নয়
পরদিন সকালে ক্রীকের ধারে মাইনাররা সবাই কঠিন পরিশ্রম করছে। বেক ভুল বলেনি, ড্রাই মাইনিঙ সত্যিই শক্ত কাজ।
বাড ট্রেভার বেলচা দিয়ে পাথর লঙ টমের ওপর ফেলছে-ওর স্ত্রী ক্রীক থেকে বালতি ভরে পানি তুলে নিয়ে ঢালছে। বাড জানে এই ভারি কাজ তার বউ দুএক ঘণ্টার বেশি চালিয়ে যেতে পারবে না। তবু ওদের চেষ্টার ত্রুটি নেই।
রসি আর বেক ক্রীকের মাঝখানে কাজ করছে। একজন কাদা-মাটি সরাচ্ছে, আর অন্যজন নুড়ির ভিতর সোনা খুঁজছে।
জেক হেণ্ডারসন অনেকক্ষণ একটানা পরিশ্রম করে এখন একটা বড় পাথরের ওপর বসে কিছুটা জিরিয়ে নিচ্ছে।
প্যাটের বউ নেই যে ওকে সাহায্য করবে। একাই একমনে কাজ করে চলেছে ও। বেলচা দিয়ে পাথর তুলছে, আবার বেলচা রেখে বালতি দিয়ে পানি আনছে। পানি তোলার অভ্যাস নেই বলে হাতের পেশী আর কোমর ধরে গেছে। অবসর নেয়ার উপায় প্যাটের নেই। প্রীচারের অবর্তমানে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে মাইনাররা ওরই মুখ চেয়ে আছে। সে-ই যদি হাল ছেড়ে দেয় তবে রাত নামার আগেই কার্বন ক্যানিয়ন খালি হয়ে যাবে।
কাজের একাগ্রতায় কখন যে নিতা ওখানে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করেনি মাইনার।
‘প্যাট?’
আড়চোখে মেয়েটাকে একবার দেখে নড করল জনসন। কিন্তু কাজ থামাল না।
‘তুমি আমার ওপর রাগ করেছ, প্যাট?’
‘নাহ্,’ অন্যমনস্ক ভাবে জবাব দিল সে। ‘তোমার এমন মনে হলো কেন?’ কাঁধ উঁচাল মেয়েটা। ‘জানি না। তাহলে কি মামির ওপর রাগ?
মুখ কুঁচকে সোজা হয়ে বেলচায় ভর দিয়ে দাঁড়াল প্যাট্রিক। ও ভাল করেই জানে যা বলতে এসেছে সেটা বলার সুযোগ না পাওয়া পর্যন্ত মেয়েটা ওকে শান্তিতে কাজ করতে দেবে না।
‘না, তা আমি বলব না। ওকে ঠিক রাগ বলা চলে না।’
সমঝদারের মত মাথা ঝাঁকাল নিতা। ‘তোমার মনে ব্যথা দিয়েছে মা, তাই না? আমি জানি মনে ব্যথা পেলে কেমন লাগে। ‘তুমি যদি কাউকে ভালবাস, ওকে মুক্তি দাও। যদি ফিরে আসে তবে সে তোমার। যদি না ফেরে, তবে সে কোনদিন তোমার ছিল না।’
মনেমনে একটু চমকাল প্যাট। ওইটুকু মেয়ে এসব কথা কোথায় শিখল? অবাক হলেও ব্যাখ্যা চাইল না। বলল, ‘হয়তো তাই। কিন্তু ওসব কথা পরে হবে, কেমন? এখন আমার অনেক কাজ আছে।’ বেলচা তুলে ক্রীকের আলগা নুড়ির ওপর আক্রমণ চালাল সে।
‘তোমার ঘোড়াটা কিছুক্ষণের জন্যে আমাকে চড়তে দেবে?’
আবার কাজ থামাল প্যাট। ওর মাথায় বিভিন্ন চিন্তা না থাকলে হয়তো কারণ জিজ্ঞেস করত। কিন্তু নিতাকে তাড়াতাড়ি বিদায় করার জন্যে শুধু জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি একা জিন চড়াতে পারবে?’
লজ্জা পেল মেয়েটা। ‘জিন আগেই চাপিয়েছি।’
‘ঠিক আছে, তাহলে একটু বেড়িয়ে এসো।’
‘ধন্যবাদ, প্যাট।’ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর মুখ। চট করে ঘুরে ঢাল বেয়ে প্যাটের আস্তাবলের দিকে ছুটল ওয়ানিতা।
আমার যদি ওর মত প্রাণশক্তি থাকত! নিতার ছুটে চলা দেখে ভাবল প্যাট। লঙ টমের ওপর আরও পাথর চাপিয়ে বালতি করে পানি আনতে গেল ও।
পানি নিয়ে ফেরার পথে একটা বিকট চিৎকার শুনে থমকে দাঁড়াল। সাথে অস্ত্র না থাকায় বালতি ছেড়ে ছুটে গিয়ে বেলচাটা হাতে তুলে নিল। শব্দের উৎস খুঁজে পেয়ে আশ্বস্ত হলো। দেখল স্পাইডার স্মিথ তার ক্লেইমে এক পা তুলে ধেই-ধেই করে নাচছে আর খুশিতে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে।
‘পেয়েছি! পেয়েছি! আমি বড়লোক!’
পাউরুটির সমান আকারের একটা জিনিস হাতে পাগলের মত নাচছে ও। ‘দেখে যাও আমি কি পেয়েছি!’ জিনিসটা মাথার ওপর তুলে ধরল স্মিথ। ‘এডি! টেডি! দেখো ড্যাডি ঝর্না থেকে কি তুলেছে!’
‘তোমার হাতে ওটা কি, স্পাইডার?’ চিৎকার করল বেক। ‘কচ্ছপ?’
‘চাঁপা কলার কাঁদি!’ নাচতে নাচতেই জবাব দিল মাইনার। ‘কলাগুলো সব সোনার নাগিট! এত, যে গোনা যাচ্ছে না! ‘
‘শিট!’ বিস্ময় প্রকাশ করতেও একই শব্দ ব্যবহার করে রসি। হাতের যন্ত্রপাতি ফেলে স্মিথের দিকে ছুটল রসি আর বেক।
এডি আর টেডি আগেই পৌঁছে গেছে। স্পাইডারের হাতে বড় পিণ্ডটার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল টেডি, ‘ওটা কি, ড্যাডি?’
‘কিসের মত দেখাচ্ছে, বোকা পাঁঠা?’ খুশিতে ওটা শূন্যে ছুঁড়ে আবার লুফে নিল। ‘সোনা! এত সোনা সারা জীবনেও একসাথে দেখার সুযোগ পাবে না।’
অভিভূত ছেলেদের দিকে চেয়ে সে আবার বলল, ‘হাঁ করে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থেকো না, যাও, তৈরি হয়ে নাও-আমরা শহরে যাচ্ছি।’
‘আমরা?’ অবিশ্বাসে বিস্ফারিত হলো টেডির চোখ।
‘শহরে যাচ্ছি?’ এডি বলল।
‘হ্যাঁ, আমরা শহরে যাচ্ছি। স্মিথ পরিবার আজ আনন্দ করবে।’
নিজের ক্লেইমে দাঁড়িয়ে স্পাইডারের সাফল্যে প্যাটের মন খুশিতে ভরে উঠল। কার্বন ক্যানিয়নে সোনার খোঁজে এসেই স্পাইডারের সাথে ওর পরিচয়। ওই বুড়ো তাকে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে প্রচুর বাস্তব, আর অমূল্য উপদেশ দিয়ে সাহায্য করেছে। প্রতিদানে লোকটা কোনদিন কিছু চায়নি। সোনা যদি কেউ পায় তা ওরই পাওয়া উচিত।
ঢালের ওপর লণ্ডি-বাস্কেট হাতে মারিয়াকে দেখতে পেল প্যাট। মহিলা স্পাইডারের ক্লেইমের দিকে চেয়ে কয়েক সেকেণ্ড ওদের উল্লাস উপভোগ করল। তারপর তারের ওপর কাপড় শুকোতে দেয়ার কাজে ব্যস্ত হলো।
প্যাট জানে সোনার নেশায় অনেকে ভালবাসার মানুষের চেয়েও সোনাকে বেশি দাম দিতে শুরু করে। সেও কি তাই করছে? নিতা কি যেন বলছিল- ভালবাসলে তাকে মুক্তি দাও, ফিরে এলে সে তোমার? কাজ ফেলে ঢাল বেয়ে মারিয়ার দিকে এগোল সে।
কখন যে প্যাট কাছে এন্সে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি মারিয়া। কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে মেয়েটার কাজ করা দেখল ও। অনেক কথাই বলতে চায়, কিন্তু কাছে এলেই ওর সব কথা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। মনকে শক্ত করল মাইনার। আজ সে বলবেই।
‘মারিয়া?’
কাপড়ে ক্লিপ আঁটতে বাড়ানো হাতটা হঠাৎ থেমে গেল, কিন্তু সাড়া দিল না
‘গত কয়েকদিনে তুমি যেন আমার থেকে অনেক দূরে সরে গেছ। কেন, মারিয়া?’
‘কই না তো?’ কোন আবেগ প্রকাশ পেল না ওর স্বরে।
কিছুক্ষণ দুজনেই নীরব থাকল। বলার মত কথা খুঁজে পাচ্ছে না প্যাট। অগত্যা প্রসঙ্গ পালটাল।
‘আজকে ভাল এক তাল সোনা পেয়েছে স্পাইডার।’
‘হ্যাঁ। অন্তত একজন কার্বন ক্যানিয়ন ছেড়ে যাওয়ার সময়ে কিছু টাকা নিয়ে যেতে পারবে।’
‘অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে আমাদের সবারই কার্বন ছাড়তে হবে।’
কোন মন্তব্য করল না মারিয়া। কেবিনের দিকে রওনা হলো। নিচু হয়ে তার পেরিয়ে চট করে ওর পথ আটকে দাঁড়াল প্যাট।
‘বলো, আমার কি দোষ যে তুমি আমাকে পছন্দ করো না?’
‘কিছুই না।’
‘তাহলে আমাকে পছন্দ করো না কেন?’
‘কে বলল পছন্দ করি না?’
নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না প্যাট। ডার্বি ওদের এই ক্যানিয়নে থাকতে দেবে না—তাই ছাড়াছাড়ি হওয়ার আগে এখনই সে নিশ্চিত হতে চায়।
‘তাহলে বলো, তুমি আমাকে চাও?’
‘হ্যাঁ, চাই, চাই, চাই!’
আনন্দ রাখতে না পেরে দুহাতে মারিয়াকে জড়িয়ে ধরল প্যাট। মারিয়া সমস্ত শক্তি দিয়ে ওকে আঁকড়ে ধরে নিজের মনের সব সংশয় যেন নিঙড়ে বের করে দিতে চাইছে। প্যাটের বুকে মাথা গুঁজে আবেশে চোখ বন্ধ করে আলিঙ্গনটা পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করছে মারিয়া।
.
মাইনিঙের যেসব কাজে টিম ডার্বি নিজে অংশ নেয় তারমধ্যে চল্লিশ ফুট লম্বা ফ্লুইসের ওপর নজর রাখার কাজটাই ওর সবথেকে বেশি পছন্দ। এতে একটা- দুটো নাগিট নিজের পকেটে ভরার সুযোগ সে পায়। হ্যাঁ, নিজেরটাই চুরি করছে-কিন্তু ওর যতটা প্রয়োজন, হাত খরচার জন্যে তত টাকা জিম ওকে দেয় না। তাই এভাবেই সেটা পুষিয়ে নেয় ও। নীতির কোন বালাই টিমের নেই- বুড়ো না জানলেই হলো।
আজকে সুইসে কেবল গুঁড়ো সোনা উঠছে, কোন নাগিট নেই। সবাই জানে কোবল্ট ক্যানিয়নের সোনা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। শীঘ্রি ওদের আর কোথাও সরে যেতে হবে। কোথায়-তাও ওরা জানে, শুধু কয়েকটা খুঁটিনাটি সমস্যা মিটিয়ে নেয়ার অপেক্ষা।
ম্যাগিল এসে হাজির হলো ক্যাম্পে। ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে ছুটে টিমের কাছে গিয়ে কি যেন বলল। দু’তিনজন কর্মচারী মুখ তুলে তাকালেও মনিটরের প্রচণ্ড শব্দ ছাপিয়ে ওদের কথা শুনতে পেল না। কিন্তু বসকে দাঁত বের করে হাসতে দেখে বুঝল খারাপ কোন খবর আনেনি ফোরম্যান।
ম্যাগিলকে নিজের জায়গায় কাজে লাগিয়ে পাইন গাছের ভিতর দিয়ে ঘোড়া নিয়ে এগোল টিম। জঙ্গলের ভিতর মনিটরের শব্দ তেমন জোরালো নয়। গাছের পাতা আওয়াজ ঠেকাচ্ছে। ম্যাগিল ঠিকই বলেছিল। ওখানে একজন তার জন্যে অপেক্ষা করছে। মেয়ারের পিঠে মেয়েটাকে অত্যন্ত সুন্দর দেখাচ্ছে।
‘কোবল্ট ক্যানিয়নে স্বাগতম, ওয়ানিতা।’ ঘোড়ার পিঠে বসেই ঝুঁকে নাটকীয় ভঙ্গিতে কুর্নিশ করল টিম। ‘বড় মাইনাররা কিভাবে কাজ করে দেখতে এসেছ?’
নিরাসক্ত ভাবে কাঁধ উঁচাল নিতা। ‘হয়তো তাই।’
তোমার মা জানে তুমি কোথায় আছ?’ মেয়েটার পিছনে তাকিয়ে জঙ্গলে আর কাউকে দেখতে পেল না টিম।
‘মাকে বলতে হবে কেন?’ একটু রাগের সাথেই বলল নিতা। ‘ইচ্ছে মত আমি যখন যেখানে খুশি যাই।’
‘ভাল কথা। কিন্তু আমার মনে হয় না তোমার এখানে আসাটা সে পছন্দ করবে।’
‘আমি কচি খুকি নই। আমার বয়স সতেরো-ষোলো বছর বয়সেই মা বিয়ে করেছিল। তুমি কি মনে করো আমাকে অনুমতি নিয়ে বেরোতে হবে?’
‘না, না! আমি তা বলিনি!’ দুহাত উপরে তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করে হাসল টিম। ‘বুঝলাম তুমি নিজের ভালমন্দ নিজেই বুঝতে শিখেছ। বুড়ো আঙুল ঝাঁকিয়ে নিচের ক্যানিয়ন দেখাল সে। ‘এসেই যখন পড়েছ তোমাকে একটু ঘুরিয়ে দেখাব? দেখতেই তো এসেছ, তাই না?’
‘ক্ষতি কি?’
ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে এগোল টিম। ‘তাহলে এসো।’
মেয়ারের লাগামটা ঝাঁকি দিল নিতা। ওর ঘোড়া টিমকে অনুসরণ করল।
আর যা-ই হোক, গাইড হিসেবে টিমের দক্ষতা আছে বোঝা গেল। গাছের ফাঁক গলে বেরিয়ে ক্যানিয়নের উপরের দিকে আঙুল তুলে নির্দেশ করল সে।
‘পৌনে এক মাইল দূরে কোবল্ট ক্রীকের অর্ধেক পানি আমরা ঘুরিয়ে এদিকে নিয়ে এসেছি। দেখেছ?’ শব্দ তুলে হাসল ও। ‘ডিনামাইট দিয়ে ড্যাডি ক্রীকের পানি যেদিকে খুশি নিয়ে যেতে পারে।
‘পানি একটা খাঁজ দিয়ে ঢাল বেয়ে এসে তোমার ডানদিকে একশো গজ দূরে শেষ হয়েছে।’
ওদিকে তাকাল নিতা। ‘কিন্তু শেষ কিভাবে হবে? পানিকে কোথাও না কোথাও যেতেই হবে।’
‘নিশ্চয়। ওখানে তিন ফুট চওড়া একটা পাইপের ভিতর পড়ছে পানি। পাইপটা প্রায় খাড়া হয়ে নেমেছে। দশ ফুট নিচে পাইপটা সরু হয়ে দুফুট হয়েছে, আরও নিচে একফুটে দাঁড়িয়েছে। পানি যত নিচে নামছে গতি ততই বাড়ছে। পানির চাপ আর পাইপ সরু হওয়ার কারণেই এটা ঘটছে।’
‘ঠিক বুঝলাম না।’ মাথা নাড়ল নিতা। ‘আমিও বুঝি না, কিন্তু ড্যাডি তাই বলে।’
ক্যানিয়নের নিচে নেমে এসেছে ওরা। নিতাকে নিয়ে মনিটর আর সুইসের দিকে এগোল টিম। ডার্বির বিশাল কাণ্ডকারখানা দেখে অবাক হয়েছে মেয়েটা।
‘ওখানে ঢালের নিচে,’ বলে চলল টম, ‘একফুট পাইপের পানি একটা ফানেলের মধ্য দিয়ে চার ইঞ্চি হোস পাইপে ঢোকানো হচ্ছে। মনিটরের মাথায় পানির চাপ প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে দুশো পাউণ্ড। কোবল্ট ক্রীকের বাকি অর্ধেক পানি এই ক্যানিয়ন দিয়ে সুইসের ওপর দিয়ে বইছে। মোটামুটি সব ভারি কাজ ক্রীকের পানিই করছে। সুইসে পাথর চাপানোর কাজটাই কেবল আমরা করছি।’
চারপাশে তাকিয়ে মনিটরের ধ্বংসলীলা দেখে শিউরে উঠল নিতা। কার্বন ক্যানিয়নেরও এই অবস্থা হোক, এটা সে চায় না।
‘নরকের মতই দেখাচ্ছে,’ মন্তব্য করল ও।
টিমের মনে ওই মন্তব্য কোন ছাপ ফেলতে পারল না। সে গর্বের সাথে বলল, ‘এসব যন্ত্রপাতি দিয়ে আমরা দৈনিক বিশ টন পাথর থেকে সোনা বাছাই করে তুলতে পারি। এসব কার্বন ক্যানিয়নের মাইনারদের মত চুনোপুঁটির কাজ নয়।’
‘ঘোড়া থামাল টিম। অল্প দূরেই মনিটর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বাম্বা উলটো পাশের ঢালে পানির তোড় তাক করে কাজ করছে। সুইসটাও কাছেই। ওখানে ম্যাগিলের তত্ত্বাবধানে তিনজন বেলচা দিয়ে পাথর তুলছে। কিন্তু কাজের চেয়ে আরোহী দুজনের ওপরই কর্মচারীদের বেশি মনোযোগ। ওদের চোখেমুখে অশুভ অশ্লীলতার ভাব ফুটে উঠেছে। কিন্তু নিতা সেটা লক্ষ করল না—ওর মন এখন অন্যখানে।
হাত বাড়িয়ে মেয়ারের লাগাম ছিনিয়ে নেয়ায় বাস্তবে ফিরে এল নিতা। ঘোড়াটাকে টেনে নিজের কাছে এনে সামনে ঝুঁকল টিম। কুৎসিত একটা হাসি ফুটে উঠেছে ওর মুখে।
‘আমাদের ক্যাম্প দেখা তো শেষ হলো, এবার বলো তুমি আসলে কেন এসেছ।’
ওর স্বরে নতুন একটা ভাব খেয়াল করে নিতা চট করে মুখ তুলে তাকাল। ‘আমি-আমি বেড়াতে বেরিয়েছিলাম, ভাবলাম লোকজন যেসব কথা বলাবলি করছে তা নিজের চোখেই দেখে যাই।’
‘যুক্তিসম্মত কথা। না দেখা জিনিস দেখার সাধ থাকা খুব স্বাভাবিক। আমারও মনে একটা কিছু দেখার সাধ আছে।’ টিমের হাসি বিশদ হলো। ‘তোমাকে!’
মাথা নাড়ল নিতা। ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠেছে ওর চেহারায়। ‘বুঝলাম না। তুমি আমাকে আগেও দেখেছ।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু কাছে থেকে নয়। খুব কাছে।’
মেয়েটার চোখ বিস্ফারিত হলো। ঘোড়াটাকে স্পারের খোঁচায় আগে বাড়াবার চেষ্টা করল, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। এখন বুঝতে পারছে ভুল তার অনেক আগেই হয়েছে। এটা কার্বন ক্যানিয়ন নয়, আর টিম ডার্বি অত্যন্ত জঘন্য চরিত্রের লোক।
নিতার আত্মবিশ্বাস সম্পূর্ণ উবে গেছে। টিমের হাত থেকে লাগাম ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল। সামনে ঝুঁকতেই ওকে জড়িয়ে ধরল লোকটা। দুহাতে মাথায় আর কাঁধে অনবরত কিল মেরেও কোন লাভ হলো না, টেনে নিতাকে কোলে তুলে নিল ডার্বি। কুৎসিত উদ্দেশ্য প্রকাশ পাচ্ছে ওর ভাবে।
ঠেকাতে পারছে না নিতা। দেহের বিভিন্ন নরম জায়গায় খেলে বেড়াচ্ছে লোকটার হাত। চুমো খাচ্ছে-ভেজা ঠোঁটে আক্রমণ করছে যেন। ওর কাজে মমতার কোন চিহ্ন নেই। নিতা বুঝতে পারছে সামনে চুমোর চেয়েও খারাপ কিছু আসছে।
কিছু করার নেই জেনেও লড়ে চলেছে ও। সমানে হাত-পা ছুঁড়ছে। মেয়ারটা ওর লাথি খেয়ে লাফিয়ে উঠল। পিঠের ওপর অদ্ভুত ধরনের নড়াচড়ায় আতঙ্কিত হয়ে টিমের ঘোড়াটা ছুট দিল। নিতা আর ঘোড়া-দুটো একসাথে সামাল দিতে পারছে না। ক্যানিয়নের উপর দিকে ছুটছে ঘোড়া।
‘বাম্বা!’ চিৎকার করল সে।
ডাকটা দৈত্যের কানে পৌঁছেচে। এক নজরে পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে মনিটরের মুখ ঘোরাল ও। শক্তিশালী পানির তোড় ঘোড়াকে ঠেকিয়ে দিল। কয়েকজন কর্মচারী ঝাঁপিয়ে পানির পথ থেকে সরে গেল। বাকি লোক ভীত বিস্ফারিত চোখে ঘুরে দাঁড়ানো ঘোড়াটাকে ঘিরে ফেলল।
সম্পূর্ণ ভেজা অবস্থায় পাগলের মত হাসতে হাসতে শেষ পর্যন্ত ঘোড়াটাকে বাগে এনে ফেলল টিম। তারপর নিতাকে একহাতে জড়িয়ে লাফিয়ে নেমে পিছল মাটিতে টাল সামলাল। লোকগুলো আরও কাছে এগিয়ে এল।
‘দেখো আমি কি ধরেছি। কার্বন ক্যানিয়নের মেয়ে!’
‘আমাকে ছেড়ে দাও!’ রাগে আর ভয়ে চিৎকার করল নিতা।
‘খাসা মাল!’ কাদা মাখা এক কর্মচারী মন্তব্য করল।
ওকে কোথায় ধরলে, বস্?’ আরেকজন প্রশ্ন করল।
‘ও নিজের ইচ্ছায় এসেছে! মনে হয় আমাকে ছাড়া থাকতে পারেনি!’
হেসে উঠল সবাই।
ডার্বির কর্মচারীরা কার্বন ক্যানিয়নের লোকজনের মত স্থায়ী বাসিন্দা নয়। ক্ষণস্থায়ী লোক। ওরা ক্যাম্পেই অস্থায়ী বাঙ্কহাউসে থেকে কাজ করে। এবং মালিক ছাড়া আর কারও ধার ধারে না। অনেকেরই মাইনের ঘানি টানা ছাড়া জীবন বলতে আর কিছু নেই। লম্বা সময় পাথর টানা, তিন বেলা খাওয়া, ঘুমানো, আর হয়তো মাঝেমাঝে একটু তাস খেলেই ওদের দিন কাটে।
ওদের কিছু লোক বছরখানেকের মধ্যে নারী সঙ্গ উপভোগ করেনি। যারা করেছে তারা বাজারে মেয়ের সঙ্গই পেয়েছে। তাই ওদের কাছে ওয়ানিতা ফিশার জঙলী ফুলের মাঝে গোলাপের মত।
‘ওপরে উঠে পড়ো, টিম!’ গুণ্ডা প্রকৃতির ম্যাগিল উস্কাল।
‘চেরিটা খাও, বাছা!’ বয়স্ক একজন বলল।
‘শুনে রাখো, আমি কিন্তু সেকেণ্ড!’ বলে উঠল আরেকজন।
ম্যাগিল ওকে ধাক্কা দিল। ‘মস্তানি ছাড়ো। আমি নেক্সট!’
পালটা ধাক্কা দিল তৃতীয় বক্তা। ‘কে বলে তুমি আগে?’
‘সিনিয়রিটি বলে। আমি ফোরম্যান!’
‘আমার গায়ে জোর বেশি!’
দুজনের কেউ অধিকার ছাড়তে রাজি নয়। মারপিট বেধে গেল ওদের। বাকি লোকজন দুজনকেই উৎসাহ যোগাচ্ছে। উল্লাসে মেতে উঠেছে সবাই।
‘ম্যাগিল সেকেণ্ড,’ বলে হাসতে হাসতে নিতাকে মাটিতে ফেলে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল টিম। ‘ম্যাগিলই ওর খোঁজ এনেছিল। তারপর… অর্থপূর্ণ ভাবে সবার দিকে তাকাল ওদের বস্।
হাওয়া কোন্দিকে বইছে বুঝে দাঁত বের করে হাসল বাম্বা। খুশিতে মনিটর ছেড়ে এগিয়ে এল দৈত্যটা। মুহূর্তে আকাশের দিকে পানি ছুঁড়তে শুরু করল হোস পাইপ। পুরো ক্যাম্প ভিজে একাকার হলো।
ভয়ে ওয়ানিতার অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা। সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রাণপণে যুঝছে ও। টিমের বুকে ওর দুর্বল হাতের আঘাত পড়ছে। ওদিকে অমানুষটার ভ্রূক্ষেপ নেই। দেহের ওজন দিয়ে মেয়েটাকে মাটিতে চেপে ধরে সে হাত দুটোকে সক্রিয় করল।
ওর হাতের প্রচণ্ড টানে কলার থেকে কোমর পর্যন্ত ছিঁড়ে গেল ব্লাউজ। দুই হাঁটুর মাঝখানে ঠাণ্ডা অনুভব করল নিতা। টিমের ঊরু জোর করে ওর পা দুটো ফাঁক করার চেষ্টা করছে। লোকটাকে এখন আর সুদর্শন মনে হচ্ছে না-ওখানে ফুটে উঠেছে সাক্ষাৎ শয়তানের চেহারা। মুখ ফিরিয়ে নিল নিতা।
মনিটরের আওয়াজ ছাপিয়ে একটা প্রচণ্ড শব্দ হলো। প্রতিধ্বনির সাথে টিমের মাথা থেকে হ্যাটটা উড়ে গেল। নিতার ওপর থেকে দুঃসহ ওজনটা হঠাৎ সরে গেল। উঠে দাঁড়িয়েছে টিম। প্রথমে হ্যাটের দিকে তাকিয়ে পরে শব্দের উৎসের দিকে ফিরল ও।
প্রীচারের ঘোড়াটা ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। কোন তাড়া নেই। লম্বা লোকটার শার্টের বোতাম এখন খোলা। পরিচিত সাদা কলারটা আর ওর গলায় নেই। হ্যাটটা নিচের দিকে টানা রয়েছে বলে চোখ আর মুখের কিছুটা অংশ ঢাকা পড়েছে। এছাড়া টিম ওকে আগে যেমন দেখেছে ঠিক তেমনি আছে ও। একই বুট, ম্যাকিনও আর কালো শার্ট।
কেবল গানবেল্টের সাথে খালি খাপ আর হাতের পিস্তলটা নতুন।
‘প্রীচার!’ চিৎকার করল নিতা। এত জোরে চেঁচিয়ে ওঠায় ওর গলাটা চিরে গেল। কিন্তু এর প্রয়োজন ছিল না। লোকটা জানে ওখানে কি ঘটছে।
আনন্দ বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় রাগে টিমের চেহারা বিকৃত হয়েছে। শিকারি কুকুরের তাড়া খাওয়া কোণঠাসা চিতার মত সতর্ক চোখে শত্রুকে লক্ষ করছে ও। এই তৃতীয়বার ওই লোকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পিস্তলের দিকে হাত বাড়াল যুবক। কিন্তু ধীরে বা চিন্তাযুক্ত মনে নয়। এবার অনুশীলন করা দক্ষ হাতে ক্ষিপ্র গতিতে পিস্তল বের করল।
পিস্তলটা খাপ থেকে বের করার সঙ্গে সঙ্গে হাতে স্লেজের আঘাতের মত একটা প্রচণ্ড ধাক্কা অনুভব করল টিম। পরপর আরও তিনটে গুলির আওয়াজ হলো, কিন্তু একটাই লম্বা শব্দের মত শোনাল। অসম্ভব একটা ব্যাপার। হ্যামারটা যদি ওভাবে টানাও যায় পিস্তলের সিলিণ্ডার এত দ্রুত ঘুরতে পারে না।
কিন্তু তাই ঘটেছে। ডার্বির পিস্তলটা মাটিতে পড়ার আগেই দ্বিতীয় গুলির আঘাতে ঘুরতে ঘুরতে উড়েছে-তৃতীয় গুলিতে আবার ঘুরেছে-চতুর্থ গুলিতে বিস্ফোরিত হয়ে টুকরোগুলো ছড়িয়ে পড়েছে।
নিজের ডান হাতের দিকে টিমের নজর পড়ল। কব্জির একটু নিচে হাতের তালুতে লাল একটা গর্ত দেখা দিয়েছে। লাল ক্ষত থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত মাটিতে ঝরে পড়ছে। হাঁ করে তালুর দিকে তাকিয়ে আছে ও। অবাক বিস্ময়ে চোখের পাতাও ফেলতে পারছে না। ব্যাপারটা চোখের পলকে কিভাবে ঘটে গেল বুঝে উঠতে পারছে না। ওর থেকে অল্প দূরেই দাঁড়িয়ে আছে বাম্বা। নিরানন্দ চেহারা। আর সবার মত ছুটে পালায়নি ও, কিন্তু বাধা দেয়ারও চেষ্টা করেনি। ডার্বির পিস্তলের কি দশা হয়েছে তা সে দেখেছে।
ছোট একটা পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে চিন্তিত চেহারায় আক্রমণকারীকে দেখছে বাম্বা। মুখে রাগের কোন চিহ্ন নেই। আছে শুধু কৌতূহল।
উঠে দাঁড়াল নিতা। কাপড় থেকে কাদা-মাটি ঝেড়ে ফেলার মিছে চেষ্টায় বিফল হয়ে শেষে প্রীচারের দিকে দুহাত বাড়িয়ে দিল। একটু ঝুঁকে এক হাতে ওকে তুলে নিয়ে নিজের সামনে বসাল স্ট্রেঞ্জার।
প্রীচারের বুকে কাদা মাখা মুখ লুকাল নিতা। থরথর করে কাঁপছে ওর দেহ। ফোঁপানির মাঝে দমকে দমকে কাশি উঠছে। একটা কথাও বলল না লম্বা লোকটা। নীরবে এক হাতে শক্ত করে মেয়েটাকে ধরে রাখল।
ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ওয়াটার ক্যাননের ফোয়ারা ভিতর থেকে বেরিয়ে এল ওরা।
মনিটরের শব্দ ছাড়া ক্যাম্প থেকে আর কোন সাড়া আসছে না।