নিগূঢ় সংকেত

নিগূঢ় সংকেত

(১)

গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠান সেরে, অম্বরিশ ও তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী এসে উঠল তাদের কলকাতার নতুন বাড়িতে৷

সুদর্শন, সুঠাম চেহারার অম্বরিশের বয়স আটত্রিশ ও ঊনচল্লিশ এর মধ্যবর্তী ধূসর সীমারেখায়৷ একুশ বছর সেনাবাহিনীতে চাকুরি করার পর ভলেন্টিয়ার রিটায়ারমেন্ট নিয়ে বর্তমানে সে এখন নিজের একটি বই-এর দোকান দিয়েছে৷ বাড়িটা বেশ সস্তায় পেয়েছে সে৷ যদিও পরে মিস্ত্রি লেবার লাগিয়ে টুকিটাকি কিছু কাজ করাতে হয়েছিল৷

বাড়িটাকে ছোটখাট বাংলো বললে কিন্তু ভুল বলা হবে না৷ সামনে চওড়া উঠান, উঠানের ওপাশে চারপাশ ঘেরা ছোট্ট বাগান আর তারকাঁটায় ঘেরা উঁচু পাঁচিল৷ বাগান আম, কাঁঠাল, লিচু, সুপুরি সহ মর্নিং গ্লোরি, সুবর্ণলতার মত বিস্তর ফুল-ফলের, লতা-বৃক্ষে পরিপূর্ণ৷ তবে অবাক করার মত ছিল নারকেল গাছগুলো৷ বাগানের দুটো নারকেল গাছ এতটাই উঁচু ছিল যে এদের উচ্চতাকে যেকোন গগনচুম্বি অট্টালিকার সাথে তুলনা করা যায়৷ এতো উঁচু নারকেল গাছ এর আগে কখনো দেখে নাই অম্বরিশ৷ সব মিলিয়ে ঘরটা যেন তার স্বপ্নের বাস ভবন৷ একসময় ঠিক এরকমই একখানা ঘরের কল্পনার রেখাচিত্র করেছিল সে মনে মনে৷

বেশ কয়েকমাস কেটে যায়৷ একদিন হঠাৎই ব্যবসায়িক সূত্রে অম্বরিশকে নেপাল যাওয়ার প্রয়োজন পরে৷ দু’দিনের মধ্যেই বেরোতে হবে৷ অলি নয় মাসের সন্তানসম্ভবা৷ যখন তখন প্রসব যন্ত্রণা উঠতে পারে তাই এমতাবস্থায় স্ত্রীকে একা ফেলে যাওয়া বিপদ৷ কিন্তু না গেলেই নয়৷

অম্বরিশ আর অলির দুজনেরই মা, বাবা নেই৷ দু-একটা আত্মীয় আছে বটে দূরসম্পর্কের, কিন্তু এই মুহূর্তে অলির দেখাশোনা করার জন্য তাদের এখানে আসা সম্ভব নয়৷ তাই সে তার ভবিষ্যতে অনুপস্থিতির দিন গুলোতে অলির দেখাশোনা করার জন্য একজন আয়া ঠিক করে৷

(২)

নেপালে এসে প্রায় একসপ্তাহ কেটে গেছে৷ যে কারণে আসা সেই কাজ-কর্মগুলো ভালোয় ভালোয় মিটে গেছে। পরদিন ন’টার সময় ত্রিভুবন এয়ারপোর্ট থেকে কলকাতার ফ্লাইট ছাড়বে৷

আজ সে কিছুটা স্বস্তিবোধ করছে৷ নইলে এতদিন সে বেশ চিন্তিত ছিল অলিকে নিয়ে৷ বারবার ভিডিও কলে তার খোঁজখবর নিয়েছে, আয়া মাসিকে ফোন করে বারবার ঔষধের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে, কড়া আদেশে বলে দিয়েছে তার স্ত্রীর কোন অযত্ন যেন না হয়৷

বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়ে এল৷ পাহাড়ি অঞ্চলে সন্ধ্যা নামে খুব তাড়াতাড়ি৷ অলি বলেছিল আসার সময় সে যেন তার জন্য ভুট্টার চকলেট আর নেপালি অলঙ্কার করা ঢাকনাওয়ালা চায়ের পেয়ালা নিয়ে আসে৷ সে নাকি কলেজে পড়ার সময় একবার বন্ধুদের সাথে নেপালে ঘুরতে এসে সেই ভুট্টার চকলেট খেয়েছিল৷ সেই স্বাদ আজও তার জিভে লেগে আছে৷

‘আসান’ নেপালের নামকরা বাজার৷ সেখান থেকে অনেক কিছুই কিনেছে সে৷ নতুন ঘরটা সাজাবার জন্য টুকিটাকি জিনিসপত্র থেকে সস্তায় কয়েকটা বই, চাদর, ভবিষ্যতের সন্তানের জন্য কিছু খেলনাপাতি আরো কত কি৷ অলির জন্য ভুট্টার চকলেটও কিনেছে৷ তবে অনেক খুঁজেও সে নেপালি কারুকার্য করা পেয়ালাটা পায় নি৷ তিন চারটে বড় বড় দোকানে ইতিমধ্যে সে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে কিন্তু পাইনি, স্টক শেষ৷ দোকানদারদের বক্তব্য এরকম পেয়ালার চাহিদা, বাইরে থেকে আসা পর্যটকদের কাছে খুবই বেশি তাই এসব জিনিস বেশিদিন স্টকে থাকে না৷

অম্বরিশ হতাশ হয়ে চলেই যাচ্ছিল হঠাৎ সে থমকে দাঁড়াল৷ রাস্তার এক পাশে ধোঁয়াচ্ছন্ন, অন্ধকার গলিটার দিকে তার চোখ গেল৷ চোখ দুটো ছোট করে, দৃষ্টি বর্ধিত করে সে গলির ভিতর দেখার চেষ্টা করল৷ ধূম-ধোঁয়াশা, অন্ধকার গলির মধ্যে দেওয়ালের একপাশে অস্পষ্ট কিছু একটা দেখা যাচ্ছিল৷ সম্ভবত একটা ঘুমটি দোকান৷ সন্তর্পনে সে পা বাড়াল সেদিকে৷ যতই ভিতরে যায় ততই গলিটার মধ্যে বিরাজমান গাঢ় নিস্তব্ধতা তাকে ঘিরে ধরে৷ বাইরের সূর্যালোকের ছিঁটে-ফোটাও এখানে এসে পৌঁছাচ্ছে না৷ এ যেন জগৎ সংসারের একেবারে শেষ সীমা। জন-প্রাণীর লেশমাত্র চিহ্ন নেই এখানে৷

আরেকটু ভিতরে যেতেই একটা কেরোসিন বাতির টিমটিমে আলোয় দেখল, সেই অন্ধকারের কিছু অংশ ভেদ করে মুখ উঁচিয়ে রয়েছে ঘুমটির তেরপলের ছাউনি৷ হ্যাঁ, ঘুমটি দোকানই বটে৷ এমনিতে কারও চোখে পড়া বৈ তো নয়, খুব ভাল করে খেয়াল না করলে দেখতে পাওয়াটায় দুস্কর৷ সে একবার ভাবল, এই জনমানবহীন এরকম এক অন্ধকার গলির এই দোকানে আদৌ কোন ক্রেতা আসে? মনে তো হয় না যে পেয়ালা এখানে অন্তত পাওয়া যাবে৷

ঘুমটির সম্মুখে যেতেই দেখল ছোট্ট চারহাতার ঘুমটিতে সাজানো রংবেরঙের ঘর সাজাবার বিভিন্ন সামগ্রী৷ আলিবাবার গুপ্তধনের মত চকচক করছিল সেসব৷ চোখ ধাঁধানো আলোক ছটা যেন সেগুলোর অন্তস্থ কোন এক অজ্ঞাত উৎস থেকে বেরিয়ে আসছিল৷ দোকানের মালিক নেই৷ অম্বরিশ হাঁক দিতে যাবে এমন সময়, চারিদিকের নিস্তব্ধতার অকস্মাৎ অবসান ঘটল৷ একটা পাতলা কর্কশ গলা ঘুমটিটার ভিতর থেকে ভেসে এল৷

‘কি চাই?’

একটু পরেই সেই চোখ ধাঁধানো ছটার মধ্যে থেকে একটা অবয়বকে আসতে দেখা গেল৷ মধ্যযুগের সুলতান বাদশাদের মত নানা রঙের পাথরের কাজ করা লাল আলখাল্লা পরিহিত এক বৃদ্ধ৷ কিছুটা সামনে ঝুঁকে পড়ে, একটা বাকা লাঠিতে ভর করে ঠক্ ঠক্ শব্দে এগিয়ে এল৷

নেপালি বৃদ্ধোর চোখে-মুখে বার্ধক্যের বুলিরেখা স্পষ্ট৷ কপালের চামড়া জড়ো হয়ে অসংখ্য ঢেউ খেলানো রেখা ফুটিয়ে তুলেছে৷ বয়সের জেরে পিঠ কুঁজো হয়ে গিয়েছে৷ বৃদ্ধোর ছোট্ট টানাটানা চোখের পাতাগুলো সেটার এতখানিই ঢেকে ফেলেছিল যে চোখ দেখাই যাচ্ছিল না প্রায়৷

‘কি চাই?’ আবার জিজ্ঞেস করল বৃদ্ধ৷

‘নেপালি নকশাকাটা, ঢাকনাওয়ালা পেয়ালা হবে? ওই সোপিস আর কি৷’

বৃদ্ধ আধবোজা চোখে তার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকল৷ কিছু না বলেই লাঠি হাতে আবার ঠক্ ঠক্ করতে করতে যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকেই অদৃশ্য হয়ে গেল৷

কিছুক্ষণ পরে পুনরায় বৃদ্ধর আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করল অম্বরিশ৷ জরাজীর্ণ হাতে সে একটা পেয়ালা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘দেখ! এরকম?’

কালো রঙের উপর সোনালি রঙের নকশা কাটা৷ ঢাকনাতেও নেপালি ভাষায় কীসব অক্ষর অলংকৃত করা৷ গ্লেজের একটা পরদ থাকায় সেটার চকচকে ভাবটা চোখে লাগার মতন ছিল৷

‘খুব চলবে!’ বিস্ময়, বিস্ফারিত চোখে, প্রফুল্লের সাথে বলে উঠল অম্বরিশ৷

বৃদ্ধর কাছ থেকে পেয়ালাটা নেওয়ার সময়, তার হাত বৃদ্ধর হাত একটু ছুঁয়ে যায়৷ সাথে সাথে তার সারা শরীর শিরশিরিয়ে একটা শীতল অনুভূতি বয়ে যায়৷

মনে মনে ভাবল, কি ঠান্ডা হাত রে বাবা৷ মনে হল যেন শুষ্ক কার্বনডাই-অক্সাইড বরফে হাত ঠেকল৷

পেয়ালাটা হাতে নিয়ে সেটাকে বেশ করে নেড়ে-চেড়ে দেখতে লাগল৷ একটা স্বভাব ফৌজি লোকেদের, সব জিনিসকে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে তবে সেটার সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেবে৷ বিশেষ করে অম্বরিশের এই সন্দেহবাতিক খুঁত খুঁতে স্বভাবের জন্য অলি তার সাথে বেশ কয়েকবার ঝগড়াও করেছে৷ তবু অভ্যাস কি আর অত সহজে যায়?

পেয়ালাটা বেশ মনে ধরেছে তার৷ সেটার উপর থেকে চোখ যেন ফেরানোই যায় না৷ রূপ, রঙ কেমন যেন এক মায়াবী মাদকতায় ভরা৷ পছন্দ না হয়ে কোন উপায়ই নেই৷ আরো বেশ কিছুক্ষণ সেটাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বৃদ্ধকে সেটার মূল্য জিজ্ঞাসা করল৷

‘পয়সা দিয়ে কি এর দাম মেটানো যায়?’ চাপা, কর্কশ, ক্ষীণ হাসি হেসে বললো বৃদ্ধ৷

‘টাকা লাগবে না! তাহলে কি লাগবে?’ অবাক হয়ে, জিজ্ঞাসাসূচক সুরে বলল অম্বরিশ৷

‘সময় এলেই বুঝতে পারবে৷’

বৃদ্ধর এই রহস্যময় উক্তিটায় তার কেমন একটা খটকা লাগল৷ সে নিজেও ব্যবসাদার, কই কখনও তো সে তার অন্তরঙ্গ বন্ধুকেও এমনিতে বই দেয় নি৷ দেবেই বা কেন? ব্যবসা, ব্যবসার জায়গায় আর বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা নিজেদের জায়গায়৷ এক্ষেত্রে তার মত অপরিচিত এক খরিদ্দারকে এভাবে ফ্রি-তে দিয়ে দিল৷ বৃদ্ধ কি উন্মাদ না কি এর পিছনে কোন কু-মতলব লুকিয়ে আছে? সে কিছু বলতে যাবার আগেই বৃদ্ধ চলে যাচ্ছিল, সে আবারও জিজ্ঞেস করল, ‘এই যে শুনুন, কত কি দেব এটার জন্য বলে যান?’

‘বললাম তো কিছু লাগবে না৷ যাও এখান থেকে৷’ দোকানের ভিতরের অন্ধকার অংশটা থেকে গমগম করে ভেসে এল৷

অযাচিত এই পাওনায় অম্বরিশ যে নিজেকে লাভবান বোধ করল না তা অবশ্য বললে ভুল বলা হবে৷

দোকানের সামনে থেকে পাশে সরে এসে পেয়ালাটাকে ব্যাগ বন্দী করল৷ ফেরার জন্য উদ্যত অম্বরিশের এমন সময় চোখ পড়ল একটা জিনিসে৷ ঘুমটির পাশের দেওয়ালে সাঁটা একটা সাইনবোর্ড৷ সে একটু অবাক হল, কারণ আসার সময় এটা ছিল না বা হয়ত সে খেয়াল করে নাই৷

