পাঁচ
পরদিন সাতটার সামান্য পরে সারাসিনের হোটেলে পৌঁছল নিকোলাস। ট্রাঙ্কটা কোচ-অফিসে রাখা হলে মিস্টার স্কুয়্যারসের খোঁজে চলল ও।
ভদ্রলোক খেতে বসেছেন। নতুন ছাত্র তিনটেও আছে, তাদের সঙ্গে সৌভাগ্যক্রমে আরও দু’জন জুটেছে। উল্টোদিকে বসে আছে এই পাঁচ ছাত্র। শিক্ষক মহোদয়ের সামনে কফি, প্লেট ভর্তি টোস্ট এবং ঠাণ্ডা মাংস রাখা; কিন্তু সে মুহূর্তে তিনি ছেলেগুলোর নাস্তার আয়োজনে ব্যস্ত।
‘এই দুধটুকুর দাম দুই পেনি?’ ওয়েটারের কাছে জানতে চাইলেন তিনি চোখ তাঁর নীলরঙা বড় একটা মগের ভেতরে। ‘লণ্ডনে দুধের এত দাম,’ ব্যথিত কণ্ঠে বললেন ভদ্রলোক। ‘মগে গরম পানি ভরে আনোগে যাও।’
‘বলেন কি?’ ওয়েটারের কণ্ঠে বিস্ময়। পানসে হয়ে যাবে তো!’
‘হোকগে,’ বললেন স্কুয়্যারস। ‘খরচ তো বাঁচবে। তিনটে মোটা রুটি আর মাখনের অর্ডার দিয়েছিলাম।’
‘আসছে, স্যার।’
মিস্টার স্কুয়্যারস মাংসে মস্ত কামড় বসিয়ে চিবানোর সময় দেখতে পেলেন নিকোলাসকে।
‘বসো, বসো,’ বললেন। ‘আমরা নাস্তাটা সেরে নিচ্ছি।’
ভদ্রলোক ‘আমরা’ কোথায় পেলেন বুঝতে পারল না নিকোলাস। একাই তো গোগ্রাসে গিলছেন, তবে কথা বাড়াল না। হাসি হাসি মুখ করে বসে পড়ল।
‘ওহ্! দুধ আর পানি এসে গেছে?’ বললেন স্কুয়্যারস। ‘ভেরি গুড। রুটি- মাখন কই?’
দ্বিতীয়বার রুটি-মাখনের কথা শুনে নড়েচড়ে বসল ছেলেগুলো, চকচক করছে পাঁচ জোড়া চোখ। মিস্টার স্কুয়্যারস তখন স্বাদ নিচ্ছেন তরলের।
‘আহ্,’ বললেন, ‘অমৃত! ফকিরদের কথা ভাবো, ছেলেরা, এ জিনিস পেলে তারা বর্তে যাবে না? খিদের জ্বালা বড় জ্বালা, কি বলো হে, নিকোলাস?’
‘সত্যিই, স্যার।’
‘শোনো তোমরা,’ ছেলেগুলোর উদ্দেশে বললেন শিক্ষক। আমি এক বললে বাঁ দিকের ছেলেটা দুধে চুমুক দেবে; দুই বললে তার পাশের জন; এভাবে পাঁচজনই খেতে পাবে। বুঝেছ?’
‘ইয়েস, স্যার, পরম আগ্রহে বলল পাঁচটি ছেলে।
‘গুড,’ বললেন স্কুয়্যারস; মন দিয়ে খেয়ে চলেছেন নাস্তা। তৈরি হয়ে থাকো তোমরা। আমি বললে শুরু করবে। এর মধ্য দিয়ে ধৈর্য পরীক্ষাটাও হয়ে যাবে। বুঝলে, নিকোলাস, ছেলেদের মনের জোর বাড়াতে এর বাড়া পরীক্ষা নেই, গপাগপ মাংস আর রুটি সাঁটতে সাঁটতে নতুন শিক্ষকের দিকে ফিরে বললেন।
ক্ষুধার্ত ছেলেগুলোর চোখ মগ আর প্লেটের ওপর স্থির। (এসে গেছে রুটি- মাখন)। একেক গ্রাসে খাবার উঠে যাচ্ছে স্কুয়্যারসের মুখে।
‘চমৎকার নাস্তার জন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ,’ খাওয়া শেষে ঢেকুর তুলে বললেন ভদ্রলোক। ‘নাম্বার ওয়ান, দুধ খেতে পারো।’
কিন্তু ছেলেটি চুমুক দিয়েছে কি দেয়নি, দ্বিতীয়জনকে আহ্বান জানালেন স্কুয়্যারস। এভাবেই নামকাওয়াস্তে দুধ পান করল পাঁচ বালক।
স্কুলশিক্ষক এরপর তিনটে রুটি পাঁচ টুকরো করলেন, মাখনেরও ভাগাভাগি হলো।
‘জলদি খেয়ে নাও,’ বললেন, ‘কোচ দু’এক মিনিটের মধ্যেই ছেড়ে দেবে।’ অনুমতি পাওয়ামাত্র হামলে পড়ল অভুক্ত ছেলেগুলো, ঠোঁটের কোণে হাসি ধরে রেখে তা লক্ষ করছেন তাদের শিক্ষক।
শীঘ্রিই খবর এল, কোচ তৈরি। সবাই হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এল বাইরে।
ট্রাঙ্ক আর বাক্সগুলো তোলা হয়েছে কোচে, ছেলেদের চাপতে হবে তাতে। অন্যান্য যাত্রী আর তাদের ভৃত্যদের কলরবে মুখর হয়ে আছে পরিবেশ। ঘোড়াগুলো খুর দাপাচ্ছে, যাত্রা শুরুর জন্যে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে।
নিকোলাস তার দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত, চোখে চোখে রাখছে ছেলেগুলোকে, এসময় তার চাচার গলা শুনতে পেল।
‘এই যে, তোমার মা-বোনকে নিয়ে এসেছি।
‘ভয় পাচ্ছিলাম রওনা হয়ে গেছিস, বললেন মিসেস নিকলবি, চুমু খেলেন সন্তানকে।
‘শোনো, নিকোলাস,’ স্কুয়্যারস এগিয়ে এসে বললেন, ‘তুমি পেছনে বসো। ছেলেগুলোর ওপর নজর রাখা দরকার। পড়ে-টড়ে গেলে পুরো বিশ পাউণ্ড গচ্চা!’
‘নিকোলাস,’ ফিসফিস করে জানতে চাইল কেট, ‘এই অভদ্র লোকটা কে? কেমন স্কুলে যাচ্ছ তুমি?’
‘ইনিই আমাকে চাকরি দিয়েছেন, কেট। আর ইয়র্কশায়ারের লোকেরা একটু বোধহয় বেয়াড়াই হয়। আমাকে এখন যেতে হচ্ছে রে। তোরা ভাল থাকিস। মা, চললাম! গুড বাই, চাচা! আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ!’
সীটে বসে হাত নাড়ল নিকোলাস, ভার হয়ে গেছে মন। যেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু উপায় নেই।
ঠিক সেসময় কে যেন তার পা ধরে আলতো টান মারল। নিচে চেয়ে দেখে একটা লোক, নোংরা একটা চিঠি গুঁজে দিচ্ছে ওর হাতে।
‘কি ওটা?’ প্রশ্ন করল নিকোলাস
‘শ্!’ বলল নিউম্যান নগস, সে-ই এসেছে।
চকিতে মিস্টার রালফকে দেখে নিয়ে জরুরী কণ্ঠে বলল, ‘নিয়ে যাও। পরে পড়ে নিয়ো। কেউ যাতে না জানে।’
‘দাঁড়ান!’ চাপা কণ্ঠে বলল নিকোলাস–কিন্তু চলে গেছে তখন লোকটা।
সশব্দে বন্ধ হলো কোচের দরজাগুলো। কোচোয়ান ঘোড়াগুলোর উদ্দেশে ‘অল রাইট’ বলামাত্র বেদনার্ত দুটো মুখ এক ঝলকের জন্যে দেখতে পেল নিকোলাস, তারপর ক্রমেই অস্পষ্ট হতে লাগল মুখ দুটো।