নিজেদের রেললাইন
দ্বারকাপ্রসাদ রামেকা সরকারি নিলাম থেকে রেলের একটা ঢাউস ইঞ্জিন কিনে ফেলল। এর আগে সে আস্ত একটা বস্তি কিনেছে। কিনেছে ফেল-পড়া সার্কাসের পেল্লাই তাঁবু, খাঁচাসুদ্ধ বাঘ—এমনকি দুনিয়াময় ধার ছড়ানাে তেজারতি কারােবার।
কিন্তু আস্ত একটা রেলইঞ্জিন এর আগে সে কখনাে কেনেনি। রীতিমতাে রেলইঞ্জিন। হুইসিল মারার হান্ডিল আছে। সেখানে একসময় ডাইভার হাতের ভারে ঝুলে পড়ে বাঁশি বাজাত। লাইনের ওপর গােরু থাকলে সরে যেত তখন। স্টেশন মাস্টার বুঝত, গাড়ি ঢুকছে। পাবলিক টের পেত—এইবার গাড়ি ছাড়বে।
ইঞ্জিনের নাকটা ইস্পাতের তৈরি পেল্লাই এক পাশবালিশের ডগা বটে। ছােটো চাকা বড়াে চাকা মিলিয়ে মােট ষােলােখানা চাকা। তারা ইঞ্জিনের দুপাশে মােটা মােটা ইস্পাতের ডান্ডিতে জোড়া। না জানি এ ইঞ্জিন কোথায় মাল আর প্যাসেঞ্জার গাড়ি নিয়ে ছুটেছে।
সরকারি নিলাম খাতায় ইঞ্জিনটার বয়স সাতাত্তর। শেফিল্ডে তৈরি। দ্বারকাপ্রসাদ রামেকা নিজে এখন চৌষট্টি। জন্ম নারায়ণগঞ্জে। তার মনে হল, এ ইঞ্জিন না হােক হাবড়া-কালকা করত নিশ্চয়। যখন তাগড়া ছিল ইঞ্জিনটা তখন হয়তাে হাবড়া থেকে এক ছুটে মােগলসরাই চলে যেত। ফিরত অমৃতসর মেল টানতে টানতে। চাই কি ফিরেই হয়তাে ওকে আবার বােম্বাই মেল নিয়ে রায়পুর অব্দি যেতে হত। কত কত লাইনের মাল আর মানুষ নিয়ে ওকে সারাজীবন কারােবার করতে হয়েছে। সারাজীবন বলা ঠিক হল না। বরং বলা যায় ইঞ্জিনটার চাকরি-জীবনে। কিংবা দৌড়ের জীবনে। এখন এই অবেলায় নিউ-জলপাইগুড়ি স্টেশনের ইয়ার্ডে ও নিলামে বিক্রি হয়ে গেল।
স্টেশনের সাইডিংয়েই পড়ে আছে সাত বছর। দ্বারকাপ্রসাদ রামেকা সাত সাতজন নিলামদারের ডাক টপকে তবে ইঞ্জিনটাকে ধরেছে। দুর্গাপুজোর পরের আকাশ। সুন্দর পিচ রাস্তা পাহাড়ের ওপারের চা-বাগানের দিকে চলে গেছে। রােজ এই ইঞ্জিনটাকে দেখতে দেখতে দ্বারকাপ্রসাদ তার সাইকেলে চা-বাগানের দিককার চড়াই রাস্তা ভাঙে।
নিলামে ডাক দিতে যারা এসেছিল—তারা দূরের দূরের। কলকাতার এক পার্টির গাড়ি করেই ফিরে গেল। দার্জিলিংয়ের তিনজন ফিরল জিপে। বাকিদের দেখা যাচ্ছে না। দ্বারকাপ্রসাদ স্টেশনমাস্টারের ঘরে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে নমস্কার করল, সরকারবাবু—
আরে করেন কী! করেন কী ? আপনার মতাে মানুষের আমায় অতটা নমস্কার করার কথা নয়।
সে কেনাে সরকারবাবু?
বেশি কথা বাড়ালেন না স্টেশনমাস্টার। জানেন তিনি,—এবারে দ্বারকাপ্রসাদ মানুষের ভেতরকার ভগবানের কথা তুলবে। তার মানে আরও তিরিশ মিনিট।
একটা গুডস ট্রেন ছাড়বে।
কাজের কথায় আসুন। তাড়াতাড়ি বলুন। ইঞ্জিনটা কিনলম—
সে তো আপনি কিনেই চলেছেন। কোনওদিন দেখব স্টেশনটা কিনে ফেলেছেন!
না। সে কিছু না। আপনার ইয়ার্ডে অফসাইডে রেখে গেলাম। আপনি একটু ইঞ্জিনটা দেখবেন।
হাে হাে করে হেসে উঠলেন স্টেশনমাস্টার। তারপর থেমে বললেন, নিশ্চিন্তে যান তাে। ওকি পকেটে পুরে নিয়ে যাবার জিনিস? ও আবার দেখব কী। যান যান—বলেই তিনি নিজের কাজেই লেগে গেলেন।
স্টেশনের বাইরে এসে দ্বারকাপ্রসাদ রামেকা বাঁ-পা প্যাডেলে রেখে হপ করে করে ডান-পা শূন্যে তুলে সাইকেলের সিটে বসল। খানিকটা সরল সমতল রাস্তা। তারপরেই সাইকেল গিয়ে পড়ল রাস্তার চড়াইয়ে। দু-ধারে পাহাড়ি ডাঙা। ধুমধাম করে আকাশের দিকে উঠে গেছে। ওপরে উঠতে পায়ের খােবলা ফেটে যায় রামেকার। সামনেই দু-ধারের চা-বাগানে চায়ের ঝােপ। ঢেউ দিয়ে দিয়ে ওপরে উঠে গেছে। কচি পাতায় ছায়া দিতে মাঝে মাঝে ডালপালা ছড়ানাে ঝকড়া গাছ।
হই রামেকাজি।
হই—বলে বলে সাইকেলে এগােয় রামেকা—আর বাগানের এক এক জায়গায় মদেসিয়া মাতব্বরদের সেলামের জবাব দেয়।
চরশির মােড়ে এসে বড়াে বটতলার পাশ দিয়ে গিয়ে রামেকা ভবন। এই পথটুকু পার হবার সময় দ্বারকাপ্রসাদের রােজ মনে হয়—আঃ! কী মুক্তি! গাছপালার ভিতর দিয়ে হিমালয়ের ছােটোবড়াে পাহাড়ের মেলা। বর্ষায় কোনাে কোনাে পাহাড়ের গা জলের ঢাল খুবলে খেয়ে লাল দগদগে করে দিয়েছে। তাতে শীতের পড়ন্ত রােদুর। এই পথটুকু পেরিয়ে এসে দ্বারকাপ্রসাদের মনে হবেই—কী এক অফুরন্ত শান্ত আনন্দ তার জন্যে থমকে থেমে আছে এখানে।
রামেকা ভবন দেখতে অতি সাধারণ। এখানে থাকে রামেকা পরিবার। বউ, ছেলেরা, বড়াে মেয়েরা, ছেলের বউ। ছেলেদের মােপেড গাড়ি। আর নিলামে কেনা জিনিস-পত্তরের স্যাম্পেল।
দ্বারকাপ্রসাদের বউ অগস্তি কাঠের বারান্দার লাগােয়া রান্নাঘরের দোরে বসে পুরঠাসা করলা দিয়ে ভাত মাখছিল। দেখেই দ্বারকাপ্রসাদ রাগে রাগে বারান্দায় উঠে এল, আবার ভাত খাইতে বসলি। ডাগদারবাবুর বারণ শুনবি ? পা ফোলা কিন্তু বন্ধ হয়নি।
ফুলুক। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে তােমরা পাটের কারােবার করলা দুইশাে বছর।
দ্যাখ, অগস্তি। তিরিশ বছর হইল পাট ছাইড়া ইন্ডিয়া আইসা লােহা ধরছি। পাটের কারােবার ছাইড়া নিলামের বেওসা। আর তুই ভাত ছাড়লি না—
তােমরা শীতলক্ষার পাড়ে দুইশাে বছর ভাত খাইছ। আমি তাে কারােবারি—ঘরে থাকি—তাই ভাত খাই! তবে করেলা যােধপুরি করে রাধিস কেন? এই তােমরা শিখাইছাে।
ছেলের বউ কাছাকাছি থাকলে এমন খােলাখুলি কথা বলতে দ্বারকাপ্রসাদের কেমন লজ্জা করে। অগস্তি মােটা, ফর্সা মানুষ। চার ছেলে তিন মেয়ে হয়ে গেল তার। অথচ বড়াে ছেলের বউয়ের একটাও বাচ্চা হল না।
দেশভাগের সময় দ্বারকাপ্রসাদ তাগড়া জোয়ান। তাই পাট ছেড়ে এদেশে এসে নিলামিতে নেমে দিনরাতের খেয়াল করেনি। তাই এই বাড়ি—জায়গা জমি। বেওসা বেড়েছে—অগস্তিরও একটা একটা করে বাচ্চা বেড়েছে। এখন মােটা হয়ে গিয়ে থপথপ করে হাঁটে। ভাতটা খায় সুখ করে। পা ফোলে।
চারপাইয়ে বসে বাঁ পায়ের ওপর ডান পা আরামে ফেলে দিয়ে দ্বারকাপ্রসাদ সবে কাত হচ্ছিল। এমন সময় বড়াে ছেলে বিরজুপ্রসাদ বাড়ির সামনের মাঠে ভটভটি থেকে নামল। সিধে এসে বলল, বাপু ইঞ্জিন ডাকছেন শুনলাম ?
এদের জন্ম ইন্ডিয়ায়। তবু মা-বাপের কথার ধাঁচ ওদের কথায় ঢুকে গেছে। হা। নিলামে খরিদ করলাম। কেন?
অত বড়াে মাল কাটাতেই যাবে ছে মাহিনা। তারপর আল আল করে বেচতে আরও ছ-মাস লাগবে।
তাই বলে আস্ত একটা ইঞ্জিন কেনব না? এতকাল তাে ভাঙা ট্রাকটর, আর্থমুভার কিনলম। দেখি না একটা ইঞ্জিন কিনে কী হয়—
বয়লারে কিছু তামা পাইবেন। ব্যাস! তারপর তাে সিরিফ লােহা। লােহা নারে—ইস্পাত। যেখানে হাত দিবি ইস্পাত—শুধু ইস্পাত।
সে তাে আরও কঠিন হইল বাপু। পার্ট বাই পার্ট কাটাই করাও তাে কঠিন হইবে। তারপর অতবড়াে মাল বেচবেন কুথায়?
সে ভাবনা আমার। তুই এতবড়াে লায়েক হইলি—বেটার বাপ হলি না।
বড়ােছেলে একদম ঘাবড়াল না। ইঞ্জিনের বাত হইচ্ছে—বেটার কথা আসে কোথা থেকে? আঁ? না হােক লাখাে টাকা ওখানে ঢালিয়া দিলেন।
লাখাে লাগে নাই। নিরানব্বই হাজার। জিনিসটার দাম কত হবে বল তাে?
পানচ্ লাখ | বেওকুফ। কমােম বিশ লাখ রুপিয়া। তাও তাে বুঢ়া ইঞ্জিন। দৌড়ায় না।
খদ্দের পাইবেন! আমি তাে বলি নিরানব্বই হাজার বেহুদা ইঞ্জিনটায় আটকায় রাখলেন। আর এখনই নগদা রুপিয়া সবচেয়ে বেশি দরকারি। মাধেসিয়া মাতব্বররা দেশে যাইবে। ওদের এখন টাকা লাগবে।।
লাগলে দেব। ইঞ্জিনের দোষ কী? আস্ত একটা ইঞ্জিন।
বেশ তাে। বাড়ির সামনের জমিনটায় রেললাইন বসাইয়া দেন বাপু। নতুন পাতা লাইনে আপনার ইঞ্জিন দেখতে সবাই রামেকা ভবনে আসবে।
যদি লাইন বসাইতে পারতাম তাে রামেকা ভবনে সবার আসতে হইত। বাঃ! বাপু!! নিজের একটা রেলকোম্পানি খুলেন তাইলে
আর কথা এগােল না। হিমালয়ে সন্ধ্যা এল। এল রামেকা ভবনেও। জঙ্গলের কাঠ কেটে বানানাে দোতলা। কাঠের সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে যায়। ছেলেরা। একতলায় থাকে দ্বারকাপ্রসাদ, অগস্তি আর তিন মেয়ে।
অ্যালােপ্যাথির ওষুধগুলাে তাকে তােলা। দ্বারকাপ্রসাদ দেখল, চুলাের ওপর তাওয়া বসিয়ে অগস্তি একখানা থান ইট গরম করল—তারপর সেখানা পায়ের পাতা, কাপড়ের ওপর দিয়ে কোমরে সেক দিতে লাগল। দিতে দিতেই জানতে চাইল—আপনি শােনলাম আস্ত একখানা ইঞ্জিন কেনছেন।
দ্বারকাপ্রসাদ লাে-ভােল্টের আলােয় দেওয়ালে নিজের মাথার চ্যাপটা ছায়া দেখছিল। অগস্তি তখনাে তার মুখের দিকে তাকিয়ে।
কোনাে জবাব না পেয়ে নিজেই অগস্তি একসময় বলল, তা ভালাে করছেন। আমাদের কোনাে ইঞ্জিন ছিল না। একটা ইঞ্জিন হইল।—বলেই ঠান্ডা হয়ে আসা থান ইটখানা তাওয়ার ওপরে আবার গরম করতে দিল।
এবারও কোনাে জবাব না দিয়ে দ্বারকাপ্রসাদ চুপ করে থাকল। মেজো ছেলে সরযু গেছে চিন্নাগুড়িতে। ওখানে মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টে তাঁবু, বেলচা, লরি, জিপের নিলাম আছে কাল। পরের ছেলেটা বানারহাট কমার্স কলেজে আজ চার বছর ধরে শুধুই ধ্যাড়াচ্ছে। এবার ওখান থেকে ছাড়িয়ে এনে বিনােদকে বেওসায় জুতে দেওয়া দরকার।
অগস্তি তাকে কখনাে আপনি বলে। আবার কখনাে তুমিও। কোনাে সাধআহ্লাদ কিংবা ওদের নিজেদের জীবনের লম্বা-চওড়া কোনাে বাত হলে—অগস্তি এইভাবে বলে—আপুনি তাে কম খাটেন নাই। জীবনটারে দাঁড় করাইলেন। কিংবা বলবে—চলেন যাই—শুইয়া পড়ি। এইবার ল্যাপতােশক ঠান্ডা হইতে আরম্ভ করবে।
আবার খেয়াল হলে বলবে—এই যে এতগুলান পােলাপান—কোনােদিন কি ভাবছ—তুমি এতবড়াে একটা ফেমিলির বাবা হইবা! | এখন বলল, আপুনি ইঞ্জিনের মালিক হইলেন—জিনিসটা আমাদেরই দেখাইলেন না!
কালই সূর্য উঠলে দেখবা।
দ্বারকাপ্রসাদ আদর করে ডাকার সময় নির্ঘাত তুই-তুই করবে। যেমন এখন বলল, দ্যাখ বিরজুর মা—তুই ভাতটা ছাড়। এই বলে দিলম। ভাতটা ছাড়। কোনদিন ভাতের থালিতে মরে পড়ে থাকবি। দ্বারকাপ্রসাদের নাম পাহাড় ডিঙায়ে ছড়াইয়া পড়বে একদিন—কিন্তু তুই থাকবি না দ্যাখতে।
কী আর করবেন। আপুনি তখন কচি দেইখা একটি মেয়ে বিয়া করবেন।
চুপ কর। এখনাে আমার তিন ছেলের বিয়া বাকি। মেয়েরা বড়াে হইতেছে। বেওসা বাড়বে আরও।
আজকাল সেজো আর ছােটো ছেলে রুটি চিবােলে ওদের চোয়াল ওঠে পড়ে—ইঞ্জিনের পিস্টন লাগে যেন। সেই চোয়ালে কচি দাড়ির রেখা পড়েছে। খেতে বসে দ্বারকাপ্রসাদের চোখে কিছুই এড়াল না। শেষের ছেলে দুটো তাহলে জোয়ান হয়ে যাচ্ছে। আর কী চিন্তা। এমন চার ছেলে মানে—সে এখন চারপাইয়ে শুয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারে।
খেতে বসে শেষের দুই ছেলে আর মেজো মেয়েটা ইঞ্জিনটার কথা বলতে লাগল। শেষে ছােটো ছেলে জানতে চাইল, বাপু! ডিজল বা স্টিম ইঞ্জিন? | এই ছেলে পড়াশুনােয় ভালাে। একা একা পড়ে। চা-বাগানের বাইরের স্কুলে হায়ার সেকেন্ডারি পড়ে। হ্যা। একটা প্রশ্নের মতাে প্রশ্ন করেছে। নিলামের সরকারি অ্যাডভার্টাইজে ছিল, ইস্টিম ইঞ্জিন। তাই বলল দ্বারকাপ্রসাদ। বলে জানতে চাইল, কেন চালাইবি নাকি ইঞ্জিনটা ?
