্ধবী এবং পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি যাকে আমি শারীরিক সমস্যাটা শেয়ার করেছি। কারন, সে এই ফিল্মের কো-প্রডিউসার অ্যান্ড ফাইনান্সার। তাছাড়া যেহেতু সমস্যাটা শারীরিক সম্পর্কিত, সুতরাং বুঝতেই পারছেন একজন পুরুষ-মানুষ পড়িত। আর রাফিয়ার হল সেই মাকড়সা, যে যে-কোনো পুরুষ প্রাণীকে অনায়াসে আটকাতে পারে জটিল জালে। কী ভাবছেন? এবারও বুড়ো প্রিন্সিপাল! এইতো ফেঁসে গেলেন। ভুল। গ্রেট মিসটেক!
শিট! তার আগে আমি নিজেই ফেঁসে যাচ্ছি। বাজে ক’টা! রাতে তিনটা। কল করা দরকার। রাফিয়াকে। অতি দ্রুত। আপডেট আনতে হবে। ব্রেকিং নিউজ।
.
রাফিয়ার ফোন অবশ্য কল সেন্টারের মতো। সেভেন বাই টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স সার্ভিস। কল করামাত্রই সুমধুর রেসপন্স। ‘অল আওয়ার কাস্টমার রিপ্রেজেন্টেটিভ্স আর বিজি নাউ, প্লিজ ট্রাই এগেইন আফটার সাম টাইম।’ অর্থাৎ কাস্টমারদের ওয়েটিং-এ রাখাই কল সেন্টারগুলোর প্রধান দায়িত্ব। অথবা ফোন ধরেই লাইন কেটে দিতে হবে। তবে রাফিয়া অবশ্য কাস্টমার কেয়ারের মতো শুধুমাত্র লাইন কেটে দিয়েই নিশ্চুপ থাকে না। কলব্যাকও করে। ঠিক একমিনিট পর। এই একমিনিটে সব মিথ্যা গুছিয়ে নেয় সে। কারণ, মিথ্যে বলা ওর ফেভারিট হবি। তোমার প্রিয় শখ রচনা।
উহ্! একজ্যাক্ট মোমেন্টে ফোন করেছিস নিতু। আমি নিজেই তোকে কল করব করব ভাবছিলাম। কিন্তু ব্যাটা প্যাট্না ফোন-ই রাখে না।
প্যাটনাটা আবার কে? তোর নতুন পাবলিক! বি.এফ নম্বর ফোর টুয়েন্টি টু?
প্যাঁচাল বাদ। আগে বল্, কনগ্রাচুলেসন্স।
ও কে, বললাম, কনগ্রাচুলেসন্স
উ-হুঁ! একবার না। তি-ন-বা-র, তিন তিনবার বলবি।
কিন্তু কেন?
আগে বল্!
রাফিয়ার সাথে তর্ক করা, আর তামিল ফিল্মে একাকী নায়কের সাথে এক ডজন মাস্তান লাগিয়ে মারামারি করা এক জিনিস। বৃথা। পণ্ডশ্রম! অনিবার্য পরাজয়। সুতরাং কথা না-বাড়িয়ে আমি হাসলাম।
ও কে। কনগ্রাচুলেসন্স এক। কনগ্রাচুলেসন্স দুই। কনগ্রাচুলেসন্স তিন।
রাফিয়া বিজয়ীর হাসি হাসল।
গুড। ভেরি গুড। এবার কারণটা শোন। প্রথমটা হল, বাবা একবাক্যে ক্যামেরা কিনে দিতে রাজি হয়েছেন।
বিনা অপারেশনে! শুধু ওষুধে নাকি ইনজেক্শনে?
পাগল! এদেশে আন্দোলন ছাড়া দাবি আদায় করা যায়!
কী করলি! ভাংচুর? জ্বালাও-পোড়াও? হরতাল?
