নিকোলাস নিকলবি – ৯

নয়

বিকেলে স্কুল চলাকালীন সময়ে ছাত্রদের জড়ো করলেন মিস্টার স্কুয়্যারস। প্রতিবার লণ্ডন থেকে ফিরে ছেলেদের মা-বাপ, আত্মীয় স্বজনদের সম্পর্কে রিপোর্ট করা তাঁর রীতি। চিঠিপত্র, খবরাখবর, বকেয়া বেতন পেয়েছেন কি পাননি- এই হচ্ছে তাঁর আলোচনার বিষয়বস্তু। লণ্ডন থেকে ফেরার পরদিন বিকেলে ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানটির সভাপতিত্ব করেন তিনি।

এ মুহূর্তে স্কুলরূমে সমবেত হয়েছে সকলে। একগাদা কাগজপত্র হাতে ঘরে ঢুকলেন মিস্টার স্কুয়্যারস। তাঁর পেছন পেছন এলেন মিসেস স্কুয়্যারস। বগলদাবা করে দু’খানা বেত এনেছেন।

‘কেউ বিনা অনুমতিতে মুখ খুললে,’ হুমকি দিলেন স্কুয়্যারস। ‘পিঠের চামড়া তুলে নেব।’ কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এল ঘরে। আরম্ভ করলেন ভদ্রলোক:

‘ছেলেরা, আমি লণ্ডন থেকে সুস্থ শরীরে ফিরে এসেছি।’ এ খবর শোনামাত্র তিনবার চিয়ার করার নিয়ম ছাত্রদের। নিকোলাস কোনদিন এত দুর্বল হর্ষধ্বনি শোনেনি। একের পর এক কাগজ উল্টাচ্ছেন স্কুয়্যারস। ‘কয়েকজনের বাবা-মার সঙ্গে দেখা করেছি। তাঁরা তোমাদের ব্যাপারে খুবই সন্তুষ্ট। তবে কেউ কেউ অবশ্য আমাকে হতাশ করেছেন। বোল্ডারের বাবা তাঁদের একজন- দু’পাউণ্ড, দশ শিলিং কম দিয়েছেন। কোথায় বোল্ডার? এদিকে এসো।’

রুগ্ন চেহারার এক ছেলে এগিয়ে এল। চেহারায় ভীতির ছাপ স্পষ্ট।

‘বোল্ডার, ধীরে বললেন স্কুয়্যারস, ‘তোমার বাবা যদি মনে করেন- আরে! হাতে ওসব কি?’ সপাসপ বেতের বাড়ি মারলেন ওর দু’হাতে।

‘গোটা উঠেছে, স্যার,’ কাঁদতে কাঁদতে বলল ছেলেটি। ‘উঠতেই থাকে, সারে না। নোংরা ঘাঁটতে হয় বলে, স্যার- আমার কোন দোষ নেই, স্যার!’

‘বোল্ডার,’ ধোলাই করতে তৈরি হয়ে বললেন স্কুলশিক্ষক। ‘তুমি হচ্ছ শয়তানের একশেষ। বেতের বাড়িতেও শিক্ষা হয়নি দেখছি। তোমার মজা বের করছি।’ ছেলেটির করুণ আর্তি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নির্দয়ের মত পেটাতে লাগলেন তিনি। নিজের হাত ব্যথা হয়ে গেলে পর ক্ষান্ত দিলেন।

‘স্মাইক, এই বদমাশটাকে আমার চোখের সামনে থেকে দূর করে দে,’ গর্জালেন ভদ্রলোক।

ছেলেটিকে নিয়ে স্মাইক বেরিয়ে গেলে আবার আসনগ্রহণ করলেন স্কুয়্যারস।

‘হুঁ,’ বললেন, ‘কবির নামে একটা চিঠি আছে। স্ট্যাণ্ড আপ, কবি।’ আরেকটি ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে আড়চোখে চিঠিটার দিকে তাকাল। ‘কবির দাদী মারা গেছেন, আর ওর চাচা মদ ধরেছে। ব্যস, এর বেশি কিছু লেখেনি তোমার বোন। তবে সে আঠারো পেন্স পাঠিয়েছে। তাতে শুধু ভাঙা জানালাটার দাম উঠবে। মিসেস স্কুয়্যারস, টাকাটা বুঝে নেবে?’

‘এর পরে গ্রেমার্শ,’ বললেন স্কুয়্যারস। ‘স্ট্যাণ্ড আপ।’ সে উঠে দাঁড়ালে পরের চিঠিটায় চোখ রাখলেন স্কুলশিক্ষক। ‘গ্রেমার্শের খালা ও ভাল আছে শুনে খুব খুশি। তিনি লিখেছেন, ও যেন মিস্টার স্কুয়্যারস আর তাঁর স্ত্রীকে সবচেয়ে কাছের মানুষ মনে করে। কাপড় পাঠাতে পারছেন না উনি। তবে সেজন্যে মন খারাপ করতে মানা করেছেন। আর বলেছেন, ওয়্যাকফোর্ডের সঙ্গে ঝগড়া-ঝাঁটি না করতে। বাহ্, কী চমৎকার চিঠি- আহা!’

এরপর মবসের পালা। সে দাঁড়ালে রিপোর্ট পেশ করলেন স্কুয়্যারস।

‘স্কুলের খাবারের বদনাম করে সৎমাকে অসুস্থ করে দিয়েছে মবস। উনি ওর চিঠি পাওয়ার পর থেকে বিছানা নিয়েছেন। বেচারী জানতে চেয়েছেন, এরচেয়ে ভাল খাবার আর কোথায় পাবে ও। ভদ্রমহিলা আমাকে অনুরোধ করেছেন, বেদম পেটাই করে ওর ভূত যেন ছাড়িয়ে দিই। এখন থেকে সপ্তাহে সপ্তাহে আধ পেনি করে হাতখরচও বন্ধ। পকেট নাইফ পাঠাবেন বলেছিলেন, সেটাও আর পাঠাচ্ছেন না। খুব খারাপ কথা,’ বললেন স্কুয়্যারস, তাঁর হাত শক্ত হলো বেতে। ‘এই বয়সেই এত অভিযোগ! এত মন খারাপ! মবস, এদিকে আয়!’ ধীর পায়ে ডেস্কের কাছে এগিয়ে এল মবস। সাদা হয়ে গেছে মুখ। একটু পরেই ঘর থেকে বেরিয়ে সমব্যথীদের সঙ্গে যোগ দিল ও।

মিস্টার স্কুয়্যারস এরপর অন্যান্য চিঠিগুলো পড়লেন। তারপর স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন, ছাত্রদেরকে নিকোলাসের দায়িত্বে বুঝিয়ে দিয়ে। আঁধার ঘনাতে স্কুলরূমে ঠাণ্ডা জাঁকিয়ে বসল। রাতে একটুকরো পাউরুটি আর পনির জুটল। তাতে খিদেটা আরও চাগিয়ে উঠল।

শিক্ষকের ডেস্কের কাছে ছোট্ট একটা স্টোভ, ওটার পাশে গুটিসুটি মেরে বসল নিকোলাস। হতাশায় ছেয়ে গেছে মন। স্কুয়্যারসদের নিষ্ঠুরতা এবং স্কুলটির মলিনতা ওর শিক্ষকতার সমস্ত আগ্রহ কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু এখানে না থেকেই বা উপায় কি? সংসার চলবে কি করে? মা-বোনকে চিঠিতে জানিয়েছে, নিরাপদে পৌঁছেছে ও। বুঝতে দেয়নি, মন টিকছে না।

এসব ভাবছে হঠাৎ চোখ পড়ল ঘাড় কাত করে, হাঁটু গেড়ে স্টোভের পাশে বসে রয়েছে স্মাইক। পড়ে যাওয়া কয়লার টুকরোগুলো কুড়োচ্ছে ও, নিকোলাস দেখে ফেলাতে পেছনে সরে গেল।

‘ভয় পেয়ো না,’ নরম সুরে বলল নিকোলাস। ‘ঠাণ্ডা লাগছে?’

‘না, না, দ্রুত জবাব দিল স্মাইক। ‘অভ্যাস হয়ে গেছে।’

‘এখানে কদ্দিন আছ? বছর খানেক হবে?’ জানতে চাইল নিকোলাস।

‘এক বছর!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল ছেলেটি। কত বছর নিজেও জানি না- সেই বাচ্চাকাল থেকে। কে জানে বন্ধুরা এখন সব কোথায়? উফ, কী যে কষ্ট এখানে!’

কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে, বলল নিকোলাস–জানে না কিভাবে সান্ত্বনা দেবে।

‘না,’ বলল ও, ‘কথাটা আমার জন্যে না। যে ছেলেটা এখানে মারা গেছে ওর ব্যাপারে কিছু জানেন?’

‘উঁহু,’ বলল নিকোলাস। ‘ওই শোনা পর্যন্তই। কেন, কি ব্যাপার বলো তো।’

কাছ ঘেঁষে এল স্মাইক। ‘সে রাতে ওর কাছে ছিলাম আমি। বন্ধুদের ডাকছিল ওর পাশে এসে বসার জন্যে। গভীর রাতে প্রিয়জনদের মুখ নাকি দেখতে পাচ্ছিল ও। সবাই ওর সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। মারা যাওয়ার সময় মাথাটা তুলে সবাইকে চুমু দিয়ে গেছে। শুনছেন?

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ।’

‘কিন্তু আমি কাদের চেহারা দেখে মরব?’ শীতে কাঁপতে কাঁপতে প্রশ্ন করল স্মাইক। ‘কে কথা বলবে আমার সঙ্গে? আমার তো বাড়ি-ঘর নেই, আত্মীয় স্বজন আসবে কোত্থেকে? আমার বাঁচাও যা, মরাও তা। আমার জীবনের কোন দাম নেই- কোন দাম নেই!’

বেড-টাইম বেল বাজতে শুরু করলে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল ও। ভারী মন নিয়ে সে রাতে নোংরা বেডরূমে শুতে গেল নিকোলাস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *