নিঃসঙ্গ শঙ্খচূড়
চিঠিটা পড়ে ছিল টেবিলেই। মিস সোম সেটা আর খুললেন না, খোলার প্রয়োজন ছিল না,অনেকদিনের আশঙ্কা আজ সত্যি হয়েছে। যে-খারাপ খবরটার জন্য এতদিন ধরে ভয় পেয়েছেন আজ সেই খবর বয়ে নিয়ে এসেছে চিঠিটা। ব্যাংক এবার তাঁর বাড়িটার দখল নেবে। কিন্তু দখল নিতে চাইলেই তো আর পাওয়া যায় না! এটা তাঁর নিজের বাড়ি—এবং তাই-ই থাকবে। তাঁর হাতে যে ধার শোধ দেওয়ার মতো টাকা আছে তা নয়, তবে সোনাগয়না কিছু আছে। সেই সুন্দর জড়োয়া গয়নাগুলোই বাড়িটাকে বাঁচাবে।
সূক্ষ্ম কাজ করা মেহগনি কাঠের দেরাজের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। একটা টানা খুলে বের করলেন চোখধাঁধানো ঝিকমিকে জড়োয়া গয়নাগুলো। সেগুলো সযত্নে ভরে ফেললেন একটা ছোট্ট কালো ব্যাগে—পঞ্চাশহাজার টাকার গয়না। ‘দেখি, কী করে ওরা আমার বাড়ির দখল নেয়,’ ফিসফিস করে বললেন তিনি। জানলা দিয়ে দু-চোখ মেলে দিলেন বাইরে।
নীচের ঘাস-ছাওয়া লনে ঝরাপাতা হাওয়ায় উড়ে যায়, ঝোপের ফাঁকে উড়ে যায় ব্যস্ত চড়ুই, প্রায়-রিক্ত গাছের প্রশাখা থেকে ঝরে পড়ে নিঃসঙ্গ একটা হলুদ পাতা, তার বুকে হেমন্তের পরোয়ানা অদৃশ্য অক্ষরে লেখা।
মিস সোমের দৃষ্টি তখন অন্যমনস্ক। তাঁর মনোযোগ দেওয়াল-ঘড়ির বেজে চলা ঘণ্টার দিকে—ঘণ্টার শব্দ গুনছেন তিনি। অবশেষে সেই ছন্দোময় শব্দ থামল।
বেরোনোর সময় হল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি এগোলেন দরজার দিকে। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে সিঁড়ি নামতে শুরু করলেন।
নীচের বসবার ঘরে আলোছায়ার খেলা। একটা চেয়ারে পড়ে থাকা কাশ্মীরি শালটা তুলে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিলেন। হেমন্ত মানেই শীতের পূর্বাভাস। দুঃসময়ের ইশারা।
বসবার ঘরের আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন মিস সোম। আয়নার অন্ধকার দিঘিতে ভাসছে তাঁর ফরসা মুখ। সে-মুখের বয়েস এই মুহূর্তে যেন তিরিশবছর কমে গেছে। অনেক, অনেক দিন আগে, যখন দেওয়ালের লাগোয়া আইভি গাছটা এই এতটুকু ছিল, তখন তাঁর মুখের ছায়া আয়নায় এমনটিই দেখাত। এখন সেই আইভি গাছ গোটা বাড়িটাকে আঁকড়ে ধরেছে, ছেয়ে গেছে সারা দেওয়ালে।
বাহান্ন বছরের মিস সোম তাঁর বাইশ বছরের প্রতিবিম্বের প্রশংসা করলেন। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে উৎকর্ণ হলেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই প্রত্যাশিত শব্দটা শুনতে পেলেন।
ঢং।
এ-বাড়ির প্রাচীন দেওয়াল-ঘড়িতে পনেরোমিনিট অন্তর-অন্তর ঘণ্টা বাজে। কালো ব্যাগটা তুলে নিয়ে সদর দরজা খুলে বাইরে এলেন। ব্যাগটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে সদর দরজায় তালা দিলেন। সিঁড়ি নেমে এসে দাঁড়ালেন ঝরাপাতা ছাওয়া লনে।
রাস্তায় পা দিতেই একটা খালি ট্যাক্সি চোখে পড়ল। ড্রাইভার গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি টানছিল। মিস সোম ট্যাক্সির কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সে বিড়িটা ফেলে দিয়ে মিটার ডাউন করল। তারপর হাত বাড়িয়ে পিছনের দরজা খুলে ধরল। ছোট্ট ব্যাগটাকে দু-হাতে শক্ত করে ধরে ট্যাক্সিতে উঠলেন তিনি। ড্রাইভার নিজের আসনে বসতেই মিস সোম বললেন, ‘রেল স্টেশান।’
স্টেশনের বাইরে সাইকেল-রিকশার স্ট্যান্ডের কাছে ট্যাক্সি এসে থামল। ড্রাইভার নেমে পিছনের দরজা খুলে ধরে মিস সোমকে নামতে সাহায্য করল। তিনি তখনও কালো ব্যাগটাকে বুকে আঁকড়ে আছেন। ভাড়া নেওয়ার পর মিটার তুলতে-তুলতে ড্রাইভার ভাবল, বুড়ির ব্যাগের ভেতর ক’লাখ টাকা আছে কে জানে।
মিনিটদশেক পরেই একটা ট্রেন হাঁপাতে-হাঁপাতে স্টেশনে এসে ঢুকল। টিকিট কাটাই ছিল। কামরায় উঠে জানলার ধারে একটা সিট পেলেন মিস সোম। আয়েস করে বসে কালো ব্যাগটাকে কোলের ওপরে রাখলেন, আঁকড়ে ধরে রইলেন দু-হাতে। তাঁর এই অদ্ভুত আচরণে কামরার অন্য যাত্রীরা একটু অবাক হল। তাঁরা মুখ টিপে হাসতেও লাগল—তবে একজন বাদে। এই ‘একজন’ মিস সোমের সঙ্গেই ট্রেনে উঠেছে—একই স্টেশন থেকে। ছেলেটির বয়েস পঁচিশ-ছাব্বিশ। পরনে সাধারণ পরিষ্কার পোশাক। ট্রেন ছাড়তেই সে নিজের সিট ছেড়ে মিস সোমের পাশে গিয়ে বসল।
বৃদ্ধা ঘুরে তাকাতেই যুবকটি হাসল—সরল হাসি। উত্তরে ভদ্রতাবশে হাসলেন মিস সোম, এবং আবহাওয়া এবং ট্রেন-লেট-এর ব্যাপার নিয়ে দু-চারটে কথাও বললেন।
‘এর মধ্যেই বেশ শীত পড়ে গেছে। গতবার এ সময়ে তো রীতিমতো গরম ছিল।’ কথাপ্রসঙ্গে বলল যুবকটি।
‘কিন্তু এ সময়টা বেশ ভালো লাগে। ঠিক শীতও নয়, অথচ শীত-শীত আমেজ।’ খুশিমাখা গলায় বললেন মিস সোম।
সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ল যুবক। ট্রেন তখন ছুটে চলেছে ধু-ধু প্রান্তর চিরে।
গোধুলি পা বাড়ায় সন্ধের দিকে। প্রকৃতির শীত নিবারণ করতে ক্রমে কালো কোট হাতে এগিয়ে আসে রাত। কখনও পাহাড়, কখনও বুড়ো গাছ দুরন্ত গতিতে জানলার পাশ দিয়ে ছুটে যায়। ট্রেন সুষম ছন্দে দোলে এপাশ-ওপাশ। শোনা যায় ইঞ্জিনের মিষ্টি গম্ভীর হুইসল-এর শব্দ।
একইসঙ্গে মিস সোমের ক্লান্ত শরীর দুলতে লাগল। চোখ বুজে এল। কোলের ওপরে রাখা কালো ব্যাগের ওপর শিথিল হয়ে এল হাতের বাঁধন। কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য। আচমকা সোজা হয়ে বসলেন তিনি। ব্যাগটা শক্ত হাতে চেপে ধরে চকিতে চারপাশে তাকালেন। যাত্রীদের দেখলেন, দেখলেন পাশে বসা যুবকটিকে। সে তখন জানলা দিয়ে বাইরের ছায়া-অন্ধকারের দিকে চেয়ে আছে।
পরক্ষণেই তাঁর দিকে ঘুরে তাকাল যুবকটি। হাসি মুখে বলল, ‘ঘুম পেয়ে থাকলে ঘুমিয়ে নিন না—আপনাকে দেখে ক্লান্ত মনে হচ্ছে।’
সর্বনাশ! তা হলে ছেলেটা দেখেছে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!
‘না, না ঘুম পায়নি। হঠাৎই কেমন একটা ঝিমুনি এসেছিল। তা ছাড়া আপনার সঙ্গে কথা বলতে-বলতে ঘুমিয়ে পড়াটা আমার ঠিক হয়নি।’ মিস সোমের স্বরে ভদ্রতা মেশানো লজ্জা।
‘তাতে কী হয়েছে।’ হাসিমুখেই বলল যুবক, ‘কোথায় নামবেন আপনি?’
‘রূপনগর।’
‘আমিও ওখানেই নামব।’
কাকতালীয়?
রাত নেমেছে। দূরে ছুটে চলা আলোর বিন্দু মাঝে-মাঝে আঁধারে হারিয়ে যায়। আবার ফিরে আসে। মিস সোম আনমনা হয়ে পড়েন।
তাঁর চমক ভাঙে যুবকের কথায়।
‘রূপনগরে কোথায় যাবেন?’
‘স্টেশানের কাছাকাছি—’ ব্যাংকে যাব সে-কথা বলা ঠিক হবে না।
‘আত্মীয়ের বাড়ি?’
এত প্রশ্নও করতে পারে ছেলেটা?
‘না, একটা জরুরি কাজে।’ কালো ব্যাগের ওপর শক্ত হল মিস সোমের হাত।
ট্রেন থামল রূপনগরে।
যাত্রীরা ধাক্কাধাক্কি করে এগোল দরজার দিকে।
হুড়োহুড়ির মধ্যে নিজেকে, গায়ের চাদর, না কালো ব্যাগ, এই তিনটের মধ্যে কোনটা আগে সামলাবেন ভেবে পাচ্ছিলন না মিস সোম। সেই যুবকটি এগিয়ে এল তাঁকে উদ্ধার করতে, দিন না, ব্যাগটা আমি ধরছি।’
দ্বিধা। কিন্তু সে মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্য।
তারপর ব্যাগটা যুবকটির হাতে তুলে দিয়ে গায়ের চাদর সামলাতে-সামলাতে ট্রেন থেকে নামলেন মিস সোম।
তাঁর খোটখাটো ভঙ্গুর শরীর নিয়ে সবার শেষে নামতে বাধ্য হয়েছেন। তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে হেরে গেছেন প্রতিযোগিতায়। এবার স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তিনি পরপোকারী যুবকটির আশায় আশেপাশে তাকালেন। কিন্তু হতাশ হলেন।
কারণ যুবকটিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। হতবুদ্ধি চোখে অন্য যাত্রীদের ক্রমশ চলে যেতে দেখলেন মিস সোম। হুইসল দিয়ে ছেড়ে গেল ট্রেন, এবং অকস্মাৎ দু-হাতে মুখ ঢাকলেন তিনি। এক বিকৃত কান্নার চিৎকার বেরিয়ে এল তাঁর ঠোঁট চিরে।
প্ল্যাটফর্মে তখনও কাছাকাছি যাঁরা দাঁড়িয়ে ছিলেন সে-চিৎকারে চমকে উঠলেন। একজন দুজন করে ভিড় জমে গেল মিস সোমের চারপাশে। অসংখ্য প্রশ্ন তাঁকে লক্ষ্য করে ছুটে আসতে লাগল।
মিস সোম তখন ডাক ছেড়ে কাঁদছেন। তাঁর কান্নামেশানো গলায় উত্তরটা অস্পষ্ট হয়ে গেল। জনতা নানান আলোচনা করতে লাগল। অপেক্ষা করতে লাগল। অবশেষে সংবিত ফিরে পেলেন মিস সোম। বললেন, ‘আমার গয়না! পঞ্চাশহাজার টাকার গয়না! ওঃ—।’ চোখ মুছলেন তিনি: নামার সময় একটা ছেলেকে গয়নার ব্যাগটা ধরতে দিয়েছিলাম। সে ব্যাগটা নিয়ে পালিয়ে গেছে।’
অতএব পরিণতি পুলিশ।
কিছুক্ষণের মধ্যে রেলপুলিশের একজন অফিসার ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হলেন। কৌতূহলী জনতাকে সরিয়ে দিলেন। তারপর মিস সোমকে লক্ষ করে বললেন, ‘আসুন, স্টেশনমাস্টারের ঘরে আসুন।’
স্টেশনমাস্টারের ঘরে তাঁকে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। না, সেই যুবকটিকে মিস সোম চেনেন না, তার চেহারার নিখুঁত বর্ণনা দেওয়াও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তবে বয়েস পঁচিশ-ছাব্বিশ, গায়ের রং ফরসা, হাসিটা মিষ্টি।
এর বেশি মিস সোমের কাছ থেকে কিছুই আদায় করতে পারলেন না অফিসার। তারপর দুজন কৌতূহলী সহযাত্রীর জবানবন্দিও নিলেন তিনি। কিন্তু সেরকম কোনও সূত্র পাওয়া গেল না।
অবশেষে মাথা নাড়লেন অফিসার: ‘আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করব, মিস সোম। কিন্তু এগোনোর মতো তেমন কোনও ক্লু আপনি দিতে পারলেন না। আপনার ঠিকানা আর ফোন নাম্বার রেখে যান। কোনও খোঁজ পেলেই জানাব।’ একটু থেমে অফিসার আবার বললেন, ‘কিন্তু যা-ই বলুন অতগুলো গয়না নিয়ে এভাবে বেরোনো আপনার ঠিক হয়নি।’
‘কী করব? উপায় ছিল না। আমি গয়নাগুলো বিক্রি করতে এসেছিলাম। সেই বিক্রির টাকা দিয়ে ব্যাংকের ধার শোধ করতাম—ওদের কাছে আমার বাড়িটা মর্টগেজ দেওয়া আছে। ধার শোধের জন্যে ওরা আমাকে লাস্ট একমাসের নোটিশ দিয়েছে।’
‘যাকগে, মন খারাপ করবেন না,’ সান্ত্বনার সুরে বললেন অফিসার, ‘মনে হয় দু-চার দিনের মধ্যে আপনার গয়নার খোঁজ পাওয়া যাবে।’
আলোচনা শেষের ইশারা পেয়েও মিস সোম দাঁড়িয়ে রইলেন। কারণ জানতে সপ্রশ্ন হল অফিসারের দৃষ্টি।
‘আমার কাছে বাড়ি ফেরার পয়সাও নেই।’ লজ্জা-মেশানো নীচু গলায় বললেন মিস সোম।
‘ওহ-হো, আমার তো খেয়ালই ছিল না।’ তিনি ঘুরে তাকালেন স্টেশনমাস্টারের দিকে। স্টেশনমাস্টার আলোচনা সবই শুনেছেন। তিনিই মিস সোমের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করে দিলেন।
ফিরতি গাড়িতে মিস সোমকে ট্রেনে তুলে দিলেন অফিসার। মিস সোম তখনও আপনমনে বিড়বিড় করছেন, ‘এত চমৎকার ছেলেটা। কে বলবে তার মনে এই ছিল।’
মিস সোমের গয়না গেল, সেইসঙ্গে বাড়িটাও। তাঁর চোখে জল এল আবার। অফিসার তখনও তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, ‘মনখারাপ করবেন না। আপনার গয়না ঠিকই ফিরে পাবেন।’
সবুজ ঘাসের লনে ঝরাপাতার শব্দ, রাতের বাতাস তাদের চঞ্চল করে করে তুলেছে। বিশাল বাড়িটা অন্ধকার—চুপচাপ।
সদর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন মিস সোম। দরজা বন্ধ করলেন। বিশাল দেওয়াল-ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে ক্লান্তিকর ছন্দে: টিক-টিক-টিক।
আলোর সুইচের দিকে হাত বাড়াতেই চেয়ারের পাশে রাখা টেবিল-ল্যাম্পটা জ্বলে উঠল। চেয়ারে বসে থাকা পঁচিশ-ছাব্বিশের যুবকটি, ট্রেনে মিস সোমের ব্যাগটা যে সরিয়েছিল, হাসল মিষ্টি হাসি।
গায়ের চাদর নামিয়ে দিয়ে মিস সোম বললেন, ‘সেকি, এর মধ্যেই তুই ফিরে এসেছিস, তুষার?’
‘ট্রেনের হাজার চাকার চেয়ে চারচাকা জোরে ছোটে,’ তুষার উত্তর দিল, ‘তা রূপনগরে কেমন কাটল?’
‘দারুণ। ঠিক প্ল্যান মতো সবকিছু হয়েছে। রেলপুলিশের আদিখ্যেতা আর ধরে না। আমার ফেরার টিকিটের ব্যবস্থা করে অফিসার নিজে আমাকে ফিরতি ট্রেনে তুলে দিয়েছে। বলেছে, তোকে ধরবার জন্য দারুণ চেষ্টা করবে।’
‘কিন্তু কোনওদিনই পারবে না।’ তুষার শব্দ করে হাসল।
‘যা চেহারার বর্ণনা দিয়েছি তা দিয়ে তো নয়ই।’ বৃদ্ধা হাসিমুখে বললেন, ‘ওঃ, পুরো ব্যাপারটা কী সহজ! ভীষণ সোজা, নারে, তুষার?’
‘তা সত্যি, তরুপিসি। তোমার মতো একজন সরল নিষ্পাপ বুড়িকে দেখে যে-কেউই ঠকত—ওই অফিসার তো দূরের কথা।’
বিজয়ীর হাসি হাসলেন তরুলতা সোম। তারপর এগিয়ে গিয়ে টেবিলের ওপরে রাখা কালো ব্যাগটা তুলে নিলেন। ব্যাগটা টেবিলে তুষারই রেখেছিল। তিনি বললেন, ‘আহা রে আমার সোনার গয়না! তোদের ছেড়ে কি আমি থাকতে পারি?’ ব্যাগটা বলিরেখাময় গালে চেপে ধরলেন তিনি। চোখ বুজে বললেন, ‘এখন ওই ইনশিওরেন্সের টাকাটা—।’
‘পঞ্চাশহাজার টাকা,’ বলল তুষার, ‘অনেক টাকা।’
‘ব্যাংকের ধার শোধ দিয়েও অনেক থাকবে। তিনি ইনশিওরেন্স কোম্পানি আবার সন্দেহ করে বসবে না তো?’
‘করলে করুক, কিন্তু টাকা না দিয়ে ওদের পথ থাকবে না।’ সহজ সুরে বলল তুষার ‘অনিচ্ছে থাকলেও হাসিমুখে ওরা এসে টাকাটা তোমাকে গুনে-গুনে দিয়ে যাবে।’
‘হুঁ, তা দেবে।’ বৃদ্ধা হাসলেন। ব্যাগ খুলে একটা-একটা করে গয়না টেবিলে রাখলেন: ‘কী দারুণ গয়নাগুলো! প্রাণ থাকতে এগুলো বিক্রি করা যায়!’
‘সুন্দর তাতে সন্দেহ নেই, তবে আমার পছন্দ মালটিচ্যালেন টিভি।’
‘তা ঠিক। যার পছন্দ তার কাছে। কিন্তু এটা দ্যাখ।’ একটা পাথর বসানো অপূর্ব ব্রেসলেট তুলে ধরলেন বৃদ্ধা।
‘মালটিচ্যানেল টিভি এবং ক্যাশ টাকা।’ তুষার বলে চলল।
‘টিভি তো এই সেদিন কিনেছিস।’ মনে করিয়ে দিলেন তরুলতা সোম: ‘আর ক্যাশ টাকা? সে তো সময় হলেই আসবে। আমি আর ক’বছর আছি, বল?’
‘ক’বছর?’ তুষার মাথা নাড়ল, ‘অদ্দিন কে অপেক্ষা করবে! তা ছাড়া তোমার এই গয়না চুরি করে ইনশিওরেন্স কোম্পানিকে ঠকানোর প্ল্যানটাও তো আমারই, তরুপিসি। আমি না থাকলে কী করে—।’
‘হ্যাঁ, তুই না থাকলে, তোর মদ-জুয়া-পয়সা ওড়ানোর বদ নেশা না থাকলে, আজ আমি যা করলাম তা আমাকে করতে হত না।’ কঠিন স্বরে মুখিয়ে উঠলেন তরুলতা সোম, ‘তোর মতো লোভী অকৃতজ্ঞ আমি দুটি দেখিনি।’
‘হ্যাঁ লোভী,’ স্বীকার করল তুষার, ‘এবং চালাক।’ হেসে যোগ করল ও, ‘এরকম স্বভাব আমি কার কাছ থেকে পেলাম তাই ভাবছি।’
ব্রেসলেটটা ব্যাগে ভরে রাখলেন বৃদ্ধা, সেইসঙ্গে গয়নাগুলোও। তারপর ফিরে তাকালেন ভাইপোর দিকে।
‘কত চাস?’
‘এই তো আমার লক্ষ্মী পিসি। না, বেশি লোভ করব না। ইনশিওরেন্সের হাফ টাকা হলেই চলবে।’
‘আর বাকি হাফ আমি মারা গেলে পর। গয়নাগাটি আর বাড়িটার কথা তো বাদই দিলাম। হুম। তা ইনশিওরেন্স কোম্পানি টাকাটা দেওয়া পর্যন্ত তো অপেক্ষা করবি, নাকি?’
‘ধৈর্য ধরতে চেষ্টা করব!’ দাঁত বের করে হাসল তুষার।
ওকে বসিয়ে রেখে দেরাজে গয়নাগুলো তুলে রাখতে গেলেন মিস সোম, গজগজ করতে লাগলেন আপনমনে, ‘লোভের একটা সীমা থাকা দরকার, লোভের একটা…।’
আধঘণ্টা বাদে তিনি তুষারকে ডাকলেন রান্নাঘরে। খেতে। তিনি নিজে শুধু চা খেলেন।
‘এখনও রাগ পড়েনি, তরুপিসি?’ হেসে জানতে চাইল তুষার, ‘নাও, একটা টোস্ট অন্তত খাও।’
‘খিদে নেই।’ বলে তুষারের গোগ্রাসে খাওয়া দেখতে লাগলেন মিস সোম।
লোভী এবং চালাক। বড্ড বেশি লোভ, তবে সেই অনুপাতে ততটা চালাক নয়, ভাবলেন তিনি, মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।
তুষার ভাবল, ‘পিসিটা আমার মন্দ নয়। টাকাটা-পয়সাটা চাইলে রাগ করে বটে, কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই আবার রাগ পড়ে যায়।’ তারপর মালকড়ি দিয়ে দেয়।
দেওয়াল-ঘড়ির ঘণ্টার শব্দ হল।
তুষারের খাওয়া শেষ হয়ে আসে। পাঁউরুটি সে পছন্দ করে, মিষ্টি খেতেও ভালোবাসে, মাখনও তার প্রিয়। যেটা সে পছন্দ করে না সেটা তার তরুপিসি মাখনের সঙ্গে যত্ন করে মিশিয়ে দিয়েছেন—সেঁকো বিষ।