আদ্যিকালের পুরানো হলদেটে একটা সাইনবোর্ড৷ বেশিরভাগ অংশেই মরচে পড়ে গিয়েছে৷ যা লেখা ছিল তার অধিকাংশে এমন মরচে ধরেছে যে সেসব পড়বার অবস্থায় নেই৷ তবে ভাল করে লক্ষ করলে, বর্ণিত অক্ষরগুলোর অবশিষ্টাংশ দেখে ঠাহর করা যায় সেগুলো নেপালি ভাষায় লেখা৷ যদিও তার কোনটারই বোধগম্য নয় অম্বরিশের কাছে৷ লেখাগুলোর ঠিক নিচে প্রথম বন্ধনীর মধ্যে ইংরেজি অক্ষরে ছোট্ট করে লেখা, ‘Do ..t buy a..ythi..g. It’s a D…..s s..re’ প্রথম লাইনটা কোন ভাবে বোঝা যাচ্ছিল৷ কিছু কিনতে বারণ করছে৷ কিন্তু পরের লাইনের, মূল কারণের জায়গাটায় মরচে ধরে লেখাগুলো একেবারে উঠে গেছিল৷ বোঝার জো নেই৷ এই লেখা যে এই ঘুমটি দোকানকেই উদ্দেশ্য করে লেখা সেটা তার বুঝতে বাকি রইল না৷ কিন্তু কেন এই দোকান থেকে কিছু কিনতে বারণ করছে? টিকটিক করে যান্ত্রিক চিৎকার করে উঠল তার হাতঘড়িটা৷ তাকিয়ে দেখল পৌনে ছটা৷

দূরের পর্বতের কোলে সূর্য ঢলে পড়েছে৷ চারিদিকের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে শেষ বিকেলের রাঙা আভার চাদর৷ আর কিছুক্ষণ পরেই অবশিষ্ট এই আলোটুকুর পরিসমাপ্তি ঘটবে৷ ঝুপ করে চারিদিক ছেয়ে নেমে আসবে অন্ধকার৷

অম্বরিশ গলি থেকে বেরিয়ে এল৷ একটা শেয়ারের গাড়ি ভাড়া করে হোটেলের দিকে রওনা দিল৷ রাত্রে সে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল কারণ কাল কাকভোরে তাকে উঠতে হবে৷

সকাল সাতটা বেজে গেছে৷ সব প্যাকিং সেরে, নেয়ে, খেয়ে সে তৈরি৷ শুধু গাড়ি আসার অপেক্ষা, গাড়ি এলেই বেরিয়ে পরবে৷ কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি এসে পড়ল৷ হোটেলের ভাড়া মিটিয়ে, তল্পিতল্পা গাড়ির মধ্যে চাপিয়ে উঠে বসল৷ আধা ঘন্টার মধ্যেই গাড়ি এসে পৌঁছালো এয়ারপোর্টে৷

ডিপারচারের আর বেশি সময় ছিল না৷ আর কয়েক ঘন্টা পেরোলেই দেশে, আর বিকেলের মধ্যেই বাড়ি৷

মোটে একটি সপ্তাহ, কিন্তু তার কাছে যেন একটা যুগ পেরিয়ে গেছিল অলির থেকে দূরে এসে৷ সারাটা পথ তার মন, স্ত্রীকে আবার কাছে পাবার তাড়নায় ব্যাকুল হয়ে রইল৷ আজ বাড়ি ফেরার স্নিগ্ধ সুখ তাকে আরো অধৈর্য করে তুলেছিল৷ ঔৎসুকতায় ভরা আনন্দের বান তার হৃদয় কূল ছাপিয়ে, মনটাকে তোলপার করে তুলছিল৷ সে যে খুব ভালবাসে অলিকে৷ মা, বাবা হারা মেয়েটার সব বলতে তো কেবল সেই আছে৷ তার সকল স্নেহ, ভালোবাসা, সুখ-দুঃখের সঙ্গী৷

পেয়ালাটা আর আনুসাঙ্গিক উপহারগুলো সে রঙিন কাগজে সুন্দর করে মুড়ে নিয়েছিল৷ অলিকে সে একেবারে চমকে দিতে চাই৷

(৩)

বাড়ি পৌঁছতে বিকেল পাঁচটা গড়িয়ে এল৷ সদর দরজার সামনে এসে এক দীর্ঘ স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল৷ তার শখের বাগান, স্বপ্নের বাড়ি সকলে যেন একসাথে তার আহ্বান জানাচ্ছিল৷ বৃহদাকার নারকেল গাছ দুটো দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে ছিল, যেন তারা অম্বরিশের দ্বাররক্ষী৷ ডোরবেলটা দুবার বাজিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিতর থেকে এক পরিচিত মধুর কন্ঠস্বর ভেসে এল৷ সেই ডাক তার ক্লান্তিভরা শরীরে নব প্রাণের সঞ্চার করল৷ দরজা খুলতেই সে প্রায় ঝাঁপিয়েই অলিকে আলিঙ্গন করল৷

‘ছাড়ো এবার, ভিতরে এসে হাত পা ধুয়ে নাও৷ তোমার প্রিয় খাবার বানিয়েছি৷’

‘তোমার শরীরের এই অবস্থায় তুমি এতো খাটতে গেলে কেন? মাসি কোথায়?’

‘যাঃ! খাটুনি হল বুঝি? আয়া মাসি এতদিন আমার খুব যত্ন করেছে৷ যাও, ব্যাগপত্তর গুলো ঘরে রেখে ফ্রেশ হয়ে নাও গিয়ে৷’

খাওয়া-দাওয়া সেরে অম্বরিশ চকোলেটের প্যাকেটটা আর উপহারটা অলিকে দিল৷ চকোলেট পেয়ে সে ঠিক ছোট খুকীর মত আহ্লাদী হয়ে পড়ল৷ কিন্তু তার চোখকে আকর্ষণ করে সেই পেয়ালাটা। এক আশ্চর্য মায়াবী শক্তি ছিল যেন পেয়ালাটায়৷ একবার দেখলে মনে হয় দেখতেই থাকি, চোখ ফেরাতে মন চাই না৷ অবাক বিস্ময়ে, বিস্ফারিত চোখে সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকল সেটাকে৷ বার বার বলতে থাকল, ‘অসাধারণ! কি অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্য৷’

অলির কথায় সায় দিল অম্বরিশ। বিনামূল্যে সে কিভাবে সেটাকে পেয়েছিল, সেসবই অলিকে জানাল। অলি শুনে খুবই অবাক। বলল, ‘সে যাক গে! একদিকে ভালোই হল। পয়সা খরচাও হল না, আবার এত্ত সুন্দর জিনিসটাও পেলাম।’

সারাদিনের পথযাত্রার ক্লান্তি গ্রাস করেছিল অম্বরিশকে। নিয়ে গিয়েছিল গভীর ঘুমের দেশে৷ হঠাৎ কেউ যেন তার অবচেতন মনটাকে টানতে লাগল চেতন জগতের দিকে৷ ঘুমটা একটু পাতলা হতেই তার কানে ভেসে এল কাতর কণ্ঠের এক চাপা গোঁঙানি৷ স্প্রিং পুতুলের মত ধড়মড়িয়ে সে উঠে বসল৷ পাশের বেড সুইচ টিপে ঘরের আলো জ্বালালো৷

অলি পাশবালিশটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল৷ প্রসব যন্ত্রনা৷ অম্বরিশ তার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিলো৷

‘সব ঠিক হয়ে যাবে৷ আমি এখনই অ্যাম্বুলেন্স ডাকছি৷’

কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স এসে পড়ল৷ অলিকে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে৷ ডাক্তার এসে অম্বরিশকে বলল- ‘অপারেশন করতে হবে, আজকেই ডেলিভারি হবে৷ আপনি কাউন্টারে ফর্ম আর টাকা জমা করে আসুন৷’

প্রায় এক ঘন্টা কেটে গেল, ওটি ঘরের বাতি তখনও জ্বলছে৷ চিন্তায় উদ্বিগ্ন অম্বরিশের মনে তখন নানা ধন্দের জোট পাকতে থাকল৷ কতজন সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছে, অলিরও যদি সেরকম…৷ আবার নিজেকেই নিজে ধমক দিয়ে বলছে, ধুর যত উল্টোপাল্টা ভাবনা৷ এসব সাতপাঁচ ভাবনার মধ্যেই একসময় অপারেশন থিয়েটরের দরজা খুলে গেল৷

ডাক্তার এসে বলল, ‘কংগ্রাচুলেশন আপনার যমজ ছেলে হয়েছে৷’

আনন্দে আত্মহারা অম্বরিশের মুখ প্রফুল্লতায় ভরে উঠল৷ কি একটা চিন্তা করল৷ নিমেষের মধ্যেই, প্রদীপের শেষ শিখার মত দপ করে সেইসব আনন্দ কোথায় যেন মিলিয়ে গেল৷

‘ডাক্তার আমার স্ত্রী?’ চিন্তিত মলিন কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল৷

‘ওহঃ! চিন্তা করবেন না, সী ইজ অলরাইট! এখন ক্লান্ত আছেন৷ বাচ্চা দু’টোকে ফিডিং করানো হয়ে গেলেই আপনি দেখতে যেতে পারবেন৷’

স্বস্তির এক নিঃশ্বাস ছাড়লো অম্বরিশ৷ কিছুক্ষণ পর সে অলিকে দেখতে গেল৷ সন্তান প্রসবের ধকলে মুষড়ে পড়েছে৷ তার দুর্বল, অর্ধচেতন শরীর লুটিয়ে পড়ে আছে বিছানায়৷ বেডের শিওরের কাছে বসে সে তার মাথায় আলতো হাত বোলাল৷ স্নেহ ভরা মৃদু স্বরে ডাকল, ‘অলি?’

ঢুলু ঢুলু চোখ ধীরে ধীরে প্রসারিত করে অলি তাকাল৷ ক্লান্তি ভরা একটা মিষ্টি হাসি হেসে আবার চোখ বন্ধ করল৷ অম্বরিশও আর বিরক্ত করল না৷

অনেকগুলো বই-এর ডেলিভারির অর্ডার থাকায় পরদিন অম্বরিশকে দোকানে যেতে হল৷ সে আয়া মাসিকে অলির দেখাশোনার ভার দিয়ে গেল আর পই পই করে বলে গেল কোন প্রকার অযত্ন যেন না হয়৷ কাজ শেষ হলে সে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসবে৷

দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমে এল৷ শরীরে ক্লান্তির স্পর্শ থাকলেও গতকালের থেকে আজ অলি অনেকখানিই সুস্থ-সবল৷ আয়া মাসি তার ভালোই দেখাশোনা করছিল বটে৷ গরম দুধ, সময়মত ওষুধ সবকিছু নিয়ে হাজির হচ্ছিল৷ অম্বরিশ ফোনে জানিয়েছিল, তার গাড়িটা বিগড়ে যাওয়াতে তার আসতে একটু রাত হবে৷

রাত্রি তখন ন’টা প্রায়৷ অনেকক্ষণ আগেই নার্স এসে অলিকে খাবার দিয়ে চলে গিয়েছিলো৷ মাসি বাইরে গিয়েছিল পান কিনতে৷ নবাগত শিশু দুটি তখন সুখনিদ্রার দেশে৷ এর পরেই হয়ত ঘুম থেকে উঠেই আবার গগনবিদারী পরিত্রাহি কান্নায় নিজের অস্তিত্ব জানান দেবে৷ অলি দেখেছে, ঘুমন্ত অবস্থায় দু’জনকে দেখে ঠিক যেন দেবশিশু মনে হয়৷

আয়া মাসি তখনও ফেরে নাই৷ এদিকে ফ্লাস্কের জলও শেষ৷ বাচ্চা দুটোর দু’পাশে কাপড় কোলবালিশের মত গুঁজে অগত্যা ওকেই যেতে হল৷ ফেরার সময় সে লক্ষ্য করল অন্য সব কেবিনের আলো জ্বলছে কিন্তু তার কেবিনটা অন্ধকার৷ নিঃসাড়ে সে কেবিনের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল৷ শুক্লাপক্ষের রাত৷ পশ্চিমের খোলা জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করছিল জ্যোৎস্নার আলো৷ সেই আলোতে অলি দেখল, মুখ পর্যন্ত ঢাকা আলখাল্লা পরিহিত পাঁচ-ছয় জনের মত অতিকায় চেহারার লোক তার কেবিনে প্রবেশ করেছে৷ তাদের উচ্চতা এতোটাই অস্বাভাবিক যে মাথা হাসপাতাল ঘরের সিলিং ছুঁয়েছে৷ আগন্তুকরা তার বেডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ তারা প্রত্যেকেই ছেলেদুটোর উপর একবার করে ঝুঁকে পরক্ষণে আবার সিধে হয়ে দাঁড়াচ্ছে৷

এতক্ষণ সে পাথরের মত দাঁড়িয়ে এসব দৃশ্য দেখছিল৷ হাত থেকে জলের ফ্লাক্সটা ঠন ঠন আওয়াজে মাটিতে পড়ে গেল৷ সম্বিত ফিরতেই এবার সে প্রচন্ড ভয়ে আর্তনাদ করে উঠলো৷ পরমুহূর্তেই অলি দেখল তার চিৎকার লোকগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে৷ আলখাল্লার জন্য কারও মুখ সে দেখতে পেল না৷ এরপর তারা প্রত্যেকেই জোনাকির আলোর দীপ্তির মত লালচে রঙের স্ফুলিঙ্গে পরিণত হয়ে জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল৷ আর সাথে সাথেই কেবিনের টিউবলাইটটাও জ্বলে উঠল৷

অলির চিৎকারে আশেপাশের কেবিন থেকে কয়েকজন মহিলা ছুটে এসেছে৷

ততক্ষণে সে ছেলেদুটোকে তার বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল৷ ভীতসন্ত্রস্ত, ক্রন্দনরত অলির মুখে ঘটনার বিশেষ কোনো বিবৃতি পাওয়া গেল না৷ যেটুকু সে বলল তাতে বাকিরা কিছুই বুঝল না৷

একসময় নার্স এসে বাচ্চা দুটোকে দেখে বলল, ‘এ যে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে দুজনেরই! দাঁড়ান ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনি৷’

নার্সের কথা শুনে অলি হাপুসনয়নে কাঁদতে লাগল৷ কেবিনের দরজার সামনে ভিড় ঠেলে হন্তদন্ত করে ভেতরে এল অম্বরিশ৷ অলি, তাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে আকুতরে কাঁদতে থাকল৷ হতভম্ব অম্বরিশ কিছুই বুঝে উঠতে পারল না৷ সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আহাঃ, কি হয়েছে বলবে তো! তোমার কেবিনের সামনে এত ভিড়ই বা কেন?’ অলির মুখে কোন রা নেই৷

ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন মহিলা বলল, ‘তোমার স্ত্রীর চিৎকার শুনেই তো আমরা এলাম৷ জিজ্ঞেস করলে ঠিক করে কিছু বলতে পারছে না৷ বোধহয় খুব ভয় পেয়েছে কোন কিছুতে৷’

‘এখানে ভিড় করবেন না, সব ঠিক আছে৷ আপনারা নিজেদের কেবিনে যান৷’ ভারি গম্ভীর গলায় ডাক্তার, নার্সকে কেবিনের পর্দা টানার হুকুম জারি করল৷

বাচ্চা দুটোর নারী টিপে, থার্মোমিটার, টেথোস্কোপ ইত্যাদি দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পরীক্ষা করে জানালো ঠান্ডা লাগার জন্য জ্বর এসেছে৷ ওষুধ দেবে, সেরে যাবে৷

একসময় ডাক্তার নার্স সবাই চলে গেল৷ অলি কিছুটা ধাতস্থ হলে অম্বরিশকে সব ঘটনা খোলসা করে জানাল৷

কথাগুলোতে আমল না দিয়েই হো হো করে হেসে অম্বরিশ বলল, ‘ওসব তোমার মনের ভুল৷ দুর্বলতা এখনও কাটে নি, তাই কি দেখতে কি দেখেছ৷ একপ্রকার হ্যালুসিনেশন হয়েছিল তোমার৷ এখন শুয়ে পড়, নইলে আরো শরীর খারাপ করবে৷’

অম্বরিশের কথাগুলো স্বস্তি আনতে পারল না অলির মনে৷ সারারাত ছেলেদুটোকে বুকে করে আগলে রাখল৷ একবার করে ছেলে দুটোর মুখ পানে চায় আর একবার করে উঠে জানালায় গিয়ে কি একটা দেখে আসে৷

এভাবে সারারাত বিভিন্ন যুক্তিতর্ক, ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে ঘটনাগুলোকে বিশ্লেষণ করে বোঝার এক বৃথা চেষ্টা করল৷ এক অশনি আশঙ্কা তার অন্তরকে উথাল-পাতাল করে তুলল৷

এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল তার খেয়াল নেই৷ জ্যোৎস্নার রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠেছিল৷ আর কিছুক্ষণ পোহালেই ভোর৷ তখন এই প্রাণহীন অন্ধকার মৃত্যুপুরীর বুক চিরে পূর্বাকাশে উদীয়মান হবে প্রাণবান বলবান সূর্য৷ তার দীপ্তিতে চারিদিক জুড়ে প্রাণের নবসঞ্চার ঘটবে৷

হঠাৎই অলির মনে হল কারা যেন তার পাশে দাঁড়িয়ে ঘনঘন নিশ্বাস ছাড়ছে৷ সে চোখ খুলতেই দেখে তার পাশে দাঁড়িয়ে সেই লোকগুলো, যাদের কিছুক্ষণ আগেই সে দেখেছিল৷ ক্ষুব্ধ সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছে৷ এবার তারা একটু একটু করে আরো কাছে আসতে লাগল অলির৷ অম্বরিশ তখন অঘোরে ঘুমিয়ে৷ সে প্রাণপণ চেষ্টা করল চিৎকার করে তাকে ডাকার৷ কিন্তু তার পুরো শরীর অসাড় হয়ে গিয়েছিল৷ ঠিক যেন প্যারালাইসড্ রুগী৷ কোন অদৃশ্য শক্তি তার শরীরের সমস্ত বল শোষণ করে নিয়েছিল৷ চিৎকার করা তো দূরে থাক, হাতের আঙ্গুল নাড়ানোর ক্ষমতা পর্যন্ত ছিল না৷ মনে মনে একবার ভাবল, তাহলে কি কিছুক্ষণ আগের ঘটনার আবার পুনরাবৃত্তি ঘটবে? এক সর্বনাশের আশঙ্কা তার মনে এল৷ ঠিক তখনই ওদের একজন তার দু’হাত বাড়াল অলির সন্তান দুটোর দিকে৷ এই সময় তার নজর পড়ল লোকটার হাতের দিকে৷ আলখাল্লার হাতা থেকে বেরিয়ে এসেছে লালচে রঙের হাত৷ হ্যাঁ, লালচে রঙ! জ্যোৎস্নার আলোতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে৷ আরো ভালো করে লক্ষ্য করল৷ দেখলো হাতটা একটা সাধারন পুরুষের হাতের থেকে প্রায় দ্বিগুণ আকারের৷ ছুঁচালো তীরের ফলার মতো সরু আঙুলগুলো৷ মানুষের হাতের চামড়াটাকে ছাড়িয়ে নিলে পেশির একটা স্তর লক্ষ করা যাবে, এ ঠিক যেন সেই রকম৷ তবে কোন এক আধাস্বচ্ছ আবরণ এটাকে ঢেকে রেখেছে৷

এরপর লোকটা দু’হাতে অলির দুই সন্তানদের তুলে নিল৷ পলকের মধ্যেই লোকগুলোর প্রত্যেকেই একে একে আগুনের স্ফুলিঙ্গে পরিণত হল ঠিক আগের মতো৷ তারা অকস্মাৎ সর্পিল ভঙ্গিতে শূন্যে পাক খেতে খেতে জানলা দিয়ে বেরিয়ে নিশি জ্যোৎস্নায় মিলিয়ে গেল৷

আর্ত চিৎকার করে উঠল অলি৷

‘কি হল?’ ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই থতমত খেয়ে জিজ্ঞাসা করল অম্বরিশ৷

‘ওই ওরা আবার!’ কাঁপা আঙুলে জানলার দিকে ইশারা তুলল অলি৷ কি একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল৷ শশব্যস্ত ভাবে চারপাশে তাকিয়ে দেখে বাচ্চা দুটো তখনও ঘুমাচ্ছিল৷ সকালের প্রথম আলো জানালা দিয়ে ঘরে এসে পড়েছিল৷

তার মানে সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল? সবকিছু কেমন যেন ধোঁয়াশার মত ছিল তার কাছে৷

অম্বরিশ জিজ্ঞেস করল, ‘খারাপ স্বপ্ন দেখেছো?’

‘হুম, মনে তো তাই হচ্ছে!’ বলেই একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল৷

‘শোনো না বলছি ডিসচার্জ নিলে কেমন হয়? এই হাসপাতলে না আমার আর থাকতে ভালো লাগছে না৷’

‘হ্যাঁ আমিও তাই ভাবছিলাম৷ ঠিক আছে তাই হোক৷ আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলি৷ বাড়িতেই তোমার দেখাশোনার একটা ব্যবস্থা করার চেষ্টা করি৷’

সেদিনের পর হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ নিয়ে অলি তার ছেলেদের সাথে কলকাতার বাড়িতে চলে এসেছিল৷ ওর দেখাশোনার জন্য অম্বরিশ দুজন নার্স রেখেছিল বাড়িতে৷

(৪)

সাত বছর কেটে গিয়েছে৷ দুই ভাই বুকুন আর তোতন বড় হয়েছে৷ অম্বরিশের ব্যবসা আগের থেকে আরও রমরমিয়ে চলছে৷ সেদিনের ছেলেমানুষ অলি আজ দায়িত্ববান মা৷

আর কিছুদিন পরেই তার দুই ছেলের জন্মদিন, তাই আজ সে ঘর-দুয়োরগুলো ঝাড়া-পোছা করছে৷ আলমারিটা ঝাড়বার সময় খবরের কাগজে মোড়া কি একটা জিনিস তার চোখে পড়ল৷ খুলে দেখে সেই পেয়ালাটা৷ সেবার নেপাল থেকে ফিরে যেটা অম্বরিশ তাকে উপহার দিয়েছিল৷ সেই অসাধারণ কারুকৃতিগুলো আজও ঠিক আগের মতোই নজর কাড়ে৷ বরং আগে থেকে যেন বেশি মোহ তৈরি করছিল৷ পেয়ালাটার জৌলুস সময়ের সঙ্গে যেন আরো বেড়ে উঠেছিল৷

অলি কিছুক্ষণ এভাবেই মোহগ্রস্তের মত পেয়ালাটার দিকে তাকিয়েই রইল৷ এর আগে পেয়ালাটার বিস্ময়কর কারুকার্য দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ঠিকই কিন্তু আজকের অনুভূতিটা তার কাছে কেন যেন একটু অন্যরকম ঠেকল৷ ঢাকনাটা খুলতেই তার মনে হল, সেটার ভেতরের অন্ধকার গহ্বর তাকে যেন ডাকছে৷ ভিতরে নিয়ে যেতে চাইছে কোন এক অপার্থিব রহস্যময় জগতে৷ অলি মন্ত্রমুগ্ধের মত পেয়ালাটার ভেতর তাকিয়ে থাকল৷ এমন সময় খুব মৃদু একটা আওয়াজ তার কানে ভেসে এল৷ ঠিক শুনতে পেল না৷ পেয়ালাটার গায়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল৷ আবারও এল আওয়াজটা৷ এত মৃদু যে ঠিক শ্রুতিগোচর হচ্ছিল না৷ তবে মনে হচ্ছিল কেউ যেন তার নাম ধরে ডাকছে, আর সেটা আসছিল পেয়ালার ভেতর থেকেই৷

আচমকা একটা ডাকে সে চমকে উঠল৷ স্পষ্ট শুনতে পেল এবার কেউ তার নাম ধরে ডাকছে তবে, এবার সেটা পিছন থেকে এল৷ তাকিয়ে দেখে অম্বরিশ দাঁড়িয়ে৷

‘কিগো! কখন থেকে ডাকছি শুনতে পাচ্ছ না?’

অলি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল, পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, ‘ওহঃ! ডাকছিলে বুঝি? অন্যমনস্ক ছিলাম তাই শুনতে পাইনি৷’

(৫)

সে রাত্রে খাওয়ার সময় খুব জ্বালাতন করছিল অলির ছোট ছেলে বুকুন৷ কিছুতেই খাবার মুখে তুলতে চাইছিল না৷ ভয় দেখিয়ে বাচ্চাদের খাওয়ানো হোক কিংবা ভোলানো হোক, এটা মায়েদের একরকম ব্রহ্মাস্ত্র যেন৷ কাজেই সেই একই পন্থার আশ্রয় নিল সে৷

‘তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, নইলে ভুতু চলে আসবে!’

বলা মাত্রই একটা মৃদু, শীতল বাতাস তার পাশ দিয়ে বয়ে গেল৷ সেইসাথে তার কথাটারই খুব মৃদুস্বরের প্রতিধ্বনি সে শুনতে পেল, ”ভুতু চলে আসবে!”, “ভুতু চলে আসবে!”…… অকস্মাৎ শিহরণ বয়ে গেল সারা শরীরে৷

অম্বরিশ পাশের ঘরেই তার বড় ছেলে তোতনকে পড়াচ্ছিল৷ হঠাৎ করে বুকুনের কান্নার আওয়াজ শুনে সে ছুটে আসে৷ দেখল অলি, বুকুনকে মাটিতে চিত করে ফেলে, চুলের মুঠি ধরে ভাতের বড় বড় গ্রাস মুখে ঠেসে দিচ্ছে৷ মায়ের নির্মম আচরণের কবল থেকে নিজেকে ছাড়াবার বৃথা চেষ্টা করছে৷ ছাড়াবেই বা কি করে? অলি যে তার পেটে পা দিয়ে শক্ত করে চেপে রেখেছে৷ ছেলেটা আকুতরে ছটফট করছে৷ গালভর্তি ভাতের জন্য গলা ছেড়ে কাঁদতেও পারছে না৷ দু-একবার অক্ অক্ করে আবার ফুঁপিয়ে উঠেছে৷

এত বছরের দাম্পত্য জীবনে অম্বরিশ, অলিকে এরকম আচরণ করতে কখনো দেখে নাই৷ তার এসব কান্ড দেখে সে কয়েক মুহূর্তের জন্য হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইল৷ তারপর এক ছুটে একরকম ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে ছেলেটাকে কোলে তুলে নিল৷

‘কি করছো, পাগল হয়ে গেছো নাকি? এমন ভাবে কেউ মারে, ছেলেটা মরে যাবে যে!’ অম্বরিশ রাগে ফুঁপিয়ে উঠে বলল৷

অলি নীরব৷ তার এলোকেশী চুল বিশৃঙ্খল ভাবে মুখের উপর ছড়িয়ে পড়েছিল৷ দু’চোখ অস্বাভাবিক রকমের লাল৷ রক্তবর্ণা সেই চোখ স্পষ্ট জাহির করছিল হিংস্রতার৷ অম্বরিশ এ এক যেন অন্য অলিকে দেখছিল৷

ছেলেটা তখনও কেঁদে চলেছিল৷ গালগুলো লাল হয়ে গিয়েছিল, মুখ দিয়ে লালা গড়াচ্ছিল৷ কিন্তু এসবের দিকে অলির কোন ভ্রূক্ষেপ নেই৷ তার পাশবিক দৃষ্টি তখনও ছেলেটার দিকে৷ অলিকে চুপ করে থাকতে দেখে এবার অম্বরিশ বেশ বিরক্ত হল৷ কাঁধে হালকা ঝাঁকুনি দিতেই অলি ধপ্ করে মাটিতে লুটিয়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ল৷

কতক্ষণ অজ্ঞান ছিল তার মনে নেই৷ জ্ঞান ফেরার পর দেখে অম্বরিশ পাশে বসে তার মাথায় হাত বোলাচ্ছে৷ তাদের বহুদিনের পুরানো ফ্যামিলি ডাক্তার পরিমল ঘোষাল একাগ্র দৃষ্টিতে ওষুধের শিশির দিকে তাকিয়ে সেটায় টোকা মারছিল৷

‘এখন কেমন লাগছে মা?’ ডাক্তার ঘোষাল গম্ভীর ভারী গলাটাকে যথাসম্ভব নরম করে জিজ্ঞাসা করলেন৷

‘মাথাটা একটু ধরে আছে৷’

অম্বরিশকে কয়েকটা ওষুধের শিশি আর ট্যাবলেট দিয়ে ডাক্তার ঘোষাল বললেন, ‘এক্সেসিভ হাইপারটেনশন! রাত্রে ঘুমের যাতে ব্যাঘাত না ঘটে তাই কয়েকটা ঘুমের বড়ি দিলাম৷ আর হ্যাঁ দুশ্চিন্তা, রাগ, যেকোনো রকমের উত্তেজনা এখন ওর স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক৷ তাই এসব থেকে ওকে এখন বিরত থাকতে হবে৷’

ডাক্তার ঘোষালকে এগিয়ে দিয়ে অম্বরিশ অলির পাশে এসে বসলো৷

‘কি হয়েছিল আমার? ছেলেরা কই?’ অলি জিজ্ঞাসা করল৷

ওরা ঘুমাচ্ছে৷ ও ঘরে ঘুম পাড়িয়ে এসেছি অনেকক্ষণ আগেই৷’ একটু থেমে কি যেন একটা ভেবে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার কি কিছুই মনে নেই?’

‘না, তেমন কিছুই তো মনে পড়ছে না৷ শুধু আবছা মনে পড়ছে ছেলেটাকে খাবার খাওয়াচ্ছিলাম, আর তখন একটা ডাক…. একটা খুব মৃদু শব্দ…৷’ কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই কি যেন একটা মনে করার চেষ্টা করল৷

‘মনে হয়েছিল কেউ যেন আমার কানে কানে বললো ভুতু চলে আসবে৷ হ্যাঁ এই কথাটাই! ঠিক এইটাই শুনেছিলাম৷ কথাটা খুব আস্তে শোনাচ্ছিল৷ যেন অনেক দূর থেকে আসছিল৷’

অম্বরিশ মৃদু হেসে বলল, ‘তুমি বিশ্রাম নাও, তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন৷’

সে উঠতে যাচ্ছিল, অলি তার হাতটা টেনে ধরল, ‘আমার কাছে একটু থাকবে প্লিজ? কেমন ভয় ভয় করছে৷’

(৬)

মাঝরাত্রে হঠাৎই অম্বরিশের ঘুমটা ভেঙে গেল৷ একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিল সে৷ কোথায় দাঁড়িয়েছিল সে জানে না, যেদিকে দু’চোখ যাচ্ছিলো শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার৷ সেই অন্ধকারের মধ্যে থেকে বারবার ভেসে আসছিল একটাই কথা ‘ভুতু খাচ্ছে’, ‘ভুতু খাচ্ছে৷’ কথাটা প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, ঠিক যেমন পাহাড়ে হয়৷

বেড ল্যাম্পের সুইচটা দিল৷ গ্লাসের জলে চুমুক দিতে যাবে, তখনই তার চোখ গেল বিছনার ওপাশটায়৷ অলি নেই৷ তাহলে কি বাথরুমে গিয়েছে? শরীরের অবস্থা ভালো নয়, একবার গিয়ে দেখা দরকার৷ এই ভেবে যেই সে পা বাড়াতে যাবে ঠিক তখনই একটা আর্তচিৎকার শুনতে পেল৷ ভয়ে সে শিউরে উঠল৷ চিৎকারটা বাচ্চাছেলের৷ এসেছিল তাদের পূর্বের বাগানের দিক থেকে৷

অম্বরিশ কাল বিলম্ব না করে ছুটে পাশের ঘরে গেল, যেখানে তার দুই ছেলে শুয়েছিল৷ ঘরের আলো জ্বালাতেই দেখল খাটে তোতন একা শুয়ে, পাশে তার ভাই বুকুন নেই৷ হন্তদন্ত হয়ে তোতনকে একরকম ঝাঁকিয়ে ঘুম থেকে তুলে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোর ভাই কোথায়?’

‘কেন এইতো পাশে শুয়ে আছে৷’ চোখ কচলাতে কচলাতে ঘুম ভাঙা গলায় বললো সে৷

অম্বরিশ আর সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি বাগানের দিকে ছুটল৷ নিশুতি অন্ধকারে চারিদিক হারিয়েছে৷ বাগানের লাইটটা বেশ কয়েকদিন থেকেই খারাপ হয়ে পড়েছিল৷ সে ফোনের ফ্ল্যাশ লাইটটা জ্বাললো৷আওয়াজটা ঠিক এসেছিল নারকেল গাছগুলোর দিক থেকে৷ তার ছোট ছেলেটা ঘরে নেই, তাহলে কি তার কিছু হয়ে গেল? এই ভর রাত্রে, অন্ধকারে সে বাগানে কেন আসতে যাবে? চিৎকারটা কার ছিল? এসব ভাবছে আর খুঁজে চলেছে৷ তার মনে তখন সংশয় ভর করেছে৷

খুঁজতে খুঁজতে একসময় সে দ্বিতীয় নারকেল গাছটার গোড়ায় এসে পৌঁছালো৷ ঠিক তখনই পাতার খসখস শব্দ তার কানে এল৷ ফ্ল্যাশ লাইটের আলোটা ফেলল নারকেল গাছটার মাথার দিকে৷ এত লম্বা গাছ যে ফ্ল্যাশ লাইটের আলো পৌঁছাচ্ছিল না সেখানে৷ আবার খসখস শব্দ, এবারেরটা একটু জোরে৷ অনেক নিশাচর পাখিরা রাত্রে গাছে এসে বসে, তারাই হবে হয়তো৷ ফ্ল্যাশ লাইটের আলোটা সরাতে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় তার মনে হল, পাতাগুলোর আড়াল থেকে কিছু একটা সড়-সড় করে নিচে নেমে এল যেন৷ অম্বরিশ চোখ ছোট করে দেখার চেষ্টা করল৷ কিন্তু ফ্ল্যাশের আবছা আলোয় কিছুই ভাল করে তার চোখে পড়ল না৷ হঠাৎই সেটা ক্ষিপ্র গতিতে গাছ বেয়ে অনেকটা নিচে নেমে এল৷ এবার লাইটের আলোয় সেটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল৷ যা দেখলো তাতে তার রক্ত জল হবার দশা৷ আর্মির কঠিন মেরুদন্ডেও ভয়ের শিহরন খেলে গেল৷

পাতার খসখস শব্দটার উৎসে পাখি বা কোন নিশাচর জীব ছিল না৷ ওভাবে মগডাল থেকে নেমে এসেছে অলি৷ ফ্ল্যাশের আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তার টকটকে লাল হিংসাপরায়ণ দুটো চোখ৷ মুখের সবকটা দাঁত অস্বাভাবিক রকমের লম্বা আর ধারালো৷ ঠোঁটের কষে লেগে থাকা রক্ত শুকিয়ে গেছিল৷

অম্বরিশের চোখ তার হাতের দিকে যেতেই ছিটকে গেল কয়েক পা৷ অলির হাতে তাদের ছোট ছেলে বুকুন৷ ছিন্ন তার শরীর৷ পেটের মাঝখানে থেকে ছিঁড়ে দু’ভাগ করে দেওয়া হয়েছে তার নরম দেহটাকে৷ নাড়িভুঁড়িগুলো বেরিয়ে এসে ঝুলে পড়েছে৷ রক্তে বুকুনের সারা শরীর ভিজে গিয়েছে, সেই সাথে অলির সালোয়ার-কামিজও৷

বুকুনের শরীরটাকে নিয়ে অলি নারকেল গাছটায় দু’বার গিরগিটির মত পাক খেয়ে একটা নিষ্ঠুর হাসি হাসল৷ তার গলাটা পুরুষ মানুষের মতো শোনাল৷ এই গলা আগেও শুনেছিল সে৷ নেপালে যার কাছে সে পেয়ালাটা কিনেছিল সেই বৃদ্ধর কাছে৷

ঘটনার আকস্মিকতায় অম্বরিশ বজ্রাহতের মত দাঁড়িয়ে রইল৷ কষ্টে, আবেগে, ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় সে বলল, ‘এ কি করলে অলি? আমাদের ছেলের একি অবস্থা করলে?’

তার কোন কথাই যেন সে শুনতে, বুঝতে পারছিল না৷ অলি তার তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো বের করে, ফিক করে তাচ্ছিল্যের একটা হাসি হাসল৷ বুভুক্ষু জন্তুর মত সজোরে কামড় বসালো বুকুনের ছিন্ন শরীরে৷ চ্যুইংগামের মতো টেনে ছিঁড়ে চিবোতে লাগল সেটার কিছুটা৷ চিবুক বেয়ে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা রক্ত পড়ল মাটিতে৷ এবার সে তার পৈশাচিক হাত বুকুনের চেরা পেটের মধ্যে ভরে, মরমর শব্দে মেরুদন্ডটা ভেঙে বের করে আনল৷ ঠিক তখনই মাথার দিকের অংশটা ছেড়ে ধপ্ করে মাটিতে এসে পড়ল৷ তার হাতের বাকি ছিন্ন অংশটাকে সজোড়ে ছুড়ে ফেলল৷ সশব্দে সেটা অন্ধকারে কোথাও গিয়ে পড়ল৷ লালায়িত জিভে মুখের চারপাশে লেগে থাকা রক্ত পরম তৃপ্তির সাথে চেটে খেল৷ তারপর আবার সড় সড় করে গাছে উঠে, পাতার আড়ালে কোথায় মিলিয়ে গেল৷ শোনা গেল শুধু পাতার খস্ খস্ শব্দ৷

অম্বরিশ এতক্ষণ পাথরের মত আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল৷ সে অবিচল, অচঞ্চল৷ যেন সে তার বোধের অতীত ঘটনান্তরে গিয়ে কূল হারিয়ে ফেলেছে৷ বুঝতে পারছে না এ কে, তার অলি না অন্য কেউ?

‘বাচাও অম্বরিশ!’ গাছের পাতাগুলোর মধ্যে থেকে অলির করুণ আর্তনাদ ভেসে এল৷ আর মুহূর্তের মধ্যেই কোন একটা ভারী জিনিস তীব্র গতিতে, সশব্দে আছড়ে পড়ল মাটিতে৷ তারপরেই সব শান্ত৷ এক অবিশ্বাস্যময় নীরবতা গ্রাস করল চারপশের পরিবেশ৷

অম্বরিশের সম্বিত ফিরতেই ছুটে গেল ঘটনাস্থলে৷ মাটিতে পড়ে থাকা জিনিসটার দিকে কাঁপা-কাঁপা হাতে ফ্ল্যাশের আলোটা ফেলতেই সে আঁতকে উঠল৷ একপাশে পড়ে বুকুনের ছিন্নভিন্ন অর্ধেক শরীর আর ঠিক পাশেই অলির প্রাণহীন দেহ৷ নিচে পড়ে থাকা একটা ইঁটে লেগে তার মাথাটা ফালা ফালা হয়ে গেছিল৷ একটা চোখ পুরোপুরি বেরিয়ে এসেছিল৷ গল গল করে রক্ত বেরিয়ে এসে আশেপাশের কিছুটা মাটিটাকে লাল করে দিয়েছিল৷

‘অলি!’ অস্পষ্ট, আর্ত কন্ঠে বলল অম্বরিশ৷ নিষ্প্রাণ অলির দেহের পাশে বসে থাকল বিধ্বস্ত মননে৷ তার জীবনসঙ্গীনিকে কেড়ে নিল এ কোন অভিশাপ? অলিকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে এখন৷ ঠিক প্রথমদিন যেদিন নব-বধুর সাজে ও তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল ঠিক সেইরকম৷ এখন সে যেন ঘুমোচ্ছে৷ এ ঘুম ক্ষণিকের নয়, এ চিরনিদ্রা৷ জগতের কোন শুভ-অশুভ শক্তি এ ঘুম ভাঙিয়ে মঙ্গল সূচনা করতে পারবে না৷

সে বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, অলি আর নেই৷ বর্ষার কালো মেঘের মতো একরাশ দুঃখ, হতাশায় তার মন ছেয়ে গেল৷ দু’গাল বেয়ে বিন্দু বিন্দু বেদনা তরল এসে মিশল মাটিতে৷

এমন সময় অদূরেই, অন্ধকারের মধ্যে থেকে কি একটা জিনিস ঘর ঘর শব্দে গড়াতে গড়াতে অম্বরিশের দিকে এল৷ সেই পেয়ালাটা! হাতে তুলে নেওয়া মাত্রই দেখল সেটার রং পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে৷ আগের মতো আর কালো নেই, বরং সেটা এখন দেখাচ্ছে লাল৷ রক্তাভ লাল, অলংকৃত মন্ত্রগুলো জ্বলজল করে জ্বলছে৷ এই সেই অভিশপ্ত পাত্র৷ এটা আনার পর থেকেই একের পর এক অঘটনগুলো ঘটতে শুরু করেছিল৷

কোন এক কারনে হঠাৎই তার চোখ গেল অদূরের অন্ধকারে৷ যে দিক দিয়ে পাত্রটা গড়িয়ে এসেছিল৷ ফ্ল্যাশের আলোটা ওদিকে ফেলতেই দেখলো কারা যেনো দাঁড়িয়ে সেখানে৷ কিছুটা এগিয়ে আরেকটু ভালো করে দেখার চেষ্টা করল৷ দেখল, সেই নেপালি বৃদ্ধ, যে এই মারণ পিয়ালাটা দিয়েছিল৷ তাকে ঘিরে দশাসই চেহারার পাঁচ-ছয় জন লোক৷ প্রত্যেকের মুখ অব্দি ঢাকা আলখাল্লা৷ অম্বরিশের মনে পড়ে গেল আজ থেকে প্রায় বছর সাতেক আগের কথা৷ ডেলিভারির সময় অলি হাসপাতলে কিছু অস্বাভাবিক দেখে খুব ভয় পেয়েছিলো৷ তাকে বলেছিল এদেরই কথা, কিন্তু তখন সে বিশ্বাস করে নাই৷ গুরুত্বহীন ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিল৷

হঠাৎই ওপাশ থেকে ফ্যাঁশফ্যাঁশে গলায় বৃদ্ধ হাসতে লাগল৷ সঙ্গে সঙ্গে বাকিদেরও শুরু হল সম্মিলিত হাসির রোল৷ চারিদিকে প্রতিধ্বনি হতে লাগল তাদের সেই অমানবিক অট্টহাস৷ অস্বস্তিকর সেই হাসি৷ বিষবাণের মত অম্বরিশের কানে বিঁধছিল৷ রাগে, বিরক্তিতে হাতের পেয়ালাটা সজোরে ছুড়ে মারল৷ বাউন্ডারিওয়ালে লেগে সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল৷ নিমেষের মধ্যেই সেইসব হাসিগুলো বন্ধ হয়ে এল৷ লোকগুলোও অন্ধকারে কোথায় মিলিয়ে গেল৷

কতক্ষন নির্নিমেষে অলির লাশের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল তার মনে নেই৷ একসময় সহসা সে শুনতে পেল পরিচিত একটা কণ্ঠস্বর৷ অলির গলা! সেটার উৎস খুঁজতে সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল৷ কিন্তা তাতে কোন লাভ হল না৷ কারণ সেটা আকাশবাণীর মত শূন্য থেকে ভেসে আসছিল, ‘অম্বরিশ, তোতনকে নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাও এক্ষুনি৷ ওরা আবার ফিরে আসবে৷ ও পেয়ালা যাদের কাছেই গিয়েছে তাদেরকেই খেয়েছে৷ ওর ক্ষিধে কখনো মেটে না৷ চলে যাও…চলে যাও…’

কথাগুলো থেমে যেতেই অম্বরিশ দেখল, অলির শরীরটা যেখানে পড়েছিল সেখানটা ফাঁকা৷ বুকুনের আধখানা শরীরের অংশটাও নেই৷ শুধু কিছুটা রক্ত মিশে মাটিটা লাল হয়ে আছে৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *