নিউ মার্কেটের ইতিহাস
ইংরেজরা যখন প্রথম কলকাতায় আসে তখন তারা বাস করত বর্তমান বি-বা-দী বাগ অঞ্চলে। সেজন্য তারা তরিতরকারি ও মাছ-মাংস কিনতো লালবাজারে কিংবা টেরেটি বাজারে, আর পোশাক-আশাক ও অন্যান্য বিলাসদ্রব্য চীনা বাজারে। তখনকার দিনে চীনা বাজারে সব দোকানদারই ছিল বাঙালি আর খরিদ্দার ছিল সাহেব-মেম। চীনা বাজারের বাঙালি দোকানদারদের একটা অপবাদ ছিল; তারা নাকি সাহেব-মেমেদের ঠকাতো। অন্তত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকের কলকাতার অধিবাসী সুপ্রিম কোর্টের অ্যাটর্নি উইলিয়াম হিকি, সেই কথাই তাঁর স্মৃতিচারণে বলে গেছেন। এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখনীয় যে ঊনবিংশ শতাব্দীর ডিরোজিওর ‘ইয়ং বেঙ্গল’ ছাত্রমণ্ডলীর অন্যতম ও বিখ্যাত বাগ্মী রামগোপাল ঘোষের পিতারও চীনাবাজারে একটা বইয়ের দোকান ছিল।
তারপর সাহেবরা যখন কসাইটোলা, ধর্মতলা ও চৌরঙ্গী অঞ্চলে বসবাস শুরু করল, তখন তারা তিনটে বাজার স্থাপন করল, শেরবরণের বাজার, চৌরঙ্গীর বাজার ও চাঁদনী চক। শেরবরণের বাজারটা ছিল, আজ যেখানে ‘স্টেটসম্যান’ অফিস অবস্থিত সেখানে। আর চৌরঙ্গীর বাজার ছিল, চৌরঙ্গী ধর্মতলা ষ্ট্রীটের সংযোগস্থলে। চৌরঙ্গী বাজারটা ছিল সবচেয়ে বড় বাজার। এই বাজারটা নীলামে হস্তান্তরের পর, এটার নূতন নামকরণ করা হয় ‘ধর্মতলা বাজার’। ১৭৯৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ এপ্রিল তারিখে নীলামদার টুলো অ্যাণ্ড কোম্পানি, বাজারটা নীলামের জন্য যে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, তা থেকে আমরা জানতে পারি যে, যে জমির ওপর বাজারটা অবস্থিত ছিল তার আয়তন ছিল নয় বিঘা। ওই বাজারে ২০৭টা পাকা দোকান ঘর, ১৪৩টা খিলানযুক্ত দোকান ঘর ও ৩৬টা খুব বড় কাঁচা গুদাম ঘর ছিল। বাজারের চৌহদ্দী সম্বন্ধে ওই বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল যে এটি “bounded by General Shibbert’s house on the east, by the Dhurrumtolah Road to the north, by the Chowringhee Road to the West, and by the Jaun Bazar Road to the south.”
১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে পাথুরিয়াঘাটার যদুলাল মল্লিক এই বাজারটা কিনে নেন!
শেরবরণ বাজার ও ধর্মতলা বাজার উঠে গেছে। কিন্তু চাঁদনী চক এখনও জীবিত। সারা ভারতের রাজধানী হিসাবে কলকাতার চৌরঙ্গী অঞ্চলে সাহেবরা যখন জেঁকে বসে, তখন তারা জিনিসপত্তর হয় ধর্মতলার বাজার, আর তা নয়তো চাঁদনী চক্ থেকে কিনত। কিন্তু অভিজাত সম্প্রদায়ের সাহেব-মেমরা কলকাতার বিশিষ্ট দোকান থেকেই তাদের জিনিসপত্তর কিনত। এসব দোকানে হয় পোশাক-আশাক-জুতা, আর তা নয়তো স্টেশনারি জিনিস, বিলাসদ্রব্য ও বই বিক্রি হত। র্যানকিন অ্যাণ্ড কোম্পানি পোশাক তৈরি করত, কাথবার্টসন অ্যাণ্ড হারপার জুতো তৈরি করত, ট্রেইল অ্যাণ্ড কোম্পানি স্টেশনারি জিনিস বেচত, আর ডবলিউ নিউম্যান ও থ্যাকার স্পিনকের দোকানে স্টেশনারি জিনিস ও বইপত্তর পাওয়া যেত। এ ছাড়া, বাজারের সমতুল কলকাতায় দু- তিনখানা বিভাগীয় দোকান ছিল। সবচেয়ে বড় বিভাগীয় দোকান ছিল হোয়াইটওয়ে লেডল-এর দোকান। আয়তনে দোকানটা যেমন ছিল বড়, ওর পণ্যসম্ভারও তেমনি ছিল বিচিত্র। এখানে যে কোনও জিনিস কিনতে পাওয়া যেত। হোয়াইটওয়ে লেডল ছাড়া, আরও তিনটে বিভাগীয় দোকান ছিল। সেগুলো হচ্ছে হল অ্যাণ্ড অ্যাণ্ডারসন, আর্মি অ্যাণ্ড নেভি স্টোরস ও ফ্রানসিস হ্যারিসন অ্যাণ্ড হ্যাদাওয়ের দোকান
দেশী লোকদের সঙ্গে সাহেব-মেমরা ধর্মতলার বাজার ও চাঁদনী চক্ থেকে জিনিস কেনা অসুবিধা বোধ করল। দোকানদাররা শুধু যে ওজনে মারত তা নয়, দামেও ঠকাতো। সেজন্য ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দে সিভিলিয়ান সাহেবরা কলকাতা করপোরেশনের কাছে, এক বাজার প্রতিষ্ঠার জন্য আবেদন করে। ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে এই আবেদন অনুক্রমে এক স্পেশাল কমিটি বসানো হয়। কমিটি সঙ্গে সঙ্গেই সাহেব-মেমেদের জন্য এক বাজার স্থাপনের সুপারিশ করে। কলকাতার অভিজাত পল্লী চৌরঙ্গীর লিওসে স্ট্রীট ও বারটরাম স্ট্রীটের সংযোগস্থলে দুই লক্ষ আঠারো হাজার টাকায় ২৫ বিঘা জমি কেনা হয়। সঙ্গে সঙ্গেই বাজার নির্মাণের কাজ আরম্ভ করে দেয় ঠিকাদার বার্ন অ্যাণ্ড কোম্পানি। ছয় লক্ষ পঁয়ষট্টি হাজার ন’শ পঞ্চাশ টাকা ব্যয়ে ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যেই বাজারের নির্মাণ কার্য সমাধা হয়ে যায়। আনুষ্ঠানিকভাবে বাজারটা খোলা হয় ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দের পয়লা জানুয়ারি তারিখে। কোন কোন কাগজে লেখা হয়েছে বাজারটা সেপ্টেম্বর মাসে খোলা হয়েছিল, সেটা একেবারেই ভুল। আরও ভুল লেখা হয়েছে যে বাজারটার নাম প্ৰথমে হগ্ মার্কেট ছিল, পরে স্বাধীনোত্তরযুগে ওর নাম হয়েছে ‘নিউ মার্কেট’। এটা নতুন বাজার বলে গোড়া থেকেই এটার নাম ছিল ‘নিউ মার্কেট’। এ নামটার সঙ্গেই সেকালের ও একালের লোক বেশি পরিচিত। মাত্র ১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দে ২ ডিসেম্বর তারিখ থেকেই এর নামকরণ করা হয় ‘স্যার স্টুয়ার্ট হগ্ মার্কেট’ সংক্ষেপে হগ্ মার্কেট। স্যার স্টুয়ার্ট হগ্ ছিলেন কলকাতা করপোরেশনের চেয়ারম্যান, ১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দের ১২ নভেম্বর পর্যন্ত। তাঁর আমলে এবং তাঁর চেষ্টাতেই বাজারটা নির্মিত হয়েছিল বলে, তাঁর অবসর গ্রহণের পর তাঁর সম্মানার্থে বাজারটার নামকরণ করা হয় ‘স্যার স্টুয়ার্ট হগ মার্কেট’। কলকাতা করপোরেশনের ‘প্রোট্রেট গ্যালারি’তে স্যার স্টুয়ার্ট হগের একখানা ব্রোমাইড ছবি টাঙানো আছে।
নিউ মার্কেটই কলকাতার সর্বপ্রথম মিউনিসিপ্যাল মার্কেট। তারপর অবশ্য কলকাতা করপোরেশন আরও কতকগুলি বাজার স্থাপন করেছে। যথা ১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দে স্যার চার্লস অ্যালেন মার্কেট, ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দে কলেজ স্ট্রীট মার্কেট ১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দে লেক রোড মার্কেট, ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দে গড়িয়াহাট রোড মার্কেট, ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দে পার্ক সার্কাস মার্কেট, ১৯৬৩ খ্রীষ্টাব্দে নিউ আলিপুর মার্কেট ও ১৯৭২ খ্রীষ্টাব্দে মানিকতলা মার্কেট। কিন্তু এতগুলো করপোরেশন মার্কেট স্থাপিত হলে কি হবে? এদের কোনটাই নিউ মার্কেটের সম্মান, মর্যাদা ও গৌরব অর্জন করতে পারেনি। উল্লেখনীয় যে ১৯৬৮-৬৯ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এসব বাজারগুলো থেকে করপোরেশনের লাভ হত, কিন্তু তারপর থেকে ক্রমাগতই লোকসান হচ্ছে।
স্থাপত্যে নিউ মার্কেট এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে। এর নকশা তৈরি করেছিল ইষ্ট ইণ্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির তৎকালীন আর্কিটেক্ট আর.বায়নে। এর জন্য তিনি পুরস্কার পেয়েছিলেন হাজার টাকার। আর মৌলিক সৌধটা তৈরি করেছিল বার্ন অ্যাণ্ড কোম্পানি। পরে এর অনেক সম্প্রসারণ ঘটেছে। খুব বড় রকমের সম্প্রসারণ ঘটে ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে, যখন পাঁচ লক্ষ ৭৭ হাজার ৯৪৭ টাকা ব্যয়ে পূর্বদিকের ব্লকটা তৈরি করা হয়। উত্তরদিকের সম্প্রসারণ ঘটে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে।
রাজধানীর সাহেব-মেমদের বাজার বলেই, নিউ মার্কেটের ছিল এক বিশেষ মর্যাদা। বাঙালিরা যে নিউ মার্কেটে জিনিসপত্তর কিনতে যেত না, তা নয়। তবে তারা বিলেত- ফেরত ব্যারিষ্টার বা ওই শ্রেণীর বাঙালি। আজ সাহেবরা এদেশ থেকে চলে গিয়েছে বটে কিন্তু নিউ মার্কেট তার প্রাচীন ঐতিহ্য হারায়নি। এখন অনেক বাড়ির গৃহিনীরা নিউ মার্কেট থেকে জামা-কাপড় কিনে এনে, প্রতিবেশীদের কাছে গর্বের সঙ্গে বলেন—‘এটা নিউ মার্কেট থেকে কেনা!”
নিউ মার্কেটে পাওয়া যায় না এমন কিছু নেই! একদিকে যেমন পাওয়া যায় তরিতরকারি-সবজি থেকে মাছ-মাংস ইত্যাদি। অপরদিকে তেমনই পাওয়া যায় রুটি, কেক্, ফলমূল, মেওয়া থেকে আরম্ভ করে পোশাক-আশাক, জুতো, বই, খবরের কাগজ, স্টেশনারি জিনিস ও নানারকম বিলাসদ্রব্য থেকে আরম্ভ করে হীরা-জহরত ও মূল্যবান অলঙ্কার পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, আপনি যদি নিজের ওজন নিতে চান বা শক্তি পরীক্ষা করতে চান, তারও ব্যবস্থা আছে নিউ মার্কেটে। আগেও বাঙালি মেয়েরা নিউ মার্কেটে যেত, তবে জিনিস খরিদ করবার জন্য নয়। কালীঘাটের ফেরত চিড়িয়াখানা ও যাদুঘর দেখে, নিউ মার্কেটে ঢুকতো বাজারের জাঁকজমক দেখবার জন্য। তার মানে, নিউ মার্কেট কলকাতার একটা দ্রষ্টব্য স্থান ছিল। কিন্তু আজ সেখানে অন্য দৃশ্য। আজ মেয়েরা নিউ মার্কেটে যায় শাড়ি, ব্লাউজ, ছেলে-মেয়েদের জামা-জুতো ও নানারকম বিলাস দ্রব্য কিনতে। যারা কিনতে যায় তারা মনে মনে বেশ আত্মগরিমার সুখ পায়। দুশো টাকায় নিউ মার্কেট থেকে যে জিনিসটা তারা কিনবে, মার্কেটের বাইরের দোকানে সেটা হয়তো পঞ্চাশ টাকা কমে পাবে, কিন্তু ওই পঞ্চাশ টাকার জন্য তারা আত্মগরিমার সুখটা জলাঞ্জলি দেবে না।
আগেকার দিনে নিউ মার্কেটে দেখেছি সাহেব-মেম, গোরা পল্টন ও গোরা জাহাজের নাবিক গিজগিজ করছে। আজ কিন্তু সে দৃশ্য আর সেখানে নেই।
১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে এক বিধ্বংসী আগুনে নিউ মার্কেটের এক অংশ পুড়ে যায়। কর্তৃপক্ষ, নিউ মার্কেটকে ভেঙে ওখানে একটা চারতলা বাড়ি তৈরি করবার প্রকল্প নিয়েছিল। মনে হয় তাতেই নেপথ্যে অগ্নিদেব অগ্নিশর্মা হয়ে উঠেছিলেন। নিউ মার্কেটের ঐতিহ্য মানুষের হাতে নষ্ট হয়ে যাবে, এটা বোধ হয় তিনি চান না, যে রকমভাবে মানুষ তার কুৎসিত পরিকল্পনায় নষ্ট করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত সেনেট হাউসটাকে। সেজন্যই নিউ মার্কেটের অগ্নিকাণ্ডের সংবাদ পড়ে মনে জেগে উঠেছিল— ‘অগ্নি স্বাহায় নমঃ’।