চার
আগুনের গোলা না ছুঁড়ে যে ক্যানন পানি ছোঁড়ে, তার ক্ষতি করার ক্ষমতা কম মনে করলে খুব ভুল হবে। আসলে ওয়াটার ক্যানন সেনা বাহিনীর যেকোন আগ্নেয়াস্ত্রের সমান ক্ষতি স্থায়ীভাবে করতে পারে।
কাঠের মঞ্চে বসানো ওয়াটার ক্যানন (মনিটর নামেও পরিচিত) ক্রীক থেকে পানি তুলে ছুঁড়ে পাড়ের মাটি আলগা করে ফেলে। ক্যাননের নাগালের ভিতরে নগ্ন পাথর ছাড়া আর কিছুই নেই। ছোট ঝোপঝাড়, আর মাটি পানির তোড়ে ধুয়ে ঝর্না বেয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে।
মনিটরের কর্মীরা কেউ জীবিত কিছুতে আগ্রহী নয়। ওরা কেবল সোনার নুড়ি চায়। দুডজন পেশীওয়ালা ঘর্মাক্ত লোক কোমর পর্যন্ত নগ্ন হয়ে বিরামহীন ভাবে খাটছে। বেলচা হাতে ক্রীক থেকে আলগা পাথর তুলে চল্লিশ ফুট লম্বা সুইসের উপরের মাথায় ফেলছে ওরা। ওখান থেকে ঝাঁকি খেয়ে ধীরে নিচের দিকে নামছে পাথর।
সুইসের কাজ দেখাশোনা করছে পঁচিশ বৎসর বয়সের এক সুদর্শন লম্পট। পানির ছিটায় ভেজা শ্রমিকদের প্রতি কোন দয়ামায়া দেখাচ্ছে না, বরং দুর্ব্যবহারই করছে। লোকটা তার থেকে শক্তিশালী লোকজনের সাথে খারাপ ব্যবহার করেও পার পাচ্ছে, কারণ সে জিম ডার্বির ছেলে টিম।
সোনা জমা হচ্ছে সুইসের সবথেকে নিচের স্তরে। সোনা পাথরের চেয়ে অনেক ভারি।
তিনজন লোক এগিয়ে আসছে টিমের দিকে। মুখ তুলে চেয়ে ওদের চিনতে পারল। অশ্লীল একটা গালি দিয়ে ওদের কাছে পৌঁছবার অপেক্ষায় জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল টিম।
তিনজনই পট্টি বাঁধা। জেগু আর টাইসনের মাথায় সাদা কাপড়ের ব্যাণ্ডেজ। ম্যাগিলের চোয়ালে তুলোর মোটা প্যাড। টিম ডার্বির সামনে এসে ওরা থামল। রাগে যুবকের মেজাজের সাথে স্বরও চড়েছে, তাই সুইসের ঘড়ঘড় শব্দ ছাপিয়ে ওর কথা শোনা গেল।
‘তোমরা তিনজন এতক্ষণ ছিলে কোথায়? এক ঘণ্টা আগেই তোমাদের শিফট শুরু হয়েছে। তোমরা ভেবেছ কি? বাম্বাকেই আমি সারাক্ষণ মনিটরের কাজে রাখব?’
টাইসন আর জেগু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। আশা করছে ফোরম্যান ম্যাগিলই জবাব দেবে।
‘আমি দুঃখিত, টিম। আমরা ডাক্তারের ওখানে আটকা পড়েছিলাম। নইলে ঠিকই আমরা সময় মত পৌঁছতে পারতাম,’ ব্যাখ্যা দিল সে।
‘কপাল খারাপ নাপতে ব্যাটা আবার বোনের সাথে দেখা করতে গেছিল, বিড়বিড় করল জেগু।
ওদের ব্যাণ্ডেজ আর অবনত ভাবটা লক্ষ করল টিম। ওই তিনজনের বেলায় দুটোই বেমানান। ড্যাডির লোকজনের মধ্যে ওরাই সবথেকে কঠিন লোক।
‘বুঝলাম। দেখে মনে হচ্ছে তোমরা রেলগাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়েছ। ঘটনাটা কি?’
ম্যাগিলের মুখে আর কথা ফুটছে না। বলার কিছু ও খুঁজে পেল না। টাইসন ওকে উদ্ধার করল।
‘আমরা বারান্দায় বসে গল্প করে শিফ্ট শুরু হওয়ার অপেক্ষায় সময় কাটছিলাম। দেখলাম জনসন শহরে ঢুকল। মনে আছে গতবার ও আসার পর কি ঘটেছিল?’
‘হ্যাঁ, মনে আছে। কিন্তু তাতে কি?’
‘আমরা ওর সামনে গিয়ে হাজির হলাম। একটু ঠাট্টা-মস্করা করছিলাম আর কি। তারপর—’
‘কী!’ বাধা দিয়ে বলে উঠল টিম। ‘তুমি বলতে চাও তোমরা মার খেয়ে এসেছ? লেহুড শহরে? তাও একটা অপদার্থ মাইনারের হাতে!’
‘না, বস্। ও একা ছিল না!’ বলল ম্যাগিল।
‘তাহলে ওর সাথে কার্বন ক্যানিয়নের আরও লোকজন ছিল?’
‘না, ঠিক তা নয়। মানে…ওখানে একজন স্ট্রেঞ্জার ওকে সাহায্য করেছিল। আমরা-
‘কোন্ স্ট্রেঞ্জার?’ ভুরু কুঁচকাল ডার্বি। হিসেব মিলছে না। ‘তুমি কার কথা বলছ? কার্বন থেকে না এলে সে কোত্থেকে এল?’
ওই লজ্জাকর ঘটনায় তেতো-বিরক্ত হয়ে আছে ফোরম্যান। খুঁটিনাটিতে যেতে চায় না ও। কিন্তু মালিকের ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে ওর প্রশ্নের জবাব না দিয়েও উপায় নেই।
‘কার্লার দোকান থেকে।’
চোখ গরম করে তাকাল টিম। ‘ন্যাকামি কোরো না- তুমি ভাল করেই জানো আমি কি বলছি!’
‘ওকে আমরা আসতে দেখিনি। জনসনের সাথেই গেল। কথা বলার জন্যে থামেনি। তাই ওর নামটা জানা হয়নি।’
‘জানো না? দেখে তো মনে হচ্ছে লোকটা তোমাদের তিনজনের কাছেই নিজের পরিচয় খোদাই করে লিখে রেখে গেছে!’
তিনজন শক্ত লোকই নরম হয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে-ভাবছে এভাবে অপমানিত হওয়ার চেয়ে সময়ের আগেই কাজে চলে আসা অনেক ভাল ছিল।
‘একজনই লোক?’ জানতে চাইল টিম। মাথা ঝাঁকাল ফোরম্যান। ‘চমৎকার!’ কণ্ঠস্বরে বিরক্তি ঢাকার চেষ্টা করল না যুবক। ‘এই ঘটনা শুনে বাবা খুশিতে উচ্ছ্বসিত হবে!’
ত্রিরত্নের চেহারা এখন আরও বিষণ্ন দেখাচ্ছে। কিন্তু টিমের কথা শেষ হয়নি।
‘ম্যাগিল, সুইসের কাজটা তুমি সামলাও।’
চোয়ালে বাঁধা প্যাডটার ওপর হাত রাখল ফোরম্যান। ‘বস্, আমার মনে হয় না আমি—’
‘তাহলে তুমি পারোটা কী। কেবল মারই খেতে পারো? এসো; কাজ শুরু করো। টাইসন, জেগু-তোমরা মনিটরের কাজে গিয়ে বাম্বাকে রেহাই দাও।’
প্রতিবাদ করে লাভ নেই বুঝে অনিচ্ছা সত্ত্বেও টিমের পিছন পিছন ওয়াটার ক্যাননের দিকে এগোল ওরা।
মনিটর সামলানো হচ্ছে ক্যাম্পের সবথেকে কঠিন পরিশ্রমের কাজ। কারণ পাইপের মুখটা চালক যেদিকে চায় সেটা ছাড়া বাকি দিকগুলোয় সরে যেতে চায়। দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওটা সর্বক্ষণ ধরে রাখতে হয়। শিফটের শেষে শরীরের প্রত্যেকটা পেশী ব্যথায় টনটন করে। কতক্ষণ ঢিলেমি করে বন্ধুদের যাওয়া দেখে শেষে সুইসের কাজে নামল ম্যাগিল।
মনিটরের প্ল্যাটফর্মে উঠে বাম্বার কাঁধে চাপড় দিল টিম। কাঁধ পর্যন্ত পৌছতে ওকে পায়ের আঙুলের ওপর দাঁড়াতে হলো। লোকটা সাত ফুট আট ইঞ্চি লম্বা। যেমন লম্বা তেমনি চওড়া। ক্যাম্পে-শুধু ক্যাম্পে কেন, সম্ভবত সমস্ত উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায় সে-ই একমাত্র ব্যক্তি যে মনিটরের পাইপটাকে একা সামলাতে পারে। জেগু আর টাইসনকে এখন পাইপের সাথে কুস্তি লড়তে হবে। বাম্বার জন্যে টিম মনেমনে অন্য একটা কাজ ঠিক করে রেখেছে।
.
সিয়েরা নেভাডার মত এমন উজ্জ্বল আর পরিষ্কার সকাল পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। স্প্যানিশ আবিষ্কারকের দল মিছে এই পর্বত-শ্রেণীর নাম রেঞ্জ অব লাইট রাখেনি। পাহাড়ের ধূসর নগ্ন গ্র্যানিটে প্রতিফলিত হয়ে উপত্যকায় এসে পড়ে অদ্ভুত একটা আলো।
কেবিন থেকে বেরিয়ে পিঠ বাঁকা করে আড়মোড়া ভাঙল প্যাট। তারপর বুক ভরে কয়েকবার সকালের তাজা বাতাস নিয়ে নিজের ক্লেইমের দিকে রওনা হলো। অভ্যাস বশেই যাওয়ার আগে কেবিনের দেয়ালে ঠেকানো ভারি স্লেজ- হ্যামারটা সাথে নিল।
প্যাটের কাছে আজকের সকালটা অন্যান্য দিনের থেকে ভিন্ন। কারণ আজ তাকে সঙ্গ দিচ্ছে প্রীচার। এতে মাইনার খুব খুশি। ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে ওকে দিয়ে হয়তো দুএকটা দোয়া-দরূদও সে পড়িয়ে নিতে পারবে। ইদানীং দিনকাল যা পড়েছে তাতে অনেক খেটেও সোনা তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। দোয়াতে যদি কাজ হয়, মন্দ কী।
‘এই ডার্বি লোকটার সাথেই তো তোমাদের ঝগড়া, তাই না?’ কথার ছলে প্রশ্ন করল স্ট্রেঞ্জার।
সজোরে মাথা ঝাঁকাল প্যাট। ‘হ্যাঁ। সে আর তার ছেলে। শহরে ওর লোকজনের হাত থেকেই তুমি আমাকে বাঁচিয়েছিলে। বুড়ো ডার্বি এদিককার সবথেকে শক্তিশালী লোক। আমার বিশ্বাস এই এলাকায় সে ‘৫৪, ‘৫৫-র দিকে এসেছিল। আমেরিকান রিভারের সোনা শেষ হওয়ার পর ও ছোট ক্রীকগুলোতে খোঁজা শুরু করেছে। এই এলাকায় একমাত্র ‘সে-ই সোনা তুলে বড়লোক হয়েছে।’
ওরা ক্রীকের ধারে পৌঁছে দেখল এরই মধ্যে অনেকে কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে। একটা দল মেরামতের কাজে ব্যস্ত। তৃতীয় দল নিজেদের সব জিনিসপত্র আর পরিবারের লোকজনকে খচ্চরের বাঁকা পিঠে বা জোড়াতালি দেয়া ওয়্যাগনে তুলছে। এত লোক চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেখে মর্মাহত হলো প্যাট। ও ভেবেছিল গতরাতে উলরিকের যাওয়াটা হয়তো একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
নিজের দুশ্চিন্তা নিজের মনেই রাখল জনসন। এসব কথা প্রীচারকে শুনিয়ে ওর মনটাও ভারি করে দেয়ার কোন মানে হয় না। লোকটা যখন এভাবে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে, নিশ্চয় ওর নিজেরও অনেক দুশ্চিন্তা আছে।
হয়তো প্যাটের মনের অবস্থা আঁচ করেই প্রীচার ওকে আরও বলার তাগাদা দিল। সেও তার গল্প বলে চলল।
‘ডার্বি লোকটা অন্যান্য মাইনারের মত নয়। জুয়া আর মেয়েমানুষের ওপর টাকা নষ্ট না করে ও আরও ক্লেইম কেনার জন্যে নিজের অন্য লোকের সাথে শেয়ারে খাটাতে শুরু করল। যেভাবেই হোক, দেখা যেত ওর কোন পার্টনার দুমাসের বেশি টেকে না। হয় তাদের অংশ ডার্বি কিনে নেয়, কিংবা ওদের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়। শোনা যায় ওর এক পার্টনারকে নাকি ক্রীকে ভেসে যেতে দেখা গেছে। এই তল্লাটের মানুষ আইন খুব কমই মানে, আর তখনকার দিনে তো অবস্থা আরও খারাপ ছিল। তাছাড়া ওই বুড়োর বিরুদ্ধে কেউ কোনকিছু প্রমাণ করতে পারেনি।
‘এইভাবে চলতে চলতে যখন ও যথেষ্ট টাকার মালিক হলো তখন একটা নিজস্ব কোম্পানি খুলে বসল। গত দু’বছরে ওর ব্যবসা বিরাট আকার নিয়েছে। এখন ও মনিটর ব্যবহার করে। তুমি ওয়াটার ক্যানন দেখেছ কখনও?’ প্রীচার মাথা ঝাঁকাল। ‘তাহলে তুমি জানো ওগুলো কি রকম ক্ষতি করতে পারে। কাজের পরে ওই জমি মানুষ বা পশু কারও কাজে লাগে না।
‘কিন্তু ওগুলো ব্যবহার করে লোকটা আরও ধনী হয়েছে। কার্বন ক্যানিয়নই একমাত্র এলাকা যেটা ওর লোকজন এখনও ধ্বংস করতে পারেনি। আমরা ওর কাজের ঠিক মাঝখানটা দখল করে বসে আছি। এই কারণেই ও আমাদের তাড়াবার জন্যে হন্যে হয়ে উঠেছে। কার্বনের আশপাশের সব ক্রীক ধ্বংস করেছে ডার্বি। কার্বনই এখানকার সবথেকে বড় ঝর্না। অনেকগুলো ছোট ক্রীক এসে পড়েছে এই ঝর্ণায়। প্লেসারভিলের এক এঞ্জিনিয়ার আমাকে বলেছে কার্বন নাকি ম্যাপেও আছে।’
প্রীচারকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। ‘তাহলে এই কারণেই তোমাদের তাড়াতে চাচ্ছে ডার্বি।’
নড করল প্যাট। ‘এই পাহাড়ে বেশি পরিমাণে সোনা যদি কোথাও থাকে তবে তা কার্বনেই আছে। স্পাইডার স্মিথ আর অন্যান্য পুরোনো লোকেরও একই মত। কিন্তু অত্যাচার সহ্য করে এখানে টিকে থাকা দিনদিন কঠিন হয়ে উঠছে। বেশিরভাগ মাইনারই লড়তে চায় না। তারচেয়ে ওরা আর কোথাও গিয়ে চেষ্টা করে দেখতে ইচ্ছুক।’
‘তুমি যাবে না?’
‘না। এমন আরও কয়েকজন আছে, যারা যেতে চায় না। কিন্তু ওরা সবাই জানে ডার্বি সব কেড়ে নেয়ার মতলবে আছে।’
‘লোভী শয়তান!’ মেয়েলী স্বরে কেউ বলল।
প্রীচার ফিরে তাকাল। ওয়ানিতা এসে দাঁড়িয়েছে ওদের পিছনে। মেয়েটার উপস্থিতি স্বীকার করে একটু হাসল স্ট্রেঞ্জার। উজ্জ্বল উদ্ভাসিত হাসিতে তার জবাব দিল নিতা। আবার প্যাটের দিকে মনোযোগ দিল অতিথি।
‘বুঝলাম, ডার্বি কেন তোমাদের তাড়াতে চায়। কিন্তু ওর কি এই ক্যানিয়নের ওপর আইন-সম্মত কোন অধিকার আছে?’
‘বিন্দুমাত্র না।’ প্যাটের স্বরে গর্ব প্রকাশ পেল। আমার মত এখানকার সবারই ক্লেইম স্যাকরেমেন্টোতে রেজিস্ট্রি করা আছে।
‘এপর্যন্ত ডার্বি ভয় দেখিয়ে কিছু লোককে তাড়াতে পেরেছে। আরও মানুষকে খেদাতে পারলে ক্লেইমগুলো ও কিনে নেবে। তাতে শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই চলে যেতে বাধ্য হব। ইদানীং আমাদের প্যান আর সুইসে পাথর ছাড়া কিছুই উঠছে না।
‘তুমি নিশ্চয় জানো ক্লেইমে কেউ কাজ না করলে সেটা বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। তাই আমাদের যেকোন উপায়ে তাড়াতে পারলে সবই ও কিনে নিতে পারবে।’
‘হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি ওর পদ্ধতিতে কিছু কাজও হচ্ছে।’ হাতের ইশারায় যারা চলে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে তাদের দেখাল প্রীচার।
‘সবাই চলে গেলেও আমি কিছুতেই যাব না,’ বলে উঠল ওয়ানিতা। আমি থাকছি। ডার্বি আমার কুকুর পাপিকে মেরেছে-আমার দাদাকেও খুন করেছে- আমাকে ওরা তাড়াতে পারবে না।’
খুনের কথায় প্রীচারের চেহারা গম্ভীর হলো। ‘শহরে কোন লম্যান নেই?’
হাসল প্যাট। ‘থাকলেই বা আমাদের কি লাভ হত? শহরের আর সবার মত তাকেও ডার্বি কিনে নিত। যে বেতন দেয় তার বিরুদ্ধে কোন লম্যান যাবে? একজন সৎ লোকও যদি পাওয়া যেত, সেও কিছু করতে পারত না। কারণ ডার্বি নিজে কাউকে মারেনি। ক্যানিয়নে কখনও আসে না ও। কেবল মাঝেমধ্যে ওই পাহাড়ের ওপর থেকে আমাদের দেখে।’ হাত তুলে দক্ষিণের একটা পাহাড় দেখাল প্যাট।
‘জিম ডার্বি লোকটা নীচ, কিন্তু বোকা নয়। খারাপ কাজগুলো ও ভাড়াটে গুণ্ডা লাগিয়ে করায়। কেউ মারা গেলেও খুনের সাথে ওকে কেউ জড়াতে পারবে না।’
‘এইমাত্র ওয়ানিতা যা বলল, সেটা তাহলে কি?’
‘বুড়ো ফিশার ওদের একটা রেইডের সময়ে হার্টফেল করে মারা যায়। সেটা বেশ কিছুদিন আগের কথা। তুমি কোন জাজকে বিশ্বাস করাতে পারবে ডার্বির লোকজনই মৃত্যুটা ঘটিয়েছে? ওর বয়স ছিল আশি।’ কাঁধ উঁচাল প্যাট ‘এর পর থেকে আমিই মারিয়া আর নিতার দেখাশোনা করে আসছি। নইলে অনেক আগেই ওরা এখান থেকে চলে যেত। কোন মহিলার মেয়েকে নিয়ে একা থাকার জায়গা কার্বন নয়।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল প্যাট। এমন ভাব দেখাল যেন জমি পরীক্ষা করছে। উৎসাহ হারিয়ে নিতা কিছুটা দূরে সরে যাওয়ার পর ও আবার কথা শুরু করল।
‘এমন নয় যে আমি পাপ করছি। মারিয়াকে আমি বিয়ে করতে চাই।’
‘বুঝেছি। কিন্তু তোমার বাধা কোথায়?’
‘বেশ কয়েকবছর আগে নিতার বাবা ক্যানিয়ন ছেড়ে হঠাৎ চলে যায়। ডার্বি বা আর কোন কারণে নয়। লোকটাই বিশেষ সুবিধের ছিল না। কিন্তু এর পর থেকে মারিয়া আর কোন পুরুষকে বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না।’ প্রীচারের দিকে আড়চোখে তাকাল প্যাট। ‘তুমি বিয়েটা পড়ালে কেমন হয়?’
‘তুমি যদি ওর মন স্থির করার অপেক্ষায় থাকো, তাহলে হয়তো তোমাকে বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে তুমি যা বললে তাতে তাই মনে হয়।’
‘জানি।’ উদাস ভাবে ক্রীকের দিকে তাকাল প্যাট। ‘তবে চেষ্টার ত্রুটি করছি না আমি।’
প্যাটের হাত থেকে ষোলো পাউণ্ড ওজনের হাতুড়িটা নিজের হাতে তুলে নিল প্রীচার। ‘ভাল, যতক্ষণ অপেক্ষা করছ, আমাকে কোন কাজে লাগাও না কেন?’
‘তা কি করে হয়? তুমি এখানে অতিথি। মানে, আমি বলতে চাই কার্বনের কোন আধ্যাত্মিক কাজ সামলানোর ব্যাপার থাকলে সেটা ভিন্ন কথা হত।’
‘কঠিন পরিশ্রম না করলে আত্মার কোন দাম থাকে না। পরিশ্রমে দেহ শক্ত না করলে আত্মা শক্ত হয় না।’ একটা ঝুল দিয়ে হাতুড়ির ওজন পরীক্ষা করল স্ট্রেঞ্জার। ‘তুমি নিশ্চয় এটা ক্লেইমে সাজিয়ে রাখতে আনোনি? ব্যবহার করার জন্যেই হাতিয়ার। ধর্মগ্রন্থ একটা হাতিয়ার—এটাও তাই। বলো, কোথায় শুরু করব আমরা?’
ক্লেইমের ঠিক মাঝখানে বিশাল গ্র্যানিট পাথরটার কাছে এসে দাঁড়াল ওরা। পাথরটার ওপর হাত বোলাল জনসন।
‘আমি সবসময়েই ভাবি, এই পাথরটা যদি কোনমতে ভাঙতে পারি তবে এর তলায় হয়তো কিছু পাব। গত দু’বছর যাবৎ রোজ সাপার খাওয়ার পর সন্ধ্যায় এটার ওপর কিছুক্ষণ করে হাতুড়ি চালাচ্ছি, কিন্তু ফল হয়নি। আমার ধারণা এইখানে একটা চুলের মত সরু ফাটল রয়েছে।’ হাত দিয়ে একটা জায়গা দেখাল প্যাট।
ঝুঁকে জায়গাটা ভাল করে পরীক্ষা করে দেখল প্রীচার। দীর্ঘদিন চেষ্টার ফলে ওই জায়গায় পাথর বেশ কিছুটা ভেঙেছে বটে, কিন্তু গোটা পার্থরটার তুলনায় ওটা খুব সামান্যই।
‘তোমার কোন ভুল হয়নি, একটা ফাটল এখানে সত্যিই আছে। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে খুব শক্ত, সহজে বাগে আসবে না। অনেকটা মারিয়ার মত?’
হেসে ফেলল প্যাট। ‘হ্যাঁ, ওদিক দিয়ে দুটোই সমান।’ পাথরের নিচটা পরীক্ষা করে দেখল। ‘এই পাথরটার সাথে আমার একটা জেদের খেলা চলছে। হয় ও ভাঙবে, নইলে আমি ভাঙব।’
‘আমি বাজি ধরে বলতে পারি কে জিতবে।’
‘উৎসাহ দিচ্ছ? গর্ত করে ডিনামাইট দিয়ে শয়তানটাকে ফাটাবার কথা আমি ভেবেছি। স্পাইডার বলে সেটাই আমার করা উচিত।’ নড করে ক্রীকের নিচের দিকটা দেখাল ও। ‘স্পাইডার স্মিথ। মনে হয় ওর কথা আমি বলেছি।’
‘হ্যাঁ, নাম উল্লেখ করেছ।’
‘পুরোনো লোক। আমার বিশ্বাস সিয়েরার এপাশে প্যানিঙ আর সুইস মাইনিঙ সম্পর্কে ওর চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না। ডার্বিও না।’
প্রীচার ঘুরে চোখ তুলে পিছনের খাড়া পাহাড়টার দিকে তাকাল। ‘তুমি ভয় পাচ্ছ, ডিনামাইট ফাটালে হয়তো রিম-রক ধসে পড়তে পারে, তাই না? উপর থেকে অনেক পাথর খসে নিচে পড়েছে। আলগা পাথরের স্তূপের নিচেই তোমার ক্লেইম। ঠিক মত একটা ঝাঁকি খেলে পুরো পাহাড়টাই তোমার ওপর ধসে পড়বে।’
আশ্চর্য হয়ে অতিথির দিকে তাকাল প্যাট। ওর মনে হচ্ছে বাইবেল ছাড়াও অনেক বই পড়েছে এই প্রীচার।
‘ঠিক তাই, ওই ভয়েই আমি ডিনামাইট ব্যবহার করিনি। পাহাড় ধসে পড়লে আমার ক্লেইম তো ধ্বংস হবেই, সেইসঙ্গে ক্রীকটাতেও বাঁধের সৃষ্টি করবে। তখন সব পণ্ড হবে। যেমন আছি তারচেয়ে গরীব হতে আমি চাই না।’
‘অর্থসম্পদশূন্যতা পাপ নয়,’ বিড়বিড় করল ধর্মযাজক।
‘কি বললে?’ অতিথির দিকে ফিরে তাকাল প্যাট।
‘কিছু না। এসো, পুরো কাজটা যাচাই করে দেখা যাক।’
প্যাটের পিছন পিছন এক চক্কর ঘুরে পাথরটাকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল। জরিপ শেষ করে হাত গুটাল প্রীচার। এই প্রথম ওর হাত দুটো ভাল করে দেখার সুযোগ পেল মাইনার। বুঝল চামড়ায় বাঁধানো বাইবেল নাড়াচাড়া ছাড়াও ওই হাত জীবনে অনেককিছু করেছে।
‘সমস্যা কয়েকটা আছে,’ বলে লম্বা লোকটা মাথার ওপর হাতুড়ি তুলল। ‘কিন্তু ঘাম ঝরিয়ে খানিক পরিশ্রম করলে সব মিটে যাবে।’ স্লেজ-হ্যামার ক্ষিপ্ৰ গতিতে নিচে নেমে এল। পাথরের ওপর লোহার আঘাতের শব্দ পুরো ক্যানিয়নে প্রতিধ্বনিত হলো।
প্রসপেক্টর দুই ভাই শব্দ শুনে মুখ তুলে তাকাল। জেক আর হিলডা হেণ্ডারসন ওয়্যাগনের পিছনে বাথটাব বাঁধতে বাঁধতে থমকে দাঁড়াল। পাহাড়ের ঢালে সদ্য বিবাহিত দম্পতি যাওয়ার প্রস্তুতিতে ট্রাঙ্কে কাপড় ভরার কাজ ফেলে জানালা দিয়ে উঁকি দিল।
প্রশংসার চোখে প্রীচারের অনায়াস ভঙ্গিতে হাতুড়ি চালানো লক্ষ করছে প্যাট। তারপর চোখ ফিরিয়ে ভাঙা সুইসের দিকে তাকাল। ওটা মেরামত করা দরকার, কিন্তু…
হয়তো প্রীচারের নীরব উৎসাহ, কিংবা অসম্ভবকে সম্ভব করার চ্যালেঞ্জে অনুপ্রাণিত হয়ে, সুইসের স্তূপ থেকে দ্বিতীয় একটা স্লেজ তুলে নিল প্যাট।
প্রীচারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেও কাজ শুরু করল। তাল মিলিয়ে একের পর এক বাড়ি পড়ছে পাথরের ওপর। শব্দের লয় দ্বিগুণ হলো।
ওয়ানিতা আবার ফিরে এসেছে। দুজনের একসাথে ছন্দ মিলিয়ে কাজ করা দেখছে। হঠাৎ ক্রীকের নিচের দিকে কি যেন ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ঘোড়া আর খচ্চরের পিঠে দুজন আরোহী এগিয়ে আসছে। ওদের একজনকে চিনতে পারল ও।
‘প্যাট! মিস্টার-মিস্টার প্রীচার!’ উত্তেজিত স্বরে চিৎকার করে ছুটে এল নিতা।
হাতুড়ির শব্দ থামল। মুখ তুলে মেয়েটার দিকে তাকাল ওরা। তারপর দুজনেই নিতার আঙুলের সঙ্কেত অনুসরণ করে তাকাল।
টিম ডার্বি মাত্র চল্লিশ গজ দূরে রয়েছে। ওর সঙ্গীর পা দুটো খচ্চরের পিঠ থেকে মাটি ছুঁই ছুঁই করছে।
প্রীচারের পাশে দাঁড়িয়ে ওর বাহু আঁকড়ে ধরেছে ওয়ানিতা-নিরাপত্তা চাইছে। স্লেজের হাতলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে লোকদুটোর ওপর থেকে চোখ না সরিয়েই সে কথা বলল।
‘ওরা তোমার পরিচিত কেউ, প্যাট?’
কপাল থেকে ঘাম মুছল মাইনার। ওর চেহারা বিষণ্ণ।
‘চিনি। বাম দিকের লোকটা টিম ডার্বি। কিন্তু ওর সঙ্গীকে চিনতে পারছি না—ওকে আমি আগে কখনও দেখিনি। নিশ্চয় ডার্বির নতুন কোন কর্মচারী ওকে একবার দেখলে ভোলা অসম্ভব।’
বেশ কাছে এসে ওরা থামল। ভাঁজ করা হাতে ঘোড়ার কাঁধে ভর রেখে সামনে ঝুঁকল টিম। একটা সূক্ষ্ম হাসি ঝুলছে ওর ঠোঁটে।
‘গুড মর্নিঙ, জনসন-ওয়ানিতা।’
মেয়েটার দিকে ফিরে ওর হাসি একটু বিশদ হলো। মেয়েদের আকৃষ্ট করার মতই একটা চেহারা পেয়েছে টিম। এবং এসম্পর্কে যুবক নিজেও সচেতন।
মুহূর্তে আকর্ষণ আর বিকর্ষণ দুটোই অনুভব করল ওয়ানিতা। সুন্দর হাসির জবাবে শুধু একটু নড করল ও।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লৌকিকতা সেরে নিতার পাশে দাঁড়ানো স্ট্রেঞ্জারের দিকে নজর দিল টিম।
‘তোমার কোন বন্ধু, জনসন? ওকে আগে কখনও শহরে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।’
‘না, ও মাত্র এসেছে,’ ব্যাখ্যা করল প্যাট। তারপর স্ট্রেঞ্জারের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে দেখে আবার বলল, ‘ও আমাদের নতুন প্রীচার।’
দৈত্যের মত লোকটার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে একটা অবোধ্য শব্দ বেরোল। ‘প্রীচার, না?’ লম্বা লোকটাকে খুঁটিয়ে যাচাই করে দেখল ডার্বি। স্ট্রেঞ্জার কোন কথা বলল না। কেবল সদয় ভাবে একটু হাসল।
ক্যানিয়নের বাসিন্দা অনেকেই ওদের কথাবার্তা শোনার উদ্দেশ্যে এসে জুটেছে। কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খুলছে না। টিম ডার্বির বিরোধিতা করা বোকামি। লোকজন ওর থেকে দূরে থাকাই ভাল মনে করে। কিন্তু চোখের সামনে ওরা যা ঘটতে দেখছে, তা বিশ্বাস করতে পারছে না।
‘শুনলাম তুমি আমার কিছু লোককে গতকাল আহত করেছ, প্রীচ্,’ শান্ত স্বরে মন্তব্য করল টিম।
‘ব্যক্তিগত কিছু না। আমি জানতাম না ওরা তোমার-ভেবেছিলাম ওরা তোমার বাপের লোক।’
অপমানে লাল হলো ডার্বি। বাম্বা ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করে আপত্তি জানাল।
‘ব্যক্তিগত কিছু নয়, না? তাহলে তোমাকে যদি কার্বন ক্যানিয়ন থেকে বের করে দিই তাহলে তোমার গা জ্বলার কারণ নেই, কি বলো?’
মাটিতে কিছুক্ষণ পা ঘষে চিন্তাযুক্ত মুখে ডার্বির দিকে তাকাল প্রীস্ট। ‘এখানে অনেক পাপী রয়েছে। আমার কাজ শেষ না করে কি করে যাই, বলো?’
নির্দেশের জন্যে মালিকের দিকে তাকাল বাম্বা। এক মুহূর্ত পরিস্থিতিটা বিবেচনা করে দেখে একটা গভীর শ্বাস ছাড়ল টিম। তারপর সামান্য নড করল। দাঁত বের করে হেসে দৈত্যটা নিচে নামল।
ক্রীকের ধারে কি ঘটছে দেখার জন্যে সবার চোখ ওখানেই আটকে আছে। মারিয়া ফিশারও দেখছে। দূর থেকে কথাগুলো শুনতে পাচ্ছে না। বাম্বাকে নিচে নামতে দেখে ওর মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে।
স্পাইডার স্মিথ তার ছাপরার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘটনা দেখছিল। এবার পাথরের ওপর বসা কাঁচপোকা লক্ষ্য করে তামাকের পিক ফেলে বিষণ্ণ মুখে মাথা নাড়ল।
প্রীচারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে প্যাট। সাত ফুট আট ইঞ্চি বিরাট দৈত্যটাকে সোজা ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখেও জায়গা ছেড়ে নড়ল না। এক গজ দূরে থেমে দাঁড়াল বাম্বা। তালগাছের মত লম্বা লোকটার চোখের দিকে তাকাতে প্যাটের মাথা আকাশমুখী হলো। হাত বাড়িয়ে মাইনারের হাত থেকে স্লেজটা নিয়ে দৈত্যটা মাথার উপরে তুলল।
আড়ষ্ট হলো প্যাট। ছুটে পালাবার জন্যে তৈরি হয়েই বুঝল আঘাতটার লক্ষ্য সে নয়। হাসি মুখে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে প্রীচার। প্রচণ্ড গতিতে স্লেজটা নেমে এল পাথরটার ওপর।
বোমা ফাটার মত আওয়াজ হলো। পাথরটা একবার কেঁপে উঠল-তারপর দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। ফাঁক দিয়ে ধোঁয়ার মত ধুলো উঠছে। পাথরের খণ্ড দুটো কয়েকবার এপাশ-ওপাশ দুলে স্থির হলো।
প্রচণ্ড আঘাতের পালটা ধাক্কায় ঝাঁকি খেয়ে বাম্বার ঝিম লেগে গেছে। সামলে উঠতে ওর সময় লাগল। স্লেজটা দুহাতে শক্ত করে ধরে উদ্ধত দৃষ্টিতে প্রীচারের দিকে তাকাল সে।
খুশি মনে জিনের ওপর দোল খেয়ে আগের মতই হালকা সুরে টিপ্পনী কাটল টিম।
‘তোমার কাজ তাহলে এখন শেষ, কি বলো, প্রীচ্?’
‘হ্যাঁ, আংশিক ভাবে শেষ হয়েছে বটে, ভাঙা পাথরটার দিকে চেয়ে উদাসীন স্বরে জবাব দিল স্ট্রেঞ্জার।
একগুঁয়ে, ভাবল টিম। খারাপ কথা। অনুচর দৈত্যের দিকে চেয়ে আবার নড করল যুবক। স্লেজের হাতল শক্ত করে আঁকড়ে ধরল বাম্বা। হালকা ভাবে ঠেলে ওয়ানিতাকে নিজের পাশ থেকে সরিয়ে দিল প্রীচার। প্যাট একটু সরে দাঁড়াল-বুঝতে পারছে না ওর কি করা উচিত—কি ঘটবে ভেবে ও ভয় পাচ্ছে। নীরবে স্থির দাঁড়িয়ে প্রকাণ্ড দেহধারী প্রতিপক্ষের গতিবিধি লক্ষ করছে স্ট্রেঞ্জার।
কি ঘটতে যাচ্ছে আঁচ করে বারান্দায় দাঁড়ানো স্পাইডারের চোয়াল ঝুলে পড়ল। বিড়বিড় করে যিশুকে স্মরণ করল সে।
পরস্পরের দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ চেয়ে ওরা একে অন্যকে যাচাই করে নিল। তারপর ক্যানিয়ন কাঁপিয়ে একটা বিকট হুঙ্কার ছেড়ে মাথার ওপর স্লেজ তুলে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাম্বা। কিন্তু স্ট্রেঞ্জারের বাড়িয়ে ধরা হাতুড়ির মাথায় ধাক্কা খেয়ে ওর নাক ভেঙে চেপটা হয়ে গেল।
কুঁজো অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দৈত্যটা টলতে টলতে পিছিয়ে গেল। ওর নাক দিয়ে কলকলিয়ে রক্ত ঝরছে। ওকে সামলে ওঠার সময় দিল না প্রীচার- হাতুড়ি ঘুরিয়ে লোকটার দুপায়ের ফাঁকে হালকা ভাবে আঘাত করল। মারটা হালকা হলেও হাতুড়িটা ভারি-হাতের স্লেজটা ছেড়ে দিয়ে দুভাঁজ হয়ে গেলা বাম্বা।
নিজের হাতুড়িটা একপাশে ফেলে দিয়ে এগিয়ে গেল প্রীচার। বাম্বাকে উঠতে সাহায্য করে ওকে ধরে খচ্চরটার কাছে নিয়ে গেল। নিচু গলায় কথা বলছে স্ট্রেঞ্জার-ওর স্বরে কোন আক্রোশ বা দস্তু নেই-শুধু প্রকাশ পেলা সহানুভূতি।
একটু বরফের সেঁক নিলেই ব্যথা কমে যাবে,’ জানাল প্রীচার। কাল সকালেই তুমি পুরো সুস্থ হয়ে উঠবে।’
লোকটার তিনশো সত্তর পাউণ্ড ওজনের দেহ অনায়াসে তুলে খচ্চরের পিঠে বসিয়ে দিল প্রীস্ট। তারপর ঘুরে বিস্ময়ে হতবাক ডার্বিকে হাত নেড়ে বিদায় জানাল।
‘দেখা করতে আসার জন্যে ধন্যবাদ, বাছা। আবার এসো।’
ওই মুহূর্তে টিমের চেহারা আর আগের মত সুন্দর দেখাচ্ছে না। বিফল আক্রোশে বাঁকা হয়ে গেছে ওর মুখ। হাতটা কোমরে ঝোলানো পিস্তলের দিকে নামছে।
প্রীচারের দিকে তাকিয়ে মাঝপথেই জমে গেল ওর হাত। সদাশয় লোকটার চোখ দুটো সরু হয়েছে। অপ্রত্যাশিত ভাবে চেহারায় ফুটে উঠেছে কঠিন আর ভয়ানক একটা ভাব। আগেরটার সাথে এই চেহারার কোন মিল নেই। পরিবর্তনটা আর কেউ খেয়াল করেনি-কিন্তু যার দেখা প্রয়োজন ছিল সে ঠিকই লক্ষ করেছে।
সদ্য ঘুম ভাঙা লোকের মত চোখের পাতা ফেলে চোখ কচলাল ডার্বি। তারপর প্রীচারের দিকে একবার আড়চোখে চেয়ে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ফেরার পখা ধরল। বাম্বার খচ্চরটা ঘোড়ার পিছু নিল। বিশাল দৈত্যটা ব্যথায় কুঁজো হয়ে বসে আছে জন্তুটার পিঠে।
এতক্ষণে মারিয়া ফিশার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বাম্বার নিচে নামার সময় থেকে টিমের ঘোড়া ফিরতি পথ না ধরা পর্যন্ত জায়গা থেকে ও একচুলও নড়েনি।
টিম পিস্তল রেঞ্জের বাইরে চলে যাওয়ার পর প্রীচার তার ফেলে দেয়া স্লেজটা তুলে নিয়ে ভাঙা পাথর দুটোর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। প্যাট আর ওয়ানিতা বিস্ময়ে অভিভূত হয় ওকে দেখছে।
‘ভাল কথা, বাম্বার শক্তি প্রদর্শনীর ফলাফল পরীক্ষা করতে করতে বিড়বিড় করল প্রীচার, ‘ঈশ্বর সত্যিই অভিনব উপায়ে কাজ করেন।’
প্রীস্টের মাথার ওপর দিয়ে ঘুরে এসে স্লেজের লোহা শক্ত আঘাত হানল ভাঙা পাথরে। পাথরটা কেঁপে উঠল, তারপর দুভাগ হয়ে গেল। দাঁত বের করে হেসে নিজের পুরোনো স্লেজটা তুলে নিল প্যাট। দ্বিতীয়বার দ্রুত লয়ে পাথরের ওপর হাতুড়ি পড়ার শব্দ উঠল ক্যানিয়নে।
স্পাইডার স্মিথ আবার একটা পিক ফেলে ডান গাল কুঁচকে নিঃশব্দে হাসল। ওর বাম গালে তামাক। ‘প্রীচার, না হাতি!’ বিড়বিড় করল সে।
দরজার বাইরে এক গাদা যন্ত্রপাতি গুছিয়ে রাখা আছে। ঝোঁকের মাথায় ওখান থেকে একটা স্লেজ তুলে নিয়ে ক্রীকের দিকে এগোল স্পাইডার।
প্রথম হলেও সেই-ই শেষ নয়, আরও মানুষ সাহায্য করতে এল। প্রথমে একে একে—পরে দুজন, তিনজন করে। সবাই ভয় ভুলে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে প্যাট আর প্রীচারের সাথে পাথর ভাঙার কাজে যোগ দিল। সবার শেষে এল জেক হেণ্ডারসন। সেও যাওয়ার প্ল্যান বাতিল করেছে। সবার মনেই নতুন আশা আর নতুন উদ্যম। পাথরের ভাঙা ছোটছোট টুকরোগুলো ছুঁড়ে দূরে ফেলছে ওরা-পাথর তো নয়, যেন নিজেদের ভয় আর হতাশাই ঝেড়ে ফেলে দিচ্ছে।
কর্মরত লোকজনের থেকে দূরে সরে এসেছে ওয়ানিতা। ক্রীকের ধারে দূরে একটা ভাল জায়গা বেছে নিয়ে বসেছে। ওখানে পাথরের ছিলকে ছুটে এসে গায়ে লাগার চান্স নেই। আনন্দে উদ্ভাসিত মুখে মেয়েটা ওদের কাজ দেখছে। ওখানে একজন লোক সবচেয়ে বেশি খাটছে-রোদে চকচক করছে ওর গোলাকার সাদা কলার।