নিজের চোখে না দেখলে

নিজের চোখে না দেখলে

একদিন বিকেলবেলা পার্কে হাঁটতে গিয়ে রামবাবু দেখলেন, বেঞ্চের ওপর শ্যামবাবু আগে থেকেই বসে আছেন৷ রামবাবু খুশি হয়ে তাঁর পাশে বসে পড়ে ভুরু কুঁচকে বললেন—

‘বুঝলে শ্যাম, সকাল থেকে মাথাটা বিগড়ে আছে৷’

‘বিগড়ে? কেন বল তো?’

‘আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, একটা ভূত আমার পায়ের কাছে বসে হাসছে৷ আচ্ছা তুমি বল, ভূত কি হাসতে পারে?’

‘ভূত বলেই কিছু হয় না তার আবার হাসি! হুঁহ…’ হাসতে হাসতে কথাটা বলে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন শ্যামবাবু৷

ভূতে যাঁরা বিশ্বাস করেন না, তাঁদের একটা বড় যুক্তি হল যে তাঁরা নিজের চোখে ভূত দেখেননি৷ এবং, যাঁরা দেখেছেন বলে দাবি করেন, তাঁরাও নাকি ডাঁহা মিথ্যেবাদী৷ নিজের চোখে না দেখে তাঁরা ভূত ভগবান টিনটিন ফেলুদা রামধনু কিছুতেই বিশ্বাস করেন না৷ আমরা অবশ্য এতদিন বিশ্বাস-অবিশ্বাস এই দু-নৌকাতেই পা দিয়ে ছিলাম; সেই নৌকাতে চড়েই আজ আমরা পুরনো এক হোটেলে হাজির হব৷ পরিত্যক্ত নয় কিন্তু— রীতিমতো জনসমাগম হয় সেখানে৷ শুধু আঠারো নম্বর ঘরখানায় কেউ যায় না৷

কেন?

‘আপনার পেশাটা কী বললেন যেন? প্যারানরম্যাল ইনভেস্টেগেটার?’

‘উঁহু… প্যারানরম্যাল ডিবাঙ্কার৷’

‘তার মানে?’

‘মানে পৃথিবীর যেখানে যত হানাবাড়ি, পোড়ো বাড়ি, ভূতের বাড়ি আছে তাদেরকে ভুয়ো প্রমাণ করাই আমার পেশা৷ চাবিটা দিন৷’

‘ভারী শৌখিন পেশা কিন্তু৷ পেট চলে কী করে?’

‘অত হেজিয়ে কী লাভ বলুন তো? চাবিটা দিন৷’

লোকটা এবার বাঁকা হাসি হেসে বলল, ‘আমাদের হোটেলেও কি ভূত খুঁজতে এসেছেন নাকি?’

আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘দেখুন ভূত আমি খুঁজি না৷ বরঞ্চ ভূত যে নেই সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিই বারবার৷’

ম্যানেজার আগের মতোই হাসিমুখে চাবির র‌্যাক থেকে একটা চাবি নামিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ভূত-প্রেত নিয়ে যা করার করুন, আপত্তি নেই৷ সকালে ঘর ছেড়ে দিলেই হল৷’

আমি মাথা নেড়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালাম৷ লোকটা টেবিল ছেড়ে বেরোতে যাচ্ছিল৷ কিছু যেন মনে করে থেমে গিয়ে বলল, ‘একটা কথা বলা হয়নি৷’ ম্যানেজারের গলাটা কেমন যেন ধরে এসেছে৷ পিছন ঘুরে বললাম, ‘কী বলুন তো?’

ভদ্রলোক একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘এমনি হলে বলার দরকার পড়ত না৷ তবে ভূতের কথা উঠলো কিনা—তাই বলছি৷ এ হোটেলের আঠেরো নম্বর ঘরটা রাতের দিকে খোলা হয় না৷’

‘কেন বলুন তো?’

আমার মনে একটা আশার আলো ফুটে উঠছে৷ একটা ভূতের বাড়ির খোঁজেই এখানে এসেছিলাম৷ কিন্তু এসে দেখলাম সে বাড়িখানা মাসখানেক আগে বিক্রি হয়ে গেছে৷ পুরনো ইট-পাটকেল ভেঙেচুরে রিনোভেসন শুরু হয়েছে৷ হতাশ হয়ে ফেরার ট্রেন ধরব কিন্তু স্টেশনে পৌঁছে দেখলাম কী কারণে যেন ট্রেনও বাতিল হয়ে গেছে৷ গোদের উপর বিষফোঁড়া৷ তাই আজকের রাতটা এখানে কাটিয়ে যাওয়ার মতো হোটেল খুঁজছিলাম৷ আপাতত ম্যানেজারের কথা শুনে মনে হচ্ছে আঠেরো নম্বর ঘরখানাকে ঘিরেও ভৌতিক কিছু গল্পগাথা চালু আছে৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন? ঘরে ভূত আছে বুঝি?’

‘তা জানি না৷ আমি নিজে কিছু দেখিনি৷ কিন্তু এখানকার কর্মচারীরা ঘরটাকে এড়িয়ে চলে৷’

আমি হাতের চাবিটার উপর দৃষ্টি বুলিয়ে দেখলাম তার উপর ষোলো লেখা আছে৷ অর্থাৎ আঠেরো নম্বর ঘর আমার কাছে-পিঠেই৷

‘কেন? কী আছে ওঘরে?’ আমি সিঁড়ি দিয়ে একধাপ নেমে এলাম৷

‘কী আছে বলতে পারব না কিন্তু সচরাচর কেউ যেতে চায় না ওদিকে৷’

‘মানে ভূত জাতীয় কিছু আছে বলছেন?’

‘বললাম তো, ভূত আছে কি না জানি না৷ তবে একটা ছবি আছে৷’

‘ছবি?!’

‘হ্যাঁ৷ অনেক পুরনো বাঁধানো একটা ছবি দেওয়ালে ঝুলছে৷ আমি এসে থেকে সরাতে পারিনি সেটাকে৷’

‘সরাতে পারেননি মানে?

‘মানে যেদিন ছুঁড়ে ফেলে দেবেন তার পরদিন ঘর খুলে দেখবেন সেটা আবার আগের যায়গায় উঠে গিয়েছে৷’

‘এ কী হুজ্জতি রে বাবা!’ আমি মনে-মনে বললাম৷ মুখে বললাম, ‘তা একখানা ছবির জন্যে আপনার লোকেরা ঘরে ঢুকতে চায় না?’

‘তা নয়৷ তবে একবার গুজব রটে গেলে বুঝতেই পারেন… লেবার ক্লাস লোকজন, একটু সুপারস্টিসাস৷’

‘সুপারস্টিসাস লোকজন না হলে কেউ ভূতে বিশ্বাস করে না৷ বেশ! আজ রাতে আমিই দেখছি আপনার ভূত ছাড়ানো যায় কি না৷’

আমার কথা শুনে ম্যানেজার হাঁ-হাঁ করে উঠলেন, ‘সর্বনাশ! ও কাজটা করবেন না৷’

‘কেন?’

‘একান্তই যদি ওসবে বিশ্বাস না করেন তবে শুনে রাখুন, কিছু রিনোভেসনের কাজ চলছে৷ সিমেন্ট, বালি-টালি ছড়িয়ে আছে৷ বারান্দাটা ভেঙে গেছে৷ না যাওয়াই ভালো৷’

‘বেশ৷ মনে থাকবে৷’

চাবিটা হাতে দোলাতে-দোলাতে আমি দোতলায় উঠে এলাম৷ নীচের তুলনায় এখানে আলো বেশ কম৷ অন্ধকারের কার্পেটে ঢেকে আছে লনের মেঝেটা৷ সেই অন্ধকার চাদরে পা রেখে আমি ধীরে সুস্থে এগিয়ে এলাম৷ ষোলো নম্বর ঘরটায় আমি বহাল হয়েছি৷ সেটার দিকে এগিয়ে যেতেই আঠেরো নম্বরটা চোখে পড়ল৷ দরজার নীচ দিয়ে সত্যি খানিকটা সিমেন্ট আর বালি বের হয়ে এসেছে৷ দরজাটার আলাদা করে কোনও বিশেষত্ব নেই৷ কৌতূহলবশত সেটার উপরে হাত রাখলাম আমি৷ হালকা ঠেলা দিলাম৷ বাইরে থেকে তালা দিয়ে আঁটসাঁট করে বন্ধ করা আছে৷ হঠাৎ কী খেয়াল হতে আঙুলের ডগা দিয়ে আলগা টোকা দিলাম দরজার উপরে৷ তারপর মনে-মনে হেসে পাশের ঘরটা ছেড়ে এগিয়ে এসে দাঁড়ালাম আমার ষোলো নম্বর ঘরে৷ চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে এলাম৷ আর সাথে-সাথে মনে হল টকটক করে একটা শব্দ আসছে কানে৷ আচমকা শব্দটা কানে আসতে মারাত্মক চমকে উঠেছিলাম৷ চারপাশে তাকিয়ে লনের উপরে আর কাউকে দেখতে পেলাম না৷ ভালো করে কান পাততে আমার নিজের কানকেই সন্দেহ হতে লাগল৷ টোকাটা আসছে আঠেরো নম্বর ঘরের দরজার ভিতর থেকে৷ আমি সাহসে ভর করে সেদিকে এক পা এগিয়ে যেতেই থেমে গেল আওয়াজটা৷ আমি ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ সেইভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম৷ কানে কি ভুল শুনলাম এইমাত্র? হতেই পারে৷ ঘরে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম৷

ভূতের ভয়টা আমার ছোট থেকেই নেই৷ শুধু ভূত কেন? অবাস্তব কোনও কিছুতেই বিশ্বাস করাটা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ৷ আমার বয়সি ছেলেরা যে বয়সে মায়ের কোলে শুয়ে স্কন্দকাটা, নররাক্ষস কী জলপরীদের গল্প শুনত সেই বয়সে আমি তিনখানা খবরের কাগজ খুঁটিয়ে পড়ে ফেলতাম৷ রূপকথা যে একেবারে পড়িনি তা নয় কিন্তু পড়ে মনে হয়েছে সে সবই তৃতীয় শ্রেণির লেখকদের অল্প খেটে বেশি পয়সা রোজগার করার বাহানা৷ আরে পড়তে হয় চার্লস ডিকেন্স কি শরৎচন্দ্র পড়৷ তা নয় যত গাঁজাখুরি আজগুবি গালগল্প৷ আর সেইসব গল্প পড়েই মনের ভিতর ভূতের অন্ধকার জমে ভূত জন্মায়৷ যেমন এই ঢোকার আওয়াজটা৷ ভেবেচিন্তে দেখলাম সেটার নানারকম ব্যাখ্যা হতে পারে৷ এমনকি আমার মনের ভুলও হওয়া সম্ভব৷ এ ঘরের জানলাগুলো ঠেলা দিয়ে খুলে দিলাম৷ বাইরে আশপাশের বাড়িগুলোতে টিমটিমে আলো জ্বলছে৷ দু-একজন মানুষও চোখে পড়ল৷ ঘরের আলো নিভিয়ে ফিরে এসে চেয়ারের উপর গা এলিয়ে দিলাম৷ জানলা দিয়ে বেশ ফুরফুরে তাজা হাওয়া এসে ঢুকছে ঘরে৷ সারাদিনের পরিশ্রমে শরীর ক্লান্ত হয়ে আছে৷ বেশ কিছুক্ষণ সেই ভাবে বসে থাকতে-থাকতে আমার চোখ ভারী হয়ে এল… ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কি না জানি না— হঠাৎ মনে হল খানিক দূর থেকে সেই টোকার আওয়াজটা আসছে৷ ধড়ফড় করে উঠে বসলাম আমি৷ নাঃ, এবার আর দূর থেকে নয়৷ আমারই ঘরের দরজায় কেউ টোকা দিচ্ছে৷ এ অবস্থায় আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে হৃৎপিণ্ডের গতি একটু বেড়ে নিশ্চয়ই যেত৷ কিন্তু আগেই বলেছি, আমি চরম বাস্তববাদী৷ চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার দিকে এগোতে-এগোতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে? কী চাই?’

ওপাশ থেকে ম্যানেজারের গলা ভেসে এল, ‘আমি৷ সব ঠিকঠাক আছে তো?’

আমি হাসলাম৷ ‘আপনি কি ভেবেছিলেন আপনার ভূত এর মধ্যেই আমার ঘাড় মটকেছে?’

‘না৷ এ ঘরটায় সেসব কিছু নেই৷’

‘অন্য ঘরে আছে বলছেন?’

‘আমি কিছুই বলছি না৷ আপনার কিছু না হলেই হল৷’

আমি শুকনো হাসি হেসে বুঝিয়ে দিলাম যে আপাতত আমার কোনও সমস্যাই হচ্ছে না৷ ম্যানেজার খুশি মনে মাথা দুলিয়ে সিঁড়ির রাস্তা ধরলেন৷ যাবার পথে আঠেরো নম্বর ঘরের কাছে গিয়ে একবার চোখ তুলে দরজাটার দিকে তাকিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন৷

আমি মনে-মনে হাসলাম৷ সামান্য একটা গুজব আর কয়েকটা অযৌক্তিক গালগল্প মানুষকে কতটা ভীতু করে তুলতে পারে! কথাটা ভাবতেই আমাকে নেশায় চেপে ধরল৷ মনে হল, এ হোটেলে যখন একটা রাত কাটাবই, তখন ১৮ নম্বর ঘরটা একবার না দেখে গেলে চলবে না৷ ভূতুড়ে ছবির সমাধান যদি করতে পারি তবে তো আর কথাই নেই৷ কিন্তু সে ঘরের দরজা তো বন্ধ৷ এ ঘরের চাবি দিয়ে সে দরজা তো আর খুলবে না! তাও ঘরের ভিতর ঢুকে একটা টর্চ হাতে নিয়ে আমি সেদিকে এগিয়ে গেলাম৷ এতক্ষণে বাড়ির সব আলো নিভে গেছে৷ চারিদিক আশ্চর্যরকম নিস্তব্ধ শোনাচ্ছে৷ অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধে বুকের ভিতরটা কেমন যেন ছমছম করতে লাগল৷ আঠেরো নম্বর ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই অবাক হয়ে গেলাম৷

কী আশ্চর্য! একটু আগে নিজে দেখে গেছি ঘরের দরজা বাইরে থেকে তালা দিয়ে বন্ধ করা৷ অথচ এখন একটা দিকে ফাঁক হয়ে বেশ খানিকটা খোলা আছে দরজাটা৷ তবে কি ম্যানেজারই আসার সময় খুলেছে সেটা? কিন্তু খামোখা রাত-বিরেতে দরজা খুলতে যাবেই বা কেন! যাই হোক সাত- পাঁচ না ভেবে ঘরের ভিতরে ঢুকে এলাম আমি৷ এবং ঢুকতেই পুরনো সিমেন্ট আর ভাঙা ইটের গন্ধ নাকে এল৷ ম্যানেজার তার মানে মিথ্যে বলেনি৷ সত্যি ঘরটায় রিনোভেসনের কাজ চলেছে৷ চাঁদ আর টর্চের আলোয় যতদূর দেখা যায় তাতে বুঝলাম আমার ঘরটার সাথে এটার বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই৷ চোখে পড়ল ঘরটার লাগোয়া একখানা বারান্দা আছে৷ সেটা মাঝখান থেকে ভেঙে পড়ে ইট বেরিয়ে পড়েছে৷ দেওয়ালের গায়ে কোনওরকমে ঝুলে আছে বারান্দাটা৷ ভয় হল, বেখেয়ালে কেউ সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে গোটাটাই হয়তো ভেঙে নীচে পড়বে৷ টর্চটা এদিক-ওদিক ঘোরাতে আচমকাই একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়তে আমি থমকে গেলাম৷ দেওয়ালের গায়ে ঝুলন্ত একটা বাঁধানো ফটোগ্রাফ৷ এটার কথাই তবে বলছিল ম্যানেজার৷ টর্চের আলো সেটার উপর রেখে আমি ধীরে-সুস্থে সেদিকে এগিয়ে গেলাম৷

এই তবে আঠেরো নম্বর ঘর! যাকে এ হোটেলের স্টাফ থেকে ম্যানেজার অবধি এড়িয়ে চলে! দেওয়ালে একখানা ছবি ছাড়া আর সন্দেহজনক কিছু নেই পর্যন্ত৷ আমার বুক ফুঁড়ে কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল৷

ছবিটা অল্পবয়সি কোনও মেয়ের৷ একসময় এ ঘরের কোনও বাসিন্দাই হয়তো লাগিয়েছিল ছবিখানা৷ মেয়েটা দেখতে কিন্তু ভারী মিষ্টি৷ বাঁকানো টিয়াপাখির মতো নাক, কোঁকড়ানো চুল, মুখের বেশিরভাগটাতেই সিমেন্ট আর ধুলো জমাট বেঁধে ঢাকা পড়ে গেছে৷ খালি তার ফাঁক দিয়ে দুটো গভীর বড়-সড় চোখ দেখা যাচ্ছে৷ মনে হল একটা ভারী হাওয়ার স্রোত আমার পিঠের পিছনে জমাট বেঁধে আছে৷ মানুষের আঙুলের মতো করেই আমাকে স্পর্শ করতে লাগল তারা৷ আমার মুখ দিয়ে আচমকাই একটা শব্দ বেরিয়ে এল, ‘কে….?’

পিছন ফিরে কাউকে দেখতে পেলাম না৷ ঘরের দরজাটা আগের মতোই খোলা৷ চাঁদের আলো ভিতরে এসে পড়ে রূপালি আলোছায়ায় ঢেকে রেখেছে ঘরটাকে৷ এছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না৷ আমার সামনে তাকিয়ে ছবিটা দেওয়াল থেকে খুলে নিলাম আমি৷ আংটা থেকে সহজেই উঠে এল সেটা৷ যতটা পারা যায় ধুলো ঝেড়ে নিলাম৷

ঘরের দরজাটা আগের মতোই খোলা রাখলাম৷ যে খুলেছে সেই দরকার হলে বন্ধ করে নেবে৷ আমার কি ঠেকা পড়েছে?

ছবিটা হাতে ঝুলিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম৷ টেবিলের উপরে রেখে দিলাম ছবিখানা৷ এখন দেখা যাক কখন আবার দেওয়ালে গিয়ে ওঠে সেটা৷ ভূত বলে যে কিছু নেই তা আমি বহুদিন আগে থেকেই জানি৷ তা সত্ত্বেও প্রতিবার কথাটা প্রমাণ করতে পেরে অদ্ভুত এক স্বস্তি পাই আমি৷ এই মুহূর্তে আবার সেই জয়ের আনন্দে ভরে গেছে আমার মনটা৷ খুব একচোট হেসে নিলাম৷ ঘরটার সামনে দিয়ে যাবার সময় ম্যানেজারের মুখটার কথা খুব মনে পড়ছে৷ আচ্ছা আহাম্মক লোকটা৷ ছবিটার দিকে চোখ পড়লে অদ্ভুত কয়েকটা প্রশ্ন ভেসে উঠছে মনে৷ কে ঝুলিয়েছিল সেটা? সরিয়েই বা নেওয়া হল না কেন? বন্ধ চোখের পাতায় তার ধুলোয় ঢাকা মুখের আড়াল থেকে চোখটা যেন এখনও তাকিয়ে আছে আমার দিকে৷

‘এই ঘুমাচ্ছিস কেন? ওঠ, ওঠ…’

ভাবতে-ভাবতে কখন ঘুমে ঢলে পড়েছিলাম মনে নেই৷ আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেল৷ আর সাথে-সাথে অদ্ভুত একটা ভয়ে আমার বুকটা শিউরে উঠল৷ মহিলা কণ্ঠ৷ তার থেকেও বড় কথা হল, গলাটা এসেছে ঘরের ভিতর থেকে৷ স্পষ্ট মনে আছে ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে শুয়েছিলাম৷ এর কী ব্যাখ্যা হতে পারে৷ চোখ খুলে সামনে তাকাতেই আমার বুকের ভিতর ভয়টা কয়েকগুণ বেড়ে গেল৷ জানলার ফাঁক গলে একফালি জ্যোৎস্না ঘরের ভিতর এসে পড়েছে৷ সেই আলোতে দেখতে পেলাম মেয়েটাকে৷ তবে অচেনা নয়৷ একটু আগে এর মুখই দেখেছিলাম আঠেরো নম্বর ঘরের ছবিটায়৷ কোনওরকমে কোমরে ভর দিয়ে উঠে হাতের সামনে টর্চটা না পেয়ে দেশলাই জ্বালানোর চেষ্টা করলাম৷ কিন্তু সেটা জ্বলল না কিছুতেই৷ এবার হালকা হাসির সাথে গলাটা আবার শোনা গেল, ‘…ওটা জ্বলবে না৷ আমি সামনে থাকলে আগুন জ্বলে না৷’

আমার হাত থেকে দেশলাইয়ের বাক্স ছিটকে পড়ল৷ কাঁপা-কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলাম, ‘ক… কে… তুমি কে?’

‘আমি ভূত৷’

‘ভূত! সে কী!’

‘তো আমার মুখ দেখে কি মনে হচ্ছে আমি বেঁচে আছি?’

আমি ভয়ের চোটে তোতলাতে লাগলাম, ‘মু… মুখ দেখে কি বো…

বোঝা যায় কে বেঁচে আছে আর কে… নেই?’

‘তাই নাকি? তো কী দেখে বোঝা যায়?’

‘আজ পর্যন্ত কেউ তো দেখেনি তাই কোথাও লেখা নেই৷’

‘অ… তা জানি না৷ মোট কথা আমি ভূত৷’

‘কিন্তু আমি যে বিশ্বাস করি না৷’

‘চোখের সামনে দেখেও বিশ্বাস হচ্ছে না!’

আমার মাথার ভিতর সব কিছু আস্তে-আস্তে গুলিয়ে যাচ্ছে৷ এই তবে আঠেরো নম্বর ঘরের ভূত? নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি? বুঝলাম এই অবস্থায় সাহস হারালে চলবে না৷ সে যখন প্রথম থেকেই তুইতোকারি শুরু করেছে তখন আমারও ভদ্রতা দেখিয়ে কাজ নেই৷ গলায় জোর এনে বললাম, ‘তা তুই মরলি কী করে?’

আমার প্রশ্নটা কানে যেতেই তার পাংশু মুখে হাসি ফুটে উঠল, ‘সে অনেক কথা৷ শুনবি?’

তার উৎসাহ মোটে বাড়তে দেওয়া উচিত নয়৷ ভূতে আমি বিশ্বাস করি না, করবও না কোনওদিন৷ এ ঘটনাটা যদি সত্যি ঘটে থাকে তাহলে আমার সারাজীবন ধরে গড়ে তোলা অবিশ্বাস এক মুহূর্তে ভেঙে পড়বে৷ সে ব্যাপারটা আমার কাছে অনেকটা জোর করে ধর্মান্তর করার মতোই৷ তীব্র বেগে মাথা নেড়ে বললাম, ‘না, না৷ আমি কিছু শুনতে চাই না৷ তুই নিজের ঘরে যা৷’

‘ধুর৷ এক ঘরে কতদিন আটকে থাকতে ভালো লাগে?’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘ভূতেরা আবার আটকে থাকে নাকি! অদৃশ্য হয়ে যেখানে খুশি যেতে পারে তো?’

‘উঁহু… মৃত্যুর পর কোনও একটা জিনিসকে ঘিরে থাকতে হয় আত্মাকে৷ আমার আত্মা ওই ছবিটাকে ঘিরে আছে৷ ওটার থেকে বেশি দূরে যেতে পারি না৷’

আমি একটু ভেবে দেখলাম মেয়েটার কপালটা সত্যিই খারাপ৷ কতগুলো আধবুড়ো রাজমিস্ত্রি আর চুন-বালির মধ্যে কাঁহাতক পড়ে থাকতে ভালো লাগে মানুষের৷ মেয়েটার যা বয়স তাতে এতদিনে তার কলেজ যাবার কথা৷ আমি গলা নরম করে বললাম, ‘তা সারাদিন কী করিস ও ঘরে?’

সে আমার বিছানার একপাশে বসে পড়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে উদাস কণ্ঠে বলল, ‘সারা সকাল ঘরেরই মেঝেতে শুয়ে ঘুমাই আর রাতে বারান্দায় গিয়ে বসি৷’

‘ওই ভাঙা বারান্দায়? সর্বনাশ!’

‘কেন? সর্বনাশের কী আছে?’

‘যদি ভেঙে পড়ে?’

‘ভেঙেই তো পড়েছিল৷ আর তাতেই তো আমি…’ আচমকা থেমে গিয়ে মেয়েটা কথা শেষ করল না৷ আমি বুঝলাম, কোনওভাবে বারান্দার রেলিং ভেঙে নীচে পড়েই সে ইহলোক ত্যাগ করেছে৷

অবশ্য সে যে সত্যিকারের ভূত সে নিয়ে আমি এখনও নিশ্চিত নই৷ মুখচোখ সাধারণ মানুষের মতোই৷ গলার স্বরেও চন্দ্রবিন্দু নেই৷ শুধু দরজাটা যে কী করে পার হল সেটাই আশ্চর্যের৷

‘তুই আমার ছবিটা খুলেছিস কেন?’

আমি ভাবনায় ডুবে ছিলাম৷ মাথা তুললে বললাম, ‘ছবি? ও… ওটা… সবাই বলছিল ছবিটা নাকি ও ঘর থেকে সরানো যায় না?’

‘কেন সরাবে? আমার ঘর, অমনি বললেই ছেড়ে দেব নাকি?’ বেশ ঝাঁঝের সাথে বলল সে কথাগুলো৷

আমি মাথা দুলিয়ে বললাম, ‘ভূত হওয়ার পর আর মাটি কামড়ে পড়ে থাকলে চলে না৷ জায়গা ছেড়ে দিতে হয়৷’

‘ছেড়ে তো দিয়েইছি৷ ঘরে অন্য লোক এসে থাকলে আমি কি আপত্তি করেছি?’ অসহায় একটা ভাব ফুটে উঠল তার গলায়৷

‘তাই নাকি? আর রাত-বিরেতে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এসে যদি লোকে দেখে ভাঙা রেলিঙের উপরে সাদা কাপড় পরা ভূত বসে চাঁদের দিকে চেয়ে আছে?’

সে মাথা নামিয়ে নিয়ে বলল, ‘আমি না চাইলে আমাকে দেখা যায় না৷’

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, ‘তা আমাকে দেখা দিলি যে?’

মেয়েটা আচমকা প্রায় কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, ‘কারণ আমার তো কথা বলার কেউ নেই৷’

মনে-মনে হিসেব কষে বুঝলাম মানুষের ঘর আঁকড়ে পড়ে আছে বলে তার ফেলো ভূতেরাও খুব একটা মেশে না তার সাথে৷ একাকীত্বে ভোগা ডিপ্রেসড ভূত৷ বন্ধুবান্ধবের সাথে ফুর্তি করার বয়স এখন৷ তার বদলে বেঘোরে মরে নিভৃতে জীবন কাটাতে হচ্ছে৷ মেয়েটার জন্য মায়াই লাগল আমার৷ বললাম, ‘তা নামটা কী যেন তোর?’

সে আগের মতোই মাথা নামিয়ে ধরা গলায় ধীরে-ধীরে বলল, ‘বেঁচে থাকতে সবাই রিনি বলে ডাকত৷’

আমি বিছানার উপর পা এলিয়ে আরাম করে শুলাম৷ বুকের ভিতরের ভয়টা এতক্ষণে উধাও হয়েছে৷ শুধু মনের এককোণে অস্বস্তি দানা বাঁধছে৷ সত্যি ভূত দেখতে পেলাম তাহলে? এতদিন কি তবে আমার ধারণা ভুল ছিল? নাঃ৷ মেয়েটা সত্যি ভূত কি না যাচাই করে দেখতে হবে৷ আচ্ছা পুরো ব্যাপারটা ম্যানেজারের চাল নয় তো? এখনও সে একইভাবে মাথা নামিয়ে বিছানার একপাশে বসে আছে৷ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তো তুই মরলি কী করে?’

প্রশ্নটা শুনে তার চোখ দুটো আবার চিকচিক করে উঠল, ‘ওই যে বারান্দা ভেঙে নীচে পড়ে৷ আয় তোকে দেখাই৷’

‘আয় মানে? কোথায় যাব?’

‘আমার ঘরে৷’

‘না, না৷ ও ঘরে বড্ড ধুলো৷’

আমার উত্তর শোনার আগেই সে ছুটে গেছে ঘরের বাইরে৷ ভূত হোক না হোক ইতিমধ্যেই আমার ঘাড়ে চেপে বসেছে সে৷ বিছানা থেকে উঠে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এগিয়ে গেলাম৷ ঘরটা আগের মতোই খোলা পড়ে আছে৷ তবে এতক্ষণে ভারী বাতাসটা বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে৷ তার বদলে রিনরিনে ঠান্ডা বৃষ্টির মতো হাওয়া খেলা করছে ঘরময়৷ চাঁদের আলো সিমেন্টের স্তূপের উপরে পড়ে সেটাকে রূপালি ধুলোর মতো মনে হচ্ছে৷ পিছনে তাকিয়ে তাকে দেখতে পেলাম না, শুধু ঘরের দরজাটা নিজে থেকে বন্ধ হয়ে গেল৷ আমার কেমন যেন ভয় করতে লাগল৷ ছবির জায়গাটা এখন খালি৷ সেদিকে তাকাতেই মনের ভিতরে তার ছায়াময় চোখ দুটো ফুটে উঠতে লাগল৷

‘দেখছিস কী ওখানে?’

আচমকা জিজ্ঞাসু গলাটা কানে যেতে আগের মতোই চমকে উঠেছিলাম৷ কিন্তু এবার আর ভয় পেলাম না৷ ছবি থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললাম, ‘ভাবছি ঘরটা আগে কেমন ছিল?’

‘আগে বলতে?’

‘যখন তুই এখানে থাকতিস৷’

দরজা পেরিয়ে আমি বারান্দার চৌকাঠে এসে দাঁড়ালাম৷ দেখলাম সে ভাঙা রেলিঙের আলগা হয়ে থাকা একটা ইটের উপর বসে পিছনের দেওয়ালে পিঠ এলিয়ে দিয়েছে৷ চাঁদের আলো ছড়িয়ে রয়েছে তার পা থেকে মাথা অবধি৷ আমি যে এসে দাঁড়িয়েছি তা সে পিছন না ফিরেই বুঝতে পারল৷

‘এই বারান্দা ভেঙে নীচে পড়ে গেছিলাম৷ সেই থেকে ভেঙেই আছে এটা৷’

আমি এক পা-এক পা করে সেদিকে এগিয়ে এসে বললাম, ‘তারপর আর জোড়া লাগেনি?’

‘নাঃ৷ আমিই লাগাতে দিইনি৷’

‘সেকি! কী করে?’

‘ওমা! ভয় দেখিয়ে৷’

‘আচ্ছা! ওরা তার মানে তোকেই ভয় পায়?’

সে এবার মাথা নীচু করে গলা নামিয়ে বলল, ‘কেন, তুই পাচ্ছিস না?’

আমি মাথা নাড়লাম, ‘উঁহু… আমি ভূতে ভয় পাই না৷’

‘তাহলে এখানে এসে বস দেখি৷’

কথাটা বলে হাত দিয়ে ভাঙা রেলিঙের উপর একটা জায়গা দেখিয়ে দিল সে৷ ইট ভেঙে স্তূপ হয়ে আছে সেখানে৷ আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, ‘ভূতে ভয় পাই না বলেছি৷ তা বলে এত তাড়াতাড়ি মরার ইচ্ছা নেই৷’

সে অদ্ভুতভাবে একগাল হেসে একটা হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘ভরসা রাখ আমার উপর৷ কিচ্ছু হবে না৷’

আমি মনে-মনে প্রমাদ গুনলাম৷ ভূতেই বিশ্বাস করি না আবার তার উপর ভরসা৷ যাই হোক তার বাড়ানো হাতটা উপেক্ষা করতে পারলাম না৷ আমি সেটা ধরতে আলতো করে টান দিল সে৷ আমি গিয়ে বসলাম একখানা সিমেন্টের চাঁইয়ের উপরে৷

‘দেখলি? ভাঙল না তো?’

আমি নীচে তাকিয়ে দেখলাম আমার পা থেকে ফুট তিনেক নীচেই লাইটপোস্ট৷ তার আলোটা দিব্যি জ্বলছে৷ মাথার ভিতরে সবকিছু এমন ভোঁ হয়ে আছে যে একটা সিগারেট না ধরালেই নয়৷ এদিকে দেশলাই জ্বালানোর উপায় নেই৷ ভূত হাত দিয়ে মাথার চুল সরাতে-সরাতে বলল, ‘প্রথম দিকে যারা এ ঘরে থাকতে আসত তাদের মজা করে ভয় দেখাতাম৷ সেই থেকেই কাল হল৷ ঘরটা তো বন্ধ হয়ে গেলই, লোকজনও আর এদিকে আসতে চায় না৷’

‘সেটাই স্বাভাবিক৷ ম্যানেজারটা আগে থেকেই ভয় দেখিয়ে দেয়৷’

‘কী বলে রে?’

‘বলে আঠেরো নম্বর ঘরে ভূত আছে৷ আর যারা ভূতে বিশ্বাস করে না তাদের বলে এখানে রিনোভেসন চলছে৷’

‘রিনোভেসন না ছাই৷ আমার পড়ার টেবিলটা তুলে নিয়ে গেছে, মা-বাবার ছবি দেওয়াল থেকে খুলে নিয়ে গেছে, আমারটাও খুলে নিয়ে যাচ্ছিল৷ বাধ্য হয়ে আবার ভয় দেখাতে হল৷’ গলায় বেশ স্পষ্ট রাগের আভাস পেলাম৷

‘তার মানে এটা তোদেরই বাড়ি?’

‘হ্যাঁ৷ আমি মারা যাবার পরে মা-বাবা বাড়িটা বেচে দেয়৷’

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম৷ মেয়েটা কী করে যে মারা গেল সেটাই স্পষ্ট নয়৷ রেলিঙের যেটুকু এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে তাতে বোঝা যায় সেটা ফুট তিনেক উঁচু৷ এই বয়সের একটা মেয়ে শুধু ঝুঁকতে গিয়ে সেটা ভেঙে ফেলবে তা তো হতে পারে না৷ তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে আগে থেকেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে৷

এবার সে দেওয়াল থেকে পিঠ তুলে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল৷ অমনি চুলগুলোও সামনে এসে গোটা মুখ ঢেকে ফেলল৷ একেবারে ইংরেজি সিনেমার ভূতের মতো৷ সমস্ত ঝুঁকে পড়া চুলকে হাত দিয়ে চিড়ে দু-দিকে সরিয়ে দিল ধীরে-ধীরে৷ খানিকটা দুঃখ জড়ানো গলায় বলতে লাগল—

‘তখন আমার বয়স ষোলোর কাছাকাছি৷ খ্যাপাটে ছিলাম বলে লোকে আমায় পাগল বলত৷ তাতে অবশ্য আমার খারাপ লাগত না৷ শুধু মনে হত—আমি তো মেয়ে, তাহলে পাগলি বলা উচিত৷ বেশ চলছিল, তো একদিন রাতে ঘুমাতে-ঘুমাতে স্বপ্ন দেখলাম যে আমার পিঠে দুটো ডানা গজিয়েছে৷ আর আমি সেই ডানায় চড়ে এই বারান্দা থেকে দিব্যি চাঁদের দিকে উড়ে যাচ্ছি৷ সেদিন ঘুম ভেঙে যাবার পর আর অতটা ভাবিনি স্বপ্নটা নিয়ে৷ কিন্তু পরের দিন আবার সেই একই স্বপ্ন দেখলাম৷ তার পরদিন আবার৷ আস্তে-আস্তে মনে হতে লাগল যে একদিন সত্যি আমার পিঠে ডানা গজাবে৷ কিছুদিন পর ধারণাটা বিশ্বাসে বদলে গেল৷ আমি রোজ সন্ধ্যায় এই বারান্দায় এসে দাঁড়াতাম৷ কিন্তু কিছুই হত না৷ একটু পরে মা ডাক দিলে আবার ঘরে ফিরে যেতাম৷ বাবা-মা বিশ্বাস করবেন না জানি, কিন্তু বন্ধুদের বলতে তারাও হাসাহাসি করত৷ জেদ চেপে গেল৷ যদি ডানা নাই গজায় তাহলে স্বপ্নটা দেখি কেন বারবার? শেষে একদিন খেয়াল করলাম স্বপ্নে আমি বারান্দায় দাঁড়ালেই ডানাটা গজায় না৷ আমি রেলিংটার উপর উঠে দাঁড়াই৷ তারপর হাত দুটো দু-দিকে ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করে ঝাঁপ দিই৷ হাওয়ায় ভাসতে-ভাসতেই গজিয়ে যায় ডানাটা৷ মনে-মনে ঠিক করলাম তাই করব৷ পরের দিন সন্ধ্যায় বারান্দায় এসে ঠিক সেইভাবে রেলিঙের উপর উঠে দাঁড়ালাম৷ হাত ছড়িয়ে চোখ বুজে সবে ঝাঁপ দিতে যাব এমন সময় পা-টা টলে গেল৷ পুরনো রেলিং তো, আমার ওজন নিতে পারেনি৷ জোরে আওয়াজ করে ভেঙে গেল সেটা৷ সেই সাথে খানিকটা ইট আর সিমেন্ট৷ আমিও নীচে এসে পড়লাম৷ তারপর থেকেই মনে হয় মরে গেছি৷’

কথাগুলো শুনতে-শুনতে আমার বেশ হাসি পাচ্ছিল৷ তাও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘ভেল্ডমেসজ৷’

‘মানে?’ সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল৷

‘মানে লোকে যে কেন তোকে পাগল বলত এবার বুঝতে পারছি৷’

‘পাগলের কী আছে? কোনও কিছু বিশ্বাস করলে তার জন্য এটুকু ঝাঁপ দেওয়া যায় না?’

‘ঝাঁপ দেওয়া যাবে না কেন? কিন্তু তারপর নীচে পড়ে এইরকম পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে৷’

সে রেগে মেগে উঠে পড়ে বলল, ‘তুই বড় বেরসিক৷ এখানে আনাই ভুল হয়েছে৷’

‘আগেই বলেছিলাম৷’

‘তোকে ঘরের দরজা খুলতে কে বলেছিল? ছবির উপর টর্চ ফেলতে কে বলেছিল?’

‘আমি দেখছিলাম ঘরে ভূত আছে কি না…’

‘তারপর কী দেখলি?’

‘দেখলাম ভূত থাকলেও সে একান্তই গোবেচারা আর বদ্ধ পাগল৷’

‘পাগল না৷ পাগলি৷’

‘ওই হল৷’

হঠাৎ কী যেন মনে পড়তে বারান্দা ছেড়ে উঠে পড়ল৷ দরজার দিকে এগোতে-এগোতে বলল, ‘তুই একটা ছাগল৷ কিছুই বিশ্বাস করতে চাস না৷’

আমি সিমেন্টের চাঁই থেকে সাবধানে উঠতে উঠতে বললাম, ‘ছেলেবেলায় শুনেছিলাম আমার মা নাকি কয়েকবার ব্লাডি মেরিকে দেখেছে৷ আমার বিশ্বাস হয়নি৷’

রিনি হাঁটা থামিয়ে পিছন ঘুরে বলল, ‘ব্লাডি মেরি কী?’

‘কিছুই না৷ ইংল্যান্ডের পুরনো লিজেন্ড৷ ব্লাডি মেরি হল এক ডাইনি৷ সে কখনও উপকারী দয়ালু, আবার কখনও ভয়ানক খুনে৷ তো তাকে ডাকার আবার এক বিশেষ পদ্ধতি আছে৷ চাঁদনি রাতে কোনও কিশোরী মেয়ে পিছন ফিরে সিঁড়ির নীচ থেকে উপরে উঠবে৷ হাতে থাকতে হবে একখানা মোমবাতি আর একটা আয়না৷ তো এইভাবে পিছন পায়ে সিঁড়ি ডিঙোতে-ডিঙোতে তিনবার ‘ব্লাডি মেরি’ বলতে হবে৷ সাথে-সাথে আয়নায় ব্লাডি মেরিকে দেখা যাবে৷’

আগ্রহ ভরা গলায় সে জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর?’

‘তারপর সে যদি ভালো হয় তো কিছু বর চেয়ে নেওয়া যেতে পারে৷ আর খারাপ হলে ঘাড় মটকে রক্ত খাবে৷’

সে মন দিয়ে কিছু যেন ভাবতে-ভাবতে স্বগতোক্তি করল, ‘কিন্তু আমার রক্ত কী করে খাবে?’

‘তা বটে, চোরের ঘরে চুরি হয় না৷’

আমরা এতক্ষণে হাঁটতে-হাঁটতে সিঁড়ির কাছে এসে পড়েছিলাম৷ সে একদৃষ্টে সিঁড়ির নীচের ধাপের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলল, ‘মোমবাতি তো আমি থাকলে জ্বলবে না৷’

‘মহা ঝামেলা তো৷ বলছি, এসব গল্প কথা৷’

আমার কথা কানেই নিল না সে৷ একতলায় রাঁধুনির ঘরের পাশে একটা আয়না ছিল৷ দৌড়ে গিয়ে সেটা খুলে নিয়ে উপরে চলে এল সে৷ মোমবাতির বদলে বাঁ হাতে থাকল আমার টর্চটা৷ আয়নাটা আরেক হাতে ধরে ধীরে-সুস্থে সিঁড়ির নীচে গিয়ে পিছন ফিরে দাঁড়াল সে৷ আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখতে লাগলাম৷ তার চোখ আয়নার উপর স্থির৷ ধীরে-ধীরে একটা পায়ের গোড়ালি সিঁড়ির উপর উঠে এল৷

‘ব্লাডি মেরি’

হাতে ধরা আয়নাটা তিরতির করে কাঁপছে৷ সেটা ভয়ে না উত্তেজনায় বুঝতে পারলাম না৷ সিঁড়ির উপর আর একধাপ পিছিয়ে এল সে৷

‘ব্লাডি মেরি… ব্লাডি মেরি৷’

এই তিন নম্বর ব্লাডি মেরি বলার সাথে-সাথেই ভয়ানক এক কাণ্ড ঘটে গেল৷ না দেখে সিঁড়ির একদিকের কোণে পা ফেলাতে তার পা পিছলে গেল৷ আর অমনি সমস্ত দেহটা সিঁড়ির ধাপ বেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল নীচে৷ আয়নাটা মাটিতে পড়ে ঝনঝনিয়ে ভেঙে গেল৷ টর্চটা গড়াগড়ি খেতে লাগল মেঝেতে৷ আমি তড়িঘড়ি করে ছুটে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, কোনওরকমে উঠে বসে খানিকটা সামলে নিয়েছে সে৷ কপাল ফেটে সরু রক্তের ধারা নেমেছে৷ সেদিকে তাকিয়ে আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘হয়েছে তো? এবার আয়নায় দেখ৷ সাক্ষাৎ ব্লাডি মেরি দেখতে পাবি৷’

সে গোমড়া মুখে কপাল মুছতে মুছতে বলল, ‘আর একটু হলেই দেখতে পেতাম৷ ধ্যাত্তেরি…’

এরপর প্রায় জোরজার করে আমাকে ছাদে নিয়ে গেল সে৷ ঠিক কোন জায়গাটায় সে জামাকাপড় মেলত, কোথায় দাঁড়িয়ে চুল শুকাত, কোন খানে জুতোর বাক্সে বেড়াল রাখত৷ এইসব দেখে বেড়াতে হল আমাকে৷ ভূতের দাবি৷ না মেনেও উপায় নেই৷ শেষে ম্যানেজারের দরজায় চারবার টোকা দিয়ে তাকে ভয় দেখিয়ে আবার সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল তিনতলায়৷ আমিও এলাম পিছন-পিছন৷ বেশ বুঝতে পারছি, এতদিন মানুষের দেখাসাক্ষাৎ না পেয়ে সে নিজেও হাঁফিয়ে উঠেছিল৷ আমারও খারাপ কাটছে না সময়টা৷ শুধু এতদিনের জমানো অবিশ্বাস সব একরাতেই মুছে গেল সেটাই যা দুঃখের৷ তেতলায় এসে আবার আমার ঘরেই ফিরে এলাম৷ আমি হাঁফিয়ে গেছিলাম৷ রিনির উৎসাহে কিন্তু এতটুকু ভাঁটা পড়েনি৷ বরঞ্চ দ্বিগুণ আগ্রহে বলল, ‘চল কিছু খেলা যাক৷’

‘খেলা? তোর বয়স ষোলো হতে পারে, আমার না৷’

‘আমিও আর ষোলো নই৷ মরে গেলে কি বয়স বাড়ে না?’ ‘আমি কি করে জানব? আগে ভূত দেখেছি নাকি?’

সে আর কথা না বাড়িয়ে বলল, ‘এত বড় বাড়ি তার উপর অন্ধকার৷ লুকোচুরি খেলবি?’

আমি ব্যঙ্গের সুরে বললাম, ‘হ্যাঁ সেই৷ তুই অদৃশ্য হয়ে যা আর আমি খুঁজে মরি৷’

‘কেন? দেশলাই ঘষলেই বুঝতে পারবি আমি সামনে আছি কি না৷’

অত দেশলাই কাঠি নেই আমার কাছে৷ তাছাড়া…’

আমি কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম৷ সে ভুরু কুঁচকে আমার পাশে বসে পড়ে বলল, ‘তাছাড়া কী?’

আমি চুপ করে রইলাম৷ এ ঘরে আলো অপেক্ষাকৃত কম৷ আমরা জানলার দিকে পিছন ফিরে বসে আছি, তাই কেউ কারও মুখ দেখতে পাচ্ছি না৷ আমার কাঁধে একটা হাত রাখল রিনি, ‘বল কী বলছিলি?’

‘আমি চাই না তুই অদৃশ্য হোস৷’

কেমন যেন চাপা হাসির শব্দ হল৷ তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল, ‘কাল সকাল হলে তো অদৃশ্য হতেই হবে৷’

‘সে তখন দেখা যাবে না হয়৷’

‘কিন্তু তুই যে বললি ভূতে বিশ্বাস করিস না৷ লোকে জিজ্ঞেস করলে কী বলবি?’

‘বলব বিশ্বাসে মিলায় বস্তু—তর্কে বহুদূর৷’

‘আর মনে-মনে অবিশ্বাস করবি?’

‘উঁহু…’

‘তাহলে?’

‘ওই বিশ্বাসে ভর করে একটু ঝাঁপ দেব৷ তোর মতো৷’

‘তারপর পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হলে?’

‘তাহলে আরও ভালো৷ এখানে এসে পাকাপাকি বাসা বাঁধব৷’

সে খিলখিল করে হেসে উঠল৷ আমার চোখ পড়ল টেবিলের উপরে রাখা ছবিটার উপরে৷ ছবির পিছনেই জানলা, সেই জানলার ফাঁক দিয়ে বাইরেটা দেখা যাচ্ছে৷ সব কিছু উলটো-উলটো দেখছি৷ পাশের বাড়ির ছাদ, অ্যান্টেনা, মাথার উপর মাটি আর পায়ের নীচে আকাশ৷ কোনওকিছুই পাল্টে যায়নি৷ খালি আমি উল্টো হয়ে শুয়েছি৷ নিজের চোখকে অবিশ্বাস করি কী করে? ভূত দেখছি নিজের চোখের সামনে৷ শুধু দেখছি? রীতিমতো দৌড়াদৌড়ি করে বেরাচ্ছি তার সাথে৷ নাঃ, নিজেকেই যেন চিনতে পারছি না৷ রিনি এতক্ষণে জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আমার দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কাল সকালেই চলে যাবি?’

‘হ্যাঁ৷ সেরকমই তো কথা আছে৷’

‘আর আসবি না এখানে?’

‘কী জানি৷ ঠিক নেই?’

‘ঠিক নেই মানে?’

‘মানে এসে কী করব?’

‘আশ্চর্য! চাইছিসটা কী তুই?’

‘সত্যি বলব?’

‘বল৷’

‘তোকে দেখতে না পেলে খারাপ লাগবে৷’

সে হাসি মুখে বলল, ‘আমি তো এখানেই আছি৷ এলেই দেখা হয়ে যাবে৷’

‘এখানে এলেই যে আবার একই স্বপ্ন দেখব তার তো মানে নেই৷’

কথাটা কানে যেতেই তার গলার স্বর পাল্টে গেল৷ পরের ঠান্ডা শব্দগুলো কানে আসতেই কেমন যেন ভয় করল আমার, ‘মানে তুই এখনও এটা স্বপ্ন ভাবছিস?’

‘তবে নয়তো কি? শুধু ভূত হলেও মানা যেত৷ এ আবার ডানাওয়ালা ভূত৷ গাঁজাখুরিরও একটা লিমিট আছে…’

‘আমার একটা কথাও বিশ্বাস করিসনি তাই না?’ অভিমানী স্বরে কথাকটা বলে আমার দিকে বেশ খানিকটা সরে এল সে৷

‘তখন একটা কথা বলেছিলাম৷ ভেল্ডমেসজ৷ মানে কী বলতো?’

‘জানি না৷’ বেশ খানিকটা রাগ আর অভিমান ভরা স্বর ভেসে এল৷

একটু আগের প্রাণোচ্ছল ভাবটা পুরোপুরি সরে গেছে তার মুখ থেকে৷

‘মানে এই যে আমরা নিজের চারপাশে ইচ্ছামতো একটা জগৎ কল্পনা করে নিই৷ তারপর একদিন বুঝতে পারি সত্যিকারের জগৎটা সেরকম নয়৷ বুঝতে পেরে আমাদের ভীষণ মন খারাপ হয়৷ একে বলে ভেল্ডমেসজ৷’

সে আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল৷ নিঃশ্বাসের শব্দ বেড়ে উঠেছে৷

কোনও একটা কারণে আমার চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে৷

‘আমি বেঁচে থাকতেও কেউ বিশ্বাস করেনি আমাকে৷ আজ তুইও করলি না৷ বেশ! আমিও দেখব, সেদিন যা করেছিলাম আজও তাই করব৷ শুধু মনে রাখিস, আমি যদি সত্যি উড়তে পারি তাহলে আর ফিরব না এখানে৷ আর দেখতে পাবি না আমাকে৷’

কথাটা বলে সে আর দাঁড়াল না৷ এক ছুটে এগিয়ে গেল লনের দিকে৷ তার মিলিয়ে আসা গলার স্বর আমার ফাঁকা ঘরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল৷ ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে প্রথমটায় হকচকিয়ে গেছিলাম আমি৷ সেটা কেটে যেতেই এক ঝটকায় উঠে পড়লাম বিছানা থেকে৷ তার পায়ের আওয়াজ এতক্ষণে আঠেরো নম্বর ঘরের চৌকাঠ পেরিয়েছে৷ আমি সেইদিকে দৌড় দিলাম৷ বুকের ভিতর কীরকম যেন একটা চাপা অনুভূতি ছটফট করতে শুরু করেছে৷ তবে কি সত্যি সে আমার কল্পনা নয়? এই কি তবে বাস্তব? আর এসব ভাবার সময় নেই৷ শুধু জানি এই মুহূর্তে রিনিকে হারাতে চাই না আমি৷ কিছুতেই না৷ ঘরের কাছে পৌঁছে দেখতে পেলাম তাকে৷ আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে৷ ডাগর ডাগর চোখে সেই বুকচেরা দৃষ্টি৷ সেই অন্ধকারের চাদর সরিয়ে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া মুখ৷ অভিমানে তিরতির করে কাঁপছে ঠোঁট দুটো৷

‘দাঁড়া, পাগলামি করিস না৷’ আমি হাত তুলে বাধা দিলাম তাকে৷ তার দু-গাল জুড়ে অদ্ভুত কোমল একটা হাসি ফুটে উঠল৷ আমি দৌড় দিলাম তার শরীর লক্ষ্য করে৷ আর সাথে-সাথে তার পায়ের নীচের একটা ইট খসে পড়ল৷ সেইসাথে রিনিও ধীরে-ধীরে মিলিয়ে আসতে লাগল ভাঙা বারান্দাটায়৷ সেদিকে ছুটে গিয়েও আর কাউকে দেখতে পেলাম না আমি৷ একটু আগে ঠিক এখানেই বসে ছিলাম দু-জনে৷ এখন সমস্ত জায়গাটা খাঁ-খাঁ করছে৷

‘রিনি…’ শূন্য গাছপালার ডালে নামটা বারবার ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসতে লাগল৷ বাইরে থেকে ঝিঁঝিঁর একটানা শব্দ আসছে৷ তাছাড়া আর কিছু নেই৷ পিছিয়ে এসে ঘরেরই চৌকাঠে বসে পড়লাম আমি৷ মনে হল বারান্দার ভাঙা ইটগুলোর মতোই আমি তাকে ধরে রাখতে পারিনি৷ মনের গভীরে অবিশ্বাসের ঝড় টেনে নিয়ে গেছে তাকে৷ আকাশের ঠিক মাঝে গোল চাঁদ এখনও আগের মতোই ফুটে আছে৷ আমি চোখ বুজলাম, সত্যি কি স্বপ্ন দেখছি?

ম্যানেজারের ডাকে ঘুম ভাঙল সকালে৷ কালরাতে দরজা খুলে রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷ সকালের চা দিতে এসে আমাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে বেশ খানিকটা অবাক হয়েছেন ভদ্রলোক৷ আমি চোখ খুলে চারপাশে একবার ভালো করে দেখে ঠাহর করার চেষ্টা করলাম৷ টেবিলের উপরে কোনও ছবি নেই৷ আড়মোড়া ভেঙে ঘুমের ঘোরটা কাটিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কটা বাজে বলুন তো?’

‘সাড়ে ন-টা৷ আপনি তো দেখছি মড়ার মতো ঘুমান৷’

‘আসলে কাল রাতে…’ কথাটা বলতে গিয়েও আমি থেমে গেলাম৷ স্বপ্নই দেখছিলাম তার মানে৷

‘রাতে কী? ঘুম হয়নি ভালো?’

‘না ঘুম ভালোই হয়ছে, আচ্ছা একটা কথা বলুন তো?’

ম্যানেজার টেবিলের উপর চায়ের ঢাকা সরাতে-সরাতে বললেন, ‘কী?’

‘কাল রাতে কি আপনি একবার উপরে এসেছিলেন?’

ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, ‘রাতে? ধুর মশাই৷ আপনি নিজেই তো বললেন ডিনার লাগবে না৷’

‘আসেননি তার মানে?’

‘নাহ৷’

অর্থাৎ পুরোটাই স্বপ্ন ছিল৷ এমনকি আঠেরো নম্বর ঘরের দরজা খোলা পাওয়াটাও৷ মনটা কেমন যেন খিঁচড়ে গেছিল৷ বিছানা ছেড়ে উঠে বললাম, ‘দিব্যি গাঁজাখুরি দিলেন তো কাল৷ ভূতের তো টিকিটিও দেখলাম না৷’

‘আরে ভূতে আমারও বিশ্বাস হয় না৷ লোকে ভয় পায় তাই সতর্ক করে দেওয়া আরকী৷’

‘আচ্ছা ওই আঠেরো নম্বর ঘরের চাবিটা আছে আপনার কাছে?’

ভদ্রলোক একগাল হেসে বললেন, ‘হঠাৎ সকালে চাবি চাইছেন! রাতে সাহস হয়নি বুঝি?’

‘ভাবছিলাম চলেই যখন যাব তখন একবার দেখে যাব৷’

‘বেশ৷ চাবি তো আমার ট্যাঁকেই থাকে৷ এই নিন৷’

ম্যানেজার প্যান্টের পকেট থেকে একখানা চাবির রিং বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন৷ তারপর কী যেন কাজের কথা মনে পড়তে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে৷ একটু পরে আমিও জামাকাপড় পরে ব্যাগের জিনিসপত্র ঢুকিয়ে লনে পা বাড়ালাম৷ একটা অজানা অনুভূতি বারবার গলা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে৷ সবটাই স্বপ্ন দেখলাম? সবটাই আমার মনের কল্পনা৷ যদি সত্যি তাই হয় তাহলে আমার এতদিনের জমানো বিশ্বাসে আঁচড় লাগবে না৷ সেটা ভেবেও অস্বস্তিটা কমছে না৷ হাজার ভাবনা জড়ো হচ্ছে মাথায়৷ সেগুলো আপাতত সরিয়ে রেখে চাবি দিয়ে আঠেরো নম্বর ঘরের দরজা খুলে ফেললাম আমি৷

নীচে যখন নামলাম তখন বাইরে ভালোমতন রোদ উঠেছে৷ হোটেলে আর একটা কর্মব্যস্ত দিনের শুরু৷ টাকাপয়সা মিটিয়ে, সইসাবুদ করে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলাম আমি৷ ফেরার সময় ম্যানেজারের সাথে একবার চোখাচোখি হতে তিনি হাসলেন৷ বেশ কিছুদূর হেঁটে এসে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ চারপাশে তাকিয়ে একবার দেখে নিলাম কেউ দেখছে কি না৷ তারপর আস্তে-আস্তে হাতের ব্যাগটা খুলে ছবিটা বের করে আনলাম৷ রিনির সেই ছবিটা৷ আঠেরো নম্বর ঘরের দেওয়ালে সত্যি ঝুলছিল৷ কাল রাতের কতটা স্বপ্ন আর কতটা নয় তা আমি জানি না৷ শুধু এটুকু জানি রিনিকে দূরে যেতে দেওয়া চলবে না৷ এই ছবিখানাতেই আটকে আছে সে৷ তার কোঁকড়ানো চুলের ঢল, তার টিয়াপাখির মতো বাঁকানো নাক, ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা আলগা হাসির আভাটুকু৷ এটা আর আমি হাত ছাড়া করছি না৷ ছবিটা আবার ব্যাগে চালান করে চেন টেনে দিলাম আমি৷ মাথাটা ধরে আছে৷ পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটের ডগায় ধরলাম৷ দেশলাই জ্বালাতে গিয়ে হল মুশকিল… একটাও কাঠি জ্বলছে না… সবক-টা কি একসাথে নষ্ট হল? ধুর ধুর…কী রে বাবা…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *