নিউইয়র্কের সাদা ভল্লুক
অতবড় জন্তুটাকে দেখে হঠাৎ সব গাড়ি থেমে গেল।
নদীর অনেক নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ। সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে নিউইয়র্ক শহরে ঢুকতে হয়। সুড়ঙ্গের মধ্যে ধপধপে শ্বেত পাথরে বাঁধানো চওড়া রাস্তা, নিওন আলো জ্বলছে, কে বলবে মাথার ওপর দিয়ে বয়ে চলছে বিশাল চওড়া আর গভীর নদী। মোটর গাড়িগুলো ঘোরানো রাস্তা দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে নেমে যায় সুড়ঙ্গে, তারপর নদীর নিচের রাস্তা দিয়ে একবারও না থেমে পৌঁছে যায় নিউইয়র্ক শহরে, ও রাস্তায় গাড়ি থামানো নিষেধ।
কিন্তু ওই বিশাল জন্তুটাকে দেখে সব গাড়ি থেমে গেল সারি দিয়ে। কতরকম হর্ন আর ভেঁপুর আওয়াজ হতে লাগলো। পিছনের গাড়ির লোক তো কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। তারপরে সবাই দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লো, দূরে সেই বিরাট সাদা জন্তুটা প্রায় সারা সুড়ঙ্গ জুড়ে আছে, দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে কি যেন দেখছে। বোধহয় চকচকে দেওয়ালে নিজের মুখ দেখতে চায়।
অতদূর থেকে ওটা যে কি জন্তু তা ভালো করে চেনা যায় না! কিন্তু নদীর নিচের রাস্তা বলেই প্রথমে মনে হলো কোনো জলজন্তু, কাছেই সমুদ্র, বুঝি কোনো অতিকায় সামুদ্রিক জীব। তাহলে কি সুড়ঙ্গ ভেঙে ঢুকেছে? সর্বনাশ, তা হলে তো জল ঢুকে এখুনি সবাই মরে যাবে। কিন্তু, এখনো তো কোথাও এক ফোঁটা জল দেখা যাচ্ছে না!
এদিকে নানান গাড়ির মধ্যে ছোট ছেলেমেয়েরা ভয়ে চিৎকার করছে। দু—একটি মেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল পর্যন্ত। অত লোকের চেঁচামেচি, অথচ জন্তুটার কোনোই ভ্রূক্ষেপ নেই। কেউ কেউ চেষ্টা করলেন গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে পিছন দিয়ে পালিয়ে যেতে। তখন আবার আরেক রকম গোলমাল, গাড়ির শব্দ, হর্ন, এই এই সাবধান, বাঁ দিক বাঁচিয়ে, দাঁড়ান আগে আমি পার হয়ে যাই! এই সব। তখন আবার হঠাৎ দেখা গেল, জন্তুটা অদৃশ্য হয়ে গেছে কোথায়!
জন্তুটার গায়ের রং সাদা, একেই সাদা পাথরের দেয়ালের পাশে ওকে খানিকটা অস্পষ্ট দেখাচ্ছিল, এখন যেন একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল। এত গাড়ির ভিড়ের মধ্যে জন্তুটা এদিকেই তেড়ে এসেছে ভেবে একদল লোক ভয়ের চোটে হেলপ হেলপ বলে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। আমি একটা গ্রে হাউন্ড বাসে বসেছিলাম, কাচের জানলা দিয়ে দেখলাম জন্তুটা লাফাতে লাফাতে সামনের দিকেই যেন চলে গেল।
পরের দিন সকালে আমেরিকার সব কাগজে হেড লাইন।
নিউইয়র্ক শহরে অদ্ভুত প্রাণী!!
সব কাগজেই আপশোস করে লিখেছে, ইস, এতগুলো মানুষ ছিল ওখানে, কেউ একটা ছবি তুলে রাখতে পারলো না! ক্যামেরা তো প্রায় সব আমেরিকানেরই মোটর গাড়িতে থাকে যখন, তখন জন্তুটার একটা ছবি তুলে আনার কথা কারুর মনে এলো না? সেই সঙ্গে অনেক গাঁজাখুরি গল্প, আর প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ! কেউ বলছে, জন্তুটাকে দেখতে একটা বেড়ালের মতো, তবে প্রায় দোতলার সমান উঁচু। কেউ বলেছে, না না, ওটা একটা গরিলা। একজন বলেছে, একটা নয়, ওখানে ছিল অন্তত তিনটে হাতি আর জিরাফে মেশানো এক ধরনের বীভৎস প্রাণী। আবার কেউ বলেছে, ওটা গরিলা নয়। আসলে কম্যুনিস্টদের গেরিলা বাহিনী ছদ্মবেশে এসেছে!
