দুই
আট বছর বয়সেই লোপেজ কোনটা ভুল আর কোনটা ঠিক তা বুঝতে শিখেছে। চুরি কাকে বলে এটাও সে জানে। তাই সে যা করতে চাচ্ছে সেটা যে কি, তা ওর অজানা নেই। মা ব্ল্যাকেনশিপ কখন কাউন্টার ছেড়ে সরবে তারই অপেক্ষায় আছে ছেলেটা। কাউন্টারে সাজানো অনেকগুলো ক্যাণ্ডি জারের মধ্যে দুটোর মুখ খোলা রয়েছে। কোন্টা নেবে সেটা সে অনেকক্ষণ আগেই মনেমনে ঠিক করে রেখেছে।
এবার সুযোগ বুঝে হাত ঢুকিয়ে সবথেকে বড় শলাটা তুলে নিল। ওটা তাড়াতাড়ি ভেলভেটের কোটের পকেটে ভরে ফেলল। মহিলা তখনও কাউন্টারের নিচে কি একটা কাজে ব্যস্ত আছে দেখে, সরে পড়ার জন্যে দরজার দিকে এগোল লোপেজ।
ওরা পুরো নজর মিসেস ব্ল্যাকেনশিপের ওপর থাকায়, দরজা আটকে দাঁড়ানো লোকটাকে দেখতে পায়নি ও। ছুটে বেরোতে গিয়ে লোকটার সাথে শাক্ত ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাওয়ার আগেই ওকে ধরে ফেলল ওই লোক।
কয়েকবার চোখের পাতা ফেলে মুখ তুলে চওড়া ব্রিমের হ্যাট পরা লোকটার দিকে আকাল ছেলেটা। এমন অদ্ভুত চোখ সে জীবনে আর দেখেনি। লোকটাও সরাসরি ওর চোখের দিকেই চেয়ে আছে। অস্বস্তি বোধ করছে লোপেজ।
একটা ব্যাপারে ছেলেটা নিশ্চিত, স্ট্রেঞ্জার তার চুরির পুরোটাই দেখেছে। কিন্তু তাহলে লোকটা এখনও কিছুই বলছে না কেন? সভয়ে মিসেস ব্ল্যাকেনশিপের দিকে একবার চাইল সে। মহিলা এখনও তার কাজে ব্যস্ত-চুরির ব্যাপারে সে কিছু জানে না।
লোকটা এখনও কিছু বলেনি। এটা কি সম্ভব যে সে দেখেনি? কিন্তু তা অসম্ভব। উদ্ধত দৃষ্টিতে কয়েক সেকেণ্ড চোখেচোখে তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য হলো লোপেজ। সে ভিতরে ভিতরে বুঝতে পাচ্ছে স্ট্রেঞ্জার আর বেশিক্ষণ ধৈর্য ধরে মুখ বুজে থাকবে না।
অপরাধীর মত পকেটে হাত ঢুকিয়ে পয়সা বের করল সে। লোকটা এবার তার মুঠো আলগা করল। ধীর পায়ে এগিয়ে পয়সাটা খোলা জারের পাশে কাউন্টারের ওপর রেখে দ্রুত ছুটে বেরিয়ে গেল লোপেজ। স্ট্রেঞ্জারের চোখ ছেলেটাকে অনুসরণ করল। ক্ষীণ একটা হাসি ফুটে উঠেছে ওর ঠোঁটে।
স্টোরের ভিতরটা খুঁটিয়ে দেখল আগন্তুক। শহরের আকার অনুযায়ী স্টোরের স্টক খুব ভাল। ব্যবসাও বেশ ভালই চলে বলে বোঝা যায়। এটা অস্বাভাবিক হলেও অদ্বিতীয় নয়। এখন ক্যালিফোর্নিয়ায় অনেক বুদ্ধিমান পুরুষ আর মহিলার সমাগম ঘটেছে। ওরা জানে সোনা লাভ করার সবথেকে ভাল উপায় হচ্ছে, অন্য লোকজনকে সোনা খুঁড়ে বের করার সুযোগ দিয়ে, ওদের কাছেই সোনার বিনিময়ে প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রি করা। এতে খাটুনি অনেক
কম।
হাতের বাম দিকে রয়েছে একটা লম্বা টেবিল-ওটার সামনে কয়েকটা হাতে কুপিয়ে কাটা কাঠের টুল। ভারি গড়নের লম্বা লোকটা এগিয়ে গিয়ে একটা শক্ত টুল বেছে নিয়ে বসল। নিজের আকার আর ওজন সম্পর্কে লোকটা সচেতন। অন্যের ফার্নিচার ভেঙে নষ্ট করতে চায় না। টুলের ওপর দেহের পুরো ভার ছেড়ে দেয়ার পরও ওটা ককিয়ে উঠল না দেখে সে আশ্বস্ত হলো।
ওর সাড়া পেয়ে মহিলা কাজ ছেড়ে মুখ তুলে তাকাল। মহিলার বয়স পঞ্চাশের কোঠায় হবে, শক্ত গড়ন, কিন্তু স্বর আর চেহারা দুটোই মিষ্টি। দেখে মনে হয় খদ্দের রুক্ষ মাইনারই হোক বা বড়লোকের স্ত্রী হোক, সবাইকেই সে দক্ষতার সাথে সামাল দিতে পারে।
‘ওয়েলকাম, স্ট্রেঞ্জার। আমি কার্লা ব্ল্যাকেনশিপ। সবাই আমাকে কার্লা বলেই ডাকে, তুমিও তাই ডাকতে পারো। আমি তোমাকে লেহুড, ক্যালিফোর্নিয়ায় স্বাগত জানাচ্ছি।’ নাটকীয় ভঙ্গিতে হাত ঘোরাল কার্লা। ‘পৃথিবীতে একমাত্র এখানেই ঋতু কেবল তিনটে। শীত, জুলাই আর আগস্ট। তুমি কি খাবে, বলো?’
‘শুধু কফি, ধন্যবাদ।’
মহিলার চোখ দুটো সরু হলো। নতুন কৌতূহল নিয়ে কাস্টমারকে খুঁটিয়ে দেখল সে। স্বরটা অদ্ভুত। মুখ বা ঠোঁট থেকে নয়, ওটা একেবারে গলার ভিতর থেকে বেরোচ্ছে।
‘তোমাকে দেখে কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তোমার সলিড্ কিছু খাওয়া দরকার।’ মাথা ঝাঁকিয়ে পিছন দিকে দেখাল সে। ‘আমার কাছে টাটকা তৈরি রুটি আছে, আর বাড়িতে তৈরি জ্যামও আছে-চাইলে খেতে পারো।’
ওর প্রাথমিক জবাবটা মন ভোলানো একটা সুন্দর হাসির মাধ্যমে এল। ‘শুনতে ভালই ঠেকছে। প্রথমে কফি, তারপর যদি সময় থাকে তখন বাকিটাও চেখে দেখা যাবে। ‘
লেহুড শহর স্যাকরেমেন্টো বা স্যান ফ্র্যান্সিসকোর মত নয়। কাদাময় রাস্তার দুপাশে মাত্র ডজনখানেক পাকা দালান আছে ওখানে। শহরের বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু তাঁবু। এই নিয়েই লেহুড শহর।
শহরের পুবে রয়েছে ঢেউয়ের মত কিছু নিচু পাহাড়। কিন্তু এর পরেই আকাশ ছুঁয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে গ্র্যানিট পাথরের পাহাড় শ্রেণী-দ্য রেঞ্জ অব লাইট। ওগুলো সারা বছরই থাকে বরফে ঢাকা।
রাস্তায় কয়েকজন লোককে কাদার-ওপর-পাতা কাঠের তক্তার ওপর দিয়ে হাঁটতে দেখা যাচ্ছে। একটু দূরে কিছু লোক ঠেলাগাড়ির ওপর স্টোর থেকে মাল বের করে বোঝাই করছে। ঘোড়ার পিঠে কয়েকজন রাস্তা ধরে চলেছে। ওদের কেউ কেউ আকাশের দিকে চেয়ে এবারের শীতটাও গতবারের মত প্রচণ্ড হবে কিনা বোঝার চেষ্টা করছে।
শহরের উত্তর দিক থেকে একটা বাকবোর্ড এগিয়ে আসছে। ঘোড়াটা ধীর গতিতে হাঁটছে।
লেহুডের নাপিত ওখানকার ডেনটিস্টের কাজটাও করে। বর্তমানে রুগীর একটা দাঁত তোলায় সে ব্যস্ত। মাইনার যেভাবে বিস্ফোরক ফাটিয়ে গ্র্যানিটের ভিতর থেকে কোয়ার্টস্ উদ্ধার করে, হাতুড়ে ডাক্তার ঠিক সেইরকম কোমল হাতে মাইনারের দাঁত তুলছে। রুগী আর ডেনটিস্ট, দুজনেই হিমশিম খাচ্ছে। সাঁড়াশির ওপর গায়ের জোরে চাপ দিয়ে মাইনারের মুখের ভিতর থেকে দুষ্ট দাঁতটাকে বের করে আনল ডাক্তার। সেইসাথে দাঁতের প্রাক্তন মালিকের মুখ থেকে বিয়োগ ব্যথায় একটা চিৎকার বেরিয়ে এল।
দাঁতটা ছোট গামলায় ফেলে মুহূর্তের জন্যে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল ডাক্তার। অস্বাভাবিক কিছু দেখবে বলে আশা করেনি। হাজার হলেও এটা লেহুড—অসাধারণ কিছুই এখানে ঘটে না। জানালার পাশ দিয়ে বাকবোর্ডটা পার হতে দেখে দারুণ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হলো ওর চোখ।
‘আশ্চর্য ব্যাপার!’ বিড়বিড় করে ঠিকমত দেখে নিশ্চিত হওয়ার জন্যে জানালার কাছে সরে দাঁড়াল ডাক্তার।
সাময়িক ভাবে ব্যথা ভুলে চেয়ারে সোজা হয়ে উঠে বসল রুগী। ‘কি? কি হয়েছে?’ প্রশ্ন করল সে।
‘প্যাট জনসন।’
এক হাতে চোয়াল চেপে ধরে অন্য হাতে গায়ের ওপর চাপা দেয়া কাপড়টা সরিয়ে জানালার পাশে ডাক্তারের সাথে যোগ দিল মাইনার।
‘আরে! সত্যিই তো!’ বলে উঠল বিস্মিত মাইনার।
নতুন প্রতিষ্ঠিত ইউনাইটেড স্টেইট্স পোস্ট অফিসের মহিলা পোস্টমাস্টার কয়েকটা চিঠি নিয়ে যথাযথ খোপে গুছিয়ে রাখছিল। হঠাৎ জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তায় বাকবোর্ডটা চোখে পড়তেই চিঠি রাখার জন্যে বাড়ানো হাতটা মাঝপথেই থেমে গেল। বাকবোর্ডের চালকের দিকে অবাক চোখে চেয়ে রইল সে।
শহরে উপস্থিত হয়ে সে যে সবার এতটা বিস্ময় আর কৌতূহলের পাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে তা একটুও টের পেল না প্যাট জনসন। সোজা সামনের দিকে মুখ করে রাস্তার ডানধার ঘেঁষে এগোচ্ছে ও। ওখানে কাদা কিছুটা কম। মাথা না নড়লেও ওর চোখ দুটো অনবরত নড়ছে। কোন হামলা বা বিপদ আসে কিনা দেখার জন্যে আড়চোখে রাস্তার দুপাশেই সে নজর রাখছে।
গন্তব্যস্থলে পৌছে লাগাম টেনে বাকবোর্ড থামিয়ে সে হাঁফ ছাড়ল। দোকানের সামনে বড়বড় হরফে লেখা সাইনবোর্ড ঝুলছে:
ব্ল্যাকেনশিপ মার্কেনটাইল
সামনের হিচ রেইলে মাত্র একটা ঘোড়াই বাঁধা আছে দেখে মনেমনে সন্তুষ্ট হলো প্যাট। হিচ রেইলের সাথে বাকবোর্ডের ঘোড়াটাকে বাঁধার সময়ে একটু সামনে রাস্তার উলটো পাশে বিশাল দোতলা দালানটার দিকে একবার না তাকিয়ে থাকতে পারল না প্যাট। ওটা ব্ল্যাকেনশিপের দালান থেকেও বড় আর চটকদার। উপরতলায় অফিস আর নিচের তলায় গুদাম। গুদামের উপরে বিরাট অক্ষরে লেখা সাইনবোর্ড:
জিম ডার্বি অ্যাণ্ড সান
মাইনিঙ অ্যাণ্ড স্মেলটিঙ
দালানটার সামনে বারান্দায় কয়েকটা চেয়ার পাতা রয়েছে। ওখানে বর্তমানে ডার্বির তিনজন পোষা গুপ্তাকে দেখা যাচ্ছে। ওদের একজন জনসনকে চিনতে পেরে ইঙ্গিত করল। নিজেদের মধ্যে নিচু স্বরে আলাপ করল ওরা। দূর থেকেও ওদের কুৎসিত হাসির শব্দ শুনতে পেল প্যাট। তাকে নিয়েই হাসাহাসি
করছে ওরা।
এব্যাপারে এখন তার আর কিছু করার নেই। সে শহরে এসেছে এবং ওরাও তাকে দেখে ফেলেছে। কিন্তু সে দুশ্চিন্তা করছে কেন? আর সবার মত তারও শহরে আসার সমান অধিকার আছে।
ঘোড়া বাঁধা শেষ করে স্টোরের সিঁড়ি বেয়ে উঠল সে। এখনও ডার্বির লোকগুলোর বিচ্ছিরি হাসি ওর কানে বাজছে। ভিতরে ঢুকে কিছুটা আশ্বস্ত হলো প্যাট। এমন নয় যে এখন আর কিছু ঘটতে পারে না, তবু ওদের চোখের আড়ালে চলে এসে ভাল বোধ করছে।
জুড ব্ল্যাকেনশিপ চোখ তুলে ওকে ঢুকতে দেখল। জেনারেল স্টোরের মালিক হার্ডওয়্যার কাউন্টারের পিছনে একটা টুলের ওপর বসে ছিল। লোকটার বয়স ষাট। একটু নাদুসনুদুস গড়ন। সাধারণত খদ্দেরদের দেখে লোকটা সাদর আমন্ত্রণ জানায়-কিন্তু প্যাট জনসনকে ঢুকতে দেখে সে খুশি হয়নি। ডান দিকে একটু হেলে খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে সামনের রাস্তাটা দেখল জুড। আপাতত ওটা জনশূন্য।
যাহোক, ব্ল্যাকেনশিপ একজন দয়ালু খ্রিস্টান। গায়ে কিছুটা চর্বি জমলেও শক্ত লোক সে। প্যাটকে নিয়ে যদি তার স্টোরে কোন গোলমাল হয়, সামলাতে না পারলে পিছনের দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়তে পারবে ও। প্যাট তার স্টোরে এসেছে দেখে অখুশি হয়নি জুড, বিরক্ত হয়েছে ওর এই সময়ে হাজির হওয়ায়।
‘বোকা গাধা,’ নিজের মনেই বিড়বিড় করল জুড। ‘কোন আক্কেল নেই, পরিস্থিতি একটু ঠাণ্ডা হতে দেয়ারও তর সইল না ওর।’
‘গুড আফটারনূন, মিস্টার বি।’ প্যাটের স্বরে জোর করে আনা প্ৰফুল্লতা প্রকাশ পেল। ‘আমাদের কিছু সাপ্লাই দরকার হয়ে পড়েছে।’
মুখ থেকে ঘোঁত করে একটা শব্দ করল জুড। ‘যা শুনলাম তাতে পুরো একটা নতুন ক্যাম্পই তোমাদের দরকার।’ ভৎসনার দৃষ্টিতে প্যাটের দিকে তাকাল সে। ‘তোমার সাহস আছে, এটা ঠিক। কিন্তু ঈশ্বর তোমার মাথায় মগজ একটুও দেননি। সাপ্লাই নয়, তোমার কিছু ঘিলু দরকার। এখানে আসার আগে কয়েকদিন অপেক্ষা করলে তোমার এমন কি ক্ষতি হত?’
‘কোন উপায় ছিল না। ওরা ম্যাকফারসনের কেবিন পুরো ধ্বংস করেছে। আরও দুটো ছাপরার ক্ষতি হয়েছে। শীত এসে পড়ছে, ওগুলো এখনই ঠিক করে ফেলা দরকার। বৃষ্টি এলে ওখানে ছেলেপেলে মারা পড়তে পারে-সেটা নিশ্চয়ই কেউ চায় না? তাছাড়া একগাদা সুইসও নষ্ট হয়েছে। ওগুলো মেরামত করতে গজাল আর পেরেক দরকার।’
উদ্বেগহীন ভাব করলেও সেটা তার প্রকৃত অনুভূতি নয়। যেসব জিনিস সে নিতে এসেছে সেগুলো জড়ো করতে শুরু করল প্যাট। এক রোল আলকাতরামাখা কন্সট্রাকশন পেপার, এক বালতি পেরেক, এক কৌটো পিচ, ইত্যাদি। হার্ডওয়্যার ছেড়ে জামাকাপড়ের দিকে ওর নজর গেল। কতগুলো প্যান্ট ঝুলছে ওখানে, একটা নিতে পারলে বেশ কাজে আসত। একটা টুপি দেখা যাচ্ছে-একজন বিশেষ মহিলার মাথায় ওটা চমৎকার মানাত। কিন্তু ওগুলো দেখেই তার সুখ, কেনার সামর্থ্য নেই।
জিনিসপত্রের স্তূপটা ক্রমেই বড় হতে দেখে জুডের চোখ দুটো সরু হলো। ‘আশা করি তুমি ওগুলো নগদ সোনার বিনিময়ে কিনবে, তাই না?’
‘হ্যাঁ,’ সহজ স্বরে জবাব দিল প্যাট। ‘অল্পদিনের মধ্যেই আমি দুই আউন্স সোনা তুলে তোমার কাছে হাজির করব।’
ঠোঁট দুটো কুঁচকে গোল করে পিছনের তাক থেকে একটা শক্ত মলাটে বাঁধাই করা খাতা নামাল ব্ল্যাকেনশিপ। ওটা খুলে দ্রুত পাতা উলটে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে থামল।
‘দুই আউন্সে কুলাবে না, তোমাদের খাতে অনেক বাকি পড়েছে, প্যাট। তোমরা আমাকে শেষ পেমেন্ট করেছ-আমি দেখে বলছি।’ পাতা উলটে পিছনের পাতায় একটা আঙুল ঠেকিয়ে উপর দিকে উঠাতে শুরু করল জুড। ‘হ্যাঁ, সেটা আট মাস আগের কথা। বুড়ো ল্যাঙলি ছোট ব্যাগে করে কিছু গুঁড়ো সোনা এনে আমাকে দিয়েছিল।’ মুখ তুলে তীক্ষ্ণ চোখে প্যাটের দিকে তাকাল স্টোরের মালিক। মাথায় পরা কাপড়ের টুপির ছায়া পড়েছে ওর চোখে, কিন্তু তাতে ওর দৃষ্টি একটুও নরম হয়নি।
‘আচ্ছা, তোমাদের কারও কি একবারও মনে হয়নি যে কার্বন ক্রীকে আর সোনা নেই? সিয়েরার সব ক্রীকেই যে অঢেল সোনা থাকবে তার কোন মানে নেই-হয়তো তোমরা যে ক্রীকে কাজ করছ সেখানে সামান্য সোনাই ছিল?’
‘তাই যদি হবে, তাহলে ডার্বি আমাদের ওখান থেকে তাড়াবার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে কেন? যেখানে টাকা নেই সেখানে ওই লোক কখনও হাত দেয় না।’
‘হতে পারে,’ স্বীকার করল জুড। ‘কিন্তু একটা ব্যাপার পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, সে তোমাদের ওখান থেকে তাড়িয়েই ছাড়বে। সোনা থাক বা না থাক, যেভাবেই হোক পুরো ক্যানিয়নটা দখল করবে ও। হয়তো সোনার জন্যে সে এটা করছে না-তোমরা ওর কথা মেনে নিচ্ছ না বলে জিদের বশেই করছে।’
‘আমার তা মনে হয় না, মিস্টার বি। আমরা যেমন জানি, ডার্বিও জানে ওখানে যথেষ্ট সোনা আছে। তুমিও জানো-কেন, তোমার থেকে জিনিস নিয়ে আমরা তোমাকে তার বদলে সোনা দিইনি?’
ঘোঁত করে একটা শব্দে অবজ্ঞা প্রকাশ করল জুড। ‘হ্যাঁহ্, সোনা! কালার! অমন সোনা ক্যালিফোর্নিয়ার সবাই কিছু না কিছু পেয়েছে-গুঁড়ো সোনা।’
‘না, ক্রীকে শুধু গুঁড়ো সোনা নয়, নাগিটও আছে। আজই স্পাইডার একটা নাগিট পেয়েছে-ওটা একটা নখের সমান বড়। ফুরিয়ে আসা ক্রীকে অমন সোনার তাল পাওয়া যায় না।’
কথাটা শুনে সোজা হয়ে বসল দোকানি। ‘স্পাইডার স্মিথ?’
মাথা ঝাঁকাল প্যাট। ‘হ্যাঁ।’
আবার খাতার ওপর ঝুঁকে পড়ল জুড। ‘নখের সমান একটা নাগিট পেয়েছে, তাই না? ঠিক আছে, তুমি ফিরে গিয়ে ওই শয়তানটাকে বোলো আমার খাতায় ওর নামে পঁচাশি ডলার তেত্রিশ সেন্ট বাকি লেখা আছে। ওটা তো শুধু আমার কাছে ওর দেনা। তোমার বা আর সবার কাছে ওর কত দেনা আছে তা কেবল ঈশ্বর জানেন। তোমরা সবাই নিজেদের অ্যাকাউন্টে ওর আর ওই হাবা ছেলে দুটোর জন্যে অনেককিছুই নিয়ে গেছ।’
প্যাট তাকের ওপর সাজানো একটা ছোট বোতল নামিয়ে জড়ো করা জিনিসের সাথে রাখল। ‘তেতাল্লিশ সেন্ট। গুঁড়ো সোনা ব্লীচ করার জন্যে আর্সেনিক চেয়েছিল স্পাইডার।’
‘যথেষ্ট হয়েছে!’ উঠে দাঁড়িয়ে একটা আঙুল তুলে শাসানোর ভঙ্গিতে সে বলল, ‘আর সহ্য হচ্ছে না আমার! আমি একজন সৎ খ্রিস্টান। সবার সুবিধা- অসুবিধা বুঝে চলার সাধ্যমত চেষ্টা করি। সব মানুষেরই সহ্যের একটা সীমা থাকে। ঈশ্বরের দিব্যি দিয়ে বলছি আমি শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি! তুমি স্পাইডার আর অন্যান্য মাইনারদের জানিয়ে দিও আজই শেষ আর একটা পয়সাও বাকি আমি দেব না। বুঝেছ? আমার দেনা তোমরা পুরো শোধ না করা পর্যন্ত তোমাদের জন্যে আর কোনও বাকি নেই। এটাই আমার শেষ কথা!’
জবাবে দাঁত বের করে হেসে নির্বিকার ভাবে এক রোল অয়েলক্লথ, জানালার দুটো কাঁচ, আর কয়েকটা দুই-বাই-চার কাঠ মেঝের স্তূপটার ওপর রাখল। তারপর একবারে যত জিনিস নিরাপদে বওয়া যায় তা তুলে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল।
‘তুমি সত্যিই ভদ্রলোক, মিস্টার বি। এইজন্যেই আমরা কেবল তোমার কাছ থেকেই আমাদের সব সাপ্লাই কিনি। তুমি জানো আমি, আমরা সবাই তোমার কাছে কৃত—’
বাধা দিয়ে ওকে থামিয়ে দিল জুড। ‘মিষ্টি কথায় আমাকে ভোলাবার চেষ্টা কোরো না, বাছা। শুকনো কথায় বিল শোধ হয় না।’ দোকানির রাগ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। শান্ত হয়ে আবার টুলের ওপর বসে পড়ল সে। প্যাট জানত এটাই ঘটবে।
‘আমি তোমাদের জন্যে এটা করছি না,’ বিড়বিড় করে বলল জুড। ‘এখানে আমিই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যার মালিক ডার্বি নয়। অবশ্য বাইরে এখনও আগের সাইনবোর্ডই ঝুলছে, কিন্তু আমি জানি ওরা কাকে টাকা দেয়। তার্বির চামড়ায় হুল ফুটাবার মত কিছু লোক থাকলে আমি শান্তি পাই।’
‘আমাদের নিয়ে ব্যস্ত আছে বলেই হয়তো সে তোমাকে কিনে নেয়ার দিকে নজর দিতে পারছে না,’ যোগান দিল জনসন।
‘আমাকে কিনে নেয়ার সাধ্য ওর কোনদিনও হবে না!’ উত্তেজিত ভাবে দ্বিতীয়বার ক্রেতার দিকে আঙুল তুলল দোকানি। ‘আমি সিরিয়াসলি বলছি, অনন্তকাল তোমাদের বাকির বোঝা আমি টানতে পারব না!’
‘সেটা আমরা জানি, মিস্টার বি।’ দরজার মুখে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে উত্তেজিত জুড়ের দিকে তাকাল প্যাট। ‘তুমি দেখে নিও, শীঘ্রি ওখানে আমরা অনেক সোনা পাব। তখন তোমার টাকা আমরা সুদে-আসলে শোধ করে দেব।’
‘জনসন।’ ডাক শুনে আবার ফিরে চাইল প্যাট। ‘তোমার মাল ওয়্যাগনে তোলা হলেই ওটা নিয়ে তাড়াতাড়ি সরে পোড়ো। রাস্তায় ওরা যে যা-ই বলুক থেমো না।’ মাথা হেলিয়ে সে ইঙ্গিতে দেখাল-ওখানে ডার্বির পোষা গুণ্ডা তিনজন এখন বারান্দা ছেড়ে নেমে দাঁড়িয়েছে।
মাথা ঝাঁকিয়ে বাকবোর্ডে মাল তোলার কাজে ব্যস্ত হলো প্যাট। উদ্বিগ্ন ভাবে ওর অগ্রগতি লক্ষ করছে জুড। বোকা, নিজের মনেই ভাবল দোকানি। লোকটা ভাল, কিন্তু একেবারেই বোকা।
কার্লা ব্ল্যাকেনশিপও কাজের ফাঁকে-ফাঁকে গলা বাড়িয়ে প্যাট জনসনের মাল তোলা দেখছে। প্যাট সম্পর্কে মহিলার চিন্তাধারাও অনেকটা তার স্বামীর মতই, তবে ব্যাপারটাকে সে আরও কিছুটা উদার চোখে দেখছে।
রাস্তার ঘটনা কার্লার একমাত্র কাস্টমার কি চোখে দেখছে তা বোঝা যাচ্ছে না। লোকটা নির্বিকার ভাবে রাস্তার দিকে চেয়ে কফিতে চুমুক দিচ্ছে।
প্যাট তার বয়ে আনা মালপত্র ওয়্যাগনে তুলে বাকি মাল আনার জন্যে তাড়াতাড়ি আবার স্টোরে ঢুকল। ছোট কয়েকটা জিনিস পকেটে ভরে দুহাতে আর সব জিনিস বের করে বাকবোর্ডে তুলল সে। ওগুলো যথাসম্ভব গুছিয়ে রেখে তেরপল দিয়ে ঢেকে বাঁধা শুরু করল।
রাস্তার ওপাশে দাঁড়ানো তিনজনের মধ্যে নীরবে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় হলো। ধীর পায়ে বাকবোর্ডের দিকে এগোল ওরা। ওদের এগিয়ে আসতে দেখে দ্রুত হাত চালিয়ে কাজ শেষ করায় তৎপর হলো প্যাট্রিক। কিন্তু নিজের উদ্বেগ ঢাকতে সক্ষম হলো না। এতে বাড়তি মজা পেয়ে ওরা একটু ছড়িয়ে প্যাটকে ঘিরে দাঁড়াল।
ওদের লীডার ডার্বির ফোরম্যানদের একজন। ওকে দেখেই চিনতে পারল প্যাট। লোকটার নাম ম্যাগিল। মাথায় বুদ্ধি কম হলেও, নীচতা আর শয়তানির বুদ্ধিতে সে পাকা। নিজের দুষ্টবুদ্ধিতে সে নিজেই অবাক হয়।
‘তোমার সাথে আমাদের কিছু বোঝাপড়া আছে,’ বলল ম্যাগিল।
কথার জবাব না দিয়ে হাতের কাজ শেষ করল প্যাট। তারপর হিচ রেইল থেকে ঘোড়ার বাঁধন খুলল। ম্যাগিলের সাথীদেরও চিনতে পেরেছে সে। দুজনই অত্যন্ত জঘন্য প্রকৃতির লোক। ওদের নাম জেগু আর টাইসন। কিন্তু ম্যাগিলের তুলনায় ওরা নিষ্পাপ। তবে পার পাবে জানলে গোলমালে জড়াতে ওদের জুড়ি নেই।
ম্যাগিল জানে মাইনার ওদের চিনতে পেরেছে। চিনুক, এটাই চায় ওরা। নিজের পরিচয় গোপন রাখার কোন ইচ্ছা বা প্রয়োজন ওদের নেই।
প্যাটকে ঘিরে আরও কাছে এগিয়ে এল ওরা। মাইনার কি করতে পারে এনিয়ে ওদের কোন দুশ্চিন্তা নেই-ওরা জানে প্যাট কিছু করতে পারবে না। এগিয়ে প্যাট আর ওয়্যাগনের মাঝখানে দাঁড়াল ম্যাগিল।
‘তুমি নেহাত অভদ্র লোক। আজ আমরা যখন তোমাদের ক্যানিয়নে গেছিলাম তুমি আমাদের একটা হ্যালো পর্যন্ত বলোনি!’
ম্যাগিলের কথা শুনে খিকখিক করে হেসে উঠল বাকি দুজন। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ওদের বাঁকা আর ভাঙা দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ল।
‘কিছুদিন আগে তোমাকে আমরা শহরে আসতে মানা করেছিলাম বলেই আমার মনে পড়ছে,’ ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল জেগু।
‘হ্যাঁ, তোমার স্মরণশক্তি বলতে কিচ্ছু নেই,’ মন্তব্য করল টাইসন। ‘কথাটা আমার স্পষ্ট মনে আছে।’ ম্যাগিলের দিকে চেয়ে সে আবার বলল, ‘গতবার যখন ও এসেছিল তুমি বলেছিলে, ‘শহরের বাইরে থেকো’। তারপর ওর মাথায় লাথি মেরেছিলে। ওতেই হয়তো ওর স্মৃতি হারিয়েছে।’
‘কিংবা ওইরকমই আর কিছু হবে,’ স্বীকার করল ম্যাগিল।
জেগু একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘হয়তো ওকে আবার লাথি মারলে ওর স্মৃতি ফিরে আসবে।
ম্যাগিলকে পাশ কাটিয়ে বাকবোর্ডে উঠে বসল প্যাট। ওয়্যাগনের মুখটা ঠিক দিকে ফেরানো থাকলে লাগামের বাড়িতে ঘোড়া হাঁকিয়ে বেরিয়ে যেতে পারত সে। কিন্তু স্টোরের সামনে ওয়্যাগনটার মুখ উলটো দিকে ফেরানো রয়েছে। তাই চট করে সরে পড়ার উপায় নেই। নিজের ওপরই ওর রাগ হচ্ছে, সে যখন এসেছিল তখনই গাড়িটা ঘুরিয়ে রাখা ওর উচিত ছিল। কিন্তু এখন আর তা ভেবে লাভ নেই।
ঘুরে ওয়্যাগনের অন্যপাশে এসে দাঁড়াল ম্যাগিল। জেগু আর টাইসন রইল উলটো দিকে। হাসছে ওরা।
‘তোমার আজ কথা বলার মুড নেই মনে হচ্ছে।’ কপট হতাশা প্রকাশ করল ম্যাগিল। ‘কি হয়েছে? ক্যানিয়নে নতুন কিছু ঘটেনি? আমি ভেবেছিলাম আমাদের আজকের ভিজিটের পর তোমার অনেক কথাই বলার থাকবে। ওখানে তোমার দিনকাল কেমন কাটছে তা আমাদের জানাবে না?’
‘হ্যাঁ, ওই ফিশার মেয়েদের কি খবর?’ কুটিল বাঁকা চোখে প্যাট্রিককে দেখছে জেগু। ‘তোমার সম্পর্ক কি বড়টার সাথে, নাকি দুটোই তোমার কাছে সমান?’
প্যাটের আঙুলগুলো লাগামের ওপর শক্ত হয়ে এঁটে বসল। রক্ত সরে সাদা হয়ে উঠেছে ওর আঙুল। ঘাড়ের পেশী টানটান হয়ে উঠল। কথাগুলো ওর গায়ে বিধতে দেখে উৎসাহের সাথে জেগু একই লাইনে আক্রমণ চালিয়ে গেল।
‘ছোট মেয়েটা তো মাত্র ফ্রক ছেড়েছে, তাই না?’ কুৎসিত ভাবে হাসল সে। ‘একেবারে ডাঁসা পেয়ারা, কি বলো?’ ঝুঁকে সামনে এগিয়ে এল লোকটা। চোখ দুটো চকচক করছে, ভাঙা দাঁতগুলো দেখা যাচ্ছে। ‘বলো, জনজন, আমাদের বললে ক্ষতি নেই।’
কোনমতে নিজেকে সামলে রাখল প্যাট। বাকবোর্ডের সরু সীটে সিধে হয়ে বসে আছে-হাত দুটো কাঁপছে। হ্যাটটা মাথার পিছন দিকে ঠেলে দিয়ে ম্যাগিল অবিশ্বাসের চোখে মাইনারের দিকে চাইল।
‘সত্যিই তোমার জুড়ি নেই, জনসন। নিচে নেমে পুরুষের মত কখন লড়বে? আবার তোমার জিনিসপত্র ভাঙার পর?’ আঙুল তুলে ওয়্যাগনের মালগুলো দেখাল ম্যাগিল।
মুখ খুলল প্যাট। জোর করে নিজেকে সংযত রেখে শান্ত স্বরে বলল, ‘আমি এখানে মারপিট করতে আসিনি।’
চরম বিরক্তিতে মাথা ঝাঁকাল ম্যাগিল। মনে হলো এরকমই একটা জবাব সে আশা করছিল। ‘ওটাই তোমার দোষ। তুমি আর তোমার কার্বন ক্রীকের বন্ধুবান্ধব—সবাই সমান। কাপুরুষের দল! কারও এতটুকু সাহস নেই।’ ঘুরে ওয়্যাগনের পিছনে গিয়ে তেরপল উঁচু করল সে।
ঝট করে ঘুরে তাকাল প্যাট। ‘ওগুলো ধোরো না!’
বিশদ হাসিতে ম্যাগিলের চেহারায় ভাঁজ পড়ল। ‘আরে! আশ্চর্য ব্যাপার! তুমি দেখছি কথাও বলতে পারো! কিন্তু যে লোকের কাছে তার মেয়েমানুষের চেয়ে সাপ্লাই বেশি প্রিয়, তাকে আমি কোন দাম দিই না।’ বাকবোর্ডে বোঝাই করা মাল খুঁটিয়ে দেখল ফোরম্যান। ‘এসব হাবিজাবি জিনিসের জন্যে কেন তোমার এত মায়া বুঝতে পারছি না। এখানে তো আলকাতরা মাখানো কাগজ আর কাঠ ছাড়া তেমন কিছুই নেই। তবে ওগুলো আগুন জ্বালাবার জন্যে ভাল। তোমরা কি বলো?’ সমর্থনের জন্যে সঙ্গীদের দিকে চাইল ম্যাগিল।
‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছ! আগুনে ওগুলো চমৎকার জ্বলবে!’ উৎসাহের সাথে বলল টাইসন।
জেগু তার হাত দুটো একত্র করে ঘষল। ‘চমৎকার হবে, বস্। আজকে কিছুটা ঠাণ্ডাও পড়েছে।’
ম্যাগিল পকেট থেকে একটা দেশলাইয়ের কাঠি বের করে ওটা বাকবোর্ডের গায়ে ঘষে জ্বালাল। জ্বলন্ত কাঠি হাতে সে বলল, ‘সময় থাকতে সীট থেকে নেমে পড়ো, জনসন, নইলে আগুনের ছেঁকা খাবে। অবশ্য শুনেছি ফিশার মেয়েগুলোও নাকি আগুন-হয়তো এতদিনে তোমার গরম সহ্য হয়ে গেছে।’
কথা শেষ করে কাঠিটা ছুঁড়ে অয়েলক্লথের ওপর ফেলল ম্যাগিল। মুহূর্তে ড্রাইভারের আসন ছেড়ে পিছিয়ে এসে তেরপলের খোলা প্রান্ত ঝাপটে আগুন নেভাতে সচেষ্ট হলো প্যাট। আগুনের শিখাটা নিভল বটে, কিন্তু ততক্ষণে ম্যাগিল ওর পা দুটো ধরে জোরে হেঁচকা টান দিয়েছে।
টাল সামলাতে ধরার মত কিছু না পেয়ে ওয়্যাগন থেকে রাস্তায় পড়ল মাইনার। রাস্তার কাদা থেকে ওঠার সময় পেল না প্যাট, তার আগেই তিনজন ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সমানে কিল-ঘুসি চালাচ্ছে ওরা।
কার্লার দোকান থেকে বেরিয়ে কখন যে পানির টবের পাশে ঝোলানো ওক কাঠের বড় বালতিটা নিঃশব্দে হাতে তুলে নিয়েছে স্ট্রেঞ্জার, তা কেউ খেয়াল করেনি। টব থেকে পানি নিয়ে ওয়্যাগনের শিখাহীন আগুনের ওপর ঢেলে দিল সে। আগুনটা পুরো নেভার জন্যে এক বালতি পানিই যথেষ্ট।
ভারি কাঠের বালতিটা মজবুত। জেগুর ঘাড়ের পিছনে বালতির আঘাতে বেশ জোরালো শব্দ উঠল। কাদায় মুখ থুবড়ে পড়ল সে। সঙ্গী দুজন অবাক হয়ে মুখ তুলে চাইল। ওদের বিস্ময় কাটার আগেই বালতিটা দ্বিতীয়বার নেমে এল। টাইসনের হ্যাট তুবড়ে মাথার ওপর বাড়িটা পড়ল। অচেতন জেগুর ওপর কাত হয়ে পড়ল টাইসন।
তৃতীয় আঘাত ঠেকাতে হাত তুলতে যাচ্ছিল ম্যাগিল, কিন্তু তার আগেই ওর চোয়ালে লেগে বালতিটা ফেটে চৌচির হলো। লোকটা কাদার ওপর চিত হয়ে পড়ল।
ঘটনা আধমিনিটের মধ্যেই শেষ।
জেগু স্থির হয়ে পড়ে আছে। দুহাতে মাথা চেপে ব্যথায় কাতরে কাদায় গড়াচ্ছে টাইসন। ম্যাগিল উঠে বসে চোয়াল ঠিক আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করছে। পালটা আক্রমণ আসতে পারে, এটা ওরা কেউ ভাবতে পারেনি। উঠে দাঁড়িয়ে লড়ার ইচ্ছা কারও মধ্যে দেখা গেল না।
ওদের উপেক্ষা করে বালতির ভাঙা টুকরোগুলো তুলে নিয়ে পরীক্ষা করল স্ট্রেঞ্জার।
‘এখন আর এসব আগের মত মজবুত হয় না,’ বিড়বিড় করে মন্তব্য করল সে। তারের হাতলটা ছাড়া কিছুই আর অক্ষত নেই।
তারের হাতলটা হুকের সাথে ঝুলিয়ে রেখে, ঝুঁকে প্যাটকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল। হতবুদ্ধি মাইনারের মুখে কথা ফুটল না। রহস্যময় লোকটা ওকে ওয়্যাগনে তুলে দিল। তারপর বাকবোর্ডটা ঘুরিয়ে নিজের ঘোড়াটা নিয়ে ফিরে এল। ঘোড়ার পিছন দিকে একটা চাপড় দিয়ে গাড়িটা চালু করে দিয়ে নিজেও পাশেপাশে শহরের সীমানার দিকে এগোল।
নিজের জখমের কথা একেবারে ভুলে গেছে প্যাট। গেল্ডিঙের আরোহী লম্বা লোকটাকেই একদৃষ্টে দেখছে। লোকটার কোন বিকার নেই। পরিশ্রমে ওর শ্বাস একটুও দ্রুত হয়নি—একবার পিছন ফিরেও চাইল না সে। কিন্তু প্যাট ফিরে তাকাল। সে যে স্বপ্ন দেখছে না, এটা বোঝার জন্যেই ওকে ফিরে তাকাতে হলো।
দেখতে পেল ম্যাগিল তার চেলাদের পাশে দাঁড়িয়ে টলছে। জেগু আর টাইসন তখনও কাদায় পড়ে আছে। প্রতিশোধ নিতে ধাওয়া করে আসা দূরে থাক, রাস্তাটুকু পার হওয়ার ক্ষমতাও ওদের নেই। আশ্বস্ত হয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে নিজের মুখ থেকে রক্ত মুছতে শুরু করল প্যাট্রিক।
যা ঘটেছে তা আবার মনেমনে ভাবার চেষ্টা করল মাইনার। স্ট্রেঞ্জার হস্তক্ষেপ করার আগে পর্যন্ত মোটামুটি পরিষ্কার মনে পড়ছে। তারপর ঘোরের মধ্যে সে কেবল একটা বালতি বাতাস কেটে ওঠানামা করতে দেখেছে। পরক্ষণেই টের পেল বাকবোর্ডের ওপর বসে আছে ও।
সবই ঝাপসা। কিন্তু একটা ব্যাপার সে পরিষ্কার বুঝছে, যা ঘটেছে স্ট্রেঞ্জার একাই সব করেছে। শহরের বা স্টোরের কেউ ওকে সাহায্য করেনি। সারা শহরের লোক যা করার সাহস পায়নি, এই লোকটা একা তাই করেছে।
কৃতজ্ঞতা মেশানো শ্রদ্ধার চোখে সাহায্যকারীর দিকে তাকাল প্যাট। কেবল একটা শব্দই ওর মুখ দিয়ে বেরোল, ‘ধন্যবাদ।’
সরল একটা হাসি ফুটল লম্বা লোকটার মুখে। হাসি দিয়েই কেবল এই হাসির জবাব দেয়া যায়।
‘ওই লোকগুলোর কি তোমার সাথে কোন শত্রুতা আছে? একজনের বিরুদ্ধে তিনজন—এটা ঠিক ন্যায় বিচার হলো না।’
একজনটা কে তার উপর সেটা নির্ভর করে, ভাবল প্যাট। ‘ওদের সাথে বিবাদ না করে আমি চলেই আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ওরা তা হতে দিল না।’ নাকটা মুছতে গিয়ে ব্যথায় মুখ কুঁচকাল জনসন। ব্যথা করছে, কিন্তু ভাঙেনি। এজন্যে সে কৃতজ্ঞ, কারণ লেহুডে কোন ডাক্তার নেই। ডেনটিস্ট-নাপিত তেমন কাজের নয়।
‘আপোষেই চলে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু গতবারের মত এবারেও মার খেতে হলো। ব্যাপারটা শুধু শত্রুতা নয়-অনেকটা ফিউডের মত। কেউ কেউ একে বলবে বলে ব্যবসা। আমার নাম জনসন। প্যাট্রিক জনসন।’
জবাবে স্ট্রেঞ্জার কেবল একটু নড করে হাসল। বন্ধুসুলভ আচরণ, কিন্তু ওর দিকে চেয়ে প্যাট বুঝল লোকটা খুব চাপা প্রকৃতির। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না, তাকে সাহায্য করেছে ওই লোক। খনির দেশে মানুষকে বেশি কৌতূহলী হতে নেই। এখানে বেশিরভাগ লোক আসে সোনার খোঁজে। কিন্তু এমনও কিছু লোক আসে, যারা পূর্বপরিচয় গোপন রাখতে চায়। তাতে প্যাটের কোন আপত্তি নেই। লোকটা তার জন্যে যা করেছে, এর পরে প্যাটের কাছে ওর সাত খুন মাফ।
কিন্তু প্যাটের কৌতূহল রয়েই গেল। সে প্রশ্ন করল, ‘তুমি কি এদিককারই লোক?’
‘না।’
লোকটার পেটে বোমা মারলেও কথা বেরোবে না, ভাবল প্যাট। ‘প্রেসারভিল?’ নিজের সিদ্ধান্ত ভুলে প্রশ্ন করল সে। ‘নাকি স্যাকরেমেণ্টো?’
মাথা নাড়ল লোকটা। ‘তাও না।’
অধ্যবসায় ছাড়া কার্বন ক্রীকে এতদিন টিকে থাকেনি প্যাট। লোকটা যতক্ষণ বিরক্তি প্রকাশ না করে ততক্ষণ প্রশ্ন চালিয়ে যাওয়া নিরাপদ।
‘তাহলে তুমি চলার পথে রয়েছ?’
‘হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। এ বিষয়ে আমি কোন চিন্তাভাবনা করিনি।’
ভাল কথা। যদি থাকে, তাহলে হয়তো এই লোকের সাহায্যে তাদের অনেক কাজ হতে পারে। বেশি আগ্রহ না দেখাবার চেষ্টা করল প্যাট। ‘শহরে তুমি আজ যা করেছ, এরপর তোমার আর শহরে থাকাটা ঠিক হবে না। ভীমরুলের চাকে খোঁচা দিয়েছ তুমি। আমার কেবিনে দুটো কামরা আছে।’ মাথা ঝাঁকিয়ে সামনের উঁচু পাহাড়গুলো দেখাল সে। ‘ঠিক রাজপ্রাসাদ নয়, তবে বাতাস আর বৃষ্টি অন্তত ঠেকে। তুমি চাইলে যতদিন খুশি থাকতে পারো।’
জবাব দেয়ার আগে মনেমনে প্রস্তাবটা কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে দেখল স্ট্রেঞ্জার। ‘ধন্যবাদ। চমৎকার প্রস্তাব, কিন্তু তোমার পরিবারের ওপর আমি বোঝা হতে চাই না।’
হাসল প্যাট। ‘আমার স্ত্রী অনেক আগেই মারা গেছে। তবে আমার একজন প্রেমিকা আছে। কিন্তু সে তার মেয়েকে নিয়ে নিজের বাসাতেই থাকে। তাই আমার কেবিনে জায়গার কোন অভাব হবে না। তুমি থাকলে আমি খুব খুশি হব, বোঝা মনে হবে না।
‘কি করব বুঝে উঠতে পারছি না।’
চুপসে গেল প্যাট। ‘তোমার আর কোথাও কাজ আছে?’
‘বিশেষ কোন কাজ নেই।’
‘তাহলে আর আপত্তি কিসের? চলো, তুমি আমার সাথেই থাকবে।’
মনে হলো আরও চিন্তা করছে স্ট্রেঞ্জার। কিংবা হয়তো সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছে, এখন অন্য কোন বিষয়ে ভাবছে। বুঝতে পারছে না প্যাট। নিজেকে সে মানুষ আর আকরের ভাল বিচারক বলে মনে করে, কিন্তু স্ট্রেঞ্জারের বেলায় মোটেও থৈ পাচ্ছে না।
শেষ পর্যন্ত জবাব এল। ‘ভালই শোনাচ্ছে।’
খুশি মনে বাকবোর্ডের শক্ত সীটে সোজা হয়ে বসল মাইনার। ব্যথা ভুলে লাগাম ঝাঁকিয়ে ঘোড়াটাকে আরও দ্রুত চলার নির্দেশ দিল। রাজি হয়েছে স্ট্রেঞ্জার-ওকে মত পালটাবার সুযোগ সে দিতে চায় না।
রাস্তাটা ধীরে ধীরে সরু হয়ে অদৃশ্য হলো। একটা ট্রেইল ঘুরে উত্তরে চলে গেছে। এঁকেবেঁকে পাহাড়ের ভিতর ঢুকেছে। ওই পথেই এগোল প্যাট।
ব্যক্তিগত প্রশ্ন না করে সাধারণ বিষয় নিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ চালাবার চেষ্টা করল প্যাট। সিয়েরা নেভাডার খামখেয়ালী আবহাওয়া, বাজারে জিনিসপত্রের দাম, কোথায় কোথায় সোনা পাওয়া যেতে পারে, ইত্যাদি নানা বিষয়ে কথা বলল প্যাট। তার সঙ্গী আলাপে আগ্রহী নয় বুঝে চুপ করল।
কার্বন ক্রীক ক্যানিয়নে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে এল।