উ হুঁ। শুধু আমরণ অনশন।
প্রেসক্লাবের সামনে কতক্ষণ মৃত থাকলি স্যালাইন দিয়ে? রাফিয়া খিল খিল করে হাসতে থাকল।
মাত্র অর্ধরাত্রি। অর্ধরাত্রি অনশনেই সরকারের পতন। বাবা পুরোপুরি ‘কাইত’।
মানে?
নট অনলি ক্যামেরা। একটা মোটামুটি ফুলসেট ফিল্ম অ্যাপারেটাস্ রেডি। আমি অবশ্য তোর মিথ্যেটা ব্যবহার করেছি। বলেছি অ্যানিমেল’স ফিল্ম বানাব। ইউনেসকো, জাতিসংঘ, চাইল্ড ফিল্ম ফেয়ার ফেস্টিভালে পাঠাবো, ব্লা ব্লা ব্লা…
দ্বিতীয়টা বল।
তোর পছন্দের অ্যাক্টর ম্যানেজড্।
হোয়াট ননসেন্স! ইম্পসিবল। এই যে মিথ্যে বলা শুরু করে দিয়েছিস? ঠিকটা বল।
আমি মনে মনে তীব্র উত্তেজনা দমিয়ে রাখছি।
জি না। ডকুমেন্ট আছে। প্রুফ রেডি। ইম্পসিবল ইজ আ ওয়ার্ড ফাউন্ড অনলি ইন নিতু’স্ ডিকশনারি। নট নেপোলিয়ান’স্ অ্যান্ড রাফিয়া |
হাসির মাত্রা আরও একদফা বাড়িয়ে দিল রাফিয়া।
ঠিক আছে মানলাম। আগে ঘটনাটা বল, কিভাবে?
বলছি। একটু থাম। তিন নাম্বার গুড নিউজটা বলে নেই। পরে ভুলে যাব। একজন অভিজাত শর্টফিল্ম প্রডিউসার, তার ব্যক্তিগত মহামূল্যবান সময় ব্যয় করে আমাদেরকে রেকর্ডিং, এডিটিং, ফিল্ম মেকিং শেখাতে রাজি হয়েছেন। ধানমন্ডিতে তার ব্যক্তিগত ফিল্ম-মেকিং কোচিং স্টুডিওতে। সময়, তিন মাস। শর্ট কোর্স।
তি-ই-ন মাস! এত টাইম কি আমরা হাতে পাব?
উহ্! টাইম! আরেক ব্যাটা তো টাইম-ই দিচ্ছে না তোর সাথে শান্তিমতো কথা বলার। কল করে করে অস্থির করে ফেলছে।
কে?
কে আবার! তোর হিরু। স্যরি, তোর ফিল্মের হিরো মিস্টার প্যাটনা।
কী তখন থেকে প্যাট্না-স্যাটনা করছিস? হু ইজ হি?
হি ইজ মিস্টার প্যাটনা আসিফ।
ওয়েট, ওয়েট। আসিফ! আচ্ছা মানলাম। কিন্তু প্যাটা-টা আবার কোন্ ডিগ্রি?
রাফিয়া স্বভাবসুলভ হাসি চালিয়েই যাচ্ছে।
শোন্ নিতু, যাদের অভ্যাস সবকিছুতেই ঘাড়-ত্যাড়ামি করা, যেমন আমি, তাদেরকে আমরা কী বলি, বল্?
ট্যাট্না!
গুড, ভেরি গুড। দশে দশ। আর যারা মেয়ে পেলেই পটানো শুরু করে, তাদেরকে আমরা কী নামে ডাকব?
প্যাট্না?
রাইট। দশে বিশ। বিষয়টা সে রকম-ই। রবীন্দ্র সাহেবের মতো আমাদেরও নতুন একটা আভিধানিক শব্দ, প্যাট্না। যে ব্যক্তি কারণে- অকারণে সর্বজাতীয় মেয়ে পটাতে পারদর্শী। তবে আর যাই বলিস, ব্যাটা কিন্তু একটা চিজ। আমি তো এক রাতেই পটে ক্র্যাশ খেয়ে যাচ্ছিলাম প্রায়। ভাগ্যিস, তুই ব্লেড ভেঙে রেখেছিলি আগে থেকে।
মানে কী! তুই কি ছবির কথা বলে ফেলেছিস?
ধীরে বন্ধু, ধীরে। একটু ধৈর্য রাখ্। কনফারেন্সে কলটা দেই। তুইও শোন্। টাকি খাবি।
.
হ্যালো, হ্যালো নিতু, লাইন অ্যাকটিভ। আর ইউ ওকে? হ্যালো! হ্যালো! কী-রে তাব্দা মেরে আছিস ক্যান? মারা গেছিস?
আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। অতি দ্রুত নিজেকে শামুকের মতো খোলসে লুকিয়ে আবারও হাসি হাসি ভাব করলাম।
নো প্রবলেম রাফিয়া, আই অ্যাম জাস্ট নোকিয়া। কানেকটিং পিপল। চালিয়ে যা। লাইভ অ্যাকটিভ।
আমার কথা শোনামাত্র রাফিয়া ফোনে মন দিল।
আমার বুক ধড়ফড় করছে। হ্যাঁ! ওই তো, ওই তো শোনা যাচ্ছে সেই কণ্ঠস্বর। সেই চিরচেনা ভঙ্গিমা…
স্যরি রাফিয়া। স্যরি টু ডিস্টার্ব ইউ এগেইন। অ্যাকচুয়ালি তোমার ফোন রাখবার পর পরই মনে হল কথাগুলো। সত্যি কথা বলতে কী, তুমি যতক্ষণ অনলাইন-এ থাক, ততক্ষণ তোমার কথাই শুধু শুনতে মন চায়। কী বলতে চাই, ভুলে যাই!
ওহ্ রিয়েলি?
রাফিয়া হাসছে।
অফকোর্স ইট ইজ।
তার মানে আবারও ভুলে গেছেন নিশ্চয়ই, কী বলবেন!
দেখ, তুমি কিন্তু এখনও আপনি বলা ছাড়নি। বাংলা ভাষায় বন্ধুত্বের প্রথম শর্তই হল হাত ধরে নিচে নেমে আসা।
মানে?
আই মিন, প্রথমে আপনি। তারপর তুমি। এরপর তুই। তুই থেকে ছুঁই… যত কাছের বন্ধু, ততো আপন ডাক
রাফিয়া হাসছে।
তুমি সত্যিই খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পার আসিফ। আমি মনে হয় প্রেমেই পড়ে যাচ্ছি প্রায়। রিয়ালি আই লাইক ইট।
শোনো রাফিয়া, তোমাদের বাসার ছাদে কিন্তু…
আমি লাইনটা কেটে দিলাম
এতক্ষণে আমার কেঁদে ফেলা উচিত ছিল। কিন্তু আজ পারছি-না। কেন যেন কান্না আসছে-না। উল্টো পুরো মুখজুড়ে থুথু জমে ফেনা হয়ে আসছে। এক ধরনের তীব্র ঘৃণা তৈরি হচ্ছে। ওদের কথোপকথন শুনতে ইচ্ছে করছে-না। এক্ষুণি কারও ওপর এই ঘৃণা ঝেড়ে ফেলতে হবে। অতি দ্রুত। রাগ কিংবা ঘৃণা যতই ভেতরে পুষে রাখা যায়, ততোই তা মহামারী আকারে আশেপাশের লোকজনের কাছে ছড়াতে থাকে। সুতরাং অ্যান্টিবায়োটিক জরুরি। এক্ষুণি অন্য ওষুধে মন দিতে হবে আমাকে।
