নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি…
১
সকালের নাশতা শেষ করে চা খেতে খেতে পত্রিকা পড়ছি। একটা নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি-চল্লিশোর্ধ্ব বয়সের একজন মানুষ হারিয়ে গেছেন। সেদিন ছিল শুক্রবার। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। বাসা থেকে বের হয়েছেন বাজার করতে। তার পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি। সবকটা বোতাম ছেঁড়া।
লোকটি পেশায় ছিলেন একজন কবি। এবার বই মেলায় তার একটি বই আসার কথা। বইটির নাম ‘নিখোঁজ!’
ছবিবিহীন চেহারার নানান বর্ণনার সহিত খুঁজে পাওয়া বেশ মুশকিলও বটে। বিজ্ঞপ্তির নিচে একটা ঠিকানা দেয়া। আমি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলাম। ঘরের ভেতরে জীর্ণ শীর্ণ অবস্থা। নোনা ধরা ফিরোজা দেয়ালে সিমেন্টের আস্তর গলে পড়ছে। বসার ঘরে একটা আয়না। সেটা ভাঙা।
বললাম, ‘পত্রিকায় একটি নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দেখে এসেছি।’
‘জি বসুন।’
‘কিন্তু কোথাও একটা ঝামেলা হচ্ছে যেটা আমি ধরতে পারছি না। লোকটি চেয়ার টেনে এনে বসলেন।’
‘আমি এসেছি কৌতূহল থেকে।’
‘কী কৌতূহল?’
‘নিখোঁজ গল্প লিখতে গিয়ে একজন নিখোঁজ হয়ে গেছেন। কোথায় যেন একটা রহস্য আছে।’
আমার কথা শুনে লোকটি বিরক্ত হলেন।
বললাম, ‘এক সাধককে চিনি, হারানো মানুষের সন্ধান দিতে জানে।’
‘কোথায় থাকেন?’
‘সুনামগঞ্জে। হাওর এলাকা।’
‘আপনি আমাকে সুনামগঞ্জ যেতে বলছেন?’
‘বেশি দূর না। গাবতলী থেকে বাসে উঠলে ৮ ঘণ্টা লাগে।’
লোকটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
‘তাকে শেষ কবে দেখেছেন?’
‘তিন মাস আগে।’
‘মানসিক কোনো অসুখ ছিল?’
‘জি না।’
‘এরপর আর যোগাযোগ হয়েছে?’
‘না।’ কিছুটা থেমে বললেন, ‘সব রকম চেষ্টা করা হয়েছে।’
দুপুর হয়ে এলে লোকটি আমাকে খেয়ে যেতে বলেন। আমিও খেতে বসে গেলাম। পুঁই শাক বেগুন ভাজি, আর পোড়া টমেটোর চাটনি। আমরা কথা বলছিলাম, নিখোঁজ গল্পের প্লট নিয়ে। কী ছিল সেখানে?
‘এমন কী হতে পারে, একজন নিখোঁজ মানুষ অন্য একজন নিখোঁজ মানুষকে খুঁজছে?।
হতে পারে। আবার নাও হতে পারে।’
চলে যাবার সময় তিনি আমাকে একটা কাগজ দিয়ে বললেন, ‘ঠিকানা লিখে রাখুন।’
‘আমার?’
‘সুনামগঞ্জের।’
‘আপনি যাবেন?’
‘জি। একটু চেষ্টা করে দেখি।’
‘ঠিকানা বলতে পারব না। তবে আমি সাথে করে নিয়ে যেতে পারব।’
লোকটি অবাক হলেন!
পরদিন রাত ৮টায় গাবতলী থেকে সরাসরি সুনামগঞ্জের উদ্দেশে আমরা দুজন রওনা দিই। সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ নিই-সাধকের সন্ধান মেলে না। সেখান থেকে ফিরে এসে আরও কদিন কেটে গেল।
তারপর হঠাৎ একদিন আরও একটি নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ে। সুনামগঞ্জের হাওরে বেড়ে ওঠা এক সন্ন্যাসীর নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি। নাম-শরীফুর ইসলাস। তাকে শেষ দেখা গিয়েছিল জাদুকাটা নদীর সামনে। নাম পরিচয়ের সাথে সাদা কালো ছবি সংবলিত বিজ্ঞপ্তিতে, এও বলা আছে-সন্ধান দিলে কবির একটি বই উপহার দেয়া হবে। বইটির নাম ‘অবিমৃশ্য।’
নিচে তাকিয়ে দেখি, সেই একই মানুষের বিজ্ঞপ্তি। সেই একই ঠিকানা।
পরদিন আবার তার বাসায় গেলাম। বললাম, ‘আপনি তো খুব সাংঘাতিক লোক।’
‘কেন?’
‘সাধককে খুঁজে পেতে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দিলেন!’
‘এতে অসুবিধা কোথায়?’
‘ছবি পেয়েছেন কোথায়?’
চাইলে জোগাড় করা যায়।’
কথা বলতে বলতে লোকটি ভেতরের ঘরে গেলেন। ঘরে দ্বিতীয় কোনো মানুষ নেই। নিজেই রান্না করছেন। আজও পোড়া টমেটোর চাটনি। আমরা দুজন একসাথে দুপুরের খাবার খেলাম। জিজ্ঞাস করলাম, ‘কতদূর কী অবস্থা।’
‘দুয়েকজন যোগাযোগ করছে। দেখি কী হয়।’
খাবার শেষ হতে না হতেই দরজায় কড়া নাড়ে একজন। প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না, তবু নিশ্চিত হবার জন্য জিজ্ঞাসা করি-‘কী নাম আপনার?’
শরীফুর ইসলাস। আমার সন্ধান করে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে।’
লোকটি একটি চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন। আমরা তিনজন ত্রিভুজ আকৃতির মতো করে তিনটা চেয়ারে বসে আছি। মাঝখানের টেবিলে দু কাপ চা। তখন আমাদের দুজনের জন্য দু কাপ বানানো হয়েছিল।
‘জি, আমি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। শুনলাম আপনি নিখোঁজ মানুষের সন্ধান দিতে জানেন।’ বললেন লোকটি।
সাধক চুপ করে রইলেন। আমি যে তার চাক্ষুস সাক্ষী, সেটা বললাম। সাধক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কবে থেকে নিখোঁজ?’
‘মাস তিনেক আগে। পেশায় একজন কবি। ‘কোথায় গিয়েছিল?’
‘বাজার করতে।’
সাধক চোখ বন্ধ করে কী সব মন্ত্র পড়লেন। তারপর দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে বললেন, ‘চারদিকে গাছ আর বন্য হাতি। পাশেই একটা লেক। কাপ্তাই গিয়ে মিলিত হয়েছে।’
‘আর কী দেখতে পাচ্ছেন?’
‘কবিকে দেখতে পাচ্ছি।’
‘কোথায়?’
‘একটা পাহাড়ের ওপর, ছোট ঘরে।’
‘এটা কীভাবে সম্ভব?’ লোকটি আঁতকে ওঠে।
সাধক বলে চলেছেন ‘সে মাটিতে আসন পেতে বসে আছে। দুপুরের খাওয়া খাচ্ছে।’
‘কিন্তু আমি তো একটু আগেই খাবার খেয়েছি। পোড়া টমেটোর চাটনি দিয়ে।
‘এতে অসুবিধা কোথায়?’ সাধক জিজ্ঞাসা করে।
‘তিন মাস ধরে লিখতে পারছি না।’
‘হাতে ব্যথা?’
‘কবিতা লেখার কথা বলছি।’
‘ও আচ্ছা। কেন লিখতে পারছেন না?’
‘নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি না।’
‘এই যে সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।’
‘সেটা আমার ছায়া। আমি ছায়ার মালিককে খুঁজছি।’
আলোচনার এই পর্যায়ে, কৌতূহল চাপা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করি, ‘তাই বলে
আপনি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিলেন?’
‘এতে সমস্যা কোথায়?’ লোকটি জবাব দেয়।
‘কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আপনার নিজেকে নিজেই খুঁজে নিতে হবে। ‘সেটা আমি চেষ্টা করছি। অন্য কেউ করলে তো ক্ষতি নেই।’ কিছুটা থেমে চিন্তিত হয়ে শরীফুর ইসলাসকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন? এই যে হাত নাড়ছি।’
‘কেন দেখতে পাব না?’
‘ওই যে বললেন, আমি পাহাড়ে…
‘আপনি যে আপনাকেই খুঁজছিলেন, বুঝতে পারিনি।’ শরীফুর ইসলাসের সরল স্বীকারোক্তি।
এমন সময় এক অচেনা আগন্তুক দরজায় কড়া নাড়ে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘একটু পানি হবে?’
ঢকঢক করে পানি খেয়ে বললেন ‘একটা নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দেখে এসেছি। শরীফুর ইসলাসকে খুঁজে পেয়েছেন?’
শরীফুর ইসলাস মাথা ঘুরিয়ে লোকটির দিকে তাকালেন। তাদের দুজনের চোখাচোখি; অদ্ভুত বিস্ময়কর এক আবহাওয়া তৈরি করেছে। আমরা চারজন ইংরেজি ‘L’ বর্ণের শেপে চারটা চেয়ারে বসে রইলাম।
২
নিজেকে খুঁজে না পেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া, একজন কবি তার ভাবনার জায়গা থেকে ভাবতে পারে। চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া-সে এখন পাহাড়ের উপরে বসে আছে। দুপুরের খাবার খায়। এও সম্ভব ভণ্ডের পক্ষে।
কিন্তু সব থেকে অবাক করা কাণ্ড হলো, দুদিন পর পত্রিকায় আরও একটি বিজ্ঞপ্তি দেখি। সেই একই নামে। এবার আর নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি না, অদ্ভুত এক রিটায়ার্ড বিজ্ঞপ্তি।
বিজ্ঞপ্তির শুরুতে লিখলেন, ‘আমি বড় ক্লান্ত। দু যুগ ধরে বহু কবিতা লিখেছি, যার একাংশ যদি কেউ পড়ত কখনো মনের ভুলে কিংবা সজ্ঞানে-তাহলে হয়তোবা এ রকম অসময়ে আমাকে রিটায়ার্ড করতে হতো না।’
পুনরায় ছুটে গেলাম তার কাছে। ‘আপনি তো ভারি আশ্চর্য লোক।’
‘কেন বলেন তো!’ যেন এ রকম অদ্ভুত কথা আগে শোনেনি।
‘পৃথিবীতে কোনো কবি রিটায়ার্ড করে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, এ রকম শুনেছেন?
‘সমস্যা কোথায়? রিটায়ার্ড নাকি বিজ্ঞপ্তিতে?’
আমি চুপ করে রইলাম। কবি যখন নিজের ধ্যানে মগ্ন থাকে, তখন কথা বলা
অপচয়।
খানিকটা ঝুঁকে এসে কবি বললেন, ‘সব পেশার লোকই রিটায়ার্ড করে। নাকি কবিতা লেখাকে আপনার পেশা হিসেবে মনে হয় না?’
‘তাই বলে বিজ্ঞপ্তি?’
‘দু যুগ ধরে কবিতা লিখেছি। কাউকে কিছু না বলে চলে যাব?’
‘আমি ভেবেছিলাম, কবিরা খুব অভিমানী হয়।’
‘সেটা প্রকাশ করাও অভিমানের অংশ।’ বলেই তিনি হাসতে লাগলেন।
কথায় কথায় দুপুর হয়ে এলে আমরা দুজন খেতে বসি। সেই পোড়া টমেটোর চাটনি কিংবা বসার ঘরের ভাঙা আয়না; সবকিছুতেই এক উদাসীন নির্লিপ্ততা।
‘কিন্তু রিটায়ার্ড কেন করবেন? সবে মাত্র চল্লিশ পেরিয়েছেন। ‘
‘কারণ আমি লিখতে পারছি না।’
‘লিখতে না পারলে চেষ্টা করুন।’
আমার কথা শুনে তিনি ঘর ফাটিয়ে হাসতে লাগলেন।
বললেন, ‘আমি রিটায়ার্ড করেছি কারণ আমি আমার কাজ ঠিকমতো করতে পারছি না।’
‘কেন পারছেন না?’
‘নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি।’
‘খোঁজার চেষ্টা করুন।‘
‘সে কারণেই ছাপিয়েছিলাম আমার নিখোঁজ হবার বিজ্ঞপ্তি। তখনো আপনার বোধোদয় হয়নি। আর এখন নিজেকে খুঁজে না পেয়ে রিটায়ার্ড করলাম। তাও মানতে পারছেন না।’
‘কবে থেকে মনে হলো, আপনি হারিয়ে গেছেন?’
‘বহুবার বলেছি। মাস তিনেক আগে।’
‘কীভাবে হারিয়েছেন বলবেন?’
‘নিখোঁজ নামে একটা বই লিখছিলাম। একজন নিখোঁজ ব্যক্তিকে খুঁজতে গিয়ে অন্য একজন নিখোঁজ হলেন। দুজনের কেউই জানে না, তারা হারিয়ে গেছে।’ কিছুটা থেমে বললেন, ‘কিন্তু আমি যে হারিয়ে গেছি কীভাবে বুঝলাম জানেন?’
‘কীভাবে?’
‘কারণ আমি লিখতে পারছি না।’