নিঃসঙ্গ পাইন – ৫

সুমিতকে নিয়ে একেবারে সময় পায় না সাকিনা। কতদিন যে চিঠি লেখা হয় না মেজো ভাইজানকে। আজ সকালে সুমিতকে খাইয়ে, দৃঢ়সংকল্প হয়ে অন্য সব কাজ ফেলে সে চিঠি লিখতে বসেছে। পাক জোনাবেষু মেজো ভাইজান, আমার শতকোটি সালাম নিবেন—এই পর্যন্ত লিখে সে বহুক্ষণ বসে রইল। মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে তারপর লিখতে শুরু করল—এবারে আপনাকে চিঠি দিতে বেশ দেরি হল। সঙ্গত কারণেই খুব ব্যস্ত ছিলাম। টেলিগ্রামে জেনেছেন সেটা। এখন খোকাকে নিয়ে বাড়িতে এসেছি। এখানে তো মা, খালা, শাশুড়ি, বোন কেউ নেই সব কাজ নিজেদেরই করতে হয়। চাচী-শাশুড়ি ছিলেন একজন এখানে, তিনিও শিকাগো চলে গেছেন। ছোট বাচ্চা যে মানুষকে এত ব্যতিব্যস্ত রাখতে পারে, তা আগে কখনো কল্পনাও করিনি। এইটুকু ছোট মানুষ, উলটে পাশ ফেরার ক্ষমতা নেই। কিন্তু তার দাপটে আমরা দুটো বড় মনুষ্যি একেবারে তটস্থ। রাতের ঘুম, দিনের আরাম সব বন্ধ মহারাজের হুকুমে। মেজো ভাইজান, আপনার ভাগনে মোটেও আপনার মতো ঠাণ্ডা হয়নি। আপনি নিশ্চয়ই তর্ক তুলবেন——তুই কি আমাকে আমার ছোটবেলায় দেখেছিলি? কেমন দুষ্টু ছিলাম, সে তো শুধু আমার মা-ই বলতে পারবে।’ মানি, আপনিও হয়তো বাচ্চা বয়সে এমনি দুষ্টু ছিলেন, আপনার মাকে এমনি ব্যতিব্যস্ত রাখতেন—’

‘কী এত মনোযোগ দিয়ে লিখছ?’

সাকিনা চমকে মাথা তুলল, ‘ওমা তুমি। কখন ঢুকেছ, টেরই পাইনি!’

‘টের পাবে কী করে? যা মনোযোগ দিয়ে লিখছিলে। কাকে লিখছ?’  

‘মেজো ভাইজানকে। সুমিত একটু ঘুমিয়েছে, তাই এই ফাঁকে—’

রকিব আরো কাছে এসে সাকিনার ঘাড়ের ওপর ঝুঁকে পড়ল ‘তুমি মেজোভাইকে খুব চিঠি লেখ। উনিও দেখি খুব রেগুলার লেখেন তোমাকে।’ রকিব ডানহাতের আঙুল দিয়ে চিঠিটা একটু ঘুরিয়ে পড়তে লাগল। সাকিনা অপ্রসন্ন মুখে চুপ করে রইল। কোনো কোনো বিষয়ে রকিব এত স্থুল যে তার ভালো লাগে না। চিঠিটা পড়ার আগে তার তো একবার বলা উচিত ছিল—পড়ব? তার খুব লজ্জা লাগে তার লেখা চিঠি অন্য কাউকে পড়তে দিতে। কত বানান ভুল থাকে, বাক্যগঠন ঠিকমতো হয় না। সে ছোটবোন আমিনা আর মেজোভাইকে লম্বা-লম্বা চিঠি লেখে, কিন্তু কখনো রকিবকে দেখায় না। মানে দেখানোর অবকাশ হয় না।

এখানে সর্বত্র বাড়ির সামনে প্রত্যেকের আলাদা চিঠির বাক্স থাকে, চিঠি লিখে সেখানে রেখে দিতে হয়। পোস্টম্যান চিঠি বিলি করার সময় ঐ চিঠি নিয়ে যায় পোস্ট করার জন্য। রকিব হাসপাতালে থাকাকালীন সাধারণত সকালবেলাতেই সাকিনা চিঠি লিখে বাক্সে ফেলে। পোস্টম্যান রোজ এগারটার দিকে আসে। মা বাবা বোন বা মেজো ভাইয়ের চিঠি এলেও সাকিনাই আগে হাতে পায়। সে চিঠি পড়ে তার একটা ছোট সুটকেসে রেখে দেয়। রকিবকে লেখা চিঠি তাকে দেয়, নিজেরটা দেখায় না। এই নিয়ে কখনো-কখনো রকিব হাসিচ্ছলে ঠাট্টাও করেছে। কিন্তু সাকিনার বাপের বাড়িতে কেউ কারো চিঠি পড়ে না। এই অভ্যেসটাই তার গড়ে উঠেছে। আজ সুযোগ পেয়ে রকিব তার বিনানুমতিতে চিঠি পড়ছে এমন ভাব দেখিয়ে যেন এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু সাকিনার এটা পছন্দ হচ্ছে না।

চিঠি থেকে মুখ তুলে রকিব বলল, ‘ মেজোভাই কি তোমার সৎভাই?’

‘মানে?’

‘এই যে লিখেছ আপনার মা-কে ব্যতিব্যস্ত রাখতেন, আপনার মা কথাটা কেন? মেজেভাইয়ের মা কি তোমার মা নন?’

‘ও এই কথা? মেজোভাই তো আব্বা-মার পালক ছেলে। মেজোভাইয়ের বাবা আব্বাজানের খুব জানী-দোস্ত ছিলেন। মেজোভাই হবার আগেই তিনি বাস-চাপা পড়ে মারা যান। মেজোভাইয়ের মা অনেকগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে খুব দুরবস্থায় পড়েন। তা ছাড়া আমরা তখন কেউই হইনি, শুধু বড় ভাই একা। পাঁচবছর হয়ে গেছে, মায়ের আর ছেলেপিলে হবার সম্ভাবনা ছিল না। তাই মা খুব আগ্রহ করে মেজোভাইকে পালক নেন। কিন্তু কী মজা জানো? দশবছর পরে আবার আমরা তিন ভাই-বোন হলাম। আমি যখন হই তখন মেজোভাইজানের বয়স দশবছর। মেজোভাইজানের কোলেপিঠেই আমি মানুষ। প্রথম অ আ ক খ-ও শিখি মেজোভাইজানের কাছেই। আমার পরে আরো দুটো ভাইবোন হওয়াতে মা-র শরীর খুব ভেঙে যায়, মা আমার যত্ন নিতে পারতেন না, তাই মেজোভাইজানই ছোট থেকে আমার দেখাশোনা করেন।’

রকিব একটু কাষ্ঠহাসি হাসল, ‘খুব ইন্টারেস্টিং তো! এত কথা আমার জানা ছিল না। আমি তো ভেবেছি মেজোভাই তোমার আপন ভাই।’

‘আপন ভাই-ই তো। এক মায়ের পেটের হয়তো নই, কিন্তু যেভাবে এক সংসারে মানুষ হয়েছি, তাতে সম্পর্ক মায়ের পেটের ভাইবোনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, বরং বেশিই।

রকিব কেমন এক অদ্ভুত গলায় হাসতে হাসতে ‘খুবই বেশি তা বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় না’ বলে বেডরুমের দিকে পা বাড়াল কাপড় বদলাবার জন্য।

কথাটা খট করে বাজল সাকিনার কানে। সে ভ্রূ কুঁচকে রকিবের দিকে চেয়ে রইল, কিন্তু কিছু বলার বা ভাবার অবসর পেল না। সুমিত হঠাৎ জেগে কেঁদে উঠল। সাকিনা ব্যস্ত হয়ে তাকে কোলে তুলে নিল। রকিব বেডরুম থেকে মুখ বের করে বলল, ‘কাঁদতে না-কাঁদতে কোলে তুলে নিলে? ওতে যে ওর অভ্যেস খারাপ হয়ে যাবে। প্ৰথমে খানিকক্ষণ কাঁদতে দেওয়া উচিত, অনেক সময় বাচ্চারা দু-এক মিনিট কেঁদে থেমে যায়। যদি না থামে তখন কোলে নেয়া যেতে পারে।’

সাকিনা বাচ্চাকে বুকে দোল দিতে দিতে ধমকের সুরে বলল, ‘তোমার মাস্টারি থামাও তো!’

রকিব অর্ধেক জামাকাপড় খোলা অবস্থায় এ-ঘরে চলে এল, ‘মাস্টারি মানে? আমার কথার ওপর তোমার আস্থা নেই? আমি একটা ডাক্তার বটে তো?’

‘তাই বলে উদ্ভট সব কথা বললে মানতে হবে?’

‘উদ্ভট?’

‘উদ্ভটই তো। এইটুকু বাচ্চাকে আলাদা একা ঘরে শোয়াচ্ছ। জানো সারারাত আমার ঘুম হয় না।

‘সে তোমার দোষ। এসব দেশে বাচ্চারা সবসময় আলাদা ঘরে আলাদা ক্রিবে ঘুমোয়। একেবারে জন্ম থেকেই। এসব দেশে তো কাজের লোক নেই, আত্মীয়স্বজনও থাকে না আমাদের দেশের মতো। বাচ্চা মানুষ করবার সমস্তটুকু দায়িত্ব পড়ে বাবা-মার ওপর। তাই একেবারে জন্মের দিন থেকেই বাচ্চার নিয়মিত অভ্যেস গড়ে তোলাতে হয়। আলাদা বিছানায় শোয়াতে হয়, রাতে শুইয়ে দেবার পর কাঁদলেও আর তুলতে হয় না—’

‘ইস, কী নিষ্ঠুর নিয়ম।’

‘যতটা নিষ্ঠুর ভাবছ, ততটা নয় কিন্তু আসলে। বাচ্চাটা ওই নিয়মে অভ্যস্ত হয়ে যায়, ওতেই সে সুখী! তাতে মা-বাবার ওপর চাপ পড়ে কম।’

সাকিনা গলায় আবদার ঢেলে বলল, ‘আমি কিন্তু সুমিতকে আজ নিজের বিছানায় রাখব। কাল রাতে ও বেশ কয়েকবার কেঁদেছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *