নিজে বুঝে নিন – আশাপূর্ণা দেবী

নিজে বুঝে নিন – আশাপূর্ণা দেবী

রাত নাগাদ বারোটা৷

ভুরসুট পরগণার প্রতাপপুরের বড়কর্তা জগদীশপ্রতাপ তাঁর কলকাতার বাড়ির তিনতলায় নিজের শোবার ঘরে একা একা বসে জোর আলো জ্বালিয়ে দুখানা মোটা খাতা সামনে বিছিয়ে হিসেবপত্র দেখছিলেন৷

যদিও জমিদারীর বারোটা বেজে গ্যাছে কবেই৷ এখন তালপুকুরে ঘটি ডোবে না তবু ‘বড়কর্তা’ নামটির মায়া ছাড়তে পারেননি জগদীশপ্রতাপ৷ এখনো প্রতাপপুরের কেউ ‘বড়কর্তা’ না বললে মনে মনে যথেষ্ট চটেন৷

চটবার কারণও বিদ্যমান আছে বৈকি৷ ওই ‘প্রতাপপুর তো তাঁরই ঠাকুর্দার বাবা নরসিংহপ্রতাপের খাস ‘পত্তন’৷ তাঁর নামেই প্রতাপপুর৷ তিনি নাকি দাবি করতেন তিনি মহারাজা প্রতাপাদিত্যর জ্ঞাতিগুষ্টির৷

তা যাকগে৷ কে কী না দাবি করছে!

তবে বোলবোলাও একখানা ছিল বৈকি৷ জগদীশপ্রতাপের বাবার আমলেও ছিল কিঞ্চিৎ৷

জগদীশ অবশ্য তাঁর বাপের ঠাকুর্দা মহামান্য নৃসিংহপ্রতাপকে জ্ঞানে তেমন ভালো করে দেখেননি৷ আবছা মনে পড়ে, দীর্ঘদেহী এক ব্যক্তি খুব ভোরবেলা আকাশের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে সূর্যপ্রণাম করছেন৷ মন্তর পড়ছেন গমগমে গলায়৷

এছাড়া আর বিশেষ কিছু মনে পড়ে না৷

যা কিছু শোনা বাবার কাছে৷

শুনতে পেয়েছেন সেই নৃসিংহপ্রতাপের জন্মদিনটি আর তাঁর জন্মদিনটি এক৷

নৃসিংহপ্রতাপের সেদিন সত্তর বছরের জন্মতিথি৷

সকালবেলা ঠাকুরমন্দিরে ভোগ পুজো সব দেওয়া হয়ে গ্যাছে৷ নৃসিংহপ্রতাপ তিলবাটা মাথায় ঘষে দীঘিতে চান করে এসেছেন এবং এসে খিড়কির পুকুরে একটি জীওলমাছ ছেড়ে দিয়ে নিজের দীর্ঘায়ু নিজেই কামনা করে পুজোপাঠ করেছেন৷ তখনো না সাড়া না শব্দ৷

দুপুরে যখন রুপোর থালা-বাসনে সত্তর প্রকার ব্যঞ্জন সাজিয়ে প্লাস বৃহৎ একটি রুইমাছের মুড়ো আর বড় জামবাটির একবাটি পরমান্ন নিয়ে যুঁইফুলের মতো ফুরফুরে চামরমণি চালের ভাতটির সামনে খেতে বসেছেন আর গালচের আসনে ধারেকাছে মস্ত একটা পিলসুজের ওপর প্রকাণ্ড একখানা পেতলের প্রদীপ পেটভর্তি খাঁটি গাওয়া ঘি নিয়ে দপদপ করে জ্বলছে৷

আগের আমলে এটাই ছিল জন্মদিনের শুভকাজের অঙ্গ৷ কেক কাটাকাটির তো চলন ছিল না৷ আর বয়েস গুনে জ্বেলে দেওয়া মোমবাতির সারি ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেওয়ারও পাট ছিল না৷ সেকালে লোকে বাতি নিভে যাওয়াটাই অলক্ষণ কুলক্ষণ মনে করত৷ তাই প্রদীপে পেটভর্তি তেল, মোটা করে সলতে৷

আর খানদানি বাড়িতে প্রদীপের পেট ভরানো হত তেলের বদলে ঘিয়ে আর প্রথম অন্নটি মুখে দেওয়া মাত্তর ভোঁ ভোঁ করে তিনবার শাঁখে ফুঁ দেওয়া৷

তা সে সব পর্ব মিটেছে৷

তোয়াজ করে খেয়ে চলেছেন নৃসিংহ৷ সত্তরটি পদ, সুযোগমতো একবারও অন্তত মুখে ঠেকাতে হবে৷ তো ঠ্যাকাতে ঠ্যাকাতে যখন চাটনিতে এসে ঠেকেছেন, তখন আবার তিনবার ভোঁ ভোঁ শঙ্খধ্বনি৷

কী হল? আবার শাঁখ?

জিগ্যেস করতে না করতেই, ট্যাঁ ট্যাঁ কান্নার শব্দ৷ সদ্যোজাত শিশুর গগনবিদারী পরিত্রাহি শব্দ৷

ওটা আবার কী? কাঁদে কে?

বুড়ি পিসি কাছে বসে পাখা নাড়ছিল৷ বলল,—ঘরে নতুন মানুষ এল৷ তোর ব্যাটার ঘরে নাতি জন্মালো৷

—অ্যাঁ, তাই নাকি? তার মানে নৃসিংহপ্রতাপের প্রপৌত্র এল৷ তো আসবার কথা ছিল বুঝি?

—কথা ছিল বৈকি৷ তো দু-দশদিন বাদে আসার কথা৷ আচমকা আজই তোর জন্মদিনে হানকান করে ভূমিষ্ঠ হয়ে বসলো৷

নৃসিংহ ক্ষীরের বাটিতে গোঁফ ডুবিয়ে মুচকে হেসে বললেন,—‘হুঁ৷ ব্যাটা খুব ধড়িবাজ হবে মনে হচ্ছে৷ ওরে কে আছিস, এই প্রদীপটায় আরো ঘি ঢেলে দিয়ে যা৷

শুধু ঘি না, একেবারে খাঁটি গব্যঘৃত৷

তো সেই প্রদীপ ঘি খেয়ে খেয়ে একনাগাড়ে জ্বলতে থাকল৷ ছ-দিন ছ-রাত৷ ষেটেরা পুজোর পরদিন সকালে তার ছুটি৷ রাতে বিধাতাপুরুষ কপালে লেখন দিয়ে যাবার কাজ সেটা অবধি৷

বিধাতাপুরুষ কী লিখে গেলেন কে জানে! তবে সেই জগদীশের কাছে খাঁটি গব্যঘৃত এখন স্বপ্নের বস্তু৷

সাবেকী মানটির ঠাটবাট রেখে চলেছেন এখনো৷ ভাতের পাতে ঘি, দুধ, দই, চাটনি, পাতিলেবু কম্পালসারি৷

গাওয়া ঘি বলে দেশ থেকে ঘি আনান বেশি দাম দিয়ে৷ তো সেই খাঁটি ঘিয়ের আড়াইভাগ বনস্পতি৷ আর বাকি দেড়ভাগ ভঁয়সা৷

তা হলে কী হবে, দেশের ঘি বলে ওতেই আত্মপ্রসাদ জগদীশপ্রতাপের৷

‘প্রতাপের’ বালাই নেই কোথাও, তবু প্রতাপপুরের অহঙ্কার৷

ওই যে নৃসিংহপ্রতাপের সঙ্গে জন্মদিনের মিল, তাই তাঁর সঙ্গে যেন কেমন একাত্ম অনুভব করেন৷ আবার বাপের মুখে শুনেছেন, চেহারাতেও নাকি মিল৷

তবে?

হলেও অবস্থান্তর, মনেপ্রাণে জগদীশ প্রতাপপুরের বড়কর্তা৷ চালচলনে তদুপযুক্ত ছাপ রাখার আপ্রাণ চেষ্টা৷

এই যে রাতদুপুরে খাতাপত্তর নিয়ে হিসেবে বসেছেন, তো টেবিল-চেয়ারের বালাই আছে নাকি? শোবার ঘরের মস্ত পালঙ্কটাকেই ‘কাছারিঘরের ফরাস’ মনে করে তার মাঝখানে জোড়াসনে বসে সামনে খুলে রাখা জাবদা খাতা দুটো থেকে কীসব মেলামিলি করছেন৷

আগে আগে ভারী কাচের দোয়াতদানি সামনে বসিয়ে কলমে কালি ডুবিয়ে লিখতেন৷ ছেলে বলে বলে ফাউন্টেন পেন ধরিয়েছিল৷ সম্প্রতি আবার ‘আরো সুবিধে’ দেখিয়ে নাতি ডটপেন ধরিয়েছে৷

তা দেখছেন ব্যাপারটা মন্দ নয়৷ বেশ সুবিধের৷ কালের বদলের সঙ্গে সঙ্গে সুবিধে বাড়ছে বৈকি! তবে অসুবিধেও যে বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, একথা জগদীশপ্রতাপ জোরগলায় ঘোষণা না করে ছাড়েন না৷

এখন আর ছেলে তর্কে নামে না৷ তর্কটা নাতির সঙ্গে চলে৷ পাল্লাটা কোনদিকে ভারী, ডটপেনের না খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের—এ তর্কের মীমাংসা হয় না৷

রোজই হিসেব চলে৷

টেবিলে খাওয়া আরামের না মাটিতে বসে খাওয়ার৷ প্যান্ট-পায়জামা সুবিধের, না লম্বা কোঁচা ধুতির!

নাতির প্রশ্নে দাদুর জবাব,—পেন্টুল পাজামা তো তোদের একালে জমিদারেও পরে, জমাদারেও পরে৷ কিন্তু লম্বা কোঁচা? কই দেখা দিকি কোনো জমাদারের…টেবিলে খাওয়া? যেন অফিস কাছারিতে কাজ করতে বসা৷ মাটিতে আসন পেতে ছড়িয়ে বসে খাওয়ার অভিজ্ঞতাই আলাদা, হিসেব করে দ্যাখ৷

তা সে যাক৷

এখন জগদীশ যে হিসেব নিয়ে বসেছেন, সেটি বেশ জটিল৷

প্রতাপপুরের ‘বাবুদের বাড়িটি’ মানে নৃসিংহপ্রতাপের বানানো সেই প্রাসাদটির এখন এমন জরাজীর্ণ অবস্থা ঘটেছে যে, মেরামতি করে একটু ভদ্রস্থ করতে হলেও লাখ লাখ টাকার ব্যাপার৷ আসবে কোথা থেকে সে টাকা? আর সারিয়ে তুলেই বা কী হবে? কে বাস করতে যাবে সেই ভুরসুট পরগণায় প্রতাপপুরে?

ছেলের মতে বেচে দাও৷ বরং ঘরে কিছু আসবে৷ মরা হাতি লাখ টাকা—ওই ভাঙা বাড়িরও এখন অনেক দাম পাওয়া যাবে৷

—ভিটে আবার বেচব কী?

বলে প্রথমে খুব রাগারাগি করেছিলেন জগদীশপ্রতাপ৷ ক্রমশ যুক্তিতর্কে নিমরাজী! কিন্তু মুশকিল এই—নয় নয় করেও সেখানে এখনো অনেক আসবাবপত্তর৷ যাওয়াও হয় সেখানে৷ অন্তত জগদীশ তো যান৷

সবাই যে ‘বড়কর্তা’ বলে ছুটে আসে, এ আহ্লাদ গৌরব কি দার্জিলিং, কাশ্মীর, নৈনিতাল পাহাড়ে গেলে হবে?

তা সেসব যখন চুকেবুকে যাচ্ছে, জিনিসগুলোর কী হবে? ছেলে আর বৌমা বলল— এখানে কাজে লাগার মতো যা কিছু আছে নিয়ে আসুন৷ বাকি বিলিয়ে দিয়ে আসুন৷

কিন্তু এখানে কাজে লাগবার মতো অনেক কিছুই তো একে একে আনা হয়েছে৷ আর কী আনা হবে? ঘরে ঘরে যে বৃহৎ বৃহৎ পালঙ্ক বসানো আছে, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড যে কাঁঠালকাঠের সিন্দুকগুলো আছে এখানে সেখানে, বৈঠকখানা বাড়িতে যে ঝাড়লণ্ঠনটা ঝুলছে—সেগুলো বিলোতে চাইলেই বা নেবে কে? কার ঘরে এত জায়গা আছে?

তাছাড়া আর একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার আছে, যেটা নিয়েই এখন সমস্যা আর হিসেবনিকেশ৷ জগদীশের ঠাকুমা একদা বড়লোকের গিন্নির দেমাকে আবদার করেছিলেন, তাঁর ‘লক্ষ্মীর ঘরটি’র অর্থাৎ পুজোর ঘরটির পুরো মেজেটা টাকা গেঁথে গেঁথে বাঁধিয়ে দিতে হবে৷ যেমন সব কাশী-বৃন্দাবনের মন্দিরে দেখে এসেছেন৷

যে কথা সেই কাজ৷

আনানো হল বস্তাভর্তি চকচকে আসলি চাঁদির টাকা৷ কোনোটায় মহারানীর মুখ, কোনোটায় তাঁর ন্যাড়ামাথা ছেলের মুখ৷ তা সেটি গুছিয়ে সাজিয়ে গাঁথতে মিস্ত্রিরাই পারবে৷ ডাকা হল হিন্দু রাজমিস্ত্রি মুকুন্দকে৷ ঠাকুরঘর বলে কথা! চিরকেলে রাজমিস্ত্রি রসিদ আর আবদুল হেসে হেসে বলল,—বাড়িখানা কিন্তু আমরাই বানিয়েছিলুম মা-ঠাকরুন৷ আপনার ওই লক্ষ্মীর ঘরটিও৷

তা হোক৷ এখন ঘরে উঁচু তাকে লক্ষ্মীর পট৷ নতুন ধানের হাঁড়ি৷ সেসব থাকবে৷ শুধু মেজেটা খোঁড়াখুঁড়ি৷ তারপর টাকা গেঁথে গেঁথে মেজে বানিয়ে ফেলা৷

এখন জগদীশ মহা ফাঁপরে পড়েছেন ওই ঘরটার হিসেব নিয়ে৷ ক-হাত বাই ক-হাত ঘর! তার মেজেটা জুড়ে যে টাকা পোঁতা হয়েছে সে কত টাকা!

পুরনো তস্য পুরনো সব খাতাপত্তর থেকে মজুর মিস্ত্রিদের দৈনিক ‘রোজ’-এর হিসেব৷

মুকুন্দর ‘রোজ’ ছ’আনা, তার মজুরের রোজ দু’আনা৷ কিন্তু ক’দিন লাগল আর কতগুলো টাকা পুঁতল তার হিসেব পাচ্ছেন না কোথাও৷ তাই রাত জেগে সেই আদ্যিকালের খেরো বাঁধানো খাতা নিয়ে আঁতিপাঁতি খুঁজছেন৷

ছেলে বলল,—অত হিসেবের কী আছে?

যখন খোঁড়াখুঁড়ি করতে লাগবে, তখন কেউ পাহারা দিতে উপস্থিত থাকবে৷ যত যা ওঠে৷

তবে সত্যি টাকার এখন অনেক দাম৷ ষোলো আনার টাকা এখন অনেক বেশি দামে বিক্রি করা যাবে৷

কিন্তু কে বসে পাহারা দেবে?

ছেলে বলে,—আপনার ঠাকুমার আবদারকেও বলিহারি যাই বাবা! ঘরের মেজেয় টাকা গেঁথে বাহার করে দিতে হবে? তিনি টাকা মাড়িয়ে মাড়িয়ে হাঁটা-চলা করবেন! অথচ টাকা নাকি মা-লক্ষ্মী, পা ঠেকে গেলে নমস্কার করতে হয়!

ছেলের বউ বলল,—সেকালের জমিদার-গিন্নিদের অহঙ্কারই ছিল আলাদা৷ সত্যি, টাকা মাড়ানো উচিত?

জগদীশ বললেন,—এ প্রশ্ন আমিও করেছিলাম বাবাকে৷ বাবা বলেছিলেন, দেবমন্দিরে তো থাকে, এ তো ওঁর পুজোর ঘর লক্ষ্মীর মন্দির৷

এখন পরের জেনারেশান বুঝুক ঠ্যালা৷

বাড়ি বেচে দেব চুকে যাবে৷ তা নয় তার মেজে খোঁড়াও, টাকা ওপড়াও৷ তো গুনে দেখেছেন কখনো কত টাকা গাঁথা আছে?

ওরে বাবা! কে আবার কবে গুনে দেখতে গ্যাছে?

কিন্তু এখন ভাবছেন জগদীশ, গোনা থাকলে ল্যাঠা মিটে যেত৷ খোঁড়াখুঁড়ির মিস্ত্রিকে কড়া করে বলে দেওয়া যেত, দ্যাখো বাপু, এই আছে, একটুও যেন এদিক ওদিক না হয়৷

সে শাসানির উপায় নেই৷

তবু এই সত্তর বছরের জগদীশ এই রাত বারোটায়, বাড়ির সবাই যখন ঘুমে কাদা, আর রাস্তা নিঃঝুম, তখন পালঙ্কের ওপর বাবু গেড়ে বসে সামনে খেরোর খাতা খুলে সেকালের নায়েব গোমস্তাদের ‘অনিন্দনীয়’ ছাঁদের হাতের লেখা সব হিসেবপত্তর তন্ন তন্ন করে দেখছেন, যদি কোথাও লেখা থাকে কত টাকা পোঁতা হয়েছিল৷

হঠাৎ একটা জায়গায় চোখ পড়ে গেল৷ আর চোখ যেন সেখানেই ফ্রিজ হয়ে গেল৷

‘কলিকাতার ট্যাকশাল হইতে আনয়ন করা হইল দেড় মণ রৌপ্যমুদ্রা৷ ও…সের গিনি৷’

কত সের? বোঝবার উপায় নেই৷ ঠিক সেইখানটাই পোকায় খেয়েছে৷

দেড় মণ রৌপ্যমুদ্রা!…এত সের গিনি!

হঠাৎ ভারী রাগ হয়ে গেল জগদীশপ্রতাপের৷ কর্তারা সব যা ইচ্ছে করে গ্যাছেন৷ আর পরের জেনারেশানের ভাগ্যে শুধু ডুগডুগি৷

টাকার হিসেব, গিনির হিসেব সংখ্যা দিয়ে নয় মণ সের দিয়ে৷ সাপের পা দেখেছিলেন সব৷

টাকা থাকলেই এইভাবে নয়ছয় করতে হবে?

রাগের চোটে জগদীশপ্রতাপের মনে পড়ল না, চিরকালের পৃথিবীতে আদি অনন্তকাল থেকে তাই হয়ে আসছে৷ টাকা থাকলেই নয়ছয়৷ শুধু ‘নয়ছয়ের’ রীতি-পদ্ধতিটাই স্থান কাল পাত্রের হিসেবে আলাদা হয়৷

নবাব বাদশারা তাঁদের জুতোয় হীরে মুক্তো সেঁটে বাহার করতেন৷ খানদানি বাবুরা পোষা বেড়ালের বিয়েতে লাখ টাকা খরচ করতেন৷ আর বড়মানুষের গিন্নিরা শখ হলে তাঁর দাঁড়ের ময়নাপাখি, টিয়াপাখির দাঁড়টাকে সোনা দিয়ে গড়িয়ে নিতেন৷

তা শুধু সে যুগে কেন, এ যুগেও কি টাকা নয়ছয়ের কোনো হিসেব আছে? হুঁ! এ যুগে অত সোনারুপোয় বাহার না দিক, শখের খাতিরে লাখ লাখ টাকা আকাশেই উড়িয়ে দেয়, বাতাসে ছড়িয়ে দেয়৷ কে ভাবতে যাচ্ছে দেশের কত লোক খেতে পাচ্ছে না!

রাগটা একটু প্রশমিত হলে জগদীশপ্রতাপ ভাবলেন, তা তো হল, রুপোর টাকা ঠাকুরঘরের মেজেয় আর দেওয়ালের খানিকটা পর্যন্ত যে গেঁথে রাখা হয়েছে, সেটা তো চাক্ষুষই দেখেছি৷ তবে টাকাগুলোর ওজন যে দেড় মণ তা কে ভাবতে গ্যাছে?

বেশ মনে পড়ে, ছেলেবেলায় জগদীশ আর তাঁর পিঠোপিঠি দিদি ঠাকুরঘরে গেলেই গুনতে বসতেন, কতগুলো টাকা মহারানী-মার্কা, কতগুলো ন্যাড়ামাথা রাজা-মার্কা৷

কিন্তু গিনি?

গিনি তো কোথাও সাঁটা থাকতে দেখেননি৷

অথচ খাতায় পষ্ট করে গিনির হিসেব লেখা রয়েছে৷ গিনি…সের৷ লক্ষ্মীছাড়া কাগুজে পোকারা কেটে খাবার আর জায়গা পায়নি! ওই ‘কত’ সের তার সংখ্যাটি হাপিস করে দিয়েছে!

তা দিক, ছিল তো কিছু৷ দশ সের পাঁচ সের এক সের আধ সের যা হোক৷ কিন্তু কোথায় তারা?

মাথাটা আরো ঝুঁকিয়ে খাতাটা আরো তন্ন তন্ন করে দেখছেন, হঠাৎ যেন সামনে একটা ছায়া পড়ল৷

কে?

চমকে উঠলেন জগদীশ৷

—কে? কে? কে রে ব্যাটা!

ব্যাপারটা কী? যতই রোগা সিড়েঙ্গে আর তোবড়ানো চেহারা হোক, রাত বারোটায় বন্ধ ঘরের মধ্যে ঢুকে এল কীভাবে?

তবে কি আজ জগদীশ দরজায় খিল লাগাতে ভুলে গেছলেন? কিন্তু এমন ভুল তো হয় না জগদীশের৷

গিন্নি চন্দ্রবিন্দু হয়ে যাওয়ার পর থেকে তো একাই থাকতে হয়৷ কাজেই বেশ জম্পেশ করেই সব বন্ধ করে তবে শোন৷

ওঃ! দৈবাৎ একদিন হয়তো ভুলে গেছেন, আর অমনি ব্যাটা চোর এসে সেঁধিয়েছে? কোথায় ওৎ পেতে বসে থাকে?

যাক, সাবধানতার ঘাটতি নেই জগদীশের৷ কারণ এই ঘরেই লোহার সিন্দুক৷ এখন সব ব্যাঙ্কের ভল্টে৷

সংসারের সব গয়নাপত্তর আর দরকারি কাগজপত্তর ভল্টে রেখে আসার ফ্যাশন হয়েছে৷ জগদীশ এ ফ্যাশানের গাড্ডায় পড়তে রাজি নয়৷ ছেলে বউ যত বলে বলুক৷

চোখের সামনে না থাকলে জিনিসটা ক্রমেই ছায়া-ছায়া হয়ে যাবে না? একবার খুলে দেখবার ইচ্ছে হলে দেখতে পাবেন?

কেন, মজবুত সিন্দুকের অভাব আছে বাজারে?

আর তোমার গিয়ে ব্যাঙ্কেই বা কী নিরাপদ? রাতদিনই তো ‘ব্যাঙ্ক ডাকাতি’! ব্যাঙ্ক লুঠ!

জগদীশের মাথার শিয়রে লোহার সিন্দুক, মাথার বালিশের তলায় রিভলবার৷

এর থেকে বুকের বল আর কিসে?

‘কে?’ বলে উঠেই জগদীশ হাত বাড়িয়ে মাথার বালিশের তলায় হাত চালিয়েছেন৷

সঙ্গে সঙ্গে সামনের মূর্তিটা বলে উঠল, উঁ-হু-হু, দোহাই বড়কত্তা, অমন কাজটা করবেন না! ওতে আপনার লোকসান বৈ লাভ হবে না!

বড়কর্তা!

তার মানে চেনা চোর?

অর্থাৎ প্রতাপপুরের জানিত?

হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললেন,—হুঁ, তা সত্যি৷ তোর মতন একটা ছুঁচোকে মেরে গুলিটাই লোকসান৷ তো কে তুই?

আজ্ঞে কেউ না৷

কেউ না? বটে? তামাশা? তবে তো দেখছি মরণের কাল ঘনিয়ে এসেছে তোর৷ ইষ্টনাম স্মরণ কর ব্যাটা৷ এই চালালাম হাত বালিশের তলায়৷

আজ্ঞে বড়কর্তামশাই, আমাদের মতো নিকৃষ্ট জনের আবার ইষ্টোনাম! আর বাঁচাই বা কী, মরাই বা কী!

—হুঁ৷ খুব কথা জানিস দেখছি৷ তো বড়কর্তা বললি কোন সুবাদে?

—শৈশবাবধি শুনে আসছি, ওই সুবাদে৷

—বুঝেছি৷ প্রাতাপপুরের ‘মাল’৷ তো বাঘের ঘরে ঘোগ? বড়কর্তার ঘরে এসে সেঁধিয়েছিস চুরি করতে?

—আ ছি ছি! অমন কথা বলবেন না কর্তা৷ আপনার ঘরে সেঁদুব চুরির মতলবে?

—বটে? তা মাঝরাত্তিরে দোরটা একটু খোলা পেয়ে সুড়ুৎ করে ঢুকে এসেছ কীসের মতলবে যাদু? কর্তার পা টিপে দিতে? না পাকাচুল তুলে দিতে?

—হিসেবের খাতার পাতা পোকায় কেটেছে দেখে চিন্তা করছিলেন, তাই ভাবলুম…

জগদীশ সোজা হয়ে চড়া গলায় বলে ওঠেন,—বলি তুই লোকটা কে? নাম কী?

—আজ্ঞে জ্ঞানাবধি তো দেখে আসছি, সবাই বৈকুণ্ঠ বলে ডাকে৷

—বটে, নাম জানো না? সবাই বৈকুণ্ঠ বলে ডাকে! সেটাই জানো? পাজি বদমাস৷ একটা কথার সিধে জবাব দিতে জানো না? বলি প্রতাপপুরে তো মেলাই বৈকুণ্ঠ, টাকাওলা বৈকুণ্ঠ, খোঁড়া বৈকুণ্ঠ, কুমীর-খাওয়া বৈকুণ্ঠ…

—আজ্ঞে ওনারা তো সব সজ্জন৷ এ হতভাগা হচ্ছে মুকুন্দ মিস্ত্রির ব্যাটা, মিস্ত্রি বৈকুণ্ঠ৷ এখন অবশ্য পাবলিকে বলে…

—অ্যাঁ, কী বললি?

স্প্রিঙের পুতুলের মতো ছিটকে খাড়া হয়ে বসলেন জগদীশ৷

—চালাকি খেলতে আসার আর জায়গা পাওনি ব্যাটা! রাগের মাথায় আপন খুড়োর মাথাটা থান ইঁটের ঘায়ে গুঁড়ো করার দায়ে তার না ফাঁসি হয়েছে! আর তুমি ব্যাটা…

লোকটা অকুতোভয়ে বলে,—আজ্ঞে ফাঁসি হয় নাই, একথা তো বলি নাই৷ সেই তরেই তো বলতে যাচ্ছিলুম, এখন পাবলিকে নামটা উচ্চারণ করতে বলে ‘খুনে বৈকুণ্ঠ’৷ আমার ঘরখানাকে বলে ‘খুনে বৈকুণ্ঠর বাড়ি’৷

—‘ওঃ! তা ফাঁসির ফাঁস আলগা করে ফেলে জেলখানা থেকে পালিয়েছিলি তাহলে? বদলে আর একটা নকল বৈকুণ্ঠ ফাঁসিতে ঝুলল?

—আ ছি ছি!—শিউরে উঠল লোকটা৷

—ওকথা বলবেন না কর্তা৷ প্রাণে বড় দাগা পাব৷ তবে হ্যাঁ, ঘটছে এমন ঘটনা রাতদিনই৷ জেলখানার মধ্যে কতজনই যে অপরের নামে ‘প্রকসি’ দিয়ে ঘানি ঘোরাচ্ছে, পাথর ভাঙছে, তার সীমেসংখ্যা নাই৷ আর ফাঁসি? তাও মাঝে মধ্যে দু-একটা প্রকসি চলে বৈকি! তা ওসব হল গে পয়সাওলা লোকদের কারবার৷ হতভাগা বৈকুণ্ঠ মিস্ত্রির বলে পান্তাোর ওপর নুন জুটত না, সে কিনতে যাবে ফাঁসি খাবার মানুষ! ছ্যা!

—থাম বদমাস! কেবল প্যাঁচানো কথা!

জগদীশ প্রচণ্ড এক ধমক দিয়ে উঠে রিভলবারটা টেনে বের করে বাগিয়ে ধরে বললেন,—সিধে জবাব দে৷ বলি ফাঁসিটা শেষতক হয়েছিল, না রদ হয়ে গিয়েছিল?

—আজ্ঞে গরিবগুর্বোর কী আর শাস্তি রদ হয় বড়কর্তা? সেও বড় মানুষদের ঘটনা!

—ফের? বললাম না, সিধে জবাব দিবি! বলি ফাঁসিটা হয়েছিল?

—আজ্ঞে হ্যাঁ৷

—কার হয়েছিল?

—ওই তো রাজমিস্ত্রি বৈকুণ্ঠের৷

—তাহলে তুই কে?

—ওই তো বললুম, আজ্ঞে ‘কেউ’ বললে ওই বৈকুণ্ঠ মিস্ত্রি, আবার ‘কেউ না’ বললেও চুকে যায়৷

—আবার!

জোরে একটা ধমক দিতে যাচ্ছিলেন জগদীশপ্রতাপ, হঠাৎ দরজায় ধাক্কা পড়ল৷ তার সঙ্গে জগদীশ-এর ছেলে অমিতপ্রতাপের উদ্বিগ্ন গলার স্বর,—বাবা, দরজাটা একটু খুলুন তো!

জগদীশ একটু হতচকিত হলেন৷ তাহলে তো ঘরের দরজা বন্ধই আছে৷ ভুলে খুলে রাখিনি৷ তবে? ওই পাজিটা অথবা পাগলটা ঘরের মধ্যে ঢুকল কী করে?

সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য মাথায় খেলে গেল, তার মানে ব্যাটা আগেই কোনো ফাঁকে ঢুকে পড়ে খাটের নীচে-টিচে লুকিয়ে ছিল৷ জগদীশ যখন খাওয়া-দাওয়া করছিলেন, তখন তো আর দরজায় তালা লাগিয়ে যাননি৷ এবার থেকে তাই করতে হবে দেখছি৷

তা এসব তো মুহূর্তের চিন্তা৷

খাট থেকে তাড়াতাড়ি নেমে পড়ে দরজাটা সাবধানে খুলতে গেলেন, পাছে বৈকুণ্ঠবাবাজী ফস করে বেরিয়ে সটকান দেন৷

কিন্তু এ আবার কী, কোন ফঁকে ফট করে কোথায় গা-ঢাকা দিল?

কোথায় আর, সেই খাটের নীচেই! আচ্ছা থাকো বাবাজী, দ্যাখো তোমার কী হয়!

দরজাটা খুলেই নিজেই প্রশ্ন করলেন,—কী হল?

ছেলে বলল,—আমাদের আবার কী হবে? আপনার কী হল তাই জানতে এলাম৷ মনে হল হঠাৎ যেন কাউকে ধমকে উঠলেন!

জগদীশ মনে মনে হাসলেন, বাবুর কান মাঝরাতেও খাড়া!

—ও হ্যাঁ, তা দিয়েছিলাম বটে৷

—এত রাত্তিরে—বন্ধ ঘরের মধ্যে কাকে?

খাটের নীচের দিকে একটু অলক্ষ্যে তাকিয়ে জগদীশ একটু মজা করার গলায় বললেন,—‘কাউকে’ বললে কাউকে, আবার কাউকে নয় বললে নয়!

ছেলের পিছু পিছু বউমাও চলে এসেছে৷ দুজনে একটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টিবিনিময় করে বলল,—মানে?

—মানে এক ব্যাটা ছুঁচো এসে জ্বালাচ্ছিল…

বউমা ঘরের মধ্যে ঢুকে এসে এই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘরটার দিকে তাকিয়ে দেখে অবাক হয়ে বলল,—এই ওপরের ঘরে ছুঁচো!

—সেই তো…

ছেলে চমকে উঠে বলল,—বাবা, আপনার রিভলবারটা খাটের ওপর পড়ে আছে কেন?

—ওই তো…

জগদীশ অম্লান গলায় বলেন,—ভেবেছিলাম, জ্বালাচ্ছে নিকেশে করে দিই৷ তো ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করতে আর ইচ্ছে করল না৷

কী কাণ্ড! ঘরের মধ্যে ছুঁচো!

তো সেটাকে তো তাড়াতে হবে৷

ছেলে ফটাফট ঘরের আর দুটো আলো জ্বেলে দিয়ে আলনায় ঝোলানো জগদীশের শৌখিন ছড়িটা নিয়ে খটাখট খটাখট তাড়া লাগিয়ে ঘর তোলপাড় করে তুলল৷

খাটের নীচেটায়?

তা দেখল বৈকি৷ টর্চ জ্বেলে হেঁট হয়ে৷

ইত্যবসরে নাতিও ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে৷

—কী হয়েছে দাদু? এত রাত্তিরে সবাই হট্টগোল করছ কেন?

দাদু অপ্রতিভাবে বলেন,—কিছু না দাদু, ঘরের মধ্যে একটা ছুঁচো ঢুকে পড়েছিল, সেটাকে তাড়াতেই—কিন্তু কোন ফাঁকে সে হাপিস হয়ে গেল! অবশ্য ছুঁচো, ‘চোর বললে চোর’৷

—চোর, অ্যাঁ! কই? কোথা দিয়ে পালাল?

জগদীশের চিন্তার সুর,—তাই তো ভাবছি৷

—বাবা!

অমিতপ্রতাপ বলল,—আপনি রাত অবধি জেগে জেগে ওইসব পচা পচা ভুতুড়ে খাতাগুলো দেখতে বসবেন না৷ খাতাগুলো দেখলেই তো আমার মাথা ঝিমঝিম করে৷

আর ছেলের কথা শেষ হতে না হতেই বউমা বলে উঠলেন,—আর রাতের খাওয়াটা একটু হালকা হলে ভালো হয়৷ আপনাদের প্রতাপপুরের পাঠানো ক্ষীরের সঙ্গে খাজা কাঁঠাল পাকা আম আর তার সঙ্গে খাস্তা লুচি চটকে মেখে—ওঃ! আমার তো দেখেই পেটব্যথা করে, খাবার কথা ভাবতেই পারি না৷

—হা-হা-হা!

জগদীশপ্রতাপ এই মাঝ-রাত্তিরেই ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠলেন৷

—তা পারবে কোথা থেকে?—জন্মাবধি তো ভয়ে ভয়ে না খেয়ে খেয়ে নাড়ি মরা! আমার ঠাকুর্দা একটা আস্ত কাঁঠাল খেতেন, বুঝলে? একাসনে বসে এককুড়ি বড় সাইজের ল্যাংড়া আম৷ আর একটা ছাগলও একা সাবাড় করতে পারতেন৷ আমার ঠাকুমাটিও কম যেতেন না৷ বলতেন, আমের সময় আবার দু-বেলা ভাত খেয়ে মরি কেন?…তাই তাঁর রাতে ভাতের পাট থাকত না৷ দাসীরা কেউ একজন এক ঝুড়ি আম, এক গামলা জল আর একখানা বঁটি নিয়ে বসত৷ আর ঠাকুমা বসতেন একখানা খালি থালা আর এক কাঁসি ভর্তি মাছের ঝাল নিয়ে৷ একটির পর একটি আম ছাড়িয়ে পাতে দিয়ে চলেছে, আর তিনি খেয়ে চলেছেন৷ গোনাগুণতির ধার ধারতেন না৷ তার সঙ্গে ওই সর্ষেলঙ্কায় গরগরে মাছের তেলঝালের টাকনা৷ নিজের গাছের আম, পুকুরের মাছ, গোনাগুণতি কীসের?

নমস্য মহিলা!

বউমা বললেন—তা না হলে আর অমন সব প্ল্যান মাথায় আসে? টাকা পুঁতে পুঁতে ঠাকুরঘরের মেজে বাঁধাব! ‘মোজাইক’ কোথায় লাগে? এ একেবারে বাহারের চূড়ান্ত!

জগদীশ আবার হেসে উঠলেন৷

—তা যা বলেছ বউমা৷ এই তো হিসেবের খাতায় সেই টাকার ওজন দেখে চক্ষু-চড়কগাছ৷…কলিকাতার ট্যাকশাল হইতে দেড়মণ রৌপ্যমুদ্রা আনয়ন করা হইল৷

—দেড়মণ রৌপ্যমুদ্রা! শুনে মাথা ঘুরছে বাবা৷ শুতে যাচ্ছি৷

বউমা নেমে গেলেন৷

সঙ্গে সঙ্গে নাতিও৷ শোনা গেল প্রশ্ন করছে,—‘মণ’ কী মামণি?

অমিতপ্রতাপ বলল,—রিভলবারটা আমায় দিন তো৷

—কেন? তুমি আবার কী করবে?

—থাক না আমার কাছে৷ আপনি ঘুমের ঘোরে কী করতে কী করে বসবেন, বলা যায়!

—হা-হা-হা৷ ভাবছিস বাবাটার মাথার গোলমাল হয়েছে৷ নারে বাবা না৷ এখন পরামর্শ দে দিকি, বাড়িখানা হাতছাড়া করার আগে ওই দেড়মণ রৌপ্যমুদ্রা উপড়ে নেওয়া যাবে কীভাবে?

—কাল দিনের বেলা ভাবা যাবে বাবা৷ এখন শুয়ে পড়ুন৷

আবার ফটাফট জোরালো আলোগুলো নিভিয়ে দিয়ে ছেলে দরজাটা টেনে ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেল৷

জগদীশ তাড়াতাড়ি দরজায় খিল ছিটকিনি দুটো লাগিয়ে, ঘুরে এসে আবার খাটের ওপর বসতেই যেন খিক খিক করে একটা হাসির শব্দ পেলেন৷

—কে? কে? অ্যাঁ!

—খুব বেপোটে পড়ে গেছলেন বড়কর্তা, কী বলেন? ছেলে বউমা নাতি পর্যন্ত ছুঁচো খুঁজতে হাল্লাক!

জগদীশ সন্দেহের গলায় বলেন,—তোর রকমসকম দেখে তো তোকে মানুষ বলে মনে হচ্ছে না বাপু?

—আজ্ঞে আপনি হচ্ছেন বিবেচকখোণ বেক্তি৷

—ফাঁসি খেয়ে মরে অপদেবতা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস নাকি?

—আহা বড় ভালো নামটি তো দিলেন কর্তা৷ অপোদেবতা৷ বাড়তি একটা ‘অপো’ থাকলেও দেবতার দরে চলে এলুম তালে?

—হুঁ৷ তো হঠাৎ আমার এখানে কেন বাপু? মতলবটা কী?

জগদীশ রিভলবারটা বালিশের তলায় গুঁজে রেখে খাতার বোঝা বন্ধ করে সরিয়ে রেখে বাবুগেড়ে গুছিয়ে বসে বললেন,—শুনি তোর মতলব?

—কোনো কুমতলোব নাই বড়কর্তা৷ সাত পুরুষে আপনাদের খেয়ে মানুষ৷ ওই যে আপনার ঠাকুরমার টাকা পোঁতা ঘর, ও ঘর তো আমারই বটঠাকুর্দা বানিয়েছিল৷

—অ্যাঁ, তাই নাকি? কে সে? নামটা কী?

—আজ্ঞে বাবার জ্যাঠা৷ নাম ছিল পাতকীচরণ৷ হিন্দু সম্প্রদায়ের মিস্ত্রিদের মধ্যে খুব নামডাক ছিল৷ দেবমন্দিরের কাজকম্মো তো অহিন্দু মিস্ত্রি দিয়ে চলত না৷

—বটে নাকি? খুব যে ভাঁওতা দিচ্ছিস! ঘরবাড়ি মঠমন্দির পুজোর দালান এসব কারা বানায়? আমি তো বরাবর দেখছি রসিদ মিস্ত্রি আর তার ছেলে বাহার মিস্ত্রি…

—বড়কর্তা, সে সব হল গে পুজোপাঠ আরম্ভ হবার আগে৷ আরম্ভ হয়ে যাবার পর কোনো কাম পড়লেই ডাক পড়ত এই আমাদের৷

—বুঝলুম৷ তো তোর বাবার জ্যাঠাকে তুই দেখেছিস?

—দেখেছি৷ একশোর কাছে বয়েস হয়েছিল৷ নামিয়ে বসিতে দিতে হত৷ আমারে খুব ভালোবাসত৷ যত গপ্পো আমার সঙ্গে৷

—হুঁ, শৈসব থেকে এঁচোড়ে পাকা! তো খাতায় হিসেব দেখছি, রুপোর টাকা, ওজন দেড়মণ—তা থেকে কতটি সরিয়েছিল ঠাকুর্দা, সে গপ্পো কখনো করেছিল তোর কাছে?

সিড়েঙ্গে বৈকুণ্ঠ সড়াৎ করে একদম সোজা৷

—ছি ছি! অমন পাপকথা মুখে আনবেন না হুজুর৷ এ কী বৈঠকখানা ঘরের কাজ-কাম? যে তা থেকে কিছু মারবে? ঠাকুরঘর বলে কথা!

—ওঃ, ধর্মজ্ঞানী পুরুষ! তো বল দিকিনি গিনির হিসেবটা কী? সেও নিশ্চয় তোর বড় ঠাকুর্দা…

থামতে হল৷

আবার দরজায় ধাক্কা৷

—বাবা! দরজাটা আর একবার খুলুন তো!

জগদীশ গলা নামিয়ে বললেন,—আজ আর হল না৷ এখন যা৷ কাল আবার আসিস৷

উঠে দরজা খুললেন জগদীশ৷

—কী? আবার কী হল?

—কী হল সেটাই তো জানতে এসেছি৷

ছেলের স্বর বেজায় বিরক্ত উত্তেজিত৷

—মনে হচ্ছে আপনমনে কথা বলে যাচ্ছেন৷ শুনতে পাচ্ছি তখন থেকে৷

জগদীশ আত্মস্থ৷

বললেন,—কইছি তাই নাকি?

—মাঝরাত্তিরে একা একা কথা বলবেন মানে? ঠিক আছে, আমি এ ঘরে শুই৷

—মাথা খারাপ? তুই আবার কী করতে শুতে আসবি?

—তো আপনি যদি…

—আরে বাবা, কিছু না কিছু না৷ আমার মেজ মামা বলত, রাত্তিরে যদি ঘুম না আসে তো খবরদার ঘুমের ওষুধ খেতে যাবি না৷ একমনে ধারাপাতে পড়া ‘কড়াকিয়া’, ‘গণ্ডাকিয়া’, ‘কাঠাকিয়া’ আউড়ে যাবি৷ দেখবি ঘুম ‘বাপ বাপ’ করে আসতে পথ পাবে না! যা যা, শুতে যা৷ আর কথা-টথা শুনতে পাবি না৷

ছেলেকে প্রায় ঠেলে বার করে দিয়ে দরজা বন্ধ করলেন৷

শুয়ে পড়লেন৷ শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলেন, কাল আবার আসতে বললাম, আসবে তো? এলে খুব ফিসফিসিয়ে কথা বলতে হবে৷

কিন্তু আচ্ছা, ভূত-টুত বলে তো মনে হচ্ছে না৷ কই কথা বলতে তো গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল না৷ ভয়-ভয় ভাবও করছিল না৷ অথচ ঢোকা বেরোনোও তো টের পাওয়া গেল না৷ একা আমার বুড়ো চোখ নয়, আরো তিন জোড়া চোখ তল্লাস করেছে ঘর৷

আমাদের প্রতাপপুরে ছেলেবেলায় দেখেছি গোষ্ঠ তেলির ঠাকুমা একটা বিদ্যে জানত—ধুনোপড়া৷

চোরের নাকি গোষ্ঠর কাছ থেকে ওই ধুনোপড়া শিখে নিয়ে চুরি করতে বেরোত৷

না এল তো চুকেই যাবে৷ না এলে বোঝাই যাবে চোর-জোচ্চোর৷ আর একে…

ঘুমটা সবে এসেছে, কানের কাছে মাছির পাখা নাড়ার মতো ফিসফিশ শনশন শব্দ৷

—বড়কর্তা! ঘুমালেন নাকি?

ধড়মড়িয়ে জেগে উঠলেন জগদীশপ্রতাপ৷

নাইলনের মশারি৷ মশারির মধ্যে থেকেই দেখতে পেলেন একটা ছায়ামূর্তি৷

—একী, অ্যাঁ৷ আবার এক্ষুনি এলে যে? বলে দিলাম না কাল আসতে?

বললেন অবশ্য খুব চাপা গলায়৷

—আমাদের আবার কালাকাল৷ কীবা রাত্রি কীবা দিন৷…ওই গিনিগুলোর হদিস জানতে বটঠাকুর্দার সন্ধানে ঘুরপাক খেলুম কে জানে কতক্ষণ! তারপর মনে হল ‘কাল’কে এসে গেছে৷ কিন্তু এসে মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল বড়কর্তা৷

—কেন, হঠাৎ খারাপ কেন?

—আজ্ঞে হুজুর, আপনাদের বড় সন্দ বাতিক৷ এখনো ভাবতেছিলেন ব্যাটা বৈকুণ্ঠ ভূত না চোর৷

—বটে! আমি কী ভাবছিলাম তা টের পেলি কী করে?

—সেই তো৷ ওই রোগেই তো সুখ-শান্তি গ্যাছে৷ না বলতেই সব বুঝে ফেলি৷

—দ্যাখ বাপু, ভূতে বিশ্বাস অবিশ্বাস সবটাই মনুষ্য-জন্মের একটা রোগ৷ তুই যখন বেঁচেছিলি, সহজে ভূত বিশ্বাস করতিস?

—বেঁচে? হতভাগা বৈকুণ্ঠ আবার বেঁচেছিল কবে বড়কর্তা? মরেই তো থাকত!

—নাঃ, সোজা করে কথা বলার ধাতই নেই তোর৷ তা তোর বটঠাকুর্দার সঙ্গে দেখা হল?

—হওয়া খুব কঠিনই হচ্ছিল৷ ওনারা হচ্ছেন পুণ্যাত্মা৷ স্বর্গে ওনাদের পুণ্যির ওজন মাফিক সব মহল্লা৷ আমাদের মতন গলায়-দড়ি পাপীতাপীদের সেখানে পৌঁছবার পাশপোর্টই নাই৷ তবে…

—থাম থাম৷ ওই মহল্লাটা কী জিনিস?

—ও আজ্ঞে অন্য কিছু না, নামী দামি শহরের ‘এসটাইল’৷ কে কোন মহল্লায় ঠাঁই পেয়েছে জানতে পারলেই বোঝা যাবে কার কতটা পুণ্যি৷ এই যেমন আপনাদের রাজধানীতে—বাসার ঠিকানা শুনলেই বুঝতে পারা যায় কে রাজা, কে গজা৷ কে মন্ত্রী, কে যন্ত্রী৷ কে অফিসার, কে কেরানী৷ কে এলেমদার, কে জমাদার৷

—বটে! রাজধানীর এত কথা জানিস তুই?

—আজ্ঞে এখোন তো আর রেলভাড়া লাগে না৷ সর্বত্র চড়ে বেড়াই আর দেখি৷

—হুঁ৷ কিন্তু ঠাকুর্দার কাছে যেতে পাশপোর্ট লাগে কেন?

—সে আজ্ঞে ওখানকার আইন৷ বড় কড়া আইন৷ তবে কিনা পাহারাদারকে একটু ঘুষটুস দিয়ে…

—অ্যাঁ, স্বর্গেও ঘুষ?

—আজ্ঞে কর্তা, ঘুষ আর কোথায় নাই?

খিক খিক একটু হাসির শব্দ৷

—থাক৷ আমার আর জেনে কাজ নেই৷ ঠাকুর্দা কী বলল তাই বল?

—বলল? বলল যে…

ঘর অন্ধকার৷ জোর পাখার বাতাসে মশারি উড়ছে৷

বৈকুণ্ঠকে এক-একবার দেখা যাচ্ছে, এক-একবার যাচ্ছে না৷

—কী রে, কী হল? থেমে গেলি যে? চলে গেলি নাকি?

—আজ্ঞে চুপ চুপ৷ সিঁড়িতে যেন কার পদশব্দ শুনলুম৷ আবার না ছোটকর্তা দরজা ধাক্কায়!

—ধাক্কাক৷ আমি অঘোরে ঘুমোচ্ছি৷ ক্যানেস্ত্রা পিটোলেও ঘুম ভাঙবে না৷

—বলল, গিনি ছিল আজ্ঞে সাড়ে বারো সের৷ ঠাকুর্দার সাক্ষাতে ওজন হয়েছিল৷

—সা-ড়ে বা-রো সের গিনি! বৈকুণ্ঠ, এখন তার কত দাম?

—জানা নাই বড়কর্তা৷ চিরদিনই আদার বেপারি, জাহাজের খবর রাখি না৷

—আমিই বলছি—অনে-ক দাম৷ হিসেব করতে গেলে মাথা গুলিয়ে যাবে৷ ছেলেকে জিগ্যেস করতে হবে৷ এখন কী উপায়, তা বল?

—আজ্ঞে কীসের উপায়?

—ওই সোনারুপো উদ্ধারের৷…বৈকুণ্ঠ, চুপ করে গেলি যে! এই বৈকুণ্ঠ!

—আজ্ঞে ঠাকুর্দাকে শুধিয়ে এলাম৷

—এক্ষুনি শুধিয়ে আসা হয়ে গেল?

—তা হলে আজ্ঞে৷ মনোরথে চেপে যাওয়া-আসা৷ তো ঠাকুর্দা বলল, উদ্ধারের উপায় কম৷ মিস্ত্রি উপড়োতে গেলে চুরি করে সাফ করে দেবে৷

—আরে বাবা, পাহারা থাকবে৷

—যে রক্ষক সেই ভক্ষক হবে৷ আর চুরি না করে তো গরমেন্টের ঘরে খবরটা তুলে দেবে৷ ব্যাস, পুলিশি জেরা চলবে৷ এত অবধি তোমার পূর্ব-পুরুষ পেল কোথায়? হিসেব দাও৷ না দিতে পারলে গারদে যাও৷

—ওই সেরেছে! তাহলে তো বড় বিপদ!

—আজ্ঞে আপনাকে আর আমি কী বলব? তবে ঠাকুর্দা বলত, সম্পদই বিপদ৷ তো এখন ঠাকুর্দা বলল, বড়কর্তাকে বলগে, যা করার তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে৷ পুরাতন অট্টালিকাখানা দানই করুন আর বেচেই দিন, যেন চটপট করেন৷

জগদীশ সন্দেহের গলায় বলেন,—কেন রে বাপু? বড়কর্তার দিন ফুরিয়ে আসছে নাকি?

—আহা! ঈশ! তা নয় আজ্ঞে৷ ওই অট্টালিকাখানারই দিন ফুরিয়ে এসেছে৷ কোনোদিন না হুড়মুড়িয়ে ভূমিসাৎ হয়৷ মেরামত তো হয় নাই দু-পুরুষ কাল৷

—মেরামত! হুঁ, ও বিশাল বাড়ি মেরামত করা বড় সোজা! তা বলে এক্ষুনি পড়ে যাবে?

—আজ্ঞে যেতে পারে তো! আমি বলি কি কর্তা, এই মওকায় বেচে দিন৷ মোটা টাকা ঘরে আসবে৷ তারপর হিঃ হিঃ, পড়ুক হুড়মুড়িয়ে৷ আপনার কাঁচকলা৷

জগদীশ রেগে বললেন,—তার মানে জেনে বুঝে লোকঠকানো!

—তো সে যদি বলেন তো, একখানা ধম্মোপুণ্যির আখড়া খুঁজে দানই করে দ্যান৷

—তাও তো ঠকানো৷ জানছি যখন পড়ে যাবে৷

—বাঃ, তাতে আর ঠকানোটা কোতা? তানারা তো গাঁটের কড়ি খরচ করে কিনচেন না? তানাদের আগেও ছিল না, পরেও থাকবে না৷ মাঝখানে দু-দিন নেত্য করে নেবে৷ তাছাড়া আপনার পুণ্যির ছালাখানায় মোটা খানিকটা পুণ্যি জমা পড়বে৷…যখন দানটা করবেন, খপরের কাগজের লোক আসবে৷ ফটাফট ফটক উঠবে৷

জগদীশ একটা নিঃশ্বাস ফেললেন৷

—বৈকুণ্ঠ, বললি তো ভালো৷ কিন্তু ওই দেড় মণ মহারানী-মার্কা টাকা আর সাড়ে বারো সের গিনি…

—ও আর চিন্তা করে লাভ নাই বড়কর্তা৷ ওসব তো আপনার গাঁটের থেকে যাবে না? যাদের গেল তেনারা তো আগেই পগার পার হয়ে গ্যাছেন৷

—ঠিক৷ ঠিক৷ অ্যাঁ, তাই তো! বাঁচালি রে বৈকুণ্ঠ৷

—তো এখন যাই বড়কর্তা৷ আবার আসতে অনুমতি করবেন তো? আপনার কাচে এলে বড় সুক পাই৷

বড়কর্তা কিছু জবাব দেবার আগেই দরজায় টোকা৷

ব্যাস৷ বড়কর্তা চাদর মুড়ি দিয়ে সপাট৷

টোকা৷ টোকা থেকে ধাক্কা৷ ধাক্কা থেকে দুমদাম৷ দমাস-দমাস৷

কিন্তু জগদীশ তো অঘোরে নিদ্রায়৷

তবে ভয় খাবার কিছু নেই৷ নাক ডাকছে বাঘের গর্জনে৷

সকালবেলা ছেলে বলল,—বাবা, আপনাকে আর একা শুতে দেওয়া হবে না৷

—কেন? কেন হে বাপু? আমার অপরাধ?

—আপনি রাতের বেলা সারারাত বিজবিজ করে কথা বলে চলেন৷ এটা একটা ব্যাধি৷

—ব্যাধি! ওঃ! সারারাত বিজবিজ? বলি নাক ডাকায়টা কে?

—সেটা শেষ রাতে৷ আপনার ঘরে আজ থেকে কেউ শোবে৷

—কেউ শোবে না৷ আমি আজই প্রতাপপুরে যাচ্ছি৷

—প্রতাপপুরে? একা?

—একা ছাড়া…তোমাদের সময় আছে? দ্যাখার অভাবে ওই বিশাল অট্টালিকাখানা ধ্বংস হতে বসেছে৷ ওটাকে আমি ওখানেই হরিসভায় দান করে আসব৷

ছেলে-বউ দুজনেই একসঙ্গে চমকে উঠল৷

—অ্যাঁ! দান করে আসবেন? এখন ওর দাম কত ভেবেছেন? আমি তো একটা খদ্দের ঠিক করার চেষ্টায় আছি৷

জগদীশ মনে মনে বলেন, লবডঙ্কা৷ তোমার চেষ্টা সফল হবার আগেই বাড়ি মাটিতে শোবে৷

মুখে বললেন,—না না৷ পিতৃপুরুষের ভিটে বেচা হবে না৷ দানই করে দেব৷

—আর ওই ঠাকুরঘরের মেজেয় আর দেয়ালে পোঁতা খাঁটি রুপোর টাকাগুলো?

—পারিস তো উপড়ে নিয়ে আয়৷

—সে তো আর সোজা কথা নয়!

—তাই তো বলছি, যেটা সোজা সেটাই হোক৷ দান করে দেয়া হোক৷ আমি আজই যাচ্ছি৷ একটা টিকিট আনিয়ে রাখি৷

ছেলে রাগমাগ করে বলল,—একটা নয় দুটো৷ আপনাকে তো আর এই বয়েসে একা ছাড়তে পারি না৷

—তবে চল৷ ভালোই হবে৷ ফটাফট ফটো ওঠবার সময় তোরও উঠে যাবে৷ কাগজে ছাপা হবে৷

শুনে বউ বলল,—আমিও যাব৷

—বেশ তো৷ চলো একবার শেষ-মেষ ভিটেবাড়ির দেশে৷

যাওয়া হল৷

দিব্যি সমারোহ করেই যাওয়া হল৷ ছেলে বউ নাতি চাকর সবাইকে নিয়ে৷

কিন্তু…

কারোর ভাগ্যেই কি ফটো-ওঠা জুটল, কাগজে ছাপা হতে?

নাঃ! কপালে ঘি না থাকলে কি হবে?

সন্ধেরাতে পৌঁছলেন৷ সাপখোপের ভয়ে পুরনো বাড়িতে না উঠে ওখানের বাসিন্দা জ্ঞাতিদের বাড়িতে উঠলেন৷ ব্যাস, সন্ধের পর থেকেই বৃষ্টি৷ ওঃ কী বৃষ্টি, কী বৃষ্টি! যেন প্রলয়কাল ঘনিয়ে এসেছে৷ শুধু তো বৃষ্টিই নয়, সঙ্গে ঝড়ও৷

জ্ঞাতিরা বলল,—দশ বছরের মধ্যে এমন ঝড়বৃষ্টি দেখিনি৷ গাছ উপড়ে পড়ছে মড়মড়িয়ে, ঘরের চালাটালা ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে দু-দশ মাইল দূরে৷ দীঘি-পুকুরের জল উপচে উঠে লোকের বাড়িতে ঢুকে আসছে৷ কতজনের কত কী ঘটল৷

আর?

আর সেই রাতেই ঘটে গেল সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটি৷ বৈকুণ্ঠর ঠাকুদ্দা যার ওয়ার্নিং বেল দিয়েছিল৷

কিন্তু সকালবেলা দিব্যি আকাশ ফর্সা৷

ঘুম-টুম নেই৷ সকাল হতেই বেরিয়ে পড়লেন জগদীশ৷

দেখলেন সেই দেড়মণ রুপোর টাকা আর সাড়ে বারো সের গিনির ওপর হাজার হাজার মণ ইঁট পাথর লোহা-লক্কড়ের স্তূপ৷

হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছেন জগদীশ৷

কানের গোড়ায় সহসা ফিসফিস৷

—মন খারাপ করবেন না বড়কর্তা৷ ভবিষ্যৎকালে কোনো একদিন এই স্তূপ খনন হয়ে এইসব পুরাতন মুদ্রা…ইয়ে আবিষ্কার হবে৷

—তুই? তুই এখানেও?

—আজ্ঞে আমাদের তো এখানেই বাস৷ তিন পুরুষ যাবৎ৷

জগদীশ এদিক ওদিক তাকালেন৷ কাউকেই দেখতে পেলেন না৷ কেউ কোথাও নেই৷

—দিনের বেলাও ঘুরিস?

—আজ্ঞে আমার আবার দিন আর রাত! আমি তো সবসময়ই আপনার সঙ্গে সঙ্গে৷

—তা তোর ঠাকুদ্দার দেখছি গণনায় ভুল৷ পুণ্যির ছালাটা ভরতে তো তর সইল না৷

—না হোক গে, এমনিই আপনার অনেক আছে৷ পরের ধনে পোদ্দারি করে লাভটা কী? সে ভদ্দরলোক যা করে মঙ্গলের জন্যেই করে৷

—সে ‘ভদ্দরলোক’! মানে?

—কর্তা, আমার আবার ও নামটা মুকে আসে না৷ আপনি নিজে বুজে নিন৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *