নিতাইকাকু

নিতাইকাকু

রবিবার। বড়মামার চেম্বার নেই। রোগেরও ছুটি। রুগিরও ছুটি। দোতলার হলঘরে বেশ বড় জমায়েত। জগন্নাথকাকু, বিকাশকাকু। আমাদের বাড়ির সবাই। পাড়ার আরও অনেকে। বিজ্ঞানের অধ্যাপক, গবেষক নৃপেনবাবু। বিজ্ঞান ছাড়া কিছুই বিশ্বাস করেন না। ভুরু কুঁচকে বসে আছেন। সবার থেকে আলাদা। কথায় কথায় বলেন, ‘কোয়ান্টাম থিওরি’। জ্যোতিষী নিতাইকাকুকে আজ দেখে নেবেন। বিজ্ঞানের শিলে ফেলে যুক্তির নোড়া দিয়ে থেঁতো করবেন।

বিকাশকাকু বড়বাজারের সেরা দোকান থেকে এক ঝাঁকা খাস্তা কচুরি এনেছেন। আজ বিরাট ব্যাপার। এক রাউণ্ড চা হয়ে গেছে। নিতাইকাকু নিজের জীবনের গল্প বলছেন।

বাবা বললেন, নিতাই তোর বিয়ে দোবো, মেয়েটা ভালো, পরিবার ভালো। একবার গিয়ে দেখে আয়।

বিয়ে। বিয়ে করতে যাব কোন দুঃখে। সারাটা জীবন একটা মেয়েকে ঘাড়ে নিয়ে ঘোরা। আমি কি ঘোড়া!

নৃপেনবাবু বললেন, ছিঃ, ছিঃ নারীদের আপনি বোঝা ভাবেন? নারী হল শক্তি। শক্তি স্বরূপিণী। কোয়ান্টাম ফিলড থিয়োরিতে শিব আর শক্তির ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। সর্বত্র ঝিন ঝিন, রিন রিন, চিন চিন করে শক্তি কাঁপছে। ঢেউয়ের পর ঢেউ ঢেউ বেরোচ্ছে তরঙ্গের আকারে। জন্ম, মৃত্যু, মৃত্যু, জন্ম…।

নিতাইকাকু বললেন, স্টপ, স্টপ। আমি আমার জীবনের কথা বলছি। বিয়ের কথা শুনে মার চম্পট। সোজা বীরভূমে। সেখানে অট্টহাস বলে একটা শক্তিপীঠ আছে। কারো ক্ষমতা নেই আমাকে খুঁজে পায়; সমস্যা হল, কোথায় থাকব? কী খাব? কুঠিয়ায় এক ভৈরবী। কী চেহারা। আগুন বেরচ্ছে শরীর দিয়ে। চোখ দুটো যেন হোমের শিখা! ভয় আর ভক্তি দুটোই হল। ভৈরবী ইশারায় কাছে ডাকলেন, বেশ করেছিস পালিয়ে এসেছিস? বিয়ে তোর সহ্য হবে না।

খুব অবাক হয়ে গেলুম। কী করে জানলেন আমি পালিয়ে এসেছি! এর পরে যে-কথাটি বললেন, শুনে আমার মাথা ঘুরে গেল। বললেন, পূর্ব জন্মে তুই আমার স্বামী ছিলিস। এ জন্মে তুই আমার ছেলে হবি।

বয়েস তখন কম। একপাশে বিরাট শ্মশান। চিতা জ্বলছে। চিতার কাঁপা কাঁপা আগুনে, মাথার ফেট্টি-বাঁধা কালো কালো কটা ছায়া মূর্তি বাঁশ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। পাশ দিয়ে বসে যাচ্ছে অসম্ভব নোংরা, শীর্ণ একটা নদী। নদীর ওপারে, জঙ্গলে, একপাল শেয়াল মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে। নদীর দিক থেকে রাতের ভারী বাতাসে পচা পচা একটা গন্ধ ভেসে আসছে।

কুঠিয়ায় একটা প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলছে। ঘরের উত্তরের দেয়াল ঘেঁষে টকটকে লাল তারা মায়ের মূর্তি। দেখলেই ভয় করে। তার ওপর এইসব কথা।

সাধিকা বললেন, আর যে পালাতে পারবি না। তোকে আমি বেঁধে ফেলেছি।

আমি তখন কাঁদছি—তুমি কি আমায় বলি দেবে!

মুচকি হেসে বললেন, অবশ্যই! তবে দেহটা থাকবে।

হঠাৎ বললেন, এই মাটির কলসিটা নিয়ে ওই নদীটায় চলে যা। জল নিয়ে আয়, মায়ের ভোগ রান্না হবে।

বললুম, ও তো বিষাক্ত জল।

সাধিকা বললেন, বিষ নিয়েই আমাদের কারবার।

কলসি হাতে নদীর দিকে যাচ্ছি। চিতা নিবে গেছে। ফিন ফিন করে ধোঁয়া উঠছে। কুচকুচে কালো রাত। শবের সঙ্গে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা চলে গেছে। শব ভালো করে দাহ করা হয় না। আধপোড়া দেহ জলে ফেলে দিয়ে গেছে। বাকি কাজটা শেয়ালে করবে। সকালে শকুন আসবে ঝাঁকে ঝাঁকে। প্রথমে ভীষণ ভয় করছিল; হঠাৎ খুব সাহস এসে গেল। সব চেয়ে সাংঘাতিক কী হতে পারে মৃত্যু। মানুষ তো মরবেই। মরার জন্যেই পৃথিবীতে আসা। মৃত্যু আস্বাদন করব বলেই এই জীবন। জল নিয়ে ফিরে এলুম, তখন আর ঘেন্নাও করছে না। অন্ধকারে কলসিতে কী ভরেছি জানি না। সাধিকা বললেন, ওই কলসির জল এই কলসিতে ঢাল।

অবাক কাণ্ড! প্রদীপের আলোয় দেখছি, কাঁচের মতো জল এই কলসি থেকে ওই কলসিতে পড়ছে। বিশাল চেহারার একটা লোক ভূতের মতো দাওয়ায় এসে দাঁড়াল। মনে হল কিরাত। সাধিকা জিগ্যেস করলেন, মাংস এনেছিস?

মাংস এনেছে। কাঠের উনুনে আগুন জ্বলল। সাধিকা মায়ের ভোগ রাঁধতে বসলেন। কী তার স্বাদ! রাতে যখন খেতে বসলুম, তখন মনে হল এমন সুস্বাদু ভোগ আগে কখনো খাই নি। সাধিকা বললেন, ওই কম্বলটা পেতে শুয়ে পড়। অনেক রকম শব্দ শুনতে পাবে, ভয় পেয়ো না।

শুয়ে পড়লুম। তন্দ্রা, ঘুম, ঘুম, তন্দ্রা এই রকম চলতে লাগল। হঠাৎ চোখ দুটো যেন ঝলসে গেল। ঘরে হাজার হাজার পাওয়ারের আলো জ্বলে উঠেছে। পূজার আসনে সাধিকা বসে আছেন সোজা। সাধিকা কোথায়! বাঘছালের আসনে বাঘ ছাল পরে বসে আছেন স্বয়ং মহাদেব। বিরাট আলোর উৎস হল মহাদেবের ত্রিশূল। আমার শরীর অসাড় হয়ে গেল। অচেতন হইনি; কিন্তু পাথর। সে এক অদ্ভুত উপলব্ধি! পাষাণী অহল্যার মতো। পাথর কিন্তু চেতনা আছে। সব বুঝতে পারছে। কালের পর কাল চলে যাচ্ছে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, বসন্ত। রামচন্দ্র এসেছেন, তাও বুঝতে পারছেন।

ভোর হয়ে গেল। সব জড়তা চলে গেল। বাইরে এসে দেখছি সাধিকা ফুল তুলছেন। দিনের বেলা অনেক ভক্ত আসতেন। আর আসতেন দুটি বধূ। সকালে মায়ের পুজো হত খুব বড় করে। বড় করে ভোগ দেওয়া হত। ওই দুটি বউ যা খাটতেন সে বলার নয়, যেন দশভূজা। আর কাজ ছিল কাঠ কাটা। বহু দূরে একটা টিউবওয়েল ছিল, সেইখান থেকে জল বয়ে আনা। কিরাতের মতো ওই লোকটির নাম ছিল রাবণ। বড় ভালো মানুষ। সাধিকা মায়ের জন্যে জীবন দিয়ে দিতে পারত। বড় বড়গাছ একাই কেটে আনত জঙ্গল থেকে। মাঝে মাঝে কুটিয়ার ছাতে উঠে খড় বিছিয়ে দিত। চালের ওপর লাউ গাছ লতিয়ে দিয়েছিল। বড় বড় লাউ হত। নদী থেকে মাছ ধরে আনত।

একদিন আলো দেখলুম, মহাদেবের শুভ্রজ্যোতিঃ। এরপরে দেখলুম কালীর কালো। সে যে কী ভয়ঙ্কর! আলোর কোনও ওজন নেই, কালোর ওজন আছে। আলো পাউডারের মতো, পরাগের মতো। কালো আলকাতরার মতো, জমাট রক্তের মতো।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। অদ্ভুত শব্দ। যেন লোহার শেকল বাজছে। ভারী ভারী লোহার শেকল। চোখ মেলে কিছুই দেখতে পেলুম না। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। মাটির বহু গভীরে কবরে চলে গেছি যেন। শ্বাস নিতে পারছি না। কনকনে ঠান্ডা। কালে কালে কে যেন বলছে, মৃত্যু—তুমি মরে যাচ্ছ। উঠে বসার চেষ্টা করলুম। পারলুম না। শেকলের শব্দ হল। কেঁদে ফেললুম—মা! এক বিন্দু আলো দেখাও। স্থির জোনাকির মতো, দূর আকাশের তারার মতো সেই ভয়ঙ্কর অন্ধকারে এক বিন্দু আলো ফুটলো। দেখি, মায়ের কালো কপালে তাঁর ত্রিনয়ন। টকটকে লাল মায়ের মূর্তি। নিরেট অন্ধকারে খোদাই করা। ‘মা’ বলে জ্ঞান হারালুম।

ভোর হল। জ্ঞান ফিরে এল। সাধিকা মা ফুল তুলছেন, গান গাইছেন। আমি গিয়ে বললুম, মা! তুমি আমাকে এই সব দেখিও না। আমার ভয় করে, আমি মরে যাব মা।

মা অদ্ভুত একটা কথা বললেন, না মরলে বাঁচবি কি করে! শেষ দর্শন বাকি আছে।

অবশেষে সেই দর্শন হল। সে তো বলা যাবে না। কিছুই নেই। আপনারা ভাবার চেষ্টা করুন, ধারণা করার চেষ্টা করুন। কিছু নেই। কিছু থাকলে কিছু নেই, ধারণা করা যায়। আছে আর নেই, নেই আর আছে, এই দুটো মাত্রায় জগৎ বাঁধা। স্বামী বিবেকানন্দ একটা গানে বলার চেষ্টা করেছেন, নাহি সূর্য নাহি জ্যোতিঃ, নাহি শশাঙ্ক সুন্দর / ভাসে ব্যোমে ছায়াসম, ছবি বিশ্ব চরাচর / তারপর?

অত্যন্ত কঠিন পর্যায়—ধারণার লয়। অস্ফুট মন আকাশে জগত সংসারে ভাসে, ওঠে ভাসে ডুবে পুনঃ অহং-স্রোতে নিরন্তর। আমি মানে আমার অস্তিত্ব, আমার অহঙ্কার আছে বলে তুমি আছ, একটা বিভেদ। আমি দেখছি তাই তোমাকে দেখাচ্ছে। আমার দর্পণে তুমি, তোমার দর্পণে আমি। এই জগৎ একটা আয়না। আয়নাটা ভেঙে গেলে কী আর রইল। এই যে ছায়া, সেই ছায়াদল আর থাকবে না। স্বামীজি লিখছেন—ধীরে ধীরে ছায়াদল, মহালয়ে প্রবেশিল, বহে মাত্র ‘আমি আমি’ এই অনুক্ষণ। ‘আমি’টা অর্থাৎ অনুভূতিটা রয়েছে তখনো—চেতনা। শেষ অবস্থা। তারপর? সে ধারাও বদ্ধ হল, শূন্যে শূন্যে মিলাইল, ‘অবাঙ-মনসোগোচরম’ বোঝে প্রাণ বোঝে যায়। এই শূন্য এক মহাবিজ্ঞান। শূন্য আর অনন্ত এক। উপনিষদ সেই মহাবিজ্ঞানের কথা বলছেন—পূর্ণস্য পুর্ণম আদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যপ তো সংস্কৃতে পূর্ণম শব্দে দুটি অর্থ—পূর্ণ এবং শূন্য। সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে ভাগ করলে অনন্তকে পাওয়া যায়।

নৃপেনকাকু নড়েচড়ে উঠলেন। হাতে কাগজ ছেঁড়ার ভঙ্গি করে বললেন, আমার কোয়ান্টাম-এই আমি ছিঁড়ে ফেললুম। আজ থেকে আপনি আমার গুরু।

নিতাইকাকু হাসতে হাসতে বললেন, আমি গুরু হওয়ার জন্যে পৃথিবীতে আসিনি। আমি চির-শিষ্য। আরও একশোবার আসব শিষ্য হওয়ার জন্যে। কত জানার আছে। শেখার আছে। পদার্থ হয়ে অপদার্থ। পদার্থ-বিদ্যার কিছুই জানি না। এই যে আপনার কোয়ান্টাম, আমার জ্ঞানে কালী। শিব থেকে নির্গত শক্তি। কালো কেন? সাধক আলো করবে বলে। সেই অন্ধকারে প্রবেশ করে সৃষ্টি আর স্রষ্টাকে জানবে। সাধকও তো বিজ্ঞানী। তফাৎ কোথায়? বিজ্ঞানী বলছে, আমি জানব। সাধক বলছে কৃপা করে আমাকে জানাও। এই সৃষ্টিতে তুমি আছ, আলোতে আছ, অন্ধকারে আছ। জড়ে আছ, জীবনে আছ। তুমি নেই তো, কিছুই নেই। সব কিছুই এখানে হচ্ছে, জন্ম হচ্ছে, মৃত্যুও হচ্ছে। এমন কি একটা পাথরের অস্তিত্বও পাথরে ঠাসা আছে। পৃথিবীতে দুটো শক্তি খেলা করছে—দেখার শক্তি আর দেখবার শক্তি। এইটাই হল ক্ষেত্র, আপনাদের পরিভাষায় ফিল্ড। গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায়—ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ বিভাগযোগ সকলেরই পড়া উচিত। অর্জুন শ্রীভগবানের কাছে জানতে চাইছেন—হে কেশব! প্রকৃতি ও পুরুষ, ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ, জ্ঞান আর জ্ঞেয় কি? আপনার পদার্থবিদ্যা বলছে, পদার্থ মানে শক্তি। ক্ষুদ্রতে ক্ষুদ্র শক্তি বৃহতে বৃহত। আর আপনাদের বিজ্ঞানী ডিবাক সাহেব বললেন, অণুর গঠন শুধু ইলেকট্রন নয় পেছনে অনুরূপ আরও একটা পদার্থ আছে, যেটা হল পজিট্রন। দুটিতেই বিদ্যুৎশক্তি, ওটিতে নেগেটিভ, এটিতে পজেটিভ। দূয়ে মিলে নিউট্রাল, শান্তি। তা না হলে প্রতিটি বস্তুই আমাদের ‘শক’ মারত। আমাদের শাস্ত্র এই অবস্থানকেই বলছেন পুরুষ আর প্রকৃতি। শিব আর কালী। সৃষ্টি। কালী শিবকে ত্যাগ করে বেরিয়ে এলেই সংহার মূর্তি।

আমি তিন দিন ওই অবস্থায় পড়েছিলুম। দেহ আছে, প্রাণের লক্ষণ নেই; কিন্তু মৃত্যু নয়। চতুর্থ দিনে আমি ফিরে এলুম। কোথা থেকে এলুম বলতে পারব না। স্মৃতি ফিরিয়ে আনার জন্যে মা অনেক আয়োজন করে রেখেছিলেন। ঘট, ঘটি, বাটি, গেলাস, নুড়িপাথর, বড় পাথর, সাদা কাপড়, নীল কাপড়, গেরুয়া কাপড়। ফুল, ফল। প্রথমেই যা চোখে পড়ল, লাঠি কাঁধে মাথায় পাগড়ি বাঁধা একটা লোক কোথায় চলেছে। ওই লোকটাকে ধরে আমার অস্তিত্ববোধ ফিরে এল।

নিতাইকাকু ঘড়ি দেখলেন, নাঃ অনেকটা বলেছি, অনেকক্ষণ বলেছি, আর না। এইবার আমরা কচুরি খাব, চা খাব। রোজকার জীবনের কথা বলব।

নৃপেনকাকু বললেন, শুধু এই কথাটা বলুন, গ্রহ-নক্ষত্র কি মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে?

আপনি বিজ্ঞানী। আমি আর এক বিজ্ঞানীর কথা বলছি—নিউটন। জ্যোতিষে তাঁর ভীষণ বিশ্বাস ছিল। রয়্যাল সোসাইটির সদস্য বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা একদিন তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, কেন আপনি জ্যোতিষ বিশ্বাস করেন? নিউটন চমৎকার উত্তর দিয়েছিলেন, আমি আপনাদের মতো বিশ্বে যা কিছু ঘটছে সবই অ্যাফলিডেন্ট, তা বিশ্বাস করতে রাজি নই, তাছাড়া শাস্ত্রটি আমি ভালো ভাবে পড়েছি, আপনারা পড়েন নি।

অ্যাস্ট্রলজি পৃথিবীর প্রাচীনতম শাস্ত্র। বহু বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ, নামকরা মানুষ জ্যোতিষ বিশ্বাস করতেন, করেন, করবেন। বিদেশি কয়েকজনের নাম বলি, চসার, দান্তে, শেকসপিয়ার, ক্রমওয়েল, কোপারনিকাস, কেপলার, প্লেটো, বেকন। বিখ্যাত নষ্ট্রাদামুসের সমস্ত ভবিষ্যতবাণীই তো অ্যাস্ট্রলজি নির্ভর।

চাঁদের উপাসনা থেকেই জ্যোতিষের জন্ম। ইতিহাসের আদিকাল। সভ্যতার আলো তখনো জ্বলেনি। দীর্ঘ রাত। সূর্যাস্তের পরেই অন্ধকার রাত। রহস্যময় চাদরের তলায় হারিয়ে গেল দিনের পৃথিবী। চতুর্দিকে গভীর অরণ্য। দীর্ঘ দীর্ঘ ঢেউয়ের লাইনটানা ভয়ঙ্কর সমুদ্র। সারাদিন ফুঁসছে। যোজনব্যাপী মরুভূমি। বালির ঢেউ। আকাশছোঁয়া পর্বতশৃঙ্গ। গড়িয়ে গড়িয়ে হিম-ঠান্ডা নেমে আসছে শ্বেত ভাল্লুকের মতো। দাঁতাল জানোয়ারের দল তেড়ে আসছে। অসহায় মানুষ। প্রকৃতির ওপর তখনো প্রভুত্ব বিস্তার করতে পারেনি। তখন। সেই বর্বর মানুষের দল স্নিগ্ধ চাঁদের দিকে তাকিয়ে বসে থাকত শুক্লপক্ষের রাতে। এ কী শোভা! ছ’হাজার বছর আগের, মানবচিত্র। মানুষ যত তার চেয়ে বেশি শ্বাপদের দল। মৃত্যুকে চারপাশে ছড়িয়ে রেখে বাঁচার চেষ্টা। মানুষ যত দেখছে তত দার্শনিক হচ্ছে, ভাবুক হচ্ছে। চাঁদই কারণ। মানুষ প্রথমে দার্শনিক, তারপর প্রযুক্তিবিদ, তারপর বিজ্ঞানী।

ইতিহাসের কাল আসবে অনেক পরে। তার আগে দলে দলে মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসছে চলে যাচ্ছে। তারা অবাক হয়ে দেখছে। দিনের আকাশ, সূর্য। রাতের চন্দ্র। শীতল জ্যোৎস্না। অন্ধকার আকাশ পটে তারার শোভা। এ কি দুর্লঙ্ঘ্য নিয়মে জগৎ বাঁধা! উদয় অস্ত। ঋতুচক্রের পরিবর্তন। রাতের দৈহিক নিষ্ক্রিয়তার অবসরে কল্পনা কাজ করছে। ওই যে তারা দূর আকাশের তারামণ্ডল, ওদের এক একটা নাম রাখলে কেমন হয়। সেই জগতে পশুরাই প্রবল। মানুষ তখন পাশব-দেবতারই উপাসনা করত। তাদের নামেই তারকারা পরিচিত হল।

পাঁচহাজার বছর আগে প্রাচ্যের পুরোহিতরা এই আঁকা, চন্দ্র, নক্ষত্রমণ্ডল দর্শন ও প্রাকৃতিক নানা ঘটনা দেখে, লিখে, মিলিয়ে, একটা সংযোগ খুঁজে পেলেন, অভ্রান্ত এক গণিত। তারই নাম ‘অ্যাস্ট্রোলজি’। নাঃ, আর না। দুটো খাস্তা কচুরিতে এত পোষায় না।

বিকাশকাকু বললেন, আর কি খাবেন বলুন?

নিতাইকাকুর হাসি হাসি মুখ হঠাৎ খুব থমথমে হয়ে গেল। নৃপেণবাবুকে বললেন, আপনি এখন বাড়ি যান। ডাক্তার আপনিও সঙ্গে যান। ওষুধের ব্যাগ, ইনজেকশানের সিরিঞ্জ যেন সঙ্গে থাকে।

সারা ঘরে একটা ভয় নেমে এল। নৃপেনবাবু ঝট করে উঠে দাঁড়ানোর ফলেই বোধ হয় টলে গেলেন। বড়মামা টেবিলের ওপর থেকে ব্যাগটা তুলে নিয়ে আমাকে বললেন, চলে আয়।

বড়মামা একবারই শুধু জিগ্যেস করলেন, কেউ কী অসুস্থ!

নৃপেনকাকু বললেন, না তো!

আমরা গেটের কাছ পর্যন্ত গেছি, নৃপেনকাকুর মেয়ে মাধুরী তীরবেগে বেরিয়ে আসছে। আমাদের দেখেই ভেঙে পড়ল—মা নেই। মা আর নেই!

মাসিমা বললেন, জ্যোতিষকাকু আপনি খুব সাংঘাতিক। যদি জানতেই পারলেন চলে যাচ্ছে টেনে রাখলেন না কেন। অমন দেবীর মতো মেয়েটা চলে গেল। যাওয়ার বয়েস তো হয়নি।

দেখো একটু আগে, কয়েক দিন আগে জানতে পারলে হয়তো আমি টপকে দিতে পারতুম। যেভাবে মানুষ খানা, কি গভীর গর্ত টপকে যায়, সেইভাবে। সামান্য সময়ের পরিচয়। হঠাৎ যখন দেখতে পেলুম, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। অনেকটা চলে গেছেন ওদিকে। লোকালয়ে আমার আর থাকা উচিত নয়। আমি আমার জায়গায় ফিরে যাই।

সে হয় না, আমরা আপনাকে ছাড়ব না। আমাদের মন্দিরে মা বসবেন। আপনার সাধনপীঠ, চলে গেলেই হল। আমরা কার আদেশে চলব?

তোমরা আমাকে এত ভালোবাস?

শুধু ভালোবাসা? তার সঙ্গে শ্রদ্ধা।

বড়মামা বিষণ্ণমুখে ঘরে ঢুকে বললেন, আজ তৃতীয় দিন। উপোস। কেউ কিছু খায়নি। নৃপেনও মরবে, মেয়েটাও মরবে। আপনারা সবাই রয়েছেন, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিতে চাইছি।

কী সিদ্ধান্ত?

আমি বিয়ে দোবো।

কার সঙ্গে কার বিয়ে?

বিলুর সঙ্গে মাধুরীর।

এত অল্প বয়েসে বিয়ে? মাধুরী গত বছর মাধ্যমিক পাস করে উচ্চমাধ্যমিক পড়ছে। বিলুর ফার্স্ট ইয়ার।

আমাদের ঠাকুরদা এগারো বছর বয়েসে বিয়ে করেছিলেন। ঠাকুমার বয়েস তখন পাঁচ।

ঠাকুমা একদিন রেগে গিয়ে ঠাকুরদার কবজিতে কামড়ে দিয়েছিল। সেই দাগ সারা জীবন ছিল।

আমি বললুম, বিয়ে করবো না।

বিয়ে করবি না মানে? এটা কি তোর মামার বাড়ি?

মামার বাড়িই তো।

এ মামার বাড়ি সে মামার বাড়ি নয়। বিলুর আমি বিয়ে দেবো। আমি ওই দৃশ্যটা ভুলতে পারছি না। শ্মশান থেকে ফিরে এসে দাঁড়ান মাত্রই মাধুরী ছুটে এসে বিলুর বুকে মাথা রেখে কাঁদতে লাগল। আমরা সবাই আছি, মাধুরী কিন্তু বিলুকেই সবচেয়ে আপনার ভাবল। মাধুরীর মায়ের আত্মা আমার কানে কানে বলে গেল, এরা দুজন। আমার বিরাট পরিকল্পনা। কেউ আমাকে চা দিচ্ছে না কেন?

বলতে না বলতেই গান্ধারী চা নিয়ে এল। ক’দিন আগে রাসের মেলায় গিয়েছিল, বড়মামার জন্যে ঢাউস একটা কাপ কিনে এনেছে। ঘোর বেগুনি রং। বড়মামা বলেছিলেন, ফ্যান্টাস্টিক! তোর চয়েস আছে গান্ধারী।

চায়ে চুমুক দয়ে বড়মামা বললেন, দুটো জীবন এক করার সঙ্গে সঙ্গে, দুটো বাড়িও এক করে দেবো। বিরাট বড় একটা সুড়ঙ্গ কাটাব। এ-বাড়ির এই ঘর থেকে নামবে, ও-বাড়ির ওই ঘরে গিয়ে উঠবে। সেইরকম হাইট হবে। হামাগুড়ি নয়, কমফর্টেবলি দাঁড়িয়ে হেঁটে হেঁটে যাওয়া যাবে। পাকা টানেল। চাপা আলো। সফট মিউজিক। বর ওই টানেল দিয়ে যাবে। বর-কনে ওই টানেল দিয়েই আসবে।

বড়মামা ‘একসাইটেড’। বিকাশকাকু চলে গিয়েছিলেন। আমাকে বললেন, বিকাশকো বোলাও। আজ-বাদে কাল বিয়ে লোটকে বসে আছিস? নির্লজ্জ…।

মাসিমা বললেন, যাদের বিয়ে তাদের একবার জিগ্যেস করা দরকার। যুগ বদলেছে। কেউ কোথাও মন দিয়ে বসে আছে কি না!

নিতাইকাকু বললেন, বিয়েটা হবেই। তারপর হাসলেন। হাসিটা যেন কেমন!

বড়মামা বললেন, আজই পাঁচিলটা ভাঙা করাব।

মাসিমা অবাক হলেন, কোন পাঁচিল?

আরে, আমার ঠাকুর্দা আর মাধুরীর ঠাকুর্দা গলায় গলায় বন্ধু ছিলেন। পাশাপাশি দুটো বাড়ি। একসঙ্গে তৈরি। একই কনট্র্যাকটার। একটা বেড়ালের জন্যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ। দু’বাড়ির মাঝখানে পাঁচিল উঠে গেল।

বেড়াল?

এ বাড়ির ঠাকুর্দা একটা কাবলি বেড়াল পুষেছিলেন। সেটা এ বাড়িতে চলে আসত। ঠাকমার আদরে সে আর ও বাড়িতে ফিরত না। এই নিয়ে অশান্তি বাড়তে বাড়তে পাঁচিল। পাঁচিল আমি ভাঙব।

বড়মামা ফোন তুললেন, হ্যালো! কী হল। তোমারও আঠারো মাসে বছর। আজই ভাঙতে হবে। আরে মন্দিরটা তো তৈরিই হল না। ভাঙবে কি? ভাঙতে হবে পাঁচিল। উত্তর দিকে লম্বা বাউন্ডারি ওয়াল। আমাদের পাঁচিল আমরা ভাঙব, কার বাবার কী? কুইক। জলদি। আর তুমিও চলে এস। একটা সুড়ঙ্গ তৈরি করতে হবে। আরে টানেল, টানেল। টি.ইউ.এন.ল। তুমি এসো না। অ্যাঁ, অ্যাঁ, না করে।

মাসিমা বললেন, পাঁচিলটাও ভাঙা কি খুব জরুরি?

অফকোর্স। বিরাট একটা মাঠ বেরোবে। এদের ছেলে মেয়েরা খেলবে। দুটো গোল্ডেন রিট্রিভার কুকুর কিনে দেবো। একডজন টেনিস বল। একটা দোলনা বসিয়ে দেবো। একটা স্লিপ। সবুজ ঘাস। ফুলের বেড দিয়ে ঘেরা আর বাচ্চারা দৌড়চ্ছে। চিৎকার করছে। মাধুরী মা হয়েছে। গার্জেন বেঞ্চে বসে কমলা লেবু রঙের সোয়েটার বুনছে। কুসি দিদা হয়েছে, আমি দাদু। মাধুরীর মেয়েরা বড় হবে। ভালো মিশনারী স্কুলে পড়বে। সাদা পোশাক, নীল টাই, সাদা মোজা, ঝকঝকে কালো জুতো।

মাসিমা বললেন, শুধু মেয়ে! ছেলে হবে না?

ছেলে? ছেলের কী দরকার? মেয়েই ভালো। সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে। খাড়া, খাড়া নাক, টানা টানা চোখ। সামান্য লালচে। সিংহের কেশরের মতো চুল। ছেলের কী দরকার! ভালো, ভালো জামাই।

বড়মামা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কুইক, কুইক। আমাদের একটা জায়গায় যেতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *