নিউ হোপ ডায়ামন্ড

নিউ হোপ ডায়মন্ড 

শনিবার ঘুম থেকে উঠেই শুনি একেনবাবু আর প্রমথর মধ্যে তর্কাতর্কি চলছে। প্রতিদিনই একটা না একটা কিছু নিয়ে ওদের লাগে। আজ প্রাচুর্যের সঙ্গে সুখের সম্পর্ক নিয়ে। একেনবাবুর বক্তব্য টাকা না থাকলে সুখী হওয়া যায় না। 

প্রমথ মানবে না। “সুখী-অসুখী হওয়া নির্ভর করে অ্যাটিচুডের ওপর। একটা বাচ্চাকে ঘর-ভরতি খেলনা দেওয়া হল। এক ঘণ্টা যেতে না যেতেই তার কান্না, কারণ খেলনাগুলো পুরোনো হয়ে গেছে। অন্য একটি ছেলেকে রাখা হল একটা ঘরে, যেখানে শুধু পাহাড় পরিমাণে হর্স-শিট মানে ঘোড়ার গোবর। সে ছেলেটা কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরমানন্দে গোবর ঘেঁটে যাচ্ছে… কেন?”

“জানি না, স্যার।”

“কারণ ও সেই টাট্টু ঘোড়াটাকে খুঁজছে, যে ঘর নোংরা করে তার ভেতর লুকিয়ে বসে আছে!”

“এটা ভালো বলেছেন, স্যার!”

.

সকালে কফি খাব কী, বাড়িতে দুধ নেই! প্রমথর দুধ আনার কথা ছিল গতকাল। বিরক্ত হয়ে বললাম, “ফালতু তর্কাতর্কি না করে দুধটা তো কিনে আনতে পারতিস?”

“তুই তো তর্কাতর্কি করছিস না, তুই যা।” অম্লানবদনে প্রমথর উত্তর।

একেনবাবু দেখলাম দুধের অপেক্ষায় না থেকে, ব্ল্যাক কফি নিয়ে বসেছেন।

“এরকম তেতো কফি, দুধ ছাড়া গলা দিয়ে নামছে কী করে?”

“কেন স্যার, এই তো পাঁউরুটিতে পিনাট বাটার দিয়ে খাচ্ছি।”

‘পিনাট বাটার’ হচ্ছে চিনেবাদাম-এর মাখন। নিউ ইয়র্কে আসার আগে বস্তুটা যে কী, সেটাই জানতাম না। অতি বাজে লাগে আমার, কিন্তু একেনবাবু ওতেই অমৃত আবিষ্কার করেছেন। বলতে যাচ্ছিলাম, ‘আপনি তো পিনাট বাটার দিয়ে বিষও খেতে পারেন,’ তার আগেই ফোন বাজল। 

“হ্যালো।”

“কী করছিস তুই?” বেন্টুমাসির গলা। উত্তর দেবার আগেই দ্বিতীয় প্রশ্ন, “হ্যাঁরে, একেন আছে?”

“এই তো পাশেই,” বলে দ্রুত ফোনটা একেনবাবুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে কিচেনে গেলাম টি-ব্যাগের খোঁজ করতে। দুধ-ছাড়া চা তবু খাওয়া চলে। 

বাইরের ঘর থেকে একেনবাবুর গলা ভেসে আসছে। ‘তাই নাকি, ম্যাডাম… সরি, সরি, মাসিমা… কবে ঘটল? … আজকে? …নিশ্চয়, আমি ওঁদেরও বলছি, ‘ ইত্যাদি। 

মাইক্রোওয়েভে জল গরম করে তাতে টি-ব্যাগ ফেলে কিচেন থেকে যখন বেরোলাম, প্রমথ নেই বোধহয় বাথরুমে। একেনবাবু একা, হাতে কফি, সামনে নিউ ইয়র্ক টাইমস, মুখটা বিমর্ষ। 

“মাসিমা তলব করেছেন স্যার।” আমাকে জানালেন। 

“তলব করলেই তো চলবে না, কারণ?” আমার বিরক্তি তখনও যায়নি। 

“ওঁর পরিচিত কারোর দামি একটা হিরে হারিয়ে গেছে।”

“আংটি না দুল?” হিরে শুনলে ও দুটোই প্রথম মনে পড়ে। 

“না স্যার, বললেন লুজ হিরে।”

“লু-জ হিরে? কী বলছেন যা-তা! শুনেছেন ঠিক?”

“তাই তো বললেন স্যার… আসলে একটু উত্তেজিত ছিলেন, পুরোটা বুঝিনি। বললেন তাড়াতাড়ি চলে আসতে।”

.

বেন্টুমাসি সব সময়েই উত্তেজিত। সত্যি কথা বলতে কী, ওঁকে আমি প্রাণপণ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। আগেও একটা কাহিনিতে বেন্টুমাসি সম্পর্কে লিখেছি, বার বার গুরুজনদের অসম্মান করতে চাই না। আমার দূর সম্পর্কের মাসি হলেও মহিলা হিসেবে খুবই ডেঞ্জারাস। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে প্রশ্ন আর হুকুমের পর হুকুম দিয়ে জীবন দুর্বিষহ করার অপরিসীম ক্ষমতা ওঁর আছে। কয়েক বছর আগে ছেলের কাছে বেড়াতে এসে সবাইকে জ্বালিয়ে মেরেছিলেন। এবারও এসে এর মধ্যেই ফোন করেছেন বেশ কয়েক বার। টালবাহানা করে এখনও যাইনি। 

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শ্যামলদার ফোন। ধরতেই বললেন, “হ্যাঁরে বাপি, তোরা দুপুরে চলে আয়। এখানে লাঞ্চ খেয়ে যাবি, আর মা’র সমস্যার সমাধান করবি।”

“কী ব্যাপার? কার নাকি হিরে হারিয়েছে?”

“আগে আয় তো, তারপর শুনবি।” শ্যামলদা ব্যাপারটা বিশদ করতে চাইল না। “রিনা তোদের জন্য সরষে দিয়ে ইলিশ রান্না করছে।”

ইলিশ আমার খুবই প্রিয়। বাংলাদেশের পদ্মার ইলিশ আগে শুধু জ্যাকসন হাইটস-এ মিলত, এখন নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সির নানান দোকানে পাওয়া যাচ্ছে। মানছি, ফ্রোজেন ইলিশের স্বাদ আলাদা, টাটকা ইলিশের মতো নয়। কিন্তু রিনাবউদি সেটাই অল্প একটু ভেজে এমন রাঁধেন, হেভেন্‌লি! 

.

আমাদের বেরোতে একটু দেরিই হল। হোয়াইট প্লেইন্‌স-এ শ্যামলদার বাড়িতে যখন পৌঁছোলাম, তখন দুপুর প্রায় বারোটা। বেন্টুমাসি ওঁর বিশাল বপু নিয়ে বাইরের ঘরে গদিওয়ালা ‘লেজি-বয়’ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। 

প্রথম প্রশ্ন, “এত দেরি করলি কেন?”

প্রমথই একমাত্র বেন্টুমাসির সঙ্গে লড়াই করতে পারে। বলল, “আমরা কি তোমার প্রতিবেশী? ম্যানহাটান থেকে এখানে আসতে কতক্ষণ লাগে জানো?”

“তুই চুপ কর, তুই তো গাড়িও চালাস না।” বেন্টুমাসি প্রমথকে দেখেছে সেই হাফ প্যান্ট পরা অবস্থা থেকে। ওঁর বাক্যবাণ থেকে প্রমথও নিস্তার পায় না। 

“শ্যামল, চেয়ারটা সোজা করে দে তো!”

শ্যামলদা চেয়ারের পেছনটা সোজা করে দিতেই বেন্টুমাসি বললেন, “ঘাড় ঘুরিয়ে কথা বলতে পারি না আজকাল। একেন, তুমি সামনে এসে বসো।”

একেনবাবু যখন সুবোধ বালকের মতো সামনের দিকে এগোচ্ছেন, আমি চেষ্টা করলাম কেটে পড়ে রান্নাঘরের দিকে যাবার। 

“অ্যাই, তুই কোথায় যাচ্ছিস?”

“দেখছি, রিনাবউদির কোনো সাহায্য যদি লাগে।”

“কিচ্ছু লাগবে না, এখানে বস,” বলে পাশে একটা চেয়ার দেখালেন। “প্ৰমথ তুইও বস, সবারই শোনা দরকার।”

 আমরা বসতেই একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি মন্টু ঘোষকে চেনো তো?”

মন্টু ঘোষ ম্যানহাটান ছেড়ে হোয়াইট প্লেইন্‌স-এ এসেছেন বেশ কয়েক বছর হল। আমরা চিনি, একেনবাবুর চেনার কথা নয়। 

“চিনি কি স্যার?” একেনবাবু আমার আর প্রমথর দিকে তাকালেন। 

“না চিনলেও চলবে, কাছেই থাকে। দুটো রাস্তা পার হলেই ওর বাড়ি। বেচারার দোকান থেকে ভীষণ দামি একটা হিরে চুরি হয়ে গেছে।”

“ভীষণ দামি’ কথাটা তোমাকে কে বলল, দোকানদাররা সব সময়েই বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে।” কথাটা বলতেই প্রমথ ধমক খেল। “চুপ কর তুই, মন্টু সেরকম ছেলেই নয়!”

একেনবাবুকে দেখে বুঝতে পারছিলাম উনি একটা স্টেট অফ কনফিউশনের মধ্যে আছেন… কে মন্টু, কোন দোকান, দোকানে হিরেটা ছিল কেন, ইত্যাদি নিয়ে। ইতিমধ্যে ট্রে-তে আমাদের জন্য তিন গ্লাস কোক নিয়ে শ্যামলদা এল। 

“দাঁড়াও মা, দাঁড়াও, ব্যাপারটা একেনবাবুকে বুঝিয়ে দিই। যার কথা মা বলছে, মন্টু ঘোষ, সে গত বছর আমাদের এই হোয়াইট প্লেইন্‌স-এ একটা গয়নার দোকান খুলেছে।”

“মন্টুবাবু? যিনি ইঞ্জিনিয়ার?” আমি অবাক হয়ে বললাম। 

“ঠিক ধরেছিস। বছর খানেক আগে মন্টুর চাকরি যায়। বাজার মন্দা বলে চাকরি পাচ্ছিল না। 

“তাই বলে গয়নার দোকান খুলে ফেললেন! কী জানেন উনি গয়নার?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল। 

“গড়িয়াহাটে মন্টুর শ্বশুরের গয়নার দোকান আছে। ও না জানুক, ওর বউ ব্যাবসার অনেক কিছু জানে। ওসব কথা বাদ দে, ওদের দোকান থেকে একটা দামি হিরে অদৃশ্য হয়েছে, মা তাই নিয়ে খুব চিন্তিত। এবার বলো মা, যা বলার।”

বেন্টুমাসি অপ্রসন্ন মুখে বললেন, “নতুন যে কী কথা বললি, বুঝলাম না। যাক গে, যা বলছিলাম… একেন, সেই হিরেটা তোমাকে উদ্ধার করতে হবে।”

“কবে চুরিটা হল, ম্যাডাম?”

“আবার ম্যাডাম?”

“সরি ম্যাডাম, মানে মাসিমা।”

“চুরি হয়েছে কাল রাত্রে, কিন্তু উদ্ধার করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। বিয়ের আংটিতে বসবে, বায়না হয়ে আছে। বিক্রি হবার কথা এই শনিবার।”

“পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে?” একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন। 

“পুলিশের কথা ছাড়ো, ওদের কেরামতি জানা আছে! দায়িত্ব তোমার… মন্টুকে আমি দুটো নাগাদ আসতে বলেছি। যা জানার ওর কাছ থেকে জেনে নিয়ো।”

প্রমথ আর আমি চোখাচোখি করলাম। বেন্টুমাসির মিলিটারি জেনারেল হওয়া উচিত ছিল। 

.

খেতে ডাক পড়ায় এ নিয়ে আর কথা হল না। বেন্টুমাসি খাবেন নিরামিষ, অন্য ঘরে আলাদা ব্যবস্থা। খেয়ে-দেয়ে ঘণ্টা খানেক ঘুমোবেন। ০খানিকক্ষণের জন্য হলেও নিশ্চিন্তি। 

দুটো বেজে কয়েক মিনিট হতে না হতেই তপন এল। তপন একসময়ে ট্র্যাভেল এজেন্সিতে কাজ করত। আমাদের থেকে ছোটো, অতি বাচাল। 

এসেই শ্যামলদাকে বলল, “মন্টুদা আধ ঘণ্টার মধ্যে আসছে। আমাকে পাঠিয়ে দিল, হিরে চুরি নিয়ে প্রশ্ন-টশ্ন থাকলে উত্তর দিতে পারব।” তারপর আমাকে আর প্রমথকে দেখে বলল, “আরে, এই যে বাপিদা আর প্রমথদা, কী খবর?”

