নিতাইচন্দ্রর ঠিকানা
ঠাকুমা ওকে ডাকতেন নিতাইচন্দ্র বলে, মা ডাকতেন নিতো। বাবা ডাকতেন নিতাই।
কবে যে ও আমাদের বাড়িতে কার মাধ্যমে এসেছিল তা আজ আর মনে নেই। পাশের বাড়ির মণি-মাসিমার কাজের লোক ক্ষ্যান্তমণিদিদিই ওকে নিয়ে এসেছিল আমাদের বাড়িতে। ছোটো ছেলে। একটা ছেঁড়া হাফপ্যান্ট পরনে আর গায়ে একটা নোংরা হাত-কাটা গেঞ্জি।
মা প্রথম দিনই বলেছিলেন, তোকে দেখছি ধোপাবাড়ি পাঠাতে হবে। তোর গায়েও যা ময়লা!
ও বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হেসেছিল হি হি করে।
মাধবদার ওপর ভার পড়েছিল ওকে পরিষ্কার করার। ঝামা দিয়ে আর সানলাইট সাবান দিয়ে পাক্কা একটি ঘণ্টা ঘষে-মেজে মাধবদাদা নিতাইকে পরিষ্কার করেছিল। গামছা পরিয়ে ছাদে বসিয়ে রেখে ওর জামাকাপড় শুকোতে দিয়েছিল। পরে মা অবশ্য ওকে নতুন জামাকাপড় কিনে দেন।
দেখতে দেখতেই নিতাই আমাদের বাড়িতে একেবারে অপরিহার্য হয়ে উঠল। নিতাইকে নইলে কারোরই চলে না। ঠাকুমার দেখাশোনার জন্যে বামুনদি ছিলেন। তা সত্ত্বেও ক্ষণেক্ষণে নিতাইচন্দ্রকে না হলে তাঁর চলত না। মায়েরও হাতের কাছে সবসময় ও না থাকলেই চলত না। বাবাও মাঝে মাঝেই ডাকতেন ওরে নিতাই কোথায় গেলি? বলে।
তেতলা বাড়িতে ও হরিণের মতো ছুটে বেড়াত সিঁড়ি টপকে টপকে। আমি ছড়া লিখলাম ওর নামে:
নিতাই নিতাই নিত্যে
একলহমার অবসর নেই
তবু সুখ-কামনা চিত্তে।
‘এই’ বললেই হাতের কাছে
‘নেই’ বললেই নেই
হিসাববিহীন কাজ করে যায়,
লাফায় যে ধেই ধেই।
একরত্তি ছোঁড়া,
যেন বল্গা-ছেঁড়া ঘোড়া
মোদের নিতাই, নিতাই
তার একটিও নেই জোড়া।
দেখতে দেখতে চার-পাঁচ বছর কেটে গেল। নিতাই-এর তখন উঠতি বয়েস। ও দেখতে দেখতে বড়ো হয়ে গেল। নাকের নীচে গোঁফের ছায়া ঘন হয়ে এল। গলার স্বর বদলে গেল।
আমি নিতাই-এর চেয়ে অল্পই বড়ো ছিলাম। আমিও স্কুল ছেড়ে কলেজে উঠলাম। নিতাই-এর জীবনেও যে এই দ্রুত পরিবর্তনশীল চার-পাঁচটি বছরের মধ্যে কিছু পরিবর্তন ঘটা উচিত ছিল বা স্বাভাবিক একথা আমাদের কারো মনেই পড়ল না।
নিতাই কাজ করে। আমাদের সকলের কাজ করে। আমাদের সুবিধে হয় খুবই। ভালো কাজ করে অথচ মাইনে কম।
দুপুরে দু-ঘন্টা বিশ্রাম ছাড়া ভোর পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা অবধি অক্লান্ত পরিশ্রম ছিল নিতাইয়ের। সমস্ত কাজের জন্যেই আলাদা আলাদা লোক থাকা সত্ত্বেও নিতাই-এর কাজ কমত না একটুও, কারণ ওর কাজই ছিল সকলের ফরমায়েশ খাটা। সেজোকাকুর নস্যি, ছোটোকাকুর সিগারেট, মায়ের জর্দা, ঠাকুমার তুলসীপাতা, বাবার দাড়ি-কামানো ব্লেড, ছোটোবোনের পেনসিল, ছোটোঠাকুমার দোক্তাপাতা। এইসবের জন্যে ওকে সারাদিনে কত বার শুধু দোকানেই দৌড়োতে হত। যতবার ওপর-নীচ করতে হত তাতে পনেরো দিনে একবার করে মাউন্ট এভারেস্ট চড়া আর থর মরুভূমি পেরোনোও হয়ে যেত।
একদিন মা বললেন, ক্ষ্যান্তমণি যে বলেছিল তোর মা-বাবা সকলেই আছে তা তুই একদিনের জন্যেও দেশে গেলি না এই ক-বছর। ব্যাপারটা কী বল তো?
উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল নিতাই।
কী রে? কথা বলছিস না কেন?
তবুও নিতাই চুপ করেই রইল।
মাইনে যে পাস তার থেকে কিছু কি পাঠাস মা-বাবাকে?
না:।
জোরে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল নিতাই।
কেন? পাঠাস না কেন?।
এমনিই।
তোর দেশটা কোথায়?
ডায়মণ্ড-হারবার লাইনে।
গ্রামের নাম কী?
ওই তো। আমতলার কাছেই।
আরে গ্রামের নাম তো বলবি।
বলে কী হবে?
তার মানে? তুই যদি চুরি করে পালাস-টালাস, পুলিশকে তোর ঠিকানা জানাতে হবে না?
ফিক করে হাসল নিতাই।
বলল, আমি যে চুরি কখনোই করব না, তা আপনি জানেন।
মা, পান মুখে দিয়ে, জর্দা ফেলে বললেন, ভালো লোকও চোর হয়। ‘সু’ আর ‘কু’ দুই দেবতা অনবরত ঘোরেন। কার ঘাড়ে যে কোন দেবতা কখন ভর করেন তা কে বলতে পারে?
আমি চুরি করব না। মরে গেলেও না।
মা পানের পিক ফেলে বললেন, তা না হয় মানলাম কিন্তু তুই কি গোরু না ছাগল যে তোর ঠিকানা থাকবে না? তাদেরও তো একটা ঠিকানা থাকে, নাকি?
নিতাই চুপ করে থাকল মাথা নীচু করে। কিন্তু কথা বলল না।
অনেকক্ষণ পরে বলল, ক্ষ্যান্তমাসি সব জানে।
মা আমাকে একদিন বললেন, শুনেছিস, ক্ষ্যান্তমণি নাকি মণিদের বাড়ির কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। কিছু না বলে। হঠাৎই। ওদের বাড়ি থেকে একটি দেওয়াল-ঘড়িও হারিয়ে গেছে। ঘড়িটা মণির শ্বশুরমশাই সেই উনিশ-শো চৌত্রিশে সুইটজারল্যাণ্ড থেকে এনেছিলেন। মোরগ ডাকতে ডাকতে বেরিয়ে আসে প্রতিপ্রহরে।
রমা বলছিল, হঠাৎ না বলে-কয়ে চলে গেল তাই সন্দেহ হচ্ছে। কিন্তু অত বড়ো ঘড়ি নিলই বা কী করে? মান্তু বলছিল, পুঁটুলির মধ্যে করে নিয়ে গেছে। নিয়ে যেতে চাইলে কেউ কি আর ঠেকাতে পারে? আস্ত মানুষ নিয়ে যাচ্ছে, আর ঘড়ি!
এখন নিতাই যদি কিছু করে বসে তাহলে বাড়িসুদ্ধু সকলে তো দায়ী করবে আমাকেই।
মা বললেন।
আমি বললাম, নিজের বাড়ির ঠিকানা জানে না এমন তো হতে পারে না। কিন্তু তোমরা নিতাইকে নিয়ে ভাবছই বা কেন? ও তো আমাদের বাড়ির লোকই হয়ে গেছে। ও যে অমন কিছু করবে তা বিশ্বাস হয় না।
ঠাকুমা দালানে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। বাইফোকাল চশমার ওপরে চোখ তুলে বললেন, কথায় বলে, জন, জামাই আর বোনপো কখনো আপন হয় না। তারা হতে চাইলেও কেউ তাদের আপন মনে করে না। আর অন্যেরা মনে করতে চাইলেও তারা হতে চায় না।
তাই?
আমি বললাম।
মা বললেন, কী জানি বাবা, আমার তো মন খারাপই হয়ে গেছে ক্ষ্যান্তমণির হঠাৎ চলে যাওয়াতে। তা ছাড়া মেয়েটা অমন না বলে-কয়ে যে চলে গেল সে-কারণেও তো একটা খোঁজ নেওয়া দরকার। কোনো বিপদ-আপদও তো হয়ে থাকতে পারে। বলা নেই কওয়া নেই, কাকভোরে উঠে সে বেপাত্তা হয়ে যাবে? এ কীরকম! সাতবছর কাজ করছে সেখানে।
আমি বললাম, নিতাইকে সঙ্গে করে আমি যাচ্ছি ক্ষ্যান্তমণিদিদিদের বাড়ি। তাহলে ক্ষ্যান্তদিদির কোনো বিপদ হল কি না জানা যাবে আর নিতাই-এর বাড়িও দেখা হয়ে যাবে একইসঙ্গে। ক্ষ্যান্তমণিদিদিদের গ্রামেই তো নিতাইয়েরও বাড়ি। তাই নয়? তোমরা নিতাইকে যা মনে করো, ও তা নয়।
আমি কিছুই মনে করি না। তোর বাবা কেমন অগোছালো ভুলোমনা তা তো জানিসই। আলমারির চাবি, কলম, মানিব্যাগ কোথায় যে ফেলে রাখেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছুরই ঠিক থাকে না। মানুষের মনে লোভ জাগাতে নেই, বিশেষ করে অভাবী মানুষের। আমার মা বলতেন, মানুষের লোভের কথা কি কেউ বলতে পারে? ভগবানরাই জানেন না, তা মানুষ। কখন যে কোন মানুষ কী করে তা আগের মুহূর্তেও নিজে জানে না।
আমি বললাম, আগামী রবিবারে যাব নিতাইকে নিয়ে। ক্ষ্যান্তদিদির খোঁজ করতে।
সকালের জলখাবার খেয়ে নিতাই আর আমি বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে ট্রামে করে মোমিনপুরে গেলাম, তার পর বাসে করে ডায়মণ্ড হারবারের পথে। দেখতে দেখতে ঠাকুরপুকুর, জোকা পেরিয়ে গেলাম। এখন দু-দিকে সবুজের সমারোহ। ভরা বর্ষা। কলেজ খুলে যাবে এবারে। নতুন কলেজে উঠেছি। নতুন সব বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে। সেই আনন্দেই ডগমগ হয়ে রয়েছি আমি। যেন ডানা গজিয়েছে আমার। বাবা বলেছেন, একটা মোটরসাইকেল কিনে দেবেন।
দু-পাশের বৃষ্টিভেজা ধানখেত, নারকোল গাছ, কলা গাছ দেখে মন নেচে উঠছে। নিতাইকে বললাম, তোর কী মজা রে! এমন সুন্দর জায়গায় থাকিস?
নিতাই মাথা নাড়ল। মুখে কিছু বলল না।
পৈলান, কোণচৌকি পেরোবার পর নিতাই কী যেন বলল, কনডাক্টরকে। বাস কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। নিতাই উঠে পড়ল সিট ছেড়ে। আমিও নামলাম ওর পেছনে পেছনে। ওর গ্রামের নামটা তবুও জানা গেল না।
বাসটা চলে গেল। আমি টিকিটটা উড়িয়ে দিলাম। সেটা কিছুক্ষণ বাসটাকে ধাওয়া করে গিয়ে আবার ফিরে এল। এসে পথে পড়ল।
পথের দু-পাশ দিয়ে নালা গেছে। নালার ওপর সাঁকো। পথের পাশে পান-বিড়ির দোকান। ছোট্ট একটি মুদিখানা। কেরোসিনের তেল, গুড়, আর শুকনো লঙ্কার গন্ধ বেরোচ্ছে। বড়ো একটা নিম গাছ। সাঁকোর পাশেই। একটু এগিয়ে একটি কৃষ্ণচূড়া।
পায়ে-হাঁটা পিছল রাস্তা দিয়ে আমরা এগোতে লাগলাম। দু-ধারেই ধানখেত। সবুজ। ঘন সবুজ। দূরে একসারি সাঁইবাবলা এবং তার পরেই আম-জাম-কাঁঠালের কুন্ডলীর আড়ালে কয়েকটি খড়ের এবং দু-একটি টালির ঘর দেখা যাচ্ছে। পুরো গ্রামটিই বড়ো জীর্ণ। গরিব। একপাশে মস্ত একটা বাঁশঝাড়। নীলকন্ঠ পাখি উড়ছে সবুজ খেতের ওপর। ডাহুক ডাকছে গ্রামের গাছের দোলায়। কলকাতার এত কাছে এমন গ্রাম যে আছে তা ভাবা যায় না।
আমি বললাম, নিজের মনেই, কী সুন্দর!
নিতাই কোনো কথা বলল না।
গ্রামের মধ্যে ঢুকতেই মেয়েরা এবং ছোটো ছেলে-মেয়েরা নিতাইকে দেখামাত্রই ওরে দ্যাকরে! নিত্যে এসেছে রে। আমাদের নিতে। জামা পেন্টুলুনের ইস্টাইলটা দ্যাক একবার! বলেই নিতাইয়েরই সমবয়েসি একটি ছেলে, হয়তো ওর বন্ধুই হবে, হেসে উঠল হাতে তালি দিয়ে।
নিতাই হাসল। ম্লান হাসি।
তখন ক্ষ্যান্তমণিদিদি দৌড়ে এসে কেঁদে উঠল ডুকরে। কয়েকজন মেয়ে ক্ষ্যান্তদিদির আশপাশে জুটল। পুরুষরা সবাই মাঠে। শুনলাম যে এক বিচ্ছিরি দুঃস্বপ্ন দেখে ক্ষ্যান্তদিদি ভোররাতেই প্রথম বাস ধরে চলে আসে মণিমাসিদের বাড়ি ছেড়ে এই গ্রামে। এবং এসে দেখে যে, সেই দুঃস্বপ্ন সত্যি। তার পনেরো বছরের ছেলে রাখালকে সাপে কামড়েছে। তাও যে-সে সাপ নয়। চন্দ্রবোড়া সাপ। ওঝা বদ্যি, এমনকী ব্লকের ডাক্তারবাবু কেউই কিছু করতে পারলোনি রে নিত্য! সে চইলে গেল।
বলেই ক্ষ্যান্তমণিদিদি কেঁদে উঠল।
আমি নিতাই-এর মুখ দেখে বুঝলাম যে, রাখাল ওর খেলার সাথি ছিল।
ক্ষ্যান্তমণিদিদি আমার সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিল। তার পর ক্ষ্যান্তমণিদিদির খড়ের ঘরের দাওয়ায় মাদুর পেতে বসতে দিল আমায়।
বলল, আমার খোঁজে এয়েচো আমাদের গাঁয়, দুটি ডালভাত খেয়ে তবেই যাবে দাদাবাবু।
তখনও কাঁদছিল ক্ষ্যান্তমণিদিদি। বলছিল, মণিমাকে গিয়ে বোলো, বড়ো ভালো ছেলে ছিল গো রাখাল আমার। ওর ভরসাতেই ছিলাম। এখন চিতেয় ওঠার দিন অবধি আমায় কাজ করতে হবে গো দাদাবাবু। নিস্তের নেই কোনো। ভাবলেও বুক ফেটে কান্না আসে।
বলেই, ভেতরে গেল রান্না করতে।
একটুখন বসে, জল আর বাতাসা খেয়ে আমি নিতাইকে বললাম, তুই তোর বাড়ি নিয়ে যাবি না?
নিতাই ফ্যালফ্যাল-করে চেয়ে রইল তখনও আমার চোখে।
তার পর আমাকে নিয়ে উঠল। যেন বিষম অনিচ্ছায়। গ্রামের একপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছোলাম আমরা। একটা একচালা খড়ের ঘর। ভেঙে গেছে। আগাছা গজিয়ে গেছে তার ভিটেতে। একটা সজনে গাছ ঝুঁকে পড়ে যেন অন্ধকার ঘরের ভেতরে কী আছে তা দেখবার চেষ্টা করছে। দাঁড়কাক ডাকছে কর্কশ গলায়। মেঘলা আকাশের নীচে ঝুরুঝুরু হাওয়ায় নিম ফুল উড়ছে।
আমরা তার ভিটেয় উঠতে যাচ্ছি এমন সময় পেছন থেকে একটি মেয়ে ডাক দিল। বলল, নিত্যেদা, ওখানে যেয়োনি। কাল-কেউটে জোড়ে আছে ওখানে। মারা পড়বে গো!
কে রে? টেঁপি?
নিতাই ঘুরে দাঁড়াল।
হ্যাঁগো? নিত্যেদা। মনে আছে? তুমি আমার গায়ে হ্যারিকেনের ছাঁকা দিয়েচিলে? আমি যখন ছোট্ট ছিলাম?
বলেই, হেসে উঠল ফোকলা দাঁতে।
নিতাইও হাসল। বলল, তুই এখনও ছোটোই আছিস।
তার পর আমাকে বলল, চলো দাদাবাবু ফিরি।
এই কি তোমার বাড়ি? ঘর?
টেঁপি বলল, হ্যাঁ গা! এই তো। তুমি কে গা?
কী উত্তর দেব, ভেবে না পেয়ে উত্তর দিলাম না।
নিতাই মাথা নোয়াল। তার পর আমাকে বলল, দাদাবাবু, মাকে বোলো, এই আমার ঠিকানা। বাবা মারা গেছিল যখন আমি ছ-মাসের। পিচরাস্তায় গাড়ি চাপা পড়ে। আর মা, পাঁচ বছর আগে এমনই এক বর্ষার দিনে যখন কচুর শাক তুলছিল তখন…
কী করে?
বাজ পড়ে। মাঠের মধ্যে নয়, গাছ আর ঝাড়ের মধ্যেই পড়েছিল দেহটা। সন্ধে বেলা খুঁজতে খুঁজতে পেয়েছিল ভুন্তকাকারা।
একটু চুপ করে থেকেই বলেছিল, তাপ্পর-ই তো ক্ষ্যান্তমাসি আমাকে সঙ্গে করে নে গেছল তোমাদের বাড়ি।
সাদা খয়েরি গো-বক বসেছিল পুকুরপাড়ে। বিতিকিচ্ছিরি বুককাঁপানো শব্দ করে একটি হুপী পাখি জোরে উড়ে চলে গেল।
নিতাই বলল, যেন নিজেরই মনে, শহরের বাবুরা ভাবেন, সকলেরই বুঝি তাদেরই মতো বাড়ি থাকে। ঠিকানা! আমরা গোরু-ছাগলেরই মতো বাবু। আমাদের ঠিকানা তোমাদেরই বাড়ি। সবাই কি ঠিকানার ভাগ্য করে আসে এখানে? টিভিতে দেখো-না? মাঝে মাঝে নেতারা হেলিকপটারে চড়ে আসেন? এসে শুধোন, আপনারা ভালো আছেন তো? কই তকলিফ হ্যায় আপলোগোঁকো?
এই সেই গ্রাম। সেই সব গ্রাম।
জোর বৃষ্টি নামল হঠাৎ। নিতাই বলল, দৌড়োও দাদাবাবু। তোমরা হলে গিয়ে শহরের বাবু নোক। বিষ্টিতে ভিজেচো কী জ্বরে পড়বে।
বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তিরের ফলার মতো বিঁধছিল আমাকে। কপালে, চোখে, বুকে, মুখে। আমি দৌড়োতে লাগলাম। দূরে ক্ষ্যান্তমণিদিদির বাড়ি তখন বৃষ্টির দুধলি ঝালরে ঢাকা পড়ে গেছিল। মনে হচ্ছিল যেন জাপানি ওয়াশের কাজের ছবি কোনো। সাজানো-গোছানো বসবার ঘরের দেওয়ালে টাঙানো আছে। ঠোঁটে গাল-গড়ানো বৃষ্টির জলের ছাট লাগতে লাগল।
নোনতা।