তিন মেয়েই একসঙ্গে হেসে উঠল। আমরা বাপু নিজেদের ইঞ্জিনে বসব। আর তােমার বেটা প্রকাশ রামেকা ইঞ্জিন চালাইবে।
ছােটো ছেলে প্রকাশ বলল, কী করে চালাইব? নিজেদের রেললাইন কোথায় ?
ওঃ! তাের আবার নিজেদের রেললাইন দরকার! তবে কি বাপু সরকারি লাইনে তােমারে তােমার ইঞ্জিন চালাইতে দেবে? | এইভাবে নতুন কেনা ইঞ্জিনটা রাতের খাওয়া-দাওয়ার পরেও ওদের কথাবার্তায় রাজত্ব করতে থাকল। হিমালয়ের পাহাড়গুলাে থেকে একসময় একটা ভিজে গভীর রাত গড়িয়ে এসে ওদের ঘরবাড়ি, উঠোন, গােহাল, নিলামদারির স্যাম্পেল ছড়ানাে খােলা মাঠ, গাছপালাকে ঢেকে ফেলল।
দ্বারকাপ্রসাদ তার ঘরের জানালা দিয়ে রােজ সকালে ঘুম থেকে উঠে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে। তাই সে ডানকাতে শুয়ে। কান অব্দি ভুটানি কম্বল। দুরে কুয়াশার ভেতর নতুন রেলস্টেশনে মালগাড়ি শান্টিং হচ্ছিল। তার ঘটাং শব্দ কুয়াশায় ভেসে এসে একটা ফুটো দিয়ে দ্বারকাপ্রসাদের বুকের ভেতর ঢুকে গেল।
ঘুমন্ত বলেই সেই ঘটাং দ্বারকাপ্রসাদের বুকের খাঁচার ভেতর ঘুরপাক খেতে খেতে হাড়ের কড়ি-বরগায় ধাক্কা লেগে ফুসফুসের জালে গলে গলে পড়তে লাগল। তখন দ্বারকাপ্রসাদের সারা বুক জুড়ে একটাই হুইসেল বেজে উঠল।
দ্বারকাপ্রসাদ রামেকা অবাক হয়ে দেখল, সে নিজেই দিব্যি ইঞ্জিনটা চালাচ্ছে। তার মাথায় ফানেলের ময়লা পটি। গায়ে মােটা কাপড়ের ফতুয়া। বাঁ-হাতের কক্তিতে উল্কি দিয়ে লেখা—ড়ি পি আর। পাশেই দাঁড়িয়ে অগস্তি। ওড়না দিয়ে ঘােমটা টানা। গায়ে বিয়ের সময়কার ঘাগরা! ইঞ্জিন চমৎকার গড়গড়িয়ে চলেছে। দুপাশে চা-বাগানের ঝােপ। তাতে পাহাড়ি প্রজাপতি এসে বসছে। বসেই ঝােপ বদলাচ্ছে।
ঘুম ভাঙলে দ্বারকাপ্রসাদ দেখল, রােদ উঠে গেছে। বাড়ির সবাই উঠে পড়েছে। অগস্তি গােহাল থেকে দুধ আনছে বালতিতে। দ্বারকাপ্রসাদ তখনাে মনে মনে ইঞ্জিন চালাচ্ছিল।
সকালবেলার রােদুর ঠান্ডার মােড়কে আবছা করে দিচ্ছিল সবকিছু, আবার সবকিছু ওই রােদেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। ফেনা তােলা দুধের বালতি হাতে বারান্দায় উঠেই অগস্তি জানতে চাইল, কোথায় যাও?
ইঞ্জিন দেখবি না?
অগস্তি ঠা ঠা হেসে উঠল। তারপর বালতিটা রান্নাঘরে বড়াে থালায় ঢেকে রেখে বেরিয়ে এসে বলল, যাব। কিন্তু এখন কি টাঙা পাইবেন?
রামেকা বস্তির লখানি এখন টাঙা নিয়ে যাইবে টিশন। তাকেই থামাইবা।
ছেলেরা ঘুমাইতেছে। বড়কা কাল বেশি রাতে ফেরছে। আপুনি তখুন ঘুমে—
ডাকাডাকির কাজ নাই। তুই যাবি তাে চল।
লখানির টাঙা যাচ্ছিল স্টেশনে। সে রামেকা বস্তির বাসিন্দা। দ্বারকাপ্রসাদ হাত তুলতেই থামল। অগস্তিকে অনেককাল পরে টাঙায় পাশে বসিয়ে দ্বারকাপ্রসাদ মালগাড়ির শান্টিং এলাকায় গিয়ে থামল। অগস্তিকে অনেক সাবধানে নামাল, ওই দ্যাখ
কয়েকটা রংচটা মালগাড়ি মাটিতে মুখ থুবড়ে ছাইগাদায় কতকাল আধখানা মতাে গেঁথে গিয়ে পড়ে আছে। তাদের পাশে রেললাইন ঘাসে ঢাকা বাফার গিয়ে শেষ। সেখানটায় কালাে মতাে ঢাউস ইঞ্জিনটা চুপচাপ দাঁড়ানাে।
খুশিতে অগস্তির মুখ চকচক করে উঠল, করেছেন কী? এ যে একদম আসলি ইঞ্জিন!
আসলি কীরে অগস্তি। দ্বারকাপ্রসাদ কখুনাে নকলি মালের নিলামে যাবে?
অগস্তি দেখল, তার পাশেই তার মাথা ছাড়িয়ে ইঞ্জিনের চাকা। পর পর তিনখানা। এক মাপের। আর সামনের পাঁচটা চাকা কিছুটা ছােটো হয়ে এক মাপে ইঞ্জিনের নাকটা ঘাড়ে করে লাইনে দাঁড়ানাে।
আপুনি কেত্তো বড়লােক আছেন? হাঃ! হাঃ! হাসাইলি অগস্তি। এই এক ইঞ্জিনে লাখাে রুপেয়া লাগাইলাম।
আপুনি তাে শেঠ আছেন। পানচ্ সিকা দিবেন। ইঞ্জিনের নামে সিন্নি চড়াইব।
সিকার দিন আর নাই অগস্তি।
এতবড়াে একটা যন্তর কেনলেন আপুনি। কিন্তু দেখার কেউ নাই। আপুনার বাপু নাই। মা নাই। দ্যাখলে খুশি হইতেন খুব। আপুনার বংশে কেউ কোনােদিন ইঞ্জিন কেনতে পারে নাই–
আমিই কি জানতাম—কোনােদিন আমি আস্ত একটা ইঞ্জিন কেনতে পারব।
ড্রাইভারের পাদানির কাছে রেলের বড়াে নিলামি টেবিল পড়ে ছিল। কাল ডাকের পর আর ভােলা হয়নি। আজ হয়তাে আবার নিলাম হবে—তাই পড়ে আছে। সব নিলামি ডাকে দ্বারকাপ্রসাদ যায় না। আজ হয়তাে ঘিউ, পচা ডাল কিংবা চটের বস্তার লট ধরে ধরে নিলাম হবে।
সেই টেবিলের ওপর অগস্তিকে টেনে তুলে দ্বারকাপ্রসাদ রামেকা বউসমেত স্বচ্ছন্দে ইঞ্জিনে গিয়ে চড়ল। সকালবেলার পরিষ্কার রােদে তখন ইঞ্জিনের গায়ের তামার সরু নালিগুলাে ঝকঝক করছে। তামার লাইনিং কালাে মিশমিশে ইস্পাতের জোড়ে সরু কিন্তু লােভের একদম সরল রেখা। খদ্দের রেল থেকেই খবর পেয়ে সিধে চলে আসবে। সেদিক থেকে চোখ টেনে এনে দ্বারকাপ্রসাদ বলল, এই দ্যাখ—এই হল গিয়ে বানশি মচাবার হন্ডিল। এইটেয় চাপ দিলে লাইনের ওপর হইতে সবাই সরে যায়।
একটু বজাইবেন? ছােট্ট করিয়া বজাইলে কেউ কি কিছু বলিবে? দূর পাগলি! এ ইঞ্জিন তাে এখন আমাদের। কে কী বলিবে!
তবে বানশি বাজান না। খানিক শুনি। শুনে বুঝি—আওয়াজ মিঠেলি, না ক্যাওড়া আছে।
ইঞ্জিনের কয়লা তােলার জায়গাটা খাঁ-খ। সেখান থেকে প্ল্যাটফর্মের একট | দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়ে দ্বারকাপ্রসাদ বলল, এখন বাজাইলে অন্য গাড়ির লাইন ভুল হইবে অগস্তি। ওরা তাে বানশির জ্বালানি দিয়া চলাফেরা করে।
এবার ইঞ্জিনটার বয়স ধরা পড়তে থাকল চোখে। আলিসান লাশ। নাকের জায়গায় কয়েকটা জোড় খুলে গিয়ে বিরাট বিরাট জং, সেখানে ঢাউস নাকের পাচড়া খুলে গিয়ে হল-হল করছে।
ফাকা বয়লারের মুখে কাচের ফাকা বাক্স। ওখানে একসময় জল আর ইস্টিম পাশাপাশি থেকে জানিয়ে দিত ধোঁয়ার চাপ কতটা। কেমন জোরে ইঞ্জিন দৌড়বে। এসব কথা কাল নিলামের সময় শুনেছে দ্বারকাপ্রসাদ।
এই? করিস কী? করিস কী?
অগস্তি কোনাে জবাব দিল না। সে তার সিথির সিঁদুর আঙুলের ডগায় তুলে ইঞ্জিনের কালাে গায়ে স্পষ্ট করে চোখের ফাদ আঁকল। তারপর তাতে
একটা ফোটা বসিয়ে দিয়ে বলল, ডালা কুলা আনি নাই। তাই এইভাবে বরণ করলাম।
থাম বললাম। থাম অগস্তি।
গাই আনলে বরণ করেছিলাম। আর এতবড়াে একটা দানাে আনলেন—বরণ করব না?
দানাে? বলে হাে হাে করে হাসল দ্বারকাপ্রসাদ। ঠিক বলছিস। দানােই বটে! এক সময় হাজারাে প্যাসিঞ্জার নিয়ে হাজার হাজার মাইল ছােটসে— | অগস্তি দুই হাতে দ্বারকাপ্রসাদের ডান হাতখানা জাপটে ধরল। চারদিকে লােকজন। ছাইগাদায় বাতিল ওয়াগানের সারি সারি কবর। কামরার স্পেয়ার চাকা লাইনের পাশেই লাটাই করে থাক থাক সাজানাে। তার পাশেই স্লিপারের থাক। বেয়ারিংয়ের ধনুক লােহার গাদি। বাফার পেরিয়েই ডুমুর গাছ আর পাতি ঘাসের জংলা। পােড়াে মাঠ।
করিস কী? করিস কী অগস্তি ? ইটা কি ছেলছাড়ের সময় ? না জায়গা? তাের হইল কী?
আপুনি আমার একটা কথা রাখেন। আরে ছাড় তাে আগে।
ছাড়ব না। আগে বলেন। কী বলব? এ ইঞ্জিনটা কাটাই করে ভাগে ভাগে বেচিয়া দেবেন না। আগে ছাড় তাে আমার হাত। কে কোথা থেকে দেখবে শেষে অগস্তি—
বিহার পরে আমি কোনােদিন কিছু চাই নাই আপুনার কাছে। সােনা চাই নাই। ঘাগরা চাই নাই। এক শিশি ইমলির আচারও চাই নাই কোনােদিন।
বেশ তাে।
এই ইঞ্জিনটা আমার চাই। এটাকে আর কাটাই করে ভাগায় ভাগায় সাজাইবেন না। খরিদার আইলে বেচবেন না। আমাদের দুইজনের জন্য থাকুক।
শুধু আমাদের দুইজনের জন্য।
শুধু দুইজনায় চড়ব! না? স্রিফ দোনাে! বলতে বলতে চোখ বুজে গেল অগস্তির। সেখানটায় তাকিয়ে দ্বারকাপ্রসাদের ধক করে উঠল বুকটা। ওই দুই কোটরে একসময় ঝকঝকে আনন্দ হয়ে দুটো কালাে মণি টলটল করত। এখন সেখানে ফোলা ফোলা মাংসের ভেতর ছাতারে পাখির লেজ যেন। ছাই রং ঘােলাটে হাজার বললেও অগস্তি চশমা নেয় না। বলে, আমি কি পড়ি? না, লিখি?
দ্যাখাে তাে বটে—
তা সে কাজ এই চোখে চলিয়া যায়।
এবার দ্বারকাপ্রসাদ অগস্তির মুখ থেকে ওপরে তাকাল। গাছপালাসমেত পাহাড়ের মুণ্ডু নিয়ে দুনিয়াটা চোখের সামনে যেন এক দৌড়ে গড়িয়ে চলে এসেছে। এরকম এসেছে বলেই না পাহাড় পর্বত গাছপালা এখানে মনােহারী সিনসিনারি। ফি বছর সিনেমাওয়ালারা এদিকটায় ছবি তুলতে আসে। দ্বারকাপ্রসাদ খুব গুহ্য কথা বলার ধরনে অগস্তির কাছাকাছি হল। শুন অগস্তি আমি এখনাে কী কী নিলামে কিনি নাই?
আপুনি বলেন না কেন নিলামে এখনাে কিনি নাই—রামচরিত মানস, হনুমানজি, হিমালয়, গঙ্গাজি, মহাভারত, মা-বাবা, বউ-বেটা—
মাঝখান থেকে অগস্তি বলল, আরও অনেক কিছু কেনেন নাই। রেলবাই, পেলাটফর্ম, খাবার পানি, হাঁতি, সুখশান্তি
ঠিক বলেছিস। কিন্তু রেলবােয়ে লাইন কিনি নাই। তাে ইঞ্জিন রাখবি কোথায় ?
জবাবে কী বলতে যাচ্ছিল অগস্তি। কিন্তু হঠাই দেখল, দু-ধারের ছাইগাদা পেছনে পড়ে যাচ্ছে। ঘাসে ঢাকা কাঠের বাফারও পেছনে সরে যাচ্ছে— | চমকে গিয়ে অগস্তি বলে ফেলল, এই বিরজুর বাবা—দেখেন কেন কী হইতেছে। এ ইঞ্জিন তাে আপুনি চলে—
তাই তাে। কে চালায়? বলে কয়লা গাদি দেওয়ার ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দ্বারকাপ্রসাদ ভয়ে-উত্তেজনায় লােহার মই বেয়ে ওপরে উঠল। মনে মনে সে বলল, বঢ়িয়া ইঞ্জিন তাে ! ইস্টিম নাই, ড্রাইভার নাই—তাও চলে? | দুজনে কথাবার্তায় অ্যাতােই মশগুল ছিল—খেয়ালই করেনি—কখন একটা লাইট ইঞ্জিন ব্যাক করে এসে এই ইঞ্জিনটার পেছনে শিকলি বেঁধেছে। তারপর টানতে শুরু করে দিয়েছে।
দ্বারকাপ্রসাদ বলল, সামনের টিশানে ডবল লাইন আছে—ওখানে গিয়েই ইঞ্জিন থামবে।
অগস্তি জানে না, কী করে ইঞ্জিনের চাকা গড়াচ্ছে। সে হাসতে হাসতে বলল, জবর ইঞ্জিন কেনছেন। সুন্দর চলে।
দ্বারকাপ্রসাদ দেখল, কীভাবে ইঞ্জিন চলছে তা খুঁজে দেখার মতাে বুদ্ধি বা ইচ্ছে কোনােটাই অগস্তির নেই। ইঞ্জিনটা নিজেদের হওয়ায়—সেই খুশিতেই
অগস্তি মজে আছে। তারপর আবার ইঞ্জিন ছুটছে—একদম ডবল খুশি।
কতকালের পড়ে থাকা জং ধরা জিনিস। তবু রীতিমতাে জবরদস্ত। ঘটানং ঘটানং শব্দ করে পেছনের টানে দিব্যি গড়গড়িয়ে চলেছে। কিন্তু ইঞ্জিনটার সারা শরীর থেকে ঢিলেঢালা সব আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। শেষে খুলে পড়ে যাবে না তাে?
সকালবেলার রােদের ভেতর দিয়ে কালচেপানা জিনিসটা পেছন মুখাে হয়ে ছুটছে। দ্বারকাপ্রসাদ বুঝল, রেলের লােক এইভাবে ইঞ্জিনটাকে প্রায়ই জায়গা। বদলে বদলে রাখে। নিশ্চয় অন্য কোনাে গাড়ি বা মালগাড়িকে জায়গা দিতেই।
কত না বৃষ্টি—কত না রােদ খেতে খেতে ইঞ্জিনটা বছরের পর বছর সাইডিংয়ে পড়ে থেকেছে। এতদিনে বাফা যেত—যদি না মাঝে মাঝে এমন ঘটানং ঘটানং করে পেছনের টানে এই বিরাট লােহার বান্ডিল নাক, আট জোড়া চাকা আর কয়লার ফাকা ঘর সমেত জায়গা বদলাতে বাধ্য হত।।
এবারে দুরে স্পষ্ট রােদে পাহাড়গুলাে হাসতে লাগল। রেললাইনের দুধারের জঙ্গলে হাতি-ঘাস মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। রেলকলােনির খাটাল থেকে মােষ চরতে বেরিয়েছে। অগস্তির দিকে তাকিয়ে দ্বারকাপ্রসাদের সারা মন ভরে এল। এখন থপথপ আধবুড়ি। শীতলক্ষার ঘাটে পাট বােঝাই ফ্ল্যাটে জলের কিনার ধরে ছুকরি অগস্তি যখন ঘাঘরা তুলে পা ডুবিয়ে বসত—তখন পরিষ্কার মনে পড়ে দ্বারকাপ্রসাদের—নদীর জল অব্দি থমকে থেমে থাকত। মুখে বলল, এই অগস্তি বাঈ
উ।
তুই আমারে সংসার দিলি। সাত সাতগাে ছেলেমেয়ে দিলি। আমি তােকে কী দিলম!
এই তাে একটা ইঞ্জিন দিলেন। এইবার লােহা-লক্কড় কিনে আমাদের ঘরের পাশে লাইন বসান।
তারপর।
জঙ্গল ইজারা নিবেন। তার গা দিয়ে লাইন বসায়ে পাহাড় তক্ লইয়া যাইবেন—
সে তাে অনেকদূর অগস্তি বাঈ।
ও উচা-নিচা জমি শস্তায় পাইবেন। তার উপর দিয়া রামেকা লাইন যাইবে। নিজেদের ইঞ্জিনে চড়ব। নিজেদের লাইনে গাড়ি ছুটাইবেন—
অগস্তি বাঈয়ের স্বপ্ন দেখা মুখ ঘিরে একটা বড়াে আশার পাতলা কুয়াশা। সেদিকে তাকিয়ে রামেকা টের পেল—দুধারের জংলা দুনিয়া থেমে আসছে। পেছনের ইঞ্জিনটা তাহলে থামল। বেশ দূরে ছােট্ট স্টেশনের ছােট্ট ছাউনি। অনেকগুলাে লাইনে এখানে সেখানে মালগাড়ি ছড়ানাে। গােটা দুই চালু ইঞ্জিন দাঁড়িয়ে হাঁফাচ্ছে।
মাত্র একটা স্টেশন। তবু এখানে কোনােদিন আসেনি দ্বারকাপ্রসাদ। প্যাসেঞ্জার ট্রেন এখানে সব সময় দাঁড়ায় না। সকালবেলার পরিষ্কার রােদুর মালগাড়ি, ইঞ্জিন আর বাফারের গায়ের জঙ্গলের আনাচে-কানাচে দিব্যি ঢুকে পড়েছে। ফলে যেসব জায়গা ছায়া—সেসব জায়গা খাটি, ঘন আড়াল পেয়ে দিব্যি জমাট।
পেছনের ইঞ্জিন থেকে এক ছােকরা খালাসি—দ্বারকাপ্রসাদ বুঝল, হেলপার খালাসি—কেন না দ্বারকাপ্রসাদ তাে দাবিদার শূন্য পচা ডাল, বাতিল দেশলাই, হলুদ হয়ে যাওয়া চিনি নিলামের ডাকের আগে সরেজমিনে যাচাই করতে এসে গুডস ওয়াগন, ইঞ্জিন-ফিনজিন দেখে আসছে আজ প্রায় তিরিশ বছর—বিরজুর বয়সিই হবে ছােকরা—ইঞ্জিনের পাদানি থেকে লাফিয়ে নামল।।
দ্বারকাপ্রসাদ উঁচু থেকে তার মুখে তাকাতেই ওভারঅল গায়ে ছােকরা অবাক হয়ে তাকাল, মুখে কাটা দাগ, বলল, আরে! উহা ক্যায়সে ঘুসা?
একথায় ফোঁস করে উঠল অগস্তি, ক্যায়সা বত্তমিজি? ইয়ে ইঞ্জিন তাে আমাদের—
শুনে তাে হেলপার ছােকরা তাজ্জব। একদম গম্ভীর হয়ে গিয়ে ভক করে হেসে উঠল। তারপর থেমে ডাকতে লাগল, ড্রাইভারসাব। জলদি আইয়ে— রেলবােয়ে ইঞ্জিনকা মালকিন আ গয়ি—! | দ্বারকাপ্রসাদ রামেকা বুঝল, ভাঙা ওয়াগন, বাতিল ইঞ্জিন, গার্ডার, স্লিপার যে নিলাম হয়—ডাল, মশলা, পেঁহু, চিনি, দিশলাইও যে নিলাম হয়—তা এই হেলপার বা তার ড্রাইভার জানেই না।
পেছনের ইঞ্জিন থেকে ড্রাইভার নেমে এল। তাগড়া গোঁফ। স্যান্ডাে গেঞ্জির বাইরের বুকখানা এই সকাল বেলাতেই ঘাস আর কয়লার গুঁড়ােয় মাখামাখি। গাঁইয়া, আনপঢ় কথা দুটো শুনে মাঝবয়সি ড্রাইভারের মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেল। সে রােদ বাঁচিয়ে বড়াে এক চৌকো ছায়ার ভেতর দাঁড়িয়ে কটকটে চোখে ওপরে তাকাল। কইলা ঘরে কইলা নাই। বয়লারে ইস্টিম নাই। ইয়ে মিঞাবিবি ক্যায়সে ঘুসা?
শুনেই অমনি অগস্তি ফেঁস করে উঠল। আপনি কিছু বলছেন না কেন? খোঁচা খেয়ে দ্বারকাপ্রসাদ কী বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই ড্রাইভার হেসে উঠল, কী বােলবে! লাটসাহেব লাটসাহেবাইন ঘুমনে কে লিয়ে রেলবােয়ে ইনজনে— | চুপ রহাে।—অগস্তির গলায় যত জোর ছিল, তার চেয়েও জোরে ধমকাল। দ্বারকাপ্রসাদ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। ইঞ্জিনটা তার নিজের হলেও এমন উঁচুতে তারা দুজনে এখন দাঁড়িয়ে—এখান থেকে সে নিজে কোনওক্রমে নামতে পারলেও অগস্তির নেমে পড়া অতটা সহজ হবে না। তার চেয়েও বড়াে কথা—অজানা স্টেশন ঘর, লােকজন থেকে শান্টিং ইয়ার্ডে এতদূরে মাটিতে দুজনে নেমে পড়তে না পারায় তার নিজের ইঞ্জিনের দশাসই চেহারা সত্ত্বেও জায়গাটা বড়াে অনিশ্চিত লাগতে লাগল দ্বারকাপ্রসাদের। লােক দুটোর তাকানােও ভালাে নয়। জঙ্গল লাইনের হেলপার-ড্রাইভার। আরও মুশকিল—নিজেদের ইঞ্জিন হলেও অগস্তি সে খেয়ালই করছে না—মাটিতে তার নেমে পড়াই এখন কত কঠিন এখান থেকে। এমন সুন্দর সকালবেলা—তার ওপর নিজেদের ইঞ্জিন, তবু সব কত কালাে হয়ে যাচ্ছে। একটু আগেও গড়গড়িয়ে ইঞ্জিনে করে আসার সময় কত আনন্দ ছিল।
অগস্তির ধমকানি ওরা গায়ে মাখল না। ওরা হেসে হেসে ওপরে তাকিয়ে বলল, কোয়! রাজারানি বা !
ইঞ্জিনের পাটাতনে এসে রােদ পড়ছিল। ইস্পাতের চাদর পাতা পাটাতন। তার ওপরেই অগস্তি কোনাে মতে থপথপ করে জায়গা বদলাল। দ্বারকাপ্রসাদকে এগিয়ে দিয়ে বলল, বেহায়া দুটোকে ধমকান না কেন বুঝি না। এ ইঞ্জিন কি আপুনার না?
একশােবার আমাদের। একশােবার অগস্তি— তবে? কারে পরােয়া করেন ? ঠিক এই সময় ধানখাের টিয়ার ঝাক শোঁ শোঁ শব্দ করে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল।
অমনি হেলপার ছােকরা পাদানিতে পা রেখে ওপরে উঠতে এগিয়ে এল। অগস্তিও ওপর থেকে ঝুঁকে পড়ে চেঁচিয়ে উঠল, উতােরাে। উতােরাে। এ হমরি ইঞ্জিন দু পাটি দাঁত বের করে হেলপার বলল, জি রানিজি!
নীচে দাঁড়ানাে ড্রাইভার চেঁচিয়ে বলল, জি সরকার! ইয়ে তাে স্রিফ আপনি টাঙ্গা লাটসাহেবাইন।
দুহাতে বাধা দিতে গেল দ্বারকাপ্রসাদ। পারল না। অগস্তিও এগিয়ে এল। তার হাতের আঙুল হেলপার ছােকরা উলটোদিকে মটকে দিচ্ছিল। ব্যথায় ককিয়ে অগস্তি ইঞ্জিনের বয়লারের ঢাকনায় পিঠ ঠেকিয়ে টাল রাখল। নয়তাে পড়ে যেত। ঠিক সেই সময় হেলপার তার গলার ভারি সােনার হার একটানে ছিড়ে নিল। নিয়েই সে মানুষের মাথার চেয়েও উঁচু পাটাতন থেকে নীচের ঘাসে ঢাকা ছাই মাটিতে লাফিয়ে পড়ল।
ডাকু ! ডাকু !! ডাকাইত ।
অগস্তির এ গলা বেশিদূর গেল না। দ্বারকাপ্রসাদও নীচে লাফিয়ে পড়ল। এবার সে ব্যথা বা চোট লাগার কথা ভাবেনি। তার চোখের সামনে সকালবেলার আকাশ লাল হয়ে গেল। ভেবেছিল, নীচে পড়েই উঠে দাঁড়াবে। এ বয়েসে অনেককাল সে কোনাে লাফঝাপ দেয়নি। পড়েই উঃ !—বলে সামান্য চেঁচাতে পারল মাত্র। হাঁটুর কোথাও কিছু ভীষণ ব্যথা দিয়ে মট করে ভেঙে গেল হয়তাে। ঝিম ধরানাে ব্যথায় একই সঙ্গে সে দেখতে পেল—
ড্রাইভার-হেলপার তাদের ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে তাড়াতাড়ি দূরে সরে যাচ্ছে। দূরে প্ল্যাটফর্মে একটা মালগাড়ি ইন করল। ইঞ্জিনের নাকটা দেখতে খুব বন্ধু বন্ধু। আর | অগস্তিবাঈ উঁচু পাটাতন থেকে থপথপ করে নেমে পড়ার চেষ্টা করছে। বাঁ-পায়ের পাতা আন্দাজে নীচের পাদানি খুঁজছে। হাত হ্যান্ডালে। যদি হাত খুলে যায় তাে টুপ করে খসে পড়বে।
দ্বারকাপ্রসাদ চেঁচিয়ে বারণ করল। আর নামিস না। নামিস না অগস্তি। কিন্তু কোনাে কথাই ফুটল না তার মুখে। সে ইঞ্জিন ওয়াগন মিলে অনেকগুলাে চাকা এক সঙ্গে দেখতে পাচ্ছিল।