আমেরিকার সবচেয়ে বড় খবরের কাগজ নিউইয়র্ক টাইমসে ছাপা হয় ১২০ পাতা, তার অর্ধেক জুড়েই এই সব কথা। সেই সঙ্গে টেলিভিশন আর রেডিওতেও কান ঝালাপালা, আসল সত্যি কথা কেউ বললে না। আমি যেটা দেখেছিলুম ওটা একটা সাদা ভল্লুক। কি করে ওখানে এলো তা কে জানে!
তিনদিন পর আবার ওর খোঁজ পাওয়া গেলো। এবার ছবি—সমেত। নিউইয়র্ক শহরের বাইরেই দোতলা—তিনতলা রাস্তা আছে। তার মানে একটা রাস্তা, তার মাথার ওপর দিয়ে একটা রাস্তা, তার মাথায় আর একটা রাস্তা। সেই রকম একটা তিনতলার রাস্তার রেলিং ধরে দোতলায় দোল খাচ্ছে ভল্লুকটা। ধপধপে সাদা রং, বিশাল চেহারা, মুখখানা হাসি হাসি। ভল্লুকটা কাউকে তাড়া করেনি, কাউকে মারেনি, কিন্তু ভয়ে মোটরগাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করে ওখানেই দশজন লোক মারা গেছে। সেই সময় ভল্লুকটা কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায়।
এরপর তো শহরে আর কোনো কথা নেই। কি করে এলো ভল্লুকটা? কেউ বললো, উত্তরমেরু থেকে এসেছে ক্যানাডা পার হয়ে। কেউ বললো, কোনো চিড়িয়াখানা থেকে ভেঙে বেরিয়েছে! কিন্তু কোনো চিড়িয়াখানায় তো অতবড় ভল্লুক নেই, তাও সাদা ভল্লুক নেই। অনেকে আবার ভল্লুক চোখেও দেখেনি। আমাকে দু—একজন জিজ্ঞেস করলো ভাল্লুকের লেজ আছে কিনা, ভল্লুক কি খায়, এই সব। যেন, আমি ভারতবর্ষ থেকে এসেছি বলে সব বিষয়েই জানি। আসলে তো কিছুই জানি না, ভল্লুক বিষয়ে তো একেবারেই কিছু জানি না, তবে এইটুকু শুধু জানি যে ভল্লুক মাঝে মাঝে ইচ্ছে করলে মানুষের মতো কথা বলতে পারে। ওর তো প্রমাণ আছেই। বাঃ, সেই যে, দুই বন্ধুর কথা পড়েছি। বনের মধ্যে দিয়ে দুই বন্ধু যাচ্ছিল, হঠাৎ একটা ভল্লুক এসে পড়ায় এক বন্ধু তাড়াতাড়ি গাছে উঠে প্রাণ বাঁচালো। আর এক বন্ধু, যে গাছে চড়তে জানে না, সে মড়ার মতো শুয়ে রইলো মাটিতে। তখন ভল্লুক এসে তার কানে কানে বললো, যে বন্ধু বিপদের সময় তোমাকে ফেলে একা গাছে উঠে যায়, তাকে আর কখনও বিশ্বাস করো না!
যাই হোক, নিউইয়র্ক শহরে যদিও গাছপালা নেই, আমি বেশ ভয়ে ভয়ে ঘুরতে লাগলাম। সন্ধে হতে না হতেই ফিরে যাই বাড়িতে। অনেক লোক তো ভয়ে আর বাড়ি থেকেই বেরোয় না! সব সময় মুখে শুধু ভাল্লুকের কথা। এ—রকম কাণ্ড এ—শহরে কখনও হয়নি। অনেকদিন আগে একটা সিনেমায় উঠেছিল যে কিংকং নামে একটা বিরাট গরিলা এসেছিল নিউইয়র্কে, তার গায়ে এত জোর যে টান মেরে মেরে চলন্ত রেলগাড়ি থামিয়ে তুলে আছাড় মারতে পারত। এরোপ্লেন ধরে ভেঙে ফেলে মট করে। শেষ পর্যন্ত, পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু বাড়ি, এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং—এর মাথায় উঠে বসেছিল। কিন্তু সে তো গল্প! কিন্তু এ যে একেবারে জলজ্যান্ত সত্যিকারের একটা ভল্লুক!
মজা হলো পরের দিন। সকাল দশটার সময় ১৯/২০ বছরের একটি সুন্দরী মেমসাহেব অফিসে যাচ্ছেন, তাঁর গাউনে একটা বিরাট সাদা ভল্লুক আঁকা। ওমনি তাঁকে দেখবার জন্য রাস্তায় প্রচুর ভিড় জমে গেল। মেমসাহেবের মুখে গর্বের হাসি। পরদিনই হাজার মেয়ে ওই রকম ভল্লুক আঁকা গাউন পরে রাস্তায় বেরুলো। ওইটাই হয়ে গেল ফ্যাসান। ছেলেরা পরলো ভল্লুক আঁকা টুপি, ভল্লুক আঁকা পতাকা বিক্রি হতে লাগলো খুব। টেডি বিয়ার অর্থাৎ কাপড়ের তৈরি ভল্লুক আমেরিকার বাচ্চাদের প্রিয় খেলনা। হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে নিজের টেডি বিয়ারটা ছুঁড়ে রাস্তায় ফেলে দিয়ে মার কাছে বলে উঠলো, চাইনা খেলনা ভল্লুক, আমি সত্যিকারের চাই! অমনি চারপাশের বাড়ি থেকে সব বাচ্চারা নিজেদের খেলনা ভল্লুকগুলো ধপাধপ রাস্তায় ছুঁড়ে দিয়ে বললো, চাই না, চাই না খেলনা, আসল ভল্লুক চাই।
ভল্লুকটা দিন চারেক অদৃশ্য হয়ে ছিল। আবার তাকে দেখা গেল শহরের একেবারে মাঝখানে, সেন্ট্রাল পার্কে। সেন্ট্রাল পার্ক আমাদের কলকাতার ময়দানের মতো। বিরাট বড়। সেখানে এক জায়গায় বরফের ওপরে রঙিন পোশাক পরা ছেলেমেয়েরা স্কেটিং করে। হঠাৎ দেখা গেল, সেই বরফের মধ্যে সাদা ভল্লুকটা লুটোপুটি খাচ্ছে। হয়তো শহরে খুব গরম লেগেছিল, তাই খুঁজে খুঁজে বরফের জায়গায় এসে তার এত আনন্দ। আর, সঙ্গে সঙ্গে তো সেই ভয়ের হট্টগোল। মেয়েদের চিৎকারে মনে হতে লাগলো যেন শত শত কাচের গেলাস ভাঙছে। কয়েকজন অসীম সাহসী ছেলে দল বেঁধে এগিয়ে এলো ভল্লুকটার দিকে। কিন্তু ভল্লুকটা মেঘের ডাকের মতো একটা গুরুগম্ভীর আওয়াজ করে এক মুঠো বরফ ছুড়ে মারতেই ওরা মূর্ছা গেল! তারপর ওটা নিশ্চিন্তে হেলেদুলে পার্কের পেছন দিকের গাছপালার মধ্যে দিয়ে চলে গেল কোথায়!
এবার গভর্নমেন্টের টনক নড়লো। সত্যিই এরকম একটা বিপজ্জনক জন্তুকে শহরের মধ্যে এভাবে ঘুরতে দেওয়া তো নিরাপদ নয়। কখন কার ক্ষতি করে। একে ধরতেই হবে। সারাক্ষণ সাইরেন বাজিয়ে ঘুরতে লাগলো পুলিশের গাড়ি। আকাশে উড়তে লাগলো এরোপ্লেন ভাল্লুকের খোঁজে। টেলিভিশন কোম্পানির লোক দলে দলে ক্যামেরা নিয়ে ঘুরতে লাগলো। যদি এমন একটা অভূতপূর্ব ব্যাপারের ছবি তুলতে পারে। শহরের মেয়র ঘোষণা করে দিলেন, যে—কেউ ভল্লুকটাকে গুলি করে মারতে পারবে, সে দশ হাজার ডলার পুরস্কার পাবে।
সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদের ঝড় উঠলো, কেন ভল্লুকটাকে মারা হবে? ওকে জীবন্ত ধরা উচিত, মেরে ফেলা অন্যায়, অত্যন্ত অন্যায়। ও তো সত্যিই কারুর ক্ষতি করেনি এখনো, তা ছাড়া আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বাণী আছে, জাতি, ধর্ম, নির্বিশেষে যে কোন দেশের অধিবাসীরই স্থান আছে আমেরিকায়। ভল্লুক কি একটা জাত নয়? এবং ও কোনো না কোনো দেশের অধিবাসীও নিশ্চয়ই, ওকে মারা তো উচিতই নয়, বরং কেউ যদি হঠাৎ মারে তবে তাকে গুরুতর শাস্তি পেতে হবে, একথা ঘোষণা করা উচিত; বিশেষত নিগ্রোরা ওকে পেলেই মেরে ফেলবে। সাদা ভল্লুক কিনা। যে কোনো সাদা জিনিসের ওপরেই তো ওদের রাগ। যে জন্যে দুধের বদলে ওরা কালো জামের রস খায়। ভল্লুকটাকে যদি শেষ পর্যন্ত মারতেই হয়, আমরা মারবো, নিগ্রোরা যেন না মারে!
এ কথায় নিগ্রোরা তো রেগে আগুন। তারা বললো, সাদা লোকেরা এমন পাজি, সব সাদা জিনিসই ওরা নিজেদের দিকে টানতে চায়। তা ছাড়া ওটা সাদা ভল্লুক না হাতি! ভল্লুক আবার সাদা হয় নাকি। চিরকাল তো কালোই হয়ে এসেছে! আসলে ওটা ওদের কারসাজি, কিংবা বোধহয় কালো ভাল্লুকের গায়ে গাদা গাদা চুনকাম করেছে। যাই হোক, ভল্লুক দেখে ভয় পায় সাদা লোকেরাই। আমরা ভয় পাই না। যদি হার্লেম পাড়ায় (নিউইয়র্কের নিগ্রো পাড়া) ভল্লুকটা আসে, আগে আমরা পরীক্ষা করে দেখবো, ওটা কালো না সাদা, যদি সত্যিই সাদা হয়, প্রাণে না মারি, ওটার ঠ্যাং খোঁড়া করে দেবো।
এরপর, ভল্লুকটা সম্বন্ধে অনেক খবর আসতে লাগলো, কিন্তু কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে বলা মুশকিল। একজন বুড়ো মিস্তিরী বললো, সে ওটাকে দেখেছে রাত দেড়টার সময় শহরের উত্তর এলাকায়; আবার আর একজন দোকানদার বললো, সে সেইদিনই রাত দেড়টায় ওটাকে দেখেছে দক্ষিণ অঞ্চলে! দুটো জায়গার মধ্যে অন্তত পনেরা মাইলের তফাৎ, সুতরাং একই সময় দেখা যাবে কি করে! আবার এক ভদ্রমহিলা রাত্রিবেলা এক বাক্স কেক নিয়ে আসছিলেন, হঠাৎ কে ওটা তাঁর হাত থেকে কেড়ে নেয়। ভদ্রমহিলার ধারণা, ওটা ভল্লুকটারই কাজ।
ভল্লুকটার দেখা পাওয়া যাক না যাক, ওটাকে কেন্দ্র করে সাদা লোক আর নিগ্রোদের মধ্যে নতুন করে ঝগড়া বেধে গেল! নিউইয়র্কের মাটির তলা দিয়ে যে ট্রেন যায় তার নাম সাবওয়ে। সেখানে রেলগাড়ির কামরায় নিগ্রো আর সাদা সাহেবের মধ্যে তর্ক হচ্ছিল ভল্লুকটাকে নিয়ে। সাদা সাহেব বললেন, ভাই, সাদা ভল্লুকটাকে মেরে লাভ কি? তাছাড়া, কালো—সাদা এসব তফাৎ করা এখন উচিত নয়। আমেরিকাতে আমরা সবাই সমান হয়ে গেছি। পুরনো কথা ভুলে এসো আমরা বন্ধু হয়ে যাই।
চোপরাও! নিগ্রোটি বললেন। এখন মুখে খুব সাধুপুরুষের মতো কথা বলা হচ্ছে! তফাৎ যদি না—ই থাকবে, তবে তোমরা কথা বলার সময় ‘সাদা—ভল্লুক’ বলছো কেন? শুধু ভল্লুক বলতে পারো না? আমরা কি আমাদের ভল্লুককে ‘কালো—ভল্লুক’ বলি, না শুধু ভল্লুক বলি? সাদা জাতটাই এমনি খারাপ!
মুখ সামলে কথা বলো, জাত তুলে কথা বলো না বলছি!
বেশ করবো!
খবরদার!
তারপর আরম্ভ হয়ে গেল মারামারি। এরকম মারামারি ছড়িয়ে পড়লো সারা শহরে। নিগ্রো আর সাদা লোকে দেখা হলেই লড়াই শুরু হয়ে যায়। ভল্লুকটার এদিকে আর পাত্তা নেই। তবে, ভল্লুকটাকে পেলে সাদা লোকেরাই নিগ্রোদের আগে এবং নিগ্রোরা পেলে সাদা লোকদের আগে ওটাকে খুন করবে। তা প্রকাশ্যেই বলতে লাগলো।
আমি পড়লুম মহা মুশকিলে। আগে ছিল ভাল্লুকের ভয়। এখন মারামারির ভয়। যেখানেই দাঙ্গা শুরু হোক, আমার মার খাবার সম্ভাবনা। আমার গায়ের রং সাহেবদের মতো ফর্সাও নয়, নিগ্রোদের মতো কালোও নয়। আমাকে হয়তো দু’ দলই মারবে। আমার সাদা আমেরিকান বন্ধুরা বলতে লাগলো, তোমার ভয় কি। তুমি তো আর কালো নও। আবার নিগ্রো বন্ধুরা বললো, তুমি ভয় পাচ্ছো কেন, তুমি তো আর সাদা লোক নও! এ—দুটোর কোনোটা শুনেই আমার নিশ্চিন্ত হবার কথা নয়!
তারপর ভল্লুকটার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল হঠাৎ। একদিন আমি সিনেমা দেখতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। এখানে সিনেমা দুপুর দেড়টায় আরম্ভ হয়ে রাত দেড়টা পর্যন্ত চলে, একবারও থামে না। একটা লোক একবার টিকিট কিনে ঢুকে যতক্ষণ ইচ্ছে বসে থাকতে পারে। ঘুম ভাঙলো আমার একেবারে রাত দেড়টায়। সর্বনাশ! কি করে বাড়ি ফিরবো! যদিও সারারাত মাটির তলায় ট্রেন আর বাস চলে, কিন্তু রাস্তা যে প্রায় ফাঁকা, আর আমার বাড়ি যে গলির মধ্যে। উপায় নেই, বেরিয়ে পড়তেই হলো। বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখলাম দূরে একটা চলন্ত সাদা পাহাড়! সেই ভল্লুকটা। আমার আর তখন পালাবার উপায় নেই। শুনেছি, পালাতে দেখলেই বেশি তাড়া করে। হঠাৎ মনে পড়লো, মরা মানুষকে ভল্লুক ছোঁয় না। সঙ্গে সঙ্গে আমি মড়ার ভান করে রাস্তার ওপর দড়াম করে শুয়ে পড়লাম।
ভল্লুকটা আমার কাছে এসে চারপাশটা একটু ঘুরে দেখলো। আমি তখন নিশ্বাস বন্ধ করে আছি, ও এসে আমায় ভালো করে শুঁকে দেখলো, তারপর জিভ দিয়ে আমার গালটা চাটতে লাগলো। কি খসখসে ধারালো জিভ, ভয়ে আমার প্রাণ উড়ে যায় আর কি!
এরপর সেই আশ্চর্য কাণ্ডটি ঘটলো। ভল্লুক সম্পর্কে যা শুনেছিলাম, অর্থাই ইচ্ছে মতন ওরা মানুষের মতো কথা বলতে পারে, তার স্বকর্ণে প্রমাণ পেলাম। ভল্লুকটা বললো ঘর র র, হুঁ, রং করা নয়, খাঁটি চামড়ার রংই এরকম দেখছি। তুমি কোথাকার লোক হে?
আমি চুপ।
বলো না, এমন ফর্সাও—না কালোও—না কোন দেশে হয়?
আমি চুপ।
শিগগির বলো। তুমি যে মরোনি আমি জানি, বেশি ইয়ে করলে কামড়ে দেবো। তোমার দেশ কোথায়?
ভারতবর্ষ! আমি মিনমিন করে জানালুম।
ভারতবর্ষ? সে—দেশে সব লোকের এমন চমৎকার গায়ের রং হয়? শুধু ফর্সা আর শুধু কালো লোক দেখে দেখে চোখ পচে গেল! তোমাদের দেশের সবারই গায়ের রং এ—রকম?
হুঁ।
আমি তা হলে এদেশে আর থাকবো না। ভারতবর্ষেই চলে যাবো। ঘর র র র হুঁ, চলেই যাবো। তোমাদের দেশেই আমার ভালো লাগবে, ওখানে মধু খাবার জন্য মৌচাক আছে তো?
হ্যাঁ, অনেক।
বাঃ, আমি ভারতবর্ষেই যাবো তা হলে। এ মারামারির দেশে থাকবো না। তুমি কবে নিজের দেশে ফিরবে? ওখানে গিয়ে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে!
পরদিন সকালবেলা একেবারে বড় রাস্তায় মরা অবস্থায় ভল্লুকটাকে পাওয়া গেল। গায়ে সাতটা গুলির দাগ। সারা গায়ে রক্ত মেখে ভল্লুকটা করুণ—মুখে মরে পড়ে আছে। নিগ্রো কিংবা সাদা লোক কে ওটাকে মেরেছে, তা আর জানা গেল না।