নিচুতলার সায়েবমেম

নিচুতলার সায়েবমেম

কোম্পানির আমলে কলকাতার সায়েব সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল কোম্পানির সামরিক ও অসামরিক কর্মচারী। কিন্তু তারা ছাড়াও আরও অনেক বিভিন্ন পেশার সায়েব ছিল এই শহরে। তারা হল, মিশনারি, ব্লক ও ঘড়ি নির্মাতা, কোম্পানির এজেন্ট, মার্চেন্ট, ট্যাভার্নের মালিক, সার্জেন, মিউজিসিয়ান, রুটি নির্মাতা, বুক বাইন্ডার, দোকানদার, ছুতোর মিস্ত্রি, বই বিক্রেতা, শুঁড়ি, মুচি, ছবি আঁকিয়ে, আইন ব্যবসায়ী, স্কুল শিক্ষক, বোর্ডিং হাউসের মালিক, জাহাজ-নৌকো নির্মাতা, ক্যাবিনেট তৈরির মিস্ত্রি, খামার মালিক, আস্তাবল রক্ষক, কসাই, দরজি, ইঞ্জিনিয়ার, কোচ নির্মাতা, ছাপাখানার মালিক, জুয়েলার, জকি প্রভৃতি। তারা বাস করত আলিপুর, ধর্মতলা, লোয়ার সার্কুলার রোড, মির্জাপুর, কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট, বউবাজার লেন, কসাইতলা, পুরনো চিনে বাজার, এসপ্লানেড রো, লালবাজার, ক্লাইভ স্ট্রিট, গার্সটিন প্লেস, ডেকার্স লেন, ট্যাঙ্ক স্কোয়ার (এখানকার বি-বা-দি বাগ), হেয়ার স্ট্রিট, রানিমুদি গলি, রাধাবাজার, চিৎপুর রোড, চৌরঙ্গি, মুদিবাজার লেন, ম্যাঙ্গো লেন, ওল্ডকোর্ট হাউস, গভর্নমেন্ট প্লেস, কুপার্স লেন, হুজুরিমল লেন, থিয়েটার রোড, সুকিয়া লেন, পার্কস্ট্রিট চাঁদনি, রয়েড স্ট্রিট, ক্যামাক স্ট্রিট, হগ লেন প্রভৃতি এলাকায়। মোটামুটিভাবে মধ্য কলকাতায়।

১৮২২-এ কলকাতায় নিচুতলার সায়েব, যেমন, বুক বাইন্ডার, ঘড়ি নির্মাতা, ছুতোর মিস্ত্রি, আস্তাবল রক্ষক, দরজি, কসাই, মৃতদেহ সৎকার কর্মী বা আন্ডারটেকার, মুচি, দোকানদার প্রভৃতির সংখ্যা ছিল ১৩৮। শহরে বেসরকারি নিচুতলার যে সায়েব প্রথমে এসেছিল, সে ছিল একজন দরজি, নাম W. Ramkin। শহরের শাসক এবং এলিট সম্প্রদায় সচেতনভাবে এইসব মানুষকে নেহাতই ছোটলোক বলে মনে করত। উপেক্ষা করত তাদের বঞ্চনাকে। তাদের চোখে এইসব নিচুতলার সায়েবরা ছিল Low European বা ছোটলোক শ্বেতাঙ্গ।

এইসব অদক্ষ, অর্ধ-দক্ষ সায়েবদের জীবন ছিল অতি কষ্টের। রোজগার ছিল সামান্য। বিভিন্ন কারণে কাজ হারাত। অসুখ-বিসুখের শিকার হত যখন তখন। তার ওপর ছিল মদের নেশা। অস্থির অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পরিণামে কপালে জুটত সামাজিক অসম্মান। এক সময় নিঃস্ব হয়ে ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়াত শহরে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সমাজবিরোধী কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে অপরাধী বলে দাগি হয়ে যেত। কেউ পাগল হয়ে যেত, আশ্রয় পেত পাগলা-গারদে। ভবানীপুরে ছিল সায়েবমেমদের জন্য পাগলা-গারদ। ১৮১৭ সালে এটি স্থাপিত হয়। এই পাগলা গারদে সায়েব পাগলদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সৈনিক, নাবিক এবং রাইটার। যে সব মেমসায়েব পাগল হয়ে এখানে আশ্রয় নিত, তাদের মধ্যে বেশিরভাগ ছিল ব্যবসায়ী ও সৈনিকদের মেমরা।

সরকার এই নিচুতলার সায়েবমেমদের একটা বিশেষ শ্রেণিতে ফেলেছিল যাতে তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায় চাপিয়ে দিয়ে ব্যবস্থা নিতে সুবিধে হয়। বস্তুত, এইসব সায়েবমেমরা ছিল বিলেতের হতদরিদ্র শ্রেণির মানুষ। গরিবি থেকে মুক্তি পেয়ে একটু সুখের আশায় নানান ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দিত অজানা-অচেনা এই দেশে। তাদের বেশির ভাগ মানুষের নিত্যসঙ্গী ছিল দারিদ্র্য। এদেশে এসেও হতাশ হত। সুখের মুখ দেখতে পেত না। বাধ্য হত অতি কষ্টের জীবন কাটাতে। তাদের মধ্যে শ্রেণিকরণ রেখাটি কিন্তু এলোমেলো হয়ে যেত কখনও কখনও। কারণ ভবঘুরেরা অনেক সময় অপরাধ করে ঢুকে পড়ত অপরাধীর তালিকায়। অন্যদিকে অপরাধী জেল থেকে পালিয়ে ভবঘুরে কিংবা পাগল হয়ে যেত। আসলে শিল্পবিপ্লব এবং ইউরোপে নগরায়ণের ফলে দারিদ্র্য যে চরম সীমায় পৌঁছেছিল তার অনিবার্য পরিণাম ছিল গরিবদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা। এলিট শাসকশ্রেণির মতে এই ধারণাই গড়ে উঠেছিল যে, গরিব মাত্রই অপরাধপ্রবণ।

কিন্তু মজার ব্যাপার হল, ভারতে ঔপনিবেশিক শাসকরা তাদের স্বজাতির অপরাধ প্রবণতার ব্যাখ্যা করত অন্যভাবে। সেই ব্যাখ্যার সঙ্গে ইউরোপীয় ধারণার কোনও মিল ছিল না। তারা মনে করত এদেশের অপরাধীরা পেশাগত ভাবেই অপরাধ করে। তারা জন্ম-অপরাধী। বাংলায় ডাকাতের ছেলে ডাকাত হয়। কিন্তু যেসব সায়েব ডাকাতি করত, বলা হত, এদেশের জল-হাওয়া এবং নেটিভদের মন্দ প্রভাবে তারা ডাকাত হয়েছে। শুধু তাই নয়, কোনও সায়েব তেমন মারাত্মক অপরাধ করলেও শাসকগোষ্ঠী চেষ্টা করত সেটা গোপন রাখতে। ১৮২৩ সালে The Calcutta Journal আদালতে শ্বেতাঙ্গ অপরাধীর ফৌজদারি মামলার বিবরণ প্রকাশ করায় রুষ্ট হয়েছিল সরকার। মামলাটা ছিল জনৈক Herny Imlach-এর হত্যাকাণ্ড নিয়ে। পত্রিকাটি মামলা সম্পর্কে ম্যাজিস্ট্রেট এবং সরকারি অধিকারিকদের বক্তব্য ফলাও করে প্রকাশ করলে সরকারের মুখ্যসচিব পত্রিকাটির সম্পাদককে সতর্ক করেন। তাঁকে জানান, এই মামলার যে বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে, তা অত্যন্ত আপত্তিকর। সম্পাদকমশাই যেন তাঁর পত্রিকায় এইসব কেলেঙ্কারির কথা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন।

কলকাতায় কোম্পানির কর্তৃপক্ষ নিচু শ্রেণির সায়েবদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিব্রত ছিল নাবিকদের নিয়ে। বাংলায় কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর রপ্তানি বাণিজ্য ফুলে ফেঁপে ওঠে। বৃদ্ধি পায় ইউরোপীয় ও মার্কিন জাহাজের আসা-যাওয়ার সংখ্যা। এর প্রভাব পড়েছিল শহরের শ্বেতাঙ্গ জনসমষ্টির ওপর। আঠারো শতক থেকেই শ্বেতাঙ্গ নাবিকরা কলকাতার সায়েব সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছিল। উনিশ শতকে তাদের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। কলকাতা শহরে সায়েব-নাবিকদের ভিড় করার অন্যতম কারণ ছিল দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রাজনিত ক্লান্তি ও অবসাদ। তাই অনেক নাবিক বন্দরে জাহাজ আসা মাত্রই জাহাজের কাজ ছেড়ে চলে আসত শহরে। অনেকের জাহাজের কড়া নিয়ম-শৃঙ্খলা পছন্দ হত না। তার সঙ্গে ছিল জাহাজ কর্তৃপক্ষের অন্যায় আচরণ। কখনও জাহাজের ক্যাপ্টেন তাদের অপদার্থ মনে করে বরখাস্ত করত। অনেকে বন্দরে এসে অসুস্থ হয়ে পড়ত। হাসপাতালে যখন পড়ে থাকত, সেই সময় বন্দর ছেড়ে চলে যেত তাদের জাহাজ। অনেক সময় নাবিকরা বিদ্রোহ করত জাহাজের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। ১৮২৯ সালে ‘ফেয়ারলি’ জাহাজের ক্যাপ্টেন S. I. Fuller গভর্নর জেনারেলের কাছে এক অভিযোগে বলেন, তাঁর জাহাজের বেশির ভাগ নাবিক অসন্তুষ্ট হয়ে বিদ্রোহ করে জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে। তিনি তাদের গ্রেপ্তার করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে আর্জি পেশ করলেও তারা কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। ম্যাজিস্ট্রেটদের বক্তব্য ছিল, বিদ্রোহ হয়েছিল গভীর সমুদ্রে। সেটা তাদের এক্তিয়ারের বাইরে। জাহাজ বন্দরে ভেড়ার পর তারা বিদ্রোহ করে জাহাজ ছেড়ে শহরে ঢুকে পড়েনি। এই যুক্তিতে তারা নাবিকদের গ্রেপ্তার করলেও পরে ছেড়ে দিয়েছে। তারা কলকাতার পথে পথে ঘুরে বেড়াতে থাকে।

জাহাজ-পালানো এইসব নাবিক প্রায় প্রতিদিনই বন্দর ছেড়ে চলে আসত শহরে। অনেক জাহাজ বন্দরে বেশ কিছুদিন বিশ্রাম নিত নানা কারণে। সেইসময় নাবিকরা ঢুকে পড়ত শহরে। বিশেষ করে রবিবার বিকেল বেলায় তারা দলে দলে ঘুরে বেড়াত কলকাতার রাস্তায়। শোভাবাজারের কাছে নিষিদ্ধপল্লিতে যেত ঘন ঘন। কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে তারা ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক।১০ তাদের আচার-আচরণে সভ্যতার লেশমাত্র থাকত না। যথেচ্ছ মদ্যপান করে মাতলামি, খুন, ডাকাতি প্রভৃতি অপরাধে জড়িয়ে পড়ত হামেশাই। ১৮৫৫ সালে ম্যাজিস্ট্রেট ৫০০ অপরাধের মামলার বিচার করেন যাতে নাবিকরা জড়িত ছিল। ১৮৫৬ থেকে ১৮৬১, পাঁচ বছরে ১৫২২ জন নাবিককে জেলে পোরা হয় বিভিন্ন অপরাধে। ১৮৫৫ সালে কলকাতার পুলিশ কমিশনার জানিয়েছিলেন, ন’টা খুনের মধ্যে, চারটে, আর আটটা মারধর করা মামলার আসামি নাবিক।১১ ১৭৯৫-এ শহরে পরপর অনেকগুলো ডাকাতি হয়ে যায়। ডাকাতদলের একজন রাজসাক্ষী হয়ে জানায়, তারা দলে ছিল দু’শো জন, পর্তুগিজ এবং অন্যান্য ইউরোপীয় সায়েব। তাদের মতলব ছিল, হিন্দুস্তান ব্যাংকে ডাকাতি করা। তখনই তারা ধরা পড়ে যায়। বিচারে শাস্তি হয় ছ’জনের।১২

কলকাতা শহরে নাবিকদের প্রবেশ শত চেষ্টাতেও আটকানো যায়নি। জাহাজ থেকে পালিয়ে তারা এসে বেকার হয়ে পড়ত। এক দুর্ভোগ এড়াতে গিয়ে লড়াই করতে হত আর এক দুর্ভোগ থেকে রেহাই পেতে। জাহাজে আর যা-ই হোক আহার জুটত। জাহাজ থেকে পালিয়ে আসার পর সবচেয়ে প্রয়োজন ছিল পেট চালাবার মতো কাজ পাওয়া। কিন্তু মুশকিল হল, তারা কোনও পেশার উপযুক্ত ছিল না। কলকাতায় দেশীয় অদক্ষ শ্রমিকের অভাব না থাকায় তাদের পক্ষে কাজ জোটানো ছিল শক্ত। আঠারো শতকের মাঝামাঝি অবশ্য গৃহভৃত্য হিসেবে নিচুতলার সায়েবরা কিছু কাজ পেত। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে এই সুযোগ বৃদ্ধি পায়। ধনী সায়েব পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সায়েব-কোচম্যানের চাহিদা বাড়ে। এ ছাড়া অন্য পেশায় নাবিকরা ছিল একেবারে নালায়েক।

এটা স্বাভাবিক যে, কলকাতা শহরে তারা ছিল আগন্তুক। সঙ্গে কারওর পরিচয়পত্র নেই। পরিচিত কেউ নেই শহরে। ফলে মহা সমস্যায় পড়ত নাবিকরা। শহরে এসে তারা সাধারণত ডেরা বাঁধত লালবাজার ও বউবাজার এলাকায়। বাতিল হওয়া মদ সস্তায় কিনত ‘পাঞ্চ’ হাউসের মালিকদের থেকে। আঠারো শতকের প্রথম থেকেই ‘পাঞ্চ’ সেবন ছিল একটা বড়ো রকম সস্তার নেশা। পাঁচটা উপাদান দিয়ে তৈরি হত ‘পাঞ্চ’। আরক মূল উপাদান। তার সঙ্গে মেশানো হত গোলাপ জল, লেবুর রস, চিনি আর জল। ১৭০০ সালের মধ্যে এটি সাধারণ পানীয় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল শ্বেতাঙ্গ সমাজে।১৩ কিন্তু আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে সায়েবরা বুঝতে পেরেছিল এই পানীয় শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। এর পরিণাম, অসুস্থতা এবং অকালমৃত্যু।

লালবাজার-বউবাজার এলাকায় এইসব মাতাল নাবিকরা, বিশেষ করে রবিবারে সৃষ্টি করত ভীষণ হাঙ্গামা। পুলিশ আসত সেই হাঙ্গামা থামাতে। অনেক সময় পুলিশই পর্যুদস্ত হত মাতাল নাবিকদের হাতে। তিনজন গোরা সার্জেন্ট ছাড়া তাদের কাবু করা যেত না। লালবাজার এলাকায় ব্যপটিস্ট চার্চ এবং বউবাজারে ব্যাপটিস্ট চ্যাপেলের মতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও ওই অঞ্চলে সমস্ত উনিশ শতক জুড়ে নাবিকদের দাপাদাপি অব্যাহত ছিল। মিশনারিরা তাদের মদ্যপান ও বেশ্যালয়ে যাওয়া থেকে আটকাবার চেষ্টা করেও খুব একটা সফল হয়নি।

সরকারি ও বেসরকারি নথিপত্রে নাবিকদের বেপরোয়া বেয়াদপির অনেক দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে। অনেক সময় কোম্পানির জাহাজের নাবিকরা কেউ কেউ কোনওক্রমে একটা বাড়ি তৈরি করে সেখানে নাবিকদের আশ্রয় ও বিনোদনের ব্যবস্থা করত। প্রাক্তন নাবিক আইজ্যাক উইলিয়মসন এমনই বেআইনি কাজ করে ধরা পড়ে যায় ১৮২১ সালে। দেখা যায়, তার বাড়িতে সতেরো জন নাবিক গা ঢাকা দিয়ে বাস করছে। উইলিয়মসনকে কর্তৃপক্ষ শাস্তি দিয়ে সতর্ক করে দেওয়া সত্ত্বেও সে শোধরাতে পারেনি নিজেকে। তার আচরণ এমন আগ্রাসী হয়ে উঠেছিল যে, কলকাতায় তার অবস্থান বিপজ্জনক মনে করে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তাব দেন কর্তৃপক্ষের কাছে। তাকে জানানো হয়, দু’মাসের মধ্যে কলকাতা ছাড়তে হবে। আর এই সময়ের জন্য জমা রাখতে হবে মোটারকম জামানত। না পারলে ‘তাকে ফাটকে পুরে দাও পরবর্তী নির্দেশ পাওয়া পর্যন্ত।’১৪

নাবিকদের অসুখ-বিসুখ সরকারি কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট মাথাব্যথার কারণ ছিল। তাদের বেলাগাম জীবনযাত্রার জন্য তারা হামেশাই যৌনব্যাধির শিকার হত। কর্তৃপক্ষ এর দায় চাপাত এদিশি যৌনকর্মীদের ওপর। শ্বেতাঙ্গিনী যৌনকর্মীদের চড়া পারিশ্রমিক দেওয়ার সংগতি না থাকায় নাবিকরা যেত দিশিদের কাছে। সেক্ষেত্রেও ঔপনিবেশিক শাসকের জাতি বিদ্বেষ স্পষ্ট, কারণ তাদের বক্তব্য ছিল, নাবিকরা নেটিভ যৌনকর্মীদের সংস্পর্শে যাওয়ার ফলেই তারা যৌনব্যাধিতে আক্রান্ত হয়।১৫ অনেক সময় নিষিদ্ধপল্লিতে গিয়ে নাবিকরা জড়িয়ে পড়ত খুনোখুনিতে। এর মূলে ছিল, মদ খেয়ে মাতাল হওয়া। এমনই একটা ঘটনা ঘটিয়েছিল ‘এলিজা’ নামে এক মার্কিন জাহাজের নাবিক ফ্রাঙ্ক ফোলস্ (Frank Fowls)। সে বিবিজান নামে এক পতিতার মাকে খুন করে। খুনের কারণ, তার মেয়ের পারিশ্রমিক দেওয়ার মতো টাকা-পয়সা ফোলস্-এর পকেটে ছিল না। মহিলা বাধা দিলে সে সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে পিস্তল বের করে তার মাথায় গুলি করে। মহিলার তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, পুলিশ তাদের রিপোর্টে জানায় ফোলস্ মহিলাকে মারতে চায়নি, ভয় দেখাতে গিয়ে গুলি বেরিয়ে গেছে।১৬

নাবিকদের সংযত করার উদ্দেশ্যে ১৮২২ সালে কলকাতায় গড়ে তোলা হয় Calcutta Seamen’s Friend Society. ১৮৩৭ নাগাদ এখানে নাবিকদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। গ্রন্থাগারসহ প্রত্যেকটা ঘর আসবাবপত্রে সাজানো গোছানো ছিল। একটা সেভিংস ব্যাংক খোলা হয়, যাতে তারা কিছু টাকা-পয়সা জমাতে পারে। তাদের নৈতিক চরিত্রের উন্নতির জন্য প্রতিদিন সকাল-বিকেল প্রার্থনার ব্যবস্থা করা হয়। এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তাদের পাঞ্চ হাউস বা ট্যাভার্নে যাওয়া ঠেকানোর জন্য। কিন্তু ‘না শোনে চোরা ধর্মের কাহিনি।’ এতসব করা সত্ত্বেও নাবিকদের অন্যায় কাজকর্ম এবং বদসঙ্গীদের সঙ্গে মেলামেশা করা থেকে আটকানো যায়নি।১৭

তবে, নাবিকদের সঙ্গে কলকাতার সায়েবরা যে সুমধুর আচরণ করত না, সেটাও মানতে হবে। কলকাতার নগরায়ণ এবং শহরে শ্বেতাঙ্গদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আঠারো শতকের সায়েব সমাজের সেই আন্তরিক আতিথেয়তার জোয়ারে ভাটা পড়েছিল। নাবিকসহ বিদেশ থেকে যারা কলকাতায় আসত, উঠত গিয়ে পাঞ্চ হাউস কিংবা ট্যাভার্নে। ফ্লাগ স্ট্রিট এবং সংলগ্ন গলিগুলোতে যে সব পাঞ্চ হাউস ছিল, সেগুলো ভর্তি থাকত নাবিকদের ভিড়ে। বেশিরভাগ পাঞ্চ হাউসের মালিক ছিল ইংরেজ। তাদের কারওরই লাইসেন্স থাকত না। লন্ডন, লিভারপুল বা ব্রিস্টলে দালালদের সাহস হত না ডকে ঢোকার। কলকাতায় ব্যাপারটা ছিল বিপরীত। এখানে দালালদের কাছে ডকে ঢোকা কোনও সমস্যাই ছিল না। তারা সোজা গিয়ে হাজির হত জাহাজের ডেক-এ। নাবিকদের পরামর্শ দিত, বন্দরে নেমে সোজা পাঞ্চ হাউসে আশ্রয় নিতে। পাঞ্চ হাউসগুলো ছিল এক-একটা আস্ত নরক। দালালরা নাবিকদের পাঞ্চ হাউসে ঢুকিয়ে দিয়ে নেশাগ্রস্ত করিয়ে পিঠটান দিত তাদের সর্বস্ব নিয়ে। প্রতারকদের পাল্লায় পড়ে চরম সংকটে পড়ত নাবিকরা। পাঞ্চ হাউস তাদের নিম্নমানের মদ দিত সস্তায়, যাতে মাদক মেশানো থাকত অনেক সময়। সেখানে সস্তায় মদ, অশুদ্ধ পানীয় জল আর বাসি-পচা মাংস খাওয়ার পরিণতি ছিল অকাল মৃত্যু। পাঞ্চ হাউসের মালিকরা তাদের মদ্যপানে উৎসাহ দিত। তারপর নাবিক নিঃস্ব হয়ে গেলে ছুড়ে ফেলে দিত রাস্তায়।

পাঞ্চ হাউসের মালিকরা ছিল প্রচণ্ড ক্ষমতাশীল, পেশীশক্তি ও আইনগত দু’দিক থেকেই। কলকাতার জলপরিবহণ ব্যবস্থায় খবরদারি করত তারাই। সকলেই ছিল খাঁটি সায়েব। বিলেতেই জন্ম। সুতরাং উপনিবেশের আইন-কানুনের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ‘জাস্টিসেস্ অব পিস’-এর ক্ষমতা ছিল না তাদের বিরুদ্ধে হুকুমনামা জারি করে। ঔপনিবেশিক সরকারের এই দুর্বলতার জন্যই তারা বেপরোয়া মনোভাব দেখাত। সরকারি তথ্য অনুযায়ী পাঞ্চ হাউসের মালিকরা কোম্পানির জাহাজের পলাতক নাবিকদের জন্য শহরে কফি হাউস, ট্যাভার্ন, লজিং হাউস তৈরি করে থাকার ব্যবস্থা করে দিত। তারা নিশ্চিন্ত ছিল যে, বিলেতের আইন টপকে শহরের কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না। তাই এইসব আস্তানা গড়ে তুলেছিল ম্যাজিস্ট্রেটের লাইসেন্স ছাড়াই।১৮

এদের বাগে আনার জন্য কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয় একটা উপ-আইন (Bye-law) তৈরি করতে। আইনটা পাশ হয় ১৮১৮-র ১৩ ফেব্রুয়ারি।১৯ এই আইনে বলা হয়। ক) জাস্টিসেস্ অব পিস্-এর দু’জন সদস্যের স্বাক্ষরিত অনুমতি ছাড়া হোটেল, পাঞ্চ হাউস, ট্যাভার্ন, কফি হাউস, লজিং হাউস, বিনোদন কেন্দ্র ইত্যাদি খোলা বেআইনি। এই বেআইনি কাজ প্রথমবার করলে পাঁচশো সিক্কা টাকা জরিমানা, দ্বিতীয় বারে হাজার টাকা, তৃতীয়বারে দু’হাজার। দিতে না পারলে কলকাতার সাধারণ জেলখানায় কয়েদি। খ) পাঞ্চ হাউসে কোনও রকম মাতলামি, গুণ্ডামি, ঝামেলার দায় বর্তাবে মালিকদের ওপর। এসব বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে হবে তাদের। প্রতিদিন যারা আসছে এবং যাচ্ছে তাদের ফিরিস্তি পাঠাতে হবে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। গ) নাবিকদের জাস্টিসেস্ অব পিস্-এর ঠিক করে দেওয়া নির্দিষ্ট ঘাটে নামতে হবে। অন্য ঘাটে নামলে গ্রেপ্তার ও জরিমানা, না দিতে পারলে নিশ্চিত কারাবাস।২০

এই উপ-আইন সত্ত্বেও অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। ট্যাভার্ন, পাঞ্চ হাউসের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাও ছিল। নাবিক এবং সৌভাগ্যের খোঁজে আসা সায়েবরা হয়তো তখন ভিড় জমাবে মদের দোকানে কিংবা বেশ্যালয়ে। সুতরাং কলকাতা শহরে ভেসে বেড়ানো সায়েবদের আস্তানা হিসেবে পাঞ্চ হাউস, ট্যাভার্ন প্রভৃতির অস্তিত্বকে বজায় রাখার কথা বিবেচনা করতে হয়।২১

কোম্পানির আমলে নাবিকরা কলকাতায় ‘লোফার’ নামে কুখ্যাত ছিল।২২ কর্তৃপক্ষের মনে হয়েছিল, তাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জন্য কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। নাবিকদের সম্পর্কে সরকারের মনোভাব পাল্টাচ্ছিল। তারা মনে করে, নাবিকরাও জাতির সম্পদ, এইভাবে তাদের উপেক্ষা করা সংগত নয়। এজন্য ১৭৮০-তে নাবিকদের কাজের সুযোগ দিতে একটা বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, উচ্চাকাঙ্ক্ষীরা শত্রুদেশ লুণ্ঠন করার জন্য ‘মৃত্যু অথবা গৌরব’— যে কোনও একটাকে লক্ষ্য করে জাহাজে যোগ দিতে পারে। জাহাজ পরিচালনা করবে James Bacey। ছ’টা ২২ পাউন্ডার কামান এবং একশো কুড়িজনকে নিয়ে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে কলকাতা ত্যাগ করবে। পাঁচ মাসের এই অভিযানে লড়াই হবে ওলন্দাজ, ফরাসি ও স্পেনীয়দের বিরুদ্ধে। উপযুক্ত দেখভাল এবং মদত নিশ্চিত করা হবে সকলের জন্য। ২৩

নাবিকদের পুনর্বাসনের এক পরিকল্পনা পেশ করেন রয়াল নেভির লে. জেমস এইচ জনসন (Lt. James H Johnson)। তিনি গভর্নর জেনারেলকে জানান, ব্রিটিশ নাবিক যারা জাহাজ থেকে বরখাস্ত হয়, তাদের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। লক্ষ করা যায়, নদী-বন্দরে থাকার সময় নাবিকরা ততটা মাতাল হয় না, যতটা হয় শহরের বদ্ধ পরিবেশে। কলকাতা বন্দরে এসে তারা কয়েক মাস বেকার অবস্থায় পড়ে থাকে পাঞ্চ হাউসে। বেপরোয়া যথেচ্ছাচারের সেই জীবন কাটতে থাকে যতক্ষণ তাদের পকেটে একটা টাকাও থাকে। এই সময়ে তারা জড়িয়ে পড়ে নানা কুকর্মে। রোগের শিকার হয়। জীবন শেষ হয় দুঃখজনক মৃত্যুতে। এইসব বেকার নাবিকদের একটু সুরক্ষিত স্বাচ্ছন্দ্যেভরা আশ্রয় দেওয়ার জন্যই তাঁর এই পরিকল্পনা। পরিকল্পনা ছিল, সাতশো টনের একটা জাহাজের খোলে দুশো নাবিকের থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া। জাহাজটা নদীর ধারে একটা সুবিধেজনক জায়গায় নোঙর করা থাকবে। তাদের দেখভাল করার দায়িত্ব দেওয়া হবে নাবিকদের সম্পর্কে অভিজ্ঞ কোনও ব্যক্তিকে। কাউকে নদীর ধারে যেতে দেওয়া হবে না। তারা রেশন পাবে নিয়মিত, মদ বাদে। তারপর প্রথম সুযোগে পাঠিয়ে দেওয়া হবে ইংল্যান্ডে। তাদের বেতনে কোনও আধিকারিক হাত দেবে না।

এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল, পাঞ্চ হাউস কিংবা ট্যাভার্নের অসাধু মালিকদের খপ্পর থেকে নাবিকদের দূরে রাখা। কিন্তু লে. জনসনের প্রস্তাব ও পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ খারিজ করে দেয় প্রয়োজনীয় আইনের অভাবে।২৪

নাবিকদের মতো ভবঘুরে বা বাউন্ডুলেরাও ছিল কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ। কলকাতার রাস্তা-ঘাটে ভবঘুরেদের দর্শন মিলত ১৭৬৭ সালেও যখন বাংলায় কোম্পানির ক্ষমতা তেমন জমাট বাঁধেনি। কলকাতা কাউন্সিল ১৭৬৭-র ২০ জানুয়ারি বিলেতে পরিচালক সমিতিকে জানিয়েছিল, ‘এই বসতি (কলকাতা) অনেকদিন ধরেই প্রচুর ভবঘুরেতে ভরে গেছে। তারা ইংল্যান্ড থেকে চলে আসার উপায় খুঁজে পেয়েছে অথবা পালিয়ে এসেছে কোনও ইউরোপীয় জাহাজ থেকে।’২৫ প্রায় একই সময়ে, ওই বছর ১৬ জানুয়ারি ক্লাইভও চিঠি লিখে এই সমস্যার প্রতি সিলেক্ট কমিটির নজর কাড়েন। তিনি লেখেন, ‘আর একটা অনিষ্টকর বিষয় ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, যার বিরুদ্ধে একটা ব্যবস্থা করা দরকার। প্রেসিডেন্সিতে অসংখ্য ভবঘুরে। তাদের নিজেদের দেশে হয়তো তাদের প্রয়োজন আছে, কিন্তু কলকাতায় তারা কুঁড়েদের থেকেও অধম। তাদের অনেক অন্যায়, বিশেষ করে গরিব বাসিন্দাদের হেনস্তা করার কাজে পুলিশ তাদের বাধা দিতে পারে না।’২৬ তিনি চেয়েছিলেন, ভবঘুরেদের হাত থেকে শহরকে দ্রুত মুক্ত করতে।

নিচুতলার সায়েবদের মদ্যপান এবং মাতলামি কর্তৃপক্ষকে বিব্রত করত অহরহ। ১৮২৩-এ কলকাতার ম্যাজিস্ট্রেটের লেখা এক চিঠি থেকে জানা যায়, উইলিয়ম বার্নফিল্ড (William Barnfield) নামে এক ভবঘুরে কলকাতায় মাতাল হয়ে ঘুরে বেড়াত। তাকে কয়েকবার সংশোধনাগারে পাঠিয়েও কোনও লাভ হয়নি। মাঝে মধ্যেই মাতাল হয়ে রাস্তার ধারে পড়ে থাকত নগ্ন হয়ে, কোনও হুঁশ থাকত না। তার কাছে লাইসেন্সও ছিল না।২৭ রবার্ট মুর নামে জনৈক পাঁড় মাতাল কলকাতায় থাকত। পেট চালানোর মতো কোনও সংগতি ছিল না। অথচ মদ খেয়ে লজ্জাজনকভাবে নগ্ন হয়ে পড়ে থাকত রাস্তার ধারে, শহরের মানুষের চোখের সামনে। ম্যাজিস্ট্রেট তাকে ধরে এনে বার বার সতর্ক করে দিলেও তার কোনও পরিবর্তন হয়নি। বাধ্য হয়ে তাকে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ।২৮

১৮৫০ সালে হেনরি মোজেস (Henry Mozes) অতীতের স্মৃতি থেকে তুলে আনা একটা ঘটনার উল্লেখ করেছেন তাঁর Sketches of India গ্রন্থে।২৮ক তিনি দেখেছিলেন, একজন ইংরেজ নাবিক মাতাল হয়ে অনেক চেষ্টা করেও দাঁড়াতে পারছে না রাস্তার ওপর। তার গায়ের জ্যাকেট চুরি হয়ে গেছে। যাদের সে ‘নিগার’ বলে, তেমন একজন স্থানীয় মানুষ হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে সাহায্যের জন্য। পুলিশ তাকে টেনে নিয়ে যায় থানায়। পরদিন সে জাহাজে পৌঁছয় টাকা-পয়সা, জামা-কাপড় খুইয়ে। সম্ভবত, দু’-একদিনের মধ্যে মারা যায়। তার বন্ধুরা বিলেতে তার পরিবারকে জানায়, কলকাতায় অস্বাস্থ্যকর জল-হাওয়ার শিকার হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে। সত্যিটা প্রকাশ করে না।

Calcutta Christian Observer 1837-এর সেপ্টেম্বরে মন্তব্য করেছিল, ‘What an awful sight to see British sailors rolling about the street of Calcutta drunk in the Lord’s day.’২৯ মাতাল সায়েবরা সারারাত পার্টিতে হৈ হুল্লোড় করে ভোরবেলায় মাতাল হয়ে যখন টলমল পায়ে পালকি কিংবা ঘোড়ার গাড়িতে উঠত, পালকির বেহারা এবং কোচম্যানরা মাথা নাড়ত তাচ্ছিল্যভরা নিঃশব্দ কৌতুকে। সকালবেলায় ভৃত্যরা যখন টেবিলের ওপর সায়েবদের উগরে দেওয়া বমি পরিষ্কার করত, তারা মনে করত, সায়েবদের বেঁচে থাকা এবং মরণের পথ বুঝি এমনই।৩০

সায়েবের হুঁকো বিলাস

১৮১৩ সালে প্রকাশিত দি ইউরোপিয়ান ইন ইন্ডিয়া, ক্যাপ্টেন থোমাস উইলিয়ামসন গ্রন্থ থেকে গৃহীত

এইভাবে শুধু ছোটলোক নিচুতলার সায়েবরাই নয়, ভদ্রশ্রেণির সায়েবরাও মাঝে মধ্যে মাতাল হয়ে যে সব কাণ্ডকারখানা ঘটাত, তা ছিল ‘সুসভ্য’ ইংরেজ জাতির পক্ষে লজ্জার ব্যাপার। উইলিয়ম হিকি তাঁর স্মৃতিকথায় এমনই একটা ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। সেনাবাহিনীর একজন পাদ্রি, জনৈক ব্লান্ট (Blunt) একবার মদের নেশায় চুর হয়ে নগ্ন অবস্থায় নোংরা গান গাইতে গাইতে ছুটে গিয়েছিলেন সেনা ও নাবিকদের মধ্য দিয়ে। সে এক অদ্ভুত হাস্যকর দৃশ্য! নেশা কেটে যাওয়ার পর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে তিনি এত লজ্জিত ও অনুতপ্ত হন যে, দশদিনের মধ্যেই মারা যান।৩১ নতুন সিভিলিয়নদের প্রশিক্ষণের সময় নামতা পড়ানোর মতো বারবার তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে নম্রতা ও শৃঙ্খলাপরায়ণতার গুরুত্বের কথা বলা হত। ফলে তাদের মধ্যে আঠারো শতকের সায়েব ‘নবাব’দের হালচাল অনেকটাই হ্রাস পেয়েছিল। কিন্তু নিচুতলার খেটে খাওয়া সায়েবদের মদ্যাসক্তি রীতিমতো বহাল ছিল, যা প্রশাসনের কাছে ছিল মাথাব্যথার কারণ।৩২

লর্ড কর্নওয়ালিশের আগে যাঁরা এদেশে কোম্পানির কর্মকর্তা ছিলেন, তাঁদের একমাত্র চিন্তা ছিল কোম্পানির ব্যাবসা-বাণিজ্যের প্রসার, আর নিজেদের ব্যক্তিগত তহবিল ভরতি করা নিয়ে। উপনিবেশ বা ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলার ভাবনা তাদের ছিল না। তাই নিজেদের শাসকের ভূমিকায় দেখার জন্য না ছিল আগ্রহ, না যোগ্যতা। কোম্পানিরও লক্ষ্য ছিল ভারত থেকে অর্থ উপার্জন, ভারতকে শাসন নয়।৩৩ ১৮৩০-এর দশকেও সাম্রাজ্যের ধারণা ছিল একটা সন্দেহের মধ্যে। ১৮৩৭-এও দেখা যায়, ইংল্যান্ডের যেন সাম্রাজ্যের প্রয়োজন নেই। ব্রিটিশ জনগণেরও উপনিবেশ নিয়ে উৎসাহ নেই।৩৪ আসলে, ইংল্যান্ডের মানুষ এবং লন্ডনে কোম্পানির কর্মকর্তারা এদেশ থেকে হাজার হাজার যোজন দূরে থাকায় এমন মনোভাব তাদের পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু অনেক আগে লর্ড কর্নওয়ালিশ বেশ বুঝতে পেরেছিলেন এদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশ কেবল স্বপ্ন নয়, ইতিমধ্যেই বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে। উপনিবেশের শাসনের সঙ্গে যুক্ত ইংরেজ শাসক সম্প্রদায়ের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত হলে উপনিবেশের মানুষের আনুগত্যে ফাটল দেখা দিতে পারে। সেজন্য তিনি সিভিলিয়নদের পরিশীলিত আচরণের জন্য রচনা করেন কোড বা বিধিবদ্ধ আইন। তখন থেকেই শাসক জাতির আচার-আচরণ নিয়ে সচেতন হয়ে ওঠে কলকাতার কর্তৃপক্ষ। একটা আশঙ্কা তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত, কলকাতার সায়েবদের ভাবমূর্তিতে দাগ লেগে গেলে নেটিভরা শাসকজাতির প্রতি সমীহ ও শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলবে এবং সেটা ঔপনিবেশিক শাসনের পক্ষে ক্ষতিকর।

তাদের মনে হয়েছিল, শুধুমাত্র বাহুবল দিয়ে এই বিশাল দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে অধীন করে রাখা যাবে না। ক্ষমতার ভিত্তি হল, ইংরেজ জাতির প্রতি এদেশের মানুষের সমীহ ভাব ও ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা।৩৪ক

এই আশঙ্কা খুব একটা মিথ্যে ছিল না। একজন এদিশি জনৈক শ্বেতাঙ্গ পাদ্রিকে বলেছিল, ‘খ্রিস্টধর্ম! শয়তানের ধর্ম! খ্রিস্টানরা মদ খায়, মন্দ কাজ করে, অন্যদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে।’৩৫ রিচার্ড টেম্পল মন্তব্য করেছেন, অতীতে ইউরোপীয়দের মদ্যাসক্তির স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়, কীভাবে সেটা একটা বিরাট সম্মানে কালি ছিটিয়ে দিয়েছিল।৩৬ ১৭৯৩ সালে কোম্পানির মুখপাত্র হেনরি ডুনডাস কমন্সসভায় বলেন, ইউরোপীয়দের চরিত্রের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে নেটিভদের সম্ভ্রমবোধ আছে।৩৭ বস্তুত, এই বোধটাকে টিকিয়ে রাখা ইংরেজ শাসকদের পক্ষে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিলেতের মধ্যবিত্তশ্রেণিও তাদের গরিব স্বজাতির থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে চাইত তাদের অনৈতিক ও সমাজবিরোধী কার্যকলাপের জন্য। কলকাতার কর্তৃপক্ষ এইসব ইউরোপীয় ভবঘুরে ও ডাকাতদের শাসকজাতির কলঙ্ক বলেই শুধু মনে করত না, তাদের চোখে এইসব গোরা গরিবরা ছিল সমস্ত অপকর্মের মূলে।৩৮ গোরা সিপাইদের মদ্যপান ও মাতলামি সেনাবাহিনীর নৈতিকতার মানকেই শুধু নীচে নামিয়ে আনেনি, শাসকজাতির প্রতি নেটিভদের ঘৃণার একটা বিশেষ হেতু হয়ে উঠেছিল। ১৮২৩ সালে কোম্পানির ইউরোপিয়ান রেজিমেন্টের এক অফিসার বলেন, ‘From this fatal habit the English soldier exhibits to the natives of India, a disgusting specimen of European character, the Christian character and even of human nature itself. This abominable vice of drunkenness which brings such dreadful evils upon themselves, and such disgrace on our national character and religion among our native subjects, is almost universal.৩৯

সরকারি এলিটরা মনে করত, নিচুতলার সায়েবরা যে নেটিভদের সঙ্গে মাখামাখি করে, তা উচিত নয়। তাদের মধ্যে স্বাজাত্যের অভিমান থাকা দরকার। Friend of India তো স্পষ্ট মন্তব্যই করে ফেলেছিল, কলকাতার সায়েবদের জীবন হল বেয়াড়া, উচ্ছৃঙ্খল ইউরোপীয়দের দৃষ্টান্ত।৪০ উপনিবেশের প্রশাসনের দৃষ্টিতে নাবিকদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ তাদের ‘অসভ্য নেটিভদের’ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল।

নিচুতলার সায়েবরা শুধু মদ খেয়ে মাতলামিই করত না। জড়িয়ে পড়ত নানান অপরাধমূলক কাজে। খুন, ডাকাতি, ছিনতাই ছিল অন্যতম। তবে এসব কাজে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জড়িত থাকত পর্তুগিজরা। বিশপ হেভার কলকাতার রাস্তায় রাত্রে খুনের ঘটনার উল্লেখ করেছেন, যাতে ভূমিকা ছিল পর্তুগিজদের।৪১ এরকম আরও তথ্য মেলে অন্যান্য উৎস থেকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, William Huggins তাঁর Sketches in India গ্রন্থে পর্তুগিজদের সম্পর্কে একেবারে বিপরীত তথ্য দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘পর্তুগিজরা অত্যন্ত শান্তপ্রকৃতির। মোটেই মারমুখো নয়। এর কারণ হল তাদের দারিদ্র্য।’৪২ সে সময় আজকের মতো এসব পথ-ডাকাতিতে প্রচ্ছন্ন যোগ থাকত পুলিশের। গোরা অপরাধীদের সঙ্গে তাদের আঁতাত থাকত হামেশাই। ১৮৩৬-এর ২৮ মে The Englishman পত্রিকা লেখে, কয়েকজন দিশি মহিলা পালাকিতে চড়ে যাওয়ার সময় এক রাতে ডাকাতের হাতে পড়ে চিৎপুর থেকে কলুটোলায় যাওয়ার পথে। তারা মহিলাদের গয়না-গাটি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে বাধা দেয় পালকির বেহারারা। ডাকাতরা তাদের সঙ্গে পেরে ওঠেনি। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, অকুস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ কনেস্টবল বেহারাদেরই হেনস্তা করেছিল ডাকাতদের বাধা না দিয়ে।৪৩

নাবিক এবং ভবঘুরেরা সমাজবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ত অনেক সময় অভাব-অনটন ও অন্যান্য সমস্যার কারণে। অর্থের অভাবে কলকাতা শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকা সম্ভব ছিল না। দু’বেলা আহার জোটানো ছিল কষ্টকর। তাই ট্যাভার্নে মাথা গোঁজা ছাড়া গতি ছিল না। দারিদ্র্য ও কষ্টের জীবন তাদের বেপরোয়া করে তুলত। পাঞ্চ হাউসে গিয়ে হৈ-হল্লা করে শান্তি নষ্ট করত স্থানীয় মানুষের। Bengal Harkaru পত্রিকায় স্থানীয় নাগরিকরা তাদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করে।৪৪ তবে ট্যাভার্নের মালিকরাও ছিল বেশিরভাগ অসৎ, ঠগবাজ। কোম্পানির সামরিক-অসামরিক কর্মচারীরা প্রতারিত হলে প্রশাসনের সাহায্য পেত। সে সুযোগ নাবিকরা পেত না। অবশ্য দু’-একটা ট্যাভার্ন ব্যতিক্রম ছিল। আঠারো শতকে কলকাতার হারমোনিক ট্যাভার্ন ছিল আজকের ফাইভস্টার হোটেলের মতো অভিজাত। এখানেই ১৭৮৫-র ৩ ফেব্রুয়ারি ওয়ারেন হেস্টিংসকে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়।৪৫

শুধুমাত্র নাবিকরা নয়, সেনাবাহিনী থেকে যেসব সৈনিক বিভিন্ন কারণে বরখাস্ত হত, তারাও জড়িয়ে পড়ত নানা অপরাধে। এমনকী, কেল্লার নিয়মিত সেনারাও মাঝে মাঝে কেল্লার বাইরে এসে শহরে ছিনতাই করত লোভে পড়ে। ফলে সামরিক দপ্তর থেকে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়, কোনও সৈনিক বিশেষ অনুমতি ছাড়া কেল্লার বাইরে যেতে পারবে না। আর একটা আশঙ্কা ছিল এই বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পেছনে। সেনারা শহরে গিয়ে মাতলামি করত আকণ্ঠ মদ্যপান করে।৪৬ মাসে যেদিন তারা বেতন পেত, সেদিন সেনাশিবিরে সারারাত ধরে চলত ব্যাপক হুজ্জতি। ব্রিটিশ সেনারা কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল নানান অপরাধমূলক কাজকর্মে। অনেকের বক্তব্য, তাদের এই মদ খেয়ে মাতাল হওয়ার কারণ হল, শ্বেতাঙ্গ এলিট ও তাদের মধ্যে বৈষম্যের সুউচ্চ প্রাচীর। সেনা শিবিরের একঘেয়ে জীবনের ক্লান্তি দূর করার অন্য উপায় না দেখে তারা ডুবে যেত মদের নেশায়।৪৭ এর পরিণামে সেনারা ঘন ঘন রোগের শিকার হয়ে মারা যেত। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বিলেতে সেনাদের অসুখে মৃত্যু হত বছরে মাত্র এক শতাংশ, ভারতে সাত শতাংশ।৪৮

ডাকাতি, ছিনতাই, চুরি প্রভৃতি অপরাধে যুক্ত থাকত ইউরোপের সব জাতির মানুষ। ১৭৯৫-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি পাঁচজন ইউরোপীয় সায়েব ও একজন বাঙালি চিনে বাজারে চৈতন্য শীলের বাড়িতে সিঁদ কেটে চুরি করে। তার আগে ১৭৯১-এ জনৈক মাসেক (Maseyk) পালকিতে যাওয়ার সময় আটজন সায়েবের হাতে আক্রান্ত হন কেল্লার কাছে। তাঁকে প্রচণ্ড মারধর করে ডাকাতরা তাঁর সমস্ত দামি জিনিসপত্র কেড়ে নেয়। ঘটনা জানতে পেরে পুলিশ সুপার ১৭৯১-এ ২ নভেম্বর এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ‘চৌরঙ্গি রাস্তার ওপর যে ডাকাতি হয়েছে, মনে করা হচ্ছে, তাতে জড়িত আছে তিনজন নাবিক। তারা সোনার ঘড়ি, সোনার চেন ইত্যাদি ছিনতাই করেছে। অভিযুক্তদের সম্পর্কে কেউ কোনও তথ্য দিলে তাকে চারশো টাকা ইনাম দেওয়া হবে।’৪৯ বেশি রাতে ময়দান এলাকায় যাওয়া ছিল রীতিমতো ঝুঁকির ব্যাপার। সায়েব ডাকাতরা বিভিন্ন পোশাকে ছদ্মবেশে ঘোরাফেরা করত। তারা শুধু নাবিকই ছিল না, অনেক ভাড়াটে সেনা ছিল তাদের মধ্যে।

অপরাধীরা ধরা পড়লে কঠিন শাস্তি ভোগ করত। আঠারো শতক পর্যন্ত তাদের শাস্তি দেওয়া হত প্রকাশ্যে, অনেক সময় নেটিভদের সামনে। যে ডাকাত দল চৈতন্য শীলের বাড়ি চুরি করেছিল, তারাই হিন্দুস্তান ব্যাংকে ডাকাতি করে। তাদের মধ্যে পাঁচজন এবং একজন এদিশি ধরা পড়ে। রায় দেওয়া হয়, তাদের জাস্টিসেস্ অব পিস্-এর দপ্তরের কাছে চৌরাস্তার মোড়ে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হবে।৫০ ১৭৯৫ সালে এসপ্লানেড অঞ্চলে ডাকাতি করার অপরাধে তিনজন ভাড়াটে সেনার হাত পুড়িয়ে দিয়ে দু’বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৭৯১ সালে এক পর্তুগিজ Tulloh and Company থেকে একটা হিরের আংটি চুরি করে ধরা পড়ে। বিচারে রায় দেওয়া হয়, তার হাত পুড়িয়ে এক মাসের জন্য ফাটকে পুরে দিতে হবে। এক মাস পরে ছাড়া পাওয়ার পর তাড়িয়ে দিতে হবে বাংলা প্রেসিডেন্সি থেকে।

নিচুতলার সায়েবদের মধ্যে সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ ছিল পর্তুগিজরা। পর্তুগিজ জাহাজের নাবিকরা বন্দরে নোঙর করা জাহাজ ছেড়ে শহরে এসে প্রায়ই নানান অপরাধ করত। সেজন্য গভর্নর জেনারেল পর্তুগিজ জাহাজের ক্যাপ্টেনদের সতর্ক করে দিতে বাধ্য হন। বলা হয়, তাদের জাহাজের নাবিকরা যেন ভোর পাঁচটার আগে শহরে প্রবেশ না করে এবং অবশ্যই যেন বিকেল পাঁচটার মধ্যে শহর ছেড়ে ফিরে যায় জাহাজে। এই বেঁধে দেওয়া সময়ের বাইরে যদি তাদের শহরে দেখা যায়, তা হলে তাদের কয়েদ করে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে।৫১ অন্যান্য পর্তুগিজরা শহরের ভবঘুরেদের মধ্যে মিশে গিয়ে অত্যন্ত নোংরা জীবনযাপন করত। মূলত, অপরাধ করা ছিল তাদের পেশা, বেঁচে থাকার অবলম্বন। তার সঙ্গে ছিল মদ খেয়ে মাতলামি ও যৌন কুকর্ম। J. H. Stocqueler তাঁর The Handbook of British India গ্রন্থে এজন্য দায়ী করেছেন পর্তুগিজ পাদ্রিদের জঘন্য পোশাক-আসাক, অপরিমিত অনাচার এবং নৈতিক বিকৃতিকে। ধর্মযাজক হিসেবে রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের বাণী বহন এবং প্রচারের পরিবর্তে তারা নিজেদের ধনী করে তুলেছিল পুরোহিততন্ত্রের শঠতা এবং জাদুবিদ্যার কৌশলে। পর্তুগিজ মেয়েরাও ছিল একইরকম নীতিভ্রষ্ট।৫২ দু’-একজন পর্তুগিজ বই বিক্রির মতো সাধু ব্যবসায় যুক্ত থাকলেও, তাদের সংখ্যা ছিল খুবই কম।

নিজেদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে সৌভাগ্যের সন্ধানে যারা কলকাতায় আসত তারা অনেকেই হতাশ হত আসামাত্রই উপার্জনের পথ খুঁজে না পেয়ে। সঙ্গে টাকা কড়ি যা আনত, ফুরিয়ে যেত অল্প কয়েক দিনের মধ্যে, কখনও বেহিসেবি করচ করে, কখনও ঠকবাজদের পাল্লায় পড়ে। তাদের মধ্যে অনেকে ছিল অনাথ, কেউ অসুস্থ। শহরে ঘুরে বেড়াত দিশাহীন হয়ে অত্যন্ত দুরবস্থায়। গরিব সায়েবরা জেটিতে কাজ করত ট্রলিম্যান হিসেবে। আয় হত প্রতি রাতে দুই থেকে চার আনা। দিনের বেলায় দিশি শ্রমিক সুলভ হওয়ায় সায়েব শ্রমিকের কাজ পাওয়া কঠিন ছিল।৫৩ তা ছাড়া, ধান-গমের বস্তা বওয়া বা মাটি কাটা প্রভৃতি কাজে তারা অভ্যস্ত ছিল না, যেসব কাজ দিশি শ্রমিকরা হেলায় করতে পারত। নিচুতলার গরিব ভবঘুরে সায়েবরা অনেক সময় বেঁচে থাকত বড়োলোক সায়েবদের ভুক্তাবশিষ্ট খাবার খেয়ে। উঁচুতলার সায়েবমেমরা পার্টিতে যে বিশাল পরিমাণ খাদ্যসামগ্রীর আয়োজন করত অতিথির জন্য, আক্ষরিক অর্থে তার পঞ্চাশ ভাগের মাত্র এক ভাগ তারা মুখে তুলত। বাকিটা খেত গরিব সায়েব আর দিশি মানুষ।৫৪ অনেক সময় সেই উদ্বৃত্ত খাদ্য ধনী সায়েবদের দিশি খানসামারা সস্তায় বিক্রি করে দিত গরিব সায়েবদের কাছে।৫৫ বিলেতের কর্তৃপক্ষও শহরের এইসব দুঃস্থ সায়েবদের কথা ভেবে একটা ত্রাণ তহবিল গড়ে তোলার অনুমতি দেয়। সেই তহবিল থেকে প্রতিমাসে ৮০০ টাকা খরচ করা হত গরিব সায়েবদের জন্য।৫৬

কোম্পানির আমলে কলকাতার শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল কোম্পানির গোরা পলটন ও জুনিয়র সিভিলিয়ন বা রাইটাররা। জুনিয়র সিভিলিয়ন বা রাইটাররা আসলে ছিল কেরানি।৫৭ বিলেত থেকে তরুণ বয়সে সায়েবরা সামরিক শিক্ষার্থী বা cadet এবং রাইটার হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতে আসত। খুব অল্প বয়সে, ১৫-১৬ বছর বয়সে তাদের আসতে হত দুটো কারণে। প্রথম, এদেশের জল-হাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য তরুণ বয়সিরা যতটা পারঙ্গম হতে পারত, বেশি বয়সে এলে সেটা সম্ভব হত না। ক্লাইভ, ওয়ারেন হেস্টিংসের মতো যারা সদ্য কৈশোর পেরিয়ে এদেশে আসেন, তারা এদেশের জলহাওয়ার সঙ্গে বোঝাপড়া করে বেঁচে ছিলেন অনেক কাল। আর ওয়াটসনের মতো যাঁরা প্রাপ্তবয়সে আসেন, তাঁরা অনেকেই ওয়াটসনের মতো এদেশে মাটি নিয়েছিলেন অকালে। দ্বিতীয় কারণ হল, রাইটাররা পদোন্নতি লাভ করে প্রশাসনের উঁচুপদে গেলে তাদের পক্ষে এদেশীয় ভাষাজ্ঞান ছিল খুব জরুরি। বেশি বয়সে এলে বিদেশি ভাষা সহজে রপ্ত করা কঠিন।

বিলেত থেকে যে সব নতুন cadet কলকাতায় আসত, তাদের জীবন কুসুম-শয্যা ছিল না। ১৮৩৩-এ The Asiatic Journal-এ জনৈক cadet কলকাতায় আসার আগে ও এই শহরে পৌঁছবার পর তাঁর অভিজ্ঞতার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা থেকে উঠে আসে cadet-দের জীবনের এক মলিন ছবি।৫৮ তিনি লিখেছেন, তাঁর মায়ের সঙ্গে কোম্পানির একজন পরিচালকের পরিচয়ের সুবাদে তাঁর কলকাতায় আসার সুযোগ হয়েছিল cadet হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সম্পর্কে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অজ্ঞ। এই তরুণের মা তাঁকে পরিবারের স্বার্থে কী ভয়ংকর দুর্দশার মধ্যে ঠেলে দিতে যাচ্ছিলেন, সে সম্পর্কে তিনি ছিলেন একেবারে অন্ধকারে। তিনিও জানতেন, তাঁকে ভারতে যেতেই হবে। সেটা তাঁর কপালের লিখন, কারণ তিনি মা-বাবার কনিষ্ঠ সন্তান। ভারত বা কলকাতা সম্পর্কে তাঁর মনে এক উজ্জ্বল ছবি এঁকে দিয়েছিল ভারত থেকে ফিরে আসা আত্মীয়স্বজন। তিনি লিখেছেন, ‘I should look upon India as a earthly Paradise.’ ভারতের পথে রওনা দেওয়ার আগেই সকলে বলত, তিনি বিরাট ধনী হয়ে ফিরবেন। তাই বোনেরা আবদার করেছিল, প্রথম সুযোগেই যেন তিনি তাদের জন্য শাল, মুক্তোর নেকলেস পাঠিয়ে দেন। তারা তাদের চাহিদার তালিকায় যোগ করেছিল, হাতির দাঁতের বাক্স, কচ্ছপের পাখা, সোনার বালা, ঢাকাই চাদর। তিনি যে পরিবারের সবচেয়ে ধনী সদস্য হতে চলেছেন!

কলকাতায় এসে তাঁর রঙিন স্বপ্ন মিলিয়ে গেল বাস্তবের প্রখর আলোয়। যে ঘরে তাঁকে চালান করে দেওয়া হল, সে এক ভয়ংকর স্থান। আসবাবপত্রহীন একটা ছোট ঘর, মশা আর মূষিকে ভর্তি। না টেবিল, না চেয়ার। ঘরের একটা কোণ দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সেটাই স্নানঘর।

অনেক সময় সামরিক দপ্তর নবাগত cadet-দের ফোর্ট উইলিয়মে থাকার ব্যবস্থা না করে দেওয়া পর্যন্ত তাদের সাময়িকভাবে আশ্রয় নিতে হত ট্যাভার্নে। সেখানে তাদের নানান অসুবিধে ভোগের কথা জানতে পেরে ১৮২০-র ১৫ এপ্রিল গভর্নর জেনারেল একজন অফিসার নিয়োগ করেন মাসিক ২০০ টাকা বেতনে। তার কাজ ছিল, cadet-রা বাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে পর্যন্ত তাদের দেখভাল করা। প্রধান দায়িত্ব ছিল, cadet-দের জন্য চাকর-বাকরের ব্যবস্থা করা এবং কলকাতার ঠগবাজদের পাল্লায় পড়তে না দেওয়া।৫৯ কিন্তু এই ব্যবস্থা প্রায়ই কার্যকর হত না। সামরিক অফিসারদের চরম অবহেলা cadet-দের জীবনে নিয়ে আসত দারুণ হতাশা। ফোর্ট উইলিয়মের কর্তৃপক্ষের অধীনে আসার পরও অফিসাররা তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি কোনও খেয়াল রাখত না। তাদের অনেককে একসঙ্গে গাদাগাদি করে রাখা হত একটা জঘন্য ঘরে। অনেক সময় বিছানা ছাড়াই প্রথম কয়েকটা রাত কাটাতে হত মেঝের ওপর শুয়ে। সেনাবাহিনীতে পরিচিত প্রভাবশালী অফিসারের সুপারিশ ছাড়া সহজে পদোন্নতি হত না। একজন রাইটারের চাকরি জীবনে পদোন্নতির যে সুযোগ ছিল; একজন cadet তা পেত না। হয়তো চব্বিশটা বছর একজন সাধারণ পলটন হয়ে সে অবসর নিত, অবশ্য যদি তার মৃত্যু না ঘটত সেই সময়ের মধ্যে। এই হতাশার পরিণাম ছিল দুঃখজনক। ১৮৫৬ সালে ভবানীপুর পাগলা-গারদে সেসব উন্মাদ ছিল তার মধ্যে সংখ্যায় বেশি ছিল সাধারণ সৈনিক, ৮৭ জনের মধ্যে ৩৫ জন।৬০

কলকাতায় হতভাগ্য রাইটারদের অবস্থা cadet-দের থেকে খুব একটা ভাল ছিল না। সফল সিভিলিয়ন হওয়ার আশা নিয়ে যে সব তরুণ কলকাতায় আসত, তারা মোটামুটি ভদ্র পরিবারের সন্তান ছিল। অন্তত, cadet-রা যে সব পরিবার থেকে আসত, তাদের চেয়ে উন্নত ও ভদ্র। তথাপি এই বিদেশ-ভুঁইয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে লড়াই করতে হত অনেক সমস্যার সঙ্গে।

তাদের দুর্দশার জন্য তারা নিজেরা অবশ্য অনেকটা দায়ী ছিল। তারা যে পরিবার থেকে আসত সেই পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা তেমন কিছু থাকত না। বিলেতে একটা শৌখিন কোট কিনতে পারলে অহংকারে দাপিয়ে বেড়াত। কলকাতায় আসার পর তাদের উঁচু নজর ও উপার্জনের মধ্যে ফারাক দেখা দিত বেশি করে। বিভ্রান্ত হত এই শহরের অগুনতি চোখ টানা বস্তু দেখে, যেগুলোর নাগাল পাওয়া মাসিক ৩০০ টাকা বেতনধারীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। সে সময়ের সস্তাগণ্ডার বাজারে একজন মানুষের ওই পরিমাণ বেতন নেহাত কম ছিল না। কিন্তু তা দিয়ে আরবি ঘোড়া কেনা বা ফিটনের মালিক হওয়া যেত না। অথচ এইসব মহার্ঘ বস্তুর নিত্য দর্শন লোভের আগুন ধরিয়ে দিত তাদের মনে। বয়সটা তখন সবে পাকতে শুরু করেছে, পরিণাম ভেবে দেখার সময় নয়। তাই তারা বেপরোয়া ধার-দেনা করে শখ মেটাত প্রাণ যেমন চায়। আর তা করতে গিয়ে দেনায় ডুবে যেত কাদায় পড়া পাখির মতো, যে কাদামাখা ডানা নিয়ে উড়তে পারে না। ঋণের ভার বহনের যন্ত্রণা ভোগ করতে হত দীর্ঘদিন ধরে। যারা ধারদেনা করত না, তারা পদস্থ সিভিলিয়নের মতো বাবুয়ানা করার জন্য ছুটে যেত রেসের মাঠে কিংবা তাসের জুয়ায়, যার পরিণাম ছিল অনিবার্য অনন্ত দুর্দশা।

ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পড়ুয়াদের ধার-দেনা না করে উপায় ছিল না। কলেজ-কাউন্সিলের সভাপতি হ্যারিংটন (Harington)-এর বক্তব্য ছিল, কলকাতায় দু’হাতে টাকা ওড়াবার প্রতি আকর্ষণ ছিল অমোঘ। বিলেত থেকে আসার সময় যারা পকেট ভরে টাকা আনতে পারত না, তারা পড়ত মহা সমস্যায়।

কলকাতায় এসে পরিচিত জনের কাছে হাত পাতা ছাড়া তাদের উপায় থাকত না। ১৮২৫ সালে ডবলিউ. বি. বেলি (W. B. Bayley) সিভিলিয়নদের ঋণ করার দায় চাপিয়েছিলেন কোম্পানির ওপর। এখানে এসে তারা যে বেতন পেত সেই বেতন কাঠামো ছিল পঁয়ত্রিশ বছরের পুরনো, কর্নওয়ালিশের আমলের।৬০ক তা ছাড়া কলকাতার সায়েব সমাজে আঠারো শতকের উদার অতিথিপরায়ণতা ছিল অমিল। সদ্য আগত রাইটারদের মাথা গোঁজার ঠাঁই এবং ক্ষুন্নিবৃত্তির ব্যবস্থা করে নিতে হত নিজেদেরই। তাই ঋণ না করে উপায় ছিল না। অথচ, গভর্নর জেনারেল এসব অসুবিধের কথা বিবেচনা না করে একরোখা সিদ্ধান্ত নেন, সমস্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে তিনি রাইটারদের ঋণ করার অভ্যেস বন্ধ করবেনই।৬০খ এমনও ভয় দেখানো হয় যে, কোনও প্রতিযোগিতায় বিশেষ বিবেচনা করা হবে তাদের, যারা ঋণযুক্ত এবং আয় বুঝে ব্যয় করে।৬০গ

১৮৩২ সালে জনৈক প্রাক্তন সিভিলিয়ন নবাগত রাইটারদের উদ্দেশে লিখেছিলেন, ‘রাইটার পদ গ্রহণের আগে তোমাদের ভাল করে চিন্তা-ভাবনা করতে অনুরোধ করি। অন্ধের মতো এমন পরিস্থিতিতে ঝাঁপ দিও না, যেখান থেকে ফেরা কঠিন। তাতে জীবন শুধু অ-সুখে ভরে যাবে। তোমার স্বদেশের যা কিছু ভাল, তা ছেড়ে যাওয়ার আগে ভালভাবে ভেবে দেখ। ভারতে সেই সোনার যুগ এখন আর নেই। … সে দেশে গিয়ে সৌভাগ্য দ্রুত হাতের মুঠোয় পাবে, তা আর সম্ভব নয়। পঁচিশ বছর সেখানে চাকরি করেও দেখবে কিছুই পেলে না। দেখবে স্বদেশ থেকে পাড়ি দেওয়ার সময় যেমন গরিব ছিলে, তেমনি গরিবই রয়ে গেছ… এই চাকরির সঙ্গে অন্য চাকরির পার্থক্যটা একবার লক্ষ কর। একজন সার্জেন, যদি তার শরীর-স্বাস্থ্য ভাল না যায়, স্বদেশ বা অন্যত্র চলে যেতে পারে। একজন সৈনিকও পারে। কিন্তু একজন রাইটার পারে না। কারণ এই পেশার প্রয়োজনীয় জ্ঞান শুধুমাত্র ভারতে কাজে লাগে। এটা সত্যি যে, একজন সিভিলিয়ন পঁচিশ বছর চাকরি করে অবসর নিলে বছরে হাজার পাউন্ড পেনশন পায় কোম্পানির কাছ থেকে। কিন্তু যে মানুষটার একটা পরিবার আছে, তাকে ওই সামান্য পরিমাণ অর্থের ওপর নির্ভর করতে হয়। রাইটারের কাজে যারা যোগ দেবে তাদের অর্থ ও সময় বাঁচানোর জন্য আমি এইসব তথ্য দিতে চাই।’ ভদ্রলোক সেইসঙ্গে রাইটারদের আরও কয়েকটি বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কলকাতায় আসার পর তারা যেন নেটিভদের সঙ্গে অযথা দুর্ব্যবহার না করে। ‘Remember that you have invaded their country in friendship, seized it by fraud, and retained it by violence.’ অনেক প্রবীণ সিভিলিয়ন এই চরম সত্যিটা উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর শেষ উপদেশ ছিল, মন্দ মেয়েমানুষের পাল্লায় পড়ে তারা যেন শরীর স্বাস্থ্য নষ্ট না করে। ভারতে একজন গুণবতী পত্নী এইসব তরুণ রাইটারদের জীবনে খুব দরকার।৬১

কোম্পানির আর্থিক অবস্থায় টান পড়লে তার কোপ গিয়ে পড়ত রাইটারদের ওপর। ১৭৮৫ সালে এমন ঘটনা ঘটেছিল। ওই বছর ২৭ জানুয়ারি রাইটারদের জানানো হয় যে, কোম্পানির বিভিন্ন দপ্তরের খরচ কমানোর জন্য কোম্পানি কিছু সিভিলিয়নদের ছাঁটাই এবং অন্যান্যদের বরাদ্দ পেনশনের পরিমাণ হ্রাস করতে বাধ্য হয়েছে। যদি কোনও রাইটার স্বদেশে ফিরে যেতে চায়, কোম্পানি দীর্ঘকালীন ছুটি ম়ঞ্জুর করবে। ছুটিতে থাকাকালীন অর্ধেক বেতন পাবে। ছুটি তিন বছরের। ছুটিতে যাওয়ার সময় যে পদে ছিল, ফিরে সেই পদে যোগ দিতে পারবে। তবে এই তিন বছরের মধ্যে যদি তাদের ডাকা না হয়, তারা পরিচালক সমিতিকে জানাবে, তারা আবার ফিরে আসতে চায় কি না। অন্যথায় চাকরি হারাবে।৬২

কোম্পানির রাইটারের চাকরিতে ছিল অনিশ্চয়তার কাঁটা। সবসময় এই কাঁটার ভয়ে তারা কাঁটা হয়ে থাকত। রাইটারদের চাকরির অনিশ্চয়তার মূলে ছিল তাদের দক্ষতা সম্পর্কে পরিচালক সমিতির অগাধ অসন্তুষ্টি। অবশ্য এ ব্যাপারটা ছিল আঠারো শতকে। তরুণ রাইটারদের কাজে পরিচালক সমিতি তাদের অখুশি ভাব গোপন না রেখে ১৭৫৬-র ১১ ফেব্রুয়ারি এক চিঠিতে কলকাতার কাউন্সিলকে লেখে, তারা রাইটারদের লেখা যে সব নথিপত্র পায়, সেগুলো দেখে তাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে, কাজটা তারা নিতান্ত হেলা-ফেলা করে শেষ করে। কিংবা তাড়াহুড়ো করে লেখে। লেখায় অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। অনেকক্ষেত্রেই তা অস্পষ্ট। পড়ে বোঝা দায়। বস্তুত, সেই সময়কার যে সব নথিপত্র লেখ্যাগারে সংরক্ষিত আছে, সেগুলোর মধ্যে অনেক হস্তাক্ষরই দুষ্পাঠ্য। সুতরাং পরিচালক সমিতির অভিযোগগুলো খুব একটা মিথ্যে ছিল না। তারা কড়া নির্দেশ পাঠায়, কোনও রাইটার কাজে অবহেলা করলে তাকে জবাব দিতে কাউন্সিল যেন দ্বিধা না করে।৬৩ তাদের মনে হয়েছিল, কাজকর্মে রাইটারদের গাফিলতির কারণ তাদের বিলাসিতা এবং আলস্য।৬৪

রাইটাররা আর একটা অন্যায় কাজ হামেশাই করত, যেটা পরিচালক সমিতির রোষের কারণ ছিল। অনেকে স্বদেশে ব্যক্তিগত চিঠিপত্রে কোম্পানির নথিপত্রের অনেক বিষয় প্রকাশ করে দিত, যা ছিল শৃঙ্খলাভঙ্গের নামান্তর। এমন অনেক দৃষ্টান্ত নজরে পড়ায় পরিচালক সমিতি কলকাতা কাউন্সিলকে সতর্ক করে লেখে, একমাত্র বিভিন্ন বোর্ডের সদস্য ও সচিবরা ছাড়া কেউ যেন সরকারি নথিপত্র চালান করার সুযোগ না পায়।৬৫ পরিচালক সমিতির চিঠি পেয়ে নড়েচড়ে বসে কলকাতার কর্মকর্তারা। তারা বিলেতকে জানায়, রাইটারদের জন্য তারা কতকগুলো রেগুলেসনের কথা ভেবেছে। যেমন, যে রাইটার কলকাতায় পরিবার নিয়ে থাকবে না, তারা দু’জন ভৃত্য ও একজন রাঁধুনি রাখতে পারবে। কোনও রাইটার বাগানবাড়ির মালিক হতে পারবে না। পোশাক পরতে হবে সাদামাটা। তবে পালকিটা তাদের খুব প্রয়োজন, এদেশের জল-হাওয়ায় ওটা না হলে চলে না।৬৬

১৮৫৫ সালের পর কলকাতার সায়েব সমাজে বিলেতের নিচুশ্রেণির মানুষের প্লাবন আসে। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের পর কোম্পানির সেনাবাহিনী বাতিল হয়ে যাওয়ায় ইউরোপীয় রেজিমেন্টের অনেকে বেকার হয়ে পড়ে। অনেকে অবসর গ্রহণের পর রেল, টেলিগ্রাফে কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ওয়াচম্যানের চাকরি জোগাড় করে থেকে যায় এদেশে। যে সব সেনা অসংগত আচরণের জন্য বরখাস্ত হত, স্বদেশে ফেরার রাহাখরচ তাদের দেওয়া হত না। তারা এদেশেই থেকে যেত বাধ্য হয়ে। রেল-টেলিগ্রাফ চালু হলে প্রয়োজন দেখা দিল দক্ষ শ্রমিকের। ভারতীয়রা তাদের বিকল্প ছিল না। তাই বিলেত থেকে ভাড়া করে আনা হয় অসংখ্য ফিটার, ফায়ারম্যান। এইসব অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত সায়েব শ্রমিকের দল এখানে এসে অচিরে অপযশ অর্জন করে ফেলে মদ্য সেবনে, অসভ্য আচরণ এবং ভারতীয়দের প্রতি অন্যায় ব্যবহারে।৬৭

ফলে কলকাতার সামাজিক পরিবেশ দূষিত হয়ে উঠল। যেখানে আশা করা হত, বিলেত থেকে আসা প্রতিটি শ্বেতাঙ্গ ইংল্যান্ডের রানির অনুকল্প হবে, সেখানে তারা দেখা দিল সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রে। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে তাদের পরিচয় হল ইউরোপীয় লোফার। পরিণামে সায়েব সমাজে এলিটদের মধ্যে সৃষ্টি হল এক দারুণ অস্বস্তি। যে শ্রেণিবৈষম্য বর্তমান ছিল, তা আরও প্রকট হয়ে উঠল সায়েব সমাজে।৬৮

কলকাতার সায়েব সমাজের শ্রেণি বৈষম্য থেকে রেহাই পায়নি গোরস্থানও। Theon Wilkinsons লিখেছেন, ‘Here… the niceties of Social distinction were taken into accounts.’৬৯ পদস্থ সামরিক অফিসারদের সমাধিস্থল ছিল সাধারণ সেনাদের থেকে পৃথক। প্রথম শ্রেণির সিভিলিয়নদের গোর দেওয়ার খরচ ছিল ৫০০ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণির ৩০০ টাকা। লোয়ার সার্কুলার রোড ও পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থানে গিয়ে সমাধি স্তম্ভগুলো পরখ করলে শ্রেণিবিভক্ত সায়েব সমাজের ছবিটা স্পষ্ট ফুটে ওঠে।৭০

জন পামার (John Palmer) কলকাতার সায়েব সমাজে ‘Prince of British Merchants’ নামে সুখ্যাত ছিলেন। ১৭৬৭-তে ওয়েস্ট ইন্ডিজে তাঁর জন্ম। ফরাসিদের হাতে বন্দি ছিলেন কিছুদিন। মুক্তি পেয়ে কলকাতায় চলে আসেন তাঁর পরিবারের কাছে। সে সময় তাঁর বাবা মেজর উইলিয়ম পামার ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের একান্ত সচিব। প্রথম জীবনে এক সওদাগরি অফিসে কেরানি পদে যোগ দিলেও একসময় ব্যাংকিং হাউস গড়ে তোলেন, নাম Palmer & Co.। কলকাতায় তাঁর প্রভাবশালী বন্ধুবর্গ ছিল। যোগাযোগ ছিল কোম্পানির উঁচুমহলে। এইরকম একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব পর্যন্ত সামরিক ও অসামরিক ক্ষেত্রে সামাজিক পার্থক্যের পাঁচিলটা ভেঙে ফেলতে ব্যর্থ হন। ১৮৫৭ সালে Times পত্রিকার সংবাদদাতা রাসেল (Russel) লিখেছিলেন, বিত্ত স্ত্রী-পুরুষকে ডিনারে মর্যাদা আদায় করে দিতে পারত না। একজন ‘বণিক রাজপুত্র’ বিলেতের সমাজে তার প্রাপ্য স্থান আদায় করে নিতে পারলেও কলকাতায় তাকে চিরকাল সেই সমাজের অলঙ্ঘনীয় বেড়ার বাইরে থাকতে হয়, যেটা ছিল একান্তভাবে সরকারি পদস্থ সিভিলয়নদের জন্য সংরক্ষিত।৭১

সূত্রনির্দেশ

১. Jud. (cr.), 19 December, 1822, No. 16.

২. তদেব।

৩. তদেব।

৪. Sarmistha De, Marginal European in Colonial India, 1860-1920, Kolkata (2008) p. 5.

৫. Selections from the Records of the Government of Bengal, No. XXVIII (Report on the Asylum for European and Native Insame Patients at Bhowanipore, Calcutta (1858), p.5.

৬. তদেব, p. 14, 20, 21

৭. Jud. (cr.). 19 June, 1823, No. 42.

৮. Harald Fischer—Tine, Low and Licenttous European প্রাগুক্ত, p. 144.

৯. Jud. (cr), 23 June, 1829, No. 43

১০. P. J. Marshall, The White Town of Calcutta under the Rule of the East India Company, (Modern Asian Studies, Vol. 34, part I, February 2000, p. 310)

১১. Harald Fischer—Tine, 117.

১২. P. J. Marshall, প্রাগুক্ত।

১৩. Percival Spear, The Nabobs, p. 18.

১৪. Jud. (cr.), 17 July, 1821, No. 12.

১৫. Harald Fisher— Time, প্রাগুক্ত, p. 115.

১৬. তদেব, p. 118, F. N.126.

১৭. Abhijit Dutta, European Social Life in 19th Century Calcutta, Cakutta (1994) p. 17.

১৮. Jud. (cr.), 7 February, 1817, No. 34.

১৯. Jud. (cr.), 17 July, 1821, No. 12.

২০. তদেব।

২১. Sarmistha De, ‘Boarding Houses in Nineteenth Century Calcutta; (Bidisha Chakraborty— Sarmistha De, Calcutta in the Nineteenth Century, New Delhi, (1213), p. 371.

২২. Rev. James Long, Calcutta and its Neighbourhood, Calcutta (1974), p. 97.

২৩. তদেব

২৪. Jud. (cr.), 10 August, 1821, No. 55, 56

২৫. The Rev. James Long, (ed.) Mahadev Prasad Saha, Selections from Unpublished Records of Government, (For the years 1748 to 1767) Calcutta (1973). No. 928. (এরপর থেকে Long. Selection.)

২৬. তদেব, No. 962.

২৭. Jud. (cr.) 11 December, 1823, No. 35

২৮. তদেব, 9 March, 1830, No. 35.

২৮ক. Henry Mozes, Sketches of India, London (1850) pp. 190-191.

২৯. Sarmistha De, প্রাগুক্ত, p. 91.

৩০. Ketaki Kushari Dyson, A Various Universe, New Delhi, (2006), p. 154.

৩১. Abhijit Dutta, Glimpses of European Life in 19th Century Bengal, Calcutta, (1995), p.7.

৩২. Harald Fischer—Tine, ‘Britain’s Other Civilizing Mission: Class prejudice, European ‘loaferism’ and the workhouse— system in colonial India. (The Indian Economic and Social History Review, 2005, vol. 42, p.300)

৩৩. Ashis Nandy, The Intimate Enemy; Loss and Recovery of Self Under Colonialism, Delhi (1995), p. 5.

৩৪. তদেব।

৩৪ক. Victor Jacquemont, Letters from India 1829-32. P. T. Nair (ed.), Calcutta in the 19th Century, Calcutta, 1989. p. 515.

৩৫. Sarmistha De, প্রাগুক্ত, p. 31.

৩৬. Richard Temple, Oriental Experience, London (1883), p. 409.

৩৭. Sarmistha De, প্রাগুক্ত, p. 34.

৩৮. David Arnold, ‘White Colonization and Labour in Nineteenth Century India.’ (The Journal of Imperial and Commonwealth History, January 1983, vol.xl, No. 2, p. 140.

৩৯. Harald Fischer— Tine, ‘Britaini’s Other Civilizing Mission. P. 301.

৪০. Raktim Sur, A History of Liquor. Response and Resistence in Bengal, 1790-1906. (যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত ডক্টরেট ডিগ্রির অপ্রকাশিত গবেষণাপত্র (২০১৫)। p. 226

৪১. Abhijit Dutta, European Social Life in 19th Century Calcutta, p.22.

৪২. William Huggins, Sketches in India, London (1824), p. 85.

৪৩. Ranbir Raychoudhuri, Glimpses of Old Calcutta, Calcutta (1978) p. 9.

৪৪. বিনয় ঘোষ, টাউন কলকাতার কড়চা, কলকাতা (১৯৬৯), পৃ. ১০.

৪৫. W. S. Seton Karr, Selections from Calcutta Gazattes, vol.1, Calcutta (1984), p. 89.

৪৬. Judicial, July 1865, No. 50

৪৭. P. J. Marshall, British Society and the East India Company (Modern Asian Studies, 31, 1, 1997, pp 89-108.

৪৮. তদেব।

৪৯. Sarmistha De. প্রাগুক্ত, p. 224.

৫০. W. H. Carey, The Good old Days… প্রাগুক্ত, pp. 343-44.

৫১. W. S. Seton-Kar. প্রাগুক্ত, p. 1.

৫২. Abhijit Dutta, প্রাগুক্ত, p. 18.

৫৩. Jud. (Jud.) September, 1869, No. 32.

৫৪. The Asiatic Journal, New Series, vol. 10, No. 38. 1833. pp. 114-15.

৫৫. Bishop Reginald Herber, ‘Narrative of a Journey from Calcutta to Bombay, Through the Upper Provinces, vol.1, London (1828), p.58.

৫৬. Jud. (cr.), 31 August, 1821, No. 6.

৫৭. Long Selections, p. XXX11

৫৮. The Asiatic Journal, New Series vol, 10. 1833, p. 285.

৫৯. তদেব, December 1820, p. 596

৬০. Selections from the Records of the Government of Bengal, No. XXV111, প্রাগুক্ত।

৬০ক. Bengal Past and Present, vol. XXIII, 1922 p. 121.

৬০খ. তদেব, p. 120

৬০গ. তদেব, vol.xxi 1920, p. 189.

৬১. The Asiatic Journal, New Series, vol. 8, 1832, pp. 187-196.

৬২. W. S. Seton Karr, প্রাগুক্ত, p. 74.

৬৩. Long Selections, No. 187.

৬৪. তদেব, No. 285.

৬৫. পরিচালক সমিতির চিঠি, 21 September, 1785. W. S. Seton karr, প্রাগুক্ত, p. 122.

৬৬. Long, Selections, No. 937.

৬৭. Harald Fischer— Tine, Low and Licentious Europeans, p. 144.

৬৮. তদেব, p. 182.

৬৯. Theon Wilkinson, Two Monsoons, London (1976) p. 15.

৭০. তদেব।

৭১. তদেব, p. 88.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *