নিজেকে দেখ
দুহাজার বছর আগে অ্যারিস্টটল তাঁর ‘দ্য নিকোমাচিয়ান এথিক্স’-এ লিখেছেন : “The second rule is to notice what are the errors to which we are ourselves most prone (as different men are inclined by nature to different faults) and we shall discover what these are.” নিজের দোষ দেখ। অন্যের দোষ অন্যে দেখুক। নিজেকে দেখ। নিজেই নিজের বিচারক হও। সংশোধন কর নিজেকে। তোমার মেরামতি তোমার হাতে। দোষের একটা টান আছে। নিজের চরিত্রে বিপরীত টান আরোপ কর। আমাদের শাস্ত্রে একেই বলে ‘পুরুষকার’। বিজ্ঞানের ভাষায়—’ফোর্স অ্যান্ড কাউন্টার ফোর্স’। খুব ভাল আর খুব খারাপের মাঝামাঝি একটা জায়গা বেছে নাও, “observing the pleasure or pain that we experience.” কিসে আমার আনন্দ, কিসে দুঃখ, আমার চেয়ে ভাল কে বুঝবে! বুঝে নিয়ে “We must drag ourselves away in the opposite direction.” আনন্দ হলে, সুখতৃষ্ণা হলে, তার বিপরীতে, দুঃখ হলে যন্ত্রণাদায়ক হলে তার বিপরীতে, “for by steering wide of our be setting error we shall make a middle course.
পাঁচ হাজার বছর আগে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন :
“সমদুঃখসুখঃ স্বস্থঃ সমলোষ্টাশ্মকাঞ্চনঃ।
তুল্যপ্রিয়াপ্রিয়ো ধীরস্তুল্যনিন্দাত্মসংস্তুতিঃ।।” (গীতা, ১৪।২৪ )
সুখে ও দুঃখে রাগ-দ্বেষ শূন্য হতে বলছেন ভগবান। তৃতীয় অধ্যায়ের ২৮তম শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, তত্ত্ববিদ্ কখনো আসক্ত হন না। অর্থাৎ তাঁর সুখের প্রতি অনুরাগ থাকে না, দুঃখের প্রতি বিরাগ থাকে না—
“তত্ত্ববিত্তু মহাবাহো গুণকর্মবিভাগয়োঃ।
গুণা গুণেষু বর্তন্ত ইতি মত্বা ন সজ্জতে।।”
জীব হলো পঞ্চেন্দ্রিয়ের ‘স্ট্রাকচার’। তারস্বরে এই গঠন হাঁকছে—’আমি, আমি’, ‘আমার, আমার’। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, অর্জুন! সত্ত্বগুণের পরিণাম চক্ষু ও কর্ণাদি ইন্দ্রিয়সকলে, তমোগুণের পরিমাণ রূপ ও রসাদি বিষয়সকলে প্রবৃত্ত আছে। আত্মা কিন্তু নিঃসঙ্গ—এটি জেনে গুণবিভাগ ও কর্মবিভাগের যথার্থ তত্ত্বজ্ঞ কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ করেন।
অহং-এর অবয়বের যেসব ছিদ্র দিয়ে নিন্দা, প্রশংসা, পরনিন্দা, পরচর্চা, আত্মশ্লাঘা ইত্যাদি অনবরত প্রকাশিত হচ্ছে, নিজের মনন বিঘ্নিত হচ্ছে, বৃথা কাজ ও চর্চায় জীবন অতিবাহিত হচ্ছে—সেইসব ছিদ্র ‘সিল’ কর। ঠাকুর বললেন, যে-আমি ফুটো দিয়ে ঠোঁট বের করে ‘আমি’ ‘আমি’ করে, যত ‘তুমি’ আছে, তাদের সমালোচনায় ছাতারে পাখির মতো ক্যাঁচোর ম্যাচোর করে—সেই ‘আমি’টাকে মেরে ফেল। অনেকটা এইভাবে বলেছেন, মার শালাকে!
আমাদের ‘আমি’গুলি সব যেন ‘দাঁড়-ঝোলা-শুকপাখি’। এখন তো চতুর্দিকে শিক্ষিত মানুষের বস্তি! খাঁচার ওপর খাঁচা। ঝুল বারান্দায় পাজামা- পরা ‘আমি’, সেলফোন-ওলা ‘আমি’, বারমুডা-পরা ‘আমি’, শাড়ি-পরা ‘আমি’। সব ‘আমি’ ঝুলছে। দত্ত মিত্তিরের ছেঁদা খুঁজছে। মিত্তির ঘোষের পারস্পরিক ছুঁচে সুতো ঢোকানো। ঘরে ঘরে নানা ডিজাইনে অন্যের দোষের সুতোয় কাপড় বোনা। খটাখট তাঁত। পরচর্চা, পরনিন্দার টানাপোড়েন। এক গাইয়ের চোখে আরেক গাইয়ে ‘গাই’ অর্থাৎ গরু। এক সাহিত্যিকের চোখে আরেক সাহিত্যিক-হুঁ! ও আবার সাহিত্যিক! তাহলে তো শ্মশানঘাটের দারোগা বেদব্যাস! প্রায় সব দেয়ালেই ঠাকুর, মা, স্বামীজীর ছবি। দুটি কথা মুখে মুখে—”যত মত তত পথ”, “শিবজ্ঞানে জীবসেবা”। ‘যত মত তত পথ’-এর নমুনা—বুড়ো বাপ-মাকে আলাদা করে বৌ-ছেলেমেয়েকে নিয়ে ‘সিঙ্গল ইউনিট ফ্যামিলি’ বানানো। আর ‘জীবসেবা’র নমুনা–হয়তো বাড়ির কাজের ছেলেটিকে ঘরে তালাবন্ধ করে কর্তা-গিন্নি তীর্থে চললেন!
ঠাকুর সব জানতেন। তাই ধরে ধরে চাবকাতেন। আত্মজ্ঞান অত সোজা নয়। ছেলের হাতের মোয়া নয়! এই আত্মজ্ঞানকে ঠাকুর বলছেন, ‘পাকা আমি’। ‘কাঁচা আমি’কে ‘পাকা আমি’ করা সহজ নয় জেনে ঠাকুর বিকল্পের কথা বলছেন : “থাক শালা দাস আমি হয়ে।” আরেকটি বিকল্প ‘নাম’। নাম কর। যে-কাগজ বাতাসে ফড়ফড় করছে, মন-রূপ সেই কাগজের চপলতা নিবারণে নাম-রূপ পেপারওয়েট চাপা দাও। নাম দিয়ে ভাসিয়ে দাও, নামে ভেসে যাও।
ঠাকুর বলছেন : “একদিন একজনের নাম মনে এল। সঙ্গে সঙ্গে সেই নামের সঙ্গে এল তার সমালোচনা। তখন নামটাকে মন থেকে বিদায় করে দিলুম। রোখ করলুম না, ভাবব না। যাকে ভাবলে ভাল-মন্দ ভাবনা আসে তাকে আমি ভাবব না কিছুতেই।”
শ্রীমদ্ভাগবত বলছেন :
“কিমন্যৈরসদালাপৈরায়ুষো যদসদ্ব্যয়ঃ। …
মন্দস্য মন্দপ্রজ্ঞস্য বয়ো মন্দায়ুষশ্চ বৈ
নিদ্ৰয়া হ্রিয়তে নক্তং দিবা চ ব্যর্থকর্মভিঃ।।” (১।১৬।৬, ৯)
অযথা কথার আলাপে আয়ুক্ষয় ব্যতীত আর কি ফল? অলস ও নির্বোধ ব্যক্তিদের পরমায়ু রাত্রিতে নিদ্রায় আর দিবাভাগে বৃথা কর্মে নষ্ট হয়।
ঠাকুর তিরস্কার করছেন, কতটা সময় নিয়ে এসেছ? পলকেই তো ফুরিয়ে যাবে! কেশব সেনের একজন আত্মীয়, পঞ্চাশ বছর বয়স, দেখি তাস খেলছে। যেন ঈশ্বরের নাম করবার সময় হয়নি।
ঠাকুর একদিন মাস্টারমশাইকে খুব বকলেন। সেকথা মাস্টারমশাই আবার অকপটে লিখলেন। ঘটনাটি এইরকম—ঠাকুর বারান্দায় পায়চারি করছেন। আরেক পাশে নরেন্দ্রাদি ভক্তগণ মাস্টারমশাইকে ঘিরে প্রাসঙ্গিক আলোচনাদি করছেন। আলোচনার বিষয়—ছাত্ররা সব উচ্ছন্নে যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার পতিতা পল্লীতে যায়। পথেঘাটে খারাপ লোক তাদের নাম ধরে ডাকে।
ঠাকুর হঠাৎ তাঁদের কাছে এসে বললেন, একি, এসব কি আলোচনা! মাস্টার! এদের মধ্যে তুমিই বয়সে বড়, তুমি এইধরনের আলোচনা প্রশ্রয় দিচ্ছ? ঠাকুরের ধিক্কারে সকলের মাথা হেঁট।
অ্যারিস্টটলের কথা – “Steer the ship clear of yonder spray and surge.” জাহাজের উপমা–বিরূপ চিন্তার ঢেউ, বিভ্রান্তির ঝাপটা সামলে জীবন-জাহাজকে এগিয়ে নিয়ে যাও নিরাপদ বন্দরে। হেলেনের প্রসঙ্গ টেনে এনে বলছেন : “The right course if therefore to feel towards pleasure as the elders of the people felt towards Helen, and to apply their words to her on every occasion, for if we roundly bid her begone, we shall be less likely to err.” হেলেনের জন্য ট্রয়ের যুদ্ধ। হেলেন হলো প্রমোদের প্রতীক। মন থেকে হেলেনকে তাড়াও, সুখে থাকবে। “পাঁচ পীরের পূজারী হয়ে পড়েছিস তুই বিষম প্যাঁচে/আমি, আমার এই দুটো ছাড় থাকবি তুই পরম সুখে।” পাঁচ পীর হলো মানবের পাঁচটি ইন্দ্ৰিয়।
দুহাজার বছর পরে মা সারদা আমাদের বলছেন, বাবা! অন্যের দোষ দেখো না, নিজের দোষ দেখ। মা শেষশয্যায়। এইবার ঠাকুরের কাছে চলে যাবেন। সব বেঁধেছেঁদে ফেলেছেন। দরজার কাছে বসে আছেন এক ভক্ত রমণী। ইশারায় তাঁকে কাছে ডাকলেন। তিনি সাশ্রু নয়নে বললেন : “মা, আমাদের কী হবে?”
মা ক্ষীণ কণ্ঠে থেমে থেমে বললেন : “তুমি ঠাকুরকে দেখেছ, তোমার আবার ভয় কী? তবে একটা কথা বলি—যদি শান্তি চাও, কারো দোষ দেখো না, দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপনার করে নিতে শেখ। কেউ পর নয় মা, জগৎ তোমার।’