১৬
‘খুব ভালো মামী। আপনার বান্ধবী খুব চমৎকার মানুষ। একেবারে নিজের ছোট বোনের মতো করে দেখছেন।’
‘বলেছিলাম না? সুরেখা কিন্তু এখনো ওর ছোট বোনটাকে মিস করে। ভালোই হয়েছে।’
‘কিন্তু মামী, আমাকে যে একটা ট্রেনিং নিতে টেক্সাস যেতে হবে? আমি তো কখনো—’
‘আরে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তোমাকে কিছুই করতে হবে না। ওরাই তোমাকে প্রত্যেকটি ব্যাপারে নির্দেশ দিয়ে দেবে, কাগজপত্র রেডি করে সঙ্গে দেবে, প্লেনের টিকেট করে দেবে। টেক্সাসে হোটেল রিজার্ভ করে রাখবে আগে থেকেই। সেখানে এয়ারপোর্টে ওদের লোক এসে রিসিভ করবে। সব দেখবে একেবারে অঙ্কের মতো সোজা।
সাকিনা শব্দ করে হেসে ফেলল, ‘অঙ্ক বুঝি সোজা?’
‘খুব সোজা। টেক্সাসের কোন্ শহরে? কতদিনের ট্রেনিং?’
‘ডালাসে। এক সপ্তাহের।’
‘মাত্রে এক সপ্তাহের? আরে ছোঃ! এর জন্য তুমি এত ঘাবড়াচ্ছ? দুর, দুর। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। তুমি পলক ফেলবার আগেই দেখে যাবে ট্রেনিং শেষ করে ফিরে এসে গেছ!’
ফোন রেখে দিয়ে সাকিনা খানিকক্ষণ গালে হাত দিয়ে ভাবল। জোসেফিন সবসময় উৎফুল্ল, আশাবাদী। অথচ এঁর এমন হাঁপানি আছে যে, মাঝেমাঝে ভয়ানকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সাংঘাতিক কোনো অসুখওয়ালা মানুষরাই কি এইরকম উৎফুল্ল, আশাবাদী হয়? খালাম্মাকেও তাই দেখছে। এইরকম ঘাতক ব্যাধি বহন করেও তিনি সবসময় উৎফুল্ল, আশাবাদী।
না, সব সময় না। খালাম্মাও মাঝেমাঝে ভেঙে পড়েন, কান্নাকাটি করেন। তখন সাইফ, ফ্রিডা, জোসেফিন, শামু – সবাই মিলে ওঁকে সান্ত্বনা দিয়ে চাঙা করে তোলেন। সাকিনাও ওদের সঙ্গে যোগ দেয়।
খালাম্মার মতো মানুষ—যিনি সাকিনাকে এত সাহস দিয়ে-দিয়ে চাঙা রেখেছেন, তিনি যখন ভেঙে পড়েন, তখন তাঁকে সাহস দিতে গিয়ে সাকিনারও নিজেকে খুব শক্ত মানুষ, শক্তিশালী মানুষ বলে মনে হয়। নিজের মনোবল বেড়ে যায়। নিজের ওপর আস্থা বেড়ে যায়।
আবার ফোন বাজল। রকিবের চাচা শিকাগো থেকে ফোন করেছেন। রকিবের ক্যালিফোর্নিয়া যাবার কথা উনি জানতেন না। গতকালই মাত্র রকিব ওকে ফোন করে জানিয়েছে। সাকিনা ফোনে ‘হ্যালো’ বলা মাত্র চাচা বকাবকি শুরু করলেন, ‘তোমরা আজকালকার ছেলেমেয়েরা এমন স্বাধীনচেতা হয়েছ, একটা ডিসিশান নেবার আগে মুরুব্বিদের জানানো দরকার মনে কর না। রকিব যে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটে প্র্যাকটিস করতে চায়, সেটা তো তার আমাকে আগে জিজ্ঞেস করা দরকার ছিল। সে না-করুক, তুমিও তো ফোন করে শুধু খবরটা আমাকে দিতে পারতে।’
সাকিনা কী জবাব দেবে ভেবে পেল না। চাচা তিনি রকিবের, নিজেও ডাক্তার, বিশবছর এদেশে আছেন। রকিব যদি তাঁর পরামর্শ না চায়, সাকিনা কী করতে পারে? তিনিও তো প্রতি সপ্তাহে ফোন করে যোগাযোগ রাখেননি।
চাচা বলেই চললেন, ‘আর তোমাকেও বলিহারি যাই বাপু। স্বামীকে বশ করে নিজের কবজায় রাখতে পার না! কোন্ আক্কেলে ছেড়ে দিলে?’
সাকিনা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। চাচা এসব কী বলছেন? তাও বহুদিন পর হঠাৎ ফোন করে? আর এমন অপ্রাসঙ্গিক অভিযোগ। প্রাণপণে গলা নম্র রেখে বলল, ‘চাচা, এসব কী বলছেন? আপনারা তো আগে আমাকে কখনো কোনো বিষয়ে উপদেশ দিয়ে সতর্ক করেননি? কখনো তো হিন্টসও দেননি যে, রকিবকে বশ করে কবজা করে রাখার দরকার আছে? আজ হঠাৎ আমাকেই দোষ দিচ্ছেন?’
চাচা অসন্তুষ্ট গলায় বললেন, ‘এই তো—বলতে না বলতেই পালটা জবাব। তোমারও বাপু একগুয়েমি জেদ কম নেই। সে তো মিশিগানে থাকতেই দেখেছি। একটু মানিয়ে যাচিয়ে চলতে পার না? ট্যাক্ট ডিপ্লোম্যাসি কমপ্রোমইজ—এসব কথার মানেগুলিও বোধহয় কখনো শেখনি।’
‘চাচা, আপনি না-হক আমাকে দোষারোপ করবেন না। আপনাদের ছেলের সব কীর্তি আমি জেনে গেছি। স্ট্যানলিই আমাকে জানিেেয়ছে। স্ট্যানলিকে নিশ্চয় চেনেন? রকিবের আম্মা যখন মিশিগানে এসেছিলেন, তখন তো আপনার বাড়িতেই ছিলেন। রকিব, স্ট্যানলি উইক-এন্ড গুলো আপনার বাড়িতেই কাটিয়েছে। কথাবার্তা, বাকবিতণ্ডা, রকিবের মতিগতি ফেরানোর সবরকম চেষ্টায় স্ট্যানলিও ছিল।’
চাচা হঠাৎ যেন চুপসে গেলেন। সাকিনা হাঁপাতে হাঁপাতে থেমে গেলেও তিনি অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। তারপর বললেন, ‘মা গো। বুড়ো মানুষের দোষ নিয়ো না। তোমার ওপর আমাদের খুব ভরসা ছিল। তা স্ট্যানলি তো শুনেছিলাম মিরান্ডাকে বিয়ে করে মিশিগান থেকে চলে গিয়েছিল। ও আবার জুটল কোত্থেকে?’
সাকিনা প্রাণপণ চেষ্টায় গলা সহজ রেখে স্ট্যানলি-মিরান্ডার মিশিগান ফেরা থেকে আবার মিরান্ডার স্যানডিয়েগো চলে যাওয়ার সব ঘটনা চাচাকে বলল।
চাচা খুব বিচলিত গলায় বললেন, ‘এ তো ভারি সর্বনাশ হল দেখছি! এখন রকিবকে ঐ ডাইনির হাত হতে মুক্ত করা যায় কী করে? তুমি কি স্যানডিয়েগোতে চলে যাবে?’
সাকিনা শান্ত গলায় বলল, ‘চাচা, মিরান্ডা মোটেও ডাইনি নয়। সে খুব ভালো মেয়ে। রকিব যখন ওকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, আপনাদেরই উচিত ছিল তাতে মত দেয়া। কত বাঙালি ছেলে বিদেশি মেয়ে বিয়ে করে সুখে ঘর করছে না? আর আমি স্যানডিয়েগো চলে গিয়ে কী করতে পারি? সে তো ঝোঁকের মাথায় কিছু করেনি। খুব ভেবেচিন্তে প্রতারণার প্ল্যান-প্রোগ্রাম ঠিক করেই স্যানডিয়েগো গিয়েছে।’
চাচার কণ্ঠস্বর খুব হতবুদ্ধি শোনাল—’তুমি এখন কী করবে?’
‘আমি আপাতত একটা চাকরি নিয়েছি। দেখি কী করব। চাচা, আপনাকে একটা রিকোয়েস্ট। দেশে কাউকে এখন কিছু জানাবেন না।
তাই ভালো। দেশে কাউকে এখন না জানিয়ে দেখ কিছুদিনের মধ্যে রকিবের মতিগতি ফেরানো যায় কিনা চেষ্টা-চরিত্র করে।’
‘কে চেষ্টা-চরিত্র করবে? আমি? মরে গেলেও না। ঐ মিথ্যেবাদী প্রতারকের সঙ্গে মরে গেলেও আমি আর ঘর করব না। ‘
‘দেখ, দেখ, পাগলী মেয়ের রাগ দেখ। তা রাগ হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু মা জীবনটা তো আর—’
সাকিনার সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে কান্নার ঢেউ উথাল-পাতাল করে উঠল, সে চাচার কথার মাঝেই ফোন রেখে দিয়ে সেখানেই মেঝেতে বসে পড়ল। মুখে হাতচাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। রকিব, রকিব, এ তুমি কী করলে? এখনো তোমার জন্য আমার সমস্ত দেহ-প্রাণ-মন উন্মুখ হয়ে রয়েছে। রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুধু তোমারই বাহুবন্ধনের কথা, তোমার হাজারটা আদর-সোহাগের কথা মনে হয়ে আমার ঘুম আসে না। কিন্তু তবু, তবু আর আমি তোমার বাহুবন্ধনের মধ্যে ফিরে যেতে পারব না। তুমি একটি সরল অসহায় মেয়েকে পেছন থেকে অতর্কিতে তীর দিয়ে বিঁধেছ। ঐ মেয়ে আর তোমার জন্য বেঁচে উঠবে না। ঐ তীরের যন্ত্রণায় সে চিরজীবন ছটফট করবে কিন্তু তুমি হাজার চাইলেও আর তাকে বাঁচাতে পারবে না, আর তাকে আগের মতো ফিরে পাবে না। না না কিছুতেই না। কখনই না।
দরজার বেল রাজল। রান্নাঘরের দেয়ালে ঝোলানো এই ফোনটার পাশেই পেছনদিকের দরজা। সাকিনা চমকে মুখ তুলে দেখল, দরজার কাচের ওপাশে জাহানারার চেহারা। চোখ না-মুছেই সে দরজা খুলে দিল।
‘এই-যে মেয়ে, আবার তুমি মন খারাপ করে কাঁদছিলে?’
সাকিনা তাঁকে বলল চাচার সঙ্গে তার ফোনের কথাবার্তা এবং তার নিজের প্রতিক্রিয়া।
‘তুমি এখনো রকিবকে ভালোবাস। তাই না?
‘বাসি। কিন্তু ওর কাছে আর ফিরে যেতে পারব না কিছুতেই।’
জাহানারা ওর হাত ধরলেন, ‘তুমি না চাইলে কেউ তোমাকে বাধ্য করবে না।
আবার ফোন বাজল। চাচা আবার ফোন করছেন, কাতর গলায় বললেন, ‘মা গো, তোমার এই বুড়ো ছেলেটাকে ক্ষমা কর। আমি কিছু টাকা পাঠিয়ে দেই তোমার নামে?
‘না, না, চাচা, তার দরকার হবে না। আমি একটা চাকরি করছি। তা ছাড়া ব্যাংকে এখনো বেশকিছু টাকা আছে। গাড়িটা রকিব রেখে গেছে, গাড়ি চালাতে শিখেছি— কোনো অসুবিধে নেই। আপনি ভাববেন না।’
‘কিন্তু কথা দাও, দরকার হলে বলবে?’
‘বলব চাচা।’
ফোন রেখে সাকিনা জাহানারাকে বলল চাচা কী বলেছেন আর সে কী জবাব দিয়েছে। আমি উনার কাছ থেকে কিছুতেই সাহায্য নেব না। খালাম্মা, আপনার সাথে আমার অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে একটু আলাপ করতে চাই। যা মাইনে পাই, তাতে এত ভাড়ার বাসা রাখা একটু অসুবিধে। তা ছাড়া বাসাটা আমার পক্ষে বেশ বড়ও। এক বেডরুমের একটা অ্যাপার্টমেন্ট সস্তায় পেলে ভালো হত।’
‘শোনো, এই কন্ডো ছেড়ে তুমি যেয়ো না। তুমি খেয়াল করেছ কিনা জানিনা, এই কন্ডোমিনিয়াম কমপ্লেক্সের যে-এসোসিয়েশান, সেটা চালায় এই সব কন্ডোর মালিকরাই। অবৈতনিক সোস্যাল সার্ভিস বলতে পার। তার ফলে এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে বেশ ভালো সমঝোতা আছে, সবাই সবাইকে চেনে, একে অন্যের বিপদে এগিয়ে আসে। অ্যাপার্টমেন্টগুলোরও অফিস আছে। কেয়ার-টেকার আছে। তারা সবাই মাইনে-করা। অ্যাপার্টমেন্টের সবাই ভাড়াটে। তাই ভাড়াটাদের বেশির ভাগই কেউ কাউকে চেনে না। এখানে বেশির ভাগ লোক কন্ডো কিনেছে। ভাড়াটে খুব কম। তোমার মতো দু-চারজন মাত্র। এখানকার সবার সঙ্গে তোমার বেশ জানাশোনা ও হয়ে গেছে। তোমার মনের এই অবস্থায় নতুন জায়গায় গিয়ে আরো খারাপ লাগবে। তার চেয়ে এক কাজ কর না কেন? অন্য একটি সিঙ্গল মেয়েকে তোমার বাসায় রাখ। দুজনে ভাড়া শেয়ার করলে খরচও কম হবে, তোমারও অত একলা লাগবে না।’
মন্দ কী? কিন্তু তেমন মেয়ে আমি কেমন করে খুঁজব?’
‘তোমাকে খুঁজতে হবে না। আমি ফ্রিডা, জো, ডাই, লীনা—সবাইকে বলে রাখব। অনেক সিঙ্গল মেয়ে এভাবে শেয়ারে থাকতে চায়। দেখবে শিগগিরই একটা খোঁজ পাওয়া যাবে।
‘কিন্তু খালাম্মা, রান্নাঘর তো একটা। বাথরুমও।’
‘শোনো মেয়ে, বিলেতে আমেরিকায় একই বাড়িতে তিন-চারজন আলাদা আলাদা ভাড়াটে থাকে, তাঁরা সবাই নিজের নিজের সুবিধেমতো একই রান্নাঘর ব্যবহার করে, একই বাথরুম ব্যবহার করে, কোনো ঝগড়াঝাঁটি কথা-কাটাকাটি হয় না। এ দেশের লোকেরা এভাবে থেকে অভ্যস্ত। দেখবে, তোমার কোনো অসুবিধে হবে না।’