না – ২০

২০

বাংলোয় ফিরতে ফিরতে প্রায় তিনটে বেজেছে। গাড়ি থেকে নেমে সবাই ঢুকে গেছে যার যার কক্ষে। ফেরার পথে কেউ কথা বলেনি কারও সঙ্গে। ম্যাডাম চুপ করে ছিলেন। রুবাও রবীন্দ্রসুধা বুকে নিয়ে তৃপ্ত। ক্ষুধা নেই বললেই চলে। অথচ কেয়ারটেকার জব্বর আলী বসে আছে টেবিলে খাবার সাজিয়ে। ফ্রেশ হয়ে সবাই আবার এসেছে টেবিলে। এখনো নীরব সবাই।

খাবার সময় একপর্যায়ে জাফরিন নঈম বলেন, কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে বের হব–রুবা ও আনিকা যাবে ওদের বাসায়। আমি একাকী ঘুরব কিছুক্ষণ গাড়িতে। ফেরার পথে নিয়ে আসব তোমাদের দুজনকে। জাহেদ আকবর সাহেব ইচ্ছা করলে রেস্টহাউসে থাকতে পারেন অথবা কোথাও বেড়িয়ে আসতে পারেন।

আনিকা বলে, ম্যাডাম, আমাদের বাড়িতে ঢুকবেন না?

না। আজ না। আরও আসা হবে কুষ্টিয়ায়। মিলপাড়াতেও যাব। তখন হয় একদিন ঢুকব তোমাদের বাসায়।

কথা বলছে না রুবা। খেয়ে যাচ্ছে নীরবে। ম্যাডামের কথাগুলো বিশ্লেষণ করতে লাগল মনে মনে। মিলপাড়াতে তাদের বাড়ি, এ কারণেই কি চাকরি হয়েছে তার। মিলপাড়াতে পুনর্বাসন সেন্টারের জন্য বলে রেখেছিলেন জাহেদ আকবর স্যারকে। মিলপাড়া উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আছে ম্যাডামের পরিচিত এক শিক্ষক। কোন শিক্ষক? জিজ্ঞাসা করা হয়নি। শোভন নয় ভেবে প্রশ্নটা অবদমিত করেছে রুবা। দেখা যাচ্ছে মিলপাড়া নিয়ে একটা দুর্বলতা আছে ম্যাডামের। এ দুর্বলতার উৎস কী? রহস্য কী? বুঝতে পারছে না রুবা।

জাফরিন নঈম বলেন, জব্বর আলী, রাতের মেনু কী?

অহনো ঠিক অয় নাই ম্যাডাম। তয় আপনি কইয়া দিলে ভালা অয়।

আপনার চয়েস। ছেড়ে দিলাম আপনার হাতে। কুষ্টিয়ার মানুষের প্রিয় খাবার খেতে চাই রাতে। যে ধরনের খাবার নিয়মিত খায় এখানকার মানুষ। তেমন মেনু চাই রাতে।

জব্বর আলী বলে, আইচ্ছা ম্যাডাম।

আনিকা বলে, আপু কি আজ আমাদের বাড়িতে থাকার অনুমতি পেতে পারে, ম্যাডাম?

জাফরিন নঈম শীতল গলায় বলেন, না।

না শুনে দমে যায় আনিকা। ভেতরের উচ্ছ্বাসে আচমকা তৈরি হয় ভাটির টান। রুবাও চমকে দেখে ম্যাডামের মুখ। না বলার পর মাথা নিচু করে ধীরে খেয়ে যাচ্ছেন ম্যাডাম। অভিব্যক্তি বদলে গেছে। দৃঢ়তা ফুটে উঠেছে তার ভঙ্গিতে।

জাহেদ আকবর খেয়াল করেন আনিকার এক্সপ্রেশন। দেখলেন, মন খারাপ হয়ে গেছে আনিকার। কিশোরীর আবদার রক্ষা করা হয়নি। চট করে অপমান বোধ করতে পারে, নিজেকে অবহেলিত ভাবতে পারে, তেমন ভাবলে কষ্ট পাবে বুঝে বলেন, তোমার আপু এখন অফিশিয়াল ট্যুরে। যখন ছুটি নিয়ে আসবেন তখন থাকবেন তোমার সঙ্গে তোমাদের বাড়িতে। কেমন?

আনিকা জবাব দেয়, আচ্ছা।

রুবা ভাবে, ম্যাডামের সিদ্ধান্ত সঠিক। তারা বাড়িতে থাকলে রেস্টহাউসে থাকবেন একজন নারী একজন পুরুষ। কোনো খারাপ সম্পর্ক নেই দুজনের মধ্যে। তবুও এভাবে রাত যাপন করলে প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রশ্ন ওঠার কোনো সুযোগ রাখতে চান না তিনি। বিকেলটুকুও জাহেদ স্যারের সঙ্গে একা থাকতে চাইছেন না ম্যাডাম। ম্যাডামের ব্যক্তিত্বের শক্ত এ দিক মুগ্ধ করে রুবাকে।

লাঞ্চ শেষ করে জাফরিন নঈম বলেন, চা খাওয়াতে হবে জব্বর আলী। বের হওয়ার আগে চা খেয়ে নিতে চাই।

দুধ চা, না লাল চা, ম্যাডাম?

যা আছে, তা-ই চলবে। কথা শেষ করে নিজের রুমে চলে যাচ্ছিলেন। তিনি। ফিরে দাঁড়িয়ে আবার বলেন, ড্রাইভারকে দ্রুত খেয়ে নিতে বলেন। এখনই বের হব আমরা।

লেবু চা, আদার কুচি মিশিয়ে দিয়েছে মরিচা বেগম। চায়ে চুমুক দিয়ে আবার মুগ্ধ হলেন জাফরিন নঈম। বাহ্! চমৎকার! দুটো শব্দ উচ্চারণ করলেন মাত্র।

রুবা খেয়াল করল, হালকা সাজ নিয়েছেন ম্যাডাম, টিয়া রঙের আড়ংয়ের শাড়ি পরেছেন। লাল একটা শাল জড়িয়েছেন গায়ে। ঠোঁটে লিপজেল লাগিয়েছেন। পরিপূর্ণ তৃপ্ত ও শুদ্ধতম একজন তেজস্বিনী মনে হচ্ছে এখন তাকে।

একাকী ঘুরতে চেয়েছেন। কোথায় ঘুরবেন ম্যাডাম?

জাফরিন নঈম চা খাওয়া শেষ করে বাইরে এলেন। তাকে অনুসরণ করে আনিকা ও রুবা। স্টার্ট নিয়ে বসে আছে ড্রাইভার। উঠলে ছেড়ে দেবে গাড়ি। প্রতিটি স্টেপ ছকে বাঁধা। ম্যাডামের কাজের ধাপ এমনি সুশৃঙ্খল। প্রতিটি বিষয়ে মনোযোগ দেয় রুবা। শিখে ফেলছে ম্যাডামের চিন্তাধারা। চিন্তা-ভাবনাগুলো আয়ত্তে নিয়ে আসছে ধীরে ধীরে।

জাফরিন নঈম বলেন, ড্রাইভারকে গাইড করো আনিকা।

জি ম্যাডাম। গাইড করব।

খেয়াল করছে রুবা, কয়েকবার আনিকাকে উদ্দেশ করে কথা বলেছেন ম্যাডাম। প্রশ্ন করেছেন বা কিছু করার জন্য বলছেন। যে কাজ দুজনে করতে পারে সেটা করার জন্য আনিকাকে বলছেন। কেন বলছেন? ছোটজনকে বেশি গুরুত্ব দিতে হয়, সে কারণে। নাকি কোনো কমান্ড করতে চান না তাকে। কমান্ডিং ভয়েজ কমই শুনেছে। প্রায় বলে থাকেন, কাজটা কি করা সম্ভব, রুবা? সরাসরি কমান্ড না–কিন্তু বড় নির্দেশনা দিয়ে দিচ্ছেন তিনি পরোক্ষভাবে। অসাধারণ গুণবতী ম্যাডামের সান্নিধ্যে দিনে-দিনে মুগ্ধতায় ডুবে যাচ্ছে ও।

.

আনিকার নির্দেশে চলে এসেছে গাড়ি মিলপাড়ায়। রাস্তার দুপাশে দেয়াল ঘেরা ছোট-ছোট বাড়ি। ইট বিছানা রাস্তা। ইটের ফাঁকে ফাঁকে রাস্তার দুই কিনারা বরাবর বড় বড় ঘাস দেখা যাচ্ছে। বড় কোনো গাড়ি এই রাস্তায় চলে না, বোঝা যায়। রাস্তার দুপাশে দুটো সরু ড্রেন। ময়লা আবর্জনায় ভরা। পরিষ্কার করার উদ্যোগ নেই কারও। ক্লোজড গাড়ির ভেতরে বসে দুর্গন্ধ টের না পাওয়া গেলেও, গন্ধ থাকাটা স্বাভাবিক মনে হয়। জাফরিন নঈম বেশ সতর্ক। এলাকাবাসীর সামনে নাক চেপে ধরা মানে তাদের হেয় করা। কাউকে হেয় করা তাঁর স্বভাবের মধ্যে নেই।

অনেকক্ষণ পর বলেন, এ রাস্তায় গেলে গাড়ি ঘোরানো যাবে?

রুবা বলে, এই রাস্তার মাঝামাঝি জায়গায় আমাদের বাসা। গাড়ি সোজা গেলে ঘোরানোর প্রয়োজন হবে না। সরাসরি বেরিয়ে যেতে পারবেন আমাদের নামিয়ে।

এ এলাকাতেই মিলপাড়া উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, তাই না?

জি ম্যাডাম। স্কুল এ রাস্তার শেষ সীমানায়। সোজা গেলে বিরাট সাইনবোর্ড দেখতে পাবেন।

জাফরিন নঈম ড্রাইভারকে বলেন, চলুন, ওদের নামিয়ে স্কুলের দিকে এগিয়ে যাই।

কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি এসে দাঁড়াল রুবাদের বাসার সামনে। রাস্তার পশ্চিমের বাড়িটির দরজা খুলে গেছে। বাড়ির ভেতরে উঠান দেখা যাচ্ছে। গ্রামের বাড়ির মতো উঠান। পুরোপুরি গ্রাম বলা চলে না। উঠানেও বিছানো আছে ইট। দুপাশে দুটো বড় আমগাছ। দেয়াল ঘেঁষে উঠে গেছে চারটা নারিকেলগাছ। দেয়ালঘেরা বাড়ির ওপরে টিন। টিনের ওপর শ্যাওলা জমেছে, রং উঠে গেছে। জীর্ণশীর্ণ বাড়ির অবস্থা।

গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল রুবা ও আনিকা। ম্যাডামকে নামার জন্য বলার সাহস পেল না দুজনের কেউ। রুবার বাবা এগিয়ে এলেন সামনে। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। মুখে দাঁড়ি। মাথায় টুপি। গায়ে পাঞ্জাবি-পায়জামা। এগিয়ে গেলেন গাড়ির দিকে। বাবাকে দেখে কদমবুচি করে রুবা। রুবার বাবা গাড়ির দিকে এগিয়ে সালাম দেন জাফরিন নঈমকে। সালামের জবাব নিয়ে ড্রাইভারকে ইশারা করেন তিনি। গাড়ি চলতে শুরু করেছে সামনে। এত দামি গাড়ি এ রাস্তায় আগে কখনো ঢোকেনি। আশপাশের বাড়িঘরের জানালা খুলে গেছে। সবাই উঁকি দিচ্ছে। ছোট-ছোট শিশুরা এসে জড়ো হয়েছে গাড়ি দেখার জন্য।

ঘরে ঢোকার সময় চট করে রুবা দেখে নেয় একবার বাবার মুখ। মনে হচ্ছে বাবা খুশি। প্রসন্ন। গর্বিত। সন্তানের গর্বে গর্বিত বাবাকে দেখে সিমির বাবার কথা মনে পড়ে। ওনার সঙ্গে সংলাপগুলো মনে পড়ে। যত খারাপ আচরণ করুক না কেন সিমির সঙ্গে, বাবাসত্তার কোমল রূপটি দেখেছে ও। বুঝতে পারে, পিতার ভেতর লুকিয়ে থাকে সন্তানের জন্য মৌলিক ভালোবাসা। মায়া-মমতা। পৃথিবীর শুদ্ধতম ঐশ্বর্য হচ্ছে মৌলিক এই স্নেহ। জাগতিক নানা কারণে সেটা চাপা পড়তে পারে, বিলুপ্ত হয় না। নষ্ট হয় না। ঠিক সময়ে সত্যটার প্রকাশ ঘটে। বাবাকে যেভাবে এত ঘৃণা করতে বাধ্য হয়েছে সিমি, সন্তানের বিপদে সেই বাবার কান্না টের পেয়েছে রুবা। বুঝতে পারে, নেপথ্যে শত অপূর্ণতা থাকলেও বাবাকে ঘৃণা করা ঠিক নয়। শ্রদ্ধার বিনিময়ে কেড়ে নিতে হবে মায়া।

ঘরে ঢোকার মুখে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন সত্য। তাঁকেও কদমবুচি করল রুবা।

মহিলা কেঁদে ফেললেন। বুকে জড়িয়ে ধরলেন রুবাকে। বসা থেকে দাঁড়িয়ে রুবা দেখে, কাঁদছে তার বাবা। কাঁদছে সত্য।

আনিকা বলে, কেঁদো না বাবা। বেশিক্ষণ থাকতে পারব না আমরা। কিছুক্ষণ পর ম্যাডাম এসে নিয়ে যাবেন আমাদের।

রুবা এসেছে যেন চাঁদ ঢুকেছে এ বাড়িতে। হইচই পড়ে গেছে পাড়াতে। আনন্দের বন্যায় ভেসে গেছে পাড়ার সবাই।

নিজের ঘরে ঢোকে রুবা। বুক কেমন করে ওঠে। ভেঙে যাচ্ছে বুক। বুকের জমাট কষ্ট তরল হয়ে যাচ্ছে। মনে ধেয়ে আসছে কান্নার স্রোত। ঘরে বসে কাঁদতে লাগল রুবা।

আনিকা ধমক দেয়। ম্যাডাম তোমাকে শক্ত থাকতে বলেছেন। শক্ত থাকতে পারছ না তুমি! ম্যাডামের কথা রাখতে পারছ না, বুঝেছ?

আনিকার ঝাড়ি খেয়ে চোখের পানি মোছে রুবা। শক্ত হয়ে তাকাল ঘরের দিকে। অগোছালো রুম দেখে হু হু করে ওঠে মন। আনিকা এখন একা থাকে এ ঘরে। তার পড়ার টেবিল অগোছালো। বিশৃঙ্খল। পড়াশোনায় টেবিল ব্যবহার করা হয় বলে মনে হলো না।

রুবা প্রশ্ন করে, তোর পড়ার টেবিলের এই দশা কেন?

কী দশা?

মনে হয় দীর্ঘদিন টেবিলে বসিসনি। এ টেবিলের বই-খাতা ব্যবহার হয় বলে তো মনে হচ্ছে না!

এ যে আপু! খুঁত ধরা শুরু করলে! তুমি জানো না, আমি খাটে শুয়ে বসে পড়ি?

হাঁ করে রুবা তাকিয়ে থাকে আনিকার দিকে।

কই, জানি না তো?

তাহলে শোনো, আমি টেবিলে বসে পড়তে পারি না।

টেবিলে বসার অভ্যাস না হলে পড়াশোনায় মনোযোগ তৈরি হবে না। মনোযোগ তৈরি না হলে মেমোরিও ভালো হবে না। রেজাল্ট খারাপ হবে। বলল রুবা।

থাক। এসব কথা বাদ দাও। সবাই এসেছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে। কথা বলল। বের হও এই ঘর থেকে। বসার ঘরে চলো।

বেরিয়ে এল রুবা। সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে লাগল। পাশের বাসার আংকেল বলেন, স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকজন এসেছিল। তোমার ব্যাপারে ইনকোয়ারি করে গেছে। সবাই রিপোর্ট দিয়েছে ভালো।

চট করে বুক খামছে ধরে। মনে মনে ধন্যবাদ দেয় গোয়েন্দাদলকে। ওরা ইনকোয়ারির কারণ উদ্ঘাটন করেনি। কেবল জেনে গেছে ওর বিষয়ে। সবাই ভেবেছে, চাকরির কনফার্মেশনের ব্যাপারে পুলিশ ভেরিফিকেশন এসেছিল। বাঁচা গেছে। ওই সময় কো-ইনসিডেন্স হচ্ছে চাকরি পাওয়া। চাকরি না হলে ইমপ্রেশন অন্য রকম হতে পারত। রুবা শোকরানা আদায় করে মনে মনে।

সবাই চলে যাওয়ার পর বাবা এসে বসেন মেয়ের পাশে।

রুবা বলে, কিছু বলবে, বাবা?

হ্যাঁ। জরুরি কথা আছে তোমার সঙ্গে।

বলো।

দেখো, কোনো অভিযোগ নেই আমার। যা বলব অভিযোগ হিসেবে নেবে না। দরকারি কথা হিসেবে শুনবে।

বলো। শুনব আমি।

জানি, অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমাদের। বাবা হিসেবে কোনো দায়িত্ব পালন করিনি। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছ তুমি সগ্রাম করে। তোমাকে দোয়া করি আরও বড় হও।

ভূমিকার প্রয়োজন নেই বাবা। প্রয়োজনীয় কথা বলল।

আমার কথা আনিকাকে নিয়ে।

কী কথা?

ও সারা রাত মোবাইলে কথা বলে। দিনভর ঘুমায়। ঠিকমতো পড়াশোনা করে না। রেজাল্টও খারাপ করছে। স্কুল থেকে গোপনে খবর নিয়েছি আমি। ইচ্ছামতো বাড়ির বাইরে চলে যায়। ঘুরে বেড়ায় বখাটে এক ছেলের সঙ্গে। কিছু বলতে পারি না আমরা। বললে তেড়ে আসে। দুর্ব্যবহার করে।

স্তব্ধ হয়ে রুবা শুনছে বাবার কথা।

আমি অভিযোগ করছি না। ভালোর জন্য বলছি। তুমি দেখভাল না করলে উচ্ছন্নে যাবে। একমাত্র তোমার কথা শুনবে। তোমাকে ভালোবাসে সবচেয়ে বেশি। বিষয়টা মাথায় রাখতে বলছি তোমাকে।

এখন কোথায় ও?

দেখো, ওর ঘরে ঢুকেছে। দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। নিশ্চয় মোবাইল ফোনে কথা বলছে।

বাবার কথা শুনে চট করে উঠে দাঁড়াল রুবা। নিজেদের দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখল, দরজা লাগানো ভেতর থেকে। দরজায় কান পাতল রুবা। ফিসফিস করে কথা বলছে আনিকা। হেসে উঠছে মাঝেমাঝে। কিছুক্ষণ এভাবে কান পাতার পর দরজার পাশ থেকে সরে এল ও। বসার ঘরে এসে বোনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

প্রায় ২০ মিনিট পর বেরিয়ে এসে বড় বোনের সামনে বসল আনিকা। রুবা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে তাকে।

অমন করে কী দেখছ, আপু? মনে হয় ভূত দেখছ আমার মধ্যে।

গম্ভীর হয়ে বলে, ভূত দেখব কেন? খুঁজে দেখছি আমার আদরের ছোট বোনকে।

খুঁজে দেখতে হবে কেন? আমার মধ্যে থেকে কি হারিয়ে গেছি আমি?

উত্তর দিতে পারছে না রুবা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল তার দিকে।

আপু, নিশ্চয়, ডাইনিটা আমার বিরুদ্ধে তোমাকে কিছু জানিয়েছে? নিশ্চয় তোমার অন্তরে বিষ ঢেলে দিয়েছে। খেপে ওঠে আনিকা।

না। কেউ কিছু লাগায়নি। অযথা অন্যকে দোষ দিয়ো না।

দোষ দেব না? তাহলে এমন পচা চোখে দেখলে কেন আমাকে?

আমার বোনকে পচা চোখে দেখব কেন? সুন্দর চোখে দেখছি।

তাহলে হাসো।

আনিকার আবদার দেখে হাসে রুবা। আনিকাও হেসে রুবার গলা জড়িয়ে ধরে। জড়ানো গলা আর ছাড়ে না। আচমকা কাঁদতে শুরু করে আনিকা। হু হু করে কাঁদতে থাকে…

.

গাড়ির হর্ন বাজছে। অর্থাৎ ম্যাডাম চলে এসেছেন। এর মধ্যে হালকা নাশতা করে নিয়েছে রুবা। হর্ন শুনে দ্রুত বেরিয়ে গাড়িতে ওঠে দুজন। বাবা-সত্য, আশপাশের অনেক ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়েছে গাড়ির পাশে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। একবার পেছন ফিরে তাকায় রুবা। দেখল, বাবা চোখ মুছছেন।

কেমন কাটালেন রুবা? গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন জাফরিন নঈম।

ভালো, ম্যাডাম।

বাবা তো কাঁদছে। ভালো বলছেন কেন?

অবাক হয়ে ম্যাডামের মুখের দিকে তাকাল রুবা। ম্যাডাম একবারও পেছনে তাকাননি। গাড়ির লুকিং ক্লাসে দেখেছেন ওর বাবার কান্না।

রুবা বলে, বিদায়বেলায় বাবা-মা কাঁদে। এটা স্বাভাবিক। আমার বাবা কাঁদছেন তাই।

তিনি দেখভাল করেননি আপনার। কাঁদছেন কেন?

দেখভাল না করলেও মায়া বিলীন হয়নি, ম্যাডাম। মনের তলানিতে জমে আছে মায়া। সে কারণে হয়তো কাঁদছেন।

ঠিক বলেছেন। মনের অতল তলে অনেক কিছু জমা থাকতে পারে। শত ঝড়েও সেটা বিলীন হয় না। কথাটা বলে উদাস হয়ে গেলেন জাফরিন নঈম।

রুবা প্রশ্ন করে, আপনার বেড়ানো কেমন হলো?

জাফরিন নঈম বলেন, আপনাদের স্কুল ঘুরে দেখলাম। বেশ সুন্দর! স্কুল বাউন্ডারিটা ভালো। স্টাফ কোয়ার্টারের সামনে বাগানটাও সুন্দর!

স্কুলের ভেতরে ঢুকেছিলেন, ম্যাডাম!

হ্যাঁ! ঢুকেছিলাম।

আপনার পরিচিত শিক্ষকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল?

দেখা হয়নি। তবে দূর থেকে দেখেছি তাকে।

দেখেছেন, দেখা করেননি?

না।

কেন ম্যাডাম?

উত্তর না দিয়ে কথা ঘুরিয়ে বলেন, আপনাদের স্কুলের উন্নয়ন দরকার।

জি ম্যাডাম।

প্রসঙ্গ না পাল্টিয়ে রুবা প্রশ্ন করে, আপনার পরিচিত শিক্ষকের নাম কী?

সাখাওয়াত সায়াহ্ন। ছোট্ট করে জবাব দেন ম্যাডাম।

উনি তো খুব পপুলার টিচার! প্রায় চিৎকার করে ওঠে রুবা ও আনিকা।

ওদের উচ্ছ্বাস দেখে দমে গেলেন জাফরিন নঈম।

রুবা বলে, দীর্ঘদিন এ স্কুলেন আছে তিনি। এখনো বিয়ে করেননি। একদম একা জীবন যাপন করেন। ছুটি নেননি কখনো। স্কুল ছেড়ে কোথাও যান না তিনি। এক রহস্যময় ভালো মানুষ আমাদের সায়াহ্ন স্যার!

জাফরিন নঈম বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করেন, বিয়ে করেননি এখনো?

না ম্যাডাম। উত্তর দেয় আনিকা।

কোনো সংসার হয়নি ওর?

না ম্যাডাম। এবার উত্তর দেয় রুবা।

একদম চুপ হয়ে গেছেন জাফরিন নঈম। সাখাওয়াত সায়াহ্ন মিলপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ে আছে শুনেছেন। বিয়ে করেনি, সংসার হয়নি এটা শুনল এই প্রথম। চোখে-মুখে বেদনার ছাপ বসে যায়। দূর থেকে দেখেছেন তাকে। বয়স বাড়লেও তত বয়স্ক মনে হয়নি। খুব কাছ ঘেঁষে গাড়ি নিয়ে ঘুরে এসেছেন। দেখতে পায়নি, দেখলেও হয়তো চিনতে পারত না সায়াহ্ন। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন জাফরিন নঈম।

এ স্তব্ধতায় বিঘ্ন ঘটাতে চাইল না রুবা। আনিকাও বুঝে গেছে ম্যাডামের মানোব। কখন কীভাবে কথা বলতে হবে, প্রশ্ন করতে হবে টের পেয়ে গেছে ও। চুপ থাকে আনিকাও।

কোনো সংসার হয়নি ওর? বাক্যটিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভেতর থেকে এসেছে ওর শব্দটি। সায়াহ্ন স্যারকে ওর বলে কেন সম্বোধন করলেন? স্যার কি ম্যাডামের অন্তরঙ্গ কেউ? মনে প্রশ্ন ঢোকে। উত্তর খুঁজে পেতে ম্যাডামের মুখের দিকে তাকাল রুবা। মনে হলো এ জগতে নেই তিনি। অন্য অচেনা জগতে ঢুকে গেছেন। বুঝতে পারে রুবা, উনি আসল বস নন। আসল বসের দেহের ভেতর ঢুকে গেছে দুঃখী এক নারীর প্রতিকৃতি–এ নারী হচ্ছে চিরন্তন নারীত্বের প্রতীক, মমতা ও ভালোবাসায় পূর্ণ অনন্যসাধারণ মানবী।

২১

রুবাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসার পর তিন দিন অফিস করেননি জাফরিন নঈম। রেস্টের পর আজ প্রথম এসেছেন অফিসে। জাহেদ আকবর এখনো কুষ্টিয়ায় রয়ে গেছেন। আসার পর একদম বদলে গেছেন জাফরিন নঈম। এখন তিনি বেশ সিরিয়াস কাজে। বিভিন্ন জনের সঙ্গে ফোনে আলাপ করছেন। বাইরের ডোনারদের সঙ্গেও কথা বলেছেন বহুবার। এ প্রতিষ্ঠানের কোর্ট প্রতিনিধি একজন মহিলা অ্যাডভোকেট, তাহমিনা আলম–এখন এসেছেন অফিসে। তাকে বেশ ব্যস্ত মনে হচ্ছে, ম্যাডামের মুখোমুখি বসে আছেন তিনি।

ইন্টারকমে রুবাকে কল করলেন জাফরিন নঈম।

নিজের ঘর থেকে ও দ্রুত এল কান্ট্রি ডিরেক্টরের সামনে।

অ্যাডভোকেট তাহমিনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন রুবাকে।

জাফরিন নঈম বলেন, উনি জাহানারা তাবাসসুম। এখন থেকে আপনার সঙ্গে কো-অর্ডিনেট করবেন।

অ্যাডভোকেট তাহমিনা আলম বলেন, আমার কার্ড রাখুন। সেল নম্বর আছে। যোগাযোগ করবেন। মোবাইলে বলে দেব কখন যেতে হবে জেলখানায়। কথা শেষ করে তাহমিনা আলম বিদায় নিলেন ঘর থেকে।

ভিজিটিং কার্ড হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে রুবা। জেলখানার কথা শুনে চমকে ওঠে। অবাকও হয়। দায়িত্ব পালনের জন্য জেলখানায়ও যেতে হবে?

মুখ নিচু করে চুপচাপ বসেছিল ও।

রুবা! নরম করে ডাকেন জাফরিন নঈম। সম্বোধন শুনে চমকে ওঠে ও। ম্যাডামের মুখে রুবা শুনতে ভালো লাগে। একই সঙ্গে মনে ঢুকে যায় আগের নানা প্রশ্ন –রুবা নামটি কোথায় পেলেন ম্যাডাম?

বাড়ির খবর ভালো তো?

জি। ভালো।

আসার পর খবর জানিয়েছিলেন?

জি। জানিয়েছি।

বাড়িতে কটা দিন থাকার ইচ্ছা হয়েছিল?

ম্যাডাম। সবার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। শান্তি পেয়েছি সে কারণে। আপনার সঙ্গে গিয়েছি, থেকেছি রেস্টহাউসে। আবার একত্রে ফিরে এসেছি। প্রতিটি স্টেপ এনজয় করেছি। ভালো লেগেছে আপনার সান্নিধ্য।

জাফরিন নঈম খুশি হয়ে বলেন, বুঝেছি আমি। আমার সঙ্গ পছন্দ হয়েছে। আপনার। ইউ কুড বি মাই জুনিয়র ফ্রেন্ড আউটসাইড আওয়ার অফিশিয়াল ডিউটিস।

ইটস মাই প্লেজার ম্যাডাম। খুব খুশি হলাম শুনে।

আপনাদের এলাকাটা খুব ভালো। ছোট শহর। তবু শহরটা টানে আমাকে।

বুঝতে পেরেছি। কুষ্টিয়ার প্রতি আলাদা টান আছে আপনার। আলাদা মায়াও আছে। এ কারণেই কি আমাকে নিয়োগ করেছেন ম্যাডাম?

কুষ্টিয়ার চেয়ে মিলপাড়া, আপনাদের এলাকা টেনেছে আমাকে বেশি। আবেদনপত্রে মিলপাড়া ঠিকানা দেখে অনেকগুলো দরখাস্ত থেকে আপনারটা আলাদা করে নিয়েছিলাম। নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছেন আপনি। তবে মিলপাড়া আপনার নিয়োগের একটা সূত্র হতে পারে।

সূত্রটার উৎস কী ম্যাডাম?

উৎস হচ্ছে, মিলপাড়া উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়।

স্কুল? স্কুলই কি উৎস?

না। কেবল স্কুল নয়। মূল উৎস ওই স্কুলের শিক্ষক সাখাওয়াত সায়াহ্ন।

উনি কে হন আপনার?

শৈশবে দেখা এক কিশোর।

শৈশবে দেখা কিশোরটিকে এখনো মনে রেখেছেন?

হুঁ।

দেখে এসেছেন দূর থেকে, দেখা করেননি তো!

দেখা করার চেয়ে দূর থেকে দেখতে পাওয়ার আনন্দটা বড়। দেখা করলে আনন্দ থাকত না হয়তো। কাছাকাছি থাকা, কাছাকাছি আছি ভাবতে শান্তি লাগে?

কেন ম্যাডাম?

প্রশ্নের জবাব দিলেন না জাফরিন নঈম। উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকেন। চোখে ধু ধু শূন্যতা ভেসে ওঠে। শূন্যতার ভেতর দিয়ে কল্পনার চোখে দেখতে লাগলেন ২৫ বছর আগের এক ঘটনা :

এক পাড়াতে থাকত সায়াহ্ন। দুরন্ত এক কিশোর। ফুটবল খেলোয়াড়। পড়াশোনায়ও সেরা। ভালো লাগে জাফরিনের। কিশোরী জাফরিন খেলার মাঠের কাছে গিয়ে দেখত সায়াহ্নর ছুটোছুটি। খেলতে খেলতে আড়চোখে জাফরিনকে দেখত সে। কী যে ভালো লাগা! কী যে টান তৈরি হয়েছিল দুজনার! ওই টানে একদিন ভোরে, তখনো দিনের আলো ফোটেনি, জাফরিনদের বাড়ির বাউন্ডারির ভেতর ঢোকে সায়াহ্ন, ধরা পড়ে যায় সে বড় ভাইয়ার হাতে। সায়াহ্নর হাত থেকে একটা চিঠি কেড়ে নেন ভাইয়া। বেদম পেটায় তাকে। তারপর তার আর খবর নেই। ঢাকা থেকে উধাও হয়ে যায় সে। নিরুদ্দেশ সায়াহ্নকে ২৫ বছর খুঁজে পাননি জাফরিন নঈম। রুবাদের দরখাস্ত আহ্বান করার আগে জেনেছেন, মিলপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে সায়াহ্ন। বিয়ে করেনি, সংসার করেনি–জানলেন এই সে দিন। শুনে অন্য রকম হয়ে গেছেন জাফরিন নঈমের মন।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জাফরিন নঈম বলেন, থাক এসব কথা। কাজের কথায় যাওয়ার আগে আপনার একটা প্রশ্নের জবাব দিতে চাই।

কী প্রশ্ন ম্যাডাম?

ওই যে, কুষ্টিয়া যাওয়ার সময় জানতে চেয়েছিলেন কোথায় জেনেছি রুবা নামটি।

নড়ে ওঠে রুবা। নতজানু হয়ে বলে, আজও আপনি রুবা নামে ডেকেছেন। আজও প্রশ্নটি এসেছে মনে।

তাহলে শুনুন, আপনার নিয়োগের পর থেকে বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছি আমি। বিষয়টি এককভাবে লড়েছি। স্পেশাল সিকিউরিটি এজেন্সি লেগেছিল আপনার পেছনে। তখন রুবা নামটি জেনেছি। প্রটেকশন দিয়েছি আপনাকে। কারণ নানা ধরনের অ্যানালাইসিস ও খোঁজখবর করে বুঝেছি, আপনি নির্দোষ। কেউ ষড়যন্ত্রের জালে জড়াতে চেয়েছিল আপনাকে। নিরীহ মেয়েদের উদ্ধারের জন্য কাজ করি, হেরে যাইনি। আমার কাছে অনেক বেশি আস্থাভাজন আপনি। বিশ্বাস করেছি আপনাকে। বিশ্বাস করে নিজের আবেগের কথাও শেয়ার করেছি। কুষ্টিয়ায় নিয়ে গেছি। বুঝতে হবে, প্রত্যেকের গোপন ঘরে অনেক অজানা ক্ষত থাকতে পারে। সেই ক্ষতের মূল্য দিতেও জানতে হবে।

আপনার মহানুভবতায় কৃতজ্ঞ আমি, ম্যাডাম।

কৃতজ্ঞতা জানালে বন্ধুত্ব হয় না। বন্ধুত্বের স্থান আরও ওপরে।

মনে থাকবে আপনার কথা।

অনেক সহজ হয়ে গেছেন জাফরিন নঈম। সহজ হয়ে অফিশিয়াল কথায় ফিরে এলেন। উৎসাহ দিয়ে বলেন, এখন থেকে ভয় পাবেন না আর। সাহস নিয়ে কাজ করবেন। অ্যাডভোকেট তাহমিনা আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করে জেলখানায় যাবেন। প্রয়োজনে আপনার রুমমেটদেরও সঙ্গে নিতে পারেন।

জি। বলেই বড় করে আবার শ্বাস ছাড়ে। বুকের ওপর থেকে নেমে গেল ভারী একটা বোঝা। বোঝা সরে গেলেও আবার প্রশ্ন এল মনে, জেলখানার কাজগুলো করতে পারব তো? কোনো অভিজ্ঞতা নেই ওই দিকে। রুমমেটদের নিতে বললেন কেন ম্যাডাম? অফিশিয়াল কাজে রুমমেটদের জড়ানো কি ঠিক হবে?

জাফরিন নঈম আবার যোগ করেন, ক্লায়েন্টের বিষয় গোপনীয়। চাই পারিবারিক পরিবেশে তার জেলমুক্তি। কোন পুনর্বাসন সেন্টারে নিয়ে যাচ্ছেন, মিডিয়া যেন টের না পায়। গোপন রাখতে হবে তার অবস্থান কিছুদিন।

জি। মনে থাকবে ম্যাডাম।

২২

প্রথম আলোর ছুটির দিনে, শনিবারের ক্রোড়পত্রটি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে কেমন যাবে এ সপ্তাহ-কাওসার আহমেদ চৌধুরীর আপনার রাশি কলামে চোখ বোলায় রুবা। মকর বিখ্যাত তার স্মৃতিশক্তি, ভালোবাসা, আন্তরিকতা, সততা এবং কঠোর পরিশ্রমের ক্ষমতার জন্য। পিছু ফিরে তাকিয়ে কষ্ট পেলেও পেছনের দিকে ফিরে যায় না সে। অতীত বন্ধুদের তাই মকরকে অনেক কিছুই বলার মতো থেকে যায়।

রাশিফল পড়ে নড়ে বসল রুবা।

রবিনের আচরণ নিয়ে কষ্ট পাচ্ছে ও। পেলেও ওকে কল করার ইচ্ছা আটকিয়ে রাখে। জেদ কাজ করছে মনে। জেদের সঙ্গে একধরনের দৃঢ়তাও চেপে ধরেছে ভেতরের আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা, উৎসাহ। হ্যাঁ। অনেক প্রশ্ন রয়েছে। রবিনের প্রতি। অনেক কিছু জানার আছে এ মুহূর্তে। অতীত বন্ধু নয় রবিন। বর্তমানের মানুষটি অতীত হবে কেন? রাশিফল মিলছে না রবিনের সঙ্গে। তাহলে কে অতীত বন্ধু? সিমিও তো জুনিয়র ফ্রেন্ড, রুমমেট। সিমি কি অতীত হয়ে গেছে? না। হতে পারে না। হোস্টেলে এলে ভালো মেয়েটির কথা মনে পড়ে। কষ্ট জাগে মনে। অতীত তবে কাকে বলে? সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের ঢেউ –পেছনের ঘটনা কি ঠেলে নিচ্ছে সামনে? আপনি নিজেই আপনার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন ৯০ থেকে ৯৬ ভাগ। বাকিটা নিয়তি। নিজের ভাগ্য কি নিজের হাতে খুঁড়ছে রুবা? সিমিও কি আপন ভাগ্য খুঁড়ে ঢুকে গেছে গর্তে, পলাতক হয়েছে? নাকি জীবনের গতিপথ বদলে দিয়েছে নিয়তি? কে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, কেউ তো জানি না আমরা। জাফরিন নঈমের অফিসে তাকে টেনে নিয়ে গেছে কে? নিয়তি, না ভাগ্য? জানে না রুবা। পরিশ্রমের মাধ্যমে ভাগ্য শাসন করা যায়, ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কেবল পরিশ্রম করলে হবে? আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে না? আবেগ না নিয়ন্ত্রণ করলে কেবল শ্রম কি লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে কাউকে? পারে না। ভেবে শান্ত হয় রুবা। সেলফোন হাতে নেয়। রবিনকে কল করার জন্য মনস্থির করে। তিমুর সঙ্গে রবিনের সম্পর্কের বিষয়টি খোলস হতে হবে। হয় এপার নইলে ওপার। ডিসিশন ইজ ডিসিশন।

কল করার আগে নিজের সেলফোনে রিংটোন বেজে ওঠে। অ্যাডভোকেট তাহমিনা আলম কল করেছেন। ওনার নম্বর স্টোর করে রেখেছিল। কল পেয়ে সোজা হয়ে বসে রুবা।

ইয়েস বাটনে চাপ দিয়ে লাইন কানেক্ট করে বলে, অফিস এক্সিকিউটিভ জাহানারা তাবাসসুম বলছি।

আমি অ্যাডভোকেট তাহমিনা আলম বলছি।

বলুন। শান্তভাবে বলল রুবা।

আমাদের নতুন ক্লায়েন্ট এক টিনএজার, ছাড়া পাবে আগামীকাল সকাল নটায়। জেলখানার গেট থেকে তুলে দিতে চাই আপনার হাতে। কান্ট্রি ডিরেক্টর সেভাবে নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন আমাকে।

শিওর। জেলখানা থেকে রিসিভ করে নেব আমরা। নিশ্চিত থাকুন আপনি।

কেস বেশ সেনসিটিভ। ক্লায়েন্টকে মিডিয়া থেকে লুকিয়ে রাখতে হবে। খুব সাবধানে নিয়ে যেতে হবে পুনর্বাসন কেন্দ্রে, যেন কেউ টের না পায়।

অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করব আমরা।

চটকদার খবরের আশায় অফিসে অনেক সোর্স ঘোরাঘুরি করে। রিসিভ করে অফিসে জানাবেন না কিছু।

জি। বিষয়টা খেয়াল রাখব। সেনসিটিভ ইস্যুটা কী জানতে পারি আমি?

ডেফিনিটলি, আপনাকে তো জানাতে হবে। স্পেশাল সিকিউরিটি ব্রাঞ্চ কেসটা নিয়ে কাজ করেছে। তাই কেসটার সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করা জরুরি। সেভাবে রক্ষা করেছি আমরা। আপনারাও রক্ষা করবেন।

অবশ্যই। আশ্বস্ত করে রুবা।

মেয়েটি একটি প্রতারকচক্রের পাতানো জালে পা দিয়েছে। না বুঝে ঢুকে গেছে অপরাধ জগতে। প্রথমে প্রতারকচক্রের একজন ভালোবাসার জালে জড়িয়েছে তাকে। তারপর নেশার জগতে ঢুকিয়ে দেয়। পরবর্তী সময়ে তার সঙ্গে শারীরিক মেলামেশা শুরু করে দামি হোটেলে নিয়ে। মেলামেশার দৃশ্য ভিডিও করে তারা। পর্ন ছবি তৈরি করে। এই চক্র দীর্ঘদিন ধরে এভাবে ফাঁদ তৈরি করে বাঙালি মেয়েদের নিয়ে পর্ন ফিল্ম তৈরি করে পাচার করত দেশের বাইরে। পুরো চক্রটা ধরা পড়েছে। মেয়েটিকে উদ্ধার করেছে স্পেশাল ব্রাঞ্চ। আপনাদের দায়িত্ব দিয়েছে পুনর্বাসনের।

অ্যাডভোকেট তাহমিনা আলমের কথা শুনে থরথর করে কেঁপে ওঠে রুবা। হাহাকার করে ওঠে মন। এমন কোনো বিপদে পড়েনি তো সিমি! ভাবতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল ও। ম্যাডাম বলেছিলেন কেসটির বিষয় গোপন রাখতে হবে। এমন অচিন্তনীয় গোপন বিষয়! রুবা স্তব্ধ হয়ে থাকে কিছুটা সময়।

অপর পক্ষের সাড়া না পেয়ে তাহমিনা আলম আবার বলেন, শুনছেন আমার কথা?

প্রশ্ন শুনে বাস্তবে ফিরে আসে রুবা। কম্পমান গলায় বলে, শুনছি। বলুন।

মনে হচ্ছে কাঁপছেন আপনি। এ ধরনের কেস আগে ডিল না করলেও দুর্ভাবনার কিছু নেই। সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে সব পরিস্থিতি।

জাহেদ আকবর স্যারের কথা মনে পড়ে। সাহসী হতে হবে। সহমর্মী হতে হবে। সহানুভূতিতে নিজেকে গলিয়ে ফেললে চলবে না। তেজস্বিনী কান্ট্রি ডিরেক্টরের দৃঢ়তার কথাও মনে পড়ে। সব মিলিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে রুবা বলে, চারপাশে মেয়েদের জন্য বিছানো নানা ফাঁদের কথা শুনেছি। এ ধরনের অবিশ্বাস্য ফাঁদও ওত পেতে থাকতে পারে ভেবে দিশেহারা হয়েছি। ঠিক হয়ে গেছি এখন।

তাহলে দেখা হবে আগামীকাল সকাল নটায়। ম্যাডাম বলেছিলেন, অফিশিয়াল পরিবেশে না, পারিবারিক সদস্যরা তাকে নিয়ে যাচ্ছে, জেলগেটে এমন একটি আবহ তৈরি করতে হবে। বিষয়টি আপনাকে ব্রিফ করবেন বলেছিলেন ম্যাডাম। বলেছিলেন তো?

হ্যাঁ। সেভাবে যাব আমি। নিশ্চিত থাকুন আপনি।

থ্যাংকস। কথা শেষ করে লাইন কেটে দিয়েছেন অ্যাডভোকেট তাহমিনা আলম।

কিছু প্রশ্ন করার ছিল। জানার ছিল অনেক বিষয়। প্রশ্ন করার কথা ভুলে গেছে রুবা। ঘটনার সিরিয়াস ইমপ্যাক্ট জট তৈরি করে দিয়েছে ব্রেনে। অবিশ্বাস্য ঘটনার বর্ণনা শুনে আকস্মিক ধস নেমে গেছে আবেগে, চিন্তায়। ভোতা হয়ে গেছে রুবা। কমিউনিকেশনে পারফরমেন্স খারাপ হয়ে গেছে। বিষয়টি টের পেয়ে গেছেন তাহমিনা আলম। না। অন্যের সামনে নিজের দক্ষতা আর খাটো হতে দেবে না ও প্রতিজ্ঞা করে। ভাবতে পারল একটি বড় প্রতিষ্ঠানের অফিস এক্সিকিউটিভ ও। নিজেকে আশ্বস্ত করল রুবা। অভিজ্ঞতা উন্নত করে মানুষের পারফরমেন্স। ধীরে ধীরে নিজেও দক্ষ হয়ে উঠবে পরিস্থিতি মোকাবিলায়। নিজেকে হেয় ভাবার কোনো কারণ নেই। এমন ভাবনায় শক্ত হয়ে ওঠে ও।

তাহমিনা আলমের বক্তব্য শোনার সময় মস্তিষ্কের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে সিডর। ঝড়ের পর যেমন লন্ডভন্ড হয়ে মানুষ আবার শুদ্ধ হয়ে উঠে দাঁড়ায়, রুবাও পরিশুদ্ধ করে নেয় নিজেকে। পলাতক সিমির জন্যও দুশ্চিন্তার ঝড় তৈরি হয়েছিল। সেই ঝড়ও সামলে নিয়েছে। মনে আসতে নাড়া দিতে চেয়েছিল ছোট বোন আনিকাকে নিয়ে অশুভ চিন্তা। চিন্তাটাও থামিয়ে দিয়েছে রুবা। তিমুকে নিয়ে থামেনি মনের ঝড়। হঠাৎ মনে প্রশ্ন এল, রবিনের মনে কোনো প্রশ্ন ঢোকেনি তো আকবর স্যারকে নিয়ে? শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে ফোন করেছিল সে আনিকাকে। ফাজলামো করেছে আনিকা জাহেদ আকবরকে নিয়ে। তখন স্যারকে নিয়ে কোনো সন্দেহ ঢোকেনি তো রবিনের মনে? অ্যারোসট্রোক্রেট রেস্টুরেন্টে চা খাওয়ার সময়ও ফোন করেছিল রবিন। কে আছে সঙ্গে, জানতে চেয়েছিল। উত্তর দেয়নি রুবা। সব মিলিয়ে রবিনের মাথায় জোরালো হয়েছে কি স্যারকে নিয়ে অযাচিত সন্দেহ?

প্রশ্নগুলো তাড়িয়ে বেড়াল রুবাকে। একসময় সহজ হয়ে ও ফোন করল রবিনকে।

রিং হচ্ছে…

কল ধরছে না রবিন। নো আনসার ভেসে ওঠে মনিটরে।

আবার কল করে রুবা।

আবারও রিং হচ্ছে…

এবারও কল ধরল না রবিন। আবারও ভেসে ওঠে নো আনসার।

দমে যাওয়ার পাত্রী নয় রুবা। আবার কল দেয় ও।

হ্যাঁ। কল অ্যাটেন্ড করেছে রবিন। গম্ভীর থেকে বলে, কী বলবে, বলো।

এভাবেই ফোন ধরে রুবা। একই কথা ফিরিয়ে দিল রবিন।

কী বলব মানে? ফোন ধরছিলে না কেন?

ইচ্ছা করে ধরিনি। কারও ফোন না ধরলে মেজাজ কেমন খারাপ হয় বোঝার দরকার আছে তোমার।

আমার ফোন করার প্রয়োজন কী? টিনএজ তিমু আছে তোমাকে এসএমএস দেওয়ার জন্য। তার ফোনে মন ভরে না?

ওহ? তাহলে মনের মধ্যে এ বিষ ঢুকিয়ে বসে আছ? কল না করে, কল ধরে এ কারণে শাস্তি দিচ্ছ আমাকে?

বসে আছি মানে কী? যা সত্যি, তা-ই তো বলছি। মিথ্যা

সত্যি বুকে নিয়ে বসে আছ। অযথা সন্দেহ ঢুকিয়ে রেখেছ মনে। অযথা শাস্তি দিয়েছ আমাকে।

তো সত্য সত্যিটা কী?

সত্যটা হচ্ছে তিমুকে পড়ানো ছেড়ে দিয়েছি। ভর্তি হয়েছি এমবিএ কোর্সে। চাকরি করছি সকালবেলা। আর বিয়ের জন্য লোন নেওয়ার ব্যবস্থা করছি। আমার গার্মেন্টসের এমডিকে সব বলেছি। তিনি হেলপ করছেন। ঝড়ের বেগে কথাগুলো শেষ করে রুবাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবার বলতে থাকে রবিন, তোমার মতো তো হ্যাঁন্ডসাম পুরুষ বসের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছি না। কাজ করছি। সব প্রোডাকটিভ কাজ। বলেই থেমে যায় রবিন।

রবিনের কথার প্রথম অংশ শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিমুকে নিয়ে মনের ঝড় শান্ত হয়ে যায়। আনন্দে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হয়েছিল। পরবর্তী কথা শুনে

আনন্দের কান্না থেমে যায়। বিস্ময় নিয়ে রুবা প্রশ্ন করে, তাই বলে বুড়ো বসের সঙ্গে সন্দেহ করবে আমাকে?

তুমি কেন টিনএজ ছাত্রীর সঙ্গে সন্দেহ করেছ আমাকে? পাল্টা প্রশ্ন করে রবিন।

কেউ কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। রুবার বুকের ভেতর ছুটে এলো হু হু কান্নার স্রোত। এ স্রোত আনন্দের। এ স্রোত ভালোবাসার। রবিনও অপর প্রান্তে কাঁদতে শুরু করে। দুই কান্নার ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে গেল দুজনের মনে তৈরি হওয়া সন্দেহের স্রোত। ভালোবাসায় পূর্ণ থেকে পূর্ণতর হতে লাগল দুটি মন…

২৩

লাল রঙের উঁচু প্রাচীরের দিকে অবাক হয়ে তাকাল রুবা। এর আগে কখনো আসেনি জেলখানার সামনে। এই প্রথম এসেছে। সঙ্গে আছে রুমমেট মণি ও সানিয়া। লাল প্রাচীরের এপারের মুক্ত মানুষ আর ভেতরের আটক মানুষের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? সবার দেহে বহমান লাল রক্ত। সবার রক্তের উপাদান এক। অথচ একদল শৃঙ্খলিত। আর একদল মুক্ত। ভেতর আর বাইরের মানুষের চিন্তা, আবেগ, প্রেষণা কি এক, না ভিন্ন? যাদের চিন্তায় ত্রুটি ঢুকে যায়, ভুল করে তারা, ভুল পথে পা দেয়। বাজে আবেগের ঘোরে ওলটপালট কাণ্ড ঘটে যায়, হারিয়ে ফেলে নৈতিকতা, সামাজিক রীতিনীতি লঙ্ঘন করে বসে তখন সজ্ঞানে। হয়ে যায় অপরাধী। অপরাধীর খাতায় নাম লিখে একসময় ঠিকানা হয় লাল দেয়ালের ভেতর। ভুল কি শোধরাতে পারে? আবেগ কি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তারা? মনের ঘরে কি নাড়া খায়? একজন অশুদ্ধ মানুষ কি বদলে গিয়ে ফিরে আসে শুদ্ধ মানুষ হয়ে? ভাবছে রুবা। কথা বলছে না মণি। কথা বলছে না সানিয়া। বিস্ময় নিয়ে ওরা তাকিয়ে থাকে লাল ভবনের দিকে।

ভবনের মূল গেট অনেক উঁচু। ব্রিটিশ আমলের তৈরি পুরু গেটটির আকৃতি উল্টা ইউর মতো। গেটের দুপাশের ভারী দুটি দরজা লোহার শিকলে বাঁধা। ভারী রডের ভেতর বেশ মোটা সাইজের লোহার হুকের মধ্যে ঝুলছে বিশাল আকৃতির তালা। পাশে রয়েছে মানুষ পারাপারের ছোট একটা পথ। সে-পথ দিয়ে মাথা নিচু করে বের হচ্ছে জেলপুলিশ। ঢোকার সময় নিচু করতে হয় মাথা। মাথা নিচু করার এ ব্যবস্থা কী শিক্ষা দেয়? উঁচু মাথা সব সময় উঁচুতে থাকে না। কখনো কখনো নিচে নামতে বাধ্য হয়। এ শিক্ষা কি পায় ভেতরের মানুষেরা?

কিছুদিন আগে জরুরি আইনের সময় অনেক রাজনীতিবিদ, আমলা ঢুকেছেন এ জেলখানায়। তাঁদের অনেকে বেরিয়ে এসে বলেছেন, এটা হচ্ছে প্রাইমারি স্কুলের মতো। বলেছেন জেলখানায় না এলে বোঝা হতো না। রাজনীতি কী? নিজেকেও চেনা হতো না। নিজেকে চেনাটা কি বড় শিক্ষা?

শুধু ওদের ক্লায়েন্ট না, আরও অনেক হাজতি কিংবা কয়েদি বের হবে সম্ভবত। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আরও কয়েকটি পরিবার। শুনেছে, জেলখানার সামনে ঘুরে বেড়ায় অনেক ধাপ্পাবাজ-বাটপার-দালাল। ওদের দেখা যাচ্ছে না। এখনো সম্ভবত ওদের আনাগোনা শুরু হয়নি। জেলখানার বাইরে এখনো তেমন জট তৈরি হয়নি।

এখন সকাল আটটা আটান্ন মিনিট। বেজে উঠেছে রুবার মুঠোফোন।

অ্যাডভোকেট তাহমিনা আলম ফোন করেছেন। কল ধরে রুবা বলে, জেলখানার সামনে অপেক্ষা করছি।

অপেক্ষা করুন। আমি ভেতরে সহকারী জেলারের রুমে আছি। জেলগেটের ডানে থাকুন। গাড়ি এনেছেন?

অফিসের গাড়ি আনিনি। সঙ্গে আছে একটা হলুদ ক্যাব। অফিসের কেউ নয়, এমন দুজন মেয়েও আছে সঙ্গে।

গুড। একটু পর ক্লায়েন্টকে নিয়ে বের হব আমি। রেডি থাকুন আপনারা।

রেডি আছি আমরা। আসুন আপনি।

লাইন কেটে যায়। সকাল নটা এখন। অ্যাডভোকেট তাহমিনা আলমের ফোন পেয়ে অবাক হলো রুবা। এত সিনসিয়ার তিনি! ওদের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই ভালো। সময়ের প্রতি যত্নবান। ভাবতে ভালো লাগছে। জেলখানায়ও কি সবকিছু সময় মেপে হয়? পরিকল্পনামতো জাস্ট টাইমে ঘটছে সব। এজন্য স্বস্তি পাচ্ছে রুবা।

নটা ১০ মিনিটে বের হলেন অ্যাডভোকেট তাহমিনা আলম। সঙ্গে বোরকা পরা একটা মেয়ে। পিছিয়ে ছিল তারা। তাহমিনা আলম দেখতে পাননি। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। খুঁজছেন রুবাকে।

পেছন থেকে এগিয়ে রুবা বলে, এই যে আমি।

রুবার কণ্ঠ শোনার সঙ্গে সঙ্গে বোরকার ভেতর মেয়েটি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ঝাঁকি খেল। চট করে মুখের পর্দা সরিয়ে ঘুরে তাকাল পেছনে। ভয়াবহ এক চিৎকার দিয়ে কান্নায় ভেঙে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে রুবার বুকে। মেয়েটি আর কেউ নয়–প্রিয় রুমমেট সিমি। মণি ও সানিয়াও বিমূঢ় হয়ে গেছে। মুহূর্তের মধ্যে ফিরে এল তারা বাস্তবে। দুজনেই জড়িয়ে ধরল সিমিকে। কাঁদতে লাগল সিমি। কাঁদতে লাগল মণি, কাঁদতে লাগল সানিয়া। রুবার কান্নাও থামছে না।

হতভম্ভ হয়ে গেছেন অ্যাডভোকেট তাহমিনা আলম। জেলগেটে নকল পারিবারিক পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। আশপাশের সবাই দেখছে পরিবারের সদস্যদের কান্না। এমন মৌলিক রি-অ্যাকশন প্রায়ই ঘটে জেলগেটে। পরিবারের সদস্যরা আসামি বা হাজতিকে ফিরে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। এখনো দেখছেন মৌলিক চিত্র। দেখছেন মানুষের প্রতি মানুষের মমতার টান, ভালোবাসা। অনন্যসাধারণ আত্মীয়তা।

একটু সময় নিলেন তাহমিনা আলম। কান্নার সুযোগ দিলেন সবাইকে।

কিছুক্ষণ পর সহজ হয়ে রুবা বলে, কোনো প্রসিডিউর আছে?

হ্যাঁ। এই কাগজে সই করতে হবে।

কাগজ টেনে নিয়ে সই করে রুবা। ক্লায়েন্টকে বুঝে নেয় নিজের তত্ত্বাবধানে।

তাহমিনা আলম বলেন, ক্লায়েন্টকে কি দেখেছিলেন আগে?

হ্যাঁ।

আপনার পরিচিত? নাকি অফিশিয়াল পরিচয়?

পরিচিত।

জানতেন, কে এই ক্লায়েন্ট?

না। এখন জানলাম।

নিচু গলায় রুবাকে উদ্দেশ করে তাহমিনা আলম বলেন, গোপনীয়তার প্রাথমিক স্টেপ সাকসেসফুল। দ্বিতীয় স্টেপ হচ্ছে, পুনর্বাসন সেন্টারেও গোপনীয়তা বজায় রাখা। আর একটা কাজ করা যেতে পারে। ম্যাডামের সঙ্গে আলাপ করে নেবেন। কিছুদিন ওকে ঘরোয়া পরিবেশে রাখলে ভালো হতো। মানসিক সাপোর্ট বেশি পেত। এটা আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা।

রুবা বলে, আলাপ করব ম্যাডামের সঙ্গে।

তাহমিনা আলম ভেতরে যাচ্ছিলেন, ফিরে এসে সিমির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, সবাই আমরা তোমার পাশে আছি। ওকে?

জবাব দিতে পারল না সিমি। কেবল কৃতজ্ঞ চোখে কান্নায় জড়িয়ে একবার তাকাল এমন দরদি মানুষটির দিকে।

সিমিকে বুকে জড়িয়ে ধরে রুবা এগোতে লাগল অপেক্ষমাণ হলুদ ক্যাবের দিকে।

গাড়িতে ওঠার আগে ফোন দেয় ম্যাডামকে। গাড়িতে কথা বলা ঠিক হবে বুঝতে পারে।

ফোন রিসিভ করে কান্ট্রি ডিরেক্টর জাফরিন নঈম বলেন, ক্লায়েন্ট রিসিভ করেছেন?

জি। রিসিভ করেছি।

ভালো আছে সে?

জি। আমাকে সামনে পেয়ে ভালো বোধ করছে মনে হচ্ছে।

গুড। পুনর্বাসন কেন্দ্রে বলে রাখছি আমি। গোপনীয়তা যেন ফাঁস না হয়।

জি ম্যাডাম। ফাঁস হবে না।

আপনার গলা এমন ভারী কেন, রুবা? ম্যাডাম, ক্লায়েন্ট আমার পরিচিত।

হ্যাঁ। আমি জানি।

ম্যাডাম, ও আমার রুমমেট।

তাও জানি আমি।

অনেক কষ্টের মাঝেও অবাক হলো রুবা। ম্যাডাম সব জানেন অথচ কিছুই বলেননি তাকে।

ও খুব ভালো মেয়ে ম্যাডাম।

ডেফিনিটলি ভালো মেয়ে।

ও কোনো অপরাধ করতে পারে না, ম্যাডাম। বলতে বলতে কেঁদে ফেলে রুবা।

ক্লায়েন্ট ফাঁদে পড়েছিল, সেটাও বলেছি আমি আপনাকে।

রুবার গলায় কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। দৃঢ় হয়ে জাফরিন নঈম বলেন, আপনি কাঁদছেন। মনে রাখতে হবে, ইউ আর দি অফিস এক্সিকিউটিভ অব আওয়ার ইনস্টিটিউশন।

ম্যাডামের ভয়েস শুনে নাড়া খেল রুবা। ব্যক্তিগত সম্পর্কের দেয়াল টপকিয়ে আবার ফেরত এলে কর্তব্যের সীমানায়। শক্ত হয়ে বলে, আর কাদব।

ম্যাডাম।

গুড।

একটা প্রপোজাল আছে আমার। অ্যাডভোকেট তাহমিনা আলম বলেছেন, ওকে কিছু দিন পারিবারিক পরিবেশে রাখলে ভালো হয়। আমিও মনে করছি কয়েক দিন আমাদের মধ্যে থাকুক। আপনার অনুমতি পেলে তিন দিনের ছুটি চাইব ম্যাডাম।

কিছুক্ষণ ভেবে জাফরিন নঈম বললেন, ওকে। ইউ আর অ্যালাউড। তবে ছুটির প্রয়োজন নেই। এটা আপনার অফিশিয়াল দায়িত্ব।

আই অ্যাম গ্রেটফুল টু ইউ।

গ্রেটফুল হওয়ার কিছু নেই এখানে। হোস্টেলে তোলার সময় অন্যরা যেন বোঝে, ও অসুস্থ ছিল। বাড়িতে ছিল এত দিন।

জি ম্যাডাম। সেভাবে ব্যবস্থা হবে সব।

ওর সব খরচ করবেন অফিশিয়ালি। বিল অফিস থেকে দেওয়া হবে। আপনার কাছে থাকলে মমতা পাবে, সেটা জরুরি।

এ কথার কোনো জবাব হয় না। চুপ করে থাকে রুবা।

ওর সিট রেন্ট আপনি দিয়েছেন, তাই না?

জি। বলে অবাক হয় রুবা। ম্যাডাম ওর নাড়ি-নক্ষত্র সব জানে দেখছি।

সেটাও অফিস থেকে দেওয়া হবে। মনে রাখবেন, এ ধরনের ক্লায়েন্টদের জন্য আমরা ডোনেশন পাই বাইরে থেকে। টাকাগুলো সঠিকভাবে যেন খরচ হয়, বিষয়টা নিয়ে অফিস এক্সিকিউটিভ হিসেবে সৎ হতে হবে আপনার, আমার, সবাইকে। কথা শেষ করে, উইশ ইউ গুড লাক বলে লাইন কেটে দিলেন তিনি।

সিমিকে বুকে জড়িয়ে হলুদ ক্যাবে উঠে বসে সবাই।

একজন সামনের সিটে বসা দরকার। কেউ যাচ্ছে না সামনে। চারজনে গাদাগাদি করে বসেছে পেছনে। সিমি মাথা তুলছে না। মাথাটা ঠেসে রেখেছে রুবার বুকের সঙ্গে। মমতার পরশ পেয়ে শক্তি পাচ্ছে একদম ভেতর থেকে।

.

পুরান ঢাকা থেকে গাড়ি বেরিয়ে এসেছে। এখন দোয়েল চত্বর থেকে ছুটে যাচ্ছে টিএসসির দিকে। রিংটোন বাজে রুবার মুঠোফোনে।

মনিটরে দেখে আনিকার ফোন।

আপু, কেমন আছ তুমি?

এ প্রশ্ন করছিস কেন?

এখন একটা দুঃসংবাদ দেব তোমাকে।

কী দুঃসংবাদ?

মন শক্ত করে শুনবে।

মন শক্ত করেছি, বল।

আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি।

দ্রিম করে শব্দ-বুলেট আঘাত হানে ব্রেনে। ঝিঁঝি করে ওঠে মাথা। বাকরুদ্ধ থাকে কতক্ষণ।

আপু, শুনছ আমার কথা?

আনিকার প্রশ্ন শুনে আরও গম্ভীর হয়ে রুবা বলে, শুনছি।

বিয়ে রেজিস্ট্রি করে ফেলেছি আমি।

এবার স্কাড এসে ঢোকে বুকে। ভেঙেচুড়ে গুঁড়িয়ে গেছে বুক। তবু শক্ত থেকে প্রশ্ন করে, ছেলেটা কে?

সেই গায়ক–বিজনেসম্যান।

ঠান্ডা স্বরে রুবা বলে, কনগ্র্যাচুলেশন!

আনিকা অপর প্রান্ত থেকে চিৎকার করে ওঠে। মেনে নিয়েছ তুমি?

হ্যাঁ।

ইউ আর সুইট, আপু!

বাসায় ফিরে যা এখন। নিয়মমতো সবকিছুর অ্যারেঞ্জ করব আমি।

বাবা কি গ্রহণ করবে আমাকে? তাড়িয়ে দেবে না?

না। তাড়িয়ে দেবে না। বাবার সঙ্গে কথা বলব আমি। তুই বাসায় যা।

কথা শেষ করে লাইন কেটে দিয়েছে রুবা। স্তব্ধ হয়ে গেছে। শূন্য হয়ে গেছে চোখ। আরও মমতায় সিমির মাথা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে ভাবে, ভুল করেছে আনিকা। ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর ভুল করতে দেবে না ওকে। ভুল শুদ্ধ করে ফিরিয়ে আনতে হবে ওকে আলোর পথে…কোনোভাবে ডুবে যেতে দেবে না।

নিজের কথা একদম মনে এল না রুবার। এখন মন দখল করে আছে। আনিকা। মন দখল করে আছে সিমি।

আলোর পথের যাত্রী রুবা। আলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সব বাধা ডিঙিয়ে…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *