নিঃসঙ্গ পাইন – ৮

চারদিক বরফে ছেয়ে রয়েছে। লেকের পানি জমে কাচের মতো দেখায়। সামনে লন, পেছনের বাগান, দূরের ওই মাঠ—সব সাদা। ছোট-বড় সব গাছের মাথাগুলোয় বরফ জমে নানারকম আকৃতি নিয়েছে। কেবল রাস্তাগুলোয় গাড়ি করে নুন ছিটিয়ে দিয়ে যায়। গলে-যাওয়া বরফ রাস্তার দুপাশে জমে বাংলাদেশের কাদার মতো রঙ নিয়ে পড়ে থাকে।

সাকিনার খুব একা লাগে। উইক-ডেতে সারাদিনই প্রায় বসার ঘরে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। রান্নাবান্নায় সময় বেশি লাগে না, ঘরদোর গোছানো ও তেমন কিছু নয়, কারণ অগোছালো করার লোক তো নেই বাড়িতে। বরফের জন্য বাইরে বেরিয়ে হাঁটতে পারে না। বরফজমা ঠাণ্ডাটা এখানো তার ধাতস্থ হয়নি। সাতপুরু গরম-কাপড় পরে বেরোলেও খানিক পরে মনে হয় রক্ত সব জমে গেছে। তা ছাড়া বরফে আছাড় খাবারও ভয় আছে।

রাস্তাটা নুন ছিটোনো গাড়িগুলো সাফ করে দিয়ে যায়। কিন্তু বাড়ির দরজার সিঁড়ি আর বাগানের বরফ সাফ করার দায়িত্ব বাসিন্দাদের। রকিব সিঁড়ি আর বাগান মাঝে-মাঝে সাফ করে। সে তো বরফের ওপর দিয়েই দিব্যি হেঁটে যায়। সাকিনা তার সঙ্গে বেড়াতে বেরোবার সময় রকিবের হাত ধরে সাবধানে বরফের ওপরের ওই কয়টা পদক্ষেপ পার হয়। আরো কয়েকজন প্রতিবেশিনীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে- লুচিয়া, রিভা, রোজ, প্যামেলা। কিন্তু এখন ওরা নিজে থেকে তার বাসায় না এলে সে বরফ মাড়িয়ে যেতে ভয় পায়। ওরাও খুব বেশি আসে না। এদেশের সবাই বড় ব্যস্ত। ফ্রিডা একটু বেশি আসত, তা সেও গেছে বাংলাদেশে বেড়াতে- একমাসের জন্য। ইস, সে যদি যেতে পারত ফ্রিডার সঙ্গে। এখানে তার সবচেয়ে বেশি ভাব হয়েছে ফ্রিডার সঙ্গে। মেয়েটির আদি দেশ গ্রিসে দুই পুরুষে আমেরিকাবাসী। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মেয়ে। সে কারণে ওর গায়ের রঙ চাঁপাফুলের মতো। ভুরু কালো কুচকুচে। খাস আমেরিকান নয় বলেই বোধহয় সে অন্য আমেরিকান মেয়েদের চেয়ে বেশি মিশুক ফ্রিডার পাশের বাড়িতে থাকে লুচিয়া, তারো আদি দেশ ইতালিতে। সেও দুই পুরুষে আমেরিকাবাসী। তারও গায়ের রঙ মোলায়েম মাখনের মতো, ভুরু কালো। সেও খুব মিশুক। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এরা সবাই চাকরি করে। এখন ফোনেও খানিক গল্প করা যাবে না। অবশ্য রোজ চাকরি করে না। তাকে ফোন করে খানিক গল্প করা যায়। কিন্তু মুশকিল হল, সামনা-সামনি ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে যদিবা সে ওদের কথা মোটামুটি বোঝে, ফোনে খুব কম বোঝে।

সুমিতটা যদি থাকত, তাহলে তার সময় কোথা দিয়ে কেটে যেত টেরই পেত না। সুমিতের জন্য বুকটা টনটন করে উঠল। বাড়ি বদলানোর উত্তেজনায় নতুন ভালোবাসার সুখে কিছুদিন শোকটা একটু চাপা পড়েছিল। রকিবও যেন কিছুদিন খুব বেশি মনোযোগী,খুব বেশি বিবেচক হয়ে উঠেছিল। বাসায় থাকতও বেশি। হাসপাতাল থেকে ছুটিও নিয়েছি; একটু ঘন। তাছাড়া এর মধ্যে ক্রিসমাসের ছুটি গেল। সে সময়টাও খুব হৈচৈতে কেটেছে। ২৫ ডিসেম্বর এদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন- এরা উচ্চারণ করে যিশাস ক্রাইস্ট। সারাদেশটা যেন উৎসবে মেতে উঠে। তোড়জোড় শুরু হয় নভেম্বর মাস থেকেই। তার জের চলে ৩১ ডিসেম্বর নববর্ষের রাত পর্যন্ত। এদের উৎসবে এরা প্রবাসীদেরও টেনে নেয়। ক্রিসমাসের ডিনারে চেনাজানা সবাইকে ডাকে। অন্য ধর্মের প্রবাসীরাও ‘নিউ ইয়ার্স ইভ’ অনুষ্ঠানটা খুব জাঁকিয়ে করে। তা সেই কটা দিনের উৎসব শেষ হতেই আবার যে-কে-সেই।

চারদিকে বরফের মধ্যে বন্দিনী একাকী সাকিনা। এখন আবার রকিবের কাজের চাপ বেড়েছে। ভোরে সাতটায় বেরিয়ে যায়। ফিরতে ফিরতে কোনোদিন রাত সাতটা-আটটা। প্রায় প্রতি শনিবারেই কাজ করতে হয়।

হঠাৎ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল সাকিনা। সুমিতের জন্য হাহাকারে বুকটা যেন খানখান হয়ে যাচ্ছে। কী করে কাটাবে সে জীবন এই নির্বান্ধব, নিরানন্দ, নির্জন বিদেশে?

ঝনঝন করে ফোন বেজে উঠল। সাকিনা চমকে কান্না থামিয়ে চোখ মুছতে মুছতে উঠে গেল। রান্নাঘরের দেয়ালে ঝোলানো ফোনের রিসিভার তুলে ভারী গলায় বলল, ‘হ্যালো।’

‘কী করছিলে? ঘুমুচ্ছিলে নাকি? ফোন ধরতে এত দেরি হল যে?’

‘ঘুমুইনি।’

‘গলা ভারী কেন? নিশ্চয় মন খারাপ করে কাঁদছিলে?’

রকিবের গলার সামান্যতম সহানুভূতিতে আরো একরাশ পানি ঝরে পড়ল সাকিনার দুইচোখ দিয়ে। সাকিনা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে উঠল, ‘আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না। এত একা-একা থাকা যায়?’

‘জানি সোনা, কত কষ্ট তোমার। কিন্তু কী করব বলো? আর দুটো মাস—তার পরেই সব বরফ গলে যবে, চারদিকে গাছে গাছে নতুন পাতা গজাবে, ফুলগাছে কুঁড়ি আসবে—বসন্তকালের আর দেরি নেই। তখন তোমার খুব ভালো লাগবে। এদেশে শীতকালে সবার একই অবস্থা। এইজন্যই তো এখানে শীতেই ভালো-ভালো প্রোগ্রাম থাকে টিভিতে। টিভি দেখ না কেন বসে? ২৪ ঘণ্টাই তো টিভি চলে।

‘কীজন্যে ফোন করেছিলে?’

‘এমনি। কী করছ খোঁজ নিতে। ভাগ্যিস করেছিলাম। এইতো কাঁদছিলে একা-একা। ও হ্যাঁ, শোনো একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে। বাড়িতে একটা ডিনার লাগালে কেমন হয়? আমার এক পুরনো বন্ধু ক্যালিফোর্নিয়া চলে গেছিল, সে আবার ফিরে এসেছে নতুন বউ নিয়ে। শনিবার রাতে ওকে দাওয়াত করি? ওই সঙ্গে আর্নি আর সাইফকে। কী বল?’

‘মন্দ কী?’

‘তাহলে ওই কথা রইল। আমি সন্ধেয় এসে সব ঠিক করব। তুমি এর মধ্যে ভাবতে থাক কী কী রাঁধবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *