পূর্ণেন্দু পত্রীর একটি কবিতার শিরোনাম— ‘ক্রেমলিনের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ’। আমি যেখানে আছি, সেই রেস্টহাউসের জানালা দিয়ে তাকিয়ে পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতার লাইন মনে এল। ঝকঝক করছে রোদ। আকাশ ঘন নীল। জানালার পাশে অচেনা এক বৃক্ষের পাতায়ও রোদের রং লেগেছে। রোদ আমাকে কখনো অভিভূত করে না, আমি বৃষ্টিরাশির জাতক, কিন্তু আজ আকর্ষণ করল। আমি অভিভূত গলায় উচ্চারণ করলাম, নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ!
আমি ঘরে একা। পাশের ঘরে এস আই টুটুল বন্ধুবান্ধব নিয়ে এসেছে। তার সঙ্গে গিটার। সে ঘোষণা করেছে, আজ সারা রাত সে আমার লেখা গান গেয়ে শোনাবে। আমি বললাম, কেন?
সে বলল, আপনাকে আনন্দ দেওয়ার জন্য।
আমি বললাম, গান ছাড়াই ভালো আছি। আমাকে একা থাকতে দিলেই অনেক আনন্দে থাকব।
টুটুল গত কিছুদিন ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে ডলার কামাচ্ছে। সব অনুষ্ঠানের শেষের গান নাকি হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘চান্দিপসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়’। সংগত কারণেই এই গানের পর শ্রোতারা খানিকটা বিচলিত হন। শ্রোতাদের এই বিচলিত অবস্থা টুটুল উপভোগ করে। আমি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরলে টুটুল মনে হয় খানিকটা বেকায়দা অবস্থায় পড়বে। সে সবাইকে ধারণা দিয়ে দিয়েছে, নিউইয়র্কযাত্রা আমার অগস্ত্যযাত্রা।
আমার স্বভাব হচ্ছে, যেকোনো অবস্থায় যেকোনো বিষয় নিয়ে রসিকতা করা। মৃত্যু নিয়ে ক্রমাগত রসিকতা করে যাচ্ছি। এই রসিকতা কেউ সহজভাবে নিতে পারছে না।
রসিকতার নমুনা দেওয়া যেতে পারে। আমাকে বিদায় জানানোর জন্য সবাই উপস্থিত হয়েছে। চেহারা করুণ করার আপ্রাণ চেষ্টা সবার। একপর্যায়ে আমি বললাম, ভালো খাবারের ব্যবস্থা আছে, সবাই খেয়ে যাবেন। এটা আমার কুলখানির খাবার। নিজের কুলখানির খাবার নিজে উপস্থিত থেকে খাওয়ানো একটা ভাগ্যের ব্যাপার। আমি ভাগ্যবান। ক্যামেরাম্যান মাহফুজুর রহমান খান বিদায় জানাতে এসেছেন। তাঁকে বললাম, আপনার মৃত বাবার কাছে কোনো খবর পৌঁছাতে হলে আমাকে দিতে পারেন। আমি খবর দিয়ে দেব।
নিউইয়র্কে পৌঁছালাম বিকেলে। এম্বেসি থেকে আমাকে রিসিভ করতে এসেছে দেখে চমকালাম। ‘এম্বেসি মণিহার’ আমার নাহি সাজে। মুক্তধারার বিশ্বজিৎ গাড়ি নিয়ে এসেছে। নুহাশের মায়ের মামাতো বোন (জলি) থাকেন নিউইয়র্কে; তিনিও গাড়ি নিয়ে এসেছেন। আমি পড়লাম মহাবিপদে। কোন গাড়িতে চড়ব? এম্বেসি? বিশ্বজিৎ, না জলি?
আমার চিকিৎসা শুরু হবে মেমোরিয়েল স্লোয়ান কেটারিং ক্যানসার সেন্টারে। এটি নাকি পৃথিবীর এক নম্বর ক্যানসার গবেষণা ও চিকিৎসাকেন্দ্র। স্লোয়ান ও কেটারিং নামের দুই ইঞ্জিনিয়ার তাঁদের জীবনের সব সঞ্চয় দান করে এই হাসপাতাল তৈরি করেছেন। পৃথিবীর ক্যানসার রোগীদের নজর এই হাসপাতালের দিকে বলেই তিন-চার সপ্তাহের আগে ডাক্তারের কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়াই সম্ভব না।
আশ্চর্যের ব্যাপার, নিউইয়র্কে যেদিন পৌঁছালাম তার পরদিনই ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেল। ব্যবস্থা করলেন গল্পকার জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের স্ত্রী পূরবী দত্ত। তিনি নিজেও গল্পকার; একসময় এই ক্যানসার সেন্টারে গবেষক হিসেবে কাজ করতেন। কেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ হাসপাতালে আমার মতো অভাজনের চিকিৎসা হওয়া উচিত, তা তিনি তাদের লিখে জানালেন। পূরবী দত্ত এতটা মমতা আমার জন্য লুকিয়ে রেখেছিলেন, তা আমার জানা ছিল না। ‘অকৃতী অধম জেনেও তো তুমি কম করে কিছু দাওনি।’
আমার ডাক্তারের নাম স্টিফান আর ভেচ। দীর্ঘদেহী সুস্বাস্থ্যের বয়স্ক একজন মানুষ। খানিকটা গম্ভীর। ভুরু কুঁচকানো। তিনি সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের সব কাগজপত্র পরীক্ষা করলেন। ওই হাসপাতাল থেকে মূল স্লাইড তলব করলেন। আমি একসময় বললাম, আমার ক্যানসার কোন পর্যায়ের? ডাক্তার বলেন, চতুর্থ পর্যায়ের। ক্যানসার যখন মূল কেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন আমরা তাকে বলি চতুর্থ পর্যায়ের ক্যানসার।
আমি ভীত গলায় বললাম, ডাক্তার, আমি কি মারা যাচ্ছি?
ডাক্তার ভেচ নির্বিকার গলায় বললেন, হ্যাঁ।
শাওনের দিকে তাকিয়ে দেখি, সে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে। আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম।
মারা গেলে করার তো কিছু নেই। কে সারা সারা!
ডাক্তার ভেচ হঠাৎই আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, তুমি একা তো মারা যাচ্ছ না। আমরা সবাই মারা যাচ্ছি। এই কারণে বললাম তুমি মারা যাচ্ছ। তবে খুব দ্রুত যে মারা যাবে, সে রকম মনে হচ্ছে না।
রোগের বাইরে ডাক্তারের সঙ্গে অনেক কথা হলো। ডাক্তার বললেন, তুমি পেশা কেন বদলেছ? ছিলে কেমিস্ট, হয়েছ লেখক।
আমি বললাম, পৃথিবীতে অনেক কেমিস্ট আছে, সে তুলনায় লেখক কম বলেই পেশা বদলেছি।
আমার ছেলেও কেমিস্ট। তার কেমিস্ট্রিতে তোমার মতো পিএইচডি ডিগ্রি আছে। লেখালেখির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তোমার কোনো বই কি ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে?
আমি বললাম, হয়েছে। তবে তোমার জন্য আমি আমার নিজের ভাষা বাংলায় লেখা বই নিয়ে এসেছি। এই বইয়ে কী লেখা তুমি কিছুই বুঝবে না। তবে তুমি যদি বইটা তোমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে সাজিয়ে রাখো, তাহলে আমার ভালো লাগবে। বইটার দিকে চোখ পড়লেই তোমার মনে হবে, অতি দূরদেশের বাংলা ভাষার এক লেখককে তুমি চিকিৎসা দিয়েছিলে।
ডাক্তার ভেচের হাতে বাদশাহ নামদার উপন্যাস তুলে দিলাম। তিনি বই হাতে নিয়ে বললেন, এই বই আমি আনন্দের সঙ্গে আমার লাইব্রেরিতে রেখে দেব।
শাওন একটু পরপর কেঁদে উঠছিল। ডাক্তার একসময় শাওনের পিঠে হাত রাখলেন। ভরসার এই স্পর্শ শাওনের জন্য প্রয়োজন ছিল।
পাদটীকা
একটা আলাদা স্যুটকেস ভর্তি করে আমি লেখালেখির প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম নিয়ে এসেছি। কাগজ, কলম, কাঁচি, গাম, ডিকশনারি এবং বেশ কিছু রেফারেন্স বই।
পুত্র নিষাদকে পাশে নিয়ে স্যুটকেস খুললাম। আমাদের দুজনকে চমকে দিয়ে স্যুটকেস থেকে একটা তেলাপোকা বের হলো। অসম্ভব প্রাণশক্তির এই পোকা বাংলাদেশ থেকে চলে এসেছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। তেলাপোকাটা আমার দিকে সামান্য এগিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। তার পাগুলো শূন্যে, পাখা মেঝেতে। কিছুক্ষণ পা নেড়ে সে স্থির হয়ে গেল। দীর্ঘ ভ্রমণ চমৎকারভাবে শেষ করে সে মৃত। আমি নিষাদকে বললাম, বাবা, দেখো, বেচারা মারা গেছে।
নিষাদ বলল, তেলাপোকাকে বেচারা বলতে হয় না। মানুষকে বেচারা বলতে হয়। তুমি যখন মারা যাবে, তখন বলবে বেচারা।
তেলাপোকার মৃত্যু এবং পুত্রের কথায় প্রতীকী কিছু কি আছে?
নিউইয়র্ক থেকে | তারিখ: ২৬-১০-২০১১
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো।