নিকটজনের কথায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
গোড়ার দিনগুলি – তরুণ গাঙ্গুলি
কোথা থেকে শুরু করব। আমরা পিঠোপিঠি ভাই। অবিভক্ত বাংলাদেশের খুলনা শহরে ত্রিশের দশকে আমাদের জন্ম। স্কুলজীবনেই দেশ ভাগ। কলকাতায় আসা — স্কুল কলেজের পাঠ। তারপর চাকরি বাকরি। সংসার ধর্ম। যৌবনকাল, প্রৌঢ়ত্ব এবং অবশ্যই বার্ধক্য। জীবনের প্রথম বিশ-বাইশ বছর আমরা ছিলাম অভিন্নহৃদয় — ভাইয়ের থেকেও বেশি, বন্ধু। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম জীবনের দুয়েকটি উপন্যাসে কখনো কখনো আমিও একটি চরিত্র।
শ্যামলের সাহিত্যিক হওয়ার কথা ছিল না। জজকোর্টের মোহরায়, রেসের জকি, সেনাবাহিনীর জুনিয়র ক্যাডেট, বা প্রবেশনারি আই .এ. এস অফিসার — এমনকি কাস্টমসের প্রিভেন্টিভ অফিসারও সম্ভাব্য চাকরির তালিকায় ছিল। কিন্তু এসব কিছুই হওয়া হল না।
প্রথম সাহিত্য সাধনা বোধহয় খুলনায় স্কুলে থাকতে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের উপর একটি কবিতা, যার কপিরাইট তার প্রাপ্য নয়। এছাড়া যুদ্ধের সময়ে খুলনা শহরে প্রচুর আমেরিকান সৈন্য ছিল। তাদের দেওয়া এক কার্টুনের ছবিতে হিটলারের ফাঁসির ছবি ছিল। তার পাশের ফাঁকা জায়গায় শ্যামল ছবি এঁকে মুসোলিনির ফাঁসিও দিয়ে দেয়। মধ্য চল্লিশের দশকে বাংলার হিটলার বা মুসোলিনী ছিলেন হিরো। বাপ দাদারা এঁদের প্রশংসায় তখন পঞ্চমুখ, মফঃস্বল শহরের ১৪/১৫ বছরের একটি ছেলে কিন্তু এঁদের নায়ক মনে না করে খলনায়ক মনে করেছিল। এটাই তাজ্জব।
আমাদের বালক বয়সে প্রথম কবি আমরা দেখি মানকুমারী বসুকে। আমাদের পাড়ার মোড়ের বিরাট কম্পাউণ্ডওয়ালা নাগেদের বাড়ির সম্ভবত দিদিমা। সে বাড়িতে পেয়ারা পাড়তে গেলে তেড়ে আসতেন। অথচ পাঠ্যপুস্তকে তাঁর লেখা দেখে আমরা চমকে উঠতাম। কবি আর তার কবিতা যে এক নয় আমরা বুঝতে শিখলাম।
গোড়ার থেকে শুরু করা যাক। শ্যামলের জন্ম ১৩৩৯ সনের ১১ই চৈত্র শনিবার বারবেলা। তখন বাড়িতে বাড়িতে আঁতুড় ঘর থাকত। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মার কাছে শুনেছি ঘরের চাল উড়ে যায়। বাবার গুরুমশাই, তিনি কলেজকে বলতেন কবেজ এবং রেল লাইনকে বেল লাইন, তিনি বলেছিলেন এ ছেলে বেঁচে থাকলে হয় রাজা নয় ফকির হবে।
ছোট বয়সে এক মাথা কোঁকড়া চুল। টিকোল নাক, বড়ো বড়ো ভাসা ভাসা চোখ, সুকুমার মুখ — এই বালককে সবাই প্রথম দর্শনেই ভালোবেসে ফেলত। কিন্তু অত্যন্ত সক্রিয় মস্তিষ্ক এবং তাতে দুষ্ট বুদ্ধি বেশি থাকত। আর অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল সত্য আর কল্পিতের মিশ্রণে এক নতুন জগৎ সৃষ্টির। স্কুলে লেখাপড়ায় মোটামুটি — কিন্তু সাধু কালাচাঁদের মতোই আপাতনিরীহ কিন্তু মারাত্মক সব সিচুয়েশন গড়ে তোলার বিশেষ ক্ষমতা ছিল শ্যামলের অর্থাৎ আমাদের মণিদার। যেমন বড়ো বউদির বাবা, স্থানীয় একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার। মণিদাকে কঠিন কঠিন সব অঙ্ক কষতে দিতেন। তাঁকে জব্দ করার জন্যে একদিন যাদব চক্রবর্তীর পাটিগণিতের তিন চারের অঙ্ক জুড়ে দিয়ে তাঁকে মণিদা বুঝিয়ে দিতে বলল। তাঁর তো চক্ষু চড়কগাছ। কিন্তু সেই অঙ্কের মর্মোদ্ধার করার আগেই মণিদা পগার পার। আমাদের শহরে স্ট্রীমার কোম্পানির বড়ো সাহেব ছিলেন ক্রিকেট ভক্ত। তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে, অর্থাৎ নিজেকে অনাথ বালক সাজিয়ে, মণিদা ক্রিকেটের সাজ সরঞ্জাম যোগাড় করল। সাহেব ছিলেন আবার বউদির বাবার ভ্রমণ সঙ্গী। একদিন দেখি সাহেব আর তাওয়াইমশাই দূর থেকে আমাদের দেখছেন। পরে শুনলাম বাবার কাছে মণিদাকে উত্তমমধ্যম চপেটাঘাত খেতে হয়েছে। কোই পরোয়া নেহী। পরদিনই মুচিকে একটা গল্প বলে ছেঁড়া ফুটবল মণিদা সারিয়ে আনল। ছোট্ট শহর। সবাই সবাইকে চিনত। সন্ধ্যেবেলা খেলার শেষে আমরা বাড়ি ফিরে দেখি মুচি আবার কাছে পয়সা নিতে এসেছে। অতএব যা হওয়ার তাই হল।
কিন্তু ১৯৪৭-এর ১৫ই আগস্টের পরে মফঃস্বল শহরের জীবন শেষ হল। কলকাতার পথে আমরা রওনা হলাম — আর দ্রুত বড়ো হয়ে গেলাম। কলকাতায় আসার আগে মাস চারেক আমরা দত্তপুকুরে — এক পুরনো ভগ্নপ্রায় জমিদার বাড়িতে তিন-চারটে ঘর নিয়ে ভাড়া ছিলাম। গ্রামও না শহরও না। দত্তপুকুর স্কুলের হেড মাস্টার ছিলেন আমাদের কাকা। বাবা ভীষণ রকমের বাঙাল হলেও, বিদ্যাভ্যাসের পর কাকা পূর্ববঙ্গে আর কখনও যাননি। কতায় বার্তায় কাকা এবং আমাদের খুড়তুতো ভাইয়েরা একদম ঘটি। ওদের মাসতুতো বোন গীতাদি পরে বিয়ে করেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে। সেই সুবাদে সুভাষদা আমাদের জামাইবাবু।
এরপরে কলকাতায় টালিগঞ্জে ট্রাম রাস্তার উপর ভাড়া বাড়িতে আমাদের জীবন। আর প্রথম দুঃখ তখনই পেলাম। আমাদের সেজ দা -ভালো ছাত্র ছিলেন। কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে আশুতোষ কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। পটাসিয়াম সাইনায়েড খেয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন। শোকে দুঃখে মা কিছুদিনের জন্য অসংবদ্ধ হয়ে পড়েন। বড়ো দুই ভাই তখন কলকাতার বাইরে। বাবার রিটায়ারমেন্ট আসন্ন। তখন ১৬ / ১৭ বছর বয়সে মণিদা আমাদের ছোটো তিন ভাইবোনের গার্জিয়ান হয়ে ওঠে। আশুতোষ কলেজ থেকেই আই.এস. সি পাশ করেন ১৯৫০ সালে বি.এস.সি. কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়। ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচনে জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়। সে সময়ে কলকাতা উত্তাল। বাস্তুহারাদের দখলে শিয়ালদহ প্ল্যাটফর্ম এবং টালিগঞ্জের সব ফাঁকা মাঠে বিভিন্ন কলোনী গজিয়ে উঠেছে। কম্যুনিস্টরা তখনও নিষিদ্ধ। বিধান রায় আসুরিক পরিশ্রম করে বাংলাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন — এবং কম্যুনিস্টরা অবশ্যই তাঁকে বিব্রত করার চেষ্টায় ব্যস্ত। এই সময় স্কুল কোড বিল বোধহয় বিধানসভায় পেশ হয়। ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের তালিকায় মণিদা ছিল। কলেজ থেকে বহিস্কৃত।
মধ্যবিত্ত পরিবারে, বিশেষ করে বাস্তুচ্যুত পরিবারে এর চেয়ে বড়ো কলঙ্ক আর কিছু হতে পারে না। তবে বসে থাকবার লোক নয় মণিদা। লিলুয়ায় নিসকো নামের ইস্পাত তৈরির কারখানায় এপ্রেন্টিশের চাকরি। ওপেন হার্থ ফারনেসের ভিতর বড় ল্যাডল (চামচ) দিয়ে তরল ইস্পাত বাইরে এনে তার মান ঠিক আছে কিনা দেখা এপ্রেন্টিশের কাজ। আমাকে একদিন সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। সেই গরমে কাজ করা প্রায় অসম্ভব। এই কাজ ভালোলাগেনি। মণিদা চাকরি ছেড়ে দেয়। তবে অন্য ধরণের লোকের সঙ্গে শ্যামলের পরিচয় হল। চীফ স্মেলটার নন্দলাল মিশ্র। ফ্যাকটরির ম্যানেজার মি. আইয়ার ইত্যাদি। ফ্যাকটারির মালিক ছিলেন নরসিংহদাস আগরওয়ালা। অনেক পরে এঁর নামে প্রতিষ্ঠিত নরসিংহদাস পুরস্কার শ্যামল সাহিত্যিক হিসাবে পান। ‘মহাকাল কেবিন’ গল্পটি এখানকার অভিজ্ঞতা নিয়েই লেখা।
মণিদা বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হল চারুচন্দ্র কলেজে। শিক্ষক ছিলেন শুদ্ধসত্ব বসু। নরেশ গুহ। আর সহপাঠী হিসাবে পেয়েছিল প্রলয় সেন, বিষ্ণু বসু। বি.এ. বাংলা অনার্স নিয়ে পাশ করে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে কম্পারেটিভ লিটারেচার নিয়ে ভর্তি হল মণিদা। শিক্ষক হিসাবে বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বা সহপাঠী হিসাবে নবনীতা দেব, অমিয় দেব — এসব উপরি পাওনা। হঠাৎ মাঝপথে কলেজ ছেড়ে শাহনগরে মথুরানাথ বিদ্যাপীঠে শিক্ষক হিসাবে যোগদান। সহকর্মী ছিলেন বরেন গঙ্গোপাধ্যায়ও জ্যোর্তিময় গঙ্গোপাধ্যায়। বরেনবাবু গম্ভীর সেলফ কনশাস লোক, কিন্তু জ্যোর্তিময়বাবুর মতো সদাহাস্যময় লোক আমি খুব কম দেখেছি। নিজেকে নিয়ে রসিকতা করার খানদানি কলকাতার কালচার তাঁর ছিল।
এরমধ্যে, লেখার কাজে বিরাম ছিল না। মৌলানা আক্রাম খান পার্টিশনের পরে তাঁর ‘আজাদ’ খবরের কাগজ নিয়ে ঢাকায় চলে গেল, তাঁর ছেলে গণি মিঁয়া ‘পয়গম’ নামে ট্যাবলয়েড – বের করতে শুরু করেন। সেখানেই বেরোয় মণিদার ‘জোনাকবানু’ গল্প। মনে আছে পয়গম থেকে দশ টাকা পেয়ে আমরা দুই ভাই চাঁদনীচকের সাবির রেস্টুরেন্টে গিয়ে মাটন রেজালা প্রথম খাই।
কলকাতায় তখন একটা ফারমেনটেশন চলছে। আমার মনে আছে মণিদা হাত গোটানো ফুল শার্ট-টাই পরে রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকার দায়িত্বে থাকা প্রগাঢ় যুবক রমাপদ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে। ওকে তিনি কিছু প্রবন্ধ লিখতে বলেন। সেই তখন থেকেই মণিদার ন্যাশনাল লাইব্রেরী আসা যাওয়া।
বসুশ্রী সিনেমার উল্টোদিকে হাজরা মোড়ে ছিল ‘ভবানীপুর টিউটেরিয়াল হোম’। মালিক ছিলেন বোধহয় গোবুদা। ওই বাড়ির ছাদে শনিবারের সন্ধ্যায় বসত সাহিত্য সভা। সেখানে গল্প পড়তেন প্রবীণ সব সাহিত্যসেবী। তবে খাওয়াদাওয়াটা ভালো হত। কলেজ স্ট্রীটের কাছে শিবনারায়ণ দাস লেন থেকে বেরুত ‘তরুণের স্বপ্ন’ নামে মাসিক পত্রিকা। সম্পাদক ছিলেন প্রফুল্ল রায়। সেখানে বেরোয় ‘তারা গুণতির দেশে’ গল্পটা একটা ছোটো মেয়ের মৃত্যু নিয়ে। মেয়েটিকে আমি পড়াতাম। তার বাবা ছিলেন বিশিষ্ট ফিল্ম ডিরেক্টর নির্মল দে। ‘সানে চুয়াত্তর’, ‘বসু পরিবার’, ‘চাঁপাডাঙার বউ’ ইত্যাদি ফিল্ম করে তখন নির্মল দে-র খুব নামডাক।
যে সময়ের কথা বলছি — অর্থাৎ ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৮। আমাদের বয়স তখন কুড়ি থেকে ২৪ এর মধ্যে। তখন ক্ষমতায় বিধান রায় কলকাতায় এবং পণ্ডিত নেহেরু দিল্লিতে। জ্যোতি বসু বিধানসভায় বক্তব্য রাখলে আনন্দবাজার পাতার পর পাতা খরচ করে। লেখে ‘তিনি আরও বলেন …’ ইত্যাদি। সল্টলেক তখন লবণ হ্রদ, লেক গার্ডেনের নাম তখন মুটে পাড়া। টালিগঞ্জের রেল ব্রীজের নীচে একটু বৃষ্টি হলেই জল জমে। ট্রাম-বাস দুপুরবেলা প্রায় ফাঁকা। ছেলেমেয়েরা নিশ্চিন্তে লেকে বা ময়দানে বা ন্যাশনাল লাইব্রেরীর মনোরম উদ্যানে প্রেম করে। মণিদা বোধহয় এই সময় একজন শ্যামাঙ্গী সুশিক্ষিতা তরুণীর প্রেমে পড়ে। কি একটা স্কলারশিপ পেয়ে মেয়েটি বিলেতে চলে যায় — এবং অবশ্যই তার ছিঁড়ে য়ায। মণিদার লেখা ধীরে ধীরে বড়ো বড়ো কাগজে জায়গা করে নেয়। এখানে মণিদার প্রথম যৌবনের বন্ধুদের কথা বিশেষ করে বলা হয়নি। খুলনায় মণিদার কাছে এক ক্লাস উপরে পড়তেন শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। ওর ছোটো ভাই গৌতম আমার সঙ্গে পড়ত। শঙ্করদা, বা মিহির মুখোপাধ্যায় — মণিদার খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন একসময়ে। মিহিরদার বাড়িতে অফুরন্ত জল — তাই আমরা অনেক সময় টালিগঞ্জ রেলব্রীজের কাছে ওর বাড়িতে স্নান করতে যেতাম। মিহিরদা পরে কল্যাণীতে থাকতে শুর করেন। ওর ছোটো ভাই, ডাকনাম শঙ্কর, ভালো নামটা কিছুতেই মনে পড়ছে না, পরে বোম্বাইতে টাইমস অব ইন্ডিয়ার আর্ট ডিরেক্টর হয়। তার চেয়ে বড়ো কথা অঙ্কন শিল্পী হিসেবে সর্বভারতীয় স্বীকৃতিও পায়।
সেই অর্থে মণিদা কোনোদিনই কৃত্তিবাসের অংশ ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দীপক মজুমদার, শরৎ মুখোপাধ্যায় ইত্যাদি ওর ঘনিষ্ঠ হলে কোনো গোষ্ঠীভুক্ত জীবন যাপনে তার বরাবরই অনীহা ছিল। অনেক পরে অবশ্য কৃত্তিবাসের ২/৪ টে সংখ্যা ওর সম্পাদনায় বেরোয়। তবে নিয়ম করে আড্ডা দিতেও মণিদা পারত না।
১৯৫৯ এর মাঝামাঝি আমার কলকাতা ছাড়ার সময় হল। তখন একটি মালটিন্যাশানাল কোম্পানিতে চাকুরি পেয়েছি। দামী প্যান্টশার্টের দরকার। মণিদা আমাকে লিণ্ডসে স্ট্রীটে ভি. ভি. লীলরামের দোকানে নিয়ে গেল। এক রাত্তিরে তারা চারটে প্যান্ট বানিয়ে দিল। আমি বোম্বাই পাড়ি দিলাম পরদিন। ফিরে এসে দেখি অন্য এক মণিদা। জীবনযাপন আর লেখার অন্য এক জগতে ডুবে যাওয়া মণিদা। সে পর্বের কথা আবার অবসর মতো লিখব।
গল্পসরণি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
বিশেষ সংখ্যা ২০০৯
মিসিং পাম্প সু – তাপস গঙ্গোপাধ্যায়
বিয়ের এক বছর পর দিদি-জামাইবাবু এলেন কলকাতায়। উঠলেন টালিগঞ্জ ফাঁড়ির মোড়ে যে ভাড়া করা ফ্ল্যাটে দেশ বিভাগের পর পাকাপাকি ভাবে আমরা সবাই এসে উঠেছিলাম। চার কামরার ফ্ল্যাটে। একটা ঘরে থাকতেন বড়দা বড়োবউদি ও ভাইপো সুব্রত। সামনের বসার ঘরে শুতেন। ভেতরের ঘরে মেজদা ও মেজবউদি। আর রান্নাঘরের পাশে ছোটো ঘরটায় তিনটে নানা সাইজের খাটে মায়ের সঙ্গে শুতাম আমি, ছোড়দা ও মণিদা। বিয়ের আগে দিদিও।
জামাইবাবু, নিহার মুখার্জি জিওলজিস্ট। তখন সিকিমের রংপোতে তামার অনুসন্ধানে ব্যস্ত। দিদি জামাইবাবুরা বাংলায় তিস্তার ধারে তাঁবুতে থাকতেন। কলকাতায় আসার পর বড়দার ঘর হল তাদের কলকাতার তাঁবু। বড়দা-বড়বউদি ও ভাইপো রাতে সামনের ঘরে বাবার খাটের পাশে মাটিতে বিছানা পাতলেন।
ছোড়দা, তরুণ তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.কমের ফাইনাল ইয়ারে। মণিদা, শ্যামল তখন বেলুড়ের ন্যাশানাল আয়রন স্টিল কোম্পানির ট্রেনি স্মেলটারের কাজে ইস্তফা দিয়ে বাড়িতে বসে। লেখালেখিতে ব্যস্ত। বড়দা ভীষণ বিরক্ত। মণিদাকে বড়দা সম্ভবত নিজের ছেলের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। মণিদাকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সম্ভব অসম্ভব সব চেষ্টা করে তখন একটু দম নিচ্ছেন। এই ফাঁকে মণিদা লেখার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বড়দা সবই টের পেতেন। নিজে ইংরাজির এম.এ। রাজকীয় চেহারা, অসামান্য গানের গলা। কিন্তু নিজের পরিবারের কেউ লেখক বা গায়ক হোক চাইতেন না। ভয় পেতেন। কারণ ব্যর্থ লেখক, ব্যর্থ গায়কদের হাল তো চাক্ষুষ করেছেন। তাই মা যদি কখনো বড়দাকে বলতেন, অমুক ম্যাগাজিনে খোকার (শ্যামলদার আর একটা ডাক নাম যা শুধু বড়দাই ব্যবহার করতেন) একটা ল্যাখা বারাইসে, বড়দা ঠাট্টা করে বলতেন, ল্যাদা। ও ল্যাদক।
দিদি-জামাইবাবু আসার পর লেখক শ্যামল গাঙ্গুলীর লেখকত্ব প্রমাণ করার ডাক বড়দা সেদিন সকালে অফিসে যাওয়ার আগে মাকে বলে গেলেন, খোকাকে বলো, আজ রাতে জামাইকে ভালোমন্দ খাওয়ানোর দরকার। ওতো ল্যাদক। বাজারটা যেন ল্যাদার টাকায় করে।
মাকে বলতে হয়নি। মণিদা ভেতরের ঘরেই ছিল। সবই শুনেছে। বড়দা বেরিয়ে যেতে মাকে এসে বলল, আজ সব ব্যবস্থা করব। তুমি মা কোনো চিন্তা কোরো না।
ওদিকে জামাইবাবু খুব সকালেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন। দিদিকে বলে যান ফেরার পথে নাইট- শোর টিকিট কেটে আনবেন। বসুশ্রী সিনেমায় তখন কি একটা হিট ছবি চলছিল। মা, বড় বউদি, মেজ বউদি, দিদিকে নিয়ে সিনেমায় যাবেন। আজ যাবেন বিয়েতে পাওয়া সিলকের পাঞ্জাবি, সোনার বোতাম, ধুতি ও পাম্পশু পরে। দিদি মানে রমাদি যেন সব গুছিয়ে রাখেন। জামাইবাবু ফিরবেন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ। তারপর খাওয়া-দাওয়া করে সবাই ট্যাক্সি চেপে যাবেন সিনেমা হলে।
জামাইবাবু আর বড়দা বেরিয়ে গেলেন। তারপর মেজদা। ছোড়দা সকালে তার এক ছাত্রীকে পড়াতে গিয়েছিলেন। তাই মণিদাকে কি নির্দেশ বড়দা দিয়ে গিয়েছিলেন তা জানত না। মণিদাও মেজদার পরপর দেখলাম বেরিয়ে গেল।
সকাল দশটা নাগাদ ছোড়দা বাড়ি এল। এল, কিন্তু খুব ব্যস্ত। রান্নাঘরে ঢুকে বাজারের একটা থলি নিয়ে সামনের ঘরে চলে গেল। মা, বড় বউদি, মেজ বউদি, দিদি, কাজের দিদি ধনাদার মা অমিয়াদি সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। রান্নার দিদি রান্না করছেন। ভেতরের ঘরে খাটে বসে পড়তে পড়তে শুনতে পাচ্ছি মা বড় বউদিকে বলছেন, ঝুনু (বড়দা) খোকার ওপর সব ভার চাপিয়ে গেল। ও তো কোনো কাজ করে না। টাকা পাইব কোথায়? বাজারই বা হইব কি কইরা?
স্নেহের দেওরটির ওপর বড়ো বউদির অগাধ আস্থা। শুনলাম বলছেন, আপনি চিন্তা করবেন না। অ্যাতো কাগজে খোকার লেখা বাইরায়। দু-এক জায়গা থেকে লেখার টাকা পাইলেই তো হইয়া যাইব।
মাত্র ১০ বছর আগে উদ্বাস্তু হয়ে আমরা খুলনা থেকে এসেছি। বড়ো বউদি জানতেনই না তখন গল্প লিখে কত টাকা পাওয়া যায়। তারপর লেখক যদি মণিদার মতো উঠতি লেখক হয়।
কানে এল মা বলছেন, গদা (ছোড়দা তরুণ) কোথায় যাস? অর্থাৎ ছোড়দা বেরিয়ে যাচ্ছ কোথাও। ছোড়দার জবাবও কানে এল, এই যাব আর আসব।
ঘণ্টা খানেক পরে মণিদা দেখি বাজরের সেই থলিটা নিয়ে বাড়িতে ঢুকল। পেছন পেছন ছোড়দা। মা রান্নাঘরে বড়ো বউদিকে বোধহয় কোনো বিশেষ রান্নার ব্যাপারে ইন্সট্রাকশন দিচ্ছিলেন। কাজের দিদি, অমিয়াদি চেঁচিয়ে উঠলেন, মা দেখুন খোকা কত্তো বাজার করে এনেছে।
এরপর কি বই খাতায় মন থাকে? পড়া ছেড়ে ভেতরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে মণিদা থলিটা উপুড় করে দিয়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। বড় বউদি বাজার দেখে গালে হাত দিয়ে বললে, মা দেখে যার খোকার কা’। অমিয়া বাথরুম থিকা বাটি দুইটা আইন্যা দাও। মা আসেন দু’জনে মিলে কোটাকুটি কইয়া লই। ততক্ষণে মা মণিদার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তার দু চোখে জল টলটল করছে। বেকার ছেলে রাজার বাজার নিয়ে এসেছে। কি নেই তাতে — মাংস চার সের, দুটো ইলিশ মাছ, এক একটা কম করেও দেড় সের, সের তিনেক রুই মাছ। এ ছাড়া মণিদার হাতে একটা মিষ্টি দই-এর হাঁড়ি। তা সের পাঁচেক।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে শুধু মণিদার প্রশংসা। জামাইবাবু, বড়দা, মেজদা, দিদি — সবাই এক সঙ্গে খেতে বসেছেন। বড়দা যে বড়দা তার মুখেও মণিদার প্রশংসা। খোকা অ্যাতো বাজার করল কী করে? বড়ো বউদির মুখ ঝামটা ছুটে এল, তুমি সর্বদা ওকে ল্যাদাক বলো। দ্যাখো তো লিখে টাকা না পেলে কি খোকা অ্যাতো বাজার করতে পারত। মেজদাও একমত। মার চোখে জল। জামাইবাবু খেতে খেতে বললেন, মণিদা তো শুধু লেখেন না, বাজার সরকারও। দিদির মুখ জুড়ে হাসি।
পরের ব্যাচে, মা, বড়ো বউদি, মেজ বউদি, ছোড়দা ও আমি খেয়ে নিলাম। সিনেমার টাইম হয়ে যাচ্ছে। দিদি ভেতরের ঘরে দরজা বন্ধ করে ড্রেস করছে। হঠাৎ কানে এল জামাইবাবুর গলা, সঙ্গে সঙ্গে দরজায় ছিটকিনি খোলার আওয়াজ, রমা আমার পাম্প শু কোথায়?
জামাইবাবু সামনের ঘরে দাঁড়িয়ে। ধুতির ওপর সিল্কের পাঞ্জাবি। সোনার বোতাম। লাগাতে লাগতেই আবার জানতে চাইলেন, তার পাম্পশু কোথায়? হঠাৎ দেখি ছোড়দা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল খেতে। মা, বড়ো বউদি, মেজো বউদি সবাই একটু অপ্রস্তুত। বড়ো বউদি গলা তুললেন, রমা দ্যাখ না, তোদের খাটের নিচেই তো ছিল। দিদি কানে ঝুমকো দুল পরতে পরতে ঘর থেকে বেরিয়ে এল, খাটের তলা সব দেখেছি, ওর পাম্প শুটাই নেই।
হঠাৎ কানের কাছে বোমা ফাটল, খোকা! খোকা? খোকা কোথায়? — বড়োদা এসে দাঁড়িয়েছেন। আর তখনই সবার খেয়াল হল, মণিদা তো বাড়ি নেই। মেজদা জিজ্ঞাসা করলেন, গদা খোকা কই? ছোড়দা হাত গুটিয়ে নিয়েছে। কোনো রকমে ঢোকা গিলে বলল, শংকরদার মানে লেখক শংকর চ্যাটার্জী। খুলনা থেকে মণিদার বন্ধু। থাকেন দেশপ্রিয় পার্কের কাছে ল্যান্সডাউন রোডে।
সেই রাতে জামাইবাবু প্যান্ট, শার্ট, শু পরে সবাইকে নিয়ে সিনেমা দেখতে গেলেন। এরপর যতবার কলকাতায় এসেছেন, উঠেছেন শেয়ালদার স্টেশনের কোনো না কোনো হোটেলে।
আর মণিদা সেই রাতে যে উধাও হয়েছিল, তার পর তিনমাস কোনো হদিস ছিল না। রাতের ট্রেনেই ওড়িশা। বালেশ্বর এক বাঙালী উকিলের বাড়িতে ছোকরা চাকর।
তবে পাম্প শু ফেরৎ এসেছিল। ছোড়দাই খবর দিয়েছিল। মণিদা পাম্প শু জোড়া স্থানীয় হিজড়েদের লুঙ্গিপরা খালি গা নেতার কাছে বিক্রি করেছিল। বড়দা টাকা দিয়েছিলেন জামাইবাবুর পাম্প শু উদ্ধারের জন্য।
মণিদা – রমা মুখোপাধ্যায়
লোকে বলে একটু পাগলাটে, আবার কেউ কেউ বলেন জীবন সম্পর্কে তিনি খুবই অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। আবার কারও মতে সে খুবই উদাসীন। আমার ভাই একনম্ভর জীবন রসিক। আবার কোথায় যেন খুবই ধার্মিক এবং নিস্পৃহ। আমার ছ ভাই ও এক বোন ছিলাম। এখন চার ভাই এক বোন। বাংলাদেশে একটা খুবই সুন্দর শহর আছে যার নাম ‘খুলনা’, সেখানে আমাদের জন্ম। আমার বাবার জ্যাঠতুতো, খুড়তুতো ভাইদের ছেলে, মেয়ে এবং চার বিধবা পিসি সব নিয়ে তিরিশজন সদস্য ছিল। কিন্তু তাতে বাবার কোনো অসুবিধা ছিল না, কারণ উনি খুলনা জজ কোর্টে পেশকারের পদে আসীন ছিলেন। তখনকার দিনে মাইনে পঞ্চাশ টাকা। রোজ রাত্তিরে বাবা মায়ের কাছে বসে কেসের কথা বলতেন। তখন আমি খুবই ছোটো। আমার এসব কথা জানবার নয়। কিন্তু যখন পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ ভাগ হয়ে আমরা কলকাতায় এলাম, তখন মা আমাদের কাছে খুলনা শহরে মায়ের জীবন কেমন কেটেছে এবং কীভাবে তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ি ও দেওর-জা, জ্যাঠা- জ্যোঠি আর তাঁদের ছেলেমেয়েদের কষ্ট করে মানুষ করেছেন সব ঘটনাবহুল গল্প যখন আমাদের কাছে বলতেন তখন কেমন অদ্ভুত লাগত। এখন যে সময় পড়েছে এসময় হলে মা-বাবা করে এত বড়ো পরিবার প্রতিপালন করতেন আমি জানি না।
বাবা-মা অত্যন্ত সাহসী ছিলেন। তাঁরা যেন কোনো কিছুতেই বিচলিত হতেন না। জীবন সম্ভন্ধে তাঁরাও বেপরোয়া ছিলেন। আমাদের ভাইবোনদের লেখাপড়া নিয়ে বাবা খুব একটা মাথা ঘামাতেন না — মা দেখতেন তাঁর ছেলেমেয়েরা কীভাবে ভালো শিক্ষা পায় ও তাদের স্ফাস্থ্য ভালো থাকে। এজন্য আমাদের মা শ্রীমতী কিরণকুমারী দেবী আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন আমাদের শিক্ষার জন্য। শিক্ষা মানে শুধু বই পড়া নয় মানসিক শিক্ষাও দিতে চেয়েছেন। আমরা ১৯৪৭ সালে কলকাতায় আসি। এর আগে ১-২ মাস দত্তপুকুরে আমার কাকার কাছে থেকেছি। তারপর কলকাতায় আনোয়ার শাহ রোডে ‘ঘড়িঘর’ নামে বাড়িটিতে ১৫ নং ফ্ল্যাটে এসে আমরা বসবাস করি। সে সময় শ্যামলের বয়স বড়োজোর ১৫ কিংবা ১৬। তারপরের ভাই যিনি এখন ‘টেলিগ্রাফ’-এ আছেন অর্থাৎ তরুণ গঙ্গোপাধ্যায়, শ্যামলের চেয়ে ২ বছর ৮ মাসের ছোটো, তারপরেই আমার জন্ম এবং আমার পরের ভাই তপু অর্থাৎ তাপস গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম হয়। আমার এই ছয় ভাই-এর নাম যথাক্রমে সুখেন্দুবিকাশ, জ্ঞানেন্দুবিকাশ, পুর্ণেন্দুবিকাশ, তরুণেন্দুবিকাশ ও তাপসেন্দুবিকাশ গঙ্গোপাধ্যায়। এরাই আবার যখন কলকাতায় এসে একটু বড়ো তখন এতো বনো নাম নিয়ে খুবই বিব্রত হতো। সে কারণে সুখেন, জ্ঞান, পূর্ণ, শ্যামল, তরুণ ও তাপস এই ‘শর্ট ফর্মে’ এরা নিজেরাই নিজেদের নাম ঠিক করে নেয়। আমাদের বড়দা মেজদা আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড়ো ছিলেন। বাকি চারজন অর্থাৎ পূর্ণ, শ্যামল, তরুণ, তাপস এবং আমি একাত্মা ছিলাম। একাত্মা বলতে বোঝায় আমরা একসঙ্গে বড়ো হয়েছি।
মণিদা বি.এস.সি পড়া ছেড়ে দিয়ে বেলুড়ে একটা ফ্যারিতে কাজে লেগে পড়ে। টালিগঞ্জ থেকে ভোর ছটার সময় রওনা দিয়ে বেলুড় পৌঁছে আবার রাত ৭-৮ টার সময় বাড়িতে ফিরে আসত। তখন বয়সা খুবই কম বলে ওর অশেষ কষ্টও হতো। ভোর চারটের সময় উঠে ঠাণ্ডা জলে স্নান করে মা বা বড়োবউদির হাতে গড়া রুটি ও সামান্য তরকারি খেয়ে ও ওর দিন শুরু করত। এবং আবার রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরত। এই সময়টা ওর খুবই কষ্টে কেটেছে। এর বছর দুই পরে হঠাৎ একদিন বলে বসল আমি বাংলা অনার্স নিয়ে বি.এ পড়ব। বাংলায় অনার্সসহ মণিদা বি.এ পাশ করল। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় যোগ দিল। শ্রদ্ধেয় সন্তোষকুমার ঘোষ এর শুভানুধ্যায়ী ছিলেন। এই সময় একটি খুবই ভালো মেয়ের সঙ্গে মণিদার বিশেষ ভাব হল। কিন্তু সে লন্ডনে চলে যাওয়াতে মণিদা দুম করে বিয়ে করে বসল। আমার এ বউদি সম্ভন্ধে একটু বলি। অতি ধীর, স্থির, বুদ্ধিমতী ও সুগৃহিনী। মণিদারও একটু স্থিতি হল বলে মায়ের মনে একটু শান্তি ফিরে এলো।
এর কিছুদিন পর থেকে মণিদা ২৪ পরগণার চম্পাহাটি গ্রামে বসবাস করতে থাকে। সেখানে বহুবার আমিও আমার স্ফামী বেড়াতে গেছি। প্রথমে ওরা একটি ভাড়া বাড়িতে থাকত। তারপর মণিদার মাথায় কিভাবে খেলে গেল একটি বাড়ি করতে হবে। তৎক্ষণাৎ যেই কথা সেই কাজ। দেখতে দেখতে এক বছর বাদে মণিদা চম্পাহাটিতে একটি বৃহৎ বসবাসযোগ্য বাড়ি তৈরি করেন মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে। ওখানে থাকতে থাকতে মণিদার মানুষ সম্পর্কে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেখানে খালপাড়ের পাশ দিয়ে রাস্তা গেছে। দুপাশে স্ফর্ণচাঁপা ও নানাপ্রকার সুগন্ধী ফুলের গাছ লাগানো হয়েছিল। বাড়িটি ঐ রাস্তার পাশেই। এই বাড়িটির জন্য মণিদা অত্যন্ত পরিশ্রম করে ও চারদিক থেকে নানারকমের ফুল ও ফলের গাছ লাগান। এবং বাড়ির পেছনদিকে একটা পুকুরও তৈরি করেন। পুকুরটির দুপাশে কদম ফুলের গাছ লাগানো হয়েছিল। বসবার জন্য পাথরের বেদিও তৈরি করেন। কিছুদিন পরে ফুলগাছগুলো বড়ো হয়ে বাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছিল, দূর থেকে বাড়িটিকে ছবির মতো লাগত। আমরা অর্থাৎ আমার স্ফামী মেয়ে এবং অনেক বন্ধুবান্ধব ওখানে গিয়ে প্রায়শই মনের আশা মিটিয়ে পিকনিক করে কলকাতা আসতাম।
সেসব দিনের কথা ভোলা যায় না। মণিদার এটা একটা খেয়াল বলেই জানবেন। কারণ ওখানে বছর কয়েক থেকে আবার ধান চাষও শুরু করে দেন। এই সময় শ্যামল বহু চাষী ও ভাগচাষীদের সঙ্গে গভীরভাবে মেশামেশা করেন। যার ফলে আমরা তাঁর পরবর্তীকালের লেখা বইগুলির মধ্যে জীবনজিজ্ঞাসা প্রতিফলিত হতে দেখি। বহুদিন দেখেছি হাজরা, পঞ্চানন প্রভৃতি চাষীদের সঙ্গে একই প্লেটে মণিদা ডিমের অমলেট, মাংস কিংবা রুটি খাচ্ছেন। এভাবে মানুষের সঙ্গে মেশা এবং মানুষকে খুব কাছের থেকে দেখবার চেষ্টা, কী আকূল তৃষ্ণা এ কেবল অনুভব করা যায়। কিন্তু ভাষায় ব্যক্ত করা কঠিন।
ভাগচাষীদের বৈশিষ্ট্য তাঁর লেখায় ভালোভাবে খুঁজে পাওয়া যায়। যারা সমাজের অত্যন্ত গরীব, দিন আনে দিন-খায়, কোনো কোনো দিন হয়তো অনেকের দৈনিক আহারও জোটে না এদের সম্বন্ধে মণিদা অভিজ্ঞা। তাঁর লেখায় তিনি এসব বর্ণনা করেছেন। এদের অনেকেই আমি কলকাতায় মণিদার বাড়িতে কিছু ধান, ভাঙা চাল, সুপুরি এবং নারকেল আনতে দেখেছি। খুব ভালোবেসে তারা এইসব জিনিস শ্যামলকে দিতেন। পরে মণিদা নিজেই বলতেন ‘তোরা যা খুশি ভোগ কর। আর আনতে হতে না।’ এই সব সমতা, মানুষকে ছোটো করে না দেখা এ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের পক্ষেই সম্ভব। এই সময় মণিদার বয়স চল্লিশের কোঠায়ও পৌঁছয়নি। কিন্তু ততদিনে খামখেয়াল শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় হঠাৎই মত পরিবর্তন করে দুই মেয়ে মলি, ললি ও স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। মলি, ললির বয়সি তখন সবে এগার ও সাত বছর। বলাবাহুল্য বাড়িটি আমাদের বাড়ির পুরনো রাঁধুনি রানীদির ছোটো ভাই-এর হেফাজতে রেখে আসেন। ও কখনও নিজের দান বা কারও জন্যে কিছু করলে সে সম্পর্কে কারোকে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করে না।
এইবার কলকাতায় ফিরে এসে ও ভালোভাবে লিখতে শুরু করে। মজার কথা এই যে, প্রথম যখন শ্যামল লিখতে শুরু করেন, আমি কখনোই তার লেখা পড়তাম না। কিন্তু বেশ কিছুদিন পরে হঠাৎ তার লেখা পড়তে পড়তে বুঝতে পারি যে এই লেখাগুলো বিশেষ করে ধ্রুপদী এবং মানুষের মনের মণিকোঠায় পৌঁছে যায়। জীবন সম্পর্কে শ্যামলের অপরিসীম আগ্রহ। এই আগ্রহই তাকে অনেকদূর পৌঁছে দিয়েছে।
ওর মেয়েরা যখন স্কুলে পড়ে তখনই ও দুখানা গাড়ি কিনেছিল। কিন্তু কিছুদিন পর গাড়ির মোহ কেটে গেল। একটা জীবন ও রসিয়ে রসিয়ে ভালোভাবে ভোগ করেছে, এখনও তার জীবনসম্পর্কে অপরিসীম আগ্রহের শেষ হয়নি।
শ্যামল-চরিত্রের আর একটি দিকের কথা আমি বলতে চাই, যা অনেকে জানেন আবার অনেকে জানেন না। খাদ্যরসিক হিসেবে আমি যা দেখেছি তাই বলছি। আমার বউদি অত্যন্ত ভালো রান্না করে। কিন্তু মুখে বেশি কথা বলেন না। শুধু মৃদু মৃদু হাসেন। আবার এমন দিনও গেছে বউদির অনুযোগ করছেন — কি যে করছে জানি না। ভোরবেলায় শসা, শাঁকালু, কলা, আমলকি (যে ফলগুলো কোনটার সঙ্গে কোনোটা মেলে না) ইত্যাদি খেয়েছে। আবার বেলা দশটা সাড়ে- দশটার সময় একগ্লাস ঘরে পাতা দইয়ের ঘোল খেয়েছে। তারপর আবারও বলছে দুপুরে ভালো করে রান্না করবে। এরকমও দেখেছি কোনো কোনো দিন খিদে হওয়ার জন্য দু-একঘণ্টা বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে কোথাও গিয়ে, কথাবার্তা বলে বাড়ি ফিরে এসে বলছেন —’ইতি। ভাত দাও।’
আসলে মণিদা চেষ্টা করেন তাঁর সামনে আসা প্রতিটি মানুষকে বোঝবার, তাঁদের চরিত্র অনুভব করবার, কত লোক যে তাকে ভালোবাসে। তার খেয়ালিপনার প্রশ্রয় দেন, অবাক লাগে।
আবার মণিদা একজন উঁচুদরের সঙ্গীতপ্রেমিক। ওর বাড়িতে ওর সংগ্রহ করা পুরনো দিনের নাম করা গাইয়েদের রেকর্ড আছে। এমন এমন দিনও গেছে আমি হঠাৎ মণিদার বাড়িতে বেড়াতে গেছি তখন দেখি এক মনে শরাফৎ হোসেন খাঁ বা রসিদ খানের গান শুনছেন ও লিখে চলেছেন। মণিদা যেমন ছিলেন ঠিক তেমনই আছেন। জীবনটাকে তাকিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন। এখন সবকিছু করেও, সবকিছু দেখেও তিনি কোনো কিছুতেই বিচলিত নন। এই যে শিশুর মতো কৌতূহলী মনে নিয়ে জীবনকে দূর থেকে দেখা, জেনে নেওয়া বা উপভোগ করে সে সম্পর্কে লেখা, ওটাই তো বিস্ময়কর।
সান্ধ্যভাষা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
সম্মান সংখ্যা ১৯৯৮
আমার বাবা – ললিতা চট্টোপাধ্যায়
টালিগঞ্জের যে বাড়িটায় এখন ছোটো কাকা (তাপস গঙ্গোপাধ্যায়) আছেন, ওটাই তখন আমাদের বাড়ি হিসেবে গণ্য হত। ওই বাড়িতে প্রথমে দাদু এসে ওঠেন। ঠাকুমা আর আমার কাকারা থাকতেন। কাকদ্বীপ থেকে জেঠু এসে ওখানেই উঠতেন।
চম্পাহাটির বাড়িটার স্মৃতিই আমার মনে আছে। বাড়িটা ছিল একেবারে মাঠের মধ্যে। চম্পাহাটিতে সাত বছর ছিলাম। উত্তর দিকে মাঠ। পিছন দিকে একটা বড়ো পুকুর আর গোয়াল ছিল। সামনের দিকে ছাগল ছিল, মুরগি চাষ হত, হাঁস আর পাখি-টাখিও ছিল। আর ছিল আমাদের প্রিয় কুকুর বাঘা। বড়ো অ্যালসেসিয়ান। বাবার বহু লেখায় মলি, ললি আর বাঘার উল্লেখ আছে — যেন তিন ভাইবোন। পুকুরে জল ছেঁচে সারারাত মাছ ধরা হত, আমরা দুই বোন বাবার সঙ্গে তিড়িং বিড়িং করে লাফাতাম।
প্রথম যে গোরুটা এল, আমাদের ঘরের মধ্যে ছিল। বাবা নাইট ডিউটি করে ফিরে এলে বাঘা বাবার কাছে শুয়ে থাকত। চম্পাহাটির বাড়িটা ছিল মাঠের মধ্যে একটা জাহাজের মতো। বাড়ির সামনে ২১ ফুট চওড়া রাস্তা। রাস্তা থেকে নেমে সামনে বড়ো মাঠ। যেখানে মানুষ লন তৈরি করে, সেখানে ধান চাষ হত। প্রত্যেকটা ঘরের লাগোয়া একটা করে বড়ো বারান্দা ছিল। বারান্দায় কোলাপসিবল গেট। বাইরে ভাগচাষীরা পাহারা দিচ্ছে। ওরা দিনের বেলা ভাগচাষী, রাত্রিবেলা আবার বহু জায়গায় ডাকাতি করে বেড়াত। ওরা আমাদের বলেছে রাত্রিবেলা গাদা বন্দুক নিয়ে ডাকাতি করতে গিয়ে কোথায় কি হয়েছে না হয়েছে। আমার ৩-৪ বছর বয়স। লন্ঠনের আলোয় পড়াশোনা শুরু করেছি। খালপাড়ের ওপর খুঁটি পুঁতে ইলেকট্রিক লাইন নিয়ে আসা তো তার পরের কথা। তখন বাড়িতে অল্প বয়সী সুন্দরী যুবতী স্ত্রী—আমার মা, আমরা দুই বোন, বলাই বলে একটা কাজের লোক — সে হয়তো দিদির থেকে ২-৪ বছরের বড়ো হবে কি হবে না আর বাঘা কুকুর। বাইরে কিছু ভাগচাষী পাহারা দিচ্ছে। বাবা তখন কিন্তু নিশ্চিন্তে আনন্দবাজারে নাইট ডিউটি করছেন।
বাবা লেখক এটা বোঝার মতো বয়স বা বোধবুদ্ধি তখন হয়নি। বাবার একটা হ্যাবিট ছিল। এটা মাকে বলতেন, আমাকেও বলতেন — জানো তো, এটা লিখব। বলে গল্পটা বলতে শুরু করতেন। কিছু না বুঝেই আমি বলতাম — তারপর ? তারপর? গল্প শেষ হলে বাবা বলতেন — আচ্ছা ললিবাবু, বলো তো কেমন হবে? আমি কিছু না বুঝেই বলতাম — খুব ভালো হবে। না বুঝলেও লেখার সময় বাবাকে বিরক্ত করতাম না। ছোটোবেলা থেকেই এটা আমাদের হ্যাবিট ছিল।
বাবার তখন ভুঁড়ি-টুড়ি ছিল না। পেটানো চেহারা। অসম্ভব সুন্দর দেখতে। পুকুরে নামলে সাঁতার কেটে নিচে থেকে মাটি তুলে আনতেন। অল্প একটু ভাত খেতেন। রাত্রে আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম বা খেতে চাইতাম না, বাবা খুব রাগ করতেন। ঘুম থেকে তুলে এনে খেতে বসাতেন।
চার বছর বয়সে আমরা দুই বোন, দিদির পড়াশোনা আগে শুরু হয়েছে, মায়ের সঙ্গে ট্রেনে করে বালিগঞ্জ স্টেশনে আসতাম। সেখান থেকে এইট বি বাস ধরে ডায়াসেশন স্কুলে এসে নামতাম। তারপর স্কুল শেষ হলে সারাদিন বাদে ওই-ভাবেই ফেরত আসতাম। বাঘা আমাদের ট্রেনে তুলে দিতে আসত, আবার ওখান থেকেই রিসিভ করত।
আমরা যখন স্কুলে আসতাম, বাবা তখন নাইট ডিউটি করে বাড়ি ফিরতেন। বহু সময় এমন হয়েছে যে, কোনো একটা প্লাটফর্মে উলটো দিকের ট্রেন থেকে নেমে এসে বাবা আমাদের আদর করে গেলেন।
নাইট ডিউটি করে এসে বেশিরভাগ সময় বাবা একটু ঘুম দিতেন। তারপর দুপুরে উঠে স্নান করে খেয়ে লিখতে বসতেন। ছুটির দিন বাবার সঙ্গে দেখা হত। বাবা চাষীদের নিয়ে বসতেন। তিনি যে লেখক মানুষ, আলাদা করে লিখতে বসেছেন — এই ফিলিংটা কখনও আমাদের মধ্যে আসতে দেননি।
বাবার শিফট ডিউটি ছিল। লেখার আলাদা করে সময় ছিল না। যখন যেমন সময় পেতেন লিখতেন। সারা রাত জেগে, মশার কামড় থেকে বাঁচতে পায়ে মোজা পরেও লিখতেন। আবার, এই বাড়িতে, আমার ছেলে হওয়ার পরেও দেখেছি, অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা, হইচই, মদ্যপান সব করেছেন — পরদিন ভোরে উঠে চুপ করে লিখতে বসে গেছেন। আমরা যখন ঘুম থেকে উঠেছি ততক্ষণে বাবার লেখা কমপ্লিট।
আমার শৈশব চম্পাহাটিতে কেটেছে। শৈশবের স্মৃতি, যা মনে আছে, সব জ্বলজ্বল করে। চম্পাহাটির পর আমরা প্রতাপাদিত্য রোডের বাড়িতে উঠি। প্রতাপাদিত্য রোডের দুটো বাড়িতে আমার ছিলাম, তার মধ্যে একটা বাড়িতে অল্প কিছুদিন ছিলাম। প্রতাপাদিত্য রোডের বাড়িতে এসে বুঝতে শিখেছি যে বাবা লেখক। সেখানে বাবার সমসাময়িক সমস্ত লেখকই আসতেন। সমরেশ বসু, সন্তোষকুমার ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও আরও অনেকেই। বিমল রায়চৌধুরী ও কবিতা সিংহ-ও অনেকবার আমাদের বাড়িতে এসেছেন। এই বাড়িতে থাকার সময়ই ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে বাবা আনন্দবাজার ছাড়লেন। তারপর নবকল্লোলে লেখা শুরু করলেন, যুগান্তরে জয়েন করলেন, অমৃত সম্পাদনা করলেন। তবে বাবা যে সময় আনন্দবাজার ছাড়েন, সেই সময় মধুসূদন মজুমদার বাবাকে দিয়ে নবকল্লোলে অনেক লেখা লিখিয়েছেন। উনি বাবাকে ছোটো ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। সেই সময় এই সাপোর্টটা ওঁর প্রয়োজন ছিল। পরে বড়ো হয়ে আমরা অনেক কিছু জানতে পারি, কিন্তু সেই সময় বাবার বিষাদ, অপমান, যন্ত্রণা শেয়ার করার মতো আমরা বড়ো হইনি।
বাবা বলতেন — দেখো, তোমরা আমার মেয়ে, কোথাও মুখ খুলো না। আমরা ক্রমশ উপলব্ধি করেছি যে, উনি লেখক — আমরা নই, ওঁর কাজটা উনি করে গেছেন। কার সঙ্গে কী হয়েছে না হয়েছে আমাদের দেখার দরকার নেই। আমরা তো আর ওঁর মানসিক কষ্টগুলো দূর করতে পারব না। আনন্দবাজার ছাড়ার পরেও সন্তোষকুমার ঘোষ রাত জেগে বাবার কোনো লেখা পড়ে ভোরবেলা আমাদের বাড়িতে চলে এসেছেন। পরনে ধুতি পাঞ্জাবি। মাথার বাঁ দিকে সিঁথি করা কোঁকড়ানো চুল। বারবার চুল আঁচড়ানো হ্যাবিট ছিল। দেখেছি বাবা সন্তোষ জেঠুকে চিরুনি এগিয়ে দিয়েছেন, পিক ফেলার জন্য গামলা এগিয়ে দিয়েছেন। সারাজীবন বাবা বলে গেছেন — এই লোকটার কাছে যা শিখেছি, আমি গুরু মানি।
প্রতাপাদিত্য রোডের বাড়ির অনেক স্মৃতি আছে। তখন আমার চোদ্দ-পনেরো বছর বয়স। তখন যেটা দেখে মনে হয় — ইশ, বাবা কী করছেন। কাল সকালে মুখ দেখাব কী করে। এ রকম মনে হয়। পরে যখন সেই জিনিসটা বাবার লেখায় ফুটে ওঠে বা আমাদের বয়স বাড়ে — তখন সেটাই অন্য রকম মনে হয়। সেটা মনে পড়লে না হেসে পারি না। ১৯৮২ সালে আমার বিয়ের মোটামুটি ছ’মাস পরে বাবা কাশীপুরে চলে আসেন।
‘নিশীথে সুকুমার’-এ যে একটা অদ্ভুত সুন্দর পাগলামোর জগত ছিল, আমার মনে আছে — হি ডিড ইট । বাবা লিখতেন গান চালিয়ে। ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের যে অদ্ভুত সুরেলা জগৎ, সেটা এক বর্ণ না বুঝলেও প্রাণ মন শরীর সব কিছু স্পর্শ করে যায়। এই বোধটা আমরা বাবার কাছ থেকে পেয়েছি।
‘আজকে এখন নতুন কি’ এই ব্যাপারটা — সেটা লেখাতে বলুন, খাওয়ায় বলুন, সাজ-পোশাকে বলুন, রান্না-বান্নায় বলুন, যেটা একটা জার্ক দেবে, আনন্দ দেবে মুহূর্তে — এই ব্যাপারটা বাবার ছিল। লেখা ছাড়া বাকী অন্যান্য ব্যাপারগুলো আমার মধ্যে এসে গেছে। সেটা আমিও আমার ছেলেমেয়েদের মধ্যে সঞ্চারিত করার চেষ্টা করি।
একজন মানুষ, যাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তান আছে, তিনি যখন ওই বয়সে চাকরি ছেড়ে দেন, তাতে সংসারে যে ধাক্কাটা আসে — সেটা তখন আমরা বুঝিনি। উনি এগুলো নিয়ে কোনো আলোচনার মধ্যে যেতেন না। আমাদের পুজোর বাজারটা বিশাল হত। শুধু আমাদের কেন, কাকিমা, খুড়তুতো বোন, আত্মীস্বজন পুজোতে যাদের যা দেওয়া-থোওয়া — কোনোদিন কোথাও কিছু কার্টেল করেননি। এ ছাড়া দৈনন্দিন বাজার থেকে শুরু করে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে, কার লেখার টেবিল প্রয়োজন বা কার কী প্রয়োজন — এসব ওঁর জীবনযাপনের অঙ্গ ছিল। তবে বড়ো হয়ে ফিল করেছি আমাকে ডায়াসেশন থেকে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পাঠানো হয়েছিল — সে কি শুধু বাংলা মিডিয়াম? হয়তো অর্থনৈতিক চাপ কমাতে? সেটা ক্লাস সেভেনে বোঝার বয়স আমার হয়নি।
বাবা যখন যেখানে ট্যুরে যেতেন, সব জায়গা থেকে চিঠি লিখতেন। সম্ভবত ১৯৭২-৭৩ সালে বাবা রাজস্থান, পাঞ্জাব প্রভৃতি জায়গায় গিয়েছিলেন। সেখান থেকে লিখেছিলেন — ললিবাবু, এক জায়গার নাম বুঁদি। এখানে ময়ূর এরকমভাবে নাচে, উট এরকমভাবে যায় — সেই সব বর্ণনা। তারপর জাপান গিয়েছিলেন। সেখান থেকেও চিঠি লিখতেন — এই আগ্নেয়গিরিটা বছরের মধ্যে এত মাস জ্বলন্ত থাকে, বা এখানে অমুক পাওয়া যায়, বা এখানকার প্রকৃতিটা এই রকম। হয়তো পোস্ট কার্ডে দু’লাইনের চিঠি। সেই চিঠিগুলো আর নেই। পোস্টকার্ডগুলো যে রাখব, সেই বুদ্ধি তো সেই বয়সে থাকে না।
১৯৭৯ সালে বাবা স্টেট গেস্ট হিসাবে আমেরিকা যান। সেই সময় উনি বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়েন। ছ’মাসের ট্যুরের কথা ছিল — আমেরিকার পর ইউরোপের কিছু দেশ ঘুরে আসবেন। ওখানে সল বেলো, এরিক হপার ইত্যাদি সব লেখকরা ওঁকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গেছেন। তাদের সঙ্গে গল্প করেছেন, বিভিন্ন লোকের সঙ্গে মেলামেশা করেছেন — কিন্তু ওঁর ভালো লাগেনি। ২৮-২৯ দিনের মাথায় দেশে ফিরে আসেন। ওই সময়েই অমৃত বন্ধ হয়ে যায়। আমি সে কথা বাবাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলাম। ওই বিষাদটা কাটিয়ে উঠতে বাবার অনেক দিন লেগেছিল। এটা আমি ফিল করেছি।
ধীরে ধীরে যখন বাবার বই একটা একটা করে পড়তে শুরু করি তখন বলতেন — নিজের বাবার বই পড়ছ, এটা কি তুমি ঠিক কাজ করছ? আমি কোনো উত্তর দিতাম না। বাড়িতে অজস্র বই। সেগুলো পড়তাম। ক্লাস এইটে পড়ি যখন, ভলদিমির নবোকভের ললিতা পড়তে দেখে বাবা বললেন — বইটা আর ক’দিন বাদে পড়লে হত না। আমি বললাম — অর্ধেক পড়া হয়ে গেছে। বাবা কখনও বলেননি যে, এটা পড়ো না বা সেটা পড়ো না।
বাবা বাজারের ব্যাগ ভর্তি করে বই কিনে আনতেন। উনি আমাদের ঠিক ওইভাবে খেলনা কিনে দেননি, যেভাবে বই কিনে দিয়েছেন। ফলে আমাদের ছোট্টবেলা থেকে পড়ার হ্যাবিটটা গড়ে উঠেছে। বর্ণ পরিচয় হওয়ার পর বানান করে প্রথম যে বইটা পড়তে শিখেছিলাম — সেটা ‘পথের পাঁচালি’, সেটা এই কারণে নয় যে কেউ আমাকে পড়তে বলেছিল, এই কারণে যে আই গট ইট।
কোনো লেখা মাথায় ভর করলে বাবা ঘন ঘন ফোন করতেন — আচ্ছা, এটা লিখলে কেমন হবে। বা এটা লিখব ভাবছি। এমনও হয়েছে বাবা ১৪-১৫ বার ফোন করেছেন। কাশীপুর থেকে বাবা জুবিলি পার্কে যান। সেখানে ৫-৬ বছর ছিলেন। সেখান থেকে যান ব্রহ্মপুরে। প্রথমে সমীর রায়চৌধুরীর বাড়িতে উঠেছিলেন, তারপর সুনীল ভুঁইঞার বাড়িতে ৩-৪ বছর ছিলেন। ব্রহ্মপুরে মোট ৬-৭ বছর ছিলেন। তারপর কুঁদঘাটে একটা বাড়িতে দু’মাস মতো থেকে আবার টালিগঞ্জে আসেন।
২০০০ সালে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেদিন মেডিক্যাল কলেজের রি-ইউনিয়ন না কি একটা ছিল, সেখান থেকে বাবা আমার বাড়িতে এসেছেন। একটু খিচুড়ি খেয়ে বাবা একটা চেয়ারে বসলেন। ধুতি পাঞ্জাবি পরনে। আমার চোখে পড়ল বাবার পা দুটো খুব সরু লাগছে। বললাম — বাবা তোমার শরীর ভালো নেই? বললেন — না রে, আসলে ক্লান্ত লাগে। আমি ঠিক পেরে উঠি না। এর এক দেড়মাস আগে কোনো একটা বাচ্চার জন্মদিন-টিন ছিল, আমরা একটা খেলনা কিনতে গিয়েছিলাম। রাস্তায় সাডেনলি হি স্টার্টেড সোয়েটিং। কিন্তু তিনি কেয়ার করতে দেননি। আমি বারবার বলা সত্বেও বাবা বললেন — আমাকে একজন ডাক্তার দেখেছেন। ইকো করেছেন, আর সব করেছেন, একটু ব্লক পেয়েছেন। বলেছেন কিছু লাগবে না। পরের দিন সকালে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার জন্য গেলাম, কিন্তু রিফিউজড হলাম। যাই হোক হয়তো আমারই বোঝার ক্ষমতাটা কম ছিল।
এর সপ্তাহ দুয়েক পর বাবার রোগটা ধরা পড়ল। ৩০ সেপ্টেম্বর আমার স্বামী (সমীর চট্টোপাধ্যায়) গিয়েছে বাবার বাড়িতে। গিয়ে দেখে ফোন এলে বাবা রিসিভারটা ধরছেন হয় কানের এখানে, নয় ওখানে। ও দেখছে যে বাবা অসুস্থ, কিন্তু কী প্রবলেম সেটা বুঝতে পারছে না। তখন বাবাদের বন্ধু ডাক্তার ভূমেন গুহকে সমীর ডেকে দেখায়। তারপর বাড়িতে ফিরে এসে আমাকে বলে — কোথাও একটা গণ্ডগোল লাগছে। ওঁর মতো মানুষ, বিনা চিকিৎসায় শেষ হয়ে যাবেন?
পরের দিন দুপুরে আমি বাবার কাছে চলে যাই। প্রথমে সবাই ভেবেছিলাম একটা মাইল্ড স্ট্রোক হয়ে গেছে। সেরিব্রাল। বাবা ফোন ধরতে পারছেন না, বাঁ পা-টা টেনে হাঁটছেন। অনেক সময় থ্রম্বোসিস হলে এই জিনিসটা হয়। প্রেশার দেখলাম সাংঘাতিক বেশি। সেই সময় পুজো কমিটির লোকেরা এতো সিঙ্গারা আর নিমকি নিয়ে এসেছেন। বাবা ওদের বলেছিলেন — তোদের পুজো ওপেন করতে যাব, আমাকে সিঙারা আর নিমকি খাওয়াবি। পুজো কমিটির লোকেরা আমাকে বলছেন — একটু ওঁকে বলুন ঘুরে এসে আপনার সঙ্গে যেতে। আর আমি দেখছি যে বাবার একটি সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়ে গেছে।
একটা ট্যাক্সি ডেকে মাকে বললাম — মা, আমি বাবাকে নিয়ে যাচ্ছি। চতুর্থীর দিন। ট্যাক্সি করে নিয়ে আসছি বাবাকে। তখন পাড়ায় পাড়ায় ঠাকুর প্যান্ডেলে উঠছে। খুব কষ্ট করে সিঁড়ি দিয়ে উঠিয়ে বাবাকে আমার বাড়িতে তুললাম। রাত্রিবেলা ডাঃ নারায়ণ ব্যানার্জী বাবাকে দেখলেন। স্ক্যান করতে হবে। পরদিন দোসরা অক্টোবর, সব বন্ধ। তিন তারিখ, ষষ্ঠীর দিন, বাবার স্ক্যান হল। প্রথমেই দেখা গেল যে, ব্রেনের একটা দিকে একদম ভর্তি ইডিমা। ব্রেন টিউমার। পৃথিবী দুলে যাওয়া যে কী জিনিস দ্যাট ডে আই ফেল্ট। এতটা ইডিমা, এতটা ইনফ্লামেসন — আমি বুঝতে পারছিলাম যে এটা একটা ক্যানসারাস গ্রোথ। বাবা লেখক বলে নয় — আমাদের কাছে, আমার কাছে তো বটেই, বাবা যে কী সাংঘাতিক — আমার কাছে যে কী কষ্টকর! বেরিয়ে এসে আমার মনে হল — বাবার ফাঁসির আদেশ হয়ে গেল। প্রায় তাই-ই — একজন লোককে জানিয়ে দেওয়া হল যে, তুমি আর ছ’মাস থেকে আট মাসের বেশি বাঁচবে না।
পুজোর পর পার্ক ক্লিনিকে বাবার অপারেশন হল। ওখানে কে একজন দেখতে গিয়েছিলেন, তাকে বাবা বললেন — বন্ধুদের মধ্যে প্রথম ব্রেন অপারেশন আমার হল। পার্ক ক্লিনিকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বাবাকে দেখতে গিয়েছিলেন। বাবা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে বলেছিলেন — আমি নেহরুকে নিয়ে একটা লেখা লিখতে চাই। নেহরুর মতো পণ্ডিত মানুষ, দার্শনিক মানুষ, এত কষ্ট পেয়েছেন জীবনে! তোমরা তো আবার এটা পছন্দ করবে না।
কালীপুজো বা তার আগের দিন বাড়িতে এসে বাবা অসম্ভব উল্লসিত। কালীপুজোর প্রসাদ খাওয়ার জন্য আমার মেয়ের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করেছেন। শুধু একটা কথা আমাকে বলতেন — তুমি যদি মনে কর আমার সে রকম অসুখ হয়েছে, আমাকে মেরে ফেল।
নভেম্বরের শেষ দিকে রেডিও থেরাপি করার জন্য বাবাকে ঠাকুরপুকুর হাসপাতালে শিফট করা হল। ওখানে একটা কেবিনে থাকতেন। শীতকাল, সেই গাছপালা, পুকুর — তার মধ্যে ঠায় শুয়ে থাকতেন। আমি একবার বাড়িতে আসছি, এদিকটা দেখে আবার দৌড়ে ঠাকুরপুকুরে যাচ্ছি। কিন্তু ঐ লোকটা তো একা শুয়ে আছেন।
ঠাকুরপুকুর থেকে বোধহয় ৩০ ডিসেম্বর বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম। ওখানে বাবা ভীষণ মনের কষ্ট পেয়েছেন। মন খারাপ করে থাকতেন। অধিকাংশ সময় খেতে চাইতেন না কিছু। গল্প করে বাচ্চাদের যে ভাবে খাওয়ায়, সেইভাবে বাবাকে খাওয়াতাম। এত কিছুর পরেও খাইয়ে দেওয়াটা রেলিশ করতেন। যাতে মুখ মুছিয়ে দি — মুখটা এদিকে বাড়িয়ে দিতেন। ডিমের পোচ খেতে খুব ভালোবাসতেন। আর কাজরী মাছ। মুখে নিয়ে দাঁতে চাপলে আস্তে করে বের করে নিতে হবে, মানে নিজের হাতটা লাগাবেন না। এই আল্হাদের ব্যাপারগুলো তো ছিলই।
ছোটোবেলা থেকে একটা কথা শুনে আসছি। বলতেন — আমাদের জ্বর হলে কোয়ার্টার পাউরুটি আসত। মা এক বাটি গরম দুধ আর বড়ো জাভার দানা চিনি দিয়ে খেতে দিতেন। এটা বাবার কাছে একটা রিমার্কেবল ব্যাপার ছিল।
বাবা দত্তপুকুরে এক মাসের মতো ছিলেন। পি.জি তে দু’বার ভর্তি হয়েছিলেন। সেকেন্ড টাইমে বণ্ড দিয়ে পি.জি. থেকে তুলে এনে এখানে সরযূ নার্সিং হোমে ভর্তি করতে হয়। কারণ পি.জি তে ৩৬ থেকে ৪৮ ঘণ্টা কেউ দেখেনি বাবাকে। নেগলেক্ট করা হয়েছে। এখানে ডাঃ নারায়ণ ব্যানার্জী বাবাকে দেখতেন।
১৯-৮-২০০১ তারিখে নার্সিং হোম থেকে বাবা বাড়ি আসেন। তার পরেও তিনি উঠে বসে গল্প করেছেন। বলতেন — তোমরা এ ঘরে এসো। আমাদের এই কাশীপুরের বাড়িতে তিনি প্রায় এক বছর ছিলেন।
সেইসময় একটা ঘটনার সাক্ষী আমি ছাড়া আর কেউ নয়। একটুও অসুবিধা আছে বুঝলে আমি বাবার পাশে শুতাম। বহু রাত্রি আমি বাবার পাশে শুয়েছি। আমি একটা প্যাড আর পেন বাবার মাথার বালিশের পাশে রেখে বলেছিলাম — বাবা, এটা তোমার জন্য। বাবা পাশ ফিরে শুয়েছিলেন। শুনে একটু অদ্ভুত ভঙ্গীতে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন — আমার জন্য! মানুষটা শুধু চোখের ইশারায় কথা বলতে পারতেন। তারপর বাবা ওগুলোর ওপর হাত বোলালেন। সেই রাত্রে আমি ভিতরের ঘরে শুয়েছিলাম। সকালে আয়া আমাকে ডেকে বলেছিল — দিদি তুমি একবার এস। ঘরে গিয়ে দেখি বাবা দেওয়ালের দিকে ফিরে শুয়ে আছেন। সারাটা ঘর দলা পাকানো সেই প্যাডের পাতায় ভর্তি। বোধহয় কোনো কষ্ট থেকে বাবা আস্তে আস্তে বাইরের জগৎ থেকে নিজেকে উইথড্র করে নিচ্ছিলেন।
শেষ জন্মদিনে বাবা বিরিয়ানি করতে বলেছিলেন। কিন্তু রান্না করতে গিয়ে আমি ঘেঁটে ফেলেছিলাম। আসলে আমার মন ছিল না। তখন তো ওঁকে কোথাও নিয়ে যাওয়ার অবস্থা ছিল না। গজেন্দ্রনাথ মিত্র পুরস্কার, শরৎ স্মৃতি পুরস্কার ও কথাশিল্পী পুরস্কার — এ তিনটে পুরস্কার তিনি অসুস্থতার সময় পান, কিন্তু উপস্থিত থাকতে পারেন নি।
মৃত্যুর দু’দিন আগে, শেষ যেদিন সচেতন ছিলেন, আমাকে বলেছিলেন — আমার ভাইরা কিন্তু ছেলেমানুষ, তুমি আমার ভাইবোনদের দেখো। মানুষ নিজের ভাইবোনদের বলে যায় সন্তানকে দেখার জন্য, কিন্তু বাবা উল্টো রিকোয়েস্ট করলেন।
তারপর রাত বারোটা নাগাদ শ্বাসকষ্ট শুরু হলে বাবাকে আবার নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হয়। ক্রমশ ওঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ভোর সাড়ে চারটে পাঁচটার সময় আর কিছু করার ছিল না। আত্মীয়স্বজনদের যে কীভাবে খবর দিয়েছিলাম জানি না। আমার মাথা কাজ করছিল না। সকাল সাড়ে সাতটা আটটা নাগাদ ডাঃ ব্যানার্জী এলেন। ততক্ষণে বাবার গ্যাসপিং শুরু হয়ে গেছে। ওঁকে বললাম — আর বাবার চিকিৎসা করে লাভ নেই। আমি বাড়ি যাচ্ছি। আমি ছত্রিশ ঘণ্টার ওপর জেগে। আমার নিজেরও শান্ত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। ডাঃ ব্যানার্জি প্রচুর চেষ্টা করেছিলেন। ২৪-০৯-২০০১ তারিখে বেলা ১২-০৫ সময়ে বাবা মারা যান।
বাবার অসুস্থতার ডে- টু-ডে বর্ণনা আমি কোনোদিন দিতে পারব কিনা জানি না। এত বছর বাদে বলেই আজ বোধহয় আমি কথাগুলো বলতে পারলাম। অনেক চ্যানেল, যখন বাবা স্ব-মহিমায় নিজের জেদের সঙ্গে বেঁচে এসেছেন তখন বাবাকে নিয়ে কোনো অনুষ্ঠান করতে পারেননি, বাবার এই অসুস্থ অবস্থার ছবি তুলে রাখতে চেয়েছিলেন। আমি অন্তত অ্যালাউ করিনি। অসুস্থ বাবার ওই একটা বছর শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে কবি নজরুলের তো দেখাল না কার মতো দেখাল, তার পাশে স্ত্রী আর মেয়েরা স্থানুর মতো বসে আছে — এইসব ছবির কোনো মানে নেই, প্রয়োজনও নেই।
গল্পসরণি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
বিশেষ সংখ্যা।
একজন বহু বর্ণের মানুষ – সমীর চট্টোপাধ্যায়
তখন বোধহয় স্কুলে নাইন- টেনে পড়ি। সেই সময় দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ বেরোচ্ছিল। আমাদের স্কুলে ‘দেশ’ পত্রিকা রাখা হত। আমি পড়তাম। পড়ে সব বুঝেছিলাম তা নয়, তবে মনে হয়েছিল একটা নতুন ধরণের লেখা পড়ছি।
মৌলানা আজাদ কলেজে ভর্তি হই। পঞ্চাশের দশকের গল্পকার সত্যেন আচার্য ছিলেন আমাদের কলেজের লাইব্রেরিয়ান। তারপর একটা সাহিত্য পত্রিকা ‘সংক্রান্তি’ সম্পাদনা শুরু করলাম। নামটা সত্যেন্দ্র আচার্যই ঠিক করে দিয়েছিলেন। ৬-৭ টা সংখ্যা বের হওয়ার পর ‘সংক্রান্তি’ বন্ধ হয়ে যায়। সত্যেন্দ্র আচার্যই আমাকে দেশপ্রিয় পার্কের মোড়ে সুতৃপ্তির রবিবারের সাহিত্য আড্ডার কথা জানান। আমি সাহিত্যের আড্ডায় ঢোকা শুরু করলাম। সেখানে পবিত্র মুখোপাধ্যায়, তুষার চৌধুরি, অনন্য রায়, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, নারায়ণ মুখোপাধ্যায়, প্রভাত চৌধুরী প্রভৃতির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সেই সময় পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে অমর মিত্র, শচীন দাস, অসীম চক্রবর্তী, দীপঙ্কর দাস, অনন্ত দাস, মৃণাল বসুচৌধুরি — এমন অনেকে আসতেন। আমি তাঁর বাড়িতে যাওয়া শুরু করলাম। পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের বাড়িটাই হয়ে উঠল আমাদের সাহিত্যচর্চার জায়গা। ওখানে মানে সুতৃপ্তিতে বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমীর রক্ষিত, প্রলয় সেন, শংকর চট্টোপাধ্যায়, পুস্কর দাশগুপ্ত — এঁরা প্রতি রবিবারে আসতেন।
১৯৭৫ সাল হবে, একদিন দেখলাম ওখানে পেটানো বলিষ্ঠ স্বাস্থ্য, ভালো হাইট, অসম্ভব সুন্দর দেখতে, মাথায় কোঁকরানো চুল, তামাটে গায়ের রং, মোহময় আর স্বপ্নিল দুই চোখ, প্যান্ট ও হাফ সার্ট পরা একজনকে ঘিরে সমীর রক্ষিত, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়রা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি দারুণ দারুণ সব গল্প বলছেন আর সবাই হেসে কুটোপাটি হচ্ছেন।
তিনি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পেছনে একটু লাগলেন — শীর্ষেন্দু, তুমি তো আসলে লেখক। তোমার বই বিক্রি করে প্রকাশকদের লাভ হয়। আমার বই থেকেও প্রকাশকদের লাভ হয়, তবে ঠোঙা হিসাবে বিক্রি করে। আমি উশখুশ করছিলাম — এই ভদ্রলোক কে? নাম কি? একে তো আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। সবাই ওঁকে বলছেন — আরে তোমার কথা আলাদ, তোমার ব্যাপারই আলাদা। এখন কি কলকাতাতেই আছ, নাকি আবার ফিরে যাবে গ্রামে? পবিত্র মুখোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করতে, আমাকে ওর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি তখন বিস্ময়ে হাবুডুবু খাচ্ছি — এরকম সুন্দর সুপুরুষ একজন, যাকে দেখে আদৌ কোনো লেখক বলে মনে হচ্ছে না। ইনিই সেই শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়।
বললাম — আমি কিন্তু আপনার লেখা পড়েছি।
— তুমি আমার লেখা পড়েছ? কি লেখা পড়েছ?
— আমি আপনার ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ পড়েছি। এটা আমার খুব প্রিয় লেখা।
তখন বরেন গঙ্গোপাধ্যায় আর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বললেন — দেখলে, দেখলে শ্যামল তুমি বল তোমার লেখা নাকি কেউ পড়ে না। এই দেখ, একটি বাচ্চা ছেলে, সবে ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে, সে বলছে যে ‘কুবের …’ তার প্রিয় লেখা।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় বললেন — কি জানি, আমাকে তো কেউ লেখক বলে না। আমাকে অনেকে বক্সার বলে, কুস্তিগীর বলে, আবার অনেকে গুণ্ডা বলে। আমাকে কেউ লেখক বলে না। এই দেখছ আমার হাত — বালির বস্তায় ঘুষি মেরে মেরে হাতের এই সমস্ত জায়গা কালো হয়ে গেছে। বলে মুষ্টিবদ্ধ দুটো হাত আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।
আমি তখন হঠাৎ বললাম — হ্যাঁ, এই ভাবেই তো আপনার ‘কুবের …’ এর শুরু ‘বাঁ হাতখানা মেলে ধরল কুবের।’ প্রথম প্যারাটা আমি মুখস্থ বলে গেলাম।
তিনি চমকে গিয়ে একটু চুপ মেরে গেলেন। তারপর বললেন — তুমি তাহলে সত্যিই আমার বইটা পড়েছ। আচ্ছা।
এই হল শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তখন পরিবার নিয়ে প্রতাপাদিত্য রোডের বাড়িতে চলে এলেও, চম্পাহাটিতে ওঁর যাওয়া আসা ছিল। কিন্তু শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে আমি তখনো যাইনি।
১৯৭৬ সালের শেষাশেষি বা ১৯৭৭ সালের একদম প্রথম দিকে বিকেলে, কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের যে ব্রাঞ্চে তখন আমি কাজ করি, সেখানে পবিত্র মুখোপাধ্যায় উত্তেজিতভাবে চলে এলেন। বললেন, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় আনন্দবাজার ছেড়ে যুগান্তরে জয়েন করেছেন। অমৃতের দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি সকালেই পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে এসেছিলেন। বলেছেন— আমি অমৃত সম্পাদনা করব। তোর এখানে অনেক কবি, গল্পকার, লেখকরা আসে। তুই তাদের অমৃতে নিয়ে আয়। তারা যেমন কবিতা, গল্প, ফিচার লিখবে বা থিয়েটার, ফিল্ম রিভিউ করবে, তেমনি তারা উপন্যাস লেখার সুযোগও পাবে।
পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে অনেক আলোচনার পর আমরা অমৃতে যাতায়াত করতে শুরু করলাম। আমি, তুষার, অমর, পবিত্রদা, শচীন, প্রভাতদা, সঞ্জয় — আমরা কেউ ওর বাড়িতে গেলাম, কেউ অমৃতের দপ্তরে গিয়ে পরিচিত হলাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, তুমি কি লিখতে পারবে বল? অমর বলল — আমি গল্প লিখব। তুষার বলল — কবিতা লিখব। সঞ্জয় বলল — আমি ফিল্মটা ভালো বুঝি। প্রভাতদা বলল — আমি কবিতা, প্রবন্ধ আর ফিচার লিখি। গল্প লিখি না, তবে চেষ্টা করে দেখতে পারি। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় প্রভাতদাকে বললেন — তুই যাত্রা রিভিউ করবি। ওখানে প্রবোধবন্ধু অধিকারী আছে, তুই হবি আমাদের প্রভাতবন্ধু চৌধুরী। পবিত্রদাকে বললেন — তুই কবিতা লিখিস, কবিতার ব্যাপারটা দেখবি — কার কার কবিতা ছাপা হবে না হবে। আর প্রাণ খুলে কবিতা লিখবি। পবিত্রদা মাঝখানে ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন। তিনি পবিত্রদার ছবি দিয়ে অমৃতের মলাট করলেন। আমাকে বললেন — তুমি কবিতা লিখবি আর তোকে প্রতি সপ্তাহে ফিচার লেখার জন্য একটা পাতা দিলাম। যা তোর মানে আছে ফিচার লিখবি। উনি আমার রামকিঙ্কর বেজকে নিয়ে একটা বড়ো লেখা নববর্ষ বিশেষ সংখ্যায় আর ‘হেমন্ত হেমন্তকুমার’ নামে একটা বিশাল লেখা অমৃত ছাপলেন। আসলে আমাদের যার মধ্যে যা যা ছিল, যে যা লিখতে পারতাম, শ্যামলবাবু বুঝতে পারতেন আর সেই লেখাটা লিখিয়ে নিতেন। শৈবাল মিত্রের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও অভিজ্ঞতা ছিল। শৈবালকে নিয়ে তিনি গল্প আর ধারাবাহিক উপন্যাস ‘তরণী পাহাড়ে বসন্ত’ লেখালেন। অমর মিত্র গল্প লেখার সঙ্গে সঙ্গে ধারাবাহিক উপন্যাস ‘পাহাড়ের মত মানুষ’ লিখল। প্রভাত চৌধুরীকে দিয়ে তিন চারটে সংখ্যায় ধারাবাহিক উপন্যাস ‘সতী সাবিত্রি কথা’ লেখালেন। সেই সময় নকশালপন্থী শ্যামল রায় মিসায় জেল খেটে ফেরৎ এল। শ্যামল ‘মিসা-৭৩’ নামে জেলের জীবন নিয়ে ধারাবাহিক লিখল। তুষার চৌধুরির মতো বেসিক কবিকে দিয়েও তিনি দু’তিনটে গল্প লেখালেন।
আমরা যেমন লিখছি, পাশাপাশি গজেন্দ্রকুমার মিত্র ‘আদি আছে অন্ত নেই’, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ‘সোনার হরিণ নেই’ লিখছেন। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় একটা বিখ্যাত উপন্যাস লিখলেন ‘ঈশ্বরের বাগান’। বরেন গঙ্গোপাধ্যায় ‘বনবিবির উপাখ্যান’, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ‘হাওয়া গাড়ি’ ধারাবাহিক লিখলেন। এ ছাড়া মহাশ্বেতা দেবী, প্রফুল্ল রায়, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, অসীম চক্রবর্তী, শচীন দাস — সকলেই লিখছেন। মহাশ্বেতা দেবী বয়সে ১০-১২ বছরের বড়ো, ওঁকে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় খুবই শ্রদ্ধা করতেন।
সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রচ্ছদ কাহিনি কনসেপ্টটা তিনি প্রথম চালু করেন। এটা আজকে ‘দেশ’ পত্রিকার একটা কনসেপ্ট হয়ে উঠেছে। উনি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সিনেমা বা ম্যাক্সিম গোর্কিকে নিয়ে কভার স্টোরি করেছেন। আবার তামিল, তেলেগু, উর্দু, হিন্দি, অসমীয়া ইত্যাদি ভারতীয় ভাষায় ১২-১৪ টি গল্পের বঙ্গানুবাদ নিয়ে অমৃত সাপ্তাহিকের এক একটা সংখ্যা করেছেন।
যে কারণেই অমৃত বন্ধ হয়ে থাকুক না কেন, ‘অমৃত’কে কেন্দ্র করে নতুন লেখকদের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিল। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় সারা জীবন বলেছেন — তোদের সঙ্গে আমার লেখকের সঙ্গে লেখকের সম্পর্ক। ফলে তোরা আমার কাছে লেখকের মত মর্যাদা পাবি, সেই সঙ্গে লেখকের মতো মর্যাদাবান হওয়ার চেষ্টা করবি। কেননা লেখকদের মর্যাদাবান হতে হয়। পরবর্তী সময়ে, যখন উনি সম্পাদক নন, তখনও ওঁর হাঁটুর বয়সী যে সব লেখক, যেমন কিন্নর রায় বা অরিন্দম বসু ওঁর কাছে এসেছে, ওদের লেখায় উৎসাহ দেওয়া, লেখা সংশোধন করে দেওয়া থেকে শুরু করে লেখা ছাপানোর ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন। তিনি লেখকদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতেন।
অমৃত বন্ধ হয়ে গেলেও যারা লেখার তারা তো লিখছে। তারা লেখক হয়ে গেছে। পবিত্র মুখোপাধ্যায়, প্রভাত চৌধুরী, অমর মিত্র, শচীন দাস, দীপঙ্কর দাস, তুষার চৌধুরী, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায় আরও অনেকে — এদের কে বলবে অকবি বা অলেখক?
সত্তর দশকের দশ বারোজন কবিদের ছবি সহ অমৃতের একটি বিশেষ সংখ্যায় তিনি ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছিলেন। আর ছিল কবিদের লেখা দশটি প্রশ্নের উত্তরমালা। এদের মধ্যে কেউ কেউ এখন কবিতা লেখে না। অনন্য রায় মারা গেছে। কিন্তু জয় গোস্বামী, তুষার চৌধুরী, রণজিৎ দাশ, মৃদুল দাসগুপ্ত — এরা তো এখন প্রতিষ্ঠিত কবি। অমৃত পত্রিকার মাধ্যমে এরা লাইম লাইটে এসেছিল। এর এখন স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, স্বনামে উচ্চারিত ও সম্মানিত। আমি বলব এটা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা অ্যাচিভমেন্ট। ‘সময় বড়ো বলবান’ গ্রন্থে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ভগীরথ মিশ্র, কিন্নর রায়, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, দীপঙ্কর দাস, নলিনী বেরা, অমর মিত্র —তিনি অন্তত পরবর্তী প্রজন্মের কয়েকজন লেখকের লেখার দ্বারা উন্মুক্ত করতে পেরেছেন। এরা প্রত্যেকেই এখন বাংলা সাহিত্যের স্বীকৃত লেখক।
কবিতা লিখতে পারতেন না বলে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের অদ্ভুত একটা কুন্ঠা ছিল। কিন্ত তিনি নিয়মিত কবিতা পড়তেন, বোঝার চেষ্টা করতেন। জীবনানন্দ দাশকে তিনি দেখেছেন, মিশেছেন, কথা বলেছেন। জীবননানন্দ দাস সম্পর্কে ওঁর অগাধ শ্রদ্ধা ও বিস্ময় ছিল। ধ্রুপদী সঙ্গীত শুনতে অসম্ভব ভালোবাসতেন। একদিকে ফৈয়াজ খাঁ, আব্দুল করিম খাঁ, বড়ে গোলাম আলি বা গোলাম আলি বা বেগম আখতার বাজছে আর উনি গম্ভীর হয়ে বসে লিখছেন। প্রশ্ন করতাম — এ রকম একটা অসাধারণ গান বাজছে, আর আপনি লিখছেন। ডিস্টার্বড হচ্ছেন না? বলতেন — তুই বুঝতে পারছিস না। আমার মতো একজন নগণ্য বাংলা সাহিত্যের লেখক বসে বসে লিখছি আর ফৈয়াজ খাঁ গান গাইছেন। রামকেলি বা দেশ রাগে লেখালিখিতেও প্রচুর গানের ব্যাপার আছে। ওঁর আর একটা দুঃখ ছিল যে উনি গান গাইতে পারেন না।
তিনি আনন্দবাজারের চাকরি ছেড়েছেন, যুগান্তর -অমৃত বন্ধ হয়ে গেছে। এতে তিনি হয়তো দুঃখ পেয়েছেন, কিন্তু তাঁর অতীত, তাঁর দুঃখ তাঁর কাজে বা জীবনযাপনে প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠেনি। তিনি একেক রকমভাবে জীবনযাপন করতেন। একেকটি প্রকল্প, চিন্তা বা ভাবনা মাথায় নিয়ে, জীবনযাপনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত করে চলতেন। এর পরেও তিনি নবোদ্যমে লেখালেখি করেছেন এবং ক্রমাগত ভালো লেখা লিখেছেন। হা-হুতাশে ওঁর বিশ্বাস ছিল না। সবসময় একটা কিছু গড়ে তোলায় বিশ্বাস করতেন। চম্পাহাটি পর্ব, অমৃত পর্ব, গাড়ি কেনা- বেচা, বাড়ি বানানো — এগুলো ওঁর এক একটি গড়ে তোলা। গো-পালন, চাষবাস — এসব ওঁর সারাজীবন জুড়ে গনে তোলার ইতিহাস। সব ওঁর সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছে। আর বাড়ি বদলানো ছিল ওনার এক ধরণের খেলা। যে জায়গাটার মিশন বা প্রকল্প শেষ হয়ে গেছে, সেখানে আর থাকার কোনো মানে নেই, কোনো রহস্য নেই। তিনি নিজের মতো করে উপন্যাস লিখতেন, নিজের লেখা লিখতেন, সেই উপন্যাস নবকল্লোল ছাপা হয়েছে। যখন তিনি আজকালে ‘ভাস্কো দা গামার ভাইপো’ ধারাবাহিক লিখছেন, তখনো আজকালে জয়েন করেননি — ফ্রি ল্যান্স লিখেছেন। সেই লেখা দিয়েই সংসার চলছে। লেখা থেকে সরে আসেননি।
জুবিলি পার্কে বাড়ি শিফট করার পনেরো দিনের মাথায় পড়ে গিয়ে ওঁর গোড়ালি ভাঙে। সেই সময় এলাহাবাদের মিত্র পাবলিকেশন কলকাতায় এলেন। ওর ‘মনোরমা’ আর ‘আলোকপাত’ নামে কাগজ বের করলেন। আলোকপাতে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় একটা আত্মজীবনীমূলক লেখা লিখবেন, পরে সেটা ‘জীবনরহস্য’ নামে বই হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। ওঁর ‘ঈশ্বরীতলার রূপোকথা’ ‘হিম পড়ে এল’, ‘স্বর্গের আগের স্টেশন’, বা ‘একদা ঘাতক’ — এর (তখন ‘সামনে সমুদ্র’ নামে বেরিয়েছিল) মত অসাধারণ সমস্ত লেখা যখন নবকল্লোলে বেরোচ্ছে, তখন আমরা, ওনার অতি আধুনিক অতি উন্নাসিক তরুণতম বন্ধুরা, বলতাম — এই সব লেখা আপনি কেন নবকল্লোলে দিচ্ছেন? যদিও তখন নবকল্লোলের সার্কুলেশন সবার চেয়ে বেশি ছিল। উনি বলতেন— আমি যে লেখাটা লিখেছি সেই লেখাটা কী লেখা হয়েছে? সেটা আগে বল। তোরা কি বলতে পারিস ‘পথের পাঁচালি’, ‘অনুবর্তন’, ‘ইছামতি’ বা ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ কোথায় বেরিয়েছিল? এগুলো তোরা তো বই হওয়ার পর পড়েছিস। আমার লেখা কোন কাগজে বেরোলে এটা কোনো ব্যাপার নয়। দেশ পত্রিকা আমার লেখা ছাপাচ্ছে না, আবার কবে আমার লেখা ছাপবে তবে আমি কলম ধরব — আমি সে বান্দা নই। আমার কাজ লেখা। তারপর কোনো একটা পত্রিকায় প্রকাশ করা। না হলে সোজা পাবলিশারের কাছে গিয়ে বই হিসেবে বের করা। কারণ আমার প্রথম দুটো বই ‘বৃহন্নলা’ আর ‘অনিলের পুতুল’ পাণ্ডুলিপি থেকে বই হিসেবে বেরিয়েছিল। মধুসূদন মজুমদার আমাকে অসম্ভব ভালোবাসেন, স্নেহ করেন। সেখান থেকে আমি টাকা পয়সা পাই। আমার সংসারটা তাতে উপকৃত হয়। ফলে ‘নবকল্লোল’, কি ‘দেশ’ — এ নিয়ে আমার কোনো অহমিকা নেই, পীড়াও নেই। আমার কথা হল আমার লেখাটা হল কি হল না।
তিনি বলতেন —আমি যত অপমানিত হই, যত কোণঠাসা হয়ে পড়ি, আমার তত জেদ বাড়ে। যত জেদ বাড়ে, রাগ বাড়ে, তত আমার লেখা ভালো হয়। আমাকে ব্যক্তি মানুষ হিসাবে কে পছন্দ করল না করল তাতে আমার কিচ্ছুটি যায় আসে না। কেননা অনন্ত কাল বাঁচবার জন্যে আমি পৃথিবীতে আসিনি। আমি যদি পাঁচটি উপন্যাস আর পঁচিশটি গল্প ঠিকঠাক লিখি, তাহলে ঐ লেখাগুলোই আমাকে বাংলা সাহিত্যে ঠাঁই দেবে, বাংলা সাহিত্যের পাঠক আমাকে মনে রাখবে।
আমরাও, যারা ওঁর অনুরাগী, বিশ্বাস করি, একজন শিল্পী বা লেখকের এটাই প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত যে, আমি আমার শিল্প বা লেখার কাছেই দায়বদ্ধ।
আজকাল তিনি যখন ‘ভাস্কো দা গামার ভাইপো’ উপন্যাসটা লিখেছেন, তখন যুগান্তর বন্ধ এবং উনি সম্পূর্ণ বেকার। তারপর ওখানে তিনি রবিবারের পাতায় ধারাবাহিকভাবে ‘মহাজীবন’ নামে বিখ্যাত লেখাটা লিখেছিলেন। কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত আমাকে অনেকবার বলেছিলেন — আমি যত বার ‘মহাজীবন’ পড়ি বিস্মিত হয়ে যাই। শ্যামলের তো এই কোলিয়ারি জীবন, তার প্রেক্ষাপট জানার কথা নয়। ও কি করে এই লেখাটা লিখব! লেখার ভিতরে কল্পনা আর বাস্তব ও অতিবাস্তবের মধ্যে একটা অদ্ভুত যাতায়াত আছে।
পরে তিনি আজকালে যুক্ত হন। হয়ত একটা মাসিক বেতন পেতেন। যে সমস্ত লেখা আলাদা লিখতেন, তার জন্যেও হয়ত কিছু আলাদা টাকা-পয়সা পেতেন। আজকালে তিনি অনেক গল্প, বিভিন্ন ধরণের ফিচার লিখেছেন। প্রতিটি শারদীয় সংখ্যায় উপন্যাস লিখেছেন। প্রতিটি শারদীয় সংখ্যায় উপন্যাস লিখেছেন। তারপর বিখ্যাততম ‘বাজার সফর’ লিখেছেন। আজকালে তিনি খুব সম্মানের সঙ্গে ছিলেন। সব সময় বলতেন — আজকালকে আমার নিজের বাড়ির মতন লাগে। অল্প বয়সী ছেলে ওখানে চাকরি করে। তারা আমাকে সানন্দে গ্রহণ করে, আমার সঙ্গে তারা মিশতে ভালোবাসে। আমি তাদের সঙ্গে মিশতে ভালোবাসি। আজকালে আমি অনেক কমফর্ট ফিল করি। আজকালের সম্পাদক অশোক দাশগুপ্ত ওঁর থেকে বয়সে অনেক ছোটো। কিন্তু শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ওকে সম্পাদক হিসেব সমীহ করতেন। আবার অশোক দাশগুপ্তও শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে যেমন লেখক হিসেবে অপরিসীম শ্রদ্ধা করতেন, মানুষ হিসেবেও ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন। অশোক দাশগুপ্ত সম্পর্কে ওঁর কেথায় যেন একটা দুর্বলতা ছিল, স্নেহমিশ্রিত একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু তিনি বলতেন — দেখ, অশোক তো সম্পাদক। সম্পাদক ছাড়া আমি ওর সঙ্গে কোনো ভাবে মেশার চেষ্টা করি না। সব সময় উনি এই পজিশনের ব্যাপারটা মানতেন।
আমার কাছে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় একটা অফুরন্ত বিস্ময়ের খনি। লেখক হিসেবে এবং মানুষ হিসেবেও। আমি লেখক হিসেবে ওঁকে কোনো বয়ামবন্দী করতে পারি না। তিনি গ্রামের না শহরের লেখক? তিনি কি আধুনিক, অত্যাধুনিক বা থার্ড লিটারেচারে লেখক? তিনি কি পঞ্চাশের দশকের লেখক? এরকমভাবে ওঁকে বয়ামবন্দী করা যায় না। তেমনি মানুষ হিসাবে ওঁকে আরোই বয়ামবন্দী করা যায় না। তিনি কি স্নেহপ্রবণ? অতিথিবৎসল? ভীষণ পরোপকারী? তিনি কি ত্রুদ্ধ বা পরশ্রীকাতর? বিবাগী বা বৈরাগী মানুষ? ওঁকে এ রকম কোনো লেবেল এঁটে দিতে পারি না। প্রতিটি মানুষই মোটামুটি একটা বয়ামবন্দী মানুষ। সে অনেক প্রতিভাবান মানুষও। ওঁকে আমার কখনো মনে হয়েছে অত্যন্ত স্নেহবৎসল, আবার কখনো মনে হয়েছে ভীষণ পাষণ্ড বা হঠাৎ রাগের মানুষ। কখনো মনে হয়েছে তিনি এত নিস্পৃহ, নিরুত্তাপ, নিস্তেজ, নৈর্ব্যক্তিক কেন? আবার কখনো মনে হয়েছে এত অবগাহন করছেন কেন? এত ইনভলভ হয়ে পড়ছেন কেন? এটা তো বাঞ্ছনীয় নয়। ওঁর চরিত্রে যেমন নিস্পৃহতা ছিল, তেমনি অতিরিক্ততাও ছিল। এত বিচিত্র স্বভাবের, বিচিত্র মনের মানুষ আমি আমার জীবনে দেখিনি।
আমি ওঁর কাছ থেকে দুটো জিনিস পেয়েছি। এক, তোমার কাজটা এক তোমাক করে যেতে হবে। দুই, কোনো মানুষকে তুমি একবগ্গা বিচার করবে না। প্রতিটি মানুষ এক একটি অনন্ত খনি। তার মধ্যে ভালত্ব-মন্দত্ব দুই-ই আছে। কোনো বদ্ধমূল ধারণা না নিয়ে খোলা মনে মানুষের সঙ্গে মিশলে দেখবে সেই মানুষটার কাছ থেকে কিছু না কিছু বিস্মিত হওয়ার মত উপাদান পাচ্ছ। তারা তোমাকে জীবন সম্পর্কে অনেক রসিক করে তুলবে। আর একটা জিনিস যেটা দেখেছি — সেটা হিউমার বোধ। এখন হিউমার বোধসম্পন্ন মানুষ আমি আর দেখিনি। চরম গাম্ভীর্যের, চরম বিমর্ষ গল্পেও তিনি কোথায় যেন একটা হিউমারের ছোঁয়া লাগিয়ে দিয়ে চলে যান। জীবনের ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়েও তিনি হাসতে জানতেন। এই ব্যাপারটা ওঁরা লেখাতে আছে, ওঁর জীবনযাপনেও ছিল।
একটি স্মরণসভায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন — আমাদের অনেকের অনেক কিছু আছে, যা হয়ত শ্যামলেরও আছে। শ্যামলের লেখায় অনেক কিছু উপাদান হয়ত আমাদের লেখাতেও আছে। কিন্তু শ্যামলের একটা জিনিস আমরা অনেকেই আয়ত্ব করতে পারিনি, সেটা হচ্ছে ওর সেনস অফ হিউমার। আমরা ওর এই লেভেলটা স্পর্শ করতে পারিনি।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় সব সময় বলতেন — শিল্পের প্রধান শর্ত হচ্ছে সংশয়। সমর্পণ নয়। বিশ্বাস নয়। একটা প্রবল বিশ্বাস নিয়ে সারাজীবন চলতে গেলে, জীবনের অনেক কিছু হারিয়ে যায়। জীবনের অনেক রহস্য হাত থেকে ফস্কে যায়। সে ধর্মীয় বিশ্বাস হোক আর রাজনৈতিক বিশ্বাসই হোক। তিনি একটাই ধর্মে বিশ্বাস করতেন, সেটা হল মানবধর্ম।
গল্পসরণি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
বিশেষ সংখ্যা ২০০৯