ঔষধ, ভয়াজিয়াম। যার কাজ মানুষকে ভয় দেখানো। অন্যের টেনশনে নিজে আনন্দ পাওয়া, কমন হিউম্যান বিহেভিয়র। ডোজ, ফাইভ মিলিগ্রাম। প্রথম প্রথম গভীর রাতে অচেনা পাঁচজনকে ফোন দেয়া। স্যরি, ভুল বললাম। চেনা মানুষকে অচেনা ভঙ্গিতে কল করা। যেমন, স্কুলের শাকচুন্নি মিস্, পাশের ফ্ল্যাটের লুঙ্গি আংকেল, আমাদের পাড়ার হাফপ্যান্ট মাস্তান, ইত্যাদি ইত্যাদি।
রাতের ফোন মানেই ভয়ের ফোন। যে ব্যক্তিই ফোন ধরেন, তার কণ্ঠেই ভয়ার্ত ভাব। সামান্য উচ্চস্বরে কথা বললেই, ভীত কণ্ঠে বলে বসেন, জ্বি ভাই, সব দোষ আমার।
সবাই ভয় পেলেও, রেজা স্যার অবশ্য পান না। এমনকি লাশ-খুনের কথা বললেও উত্তেজিত হন না। উল্টো আগ্রহভরে কথা বলেন। পারলে রোমান্টিক রসালাপও করেন। মেয়েমানুষের কণ্ঠস্বর শুনলে পুরুষরা যেমন মশার মতো প্যানপেনে আওয়াজে কথা বলে, সেভাবে জানতে চান। জি বলুন, কার হৃদয় খুন হল আজ!
উহ্! শুনলে গা জ্বলে ওঠে। দাঁত কিড়বিড় করে।
আমার কাছে অবশ্য সিম আছে। এক বাক্স। রাফিয়ার দেয়া। সব মোবাইল অপারেটরের। আমি এগুলোতে আলাদা আলাদা সিম্বল দিয়ে রেখেছি। এ থেকে জেড পর্যন্ত। বিভিন্ন কাজে। ভিন্ন ভিন্ন মানুষের জন্য।
.
আমি সব সময় ব্যবহার করা সিমটা খুলে রাখব। এটাতে ঢুকবে নতুন সিম। যার গায়ে লেখা, ই।
এর অর্থ অ্যালফাবেটিক অর্ডারে এটা আমার পঞ্চম সিম। ভয় দেখাতে নয়। এটা ব্যবহার হবে জয় করাতে। ‘ই’ ফর এনজয়। তা-ও শুধু একজনের জন্য। পরিচয়টা দিতে হবে-না নিশ্চয়ই!
একবার রিং হতেই কল রিসিভ হল ওপাশে।
আমি খুব ন্যাতানো ইংরেজিতে শুরু করলাম। নিজের গুনগান, তবুও বলে রাখা জরুরি। আমার প্রনাউনসিয়েশন আমার চেহারার মতোই সুস্পষ্ট।
হেলো ম্যান! দিজ ইজ সানি লিওনি, ফ্রম মুম্বাই।
ওহ্ রিয়ালি। হোয়াট আ কোইনসিডেন্স। আই ওজ রিডিং ইয়োর লাইফ হিস্টোরি ইন উইকিপিডিয়া।
হোয়াট!
আমি বিস্মিত হয়ে জিগ্যেস করলাম।
ইয়াহ্! ওয়ান অব মাই স্টুডেন্ট…
আমি থামিয়ে দিলাম
ড্রপ ইয়োর ডার্টি বিজনেস, ম্যান।
কণ্ঠটাকে আরো জড়ানো ভেজা করে বললাম, ডু ইউ নিড মি বেইবি?
এতক্ষণে ওপাশ থেকে আগ্রহী উত্তর এল।
হোয়াই নট! হু ডোন্ট নিড ইট বেইবি? প্লিজ কাম অন।
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম।
হোয়াট আ লিলিপুটিয়ান’স্ এনডেভার টু ক্লাইম্ব অন আ জায়েন্ট’স হেড! ডু ইউ নো মাই রেইট? ওয়ান ক্রোর পার সিটিং। হ্যাভ ইট?
উনি অট্টহাসি দিলেন।
অফকোর্স। নট ওয়ান বেইবি, আই হ্যাভ হান্ড্রেড ক্রোরস। বাট নট ক্যাশ-ইন হ্যান্ড, বাট ক্যাশ অ্যাট হার্ট।
হোয়াট আ ফানি জোক।
আমি মৃদু হাসলাম।
উনি খুব রোমান্টিকতা আর আবেগ দিয়ে বলতে লাগলেন।
বিলিভ মি! মাই লাভ, মাই ইমোশন্স, মাই ফিলিংস অ্যাবাউট ইউ অ্যান্ড ইয়োর লাইফ উইল বি ভ্যালুড অ্যাট মোর দ্যান ওয়ান থাউজেন্ডস্ ক্রোরস্। টেল মি, হাউ মাচ ইউ রিকোয়ার? প্লিজ টেল্?
তীব্র ক্ষুধাপেটে এক প্লেট ভাতের করুণাময় আমন্ত্রণ, উপেক্ষা করা খুব সহজ। কিন্তু তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে এমন আবেগভরা উষ্ণ আহবান, হজম করা সত্যিই অসম্ভব।
আমি এ দফায়ও লাইনটা কেটে দিলাম।
আমার মনে হচ্ছে বুকের ভেতর কোথায় যেন, কেমন যেন বিশাল এক পাথর জমে গেছে। নামছে না। মোটেও নামছে না। কোনো এক বিশাল বনের ফাঁকা জায়গায় একা একা হাউমাউ করে বুকে আঘাত হেনে কাঁদতে পারলে, হয়তো তা নেমে যেতে পারত। আছে কি পৃথিবীর কোথাও এমন কোনো স্থান?
.
হঠাৎ করে আমার মোবাইলটা উল্টোপাশ থেকে কল পেয়ে বেজে উঠল।
ওপাশের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। এখনও সেই আবেগমাখা, সেই মমতা জড়ানো গভীর কণ্ঠস্বর। তবে এবার বাংলায়।
কী ব্যাপার সানি, আসবে না! আমি যে তোমার মতোই জেগে আছি এখনও। ভালোবাসার চেয়ে বড় সেক্স পৃথিবীতে আর কী আছে বলো তো? বল, কবে আসছ? কখন?
কথা শেষ হওয়ামাত্রই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন তিনি।
আমার বুক জুড়ে তীব্র পানির পিপাসা পেতে লাগল।
ওপাশ থেকে কথা ভেসে আসছেই। আগের ভঙ্গিমায়।
কী ব্যাপার, বাংলা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে? নাকি, ট্রানশ্লেট করব হিন্দিতে। ওহ্ স্যরি, ইংরেজিতে। শোন সানি, আই মিন ফেইক সানি। যখন বাংলাদেশী কোনো নম্বর থেকে কল করবে তখন বাংলা নাম বলবে। যেমন ডাক্তার…, মডেল…, হা-হা-হা।
একবার ঘৃণা। তারপর কষ্ট। শেষে অপমান! আমার মেজাজ চরমে উঠে গেল। অধিক শোকে পাথরের মতো আমি অধিক অপমানে ইস্পাত হয়ে গেলাম। এরপর নিজেকে ঠাণ্ডা বানালাম। আজ কিছু কঠিন জবাব শোনাবই শোনাব এই জ্ঞানের ডিব্বাওয়ালাকে। ধীর বাংলায় আমিও বলতে লাগলাম।
আপনি কি জানেন আপনি একটা লুইচ্চা? লুইচ্চা নাম্বার ওয়ান। কুষ্টিয়ার ভাষায় আপনার মতো ফোর্থক্লাস লোকদের কী বলে গালি দেয় জানেন! ইল্লাত। ইল্লাতের ইল্লাত।
শোনো সানি! পৃথিবীতে সব পুরুষই লুইচ্চা। আই মিন ইল্লাত। তুমি তো নিউ জেনারেশন পিপল। ফেইসবুক রিলেটেড একটা জোক্স শোন তাহলে। খুব মজার। এক মেয়ে তার স্ট্যাটাসে মজার একটা পোস্ট দিয়েছে– পৃথিবীতে সকল পুরুষই তিন প্রকার। এক, জাত লুইচ্চা। দুই, জন্মগত লুইচ্চা। তিন, ভদ্ৰ লুইচ্চা।
আপনি কোন্ প্রকার? তিন নম্বর?
ওয়েইট, ওয়েইট। জোক্স সেটা নয়। আসল জোক্স হল, এর বিপরীতে অন্য একজন ছেলে একটা কাউন্টার জোক্স লিখেছে। আই মিন কমেন্টস। সেটাই মজার।
কী বলুন, শুনি!
ছেলেটা লিখেছে, পৃথিবীতে সকল মেয়েই একপ্রকার। সেটা হল … শব্দটা দুই অক্ষরের। ‘ম’ দিয়ে শুরু। মুখে বলতে চাচ্ছি না। ভেবে নাও। তবে তুমি না জানলে বলছি…
স্টপ ইট্। জাস্ট স্টপ ইট্ নাউ। আমি জানি শব্দটা।
পরের বাক্যগুলো বলতে গিয়ে আমার চোয়াল শক্ত হয়ে এল।
আপনি শুধু লুইচ্চা নন। প্রথম শ্রেণির লুইচ্চা। ইউ আর আ বর্ন রাসকেল।
ওপাশ থেকে তখনও হাসি হাসি কণ্ঠ 1
ইয়েস মিস্ ফেইক সানি! সানি লিওনিকে খুব খারাপ চোখে দেখছ। তার নাম ধরে অন্যকে প্রলোভিত করছ, তাই না? কিন্তু একবার ভেবে দ্যাখো তো, আমরা কি সবাই কম-বেশি তার খদ্দের নই? প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ। বিয়ে-সন্তান, বিজনেস-সার্ভিস, পার্টি-লাইফস্টাইল সব জায়গাতেই দেহের কদর। দৃষ্টিতে কিংবা স্পর্শে। মানসিক কিংবা শারীরিকভাবে। সুন্দরী দেহ মানুষের চাই-ই চাই। বিয়েতে সুন্দরী দেহ চাই, ভবিষ্যৎ সুন্দর সন্তানের জন্য। বিজনেসে সুন্দরী শরীর চাই, কাস্টমার সার্ভিসেস সাটিসফ্যাক্টরি হবার জন্য। পার্টিতে সুন্দরী মুখ চাই, সকলকে নিজের অ্যারিস্টোক্র্যাটেড লাইফ স্টাইল প্রদর্শনের জন্য।
আমি ভারি কণ্ঠে উত্তর দিলাম।
হোয়াট ডু ইউ মিন? শান্তি কী…
ওয়েইট, ওয়েইট মাই বয়। মন, মানসিকতা, মানসিক শান্তি! বিশ্বজুড়ে প্রতিটি মহিলা স্বামীর দেয়া ফেইসবুকের ফেইক আইডি’র মতো, যে ফেইক শান্তির সংসার করে, তার রহস্য জানো? তার রহস্যও এই সানিরাই। কত শত-সহস্র সানিদের স্যাক্রিফাইস্ যে জড়িয়ে আছে প্রতিটি সংসারে, তা জানলে মানুষ হিসেবে নিজের ওপর রুচি উঠে যাবে কাল থেকে। ডিয়ার ইয়াং লেডি, সানিরা জেগে থাকে বলেই, পরদিন তোমাদের মতো অনেকেই স্বামীর বুকে শান্তিতে মাথা রেখে ঘুমাতে পারে। লালনের একটা গান শুনেছ? গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়, তাতে ধর্মের কী আসে- যায়। ও হ্যাঁ, ভালো কথা। এটাও কিন্তু কুষ্টিয়া অঞ্চলের।
ফোনটা বন্ধ নয়, আমি জোরে ছুঁড়ে মারলাম বিছানা বরাবর। আর নয়। এ-না–ফ ইজ এ-না-ফ। লুইচ্চাটাকে এবার একটা শাস্তি দিতেই হবে। চরম শাস্তি। জন্মের শিক্ষা। অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল।