নিগ্রহ
আমার ঘরে মুখার্জি ছেলেটিকে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। আমি ওকে দেখলাম। সাধারণ ভাবে, অন্যমনস্ক চোখে। এটা ইচ্ছাকৃত অমনোযোগ।
ছেলেটি দাঁড়িয়ে ছিল। আমার টেবিল থেকে হাত পাঁচ সাত তফাতে। ওর মাথার চুল থেকে পায়ের চটি সবই আমার নজরে পড়ছিল। স্পষ্টভাবে। একমাথা রুক্ষ চুল। গায়ে নীল রঙের মামুলি বুশ শার্ট, পরনে খয়েরি ট্রাউজারস। পায়ের চটিটা নোঙরা। ছেলেটি মাথায় লম্বা, গায়ের রঙ তামাটে। হাড়-হাড় চেহারা হলেও গড়াপেটা, মজবুত স্বাস্থ্য নয়।
“এদিকে এসো।”
ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে এল না। দাঁড়িয়ে থাকল। বোধ হয় এই ঘরের থমথমে, চাপা আবহাওয়ায় অস্বস্তি বোধ করছিল। বুঝতে পারছিল না, আমি কে? কেন তাকে আমার ঘরে হাজির করা হয়েছে?
এই ঘর তেমন বড় নয়। মাঝারি। জানলা আছে; তবে আপাতত বন্ধ। ভারি পরদা টানা রয়েছে আগাগোড়া জানলায়। বাইরের ছিটে ফোঁটা রোদ আসছে না; আলো প্রায় নেই। কোনো শব্দই শোনা যায় না। দুটো আলো, একটা মাথার ওপর, অন্যটা দেওয়ালে এমনভাবে জ্বলছে যেন ছেলেটিকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। নিজে আমি একটু আবছায় বসে আছি। এখন গরম কাল নয়; তবু মাথার ওপর পাখাটা মিহি রি-রি শব্দ করে ঘুরছিল।
আবার ছেলেটিকে ডাকলাম। সাধারণ ভাবে।
এবার সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল।
“বসো।”
ছেলেটি ইতস্তত করল। তার সাহস হচ্ছিল না।
“কী হল? বসো।”
ছেলেটি বসল।
“তোমার নাম?”
“সুবোধ।” ছেলেটির গলা জড়িয়ে গেল, ভাঙা ভাঙা শোনাল।
“সুবোধ হালদার।” আমি হাসলাম না, রুক্ষ হলাম না; অথচ বুঝিয়ে দিলাম আমি ওর পুরো নামটাই জানি।
সুবোধ আমাকে দেখছিল। ভয়ের চোখে, সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে।
“এখানে কত দিন আছ?”
“এক মাসের বেশি।”
“এক মাস উনিশ দিন। ঠিক?”
সুবোধ যেন আরও অস্বস্তি বোধ করল। “আপনি সব জানেন?”
জানি। কিন্তু স-ব কী?
সিগারেটটা ধরাবার জন্যে লাইটার খুঁজছিলাম। “তোমার কাগজপত্র দেখেছি।”
সুবোধের ব্যাপারে কাগজপত্র সমেত ফাইলটা আমার সামনে টেবিলে পড়ে ছিল। মুখার্জি গত পরশু দিয়ে গিয়েছিল। দেখেছি সব। সুবোধের কথা মুখার্জিরা আমায় আগেও বার কয়েক বলেছে।
সিগারেট ধরালাম। সুবোধের মুখ খানিকটা লম্বা ধরনের। চোয়াল ভাঙা। গালে কয়েকটা ব্ৰণর দাগ। থুতনি শক্ত এবং চাপা। নাকের ডগা রীতিমতন মোটা। কপালের ডান দিকে বড় আঁচিল।
“তুমি কলকাতায় থাকো?”
“দমদমে।”
“তোমার বয়েস? তেইশ না চব্বিশ?”
“তেইশ।”
“পড়াশোনা কতদূর করেছ?”
“বেশি দূর নয়। বি কম শুরু করেছিলাম।”
“তোমার কি শীত করছে?”
আমার বেখাপ্পা প্রশ্নে সুবোধ কেমন থতমত খেয়ে গেল। এটাও আমার ইচ্ছাকৃত। মানুষের স্বভাব হল, স্বাভাবিক কথাবার্তা বেশিক্ষণ বলতে দিলে সে ধাত পেয়ে যায়। আপাতত সুবোধকে খানিকটা এলোমেলো করে রাখাই আমার দরকার।
“শীত?…না, শীত নয়,” সুবোধ খাপছাড়া ভাবে বলল।
আমার মনে হল, সুবোধের শীত শীত করছে। এখন কার্তিক মাসের শেষ। সকালে রাত্রে বেশ ঠাণ্ডা পড়ছে এখানে। সকালে এক একদিন ঘন কুয়াশা জমে। রাত্রে হিম পড়ে। এখন অবশ্য না সকাল না সন্ধে। দুপুরের শেষ। জানলার পরদা সরিয়ে কাচের পাল্লাগুলো খুলে দিলে আলো আসবে, মরা রোদ দেখা যাবে মাঠে-ঘাটে।
পাখাটা বন্ধ করার উপায় ছিল না আমার। সামান্য আগে কপাল গলা ভিজে গিয়েছিল ঘামে। সল্ট ট্যাবলেট খেয়েছি জলে গুলে। এক ঘামকে বলে টেনশান সোয়েটিং। শীত গ্রীষ্ম বলে কথা নেই; উত্তেজনা থাকলেই ঘাম হবে। ইদানীং এটা হচ্ছে আমার। বয়েসের জন্যে বোধ হয়। কিংবা মনের জোর হারিয়ে ফেলছি। আমাদের পেশায় পঞ্চাশই যথেষ্ট। তার পর শরীর আর মনের স্বাভাবিকতা থাকে না।
“তুমি গলার দিকে বোম এঁটে দিলে—তাই মনে হল,” আমি বললাম। সিগারেটের ধোঁয়া গিলে একবার ফাইলটার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ তুললাম। “তোমার বাড়ির কথা বলো। কে কে আছেন?”
সুবোধ গলা পরিষ্কার করল। “অনেক আছে।”
“মা বাবা, বোন ভাই বিধবা এক পিসিও বোধ হয়…।” আমি এবার একটু হাসির মুখ করলাম।
“আপনি তো সবই জানেন…।” সুবোধ অবাক হল না আর।
“কাগজ পত্র দেখে যা জেনেছি। …তা তোমার বাবার বয়েস কত?”
“কাগজে লেখা নেই?” সুবোধ যেন অন্য গলায় বলল, একটু খোঁচা থাকতে পারে।
“যা জিজ্ঞেস করছি বলো।” আমার গলা নিজের থেকেই শক্ত হয়ে গেল।
সুবোধ চোখ নামাল। “বাবার ঠিক বয়েস আমি জানি না। বছর ছাপান্ন।”
“এখনও চাকরি করেন?”
“হ্যাঁ। সিনেমা হাউসে। বুকিং কাউন্টারে।”
“তোমাদের একটা দোকান আছে না?”
“না, দোকান নয়। আমার ভাই একটু জায়গা ঘিরে নিয়ে বসে ইলেকট্রিকের কাজকর্ম করে।”
“তোমার মা স্কুলে কাজ করেন?”
“পড়াশোনার কাজ নয়। স্কুলের অফিসে। সামান্য কাজ।”
“তোমাদের বাড়ি কোথায়?”
“বাড়ি? জানি না। দেখিনি।”
আমি সুবোধের মুখচোখ লক্ষ করছিলাম। বাড়ির কথাবার্তা বলতে তার ভাল লাগছিল না। বিরক্ত হচ্ছিল।
সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে নিবিয়ে দিলাম। দেওয়ালে ঘড়ি ঝুলছে। তিনটে দশ। বাইরে রোদের তাত কমছে বোধ হয়। জানলার পরদা সরিয়ে পাললাগুলো খুলে দিলে ছেলেটা আরাম পাবে। বাইরে আকাশবাতাস মনোরম। হেমন্তের পালানো রোদ মটর ক্ষেতের মাথায় বসে ধুলো ঝাড়ছে যেন গায়ের।
“তোমাদের দেশ কোথায় জান না?”
“শুনেছি যশোর। শোনা-কথায় দেশ। দেখিনি।”
“তোমরা কি বরাবর কলকাতায়?”
“খাস কলকাতায় নয়। আমি টালিগঞ্জে জন্মেছি। আমরা টালিগঞ্জ, বেহালা, পাতিপুকুর অনেক জায়গায় থেকেছি। ভাড়া বাড়িতে। বস্তিতে।”
“বস্তিতে?”
“আজকাল বস্তিই বেশি।” সুবোধের গলা যেন ঠাট্টার মতন শোনাল। “বস্তিতেই বেশি লোক থাকে। আমাদের মতন লোক।”
আমি কিছু বললাম না। ওকে অল্প স্বল্প সহজ স্বাভাবিক হবার সুযোগ দেওয়া উচিত। বরং আরও একটু বেশি হালকা হতে দিলেও ক্ষতি হবে না।
“তা ঠিক,” আমি মাথা নাড়লাম, “কলকাতার দশ আনাই শুনেছি বস্তি হয়ে গিয়েছে। এক একটা ভাড়াটে বাড়িতে বিশ ভাড়াটে। আউট স্কার্টের কলোনিগুলো নাকি নরক।”
“লোকে তাই বলে।”
আমার চশমাটা টেবিলের ওপর রাখা ছিল। চশমার পাশে ডট্ পেন। ডট্ পেনটা তুলে প্যাডের ওপর রাখলাম। তারপর আচমকা বললাম, “এখানে তোমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে?”
সুবোধ যেন আমার কথা ভাল বুঝল না।
“তুমি তিন নম্বর ব্যারাকে আছ না?”
“হ্যাঁ।”
“তিন নম্বরটা সবচেয়ে ভাল। স্পেশ্যাল ব্যারাক। নতুন হয়েছে। অঢেল রোদ, বাতাস, স্যানিটারি অ্যারেঞ্জমেন্টও খুব ভাল। তাই না?”
“হ্যাঁ, কিন্তু জানলার বাইরে লোহার জাল। বাইরে তাকালে কম্পাউন্ড ওয়ালের মাথায় কাঁটা তার। আপনাদের লোকজন পাহারা দেয় বসে থাকে।”
কথাগুলো আমি শুনেছি এমন কোনো ভাব করলাম না। আবার আচমকা বললাম, “তুমি গায়ে মাথায় মাখার জন্যে সাবান-টাবান পাচ্ছ তো? ওয়াশিং সোপও আমরা দি। মশার তেল পেয়েছ? এখানে খুব মশা। ম্যালেরিয়া হতে পারে। বী ভেরি কেয়ারফুল। আমাদের মশার তেলটা খুব ভাল। মিলিটারি থেকে সাপ্লাই পাই। তিন চার ফোঁটা হাতে নেবে, মাখিয়ে নেবে হাতে তারপর মুখে হাতে জাস্ট বুলিয়ে নেবে…। শরীরে যে কোনো ওপেন পার্ট-এ ইউজ করবে। কোনো ক্ষতি হবে না। …ভাল কথা, তোমার ডান পায়ের থাইয়ের এক জায়গায় ইনজিউরির দাগ আছে। ওটা কিসের? বোমা-টোমার চোট?”
সুবোধ কেমন চমকে উঠল। তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। তার যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না, এই ব্যাপারটাও আমার জানা।
মনে মনে আমি কৌতুক অনুভব করেছিলাম। সুবোধ নিশ্চয় বুঝতে পারছে না, আমি তাকে আরও কতভাবে অবাক করে দিতে পারি।
সুবোধ বলল, “না, বোমার নয়।”
“বোমার নয় ! কিসের দাগ?”
“একবার তার-কাঁটার ওপর পড়ে গিয়েছিলাম।”
“কেমন করে? তোমার পিঠের দিকেও সামান্য দাগ আছে।”
“আমাদের পাড়ার একটা একতলা বাড়ির নেড়া ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে পড়ে গিয়েছিলাম।”
“ও! কত দিন আগে?”
সুবোধ বেশ বিরক্ত হল। বুঝতে পারছিল আমি তার কথায় সন্দেহ করছি। ক্ষুন্ন হয়ে বলল, “দু-তিন বছর আগে। হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। আর জি কর। ওখানে খাতায় লেখা আছে।”
সুবোধ রেগে যাচ্ছিল। কম বয়েসে রাগটা চট করে হয়। সুবোধকে মাঝে মাঝে রাগানোও আমার দরকার। রাগানো, ভোলানো।
আমি আবার একটু নরম হয়ে গেলাম। “ছোটখাট ব্যাপারেও ওই পুলিসের বড় সন্দেহ বুঝলে হে, নিজের বাপকেও সন্দেহ। ওরা একেবারে অমানুষ। আমি কিন্তু পুলিস নয়। নাথিং টু ডু উইথ দেম। তোমার কাগজপত্রে নানান রকম কেচ্ছা ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাই বললাম।…চা খাবে?”
“না।”
“আরে রাগ করছ কেন? খাও, একসঙ্গেই খাওয়া যাক। সাড়ে তিনটে বেজে গিয়েছে। তোমার তো আবার শীত শীতও করছে।” বলে আমি টেবিলের তলায় সুইচে হাত দিলাম। বাইরে কলিং বেল বাজবে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমার আরদালি মোহন এল।
“চা দাও। দু কাপ। পাখাটা বন্ধ করে দাও।”
মোহন পাখার সুইচ বন্ধ করল। করে চলে গেল। দরজা বন্ধ হল।
আমি একটু হাসলাম। নরম হাসি। “দেখো সুবোধ, যার যা কাজ তা না করে উপায় নেই। আমারও সেই অবস্থা। আমার কাজটা ঝকমারি। তবু ভাল পুলিসের কাজ নয়। পুলিসদের আমি নিজেও পছন্দ করি না। টু টেল ইউ ফ্র্যাংকলি, আমার মেয়ে—তা ধরো তার বয়েস এখন একুশ, আমাদের ফার্স্ট চাইল্ড, তার বিয়ের এক সম্বন্ধ এসেছিল আই পি এস ছেলের সঙ্গে। না করে দিয়েছি। আমার স্ত্রী একটু খুঁতখুঁত করছিলেন। তাঁকে বুঝিয়ে দিলাম, হাজার ভাল হোক, অনেস্ট হোক—পুলিস পুলিস, দেয়ার ইজ সাম্ ডার্ট অন্ দেম ইউ ক্যান নেভার ওয়াইপ আউট।…তা তোমারও তো একটি বোন রয়েছে। কত বয়েস?” আমি খোলামেলা গল্প করার ঢঙে, খানিকটা অন্তরঙ্গ হয়ে কথাবার্তা বলছিলাম। ইচ্ছে করেই। কথা শেষ করে বাকি জলটা খেয়ে নিলাম। সল্ট ট্যাবলেটের নোনতা স্বাদ। আবার একটা সিগারেট ধরালাম।
সুবোধ বলল, “আমার বোন আর ছোট ভাই যমজ। বোনের বয়েস কুড়ি।”
“আমার মেয়েরই সমবয়েসী। কিন্তু যমজদের ব্যাপারে একটা পিকিউলিয়ারিটি আছে। যমজরা সাধারণত একই রকম হয়। ছেলে তো দুটোই ছেলে; মেয়ে তো দুটোই মেয়ে। এক ছেলে এক মেয়ে দেখা যায় না। তাই না?”
“আমি ঠিক জানি না।”
“নজর করোনি আর কি। আরও দু জোড়া যমজের কথা ভাবলে বুঝতে পারবে। তোমার বোনের নাম কী?”
“ডাক নাম বেলা।”
“বিয়ে থা দিতে পারনি? কী যেন করে দেখছিলাম?”
সুবোধ তাকিয়ে থাকল। বুঝতে পারল, আমার জানা আছে তার বোন বেলা কী করে। সামান্য পরে বলল, “বাড়ি বাড়ি ধূপ, আচার, মোরব্বা বিক্রি করে।”
সিগারেটের ধোঁয়া গিলে চুপচাপ বসে থাকলাম। আমার আর ঘাম হচ্ছিল না। টেনশান যে কেটে গিয়েছে তা নয়, সয়ে গিয়েছে। এ-রকম হয় আমার। আগে যে উত্তেজনা এবং মানসিক দূর্বলতা থাকে, কেমন একটা অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা, সেটা ধীরে ধীরে কেটে যায়। ধাতস্থ হয়ে পড়ি।
মোহন চা নিয়ে এল। রাখল। তাকে ইশারায় আমি কিছু বললাম। সে আমার ডানপাশের ঘরের দরজার চাবি খুলল। ভেতরে গেল। ফিরে এল। ইশারায় জানাল—সব ঠিক আছে।
চলে গেল মোহন।
“নাও, চা খাও।”
সুবোধ চায়ের দিকে তাকাল। মুখ দিল না।
মনে মনে আমার মজা লাগছিল। সুবোধ বোধ হয় ভাবছে চায়ের সঙ্গে কিছু মেশানো আছে। না, তেমন কিছু নেই। যা আছে তাতে ওর উপকার বই অপকার হবে না।
চায়ে মুখ দিয়ে আমি বললাম, “খাও।”
সুবোধ আমার দিকে তাকিয়ে সামান্য দ্বিধার সঙ্গে চায়ে চুমুক দিল।
“সিগারেট খাবে?”
আমার আচমকা প্রশ্নে সুবোধ থতমত খেয়ে গেল। ছোট করে বিষম খেল একবার।
“না।” মাথা নাড়ল সুবোধ।
“তুমি সিগারেট খাও না?”
“খাই।”
“এরা তোমায় সিগারেট দেয় না?”
“দেয়। এক প্যাকেট। সস্তা সিগারেট।”
“তুমি কি দামি সিগারেট খেতে?”
“না। কোথায় পাব। যা খেতাম তাই দেয়।”
“আমাদের যা নিয়ম তার বাইরে কিছু দেবার উপায় নেই। তা হলেও তুমি দেখেছো—আমাদের সব রকম ব্যবস্থাই ভাল। খাওয়া শোওয়ার কোনো কষ্ট নেই। আমরা সাধ্যমতন তোমাদের আরামে রাখার চেষ্টা করি। ঠিক?”
সুবোধ কোনো কথা বলল না। চেষ্টা করল হাসার। ওর দাঁতের, সামনের দাঁতের সামান্য দেখা গেল। সাদা। শক্ত। সুবোধের চোখ খানিকটা লালচে দেখাচ্ছিল। কেন কে জানে!
“নাও, সিগারেট নাও। যদিও তুমি আমার ছেলের বয়েসী, তবু নাও। লজ্জার কিছু নেই।” আমি হাসলাম, প্যাকেট লাইটার এগিয়ে দিলাম। “কি একটা শ্লোক আছে না—কত বছর বয়েস হয়ে গেলে যেন ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুর মতন ব্যবহার করতে হয়…!”
সুবোধ হাত বাড়াল না, সিগারেটও নিল না। চায়ে চুমুক দিল আবার।
আমার মজা লাগছিল। এই সব ছেলে ছোকরাদের এক ধরনের অবাধ্যতা থাকে। বেয়াড়াপনা ঠাণ্ডা করতে আমাদের বেশি সময়ও লাগে না। তবু, এখন এই মুহূর্তে আমি কিছু করতে চাই না।
“তুমি আর কী নেশা কর?” আমি বললাম, শান্ত গলায়, গল্প করার মতন আমেজী ঢঙে।
“নেশা ! আর কোনো নেশা করি না।”
“মদটদ খাও?”
“না।”
“গাঁজা, চরস? হ্যাশিস?”
“না না।”
“কিছুই না। বাঃ, তুমি তো ভাল ছেলে !…আজকাল যে কী হয়েছে বুঝতে পারি না। ছেলে ছোকরা দেখলেই কতকগুলো দোষ তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দি। ফরনাথিং কতকগুলো ভাইসেস তোমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়। এই যেমন তুমি। তোমার কাগজপত্রের মধ্যে দেখছিলাম—তুমি সিগারেটের মধ্যে গাঁজা ঢুকিয়ে খাও।”
“কিছুই না। বাঃ, তুমি তো ভাল ছেলে !…আজকাল যে কী হয়েছে বুঝতে পারি না। ছেলে ছোকরা দেখলেই কতকগুলো দোষ তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দি। ফরনাথিং কতকগুলো ভাইসেস তোমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়। এই যেমন তুমি। তোমার কাগজপত্রের মধ্যে দেখছিলাম—তুমি সিগারেটের মধ্যে গাঁজা ঢুকিয়ে খাও।”
“মিথ্যে কথা। আমি গাঁজা খাই না।”
“আচ্ছা ! মদও নয়?”
“এক আধ দিন খেয়েছি।”
“তোমাদের বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে মদ গাঁজার খুব চল। কী বলে?”
“অনেকে খায়।”
ড্রয়ার টেনে আমি ভেতরে হাত ডোবালাম। আঙটিটা এবার পালটে নেওয়া উচিত। সুবোধ চা খাচ্ছে।
“তোমার বোনের কথা হচ্ছিল তাই না,” আমি আঙটি পালটাতে পালটাতে বললাম, “কি যেন নাম বললে? বেলা! তা এই বেলার সঙ্গে যে ছেলেটা ঘুরত, তাকে তুমি ছুরি-ছোরা মেরেছিলে নাকি?”
সুবোধ খানিকটা থতমত খেয়ে গেল, তাকিয়ে থাকল। এমন করে আমায় দেখছিল যেন বুঝতে পারছিল না, আমি সর্বজ্ঞ কি না।
আমি চা শেষ করলাম।
সুবোধ বলল, “আমি ছুরি মারিনি।”
“কে মেরেছিল?”
“জানি না।”
“তুমি কিছুই জান না? এত ন্যাকা-বোকা তো তুমি নও হে!” হঠাৎ আমি বললাম।
সুবোধের মুখ সামান্য অন্যরকম হয়ে গেল। মনে হল, যেন ঠাস করে আমি ওর গালে চড় মেরেছি।
ওকে সামলে ওঠার সুযোগ না দিয়েই আমি বললাম, “তোমার বোন ক’বার নার্সিং হোমে গিয়েছে?”
সুবোধ স্তম্ভিত। আমার দিকে তাকিয়ে থাকল বোকার মতন। ক’মুহূর্ত পরেই তার চোখ ঘৃণায় কেমন জ্বলে উঠল।
“লজ্জার কিছু নেই,” আমি বললাম, “আমাদের মধ্যে কথা হচ্ছে। বাইরের কেউ শুনতে যাচ্ছে না। তা ছাড়া আজকাল তো এ-সব জলভাত।…ক’ বার?”
সুবোধ উঠে দাঁড়াল। “আপনি আমার বাড়ির লোকদের সম্পর্কে…।”
“বসো। মাথা গরম কোরো না। এখানে মাথা গরম করতে নেই। তাতে তোমার লাভ হবে না। বসো।”
আমার গলার স্বর হঠাৎ এত শক্ত, কঠিন হয়ে গেল যে সুবোধ বোধ হয় চমকে গেল। আবার বসল।
“তোমার বাড়িকে বাদ দিয়ে কথা বলতে পারলে ভাল হত। আমি খুশী হতাম। কিন্তু তার উপায় নেই। তোমার বাড়ি তোমায় তৈরি করেছে। …আগে তোমার বোনের কথা হোক—তারপর তোমার মা বাবার কথায় আসছি। …বলো, তোমার বোন ক’বার নার্সিং হোমে গিয়েছে?”
সুবোধ দাঁতে দাঁত চাপছিল। “একবার।”
“দু বার।”
“না।”
“প্রথম বার সে বাড়ি ছেড়ে দিন সাতেকের জন্যে কোথায় গিয়েছিল?”
“কেষ্টনগর, আমাদের এক মাসির বাড়ি।”
“দ্বিতীয় বার কেন গিয়েছিল?”
“বিষ খেয়েছিল।”
“কেন?”
“মার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল।”
“তুমি আমায় এত বোকা ভাবছ কেন হে,” আমি হাত বাড়িয়ে সুবোধের ফাইলটা টেনে নিলাম। “মা মেয়ের ঝগড়া কোন বাড়িতে না হয়। শুধু ঝগড়ার জন্যে কেউ বিষ খায়? তা ছাড়া বাপু নার্সিং হোমে মেয়েকে রাখার ক্ষমতা তোমার মা-বাবার তোমার আছে বলে তো বিশ্বাস হয় না। ও-সব বড়লোকি ব্যাপার কি তোমাদের পোষায়!”
সুবোধ এবার আর কোনো কথা বলল না। তাকে অসহায় দেখাচ্ছিল। ফাঁদে পড়ে গিয়েছে।
“তোমার বাবা আর মায়ের মধ্যে বনিবনা কেমন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
তাকিয়ে থাকল সুবোধ। তার চোখ সামান্য যেন ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। মোটা মোটা ভুরু, কপালের মাঝামাঝি এত ময়লা যে মনে হয় ঘা-টা কিছু হয়েছিল এক সময়।
“কী হল, কথা বলছ না? তাড়াতাড়ি করো—।”
“বাবা বদমেজাজী। খায় দায় তাস খেলে আর সিনেমা হাউসে গিয়ে বসে থাকে।”
“শখের তাস না জুয়া?”
“জুয়াও খেলে।”
“নেশা ভাঙ করার অভ্যেস আছে?”
“আছে।”
“তোমার মা কত দিন স্কুলের কাজটা করছেন?”
“চার পাঁচ বছর।”
“কেন?”
“পয়সার জন্যে। বাবার রোজগার কম। সেই টাকায় সংসার চলে না। বাবা যা পায়—তারও খানিকটা নষ্ট করে। মা স্কুলের চাকরিতে সোয়াশো দেড়শো টাকা পায়। মায়ের চাকরি ঝিয়ের মতন। স্কুলের অফিসে টেবিল চেয়ার পরিষ্কার করে, খাতা গোছায়, দিদিদের ফরমাস খাটে, বড়দি—মানে হেড্মিস্ট্রেসের এটা-ওটা করে, দেয়। মা সামান্য লেখাপড়া জানে। ভাল কাজ আর কি করবে?”
“তুমি কী করতে?”
“কিছু না।”
“চাকরি বাকরি করতে না কেন?”
“কেউ দিত না। দু এক জায়গায় এক আধ মাস করেছি। তাড়িয়ে দিয়েছে”।
“ঠিক আছে। …এবার তোমায় নিয়ে একটু পাশের ঘরে যাব। বেশিক্ষণ না ঘণ্টাখানেক; তারপর তোমার ছুটি।”
॥ দুই ॥
ঘরে ঢুকে সুবোধ দাঁড়িয়ে পড়ল। যেন ভয় পেয়েছে। আমি তার পেছনে ছিলাম। দরজা বন্ধ করে দিলাম।
এই ঘরের চেহারায় আপাতদৃষ্টিতে ভয় পাবার কিছু নেই। সরু, লম্বা ঘর। ছোট। একটি মাত্র লম্বাটে জানলা। জানলা বন্ধ। পরদা ঝুলছে। ঘরের মাথার। দিকে ঘুলঘুলিতে একটা একজস্ট ফ্যান, পাখাটা চোখে পড়ে না। সেটা ঘুরছিল। শব্দ হচ্ছিল সামান্য। দুটি মাত্র চেয়ার ঘরে। একটা টেবিল—লম্বা সরু ধরনের, ডাক্তারদের রোগী দেখার চেম্বারে যেমন থাকে। আপাতত মিহি বাতি জ্বলছিল ঘরে। জোরালো বাতিগুলো নেভানো। সেগুলো কোনটা কোথায় বোঝা যায় না। বোঝা যায় না—এই ঘরের দেওয়ালে একটা চোরা ছোট কাবার্ডও রয়েছে। একেবারে স্তব্ধ ঘর। পাখার একঘেয়ে শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ শোনা যায় না।
“ওই চেয়ারটায় বসো তুমি,” আমি বললাম। বলে একটা চেয়ার দেখালাম।
সুবোধ বসা-গলায় বলল, “এই ঘরটা কিসের?”
“এমনি ঘর। বেশ নিরিবিলি।” বলে আমি একটু হাসির গলায় বললাম, “আমি নাম দিয়েছি, জতুগৃহ।”
“জতুগৃহ?”
“আরে মহাভারতের জতুগৃহ নয়। পুড়িয়ে মারার জন্যে তৈরি হয়নি। যাও, বসো।”
“চেয়ারের মাথার পাশে ওটা কী?”
“কিছু না। আলো। নেভানো রয়েছে। তোমার ভয়ের কিছু নেই”।
সুবোধ চেয়ারের দিকে এগিয়ে গেল। “আমার কেমন ঘুম পাচ্ছে।”
“একটু পেতে পারে। যদি বেশি পায় টেবিলে শুয়ে পড়ো।”
সুবোধ চেয়ারে বসল। ওর মুখ বলছিল ও ভয় পেয়েছে, তবু এক ধরনের নিরুত্তেজনায় তার চোখ মুখ ঠোঁট কেমন শান্ত, শুকনো দেখাচ্ছিল। দেখানোই স্বাভাবিক। চায়ের সঙ্গে যে ওষুধটা মেশানো ছিল—তা ওকে ক্রমশই খানিকটা অবশ, শান্ত, অচঞ্চল করে তুলবে। ঘুমঘুম পাবে, আলস্য অনুভব করবে। এক ধরনের আচ্ছন্নতা আসবে সুবোধের, তন্দ্রার মতন অবস্থায় থাকবে।
সুবোধ বলল, “আমাকে এখানে কেন এনেছেন?”
আমি দাঁড়িয়েই থাকলাম। বসলাম না। হাতের ঘড়িটা দেখলাম এক পলক। চারটে পাঁচ। ঘণ্টা খানেকের বেশি আমার লাগবে না।
“তোমার কাছ থেকে কয়েকটা কথা জানতে চাই,” আমি বললাম।
“এতোক্ষণ তো জানলেন। আপনার সবই জানা আছে।”
“মোটামুটি”, আমি টেবিলের দিকে সরে গেলাম।
“তোমার কাগজপত্রের মধ্যে বানানো কথা রয়েছে অনেক। তুমি আমায় সত্যি কথা বলবে। লুকোবে না। আমি সত্যি-মিথ্যের তফাত করতে পারি।” বলে আমি পকেট থেকে পেনসিলের মতন সরু ইঞ্চি ছয় লম্বা চকচকে একটা জিনিস বার করলাম। দেখলাম সুবোধকে।
“ওটা কী?” সুবোধ বলল।
আমি হাসির মুখ করলাম। “তেমন কিছু নয়। ডিটেক্টর। এটা ইলেক্ট্রোনিক্যালি অপারেটেড এক রকম টর্চ। ইন্ফ্রারেড রে বেরুবে জ্বাললে। তোমার চোখের পাতায় আলোটা দিয়ে রাখলে ভীষণ যন্ত্রণা হবে। গরম লাগবে খুব। মনে হবে চোখের পাতা, মণি পুড়ে যাচ্ছে। বেশিক্ষণ রাখলে অন্ধও হয়ে যেতে পার।”
সুবোধ হতবাক। ভয় পেল। “আপনি আমায় অন্ধ করে দেবেন?”
“না না”, আমি মাথা দোলাতে লাগলাম, “আমি কেন অন্ধ করব ! তুমি যদি চাও হতে পারে। তোমার ওপর নির্ভর করছে। …এই আঙটিটা দেখছ?” আমি ডান হাত বাড়িয়ে আঙটিটা দেখালাম। “এটা আমার আবিষ্কার। মাছির কত চোখ, জান? মাথা ভরতি চোখ। এই আঙটিটার মাথায় সুতোর মতন সরু সরু গোটা পঁচিশ ছুঁচ আছে। ভেরী শার্প অ্যান্ড হার্ড নিড্ল্স। তোমার ঘাড় আর মেরুদন্ডের কাছে যদি টিপে ধরি যন্ত্রণায় মরে যাবে।”
সুবোধ শিউরে উঠল। তার ঠোঁট মুখ এত শুকিয়ে গেল যে জিব দিয়ে ঠোঁট ভেজাতে লাগল। ঢোঁক গিলল বার কয়েক।
টেবিলের গায়ে হেলান দিয়ে আমি ওকে আশ্বাস দেবার গলায় বললাম, “সবই তোমার ওপর নির্ভর করছে। তুমি ঠিক ঠিক বললে, সত্যি কথা বললে এ-সবের দরকার হবে না। মিথ্যে বললে…!”
সুবোধ শুকনো ফ্যাকাশে মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। তার ক্লান্ত চোখ সামান্য তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছিল। ভয়ের সঙ্গে ঘৃণা ছিল দৃষ্টিতে। বোধ হয় সে ভব্য কোনো শয়তানের চেহারাটা দেখছিল।
“আমায় একটু জল খাওয়াবেন?” সুবোধ বলল।
“এখন নয়। পরে।”
“আমার তেষ্টা পাচ্ছে।”
“পাক।”
চুপ করে গেল সুবোধ। কিছু ভাবছিল। মাটির দিকে চোখ। সামান্য পরে মাথা তুলল। “কী জানতে চান আপনি?”
“তুমি নিজেই বলো। আমার যা জানার আমি জেনে নেব।”
সুবোধ জামার গলার কাছের বোতামটা খুলে ফেলল। বলল, “আমার বাড়ির কথা আপনি জানেন। আপনার কাছে যে কাগজপত্র আছে তাতে দেখেছেন। তবে সেটা সব নয়, বাজে কথাও রয়েছে অনেক। …আমার বাবার কথাই বলি। বাবা একসময়ে সিনেমার যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করত। মেশিন সারানোর কাজ। মেকানিক। তাতে পয়সাকড়ি ছিল। চুরিচামারির জন্যে কাজটা যায়। তারপর বসেছিল অনেক দিন। শেষে হাতেপায়ে ধরে লাহাবাবুদের সিনেমায় বুকিং কাউন্টারে কাজ জোগাড় করে। বাবাকে ওরা বিশ্বাস করে না। টিকিট বিক্রির সময় কেউ না কেউ পাশে থাকে। তবু ওই কাজটাই বাবার ভরসা।”
সুবোধ থামল একটু। ঢোঁক গিলে গলা ভিজিয়ে নিল। “বাবার স্বভাবে কোনো দায়দায়িত্বের বালাই নেই। আমরা ছেলেবেলা থেকে গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগির মতন বেড়ে উঠেছি। কোনোদিন দেড় কি দু’খানা ঘরের বেশি দেখিনি। আলাদা জলকল পায়খানা পাইনি কখনো। আমার পিসি বিয়ের দু বছরের মাথায় বিধবা হয়ে আমাদের কাছে চলে আসে। পিসেমশাই কর্পোরেশনে কাজ করত। ট্রামে কাটা পড়ে মারা যায়। পিসেমশাইয়ের কিছু পয়সাকড়ি জমানো ছিল। তার মা আর ভাই পিসিমার পেছনে লেগেছিল। ভাইটা পিসিমাকে শুতে-বসতে-কাপড় ছাড়তে দিত না। পিসিমা পালিয়ে এল আমাদের কাছে। কিছু পয়সাকড়ি হাতে পেয়েছিল পিসিমা। ছেলেবেলা থেকে আমরা যে যার মতন চরে বেড়ালেও পিসি আমাদের মানুষ করেছে।”
“তোমার মা?”
“বলছি, শুনুন। দেড় দু’খানা ঘরে গাদাগাদি করে ছ’জন মানুষ থাকতাম। মা-বাবা একঘরে, বাকি চার জন অন্য ঘরে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মা আর বাবা ঝগড়া করত। বাবা ম্যাটিনি শোয়ের টিকিট বেচতে দুপুরে বেরিয়ে যেত—তারপর বাড়ি ঠাণ্ডা হত। বাবা বাড়ি ফিরত রাত্তিরে। বেশির ভাগ দিন দিশী খেয়ে। মা বাবায় আবার লাগত। মাঝে মাঝে হাতাহাতি। বাবা নেশার ঘোরে কাপড়চোপড় খুলে ফেলত, পেচ্ছাপ করত ঘরে দাঁড়িয়ে। মা বাবাকে মারত। পিসি মাঝখানে গিয়ে পড়লে দু-তরফের গালাগাল হজম করত। …আমার মা সংসার ঠেলে ঠেলে আর বাসন মেজে মেজে রোগ বাঁধিয়ে ছিল নানান রকম। পয়সা নেই বলে এক হোমিওপ্যাথ ডাক্তারকে ধরেছিল মা। তার নাম গোকুল। লোকটার চোখ টেরা ছিল। সবাই বলত টেরা গোকুল। টেরা গোকুল মাকে একটু ভালই বাসত। বলত এক দেশের লোক। মা পিসিকে টেরা গোকুলের বাড়িতে পাঠাত যখন তখন। তারপর পিসি একদিন গোকুলের বাড়িতে রান্নাবান্নার কাজে লেগে গেল। প্রথম প্রথম সন্ধের পর বাড়ি আসত, তারপর আর আসত না। পিসি এখন বারাসাতে থাকে। তার ছেলেপুলেও হয়েছে।”
সুবোধ গলা ভেজাবার জন্যে লালা গিলল। এখন তার চোখমুখ আরও শুকনো, ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। চোখের পাতা আরও যেন ছোট হয়ে এসেছে।
“তারপর?” আমি শুধোলাম।
“তারপর? …হ্যাঁ—তার পরও আছে। জন্তু-জানোয়ার, রাস্তার কুকুর, ফুটপাতের বাচ্চাকাচ্চাও বড় হয়। তারা কী খেয়ে বড় হয়, কেমন করে বড় হয়—সে-সব আপনারা ভেবে দেখবেন। আমরাও বড় হয়ে উঠেছি গাদাগাদি করে, মাটিতে শুয়ে, উকুনভরা ছেঁড়া তোশকের ওপর ঘুমিয়ে। শীতের দিন একটা কাঁথা একা কোনোদিন গায়ে দিতে পারিনি। আমি স্কুলে পড়েছি শেষ ক্লাস পর্যন্ত। পিসির জন্যে। কলেজেও ঢুকেছিলাম। পিসি থাকলে দশ-বিশ টাকা জুটত। মা-বাবা দু বেলা খাওয়াতেই পারে না তো পড়া। আমার ভাই এইট্ পর্যন্ত পড়েছে। শম্ভু —আমার ভাইয়ের মাথা মোটা। খাটতে পারে। অত রোগা, তবু ঘোড়ার মতন খাটে। শম্ভু পাড়ার ইলেক্ট্রিকশিয়ান হরিদার দোকানে ভিড়ে গিয়েছিল। কাজ শিখেছে। এখন নিজে টুকটাক কাজ করে।”
“তোমার বোন?”
“বেলা! বেলার কথা কী বলব?”
“যা ঠিক, তাই বলো।”
সুবোধ আবার জামার হাতায় মুখ মুছল, জিব চাটল। বলল, “বেলাকে ছেলেবেলা থেকেই মা শাসনে রেখেছিল। বেলা দেখতে ভাল নয়, খারাপও নয়। তার চেহারা ছিল বাড়ন্ত। বেলা স্কুলে ফাইভ-সিক্স পর্যন্ত পড়েছিল। তার কাজ ছিল বাড়িতে বসে থাকা আর ঝি-গিরি করা। মা তাকে মারত, ধরত, গালাগালি দিত। বাবা বরং বেলার হয়ে লড়ত মার সঙ্গে। অনেকটা বড় হয়ে একদিন বেলা মার সঙ্গে চুলোচুলি করল। বিচ্ছিরি ঝগড়া। মা বেলার পিঠে ছেঁকা দিয়ে দিল খুন্তির। বেলা মার কনুই মচকে দিল। সে যে কী কাণ্ড ঘটল—বুঝতে পারবেন না। বেলা উনিশ নম্বর বস্তিতে তার বন্ধু কাঞ্চনের বাড়িতে গিয়ে থাকল দু রাত। এরপর থেকে মা ঠাণ্ডা। আর কিছু বলত না।”।
সুবোধের গলা আরও জড়িয়ে আসছিল। টেনে টেনে ধীরে ধীরে কথা বলছে। আলস্য যেন তাকে গভীর করে গ্রাস করছে।
“তোমার কি খুব ঘুম পাচ্ছে?”
“হ্যাঁ, চোখ বুজে আসছে।”
“এই টেবিলে এসে শুয়ে পড়ো।”
“আমায় আর কতক্ষণ আটকে রাখবেন?”
“কথা শেষ না-হওয়া পর্যন্ত।”
“আমি পারছি না।”
“পারবে।”
সুবোধ উঠল। তার পা টলল না। তবু ঘুমঘুম অলসভাবে এসে টেবিলের সামনে দাঁড়াল। আমি সরে গেলাম। পায়ের চটি খুলে সুবোধ টেবিলে উঠল। শুয়ে পড়ল।
সামান্য অপেক্ষা করে আমি বললাম, “তোমার বোন বেলা কবে থেকে ধূপ, আচার বিক্রি করতে শুরু করল?”
“আজ বছর তিন করছে।”
“ও বিয়ে করেছিল?”
“আপনি তাও জানেন?…হ্যাঁ, ও একটা বাজে ছেলেকে বিয়ে করেছিল লুকিয়ে। কালীঘাটে গিয়ে। আমাদের বলেনি। আমরা জানতাম না। সেই ছেলেটা, বাচ্চু, গাড়ির মাল চুরির লাইনে ছিল। গাড়ির টায়ার, রিম। ব্যাটারি…টপাটপ সরাতে পারত। মল্লিকবাজার থেকে পয়সা পেত ভাল। একবার বাবার সিনেমা হাউসের কাছে গাড়ি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে। বেদম মার খায়। বাবা দেখেছিল। বাচ্চুকে এত মেরেছিল সবাই যে হাসপাতালে সে মারা গেল। তার পেচ্ছাপের থলে ফাটিয়ে দিয়েছিল মেরে। বেলা তখন কান্নাকাটি করত। আমরা সেই সময় জানতে পারি
“তা তুমি বোমা ছোঁড়া, ছুরি মারাটা কবে শিখলে?”
সুবোধ শুয়ে শুয়ে মাথা নাড়ল। “আমি বোমা ছুঁড়তে জানি না।”
“জান না? বেশ…।” আমি তার মাথার কাছে সরে এলাম। হাতে সেই চকচকে যন্ত্র। চোখে ফেলব।
সুবোধ সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসল। “না।” তার সারা মুখে আতঙ্ক। “না।”
“তুমি মিথ্যে কথা বলছ। তোমার জাংয়ের কাছে ওই দাগটা বোমার-স্প্লিনটারের। তোমার ওই পায়ের কড়ে আঙুল নেই।”
মাথা দোলাল সুবোধ। “হ্যাঁ।”
“শুয়ে পড়ো। আমায় ঠকাবার চেষ্টা করো না।”
সুবোধ শুয়ে পড়ল।
“এবার বলো।”
সুবোধ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “আমার যখন কিছুই হচ্ছিল না, একটা বেয়ারার চাকরিও নয়, তখন আমি সিঁথির ছোট বাজারে মাছ বিক্রি করব ঠিক করে পঁচিশ-ত্রিশ টাকা পুঁজি নিয়ে নেমে পড়লাম। দমদম মাছপটি থেকে কাদাচিংড়ি কিনে আনতাম আর বাজারে বসে বেচতাম। মাসখানেক পরে একটু পুঁজি বাড়ল। সকাল চারটে নাগাদ এক বন্ধুর ঝড়ঝড়ে পুরনো সাইকেল নিয়ে দমদম স্টেশনে মাছ আনতে যেতাম। একদিন গলির মধ্যে আমায় আটকে গুণ্ডারা টাকাপয়সা কেড়ে নিল। আমি লড়তে গেলাম, শালারা আমায় বোমা মারল। জখম হয়েছিলাম। হাসপাতালে যেতে হয়েছিল।”
“তখন তুমি মিথ্যে বলেছিলে।”
“হ্যাঁ। সত্যি বলে কী লাভ, স্যার। …হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আমি অন্য রকম হয়ে গেলাম। সবাই দেখি হারামি। দশ আনা ছ’ আনা। তো আমিও হয়ে গেলাম। শয়তানদের সঙ্গে লড়তে হলে শয়তান হতে হয়।”
“তোমার বোন বেলার সঙ্গে যে ছেলেটা ঘুরত, তাকে তুমি ছোরা মেরেছ?”
“না। সত্যি না। মারতে গিয়েছি। পারিনি। শালার কপাল ভাল বেঁচে গেছে।”
“কেন তাকে মারতে গিয়েছিলে?”
“কেন? কেন আপনি বুঝছেন না? আমার বোনকে সে অন্য পাঁচটা ধূপ-বেচা মেয়ের সঙ্গে টুকরির মাল করে নিয়েছিল। সারা দিন ধূপ বেচলে কমিশন বাবদ তিনটাকা। সে-শালার সঙ্গে ঘুরলে ফিরলে দশ পনেরো। চাই কি বিশ। ওই শালা শুয়োরের বাচ্চা আমার বোনকে নার্সিং হোমে রেখে…।”
“তোমার বোনেরও তো দোষ আছে।”
“এক হাতে তালি বাজে না স্যার জানি। আমাদের দোষ আছে। কুকুরের দোষ। আর আপনাদের শুধু গুণ…। আরে, ওটা কী করছেন?”
“তোমার কাটা কড়ে আঙুলের জায়গাটা দেখছি। পুরো বাদ দিতে হয়েছে। গ্যাংগ্রীন হয়ে গিয়েছিল নাকি?”
সুবোধ আমাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে আচমকা ডান পা তুলে লাথি মারল। মুখে। তার লাথিটা আমার থুতনি, দাঁত, নাকে লাগল। বেশ জোরে।
আমার লেগেছিল। চোখ বন্ধ করে নিয়েছিলাম। যন্ত্রণা হচ্ছিল নাক আর দাঁতে।
সুবোধ টেবিলের ওপর উঠে বসেছে ততক্ষণে। আমায় দেখছিল।
আমার নাক দিয়ে রক্ত চুঁইয়ে পড়তে লাগল। ওপর ঠোঁট ভিজে নিচের ঠোঁটে গড়িয়ে পড়ল।
সুবোধ বলল, “আমি বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম—আপনি কোনো চালাকি করছেন। ওই কাটা জায়গাটায় আমার খুব ব্যথা। এখনও। ভীষণ কষ্ট হয়।”
রুমাল বার করে নাক-মুখ চাপতে চাপতে আমি মাথা নাড়লাম। আস্তে। বলতে চাইলাম, জানি; আমারও হয়। সুবোধ বুঝল কিনা কে জানে!