গৌড়ানন্দ কবি ভনে

নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নাও প্রকল্প

নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নাও প্রকল্প

সংবাদে প্রকাশ, সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে ‘নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নাও’ নামে যে বহুমুখী প্রকল্পটি আপনা থেকেই চালু হয়ে গিয়েছে তা পেশাদার ছাত্র মহলেও খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

পেশাদার ছাত্র মহল এই ‘নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নাও’ প্রকল্পের মাধ্যমে রাতারাতি কাজ গুছিয়ে নেবার সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গিয়েছেন বলেই তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।

‘আমরা কয়েক বছর আগে যখন এই নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নাও প্রকল্প চালু করি, ‘ পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র নাচাও ও সিন্ডিকেটের মুখপাত্র ক্ষুদে খোকনা এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে আমাকে জানালেন, ‘তখন সত্যি বলতে কি এর সাফল্য সম্পর্কে আমরা এতটা নিশ্চিত ছিলাম না। এখন আমাদের আর কোনও সংশয় নেই। এই প্রকল্প পেশাদার ছাত্রদের ক্রমেই স্বয়ম্ভরতার দিকে নিয়ে চলেছে।’

‘আচ্ছা পেশাদার ছাত্র বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?’

ক্ষুদে খোকনা বললেন, ‘পেশাদার ছাত্র বলতে আমি স্থায়ী ছাত্রদের কথাই মিন করছি। অর্থাৎ যাদের ছাত্রজীবন কখনোই ফুরোয় না এবং যারা ছাত্রজীবনকে লাভজনক পেশায় পরিণত করেছেন।’

‘পশ্চিমবঙ্গে এখন পেশাদার ছাত্রের সংখ্যা কত?’

ক্ষুদে খোকনা এক পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে বললেন, ‘তের হাজার নশ বাষট্টি। এদের মধ্যে ৪৩.৮ শতাংশই এখন নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নাও প্রকল্পের আওতার মধ্যে পড়েন।’

‘নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নাও প্রকল্প কোন অঞ্চলে সব থেকে ভাল ভাবে চলছে বলে আপনি মনে করেন?’

‘যে অঞ্চলে ছাত্র নাচাও সিনডিকেটের প্রভাব বেশী,’ ক্ষুদে খোকনার কণ্ঠস্বরে রীতিমতো আত্মপ্রত্যয় ফুটে উঠল, ‘স্বভাবতই সেই অঞ্চলেই নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নাও প্রকল্প ভালভাবে চলছে। তবে শান্ত পাল, ভগবতী তনয়, সুরপতি আর ভঙ্গভাষী মহাবিদ্যালয়েই এই প্রকল্প সব থেকে সার্থকভাবে চলছে। সত্যি বলতে কি এই চারটে মহাবিদ্যালয় হচ্ছে নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নাও প্রকল্পের আদর্শ। তাই আমরা এই চারটি জায়গায় সুদক্ষ পেশাদার ছাত্র তৈরির প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও খুলেছি।’

‘এবারে নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নাও প্রকল্প সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।’

ক্ষুদে খোকনা বললেন, ‘ছাত্র নাচাও সিনডিকেটের পেশাদার সদস্যদের কাজ হল, ছাত্র কল্যাণ। এই ধরুন, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল বেরিয়েছে। পাশ করা অপেশাদার ছাত্ররা আরও উচ্চ শিক্ষা পেতে চায়। আমাদের কাজ হবে এইসব ছাত্রদের ঠিক পথে পরিচালিত করা। যারা অবিশ্যি ভাল ফল করেছে তারা যেখানে যেভাবে পারছে বিশৃঙ্খলভাবে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। যদিও আমরা এই বিশৃঙ্খলা পছন্দ করিনে, তবু, যেহেতু তারা মাইনরিটি তাই তাঁদের নিয়ে আমাদের বিশেষ মাথা ব্যথা নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠদের মঙ্গলই আমাদের লক্ষ্য। মেজরিটির যাতে উপকার হয় তাই করাই তো ভালো। নয় কি বলুন।’

‘অবশ্যই। এতে আর দ্বিমত হবার কি আছে। শাস্ত্রেই তো আছে গ্রেটেস্ট গুড টু দি গ্রেটেস্ট নামবার।’

‘একজ্যাকটলি,’ ক্ষুদে খোকনা বললেন, ‘আমাদের ছাত্র নাচাও সিনডিকেটের মটো হচ্ছে তাই। অথচ দেখুন, কী জঘন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, মেজরিটি ছাত্রই হচ্ছে ওয়ারসট সাফারার। সব থেকে নির্যাতিত, সব চাইতে শোষিত। আমরা ঠিক করেছি, এ শোষণ আর চলতে দেব না।’

‘বাঃ! খুবই মহৎ উদ্দেশ্য। তা কী ব্যবস্থা আপনারা করেছেন?

আপনি শুনলে অবাক হবেন স্যর, শিক্ষার নমে কী চলছে।’ ক্ষুদে খোকনা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। ‘জানেন, নমবর কম পেয়েছে বলে অনারস পড়তে দেওয়া হচ্ছে না?’

‘বলেন কী! এও হচ্ছে?’

‘তবে আর বলছি কী? আরে বাবা অনারস পড়ার সঙ্গে নম্বরের সম্পর্ক কী?’

‘এ তো একটা মৌলিক প্রশ্ন। এর কি কোনও উত্তর হয়?’

‘তবেই বুঝুন। আমরা মনে করি এটা একটা বৈষম্যমূলক আচরণ। তাই আমরা এই বৈষম্য দূর করার ব্যবস্থা করেছি।’

‘যারা এবার পরীক্ষায় ভালো ফল করেনি তাদের অনারস পড়ার উপযুক্ত করে তোলার জন্য ভালো পড়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন বুঝি?’

‘যার যার পড়াশুনা তার তার কাছে।’ ক্ষুদে খোকনা বললেন, ‘আমরা কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে যাব কেন মশাই?’

‘তাহলে বৈষম্য দূর করবেন কী করে?’

ক্ষুদে খোকনা রহস্যময় হাসি হেসে বললেন, ‘কেন, নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নাও প্রকল্প প্রয়োগ করে।’

‘যদি আরও একটু খোলসা করে বলেন তো ভালো হয়।’

‘নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নাও প্রকল্প অনুযায়ী আমরা আমাদের সমিতিভক্ত সবাইকে অবিশ্যি যারা স্বেচ্ছায় অনারস পড়তে চায় বাধ্যতামূলক চাঁদার বিনিময়ে অনারস ক্লাসে ভর্তি করে নিচ্ছি।’

‘বুঝেছি। আপনারা নতুন কলেজ খুলেছেন। বাঃ, দারুণ ব্যাপার তো।’

‘কচু বুঝেছেন। আমরা নতুন কলেজ খুলতে যাব কোন্ দুঃখে। যে-সব কলেজ আছে সেই সব কলেজেই ভর্তি করে নিচ্ছি। আমাদের কোটা আছে না?’

‘আপনাদের কোটা আছে মানে?’

‘আপনি তাও জানেন না। যে কলেজে যাদের ইউনিয়ন স্ট্রং, সেই কলেজে ছাত্র ভর্তি করার জন্য তাদেরই কোটা আছে। যেখানে যাদের ইউনিয়ন যত স্ট্রং সেখানে তাদের কোটা তত বেশী। ছাত্র আন্দোলন লড়াই করে এই অধিকার আদায় করেছে। পেশাদার ছাত্রদের এ একটা বিরাট সাফল্য। আপনি যদি আজ কলেজে ভর্তি হতে যান তাহলে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য কার্ড নিতে হবে। কারড না দেখালে কোনও প্রিনসিপ্যাল ভর্তি করবে, এমন কটা মাথা কার আছে? সদস্য হবার পর আপনি যদি অনারসই পড়তে চান, আর আপনার যদি প্রয়োজনীয় নম্বর না থাকে তবে আপনি নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নাও প্রকল্পে চাঁদা দিন। দিয়ে নিজের ইচ্ছেমত সাবজেক্ট নিন না। কে ঠেকায়?’

‘তা চাঁদার হার কত?’

ক্ষুদে খোকনা বললেন, ‘দেড়শ থেকে পাঁচশ টাকার মধ্যেই। দ্রব্যমূল্য বাড়লেও আমরা চাঁদার হার বাড়াইনি। আপনার নমবরের ঘাটতি যত হবে, চাঁদাও তত বেশি লাগবে।’

‘বাঃ বাঃ! তা এই প্রকল্পে আপনাদের কত থাকছে?’

‘মাগগী গণ্ডার বাজারে তা চলে যাচ্ছে কোন মতে। প্রকল্পটা কেমন?’

‘ওয়ানডারফুল।’

১৪ অগাস্ট ১৯৭৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *