নিতাইচরণ তন্দ্রাহরণ – বিপুল মজুমদার
বারাসাত থেকে গড়িয়ার দিকে বাস ছুটে চলেছে। বাসের জানলা দিয়ে ছুটে আসা মিঠে হাওয়ার স্পর্শে সবেমাত্র ঝিমুনি ভাবটা আসতে শুরু করেছে, অমনি ভোলাবাবুকে চমকে দিয়ে মোবাইল ফোনটা ঝিনচাক সুরে বেজে উঠল। জীবনে এই প্রথম মোবাইল নিয়ে পথে বেরিয়েছেন ভোলাবাবু। যাচ্ছেন বোনের বাড়িতে ভাইফোঁটা সারতে। স্বামীর চাকরির কারণে দীর্ঘ দশ বছর ছোটোবোন দিল্লিবাসী। কিন্তু মাস দুয়েক আগে স্বামী হঠাৎ কলকাতায় বদলি হয়ে এসেছেন। তাই দাদাকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন বোন। এত বছর পর ছোটোবোনের কাছ থেকে ভাইফোঁটার নিমন্ত্রণ পেয়ে রীতিমতো রোমাঞ্চিত ভোলাবাবু। তাঁর আনন্দ আর ধরে না। তাই দামি একপিস তাঁতের শাড়ি, বড়ো এক প্যাকেট কড়াপাকের সন্দেশ নিয়ে সকাল-সকাল উঠে পড়েছেন বারাসাত-গড়িয়া রুটের বাসে। নামবেন বাইপাসের ধারে রুবি হসপিটাল স্টপে। স্টপ থেকে চার-পা হাঁটলেই তাঁর বোনের বাড়ি।
মোবাইলটা ভোলাবাবুর নিজের নয়। বউয়ের তাড়নায় বাধ্য হয়ে মেয়ের মোবাইল নিয়েই তাঁকে পথে বেরোতে হয়েছে। ট্রেনে-বাসে ঘুমোনোর বাতিক ভোলাবাবুর অনেক দিনের। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর ইদানীং সেই অভ্যেসটা যেন আরও বেড়ে গিয়েছে। এখন সিটে বসামাত্রই তাঁর দু-চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। শত চেষ্টা করেও নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেন না। দু-চার মিনিটের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যান। তাঁর এই ঘুমকাতুরে অভ্যেসটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তাঁর স্ত্রী নাকি আজ এক মোক্ষম দাওয়াই আবিষ্কার করেছেন। মোবাইলটা গছিয়ে দিয়েছেন সেই উদ্দেশ্যেই। মেয়ের কাছ থেকে জোরজার করে মোবাইলটা নিয়ে স্বামীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘এটা বুক পকেটে রেখে দাও। এরপর খেপে-খেপে যা ডোজ দেওয়ার আমি দিয়ে দেব।’
নিজের মোবাইলটা বাবার হাতে তুলে দেওয়ার সময় অফ-অনের কায়দাকানুন শিখিয়ে দিয়েছে মেয়ে। সেইমতো আঙুল দাবিয়ে মোবাইল অন করামাত্রই অন্য প্রান্ত থেকে স্ত্রীর বাজখাই গলা ভেসে এল, ‘কী, চোখ খোলা রয়েছে তো?’
বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় তাড়াহুড়োয় স্ত্রীর কথা তেমন কানে তোলেননি ভোলাবাবু। এখন বুঝলেন খেপে-খেপে ডোজ দেওয়ার অর্থ কী! তাঁকে হুড়কো দেওয়ার মতলবেই জোরজার করে মোবাইলটা গছিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি হাসার চেষ্টা করলেন, ‘হ্যাঁ বাবা, হ্যাঁ। খোলা চোখে ড্যাবড্যাব করে দিব্যি প্রকৃতির শোভা দেখছি!’
ভোলাবাবুর স্ত্রী অনেকটা আশ্বস্ত হলেন যেন। গলার সুর নরম করে বললেন, ‘এখন কোথায় তুমি?’
বাইরেটা একনজর দেখে নিয়ে ভোলাবাবু বললেন, ‘মধ্যমগ্রাম থেকে দোলতলার দিকে চলেছি।’
‘ঠিক আছে, ছেড়ে দিলাম।’ খট করে ফোন কেটে দিলেন ভোলাবাবুর স্ত্রী।
খানিক পর আবার যখন দু-চোখের পাতা এলিয়ে পড়বে-পড়বে করছে, বুকপকেটে আবার ঝিনচাক-ঝিনচাক। মোবাইল অন করতেই আবার সেই বাজখাঁই গলা, ‘কী গো, জেগে আছ তো?’
বিরক্তিতে খিঁচিয়ে উঠলেন ভোলাবাবু, ‘জেগে না-থাকলে ফোনটা ধরলাম কী করে? যা আরম্ভ করেছ না …সত্যি!’
‘তোমাকে একদম বিশ্বাস নেই। চোখ বোজার চান্স পেয়েছ কী অমনি কুম্ভকর্ণের নিদ্রা! তারপর স্টপটপ টপকে কোন চুলোয় গিয়ে নামবে কে জানে!’
‘এবার তা আর হবে না। এত বছর পর ভাইফোঁটা নিতে যাচ্ছি, ঘুমোনোর কোনো সিনই নেই! রুবি স্টপ পর্যন্ত একদম গোল চোখ করে বসে থাকব।’
‘তাই যেন হয়! তা এখন তুমি কোথায়?’
‘বিরাটি আর এয়ারপোর্ট দু-নম্বর গেটের মাঝামাঝি।’
‘ওকে, ছাড়লাম।’
তৃতীয়বার মোবাইলটা বাজতেই তেতো গেলার মতো মুখ করে যন্ত্রটা অন করলেন ভোলাবাবু। এবারও অন্যপ্রান্ত থেকে সেই একই প্রশ্ন, ‘কী, ঘুমোওনি তো?’
ভোলাবাবু ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘আচ্ছা মুশকিলে পড়লাম তো! মাথাটা খারাপ না-করে ছাড়বে না, নাকি?’
‘তোমার ভালোর জন্যই এসব করা। ঘুমের চক্করে যাতে না-পড়ো, সেজন্যই ঘনঘন এমন ফোনালাপ!’
‘আলাপ না হাতি! বলো, পাগলের প্রলাপ! বকবক করে আমার মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে!’
‘মাথা ধরলে ধরুক, কিন্তু ঘুম যেন কিছুতেই জাপটে না-ধরে।’
‘থেকে-থেকে যেভাবে মিসাইল ছুড়ছ, তাতে ঘুম আর জাপটে ধরবে কী করে? আচ্ছা, আমার উপর তোমার কোনো ভরসা নেই?’
‘না নেই। তা তুমি এখন কোথায়?’
‘কেষ্টপুরের কাছাকাছি।’
‘ঠিক আছে, রাখলাম।’
স্ত্রী ফোন কেটে দিতে মোবাইলটা বুকপকেটে রাখতে গিয়ে পাশে বসা অল্পবয়সি ছেলেটির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল ভোলাবাবুর। ছেলেটির মুখে চাপা হাসি দেখে তিনি লজ্জা পেলেন। খানিকটা সাফাই দিতেই যেন মুখে হাসি টেনে বললেন, ‘আমার গিন্নির ধারণা আমার কোনো তালজ্ঞান নেই। বাসে একবার চোখ বুজেছি কী কেস অমনি জন্ডিস, ঘুমের ঠেলায় নির্দিষ্ট স্টপে না-নেমে সিধে গড়িয়ায় হড়কে যাব। সেজন্যই দূর থেকে ঘনঘন এমন ফোনের গুঁতো!’
ভোলাবাবুর কথায় ছেলেটির বত্রিশপাটি দাঁত বেরিয়ে পড়ল, ‘ভালোই তো! দূর থেকে কী সুন্দর গাইড করছেন আপনাকে।’
‘গাইড নয়, বলো রিমোট কন্ট্রোল।’ ভোলাবাবুর মুখ-চোখে বিতৃষ্ণার ভাব ফুটে উঠল, ‘মানছি, ট্রেনে-বাসে উঠলেই ঘুম-ঘুম ভাব আমায় পেয়ে বসে। বাইরের হাওয়া চোখে-মুখে ঝাপটা মারলেই ভারী হয়ে আসে চোখের পাতা। কিন্তু তা বলে এতটা আহাম্মক নই যে, ঘুমের ঠেলায় দিশা হারিয়ে ফেলব! যত্ত সব!’
‘তবে যা-ই বলুন না কেন, আজকের ওয়েদারটা কিন্তু জব্বর। কী দারুণ ফুরফুরে হাওয়া! বাসে ঘুমোনোর তেমন অভ্যেস নেই আমার, কিন্তু আমারই মনে হচ্ছে একরাউন্ড ঘুমিয়ে নিলে মন্দ হয় না।’
ছেলেটির কথায় কেমন যেন ভেসে গেলেন ভোলাবাবু। মুখটাকে করুণ করে বললেন, ‘তা হলে তুমিই বলো, এমন ফুরফুরে হাওয়ায় ছোট্ট করে দশ-বিশ মিনিটের একটা মিনিঘুম লাগালে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়? কিন্তু আমার জাঁদরেল গিন্নির জ্বালায় সেটুকু হওয়ারও জো নেই। কপাল বুঝলে, কপাল!’
‘আপনি নামবেন কোথায় জেঠু?’
‘জেঠু! বাঃ, বেশ বেশ!’ ভোলাবাবু প্রসন্ন হয়ে উঠলেন, ‘রুবি স্টপে। হসপিটালের পিছনেই আমার বোনের বাড়ি। যাচ্ছি ভাইফোঁটা নিতে।’
‘রুবি! ওহো, আমিও তো ওই স্টপে নামব!’ ছেলেটি কাঁধ ঝাঁকাল, ‘তাহলে আপনার কোনো চিন্তা নেই জেঠু। মোবাইল অফ করে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ুন। রুবি আসার আগেই ডেকে দেব।’
‘তুমি ডেকে দেবে? একদম শিওর তো?’
‘হান্ডে�ড পার্সেন্ট শিওর জেঠু!’
‘উঃ, বাঁচালে বটে!’
ভোলাবাবু উল্লসিত, ‘তাহলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল। এত ভালো ওয়েদার…, এমন মিষ্টি-মিষ্টি হাওয়া…, আহা! বেঁচে থাকো বাবা! তা তোমার নামটা কী বাবা?’
‘নিতাইচরণ। নিতাইচরণ নস্কর।’
‘তা বাবা নিতাইচরণ, যদি কিছু মনে না-করো, আমার এই শাড়ি আর মিষ্টির প্যাকেট দুটো একটু বাঙ্কে তুলে দেবে?’
‘অবশ্যই দেব।’
দুজনে কথাবার্তা শেষ হওয়ার মিনিট দুয়েকের মধ্যেই বাসের সিটে ভোলাবাবুর ঘাড় এলিয়ে পড়ল। জানলা দিয়ে ছুটে আসা দামাল হাওয়ায় তাঁর চুল উড়তে থাকল, জামার কলার দুলতে থাকল, মুখটা ক্রমশ ফাঁক হতে-হতে একটা সময় গুহামুখে পরিণত হল।
অনেকক্ষণ পর মোবাইল ফোনটা আবার ঝিনচাক-ঝিনচাক সুরে বেজে উঠল। সুইচ অন করতেই ও প্রান্ত থেকে ভোলাবাবুর স্ত্রী ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘ইয়ার্কি হচ্ছে…। বলি, সুইচ অফ কেন?’ এপ্রান্ত থেকে তবুও কোনো সাড়াশব্দ না-পেয়ে ভদ্রমহিলা আরও খেপে গেলেন, ‘কী আশ্চর্য, উত্তর দিচ্ছ না কেন? বলি, ডিমে তা দিচ্ছ নাকি?’
‘ভাবছি কী বলব।’
‘অপূর্ব! তা তুমি এখন কোথায়?’
‘রুবি স্টপে দাঁড়িয়ে আছি।’
‘যাক বাবা, ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল আমার।’
‘আমারও তাই।’
‘কিছু একটা চিবনোর শব্দ পাচ্ছি মনে হচ্ছে? কোনো কিছু খাচ্ছটাচ্ছ নাকি?’
‘হ্যাঁ, সন্দেশ খাচ্ছি। কড়াপাকের সন্দেশগুলো দেখছি মন্দ নয়!’
‘উদ্ভট মানুষ তো তুমি! বোনের জন্য কেনা সন্দেশ রাস্তাতেই খেয়ে নিচ্ছ?’
‘খিদে পেলে কী করব!’
‘মাথাটা তোমার গিয়েছে বিলকুল! ভালো কথা, তোমার গলাটা হঠাৎ পালটে গেল কেন বলো তো? কেমন যেন ফ্যাঁসফেঁসে লাগছে। বাসের হাওয়া খেয়ে গলাটা বসে গেল নাকি?’
‘না, না, সেসব কিছু নয়। উত্তেজনার ধাক্কায় গলাটা কেঁপে-কেঁপে যাচ্ছে।’
‘কী যা তা বকছ! ভাইফোঁটা নেবে তাতে আবার উত্তেজনার কী আছে?’
‘বারে, এত ঝক্কি-ঝামেলার পর একটু উত্তেজনা হবে না? এক হাতে মোবাইল, অন্য হাতে শাড়ি-সন্দেশের প্যাকেট নিয়ে রানিংয়ে নামতে গিয়ে আর-একটু হলে প্রায় বাসের চাকার তলায় চলে যাচ্ছিলাম। তারপর জেঠু ঘুম থেকে জেগে উঠে হঠাৎ যদি চোর-চোর বলে চেঁচিয়ে উঠতেন, তাহলে কেসটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াত বলুন তো?’
‘অ্যাই…তুমি…ইয়ে মানে…তুই কে রে হতচ্ছাড়া?’
‘আমি নিতাইচরণ নস্কর। লোকে বলে নিতাইচরণ তন্দ্রাহরণ। ট্রেনে-বাসে লোকের তন্দ্রার সুযোগে টুকটাক এটা-সেটা হরণ করে থাকি।’
‘ব্যাটা তস্কর…পাজি,
ছুঁচো…।’ বলতে-বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন ভোলাবাবুর স্ত্রী, ‘হে ভগবান, সে-মানুষটি এখন কোথায় তবে!’
‘কে, জেঠু?’ নিতাইচরণের গলায় সহানুভূতির ছোঁয়া।
‘হ্যাঁ রে মুখপোড়া, হ্যাঁ।’
‘তিনি এখন বাসের সিটে ঘুমিয়ে কাদা। ঘুমোতে-ঘুমোতে গড়িয়ার দিকে এগিয়ে চলেছেন। আমার আবার কথা বলতে গিয়ে গলায় সন্দেশ আটকে যাচ্ছে জেঠি। আর কোনো কথা নয়। টা-টা বাই-বাই!’