দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

‘নিজের মশা নিজের মার’

‘নিজের মশা নিজের মার’

টেসটিং! হ্যালো। হ্যালো। মাইক স্টিং। ওয়ান টু, থ্রি, এইট, নাইন, জিরো। ঠাস-ঠাস-ঠাস তিনবার ঠুসকি। মাইক রেডি। চেয়ারম্যান আগে বলবেন। চেয়ারম্যান চেয়ারে বসে থেকেই ভেঙচি কেটে বললেন—চেয়ারম্যান আগে বলবেন। কোনও সভায় চেয়ারম্যানকে আগে বলতে শুনেছেন! চেয়ারম্যান বলেন সবশেষে। আগে অন্যান্যরা বলবেন। মি: ঢোলাকিয়া, মুখ থেকে পান ফেলুন। যান, আগে আপনি বলুন, আপনার এলাকা। হাঁ হাঁ সো বাততো ঠিকই আছে। ঢোলাকিয়া তিনবার চেষ্টা করে, চেয়ার থেকে পিপের মতো শরীরটা তুললেন। মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। যাওয়ার সময়, পায়ের চাপে, মঞ্চের পাটাতন, অধস্তন কর্মচারীদের বিক্ষোভের মতো মৃদু আর্তনাদ করে উঠল। ভেঙে পড়ল না।

ঢোলাকিয়া পরেছেন টেরিসিল্কের ঢিলে পাঞ্জাবি। পঞ্চাশ ইঞ্চি বহরের টেরিকটন ধুতি। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, গলায় সোনার হার। হাতে সোনালি ব্যান্ডের হাত ঘড়ি। ঢোলাকিয়া পানখাওয়া দাঁত মেলে সভাস্থ সকলের দিকে তাকিয়ে স্বর্গীয় হাসি বিতরণ করলেন, তারপর মাইক্রোফোনের গলাটা আততায়ীর হাতে চেপে ধরলেন। চেয়ারম্যান চিৎকার করলেন, গণেশ, গণেশ, অ্যানাউনসমেন্ট, অ্যানাউনসমেন্ট। রোগামতো এক ভদ্রলোক, পর্বতের মতো ঢোলাকিয়ার পেছন থেকে মুষিকের মতো লাফিয়ে বেরিয়ে এলেন। ডান পাশ, বাঁ-পাশ—কোনও পাশ থেকেই, চেষ্টা করেও মাইকের নাগাল না পেয়ে বলে উঠলেন, ধ্যাততেরিকা। ঢোলাকিয়াও আশেপাশে কি একটু সুড়সুড় করছে টের পেয়ে, হ্যাতরেরিকা বলে হাত ঝাড়ছেন। ভেবেছেন, মাছি অথবা পিঁপড়ে। কিছুক্ষণ, ধ্যাততেরিকা, হ্যাততেরিকা হতে লাগল। চেয়ারম্যান হেঁকে বললেন, ঢোলাকিয়া, আগে অ্যানউনসমেন্ট।

গণেশবাবু মাইকের সামনে দাঁড়িয়েই দম না নিয়ে বলতে শুরু করলেন—বন্ধুগণ, আপনারা কাগজে পড়েছেন মশা মারার—মশা নিয়ে ঘরসংসার করার কায়দা শেখাবার জন্যে একটা কমিটি হয়েছে। পাড়ায়-পাড়ায়, নগরে নগরে, গ্রামে-গ্রামে এই রকম শত-শত কমিটি হবে। এই কমিটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, অগণতান্ত্রিক; মশা মারার নামে রাজনীতি হোক, এ আমরা গোড়া থেকেই চাই না। অগণতান্ত্রিক, কারণ গণতন্ত্রে সমস্ত মানুষই একটি ভোট ছাড়া কিছুই নয়। মশাকে শুধুমাত্র একটি ভোট ভেবে বসে থাকলে, কোনওদিনই এই ক্ষুদ্র শত্রুর মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। মশা মারতে কামান দাগা চলে না। মানুষ মারতে কামান দাগলে, কেউ হাসবে না, কেউ আমাদের মূর্খ বলবে না। মশাদের উদ্বাস্তু করা যায় না। তারা মানুষ নয়। উদ্বাস্তু করতে পারলে, তাদের দিয়ে রাজনীতি করা যেত, গণতান্ত্রিক উপায়ে ধীরে-ধীরে উৎখাত করা যেত। মশারা অতি প্রবল প্রাণী। এদের চিৎ করে ফেলে, গলায় গামছা দিয়ে, হাতে কিংবা ভাতে মারা যায় না। ভয় দেখিয়ে, কিম্বা লোভ দেখিয়েও এদের বশে রাখা সম্ভব নয়। এরা সরষের তেল খায় না, গুঁড়ো মশলা খায় না যে, ক্যানসারে মরবে। এদের ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া হয় না, এনকেফেলাইটিস হয় না, কারণ এরা ওই সব হয়ে বসে আছে। এই সব একরোখা, অরাজনৈতিক, অভারতীয় মশাদের নিয়ে মহা জ্বালা। বাঙালি মরতে ভয় পায় না। ভয় যদি পেত তা হলে বাঙালি হয়ে জন্মাত না। বাঙালি মরার জন্যে, মার খাবার জন্যেই জন্মেছে। বাঙালি সব সহ্য করতে পারে, পারে না তিনটে জিনিস—এক, বাঙালি বাঙালিকে সহ্য করতে পারে না, দুই, গরমে পাখা বন্ধ সহ্য করতে পারে না, তিন, মশার দংশন সহ্য করতে পারে না। স্পর্শকাতর এই বাঙালিকে তাই আমরা মশার সঙ্গে ঘর করতে শেখাব। নিন শ্রীঢোলাকিয়া বলুন। শ্রীঢোলাকিয়া এই অঞ্চলের একজন সম্পন্ন ব্যবসায়ী। এই মল্লুকের মসকুইটো মিনেস কমিটির কনভেনার।

ঢোলাকিয়া আবার হাসলেন। পিচ করে ডান দিকে থুতু ফেললেন তারপর মাইক্রোফোনের গলা চেপে ধরলেন চার আঙুলে, চারটে আংটি। ভাই সোব! এ মারপিটকা বাত নেহি। এ বাঙালি, নন-বাঙালিকা হিসসা না আছে। দুনিয়ামে বাত এক হি আছে—মহব্বত, প্রেম। প্রেম সে সভ কুছ কোরতে হোবে। মানুষকে আপনি হোত্যা করুন, কোই কুছু বোলবেনা। মানুষের বুদ্ধি আছে, শক্তি ভি আছে। বাঁচনেকা, মরনেকা, মারনেকা ভি ক্ষমতা আছে। যো মারতা হায়, যো মরতা হায়, দোনোই ভগবানের উললু আছে। উসকো ফরসালা উস শালেকো করনে দো। পেয়ারমে বাঁচে তো বাঁচো, নেহি তো মরো। লেকিন বাত হয় না ভাই, জীবে দোয়া কোরো যো যোন, সো যোন সেবিছে ঈশ্বর। মচ্ছর জীব হ্যায়, ভাই। উসকো, বুদ্ধিউদ্ধি কুচ নেই, শিশুকো মাফিক। উসকো মারনেকা বাত আতা ক্যায়সে। উয়ো মারে, না মরে। উসকো প্রেম দিলাতে হবে, উসকো অন্দর মে প্রেম ঘুঁষাতে হবে। বিলকুল শক্ত কাম আছে। ইস লিয়ে লিডররর চাই, লিডররর, যো উসকো সমঝাবে, কাটনে মে কেয়া হায় ভাই! ক্যা ফায়দা হায় উসমে। হামার বুকে এসে যাও ভাই চুমাউমা দাও। ফিন উড়ে যাও। হামি সবকোইকো প্রেমকা আঁখসে দেখি, এ জীবন হায় স্বপ্না।

শ্রোতাদের মধ্যে থেকে, কে একজন ব্যঙ্গ করে বললেন—হ্যাঁ হ্যাঁ তোমার প্রেম জানা আছে, ভেজাল খাইয়ে-খাইয়ে সব মেরে ফেললে, এখন সভায় দাঁড়িয়ে পেয়ার শেখাচ্ছে।

ঢোলকিয়া যেতে-যেতে ঘুরে দাঁড়ালেন—হাঁ মশাই, ও বাত তো ঠিক আছে, হামি ভেজাল দিচ্ছে লেকিন তুমি কেন খাচ্ছে! এক গানা তো শুনেছে—জেনে শুনে বিষ করিয়েছে পান। তুমহার বউ যোখোন বোলে, হাঁ গো সরসুঁ তেল লিয়ে এস, মছলি হোবে, তুমি তোখোন টিন লিয়ে ঢোলাকিয়ার পাশ আসে কেনো। তুমহার বউ যোখোন মোশলা পিষতে না চায়, তোখোন গুঁড়া মশলা আনো কেনো! বোলো, বাঙালিবাবু! ঢোলাকিয়া তুমহার কি কোরবে ভাই, বাঙালি শিউশঙ্কর ভগবান হোয়ে, হোয়ে গেছে নীলকণ্ঠ।

চেয়ারম্যান খুব চটে গেলেন। চটে গিয়ে বললেন—আমরা মশা মারার সেলফ হেলপ শেখাতে এসেছি। আমাদের এই প্রকল্পের নাম—’নিজের মশা নিজে মারো।’ আপনারা যদি মন দিয়ে না শোনেন, হাজার হাজার মশার খপপরে ফেলে রেখে আমরা সরে পড়ব। সরে পড়াই আমাদের চিরকালের অভ্যাস। যেচে ধরা দিতে এসেছি। এরপর আর সেধে আসব না। তখন সাধ্য-সাধনা করলেও আর আমাদের পাবেন না।

বলুন, বলুন, শব্দ উঠল সভামন্ডপে।

ঢোলাকিয়াকে যে ভদ্রলোক আক্রমণ করেছিলেন, পাশে বসেছিলেন তাঁর স্ত্রী। স্বামীকে কনুইয়ের খোঁচা মেরে বললেন, তোমার আর কি, সারাদিন অফিসে ঠান্ডা ঘরে বসে থাকো, মাঝরাতে, এলেলেলে করে টাল খেতে-খেতে বাড়ি ফিরে দরজা গোড়াতেই উলটে পড়ো, মাতালের মরণ! চুপ করে বোসো না। আমাকে শুনতে দাও।

মশা-বিশেষজ্ঞ, শ্রীহিমাংশু গুপ্ত এখন কিছু বলবেন।

মশা জলে জন্মায়। বাড়ির আশেপাশে জল জমতে দেবেন না। জল জমলেই ছেঁচে ফেলে দেবেন। এমন জায়গায় ফেলবেন, যেখানে আবার যেন জমতে না পায়।

জল ছেঁচে ফেলব, কি মশাই! কি দিয়ে ছেঁচব, কে ছেঁচবে! বড়-বড় মুখ-খোলা নর্দমা, সারা বছর জল জমে ভ্যাট-ভ্যাট করছে। সেই নর্দমা আমরা ছেঁচে ফেলব! মামার বাড়ি! মামদোবাজি! এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক তেরিয়া হয়ে উঠলেন।

বক্তা বললেন, শুনুন, শুনুন, নর্দমা থেকে সব সময় এক মাইল দূরে বাসা করবেন। মশাদের জন্যে নর্দমা ছেড়ে দিন, আর ছেড়ে দিন মাঝরাতের মাতালদের জন্যে। নর্দমার পাশে বসবাস কে আপনাকে করতে বলেছে। মশা মাইলখানেক উড়তে পারে। অতএব এক মাইল দূরে থাকাই নিরাপদ। হয় একেবারে নর্দমার ভেতরে থাকুন, না হলে এক মাইল দূরে থাকুন। আমি যা পড়েছি, তাই বলছি। করতে পারেন ভালো, না পারেন, আমি কি জানি।

আর-এক বৃদ্ধ চিৎকার করে উঠলেন, এই যে ‘বুকাভিজ্ঞ’, মশা আজকাল খাটের তলায়, জামার পকেটে, মেয়েদের মাথার ঘন চুলে জন্মায়। দিনের পর দিন আমি লক্ষ করে দেখেছি।

ধ্যাত মশাই! লক্ষ করে দেখেছি। আমি মশা-পণ্ডিত, মসকুটো একসপার্ট, আমাকে আপনি মশার জন্মবৃত্তান্ত শেখাবেন না। মশা জন্মায় জলে, আশ্রয় নেয় ঘরে, মরে মানুষের চড়ে-চাপড়ে।

ধোর মশাই, দেখছি খাটের তলায় মশার সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে, পিলপিল করে বেরোচ্ছে, তবু বলবেন, মশা জলে জন্মায়!

সে তো ফুটপাথে মানুষের ছেলে হচ্ছে, তার আমি করব কি! ঘর থেকে খাট বিদায় করে মেঝেতে শোওয়ার অভ্যাস করুন। জামার পকেট উলটে রাখুন, যেভাবে ঘট উলটে রাখে। কিম্বা মেঝেতে আগে একটা বিছানা পাতুন, তার ওপর খাট রাখুন, তার ওপর ঝুলে বড় মেঝে পর্যন্ত একটা মশারি ফেলে বিছানার সঙ্গে চারপাশ গুঁজে দিন। আপনার মশার জন্মস্থান বন্ধ হল। আমার মাথায় এই মুহূর্তে আর কোনও প্ল্যান আসছে না। পরে এলে জানাব!

এইবার, কমিটির চেয়ারম্যান কিছু প্ল্যান বাতলাবেন। মাইক। মাইকটা টেবিলের সামনে দাও।

বন্ধুগণ, আমি বিপ্লবী মানুষ, আমার মাথায় যা আসে, তা হল আগুন জ্বালো। আগুনে জ্বালো। আমি চাই প্রতিটি মানুষের রক্তে আগুন জ্বলে উঠুক। মশা রক্তবিলাসী। ছেলেবেলার কথা মনে করুন, রান্না ঘরে চুরি করে কিছু খেয়ে ধরা পড়ে গেলেই, মা বলতেন, আর একবার চুরি দেখি, ওই নোলায় ছেঁকা দিয়ে দেব, হায়, হায়, কোথায় গেল সেই সব মায়েরা!

চেয়ারম্যান জামার হাতায় চোখ মুছলেন। ধরা-ধরা গলায় বললেন, মশাদের নোলায় ছেঁকা দিতে হবে। রক্তের উত্তাপ বাড়াতে হবে। খোওব ঝাল খান, কাঁচা লঙ্কা, শুকনো লঙ্কা, মরীচ, আদা, সব সময় রেগে লাল হয়ে থাকুন, সব সময় মারদাঙ্গা খ্যাচাখেচি ছেলেকে ধরে পেটান। প্রতিবেশীকে ধরে ঘুষোঘুষি করুন, সব সময় হট টেম্পার, মিলট্রি মেজাজ। দেখি মশা কী করে রক্তে মুখ দেয়! হে হে বাওবা:। মা-লক্ষ্মীদের জিগ্যেস করি, তোমরা মা আজকাল, রাস্তায় যেভাবে চারদিক খুলে উদোম হয়ে বেরোও, বাড়িতেও কি সেইভাবে থাকো!

হে হে, তাহলে কিন্তু মায়েরা, মশা যে কামড়াবেই! একে লোভী, তার ওপর প্রলোভনা। একটু ঢেকেঢুকে চাপাচুপি দিয়ে থেকো। একটু ধূপধুনো দিও, শাঁখটাঁখ বাজিও। ঘরের কোণে, কোণে, মাটির সরায় একটু বেশি করে চিটে গুড় রেখে দিও, মশাদের গুড়কলে ফেলে কাবু করে রাখা। আর-একটা প্ল্যান, যাদের গায়ের রং গৌর কিম্বা কটা, তারা এক পোঁচ করে আলকাতরা মেখে বসে থাকো। কালোদের মশা একটু কম কামড়ায়।

আমাদের এই ‘নিজের মশা নিজে মারো’ স্কিমে আপনারা সবাই শামিল হলে ফল খুব ভালোই হবে। নইলে চাঁদা তুলে মশা মরার কামান। তার কিন্তু ঝামেলা বিস্তর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *