নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী – ৫

পাঁচ

বাঁকের আড়াল থেকে চড়া সুরে ট্রেনের সিটি বেজে উঠল। পরক্ষণেই বাঁক ঘুরে চটকহীন ছোট দালানটার দিকে এগিয়ে এল ট্রেন। ওটাই রেল স্টেশন। চিমনি দিয়ে সাদা ধোঁয়া বেরিয়ে এঞ্জিন পেরিয়েই কালো হয়ে যাচ্ছে।

গতি কমিয়ে স্টেশনে এসে ট্রেনটা থামল। স্টেশন-দালানের গায়ে পেইণ্ট করা সুন্দর একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে।

লেহুড, ক্যালিফোর্নিয়া-জনসংখ্যা ১৮৯

স্টেশনের সামনে ছোট্ট প্ল্যাটফর্মটা জনশূন্য। তবে কাছেই একটা গাছের তলায় রিসেপশন পার্টি অপেক্ষা করছে। দুজন মানুষ আর তিনটে ঘোড়া। টিম আর ম্যাগিলের মাঝখানে জিন চড়ানো তাগড়া কালো একটা ঘোড়া ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেনের সম্মানীয় যাত্রী জিম ডার্বির জন্যে আনা হয়েছে ওটা।

পোর্টার একটা কাপড়ের ব্যাগ হাতে নিচে নেমে যাত্রীকে সাহায্য করার জন্যে হাত বাড়াল।

‘সিঁড়িতে সাবধানে পা ফেলো, মিস্টার ডার্বি।’

‘কেন?’ তীক্ষ্ণ স্বরে জানতে চাইল ডার্বি। ‘আমরা স্যাকরেমেণ্টো ছাড়ার পর ওটা সরে গেছে?’

বাড়ানো হাতটাকে উপেক্ষা করে লাফিয়ে প্ল্যাটফর্মে নামল জিম ডার্বি। লোকটার বয়স বাষট্টি, ব্যাক-ব্রাশ করা রূপালি চুল, চৌকো চোয়াল, আর শিরদাঁড়াটা জাহাজের মাস্তুলের মত সোজা। এই পরিবেশে ইস্তিরি করা থ্রী-পীস স্যুট, মুক্তার বোতাম, আর সোনার ঘড়ির জন্যে সোনার চেন ঝোলানো জিমকে বেমানান দেখাচ্ছে।

পোর্টারের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে এগোল ডার্বি। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে বাবাকে অভ্যর্থনা জানাতে টিম ছুটে এল।

‘ওটা আমি নিচ্ছি,’ বলে হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা নিল। ছেলের অভ্যর্থনায় খুশি হয়ে নড় করল জিম।

‘মর্নিঙ, বাছা। ম্যাগিল।’

ডান হাতের তর্জনী দিয়ে হ্যাটের কানা ছুঁলো ফোরম্যান। ‘গুড মর্নিং, বস্। স্যাকরেমেণ্টোয় কেমন কাটল?’

‘একেবারে স্বর্গ। কাজের চিন্তা না থাকলে আরও সাতদিন কাটিয়ে আসতাম। ভাল খাবার, সোনা নিয়ে চতুর কথাবার্তা, পলিটিক্স-সব॥ একেই বলে সভ্যতা।’

‘মনে হচ্ছে তোমার দিনগুলো আনন্দেই কেটেছে, বস্।’

ফোরম্যানের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মাথা নাড়ল জিম। ‘তারচেয়েও বেশি, ম্যাগিল, কিন্তু আমি কিসের কথা বলছি তা বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই। আমি স্যাকরেমেন্টো সম্পর্কে এটুকুই বলব, যদি সোনার খনি থাকত, তাহলে ওখানেই থেকে যেতাম।’

‘ব্যবসা কেমন হলো, ড্যাডি?’

‘আমি যাওয়ায় আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি-বরং হয়তো ভালই হয়েছে। আইন পরিষদের সভা শেষ হলে নিশ্চিত জানা যাবে। তা, এদিকের ব্যবসা কেমন চলছে?’ ছেলে আর ফোরম্যানকে দুপাশে নিয়ে শহরের দিকে এগোল জিম।

‘পাঁচ নম্বর শাট্ থেকে এখনও নিচু জাতের আকর উঠছে। মনে হয় শিরাটা (Vein) প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।’

মাথা ঝাঁকাল ডার্বি। ‘হ্যাঁ, যাওয়ার আগেই আমি বুঝেছিলাম এই রকমই ঘটবে। আর কিছু?’

‘বারো নম্বর শাফটে আমরা আরও বিশ ফুট খুঁড়ে দেখেছি ওখানে ম্যাগনেটাইট (লোহার আকর) ছাড়া আর কিছু নেই। ওদিকে কোবল্ট ক্যানিয়নের সোনাও প্রায় শেষ।’

‘এগুলো সবই আমার জানা। কার্বনের কি খবর?’

ছেলেকে ইতস্তত করতে দেখে জিম ডার্বির চোখদুটো সরু হলো। ৰাগের দিকে চেয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হলো টিম।

‘দুদিন আগে কার্বনে আবার আমরা রেইড চালিয়েছিলাম। সাবা কিছু ভেঙেচুরে দিয়ে আসা হয়েছে। ওরা খুব ভয় পেয়েছে। মাইনাররা ভয়ে মুরগীর মত নিজেদের খোপে গিয়ে ঢুকেছিল—তাই না, ম্যাগিল?’

‘হ্যাঁ, তাই।’ ফোরম্যানের স্বরে উৎসাহ প্রকাশ পেল না। ‘ওদের এবার প্রায় তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। পশ্চিমের পাহাড়ের ওপর থেকে কিছু কিছু লোককে চলে যাওয়ার জন্যে প্যাক করতেও দেখা গেছে।’

‘তাই?’ শহরে যাবার রাস্তার ওপর থেকে চোখ না সরিয়েই বলল ডার্বি। কিন্তু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন আর কোন তথ্য এল না তখন ও ম্যাগিলের দিকে ফিরে আবার বলল, ‘তাই?’

ম্যাগিল অসহায় ভাবে টিমের দিকে তাকাল। বাপকে বলার মত কথা খুঁজে পাচ্ছে না ও। সে জানে কর্মচারীদের ওপর খবরদারি করার চেয়ে ড্যাডির কাছে ব্যাখ্যা দেয়া অনেক কঠিন। তবু চেষ্টা করল।

‘আমরা যা ভাবিনি তাই ঘটেছে। দেখা যাচ্ছে একজন স্ট্রেঞ্জার ওখানে এসে জুটেছে। ওই লোকটাই মাইনারদের মনে সাহস যোগাচ্ছে।’

‘সাহস জোগাচ্ছে? মাত্র একটা লোক? এ আবার কেমন কথা?’ ছেলের দিকে কটমট করে তাকাল ডার্বি।

‘জানি না, ড্যাডি, কিন্তু লোকটা তাই করছে।’

‘একজন স্ট্রেঞ্জার এসব করছে? কিন্তু আমি তো জানতাম জনসনই ওদের লীডার।’ অবাক হয়েছে ডার্বি।

ম্যাগিল বলে উঠল, ‘জনসনের ব্যবস্থা আমরা করে ফেলেছিলাম। ওকে ভাল মত শিক্ষা দিয়ে ছাড়তাম কিন্তু ওই স্ট্রেঞ্জারই বাগড়া বাধাল।’

অবিশ্বাসে মাথা নাড়ল ডার্বি। ‘তোমরাই ওকে বোঝাতে পারোনি আমরা কে, আর এই এলাকা কার হুকুমে চলে। সেটা ভাল করে বুঝিয়ে দিলে সে নিশ্চয় মানবে।’

‘নিশ্চয়,’ উৎসাহের সাথে বলে উঠল টিম। ‘এই এলাকায় কয়জন আর চার্চে যায়? একটা প্রীচার এখানে থেকে কি করবে? তুমি কোন চিন্তা কোরো না- আমি ব্যবস্থা করছি।’

‘প্রীচার?’ ডার্বির স্বরটা ভয়ানক রকম নিচু শোনাল। ‘অপদার্থের দল! প্রীচারকে কেন তোমরা কার্বন ক্যানিয়নে ঢুকতে দিয়েছ?’

‘সামান্য একটা প্রীচারকে নিয়ে এত দুশ্চিন্তার কি আছে, ড্যাডি?’ বিভ্রান্ত বোধ করছে ও। বাবার এত রেগে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারছে না।

মায়ের মতই হয়েছে ছেলেটা, ভাবল ডার্বি। নিজের নাকের চেয়ে দূরের জিনিস মোটেও দেখতে পায় না।

‘আমি স্যাকরেমেন্টো যাওয়ার আগে দেখে গেলাম মাইনাররা কার্বন ক্যানিয়ন ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্যে প্রায় তৈরি। ভেবেছিলাম ফিরে এসে দেখব ওরা চলে গেছে।

‘একমাত্র প্রীস্টই ওদের মনোবল ফিরিয়ে দিতে পারে। ওরা যদি নিজেদের ওপর সামান্য বিশ্বাসও ফিরে পায়, তাহলে মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে-কিছুতেই যাবে না।’

বাধ্য ছেলের মত বাবার পাশেপাশে নীরবে এগোচ্ছে টিম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনের প্রশ্নটা ব্যক্ত না করে থাকতে পারল না।

‘তাহলে আমরা কি করব, ড্যাডি?’

একটু আগেই যে মানুষের রাগে ফেটে পড়ার অবস্থা হয়েছিল সেই জিম ডার্বি এখন সম্পূর্ণ সংযত আর শান্ত।

‘ওর সাথে আমি নিজেই কথা বলব,’ জানাল ডার্বি। ‘শুধু ওকে বেঁধে আমার কাছে এনে হাজির করাটা তোমাদের কাজ।’

টিম আর ম্যাগিল একে অন্যের দিকে চাইল। কেবল এই প্রস্তাবটা ছাড়া অন্য যেকোন প্রস্তাব ওদের জন্যে ভাল ছিল। দুজনই ওই লোকটার কাছে নাজেহাল হয়েছে, তাই আবার ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে চাচ্ছে না কেউ। কিন্তু ওদের কিছুই করার নেই, জিম ডার্বি তার আদেশ জারি করেছে।

শেষে নীরবতাই ওদের রক্ষা করল। অল্পক্ষণ পরে জিম নিজেই তার মত পালটাল।

‘না। ভেবে দেখলাম সেটা ঠিক হবে না। লোকটা তাহলে শহীদের মর্যাদা পাবে। মরা প্রীচার জ্যান্ত প্রীচারের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করবে।’

‘ওদের ক্লেইমগুলো কিনে নেয়ার ব্যাপারে স্যাকরেমেন্টোর লোকজন কোন সাহায্য করতে পারবে না, বস্?’

‘বিন্দুমাত্র না। ওরা প্রত্যেকেই মনে করে সে-ই পরবর্তী সেনেটর হবে। ওদের সাথে কথা বলা বৃথা। কেউই বুঝতে চায় না।’

‘ওরা কেউ তোমার রিট পিটিশনে সই করেনি?’ অবাক হলো টিম। ‘না। শুধু তাই নয়, আরও খারাপ সব কথাবার্তা চলছে ওখানে।’ ভুরু কুঁচকাল টিম। ‘এ তুমি কি বলছ, ড্যাডি?’

‘বিশ্বাস করা কঠিন, কিন্তু ওসব গাধা পলিটিশিয়ানদের কেউ কেউ মনিটর দিয়ে মাইনিঙ করা তুলে দিতে চাচ্ছে। ওরা বলে, এতে নাকি জমি ধ্বংস হচ্ছে।’

টিমের চোখ বিস্ফারিত হলো। ‘ওটা কেবল কথার কথা, তাই না, ড্যাডি? এরকম কিছু ওরা করবে না।’

‘অনেক রাজনীতিবিদ একসাথে বসলে কি যে ঘটবে তা কেউ বলতে পারে না। ওরা পরস্পরের বক্তৃতা মনোযোগ দিয়ে শোনে। তুমি আমার সাথে স্যাকরেমেন্টোতে ছিলে না, বাছা। দিনকাল এখন বদলে যেতে শুরু করেছে। সেই আগের দিন আর নেই।

‘হাঁদা চাষাগুলোও এখন চালাক হয়ে উঠেছে। ওরা একটা লবি তৈরি করেছে। দিনদিন সংখ্যায় ওরা বাড়ছে আর মাইনারদের সংখ্যা কমছে। ওদের কথা, হাইড্রলিক মাইনিঙ ওদের জমি নষ্ট করছে।’ বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ল জিম। ‘এই দেশটাকে যারা গড়ল, তাদেরই ওরা ধ্বংস করতে চাইছে। ওই বোকা পলিটিশিয়ানদের পকেটে যদি ঠিক পরিমাণে টাকা পড়ে, তবে হয়তো রায়টা বিপক্ষেই যাবে।

‘এখন পর্যন্ত দুদিকেই ভার সমান। তবে আমি বুঝতে পারছি, আমাদের জন্যে পরিস্থিতি ভালর দিকে না গিয়ে খারাপের দিকে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু আমি হাইড্রলিক মাইনিঙে এত টাকা খাটিয়েছি যে এখন শাট্ মাইনিঙে গেলে আমার পোষাবে না। কার্বন ক্যানিয়নে ঢুকে কাজ শুরু করা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই। একটা ভাল দাঁও মারতেই হবে। আমার মনে হয় যা খুঁজছি সেটা কার্বনেই আমি পাব। তারপর মনিটরের ব্যবহার ওরা বন্ধ করে দিলেও আমাদের কোন ক্ষতি হবে না। তাই কার্বন ক্যানিয়ন আমাকে পেতেই হবে। এবং এখনই।’

টিম বা ম্যাগিল কেউই কথা বলল না। ওরা ডার্বির কথার মর্ম উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে।

‘কার্বন ক্যানিয়নের মাইনারদের এই সপ্তাহেই যেতে হবে। আর দেরি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। গভর্নরের টেবিলে ওই বিল যাওয়ার আগেই আমি কাজ শুরু করতে চাই। কারণ বেজন্মাগুলো হয়তো চাষাদের বিলই পাস করবে। অর্থাৎ, প্রীচারকে যেভাবে হোক এখান থেকে তাড়াতে হবে। সেটা কিভাবে করা যায় তার একটা ফন্দি বের করা দরকার।’

‘হয়তো আমরা- উৎসাহ নিয়ে শুরু করেছিল টিম। কিন্তু ধমক খেয়ে চুপ হতে বাধ্য হলো।

‘চুপ করো! পারলে তুমি আগেই ব্যবস্থা করতে। তোমার বাপকে একটু ভাবতে দাও।’

নীরবেই বকাটা হজম করল টিম। কারণ সে জানে ড্যাডি কারও সমালোচনা সহ্য করে না। পরমাত্মীয়ের থেকেও না। তাছাড়া বাবা তাকে মিথ্যে দোষারোপ করেনি। সত্যিই ব্যর্থ হয়েছে ও।

বাকি পথ নীরব থাকল টিম। এখন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে ও। ভাবছে বাবাই ওই পাজি প্রীচারকে সামলাবে। সে জানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে অভিনব উপায় উদ্ভাবন করতে তার বাবার জুড়ি নেই। কাঁধ থেকে দায়িত্ব সরে যাওয়ায় এখন আশ্বস্ত বোধ করছে টিম।

.

প্যাট তার লঙ টম মেরামত করেছে। ওটাকে আগের জায়গায় না রেখে ক্লেইমের মাঝখানে এনে বসিয়েছে। প্রতিবেশীরা এখনও এক ডাকে শোনার দূরত্বেই আছে। তবে স্পাইডার বা মিলটনের মত লোক আড্ডা মেরে সময় নষ্ট করতে পাহাড়ে আসেনি। গল্প-গুজবের জন্যে সূর্য ডোবার পর যথেষ্ট সময় আছে।

এমনও কিছু লোক আছে, যারা সোনার নেশায় পাগল। ওরা বাতি জ্বেলে রাতেও কাজ করে।

এই একটা দিকে প্রীচারের সাথে ওদের মিল আছে। কথার চেয়ে কাজই বেশি পছন্দ করে ও। কঠিন পরিশ্রম। বেলচা দিয়ে নুড়ি তুলে সুইসের উঁচু দিকটায় ফেলা কঠিন পরিশ্রমের কাজ। প্যাট অনেক বুঝিয়েও সহজে ওই কাজের ভার নিতে পারে না। ও অনেক বেশিক্ষণ পরিশ্রম করছে বলে প্যাট আপত্তি তুললে সে বলে আরও দশ মিনিট পর কাজ ছাড়বে।

প্রতিবাদ করেও লাভ হয় না, শেষ পর্যন্ত ওকেই হার মানতে হয়। এত বছর একা কাজ করার পর বিশ্রাম পেয়ে ওর কাঁধের পেশীগুলো খুশিই হয়।

আজও তাই ঘটছে। প্রীচার বেলচা চালাচ্ছে, আর সুইসের পাথরগুলো পরীক্ষা করে দেখছে প্যাট্রিক। কেবল পাথর আর পাথর। মাঝেমাঝে কেবল দুএকটা কোয়ার্টস্ বা পাইরাইট নিষ্প্রভ ধূসর পাথরের ভিতর ঝিলিক দিয়ে উঠছে!

হঠাৎ একটা পাথরের ওপর ওর চোখ আটকে গেল। ফেনা তোলা পানির তোড়ে দৃষ্টি কিছুটা ব্যাহত হলেও পরিষ্কার দেখতে পেয়েছে প্যাট। ওটা উজ্জ্বল, অত্যন্ত উজ্জ্বল। পাইরাইট এত উজ্জ্বল হয় না। চোখ মুছে আবার তাকাল, নিশ্চিত হতে চাইছে ভুল দেখেনি।

খুশিতে একটা ডাক ছেড়ে পানিতে হাত ডুবিয়ে পাথরটাকে মুঠো করে ধরল। পানির নিচেও ওটা প্যাটের হাতে ভিন্ন একটা অনুভূতি জাগাল।

আরও এক বেলচা পাথর সুইসের মাথায় ঢেলে থামল প্রীচার। হেসে সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার হাত ভাঙেনি তো?’

পানির থেকে হাত বের করে মুঠো খুলে দেখল হাতে কী উঠেছে। বরফ গলা পানিতে প্যাটের আঙুলগুলো গোলাপী হয়ে উঠেছে। কিন্তু ঠাণ্ডা অনুভব করছে না ও।

বাম হাতের আঙুল দিয়ে পাথরটা নেড়েচেড়ে পরীক্ষা করল সে। সাধারণ পাইরাইটের মত ওটা থেকে আটকোনা ক্রিস্টাল বেরিয়ে নেই। ক্রীকের তলায় গড়িয়ে মসৃণ হয়েছে। ওটায় একটু লালচে ভাবও রয়েছে।

‘একটা নাগিট!’ এতক্ষণে প্যাটের মুখে কথা ফুটল। ‘এত বড় নাগিট আমি জীবনে দেখিনি! এই দেখো।’ হাত বাড়িয়ে কি পেয়েছে দেখাল প্যাট।

‘তুমি ঠিক জানো ওটা সোনা?’

‘জানি, প্রীচার।’ সবকটা দাঁত বের করে হাসল মাইনার। ‘ফূস্ গোল্ড আমি ভাল করেই চিনি। আমার ভাগ্যে এই জিনিস জুটবে তা ভাবতেও পারিনি। সবসময়েই দেখেছি ভাল জিনিস কেবল অন্যের কপালেই জোটে।’ আঙুলে ঘষে একটা অংশ থেকে মাটি সরাল সে।

‘দেখেছ, কী সুন্দর! আমি জানতাম এখানে সোনা আছে, শুধু ডাস্ট নয়।’

‘ভাল, কিন্তু খবরটা কেবল নিজের মধ্যেই চেপে রেখো না-ভাল খবর সবার সাথে শেয়ার করাতেই বেশি আনন্দ।’

‘ঠিক বলেছ।’ ঢাল বেয়ে মারিয়ার কেবিনের দিকে এগোল প্যাট। ‘অ্যাই, মারিয়া! নিতা! দেখো আমি কি পেয়েছি!’

প্যাটের উত্তেজিত চিৎকারে প্যানিঙ করতে করতেই মুখ তুলে তাকাল স্পাইডার। স্পষ্ট বুঝল ও কি পেয়েছে। দ্বিগুণ উৎসাহে কাজের গতি বাড়াল। খবরটা পেলে ক্রীকের অন্যান্য মাইনাররাও তাই করবে।

কেবিনে পৌছল প্যাট। ছুটে আসায় হাঁপাচ্ছে। হাঁকডাক শুনে বারান্দায় বেরিয়ে এসেছে মারিয়া। ওর পিছন পিছন ওয়ানিতাও এল। উত্তেজনায় জনসনের স্বর কাঁপছে।

‘ওরা বলে কার্বনে সামান্য ডাস্ট ছাড়া কিছু নেই। এই দেখো! কত বড় নাগিট!’ গর্বের সাথে মুঠো খুলে হাতটা বাড়িয়ে ধরল প্যাট। পাখির ডিমের সমান নাগিটটা সূর্যের আলোয় ঝিলিক দিয়ে উঠল।

‘বড় পাথরটার তলাতেই ছিল। আমি জানতাম ওখানে সোনা আছে। দেখো, দেখো কী সুন্দর! কম করে হলেও চার আউন্স হবে!’ আনন্দে প্রথমে মা, পরে মেয়েকে আলিঙ্গন করল মাইনার।

‘চলো, প্যাট, আমরা সেলিব্রেইট করতে শহরে যাই!’ প্রস্তাব দিল নিতা। খুশিতে ঝলমল করছে ওর মুখ।

‘না, ওটা ঠিক হবে না,’ প্যাট কিছু বলার আগেই বলে উঠল মারিয়া।

‘প্লীজ, মাম্। আমরা, অনেকদিন এখানে আটকা পড়ে আছি।’ প্রীচারের দিকে ফিরল ও। এতক্ষণে লোকটা পৌঁছেচে। ‘তুমি কি বলো?’

ক্ষীণ একটা দুর্বোধ্য হাসি ফুটল প্রীচারের মুখে। ‘ক্ষতি কি?’ ওয়ানিতাকে বলল সে। তারপর প্যাটের উদ্দেশে বলল, ‘শহরে গেলে ভালই হয়। মিস্টার ব্ল্যাকেনশিপের টাকাও তুমি ওটা দিয়ে শোধ দিতে পারবে। লোকটা সৎ বলেই মনে হয় তোমাকে ও উচিত দামই দেবে।’

প্রীচারের কথাটা মনেমনে বিচার করে দেখছে মাইনার। তালুর ওপর নাগিটটা আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করছে। যতক্ষণ হাতে আছে, খুব ভাল লাগছে ওর। হাতছাড়া করতে মন চাইছে না। কিন্তু প্রীচার ঠিকই বলেছে; দেনাটা শোধ করা দরকার। ওই একটা নাগিট দিয়ে কার্বন ক্যানিয়নের সবার দেনা শোধ করেও হয়তো কিছু টাকা বাঁচবে। একবার বাকি শোধ হলে সবাই আবার ধারে জিনিসপত্র আনতে পারবে।

তাছাড়া, একটা যখন পাওয়া গেছে, এমন নাগিট নিশ্চয় ওখানে আরও পাওয়া যাবে-ভাবল মাইনার।

‘তোমার কথাই ঠিক, প্রীচার,’ বলে দাঁত বের করে হাসল প্যাট। ‘এটা দেখে বুড়ো জুড়ের চেহারা কেমন হয় দেখেই আমার পয়সা উসুল হয়ে যাবে।’

‘তাহলে আমরা শহরে যাচ্ছি?’ আশান্বিত হয়ে জানতে চাইল নিতা।

‘হ্যাঁ, যাব। তুমিও যাবে তো, প্রীচার?’

‘একা এখানে থেকে আমি আর কি করব? চলো, সবাই মিলেই যাই।’

মারিয়া আর নিতা প্রায় তৈরিই ছিল। প্যাটের তৈরি হতে বেশি সময় লাগল না। আধঘণ্টার মধ্যেই ওয়্যাগনে চড়ে সবাই শহরের দিকে রওনা হয়ে গেল।

ক্রীকের ধারে কিছুক্ষণ প্যানিঙ করে উৎসাহ হারিয়ে এডি আর টেডি পাড়ে বসে ছুরি দিয়ে দুটো দেবদারুর ডাল চাঁচছে। কোন কাজেই বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না ওরা। ওয়্যাগনের শব্দে মুখ তুলে তাকাল এডি।

‘আবার শহরে যাচ্ছ, মিস্টার জনসন?’ প্রশ্ন করল ছেলেটা।

‘হ্যাঁ। তোমরাও যাবে? গাড়ির পিছনে অনেক জায়গা আছে।’

ডাল আর ছুরি পাশে নামিয়ে রাখল এডি। ‘মন চাইছে,’ বলল সে। ‘কিন্তু ড্যাডি আমাদের যেতে দেবে না। বলে নিজেরা শহরে গেলে আমরা ঝামেলায় পড়ব।’ সরল হাসি ছড়িয়ে পড়ল ওর মুখে। ‘শহরে যাওয়ার জন্যে দিনটা খুব সুন্দর ছিল।’

‘হাই, ওয়ানিতা।’ মেয়েটাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল টেডি।

‘হ্যালো, টেডি।’ সিধে হয়ে সম্ভ্রান্ত লেইডির মত বসেছে ওয়ানিতা। ছেলে দুটোকে পেরিয়ে গেল বাকবোর্ড। ‘পরে আবার দেখা হবে।’

ওয়্যাগনটা পরের বাঁকে অদৃশ্য হলো। ভাইয়ের দিকে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে এডি প্রশ্ন করল, ‘ওয়ানিতার কি হয়েছে বলো তো? ওকে অন্যরকম দেখাল না?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *