উপন্যাস
বড়গল্প
ছোটগল্প
1 of 2

নিজের ঢাক নিজে পেটালে

নিজের ঢাক নিজে পেটালে

বড়মামা বললেন, ‘এবার আমি নিজের ঢাক নিজেই পেটাব।’

মেজোমামা চায়ের কাপে চিনি গোলাতে গোলাতে বললেন, ‘সে আবার কী?’

মাসিমা কাপে চা ঢালতে ঢালতে বললেন, ‘তার মানে লণ্ডভণ্ড আবার একটা কিছু করে ছাড়বে। ইলেকশানে দাঁড়াতে চাইছ নাকি বড়দা?’

‘ইলেকশান? ও ভদ্রলোকের ব্যাপার নয়।’

মেজোমামা বললেন, ‘তাহলে কি ধর্মগুরু হবে?’

‘সে শক্তি নেই। ধর্ম নিয়ে ছেলেখেলা চলে না।’

মাসিমা বললেন, ‘তাহলে ঢাকটা পেটাবে কী করে? কী ভাবে?’

‘আমি নিজেই আমার জন্মদিন করব। তোরা তো কেউ কিছু করলি না!’

মেজোমামা বললেন, ‘জন্মদিন! বুড়ো বয়সে জন্মদিন? লোকে তোমাকে পাগল বলবে।’

‘সারা গ্রামের মানুষকে আমি পেটপুরে খাওয়াব। সারাদিন সানাই বাজবে। ফুল, ফুলের মালা। এলাহি ব্যাপার করে ছেড়ে দোব। দেখি লোকে কেমন পাগল বলে! সেদিন সারাদিন আমি ফ্রিতে চিকিৎসা করব। একটাও পয়সা নোব না। ফ্রি ওষুধ।’

মেজোমামা বললেন, ‘মরবে, একেবারে হাড়-মাস আলাদা করে রেখে যাবে। তোমার জয়ঢাকের মতো পেট ফাঁসিয়ে দেবে।’

‘দেখা যাক।’

মাসিমা বললেন, ‘কে রাঁধবে? কে পরিবেশন করবে?’

‘তোকে কিছু করতে হবে না। কলকাতা থেকে সাতজন হালুইকর আসবে। আমার বিশজন চ্যালা পরিবেশন করবে।’

‘এ করে কী লাভ হবে। এর মধ্যে কোনও নতুনত্ব নেই। লোকে বলবে ডাক্তার সুধাংশু মুকুজ্যে রুগিমারা পয়সা ওড়াচ্ছে। লোকের চোখ টাটাবে। নামের বদলে বদনামই হবে। তার চেয়ে তুমি বরং জন্মদিনে পশুভোজন করাও। একেবারে নতুন আইডিয়া। একদিকে গ্রামের যত গোরু। আর একদিকে ছাগল। আর একদিকে বেড়াল। আর একদিকে কুকুর। আর ভোরবেলা পাখি। পৃথিবীর কেউ কোনওদিন যা ভাবতে পারেনি। বিশ্বাসঘাতক মানুষ, অকৃতজ্ঞ মানুষকে খাওয়ানো মানে ভূত-ভোজন। এ যদি তুমি করতে পার, আমি তোমার দলে আছি।’

বড়মামা চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে মেজোমামাকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরলেন। ‘তুই আমার ভায়ের মতো ভাই। আমি রাম, তুমি লক্ষণ।’

মাসিমা বললেন, ‘আহা, কী স্বর্গীয় দৃশ্য!’

বড়মামা চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ‘কিন্তু মেজো, কীভাবে ওদের নেমন্তন্ন করা হবে! মানুষকে তো চিঠি দিয়ে করে! একটা গোরু, একটা ছাগলে তো জমবে না। একপাল চাই। বাগান যেন একেবারে ভরে যায়। সেটা কী ভাবে হবে?’

‘মাথা খাটাতে হবে।’

মাসিমা বললেন, ‘কবে হবে।’ তার আগের দিন আমি বাড়ি ছেড়ে পালাব।’

বড়মামা বললেন, ‘সে আমি জানি। কোনও ভালো কাজে তোমাকে পাওয়া যাবে না।’

মাসিমা উঠে চলে গেলেন। মেজোমামা বললেন, ‘তোমার জন্মদিন কবে?’

‘সেটা আমাকে দেখতে হবে।’

‘সেটা তুমি আগে খুঁজে বের করো। আমি ইতিমধ্যে প্ল্যানটা ছকে ফেলি। জিনিসটা যদি করা যায় বড়দা, ফাটাফাটি হয়ে যাবে।’

‘আচ্ছা মেজো, নেমন্তন্ন মানেই তো ভালো-মন্দ খাওয়া। মানুষের খাওয়ার মেনু আমরা জানি। পশুর ভালো খাওয়া কী হবে? মেনুটা কী হবে?’

মেজোমামা কিছুক্ষণ ভাবলেন, তারপর বললেন, ‘পাখির ভালো-মন্দ খাবার হল, ফল, মেওয়া। গোরুর হল, ভালো বিচালি, আখের গুড় ছোলা, সবুজ ঘাস, গাছের পাতা। ছাগলের বটপাতা, কাঁঠালপাতা! কুকুরের হল মাংস।’

বড়মামা বললেন, ‘দুধ, বিস্কুট।’

‘মেনুটা আমরা পরে ঠিক করে ফেলব বড়দা।’

মেজোমামা উঠে চলে গেলেন। কলেজে আজ আবার সকালেই ক্লাস। বড়মামা আমার হাত ধরে নিজের ঘরে টেনে নিয়ে গেলেন। ড্রয়ার খুলে খুঁজে খুঁজে একটা কোষ্ঠী বের করলেন।

‘বুঝলি, জন্মতারিখটা খুঁজে বের করতে হবে। তুই কোষ্ঠী দেখতে জানিস?’

‘আমি? আমি তো ওসব জানি না বড়মামা!’

‘কী জানিস তুই? নে, এটাকে খোল। ধর।’

কোষ্ঠী খুলছে। খুলতে খলুতে ঘরের এ-মাথা থেকে ও-মাথায় চলে গেলুম। কত বড় কোষ্ঠী রে বাবা!

‘বড়মামা, ঘর যে শেষ হয়ে গেল! দেয়ালে ঠেকে গেছি। আর যে যাবার জায়গা নেই! একে কী কোষ্ঠী বলে বড়মামা?’

‘একে বলে গাছ-কোষ্ঠী। গাছের ডালে বসে ন্যাজের মতো ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে দেখতে হয়। ভাটপাড়ার তর্কপঞ্চাননের তৈরি রে ব্যাটা! এতে সব আছে। নে, মাথার দিকটা মেঝেতে পেতে বইচাপা দিয়ে এগিয়ে চলে আয়।’

চাপা দিয়ে চলে এলুম। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘরে এসে ঢুকল বড়মামার পেয়ারের কুকুর লাকি। বড়মামা সাবধান করলেন, ‘লাকি, কোষ্ঠী নিয়ে ইয়ারকি কোরো না। চুপ করে একপাশে বোসো।’

লাকি ফোঁস ফোঁস করে কোষ্ঠী শুঁকে চেয়ারে গিয়ে বসল জিভ বের করে।

বড়মামা বললেন, ‘নে, হামাগুড়ি দিয়ে মাথার দিক থেকে দেখতে দেখতে নীচের দিকে নেমে আয়। দেখবি এক জায়গায় লেখা আছে, কৃষ্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়স্য, প্রথম পুত্র জাতবান। এই জায়গায় লেখা থাকবে মাস, দিন, সাল, তারিখ, সময়।’

‘এ খুব কঠিন কাজ যে বড়মামা! আপনার মনে নেই কবে, কোন দিন, কোন সালে জন্মেছেন?’

‘ধুস, নিজের জন্মদিন মনে থাকে? নে নে, হামাগুড়ি দিয়ে দেখতে দেখতে নেমে আয়। কষ্ট কী রে? হামা দিতেও কষ্ট। ছেলেবেলায় কত হামা দিয়েছিস!’

পড়তে পড়তে নীচের দিকে নামছি। সব কি আর পড়ছি, না পড়া যাচ্ছে? কত রকমের নকশা আঁকা। ছবি আঁকা। ছক কাটা। মানুষের ভাগ্য যে কী ভীষণ জটিল! নামতে নামতে পেটে নেমে এলুম। কোথায় সেই জাতবান! সব আছে, ওইটাই নেই।

‘বড়মামা, তর্কপঞ্চাননমশাই ওটা লিখতে ভুলে গেছেন।’

‘সে কী রে! আমি কি রামচন্দ্র! না জন্মাতেই রামায়ণ লেখা হয়ে গেল!’

‘লিখতে মনে হয় ভুলে গেছেন!’

‘তাহলে এটা কার কোষ্ঠী! ভালো করে দ্যাখ রে গবেট। জন্মতারিখ, দিন, সময় ছাড়া কোষ্ঠী হয় না।’

‘আপনি একবার দেখুন, আমার চোখে পড়ছে না।’

‘এদিকে আয়, ন্যাজটা চেপে ধর। চেপে না ধরলে গুটিয়ে যাবে।’

বড়মামা হামা দিয়ে কোষ্ঠী পড়ছেন, ঘরে এলেন কবি করুণাকিরণ। বড়মামার চেয়ে বয়েসে অনেক বড়। বড় বড় কবিতা লেখেন। মাথায় বড় বড় কাঁচাপাকা চুল। ইদানিং বড়মামার কাছে প্রায়ই আসেন। শরীরে হাজারটা ব্যামো। কখনও পেট ভুটভাট। কখনও মাথাধরা। কখনও বুক ধড়ফড়, হাত-পা কাঁপা। কবি বলে, বয়স্ক বলে বড়মামা খুব খাতির করেন। বিনা পয়সায় চিকিৎসা চলে। ফ্রি ওষুধ। আজ আবার কী রোগ নিয়ে এলেন কে জানে? এখুনি জানা যাবে।

কবি করুণাকিরণ বললেন, ‘কী হে ডাক্তার, আবার নতুন করে হামা দেওয়া শিখছ না কি? দ্বিতীয় শৈশব এরই মধ্যে ফিরে এল?’

‘আজ্ঞে না, নিজের জন্মতারিখ খুঁজছি।’

‘ওটা কোষ্ঠী বুঝি? বাঃ, বেশ পেল্লায় ব্যাপার তো! খুঁজে পেলে?’

‘আজ্ঞে না।’

‘সরো, আমি খুঁজে দিচ্ছি।’

আমরা তিনজনেই মেঝেতে হামাগুড়ি দেবার অবস্থায়। কবি করুণাকিরণ খুঁজে খুঁজে বের করলেন, বড়মামার জন্মদিন পয়লা আষাঢ়। মেঝে থেকে বীরের ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘বড় শুভদিনে জন্মেছ হে ডাক্তার। আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে প্রথম পুত্র জাতবান। তোমাকে আটকায় কে? ধর্মে, অর্থে, মোক্ষে তরতর, তরতর করে ওপর দিকে উঠে যাবে।’

ধপাস করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, ‘মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল কেন? ডাক্তার, একবার প্রেশারটা চেক করো তো!’

মেজোমামা আজকাল রাতে খই-দুধ ছাড়া অন্য কিছু খান না। ভুঁড়ি হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া রাতে গুরুভোজন করলে তাড়াতাড়ি ঘুম পেয়ে যাবে। বেশি রাত অবধি লেখাপড়া করা যায় না। দুধে খই ভেজাতে ভেজাতে বললেন, ‘তোমার জন্মদিন তাহলে পয়লা আষাঢ়!’

বড়মামা বললেন, ‘হ্যাঁ। এসে গেল। প্ল্যানটা ভেবেছিস কী ভাবে কী হবে?’

‘ক’দিন ধরেই খুব ভাবছি, বুঝলে? পাখি আর কুকুরের জন্যে চিন্তা নেই। জানো তো, বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না।’

‘তুই কাককে পাখির মধ্যে ফেলছিস?’

‘ও মা, সে কী! কাক পাখি নয়! দুটো ডানা, উড়তে পারে। পাখি ছাড়া আর কী?’

‘ডাক আর স্বভাব দুটোই ভারি বিশ্রী।’

‘তুমি রূপ দেখো না দাদা, গুণটাও দ্যাখো। ইংরিজিতে বলে নেচারস স্ক্যাভেঞ্জার। তাছাড়া পায়রা আছে, চড়াই আছে। আমাদের ঠাকুর দালানেই শ-খানেকের বেশি পায়রা আছে। একমুঠো দানা আনলেই সব ফরফর করে নেমে আসবে।’

‘আরে দূর, সে তো সব গোলা পায়রা!’

‘গোলা পায়রা পায়রা নয়! তুমি যে কী বলো দাদা! তোমার জন্যে জাপান থেকে ন্যাজঝোলা পায়রা কে আনবে দাদা! পাখি বলতে তুমি কী বোঝো?’

‘ধর, টিয়া, ময়না, দোয়েল, বুলবুলি, ফিঙে, বউ-কথা-কও, নীলকণ্ঠ, কোকিল, বাবুই, চাতক, শালিক। মানে সব জাতের পাখি, যারা গান গাইতে পারে।’

‘দ্যাখো দাদা, অমন দুই দুই কোরো না। সব পাখিই ঈশ্বরের সৃষ্টি। ওই দিন একঝাঁক ছাতারে যদি ধরতে পারি, সভা একেবারে জমে যাবে।’

‘প্লিজ মেজো, ছাতারে আমদানি করিসনি। ভীষণ ঝগড়াটে পাখি। চিল্লে বাজারে মাত করে দেবে।’

‘আরে, ভোজসভা একটু সরগরম না হলে মানায়! বিয়েবাড়িতে দ্যাখোনি যত না খাওয়া হয় তার চেয়ে বেশি হয় চিৎকার।’

মাসিমা তাড়া লাগালেন, ‘তোমরা দয়া করে টেবিল ছেড়ে উঠবে? রাত কটা হল খেয়াল আছে?’

বড়মামা করুণ মুখে বললেন, ‘তুই সব সময় অমন অসহযোগীতা করিস কেন কুসি? তোর সামান্য একটু সহানুভূতি পেলে, আমরা দু’ভাই পৃথিবী জয় করতে পারি।’

‘থাক, তোমাদের আর পৃথিবী জয় করে কাজ নেই। সব মাথায় তুলে এখন জন্মদিন হচ্ছে। তাও কী রকম জন্মদিন, না পশুভোজন। লোকে শুনলে তোমাদের দুজনকেই পাগলা গারদে দিয়ে আসবে।’

মেজোমামা বড়মামার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘উঠে পড়ো বড়দা। এখানে বিশেষ সুবিধে হবে না। কুসিটার মাথায় কোনও আইডিয়া নেই। একেবারেই স্টিরিও।’

দুই মামা ছাদে এসে ঢাউস দুটো বেতের চেয়ারে গা এলিয়ে বসলেন। মাথার ওপর এক-আকাশ তারা। কোণের দিকে এক-ফালি চাঁদ ঝুলছে। মনে হচ্ছে, কে যেন ছবি এঁকে রেখেছে। মাঝে মাঝে বাতাস বইছে। দূরে, বহুদূরে একপাল কুকুর চিৎকার করছে।

মেজোমামা বললেন, ‘বড়দা, শুনছ। এই গ্রামে ওই রকম কয়েক পাল কুকুর আছে।’

‘তুই ওদের নেমন্তন্ন করবি নাকি?’

‘নিশ্চয়। তাছাড়া তুমি কুকুর পাবে কোথায়?’

‘ওরা তো লেড়ি রে?’

‘তোমার বড়দা বড় জাতিভেদ। বর্ণবৈষম্য দূর করো। ভগবানের রাজত্বে সবাই সমান।’

‘ওদের স্বভাব তুই জানিস না মেজো, ম্যানেজ করতে পারবি না। শেষে পুলিশ ডাকতে হবে।’

‘হ্যাঁ, পুলিশ ডাকতে হবে! কী যে তুমি বলো বড়দা। স্রেফ ইট মেরে ভাগিয়ে দোব।’

‘গোরু আর ছাগলের জন্যে তা হলে কী করবি?’

‘নিমন্ত্রণ ছাড়ব। বয়ানটা আমি এখুনি লিখে দিচ্ছি। ভাগনে!’

‘বলুন মেজোমামা?’

‘লেখ তো।’

কাগজ আর কলম নিয়ে বসতেই মেজোমামা বলতে শুরু করলেন :

‘সবিনয় নিবেদন,

আগামী পয়লা আষাঢ় আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ডাঃ সুধাংশু মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিবস পালিত হবে মদীয় ভবনে সাড়ম্বরে, যথোচিত উৎসব সহযোগে। উক্ত পূণ্যদিবসে এই উপলক্ষে আয়োজিত পশুভোজসভায়, স-শাবক আপনার গৃহপালিত গোরু-ছাগলকে উপস্থিত থাকার জন্য ও প্রীতিভোজে অংশগ্রহণের জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাই। উপহারের বদলে আশীর্বাদই প্রার্থনীয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অতিথি-নিয়ন্ত্রণবিধি অনুসারেই ভোজের আয়োজন করা হবে। ডাঃ মুখোপাধ্যায়ের দীর্ঘজীবন কামনা করে তাঁকে জনসেবার সুযোগ দান করুন।

ভবদীয় শান্তিরঞ্জন মুখোপাধ্যায়

নির্ঘণ্ট : প্রাতে সানাই-সহযোগে উৎসবের সূচনা। স্নান, পূজারপাঠ, হোম! অনুষ্ঠান-মণ্ডপের উদ্বোধন, মাঙ্গলিক সঙ্গীত। পক্ষী-উৎসব। ডাক্তার মুখোপাধ্যায় স্বহস্তে পক্ষীভোজন করাবেন। ক্ষণ-বিরতি। দ্বিপ্রহরে, গো ও ছাগ উৎসব। সাড়ম্বরে, গোরু ও ছাগলের সুখাদ্য বিতরণ করা হবে। রাতে কুকুরসেবা। স্বস্তিবাচন। উৎসবের পরিসমাপ্তি।

নিমন্ত্রণপত্র লেখা শেষ হয়। বড়মামা গদগদ স্বরে বললেন, ‘বাঃ, চমৎকার! তোর মাথাটা মেজো বেশ ভালোই খেলে। সাধে তুই নামকরা অধ্যাপক।’

‘নাও, এখন শুয়ে পড়ো। বড় বড় হাই উঠছে। কাল সকালে ভোলাবাবুকে প্রেসে দিয়ে আসতে বোলো, আর বেশি সময় নেই। শ-দুয়েক কপি ছাপালেই হবে।’

মেজোমামা গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ঘরের দিকে চলে গেলেন।

শ্যামল হাজরার খড়ের গোলা। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। হাজরামশাই ধুনোর ধোঁয়া ঘর অন্ধকার করে, গদির ওপর পা তুলে গ্যাঁট হয়ে বসে আছেন। সামনে লাল ক্যাশ বাক্স। মেজোমামা আর আমি দোকানে ঢুকতেই, হাজরামশাই ভদ্র হয়ে বসতে বসতে বললেন, ‘আসুন, আসুন, মেজোবাবু, কী সৌভাগ্য আমার।’

হাজরামশাই কাশতে লাগলেন। একঢোক ধুনোর ধোঁয়া গিলে ফেলেছেন।

মেজোমামা গদির ওপর ঝুলে বসলেন। চোখ জ্বালা করছে। মেজোমামা বললেন, ‘আপনার কাছে একটা খবরের জন্যে এলুম।’

হাজারমশাই কাশি সামলে বললেন, ‘কী খবর মেজোবাবু?’

‘আচ্ছা, আপনার গোলা থেকে যাঁরা খড় নেন, তাঁদের নাম ঠিকানা সব আমায় দিতে পারেন?’

হাজরামশাই সন্দেহের চোখে তাকালেন, ‘কেন বলুন তো? আমায় ভাতে মারতে চান?’

‘ভাতে মারতে চাইবে কেন?’ মেজোমামা আশ্চর্য হলেন।

‘বলা যায় না, হয়তো পাশাপাশি আর একটা গোলা খুলে বসলেন!’

‘পাগল হয়েছেন? প্রফেসারি ছেড়ে গোলা খুলতে যাব কোন দুঃখে?’

‘বলা যায় না মেজোবাবু। ছেলে-চরানো, আর গোরু-চরানো প্রায় এক জিনিস। শেষে হয়তো ভাবলেন বিদ্যের বদলে খড় দেওয়াই ভালো। অনেক সহজ কাজ!’

মেজোমামা হাসতে হাসতে বললেন, ‘তা যা বলেছেন! ব্যবসা করতে জানলে তাই করতুম। না, সে কারণে নয়। আমি জানতে চাইছি অন্য কারণে।’

মেজোমামা সব ভেঙে বললেন। বড়মামার অভিনব জন্মদিন পালনের কথা। গোরুদের সবান্ধবে নিমন্ত্রণ করতে হলে গোরুর মালিকের নাম ঠিকানা জানা দরকার। সব শুনে হাজরামশাই হাঁ হয়ে গেলেন।

‘মেজোবাবু, আপনি রসিকতা করছেন না তো! এ-রকম কথা কেউ কখনও শোনেনি।’

‘আমার দাদা পশুভক্ত। সারাজীবন গোরু, ভেড়া, ছাগলেরই সেবা করে গেল। সাত-সাতটা কুকুর। সেই ভালোবাসা পরিবারের বাইরে ছড়িয়ে দেওয়া আর-কি! বুঝলেন না হাজরামশাই!’

‘সবাই বুঝলুম’ তবে এই দুর্মূল্যের বাজার। মানুষই খেতে পাচ্ছে না।’

‘তাহলে বুঝুন, পশুরা কী অবস্থায় আছে? কটা গোরু ভালোভাবে খেতে পায়? কটা ছাগল খাবার পর পরিতৃপ্তির ঢেকুর তোলে! কটা ছাড়া-কুকুরের খাবার স্থিরতা থাকে? পশু বলে কি তারা মানুষ নয়!’

হাজরামশাই হাসলেন। হাসতে হাসতে মোটা একটা খাতা খুললেন, ‘নিন, আমি বলে যাই, আপনি লিখে নিন। চা খাবেন মেজোবাবু?’

‘তা একটু হলে মন্দ হয় না।’

হাজরামশাই কর্মচারীকে ডেকে চায়ের হুকুম দিলেন। নাম ঠিকানা লেখা চলতে লাগল। অনেকেরই গোরু আছে। মেজোমামার খুব আনন্দ। আমাকে ফিসফিস করে বললেন, ‘গোরুতেই মাত করে দেবে। কুকুরের আর দরকার হবে না। বাড়িটা বৃন্দাবন হয়ে যাবে। দাদা আমার রাখালরাজা হয়ে গো-সেবা করবে।’

মাসিমা জিগ্যেস করলেন, ‘তোমাদের পাগলামির দিনটা তাহলে কবে ঠিক হল?’

বড়মামা আর মেজোমামা দুজনেই বসেছিলেন। একসঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলেন, ‘পাগলমি মানে? জীবসেবা মানে শিবসেবা। পড়িসনি?’

‘পড়েছি দাদা। তবে এখন পড়েছি পাগলের হাতে। দিনটা কবে সেইটা শুধু বলে দাও। তার দু’দিন আগে আমি পালাব।’

‘পালাবি মানে! বাড়িতে এতবড় একটা কাজ। শুধু কাজ নয়, সামথিং নিউ। তুই পালালে আমরা যাব কোথায়? তুই আমাদের অনুপ্রেরণা।’

‘আবার ভূমিকা?’

‘দর্শক। তুই হবি দর্শক। খবরের কাগজের লোক আসতে পারে। এমন তো হয়নি কখনও। তাদের একটু আদর আপ্যায়ন করবি। ‘পশুপ্রেমী বড়দা’ বলে আমরা একটা পুস্তিকা ছাপাচ্ছি। সেটাই জনে জনে বিতরণ করবি। মনে রাখবি—এটা সাধারণ বাড়ি নয়। তপোবন। আশ্রম।’

মাসিমা মুচকি হেসে চলে গেলেন। বড়মামা বিষণ্ণ মুখে বললেন, ‘আমাদের পাগল বলে গেল!’

‘আরে এ-পাগল সে-পাগল নয়। এ হল আদরের পাগল। প্রেমিক পাগল। যে-কোনও ভালো কাজ, অভিনব কাজের সূত্রপাতে লোকে পাগলই বলে। তোমার সেই ব্যাঙ-নাচানো সায়েবের গল্প মনে পড়ে? পাগলামি থেকে এল বিদ্যুৎ। পাগলামি থেকে এল বসন্তের টিকে। নাও, এসো, চিঠিগুলো খামে ভরে ফেলা যাক। আজই নিমন্ত্রণে বেরোতে হবে। বেশি সময় নেই।’

‘তুই কি সত্যিই ”পশুপ্রেমী বড়দা” ছাপাবি?’

‘ছাপাবি কি? ছাপতে চলে গেছে।’

‘কী লিখলি, আমাকে একবার দেখালি না ভাই!’

‘ছেপে আসুক। পড়লে তুমি অবাক হয়ে যাবে। শুরুটা আমার লাইন-দুয়েক মনে আছে—পশু না হলে পশুকে ভালোবাসা যায় না। আমাদের পশুপ্রেমী বড়দা আশৈশব পশুপক্ষীর সঙ্গে বিচরণ করতে করতে এখন পশু-ভ্রাতা কি পশু-পিতার স্তরে চলে গেছেন।’

‘এই সব লিখলি? লোকে আমাকে ভুল বুঝবে না তো!’

‘কেন, ভুল বুঝবে কেন?’

‘ওই সব লিখে আমাকেই তো পশু বানিয়ে দিলি।’

‘মানুষের আর কোনও গৌরব নেই দাদা। এখন পশু হওয়াই গৌরবের। গোরু তবু দুধ দেয়। পাখি তবু গান গায়। কুকুর তবু পাহারা দেয়। তোমার মানুষ কী করে দাদা? শুধু বদমাইশি।’

‘তা ঠিক, তা ঠিক।’ বড়মামা খামে চিঠি ভরতে লাগলেন আপনমনে।

সন্ধেবেলা আমি আর মেজোমামা বেরিয়ে পড়লুম, ঠিকানা মিলিয়ে বাড়ি-বাড়ি ঘুরতে। বেশ মজা লাগছে। প্রথম বাড়ি। মেজোমামা ডাকলেন, ‘হরিদা আছেন, হরিদা?’

হৃষ্টপুষ্ট, কালো চেহারার হরিদা বেরিয়ে এলেন। দেখলেই মনে হয় ডেলি সের কয়েক দুধ খান। খাবেন না কেন? বাড়িতে তিন-তিনটে গোরু। হাম্বা হাম্বা ডাক ছাড়ছে। ভদ্রলোকের দু-হাতের কনুই পর্যন্ত কুচো-কুচো খড় লেগে আছে। মেজোমামাকে দেখেই বললেন, ‘আরেব্বাবা, কী সৌভাগ্য!’ মেজোবাবু যে।’

‘হরিদা, নিমন্ত্রণ করতে এলুম। আগামী পয়লা আষাঢ় দাদার শুভ জন্মদিন।’

‘বাঃ বাঃ, ডাক্তারবাবুর জন্মদিন! নিশ্চয় যাব। সপরিবারে, সবান্ধবে।’

‘হরিদা, নিমন্ত্রণ আপনাকে নয়, আপনার তিনটে গোরুকে।’

‘অ্যাঁ, সে আবার কী?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, দুপুরবেলা আপনার গোরু তিনটিকে বেশ সাজিয়ে-গুজিয়ে অনুগ্রহ করে নিয়ে আসবেন। মধ্যাহ্ন-ভোজনের নিমন্ত্রণ রইল। বলেন তো গোয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথামত ওদেরও বলে যাই।’

‘মানুষের ভাষা যে ওরা বুঝবে না মেজোবাবু!’

‘আপনি তাহলে ওদের বলে দেবেন। চিঠির তলায় অবশ্য লেখাই আছে, পত্রের দ্বারা নিমন্ত্রণের ত্রুটি মার্জনীয়। আপনি তাহলে ঠিক সময়ে ওদের নিয়ে যাবেন, কেমন?’

‘আমার গোরু তিনটি মেজোবাবু ভিন-জাতের। একটু ভালো খায়।’

‘কী খায় হরিদা?’

‘পাঁচ কেজি ছোলা এক-একজন…।’

‘পেট ছেড়ে দেবে।’

‘আজ্ঞে না, ওইটাই ওদের খোরাক, সম-পরিমাণ খোল-ভুসি আর খড়ের কুচো, এবেলা-ওবেলা মিলিয়ে এক ডজন ভিটামিন ট্যাবলেট।’

‘অ্যাঁ, বলেন কী? মরে যাবে যে।’

‘আপনি আপনার পেটের মাপে দেখছেন মেজোবাবু। গোরুর পেট তো পেট নয়, জালা। বিদেশী গোরু মেজোবাবু, খোরাকটি ঠিক রাখলে তবেই না দুধ ছাড়বে! এবেলা-ওবেলা-ষোল-সতের কেজি।’

‘এই সাংঘাতিক খোরাক ম্যানেজ করেন কী করে?’

‘দুধ বেচে মেজোবাবু।’

‘আচ্ছা চলি তাহলে—’ বলে মেজোবাবু আমার হাতে টান মারলেন। উৎসাহ যেন মরে এসেছে। শ্যামল সাঁপুই বাড়ির রকে বসে কড়রমড়র করে লেড়ো বিস্কুট দিয়ে চুমুকে চমুকে চা খাচ্ছিল। মেজোমামা জিগ্যেস করলেন, ‘শ্যামল, তোমার কটা গোরু!’

‘সে তো একবার আমি বলে দিয়েছি, আবার কেন?’

‘কাকে বলেছ?’

‘কেন, ওই যে সরকারের লোক এসেছিল, কী বললে—সেনসাস না কী হচ্ছে। পশুগণনা।’

‘আমি গণনা করতে আসিনি। নেমন্তন্ন করতে এসেছি। দাদার জন্মদিনে তোমার গোরুদের মধ্যাহ্ন-ভোজনের জন্যে আমন্ত্রণ জানাতে এসেছি।’

শ্যামল সাঁপুই হেসেই অস্থির। ভাবলে আমরা পাগলা হয়ে গেছি। ‘এক-আধটা গোরু! আমার সাত-সাতটা গোরু। সব কটাকে নিয়ে যাব? দুটো বাছুরও আছে!’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সপরিবারে, সবান্ধবে যাবে।’

রাত দশটার সময় ক্লান্ত হয়ে আমরা বাড়ি ফিরে এলুম। বড়মামা ডিসপেনসারি বন্ধ করে ছোট ছাদে বসে বাতাস সেবন করছিলেন। আর গুনগুন করে গান গাইছিলেন—’নেচে নেচে আয় মা শ্যামা—’

মেজোমামা ধপাস করে বেতের চেয়ারে বসে বুকপকেট থেকে নোটখাতা বের করে, বিড়বিড় করে যোগ করতে শুরু করলেন, ‘একশো-তিন। বুঝলে বড়দা।’

‘আমি যে তোর সঙ্গে যাব…অ্যাঁ, কী বললি?’

‘হাণ্ড্রেড থ্রি, দিশি, বিলিতি মিলিয়ে। ধরে নাও শ-খানেক গোরু আসবে। ইয়া-ইয়া সব চেহারা। খোরাক শুনলে তুমি লাফিয়ে উঠবে।’

‘ভালোই তো, ভালোই তো। পেটপুরে সব খাওয়াব।’

‘খোরাক শুনবে? পার হেড পাঁচ কেজি ছোলা, সম-পরিমাণ খোল-ভুসি, ছোলার চুনি, কুচো বিচলি, ভেলি গুড়—আখের গুড় হলেই ভালো হয়। বারোশো ভিটামিন ট্যাবলেট।’

‘হ্যাঁ, কোথা থেকে শুনে এলি। এসব চালিয়াতির কথা! মানুষই দু’বেলা খেতে পায় না, গোরু খাবে ছোলা, ভিটামিন ট্যাবলেট! এরপর বলবি, ছাগলে রাবড়ি খাচ্ছে।’

‘যাদের গোরু তারা বলছে। আমি গোরুর কী জানি বল? একজন বললেন, আমার গোরু আধ মাঠ কচি দুব্বো খায়, তা না হলে কনস্টিপেশান হয়।’

‘ওসব চালের কথা, রাজনীতি করছে রে মেজো। আমাদের জব্দ করতে চায়। যে যাই বলুক, আমরা আমাদের মেনু অনুসারে খাওয়াব।’

‘তা হয় না বড়দা। মানুষ হলে হত। লুচি, ছোলার ডাল, মাছের কালিয়া, পাঁপড়ভাজা। পশুদের এক-এক শ্রেণীর এক-এক প্রকার খাদ্য। যার যা খাবার তাকে তো তা দিতে হবে। কুকুরকে আলোচাল দিলে খাবে? ছাগলকে তার নিজের মাংস দিলে ছোঁবে? অশান্তি হয়ে যাবে বড়দা।’

‘তা হলে তাই হবে। ছোলা কত লাগবে?’

‘ধরো, ছশো কেজি। ছশো কেজি খোল, ভুসি, ছোলার চুনি, একশো কেজি ভেলি। বাইশটা বড় ছাগল আর বিয়াল্লিশটা ছানা আসবে। কুকুর আসবে ষাট-সত্তর, বিলিতি আরও দশ-বারোটা। ছটা তার মধ্যে অ্যালসেশিয়ান। বাকি ছটা স্মিৎস। দু’দল, না তিনদল। তিনদলের তিন রকম ব্যবস্থা। স্পিৎস খাবে কিমা। অ্যালসেশিয়ান খাবে খাবা-খাবা মাংস, লেড়ি খাবে হাড়গোড়, ছাঁচছুট। ছাগলের জন্যে চাই পুরো একটা কাঁঠালগাছ আর বটগাছ।’

বড়মামা বেশ যেন নার্ভাস হয়ে গেলেন, ‘মেজো, খরচের কথা বাদ দে। সে যা হবার হবে। কিন্তু জায়গা লাগবে বিশাল।’

‘ম্যানেজ করার জন্যে অনেক লোকও লাগবে। শ-খানেক কাঠের ডাবর চাই, গোরুর জন্যে।’

‘আচ্ছা মেজো, আজকাল তো সবাই খাওয়াবার ভার ক্যাটারারকে দিয়ে দেয়?’

‘সে মানুষ হলে হতো! পশুদের জন্যে ক্যাটারার নেই, সাপ্লায়ার আছে।’

‘কাল ভেটেরিনারি হসপিট্যালের ডাঃ সাহানাকে একবার ফোন করব। দেখি উনি কীভাবে সাহায্য করতে পারেন।’

সাড়ে এগারোটার সময় সভা ভেঙে গেল।

বড়মামা সকালের চায়ের চিনি গোলাতে গোলাতে বললেন, ‘ডিফিট, গ্রেট ডিফিট।’

মেজোমামা এক চুমুক চা খেয়ে বললেন, ‘আমি সারারাত ভেবে দেখলুম, ব্যাপারটা অশ্বমেধ যজ্ঞের মতো হয়ে যাবে। সামলানো যাবে না। লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে পারে। বিশাল জায়গা চাই, বহু লোকজন চাই। আইডিয়াটা ভালো ছিল। কাজে লাগানো গেল না, এই যা দুঃখ।’

মাসিমা বললেন, ‘যাক বাবা, বাঁচা গেছে। কদিন ধরে ভগবানকে আমি কম ডেকেছি! যাই, পুজোটা দিয়ে আসি, মানত করেছিলুম।’

মেজোমামা বললেন, ‘ঝট করে আর-একটা নিমন্ত্রণপত্র ছাপিয়ে ফেলি। আপনার গৃহপালিত পশু নয়, সপরিবারে আপনারই নিমন্ত্রণ। ভাগনে?’

‘আজ্ঞে।’

‘ঝট করে দুলাইন লিখে নাও। সবিনয় নিবেদন, অনিবার্য কারণে আগামী পয়লা আষাঢ়, আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা ডাঃ সুধাংশু মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত কর্মসূচীর কিঞ্চিৎ পরিবর্তন হয়েছে। পশুসেবার পরিবর্তে সন্ধ্যায় এক প্রীতিভোজের আয়োজন করা হয়েছে। উক্ত প্রীতিভোজে আপনার সবান্ধবে উপস্থিতি কামনা করি। ভবদীয়।’

বড়মামা খুঁতখুঁত করে বললেন, ‘অ্যাঃ, ব্যাপারটা গেঁজে গেল রে মেজো।’

আজ পয়লা আষাঢ়।

ভোর পাঁচটা থেকে সানাই শুরু হয়েছে। ভোরের সুর বাজছে। বাইরের বিশাল মণ্ডপ ফুলে-ফুলময়। কাল রাতে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল। আজ একেবারে ঝলমলে রোদ। পুরোহিতমশাই এসে গেছেন। পুজোপাঠ, হোম-অর্চনা, শুরু হল বলে। বড়মামার ম্লান হয়ে গেছে। পরনে পট্টবস্ত্র, গায়ে উত্তরীয়। রূপ একেবারে খুলে গেছে। কাল থেকে চিঠি আর টেলিগ্রাম আসতে শুরু করেছে, দূর-দূরান্ত থেকে। সকলেই দীর্ঘজীবন কামনা করেছেন।

মাসিমা পুজোর আয়োজন করেছেন। ভোরবেলাতেই বাজার এসে গেছে। বড় বড় মাছ শুয়ে আছে রকের একপাশে। পুঁচকে একটা বেড়াল মাছের আকার দেখে ভয়ে থমকে পড়েছে দেয়ালের একপাশে।

হালুইকর ব্রাহ্মণ হাতা, খুন্তি, ঝাঝরি, লটবহর নিয়ে এসে গেছেন। অ্যাসিসটেন্টরা উনুনে আগুন দিয়েছেন। বাগানের দিকের আকাশে ধোঁয়া উঠছে পাকিয়ে পাকিয়ে।

ইলেকট্রিকের লোক এসে টুনি ঝোলাতে শুরু করেছে। তিনজন ঝাড়ুদার খচরমচর করে ঝাড়ু দিতে শুরু করেছে চারপাশে। আজ সব ছবির মতো হয়ে যাবে।

বেলার দিকে ফুলের তোড়া আসতে শুরু করল। হাসপাতাল থেকে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। বড়মামার হাসি-হাসি মুখ। ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কপালে চন্দনের টিপ। দুপুরে মাছের মুড়ো দিয়ে ভাত খাবেন। ছোট্ট একবাটি ঘি খাবেন চুক করে চুমুক দিয়ে। সানাই মাঝে-মাঝে থামছে, মাঝে-মাঝে বেজে উঠছে। রান্নার শব্দ ভেসে আসছে। বাতাসে সুবাস ছড়াচ্ছে।

সন্ধে হতে-না-হতেই পুটুস-পুটুস করে আলোর মালা জ্বলে উঠল চারপাশে। তেমনি গুমোট গরম নেই। ভিজে-ভিজে বাতাস বইছে। জুঁই, বেল, রজনীগন্ধার সুবাস। একে একে নিমন্ত্রিতরা আসতে শুরু করলেন। সাড়ে সাতটার মধ্যে প্যান্ডেল কানায় কানায় ভরে গেল। বড়মামা, মেজোমামা অভ্যর্থনায় ব্যস্ত। ‘আসুন, আসুন নমস্কার, নমস্কার’ এই চলছে সন্ধে থেকে। কারুর হাতে চা, কারুর হাতে ঠান্ডা জলের বোতল। আমি বিবরণ করে চলছি ‘পশুপ্রেমী বড়দা।’ জাফরানি রঙের মলাট। গোটা গোটা অক্ষর। কেউ পড়ছেন। কেউ মুড়ে রাখছেন।

টেবিলে টেবিলে পাতা পড়ে গেল। পাশ দিয়ে গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে খাবার ছুটছে। রাধাবল্লভী, ফিশফ্রাই। বিরিয়ানি গন্ধে পাগল করে দিচ্ছে। বড়মামা আর মেজোমামা হাতজোড় করে সকলকে বলতে লাগলেন, ‘এবার আপনারা অনুগ্রহ করে আহারে বসুন।’

সভা একেবারে পরিপূর্ণ। কবি করুণাকিরণ মাঝের একটি আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘শুরুর আগে আমি একটি কবিতা পড়তে চাই, ”আজি তব জন্মদিনে, হে রাখাল/বীণা তব বাজে/জীবনের জয়গানে/থেমে থেমে সেবার মূর্তি তুমি/তোমারে চুমি শতবর্ষ পার করে/হেসে হেসে/তুমি যবে যাবে অমর্ত্যলোকে/অশ্রুজলে সিক্ত হবে/রিক্ত ধরণী।”’

ফটাফট ফটাফট হাততালি।

হঠাৎ কোণের দিকে এক ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। বাজখাঁই গলায় বললেন, ‘ওয়াক আউট। আপনারা সকলে প্রতিবাদে এখুনি এই সভা পরিত্যাগ করুন।’

‘কেন? কেন?’ সমবেত কণ্ঠে প্রশ্ন।

‘কেন? আপনারা এই পুস্তিকাটা একবার পাতা উলটে দেখেছেন?’

‘কী আছে, কী আছে?’

‘এই যত কিছু আয়োজন, সবই আমাদের অপমানের কৌশল। এক জায়গায় জড়ো করে পাইকারি দরে জুতো মারার বড়লোকি চাল।’

‘কেন? কেন?’

‘একটা অংশ পড়ে শোনালেই বুঝতে পারবেন আপনারা। পড়ছি, শুনুন।

শিবজ্ঞানে, জীব-সেবা যার জীবনের ব্রত, শৈশব থেকেই পশুপ্রেমে সে উতলা। গোরু, মোষ, ভেড়া, ছাগল, গাধা, কুকুর, পাখি এদের নিয়ে জীবন কাটাতে পারলে আমার পশুপ্রেমী বড়দা আর কিছুই চায় না। মানবদরদি আমরা দেখেছি, এমন পশুপ্রেমী আমাদের দেশে কদাচিৎ চোখে পড়ে।

সেই পশুপ্রেমী বড়দার অভিনব জন্মদিনের, অভিনব আয়োজন এই পশুভোজসভা। একদিকে গোরু, আর একদিকে ছাগল, অন্যদিকে পাল-পাল কুকুর সেবা করছে, আর তারই জয়গান গাইছে সমস্বরে।’

‘অপমান, অপমান!’ সভা চিৎকার করে উঠল।

মেজোমামা চেঁচাচ্ছেন, ‘ছি ছি, ভুল বুঝবেন না, প্রোগ্রাম চেঞ্জ করেছে, প্রোগ্রাম চেঞ্জ করেছে।’

বড়মামা বলছেন, ‘এ কী বলছেন, এ কী বলছেন, আমি কখনও অপমান করতে পারি! লেখাটা ভুল হাতে পড়েছে।’

কে কার কথা শোনে! সব লণ্ডভণ্ড করে নিমন্ত্রিতরা বেরিয়ে গেলেন। সানাই তখনও বাজছে, করুণ সুরে। রাধাবল্লভীর মহাশ্মশানে দুই মামা হাঁ করে দাঁড়িয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *