নিজের ওজন নিজে বুঝুন
একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তাটা অপেক্ষাকৃত ফাঁকা। সন্ধ্যার দিকে চৌরঙ্গি রোড ধরে হেঁটে ফিরছি, হঠাৎ সামনে এক ব্যক্তি এসে উদয় হলেন। দেখে একটু চমকে উঠেছিলাম, আগে-ভদ্রলোক-ছিলাম গোছের চেহারা। শীর্ণ, ময়লা জামা, ছেঁড়া চটি, চোখে-মুখে ক্ষুধার্ত ভাব। অবশ্য একটু পরেই বুঝলাম আমার চমকানোটা অমূলক, লোকটি একজন সামান্য ভিখিরি; গুণ্ডা বা ছিনতাইকারী নয়।
ব্যক্তিটি আমার সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘দাদা, দশটা পয়সা দেবেন, দু’-দিন কিছুই খাইনি।’ বুঝতে পারলাম লোকটি শুধু ভিখিরি নয়, নির্বোধও বটে, দু’-দিন যদি না খেয়ে থাকে, তবে দশ পয়সায়, মাত্র দশ পয়সায় আজকের দিনে কী খেতে পাবে ! আমি বাধ্য হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘দু’-দিন যদি না খেয়ে থাকেন, তা হলে দশ পয়সা দিয়ে কী হবে ?’ উত্তরে ক্ষুধার্ত ব্যক্তিটি বললেন, ‘একটু ওজন নিয়ে দেখতাম, আমার ওজন কতটা কমেছে।’
একজন পথের ভিক্ষুকের এইরকম বৈজ্ঞানিক মনোভাব দেখে আমি এরপর কতটা চমৎকৃত হয়েছিলাম সেটা বুঝিয়ে বলার নিশ্চয় দরকার নেই। তবে সেই মুহূর্তে আমারও মনে পড়ল বেশ কিছুদিন আমি নিজেও ওজন নিইনি, বহু কষ্টে শরীরের স্থূলতা মাস কয়েক আগে অনেকটা কমিয়েছিলাম, এখন সন্দেহ হচ্ছে আবার বুঝি মোটা হয়ে যাচ্ছি।
প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, আমার এই ওজন কমানোর ব্যাপারটা আমার বন্ধুবান্ধব, পরিচিত-পরিজন অনেকেই বিশেষ সহজভাবে নেননি, অনেকেই আমার মধ্যদেশের দিকে ভ্রূকুঞ্চন করে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, ‘সত্যি রোগা হয়েছ, বলছ ?’ এমনকী আমার সহধর্মিণী পর্যন্ত এ বিষয়ে গভীর সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন। একবার তাঁর সামনে ওজন নিয়ে ওজন-যন্ত্রের কার্ডে দেখলাম আগের বারের চেয়ে দেড় কেজি ওজন কম। ভদ্রমহিলা ওজনের অঙ্কের দিকে না তাকিয়ে কার্ডের নিম্নাংশের আপ্ত বাক্যটি পড়তে লাগলেন, ইংরেজিতে লেখা সেই সদুক্তি, যার বঙ্গানুবাদ হবে, ‘আপনি সৎ চরিত্রের, উদার দিলখোলা লোক। সকলেই আপনাকে ভালবাসেন।’ ভদ্রমহিলা নির্বিকারভাবে বললেন, ‘এই কথাগুলো তোমার সম্পর্কে যেমন মিথ্যে, তেমনি মিথ্যে তোমার ওজনের হিসেব।’
এই সূত্রে এক স্থূলাঙ্গিনী মেমসাহেবের কথা মনে পড়ে যায়। তাঁর স্বামী তাঁর উপরে খুব অত্যাচার করেন, তিনি ক্রমশ কাহিল হয়ে যাচ্ছেন, ক্রমশ কিঞ্চিৎ রোগাও হয়ে যাচ্ছেন। এইরকম সময়ে এক বান্ধবীর সঙ্গে সেই মেমের দেখা। বান্ধবী তাঁকে অনেকদিন পরে দেখে বললেন, ‘এ কী, লরা, তোমার একী চেহারা হয়েছে !’ লরা মেম তখন তাকে বললেন যে তাঁর স্বামীর অত্যাচারে তাঁর এই অবস্থা হয়েছে। এই বলে নিরালায় বসে চোখের জলে ভিজিয়ে তিনি প্রচুর পরিমাণ পতি-নিন্দা করলেন, অত্যাচারের বিবিধ বর্ণনা দিলেন এবং সর্বশেষে বললেন যে, স্বামীর অমানুষিক ব্যবহারে গত কয়েক মাসে তাঁর পনেরো পাউন্ড ওজন কমে গেছে। দরদি বান্ধবী তখন সুপরামর্শ দিলেন, ‘তা হলে তুমি তোমার স্বামীকে ডিভোর্স করছ না কেন ? তুমি যা যা বললে আদালতে জানালে সঙ্গে সঙ্গে ডিভোর্স পেয়ে যাবে।’ তখন লরা মেম গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘ডিভোর্স করব, নিশ্চয়ই করব। তবে আরও কিছুদিন পরে।’ বিস্মিতা বান্ধবী বললেন, ‘বিবাহবিচ্ছেদ যদি করতেই হয় তবে আর কিছুদিন অপেক্ষা করা কেন ?’ স্থূলাঙ্গিনী লরা বললেন, ‘আমার ওজনটা আর পনেরো-বিশ পাউন্ড কমলেই আমি ওঁর বিরুদ্ধে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা আনব।’
নোবেল প্রাইজের সঙ্গে ধ্বনি সমন্বয় করে ইংরেজিতে একটা বাজে পান (Pun) আছে, নো বেলি প্রাইজ (No Belly Prize)। যে কেউ রোগা হচ্ছেন, খাদ্য কমিয়ে বা পরিশ্রম বাড়িয়ে ওজন ওরফে ভুঁড়ি কমানোর চেষ্টা করছেন, তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘কী হে, তুমি কি নো বেলি প্রাইজের চেষ্টা করছ নাকি ?’
আরেকটা মোটা দাগের বিলিতি গল্প আর এক মোটা মেমসাহেবকে নিয়ে। সেই গজেন্দ্রগামিনী তাঁর ডাক্তারকে ফোন করেছিলেন, ‘ডাক্তার সাহেব, আজ আমার জন্মদিন।’ ও-প্রান্তে ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘হ্যাপি বার্থ ডে।’ মোটা মেম বললেন, ‘কিন্তু ডাক্তার সাহেব, আমি বড় বেকায়দায় পড়েছি, আমাকে শিগগির একটা রোগা হওয়ার জোরালো ওষুধ পাঠিয়ে দিন।’ ডাক্তার সাহেব শুধোলেন, ‘ম্যাডাম, জন্মদিনে রোগা হওয়ার ওষুধ দিয়ে কী হবে ?’ ‘কী বলব ডাক্তার সাহেব, আমার বর আমাকে একটা উপহার দিয়েছে। কিন্তু সেটা এতই ছোটো যে আমি তার মধ্যে গলতে পারছি না।’ মহিলার করুণ কষ্ঠে এই সংবাদ পেয়ে ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘আপনি পোশাকটা সঙ্গে করে চলে আসুন, দেখি কতটা কী করা যায় ?’ মোটা মেম আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘পোশাক ? পোশাক কী বলছেন ? আমার স্বামী আমাকে একটা গাড়ি দিয়েছে, আমি সেই গাড়ির মধ্যে ঢুকতে পারছি না।’
একদা বড় ওজনের মানুষ বলতে বোঝাত ক্ষমতাবান, কৃতী মানুষদের। তখন মানুষদের সাফল্যের মাপকাঠিই ছিল তার ওজন। এখন একমাত্র যাত্রাদলের নায়ক-নায়িকা ছাড়া আর কোথাও ওজনের কোনও গুরুত্ব নেই।
চালু কথাই ছিল, নিজের ওজন বুঝে চলবে, নিজের ওজন বুঝে কথা বলবে। তখন ওজন মানেই ছিল গুরুত্ব। কিন্তু এখন সবচেয়ে সফল লোকেরা চাইছেন তাঁদের ওজন কমাতে, ছিমছাম, ফিটফাট হতে। অতিরিক্ত দেহ-ভার নাকি কর্মশক্তি, জীবনীশক্তি কমিয়ে দেয়।
কিন্তু একথা বুঝি পুরোপুরি সত্য নয়। এখনও মাঠে-ময়দানে দেখি শেষরাতের অন্ধকারে আর বিকেলের ছায়ায় হাজার হাজার মোটা লোক যেমন হনহনিয়ে ছুটছে রোগা হওয়ার জন্যে, তেমনিই হাজার হাজার রোগা লোক ছুটছে মোটা হওয়ার জন্যে।
মোটা-রোগার কথায় মনে পড়ে, শিবরাম চক্রবর্তীর গল্পের মোটা নায়ক (তাঁর স্ত্রীও মোটা) বলেছিলেন, আমরা বাড়িতে মোটামুটি দু’জন। এরই প্রতিধ্বনি তুলে একদা আমার এক অসুস্থ বন্ধুর তন্বী সহধর্মিণী বলেছিলেন, ‘আমরা রোগারুগী দু’জন।’
তবে মোটা-রোগা নিয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত গল্প দুই খ্যাতিমান সাহেবকে নিয়ে। এঁদের দু’জনের নাম আমার বারবার গুলিয়ে যায়, তাই জব্দ হওয়ার ভয়ে লিখছি না (বার্নার্ড শ এবং চেস্টারটন নয় তো ? হে সুশিক্ষিতা পাঠিকা, ভুল হয়ে থাকলে, দয়া করে চিঠি দিয়ে বা ফোন করে অপমান করবেন না। আমার বিদ্যের দৌড় তো আপনি এতদিনে বুঝে গেছেন। আর কাণ্ডজ্ঞানের দৌড়ও প্রায় শেষ।)
সে যা হোক, বার্নার্ড শ যেমন রোগা ছিলেন, চেস্টারটন ছিলেন তেমন মোটা। একদিন কী একটা কথার মধ্যে চেস্টারটন বার্নার্ড শ’র দিকে লক্ষ করে বলেছিলেন, ‘তোমাকে দেখলেই মনে হয় দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে।’ ক্ষুর-জিহ্ব বার্নার্ড শ সঙ্গে সঙ্গে স্থূল চেস্টারটনকে বলেছিলেন, ‘অবশ্য তোমাকে দেখলেই বোঝা যায় দুর্ভিক্ষের কারণটা কী !’
এত সব কথা বলতে গিয়ে ওজনের গল্পগুলো কিন্তু ঠিকমতো বলা হল না। অন্তত দুটো বলা যাক।
একবার এক প্রগলভা সুন্দরীকে কে যেন না বুঝে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি একটু মোটা হয়ে গেছেন নাকি ?’ প্রশ্ন শুনে ভদ্রমহিলা চোখ নাচিয়ে বললেন, ‘বাজে কথা। এই জংলি শাড়িটার জন্যে এমন দেখাচ্ছে। জামাকাপড় খুলে আগেও আমার ওজন ছিল একশো চার পাউন্ড, এখনও সেই একশো চার পাউন্ড।’ এ ধরনের জবাবে ভদ্রলোক চমকিয়ে গিয়ে বললেন, ‘তাই নাকি ?’ মহিলা মোহিনী কণ্ঠে বললেন, ‘কেন ? সন্দেহ হচ্ছে ? দেখবেন ?
এ গল্পটা সুরুচির উপকূল ছুঁয়ে গেল। এরই পাশের গল্পটা অনেক ছিমছাম। একটি অত্যন্ত রোগা, চোখে হাই পাওয়ার চশমা, সত্যবাদী যুবক ইন্টারভিউ বোর্ডের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘চশমাসুদ্ধ আমার ওজন একাশি পাউন্ড।’ ইন্টারভিউ বোর্ডের চেয়ারম্যান জানতে চেয়েছিলেন, ‘চশমাসুদ্ধু ওজনের দরকার কী ?’ ছেলেটি নিজের মোটা কাচের দিকে নির্দেশ করে বলেছিল, ‘চশমা খুলে ফেললে যে আমি ওজনের স্কেলটা পড়তে পারি না।’
সবশেষে আমার নিজের ওজনে ফিরে আসি। ওজন কমানোর চেষ্টায় এখন আমার দমবন্ধ দিন কাটছে। কিন্তু আরম্ভটা হয়েছিল হালকাভাবে। অন্য একটা অসুখের সূত্রে ডাক্তারবাবু বললেন, অতিরিক্ত মেদ আমার অসুখের কারণ। তিনি নিজেও আমার থেকে কম মোটা নন। কিন্তু আমাকে বললেন, ‘আমাদের দশ কেজি ওজন কমাতে হবে।’ প্রস্তাব শুনে আমি খুশি হয়ে বললাম, ‘আজ্ঞে নিশ্চয়, আপনি পাঁচ কেজি, আমি পাঁচ কেজি।’ ডাক্তারবাবু খুশি হননি।