“তোমার খবর কী? তুমি যে গয়নার দোকানে কাজ করছ, সেটাই তো জানতাম না!”

“সেলস ম্যানেজার।” সগর্বে বলল তপন। 

“কনগ্র্যাচুলেশনস!” আমরা দু-জন প্রায় একসঙ্গেই বলে উঠলাম। শ্যামলদা একেনবাবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই তপন বলল, “আরে, আপনাকে তো গতকাল হইচই টিভি-তে দেখলাম। এক্কেবারে অন্যরকম চেহারা।”

 “কী আর করব স্যার, আমাকে তো আর পার্টটা দিল না। তবে ভালোই হয়েছে, আমার আবার ক্যামেরার সামনে মুখ খোলে না।”

এই রেফারেন্সটা যাঁরা বুঝবেন না তাঁদের বলি, ‘হইচই’ টিভি-তে একেনবাবুর মুনস্টোন মিস্ট্রি নিয়ে ক’দিন আগে একটা শো দেখানো হয়েছে। তাতে একেনবাবু যিনি সেজেছেন, তাঁর চেহারার সঙ্গে একেনবাবুর কোনো মিলই নেই। 

“আপনার কাজ তো মুখের নয়, মাথার।” বলেই হ্যা হ্যা করে হাসল তপন। “আসলে মন্টুদা যখন আপনার কথা বললেন, তখন ওই চেহারাটাই মাথার মধ্যে ঘুরছিল, তাই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। যাই হোক, আপনি যখন ফিল্ডে নেমেছেন আমাদের কোনো চিন্তা নেই।”

“কী যে বলেন স্যার! তবে কিনা, ব্যাপারটা সম্পর্কে কিছুই এখনও জানি না। শুধু জানি একটা হিরে অদৃশ্য হয়েছে, আর সেটা খুব দামি।”

“দামি বলে দামি। আমাদের খুঁটির জোর নেই, ঠিকমতো প্রমোট করতে পারলে এই হিরের দাম অন্তত হাফ এ মিলিয়ন।”

“পাঁচশো হাজার ডলার! বলেন কী স্যার, আপনারা এত দামি হিরে স্টক-এ রাখেন?”

উত্তরে তপন যা বলল, তার থেকে বুঝলাম মন্টুবাবুর গয়নার দোকান সম্পর্কে শ্যামলদা প্রায় কিছুই জানে না। মন্টুবাবুর শ্বশুরের গয়নার দোকান থাকতে পারে, কিন্তু মন্টুবাবুর দোকান হল ‘নিউ গীতাঞ্জলি’-র একটা ফ্র্যাঞ্চাইজ। নিউ গীতাঞ্জলি বছরে অন্তত হাজার কোটি টাকার ব্যাবসা করে। তপনের ‘খুঁটির জোর নেই” বলার অর্থ, ডায়মন্ড মার্কেটের রাঘব বোয়াল ডি বিয়ার্স বা অ্যালরোজার মতো খুঁটি নেই… সবই আপেক্ষিক। 

“হিরেটার কোনো ছবি আছে স্যার? এসব দেখলেও তো চোখ সার্থক।”

“নিশ্চয় আছে, এই দেখুন।” বলে পকেট থেকে যে ছবিটা বার করল, সেটা মোটেই হিরের ছবি নয়, একটা ফুলের ছবি। 

“এটা?” একেনবাবু অবাক। 

“ওই যাঃ, আসার আগে হিরের ছবিটা দিতে বললাম, কী যে উলটোপালটা দিল সেলসের মেয়েটা, খেয়ালও করিনি! তবে দাঁড়ান, আমার আইফোনে আছে।” বলে আইফোন থেকে খুঁজে বার করে দেখাল ছবি। 

গাঢ় বেগুনি ভেলভেটের ওপর ঝকঝকে পিয়ার-শেপড হিরের এনলার্জ করা 

“দারুণ দেখতে স্যার, এটা দিয়েই আংটি বানানোর কথা ছিল?”

“আংটি কেন বানানো হবে?” তপন বিস্মিত। 

“মাসিমা যে বললেন বিয়ের আংটিতে হিরেটা বসানো হবে?”

“আরে না, সেটা অন্য হিরে, মাসিমা গুলিয়ে ফেলেছেন!” বলেই তপন ঘাবড়াল! এদিক-ওদিক তাকিয়ে শ্যামলদাকে জিজ্ঞেস করল, “মাসিমা কোথায়?”

“ভাবিস না, মা ঘুমোচ্ছে।”

“বাঁচিয়েছে!” স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল তপন। “ও হ্যাঁ, যা বলছিলাম, এই হিরেটা কালেক্টর’স আইটেম। শুক্রবার এটার নিলাম হবার কথা ক্রিস্টি’জ থেকে। ক্রিস্টি’জ-এর নাম শুনেছেন তো? বিখ্যাত নিলাম হাউস। সেই জন্যেই সুরাট থেকে স্পেশাল ডেলিভারিতে দু-দিন আগে আনা হয়েছে। তার মধ্যেই এই বিপত্তি!”

উফফ, অনর্গল কথা বলতে পারে তপন। বেশিরভাগই অপ্রয়োজনীয়, শুনতে অবশ্য মন্দ লাগছিল না। দশ মিনিটের মধ্যে চুরি যাওয়া হিরের নাম থেকে শুরু করে তার হিস্ট্রি-জিওগ্রাফি সব জেনে গেলাম। নাম ‘নবাশা’। 

“নবাশা মানে কী জানেন?” জিজ্ঞেস করল তপন। 

“না,” মাথা নাড়লাম সবাই। 

““নব’ অর্থাৎ নতুন, আর ‘আশা’-র সন্ধি। ইংরেজিতে ‘নিউ হোপ’। একদিন হোপ ডায়মন্ডকে টেক্কা দেবে এটা, আর এর কাহিনিটাও শোনার মতো।”

“কী কাহিনি?” ফস করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। 

“একটা পাথর কর্ণাটকে এক অধ্যাপকের বাড়িতে পড়েছিল। ভদ্রলোক জানতেনও না যে ওঁর বংশে কেউ কয়লার খনিতে কাজ করতেন। পাথরটা তিনি ব্যবহার করতেন পেপার ওয়েট হিসেবে। আসলে হিরের চাকচিক্য আসে কাটিং-এর দৌলতে। কাটার আগে হিরে হল স্রেফ একটা পাথর।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার, তারপর?”

“হঠাৎ ওটা চোখে পড়ে যায় এক গুজরাতি ব্যবসায়ীর। জহুরির চোখ, বুঝতে পারে পাথরটার মূল্য। হাজার দশেকে পাথরটা কিনে হিরে কাটার স্বর্গরাজ্য সুরাটে নিয়ে যায়। ওটাকে কেটে বেশ কয়েকটা হিরে বার হয়, এটাই তার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো। সবই ভালো, শুধু এর কোনো ফেমাস হিস্ট্রি নেই, সেটাই মালিকদের ভাবাচ্ছে।”

“কেন স্যার, যা বললেন সেটা তো খুবই ইন্টারেস্টিং।”

“আরে না, হিরের ক্ষেত্রে ইন্টারেস্টিং হিস্ট্রি হল কোনো রানি বা কাউন্টেসের কাছে থাকা অথবা হিরের জন্য যুদ্ধ বা খুনোখুনি হওয়া। এই কারণেই এটা বেচে বড়োজোর দুই থেকে তিনশো হাজার পাওয়া যাবে, যদিও প্রায় একই ধরনের হিরে, ‘ফারনিজ ক্লু’ কিছুদিন আগে ফাইভ পয়েন্ট থ্রি মিলিয়নে বিক্রি হয়েছে। 

“আমি স্যার একটু কনফিউজড, ‘একই ধরন’ মানে?”

আবার জ্ঞান দেবার সুযোগ পেয়ে তপন উৎসাহিত হল। “হিরে বিচার করা হয় ফোর সি দিয়ে কাট, কালার, ক্ল্যারিটি এবং ক্যারাট। কাটিং-টা সবচেয়ে ইম্পর্টেন্ট, চকমকি আসে সেখান থেকেই। তার পরেই হল রং। বিশুদ্ধ হিরের কোনো রং থাকে না- জানেন তো?”

ছেলেমানুষি প্রশ্ন, উত্তরটা প্রায় সবারই জানা। একেনবাবু অবশ্য বোকা বোকা মুখ করে বললেন, “তাই নাকি স্যার?”

“তা-ই। রং আসে ভেতরের খাদ বা ইম্পিওরিটি থেকে। মাঝে মাঝে অবশ্য সেই খাদের জন্যেই দাম বাড়ে। কিন্তু ক্ল্যারিটি খুব ইম্পর্টেন্ট। দাম নির্ভর করবে হিরে কতটা স্বচ্ছ তার ওপর। আর সাইজটা বড়ো হলে তার দাম বেশি হবে, সে তো সবাই জানে। এই ফোর সি-গুলো বিচার করেই ফারনিজ ক্লু আর নিউ হোপকে একই ধরন বলেছি।”

তপনের ব্যাখ্যাটা খুব যে পরিষ্কার হল তা নয়, তবে কিছুটা আইডিয়া পেলাম। “তা এরকম একটা অমূল্য বস্তু এতদিন বাক্স-বন্দি করে রেখে দিয়েছিলে কেন?” প্রমথর বাঁকা প্ৰশ্ন 

“আমি কি রেখেছি প্রমথদা? আমাদের মালিকরা ডায়নামিক নয়, চলছে- চলবে টাইপ, এর ভ্যালুই বোঝেনি। দু-মাস আগে হায়দ্রাবাদে জেমস ডিলারদের ওয়ার্ল্ড কনফারেন্সে এটা দেখানোর পর এত হইচই হয়েছিল… মালিকদের মাথায় শেষ পর্যন্ত ঢুকল, এটা বেচলে কী পরিমাণ টাকা ঘরে আসতে পারে! তখনই নিলামে তোলা স্থির হয়।”

“কিন্তু নিলামে যদি এক হাজার ডলারে এটা কেউ পেয়ে যায়?”

“আরে না বাপিদা, এটা তোলা হচ্ছে রিজার্ভ অকশনে।”

“তার মানে?”

“এর রিজার্ভ ভ্যালু ধরা হয়েছে আড়াই শো হাজার ডলার, তার নীচে কেউ ডাক দিতে পারবে না। কোম্পানি আশা করছে হাফ মিলিয়ন পাওয়া যাবে।”

এইসব কথাবার্তার মধ্যেই মন্টুবাবু এসে হাজির। দোকানে কী একটা কাজ বাকি আছে শুনে তপন অদৃশ্য হল। বেন্টুমাসির দুপুরের ঘুমটা বোধহয় হিরে চুরির উত্তেজনায় ভালো হয়নি, বাইরের ঘরে এসে নিজের আসনে বসলেন। 

.

শ্যামলদা একেনবাবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই মন্টুবাবু একেনবাবুর হাত দুটো ধরে বললেন, “আমাদের কিন্তু রক্ষা করতে হবে, ভীষণ বিপদে পড়েছি!”

“কী যে বলেন স্যার, রক্ষা করেন তো তিনি!” বলে ওপরের দিকে তাকালেন একেনবাবু।”

“তাঁকে তো আর পাওয়া যাচ্ছে না, হাতের কাছে আপনিই আছেন।” প্ৰমথ ফোড়ন কাটল। 

“তুই চুপ করবি!” প্রমথকে ধমক দিলেন বেন্টুমাসি। 

“চুরির ব্যাকগ্রাউন্ডটা কি তপন দিয়েছে?” মন্টুবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

“কখন দিল?” বেন্টুমাসি জিজ্ঞেস করলেন। 

“তুমি তখন ঘুমোচ্ছিলে মা। তবে চুরি পর্যন্ত পৌঁছোয়নি,” শ্যামলদা বলল, “তপন যা বলেছে সবই তুমি জানো।”

“ঠিক আছে,” বেন্টুমাসি মন্টুবাবুকে হুকুম দিলেন, “মন্টু, কীভাবে চুরি হল, কোত্থেকে চুরি হল, সব কিছু একেনকে বলো, কোনো কিছু বাদ দেবে না।”

মন্টুবাবু বললেন, “তপন কতটা বলেছে জানি না, আমাদের স্ট্রং রুম থেকে একটা হিরে গত রাত্রে চুরি হয়ে গেছে। স্ট্রং রুমে চব্বিশ ঘণ্টা সিকিউরিটি গার্ড থাকে। রাতে এক্সট্রা একটা গার্ড ডগও থাকে। কেউই বলতে পারছে না, কী করে হিরেটা অদৃশ্য হল। পুলিশে খবর দিয়েছি। সকালে এসে দেখে গেছে। কিন্তু মনে হচ্ছে না শিগিরি কিছু করতে পারবে বলে। আপনি যদি তদন্তের ভার নেন তো ভরসা পাই।”

“মাসিমা যখন ডেকেছেন তদন্তের ভার তো নিতেই হবে, তবে কিনা…”

একেনবাবুকে কথা শেষ করতে দিলেন না মন্টুবাবু। “পারিশ্রমিক নিয়ে চিন্তা করবেন না। অ্যাডভান্স হিসেবে এটা রাখুন প্লিজ,” বলেই এক হাজার ডলারের একটা চেক একেনবাবুর হাতে গছিয়ে দিলেন। 

একটা জিনিস দেখেছি, একেনবাবু এমনিতে কৃপণ ‘টু-দি-পাওয়ার ইনিফিনিটি’ হলেও, কেস নেবার সময়ে ফি নিয়ে মাথা ঘামান না। 

“আপনাদের স্ট্রং রুমটা কোথায় স্যার? জায়গাটা কি একবার দেখা যাবে?”

“এখনই চলুন না, নিয়ে যাচ্ছি। স্ট্রং রুমটা দোকানের ভেতরেই। শুধু এই হিরের জন্যেই একটা সিকিউরিটি এজেন্সির তিন জন আর্মড গার্ড পালা করে স্ট্রং রুম পাহারা দিচ্ছে। তাদের একজনকে এখনই পাবেন, অন্য দু-জনের সঙ্গেও দেখা করার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”

.

মন্টুবাবুর দোকান শ্যামলদার বাড়ি থেকে মিনিট পনেরোর পথ, হোয়াইট প্লেইসের ডাউন টাউন, মানে শহরের কেন্দ্রস্থলে। পথে অবশ্য মন্টুবাবুর সঙ্গে বিশেষ কথা হল না। কোম্পানির কোনো এক্সিকিউটিভ-এর সঙ্গে কথা বলছিলেন। সেই কথাবার্তা থেকে বুঝলাম, মন্টুবাবু নানা দিক থেকেই প্রোটেক্টেড। ওঁর সিকিউরিটি কোম্পানি বন্ডেড এবং সিকিওরড। অর্থাৎ, তাদের গাফিলতিতে কিছু চুরি গেলে, সিকিউরিটি কোম্পানি ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। তা ছাড়া ইন্সিয়োরেন্সও চুরির ক্ষতি কভার করবে। তবে এগুলো শুনতে যত সহজ কার্যক্ষেত্রে ততটা নয়। ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কত হবে এবং কবে সেটা মিলবে, সেটা জানতে চাইলে কনট্রাক্টের ফাইন প্রিন্টগুলো পড়তে হবে, অর্থাৎ আইনি প্যাঁচ-ঘোঁচগুলো বুঝতে হবে। 

.

মন্টুবাবুর দোকান শনিবার একটা পর্যন্ত খোলা থাকে। এখন বন্ধ বলে সামনে শাটার দেওয়া। তবে ডান পাশ দিয়ে ঢোকার দরজা আছে। মন্টুবাবু চাবি দিয়ে সেটা খুললেন। ঢুকতেই বাঁ-দিকে শোরুম। তিনটে কাউন্টার ইউ শেপ-এ সাজানো, ভেতরে রাশি রাশি গয়না। মাঝখানের কাউন্টারের পেছনে কাচের দরজা দেওয়া একটা অফিস। দরজার মধ্যে দিয়ে দেখতে পেলাম তপন দু-জন কর্মচারীর সঙ্গে বসে হিসেবপত্র মেলাচ্ছে। আমাদের দেখে হাতটা একটু তুলল। অফিসের পাশে আর একটা দরজা, সেখান থেকে একটা প্যাসেজ দিয়ে স্ট্রং রুমে যেতে হয়। দরজায় লক থাকলেও সেটা খোলা। মন্টুবাবুর পেছন পেছন সেই দরজা দিয়ে সবাই ঢুকলাম। ঢুকেই বাঁ-দিকে পর পর দুটো টয়লেট রুম, পুরুষ আর মহিলাদের জন্য। আরেকটু এগোলে একটা ভেন্ডিং মেশিন, সেটা নানান রকমের স্ন্যাকস আর কোল্ড ড্রিঙ্কস-এ ঠাসা। যদিও খাবারগুলো দেখা যাচ্ছে, তাও প্রত্যেকটার নীচে নাম লেখা আর তার দাম, তারও নীচে অক্ষর আর সংখ্যার একটা কম্বিনেশন, যেমন A2, B3, C7 ইত্যাদি। স্লট মেশিনে পয়সা দিয়ে অক্ষর আর সংখ্যার বাটন টিপলেই ওপর থেকে সেই কম্বিনেশনের খাবার নীচের ট্রে-তে এসে পড়বে। সিম্পল অ্যারেঞ্জমেন্ট, খাবার দেখতে পেলে পাওয়া যাবে, নইলে নয়। একেনবাবু সেদিকে তাকিয়ে আছেন দেখে মন্টুবাবু বললেন, “ডিউটির সময় গার্ডদের বাইরে যাবার নিয়ম নেই, তাই এখানে স্ন্যাক্সের বন্দোবস্ত রেখেছি। অন্য কর্মচারীরাও চাইলে এখান থেকে খাবার বের করে খেতে পারে।”

“পিনাট-বাটার স্যান্ডউইচ তো দেখছি ফুরিয়ে গেছে স্যার।”

আমি হাসতে হাসতে বললাম, “একেনবাবু পিনাট বাটারের ভক্ত, তাই ওটাই ওঁর প্রথম চোখে পড়ে, অথচ দেখুন কোকের বোতলও শেষ হয়ে গেছে।”

“হ্যাঁ, মাঝে মাঝে এক-আধটা আইটেম ফুরিয়ে যায়। সোমবার সকালেই ভেন্ডিং মেশিনের লোক এসে ভরাট করে দিয়ে যাবে। শনি-রবিবার শুধু ওরা আসে না।”

প্যাসেজটা শেষ হয়েছে স্ট্রং রুমের দরজার সামনে। সেখানে সাইড করে গার্ডদের বসার জন্য দুটো চেয়ার। তার একটাতে বসে আছে বন্দুকধারী একজন গার্ড। বিশাল চেহারা। সামনে যেতেই উঠে দাঁড়িয়ে মন্টুবাবুকে ‘হ্যালো’ বলল। 

মন্টুবাবু গার্ডকে বললেন, “জিম, এঁদের কথাই তোমাকে বলেছি। এঁরা প্রাইভেটলি ইনভেস্টিগেট করবেন চুরির ব্যাপারটা।”

জিম ভাবলেশহীন মুখে কথাটা শুনল। এক বার ‘হ্যালো’ও বলল না। হাবেভাবে মনে হল একটু রেসিস্ট। মন্টুবাবু স্ট্রং রুমের দরজা খুলে দিতে বললে কাঁধটা একটু ঝাঁকিয়ে খুলে দিল। 

ছোটো একটা ঘর, একদিকে দেয়াল ঘেঁষে ভারী স্টিলের সিন্দুক। ঘরের মধ্যিখানে একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার। টেবিলের ওপর লাইন টানা একটা খাতা, সেখানে ডেট, টাইম, আর সই করার জন্য দাগ কাটা। সিলিং-এ অনেকগুলো লাইট থাকায় ঘরটা খুবই আলোকিত। কোনো জানলা নেই, ঢোকা বা বেরোবার জন্য একটাই দরজা। তবে সেট্রাল হিটিং আর কুলিং-এর দৌলতে তেমন দম বন্ধ লাগছে না। 

“সিন্দুকটা খুলে দেখাই,” বলে মন্টুবাবু পকেট থেকে দুটো চাবি বার করে দেখালেন। একটাতে পাঞ্চ করা ‘১’ আর একটাতে ২’। “এটা ডুয়েল-লক সেফ। খুলতে দুটো চাবি লাগে। আমার কাছে একটা সেট থাকে। অন্য সেটের ‘১’ নম্বর চাবি থাকে যে গার্ড ডিউটি দিচ্ছে, তার কাছে। ‘২’ নম্বর চাবি থাকে তপনের কাছে। ডিউটি চেঞ্জের সময়ে নতুন যে ডিউটিতে আসছে তপন তাকে ‘২’ নম্বর চাবিটা দেয়। দু-জন গার্ড মিলে সিন্দুক খুলে দেখে হিরেটা আছে কিনা। দেখার পর দু-জনে রেজিস্ট্রি খাতায় টাইম আর ডেট দিয়ে সই করে। তারপর যার ডিউটি শেষ হচ্ছে, সে ‘১’ নম্বর চাবি নতুন গার্ডকে দিয়ে ‘২’ নম্বরের চাবি তপনকে জমা দিয়ে যায়। একেবারে ফুল-প্রুফ সিস্টেম।”

“বুঝলাম স্যার, কিন্তু এ তো একেবারেই ম্যানুয়াল ব্যাপার। আজকাল সিসিটিভি, ইলেকট্রনিক অ্যালার্ম, রিমোট ভিউয়িং কত কিছু আছে সার্ভেইলেন্সের জন্য।”

পরিষ্কার বোঝা গেল মন্টুবাবু পুরোনো যুগের লোক, নতুন কিছুতে ভরসা নেই। বললেন, “তা আছে, কিন্তু তাতে কি চুরি ঠেকানো যাচ্ছে? আমাদের এখানে ইদানীং মাঝে মাঝেই ঝড়-বৃষ্টিতে পাওয়ার আউটেজ হচ্ছে। ব্যাক-আপ পাওয়ারও এক-আধ সময় ফেল করে। সেই চান্স আমি নিতে চাইনি।” বলে নিজের ‘২ নম্বর লেখা চাবিটা জিমকে দিলেন। 

জিমের কাছে ‘১’ নম্বর ছিল। সে প্রথমে ‘১’ নম্বর তারপর ‘২’ নম্বর ঢুকিয়ে সিন্দুকের দরজাটা খুলল। একটা সিলভার ফিলিগ্রি করা জুয়েলারি বাক্স ছাড়া সেখানে আর কিছুই নেই। 

“এটাতেই ছিল হিরেটা।” মন্টুবাবু সেটা বার করে টেবিলে রাখলেন।

“খুলতে পারি স্যার, বাক্সটা?”

“নিশ্চয়।”

একেনবাবু পকেট থেকে একটা রুমাল বার করে সন্তর্পণে বাক্সের ডালা খুলছেন দেখে মন্টুবাবু বললেন, “গার্ডদের ছাড়া অন্য কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট ওতে নেই, আমাদের সিকিউরিটি দেখেছে। পুলিশও ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে গেছে।”

“থ্যাংক ইউ স্যার,” বলে একেনবাবু বাক্সটা টেবিলে রেখে ভেতরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। দেখার বিশেষ কিছুই নেই। বেগুনি রঙের ভেলভেটের একটা লাইনিং, যার ভেতরে একটা খাঁজের মতো। হিরেটা নিশ্চয় সেখানেই গোঁজা ছিল। ভেতরটা দেখা হলে ডালা বন্ধ করে বাইরেটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বললেন, “বাক্সের এই কোণটায় স্যার, একটা ধাক্কা লেগেছিল মনে হচ্ছে।”

“তাই নাকি?” মন্টুবাবু সাগ্রহে বাক্সটার দিকে তাকালেন। 

আমি আর প্রমথও তাকালাম। সত্যিই একটা কোণে ফিলিগ্রির সূক্ষ্ম কাজ 

মনে হল একটু ড্যামেজড। 

“আগে কি এটা ছিল?”

মন্টুবাবু মাথা নাড়লেন। “কোনো টোল থাকার তো কথা নয়।”

“হয়তো কারো হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল…।”

মন্টুবাবু জিমের দিকে তাকালেন। মাথা নাড়ল জিম। 

“আপনি কখন ডিউটিতে এসেছিলেন স্যার?” জিমকে জিজ্ঞেস করলেন একেনবাবু। 

“সকাল আটটার সময়।”

“ওদের রিপোর্টিং টাইমগুলো হল আটটা, চারটে, আর বারোটা।” মন্টুবাবু বললেন। 

একেনবাবু জিমকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি আর নাইট গার্ড যখন লকার খুললেন তখন হিরেটা মিসিং ছিল, রাইট?”

সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল জিম। “সঙ্গে সঙ্গেই আমরা সেলস ম্যানেজারকে জানাই।”

“কিন্তু স্যার, নাইট গার্ড তো ডিউটিতে এসে ওটাকে দেখেছিলেন, তাই না?” রেজিস্ট্রির পাতা উলটে শেষ এন্ট্রিটা দেখলেন একেনবাবু। 

জিম চুপ করে রইল। 

“হিরেটা না দেখতে পেয়ে আপনাকে কিছু বলেছিলেন? ওঁর ডিউটির সময়েই তো ওটা হারায়?”

“না, ও-ও আমার মতোই শক্ড হয়েছিল। এই রুমে ঢোকার পথ তো একটাই আর দরজা লক করে আমরা বাইরে বসে পাহারা দিই।”

একেনবাবু মাথা চুলকে বললেন, “তবে কিনা স্যার, হিটিং-কুলিং-এর ডাক্টটা বেশ বড়ো।”

“সেখান দিয়ে ঢুকলে আওয়াজ হত, তা ছাড়া সিন্দুকের চাবি পেত কোথায়?” জিম ওর কলিগের সপক্ষে বলল। 

“তা তো বটেই,” একেনবাবু মাথা নাড়লেন। তারপর মন্টুবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “অন্য দু-জন গার্ডের সঙ্গে কখন কথা বলা যাবে স্যার?”

“একটু বাদেই বিকেলের গার্ড টিম ডিউটি করতে আসবে। নাইট গার্ড জ্যাকের সঙ্গেও আমি যোগাযোগ করছি, যাতে আজকেই দেখা হয়।”

একেনবাবু ঘরের এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন দেখে মন্টুবাবু বললেন ঘরটা তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে। শুধু ঘরটা নয়, সারা দোকান। গার্ডদের তো বটেই কর্মচারীদেরও সবাইকে সার্চ করা হয়েছে। কোথাও কিছু পাওয়া যায়নি।”

“তাহলে আর কী, চলুন স্যার, তপনবাবুর সঙ্গেও একটু কথা বলি।” ঠিক বেরোবার মুখে ঘুরে দাঁড়িয়ে জিমকে জিজ্ঞেস করলেন একেনবাবু, “আচ্ছা স্যার, আজ সকাল বেলা আপনি ‘২’ নম্বর চাবি তপনবাবুর কাছ থেকে নিয়ে এসেছিলেন, ঠিক কিনা?”

“হ্যাঁ, সেটাই তো করি!”

“তারপর স্যার?”

“তারপর আবার কী! নাইট গার্ড জ্যাকের কাছে একটা চাবি থাকে, আর আমার চাবি— এই দুটো দিয়ে সিন্দুক খোলা হয়েছিল।”

“মিস্টার জ্যাক সিন্দুকটা খুলেছিলেন, না আপনি?”

“হোয়াট ডিফারেন্স ইট মেকস, ম্যান!” এবার বিরক্ত হল জিম। “সিন্দুক খুলতে দুটো চাবি লাগে। একজন খুললেও লাগবে, দু-জন খুললেও লাগবে।”

“দ্যাটস ট্রু স্যার।”

“তাহলে?” শ্লেষ দিয়ে কথাটা বলে জিমের বোধহয় করুণা হল। বলল, “ইফ ইট মেকস ইউ হ্যাপি, আমার চাবি নিয়ে জ্যাকই সিন্দুক খুলেছিল, আমি হান্টারকে আদর করছিলাম।”

“হান্টার?”

“যে গার্ড ডগ-এর কথা বলেছিলাম,” মন্টুবাবু বললেন, “জ্যাক-এর সঙ্গে থাকে রাত্রে ডবল প্রোটেকশনের জন্য।”

“থ্যাংক ইউ স্যার। ও হ্যাঁ, আরেকটা প্রশ্ন, ভেন্ডিং মেশিন-এর শেষ পিনাট বাটার স্যান্ডউইচ কি আপনি খেয়েছিলেন?”

জিম এমনভাবে তাকাল, যেন একটা পাগলকে দেখছে। শুধু জিম নয়, মন্টুবাবুও হতবাক। 

“না, খাইনি। চাইলেও পারতাম না, ওটা মিসিং ছিল।”

“রাইট স্যার।”

.

তপনের জন্যে শুধু দুটো প্রশ্ন ছিল একেনবাবুর। প্রথম প্রশ্ন, জুয়েলারি বাক্সে টোল পড়া নিয়ে। উত্তরটা তপন জানত। ওটা ড্যামেজড অবস্থাতেই ইন্ডিয়া থেকে এসেছিল। একেনবাবুর দ্বিতীয় প্রশ্ন, ‘২’ নম্বর চাবি নাইট গার্ড জমা দিয়ে গিয়েছিল কিনা। 

“নিশ্চয়, ওটাই ওদের রুটিন। এই বিল্ডিং-এর ওপরেই আমি থাকি। চাবি থাকে আমার ডেস্ক-ড্রয়ারে। যে ডিউটি করতে আসে, তাকে দিই। মিনিট কয়েক বাদেই হিরে চেক করে যার ডিউটি শেষ হল, সে ফেরত দিয়ে যায়।”

“একদম ক্লিয়ার স্যার, এটাই মন্টুবাবু আমাকে বলেছিলেন… কেন যে গুলিয়ে যাচ্ছিল!”

এর মধ্যেই বিকেলের ডিউটি দিতে টিম এসে গেল। তপন গেল ওপরে, ‘২ নম্বর চাবিটা আনতে। 

মন্টুবাবু একেনবাবুর পরিচয় দিলেন। টিম ইতিমধ্যেই শুনেছে হিরেটা অদৃশ্য হয়েছে। তাই কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলল, “আমি যখন ডিউটি দিয়ে গেছি তখন ওটা ছিল।”

“সেটা জানি স্যার আমার প্রশ্নটা ভেন্ডিং মেশিন সংক্রান্ত।”

টিমের মুখটা দেখার মতো। 

“কী প্রশ্ন?”

“আপনি যখন ডিউটি সেরে চলে যাচ্ছেন, তখন কি ভেন্ডিং মেশিনে সব খাবার ছিল?”

“কোক ছিল না, কারণ যাবার আগে কিনতে যাচ্ছিলাম। অন্য সব কিছুই তো ছিল, যদ্দূর মনে পড়ছে।”

“আপনি শিওর স্যার?”

একটু ভেবে গার্ড বলল, “হ্যাঁ, অন্য কিছু না থাকলে চোখে পড়ত।”

“থ্যাংক ইউ স্যার।”

এর মধ্যে তপন নেমে এসেছে চাবি নিয়ে। সেটা নিয়ে নতুন গার্ড স্ট্রং রুমে গেল। এক মিনিটের মধ্যেই জিম এসে চাবিটা ফেরত দিয়ে গেল। 

“সিন্দুকটা খুলেছে স্যার?”

“কেন খুলবে না!” একেনবাবুর বোকা বোকা প্রশ্ন শুনে জিম সত্যিই বিরক্ত।

সত্যি কথা বলতে কী আমিও অবাক! মন্টুবাবুও মনে হচ্ছে হিরে পাবার ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়েছেন। 

হঠাৎ একেনবাবু বললেন, “চলুন স্যার, বাড়ি যাওয়া যাক।”

“আপনার তদন্ত শেষ? নাইট গার্ডের সঙ্গে কথা বলবেন না?”

“নাঃ, তার আগে একটা গল্প বলি।”

“গল্প!” একেনবাবুর মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্পর্কে মন্টুবাবু এখন সন্দিহান।

“কোনান ডয়েলের লেখা, স্যার… ঘোড়াচুরির গল্প… সেখানে ক্লু হল কুকুর চেঁচায়নি। সেই থেকেই বোঝা যায় বাইরের কোনো লোক চুরি করেনি।”

“বুঝলাম, কী বলতে চান,” প্রমথ বলল, “হিটিং-কুলিং-এর প্যাসেজ দিয়ে বাইরের কেউ ঢোকেনি।”

“রাইট স্যার।”

“হিরেটা দোকানে কোথাও নেই, আমরা তন্নতন্ন করে খুঁজেছি,” মন্টুবাবু আবার জোর দিয়ে বললেন। “এমনকী জার্মান-মেড ডায়মন্ড হান্টার ডিভাইস দিয়েও আনাচেকানাচে খুঁজেছি।”

“তাহলে গেল কোথায়?” প্রমথ প্রশ্নটা করল। 

মাথা চুলকোতে চুলকোতে একেনবাবু বললেন, “আপনার সকালের গল্পটা ভাবছি স্যার। সেটা একটা সম্ভাবনা।”

একেনবাবুর মাথায় আজ কী চেপেছে, কে জানে? 

“মন্টুবাবু, আপনি স্যার পুলিশকে বলুন নাইট গার্ডকে পাকড়াও করতে। ইতিমধ্যেই হান্টারের পটি ঘেঁটে হিরে না পেলে, উনি নিশ্চয় ডগিটাকে জোলাপ খাওয়াচ্ছেন।”

“দাঁড়ান, দাঁড়ান, আপনি বলতে চান হিরেটা হান্টার খেয়েছিল?” এবার আমি একেনবাবুর কথাটা বুঝলাম। 

“খাওয়ানো হয়েছিল, স্যার। টাকার জন্যে কুকুরের জীবন নিয়ে রিস্ক নেওয়া যায়, নিজের জীবনকে নিয়ে নয়। ভেবে দেখুন স্যার, মোবাইলে চাবির ছবি তুলে দোকানে দিলে সেই চেহারার চাবি করতে কয়েক মিনিটও লাগে না। আর চাবিতে নম্বর পাঞ্চ করা তো কোনো সমস্যাই নয়। এই সতর্কতা মূলত টিম-এর জন্য। কারণ, নাইট গার্ড জ্যাক ডিউটিতে এসে সিন্দুক খোলার পর আসল দু-নম্বর নিজের কাছে রেখে, নকল চাবিটা টিমকে দিয়েছিলেন তপনবাবুকে ফেরত দিতে। তপনবাবু অবশ্য খুব একটা খেয়াল করেন না। আজকেই তো হিরের বদলে ফুলের ছবি নিয়ে এলেন! তাই না স্যার?”

কথাটা শুনে তপন লজ্জা পেল। 

একেনবাবু বলে চললেন, “রাত্রে সিন্দুক থেকে হিরে বার করে চেষ্টা করলেন হান্টারকে সেটাকে গেলাতে। গেলাতে হয়তো অসুবিধা হচ্ছিল। কাজে লাগল পিনাট বাটারের শেষ স্যান্ডউইচটা। হিরেতে পিনাট বাটার ভালো করে লাগিয়ে মুখে তুলে দিতেই বড়ির মতো হান্টার সেটা গিলে ফেলল। এরপর নাইট গার্ডের একটাই অ্যাকশন। সকালে জিম এলে তপনবাবুর কাছ থেকে আনা নকল চাবি ব্যবহার করতে না দেওয়া। সেই জন্যেই তাড়াহুড়ো করে নকল চাবি জিমের কাছ থেকে নিয়ে নিজের দু-নম্বর চাবি দিয়ে সিন্দুক খুললেন। তারপর সুবোধ বালকের মতো আসল চাবি তপনকে ফেরত দিলেন।”

“পিনাট বাটার থিয়োরিটা ননসেন্স!” প্রমথ বলল, “মুখটা ধরে হাঁ করিয়ে জিভের ভেতরে হিরে ঢুকিয়ে মুখটা বন্ধ করলেই কুকুরটা গিলে ফেলত। 

“ঠিকই বলেছেন স্যার। হয়তো ডগিকে ওটা পুরস্কার হিসেবে খাইয়েছিলেন। একটা স্যান্ডউইচ তো কেউ খেয়েছিল।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু নকল চাবিটা কোথায়?”

“হু নোজ স্যার, নিশ্চয় সুযোগমতো টয়লেটে ফেলে ফ্লাশ করে দিয়েছেন। তখন সবাই হিরের খোঁজ করছিল, চাবির নয়।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *