1 of 2

না যেন করি ভয়

না যেন করি ভয়

গরম বেগুনিতে কামড় দিয়ে শানু একটু বিপদে পড়ল। হাঁ করে ফুঁ দিয়ে বেগুনির টুকরোটাকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করল। তারপর সাবধানে ছ্যাঁকা বাঁচিয়ে ওটাকে কামড় দিতে-দিতে বলল, ‘আসলে আইটা উ আজে—।’

টুনটুন জিগ্যেস করল, ‘কী বললে? কী বললে?’

বেগুনিটাকে ঠিকঠাক কবজা করে শানু আবার একই কথা বলল, ‘আসলে বাড়িটা খুব বাজে—।’

শানুর মা অনিতা, মানে টুনটুনের মাসি, ভুরু কুঁচকে ছেলেকে আলতো ধমক দিয়ে বললেন, ‘ওকে এসব আজেবাজে কথা বলার কী দরকার! ছেলেটা ক’দিনের জন্যে বেড়াতে এসেছে।’

শানু মাসতুতো বোনের দিকে একবার তাকিয়ে একমুঠো মুড়ি মুখে ঢেলে দিল। তারপর সেটা চিবোতে-চিবোতে বলল, ‘আগে থেকে না বলে রাখলে প্রবলেম আছে, মা। নইলে কোন রাতে দেখবে বাঁশির আওয়াজ শুনে…।’

অনিতা তাড়াতাড়ি ছেলেকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘থাক, থাক—এখন ওসব বাজে কথা থাক। ও সবে এসেছে…।’

টুনটুন হেসে উঠে হাত নেড়ে বলল, ‘ওতে আমি ভয় পাব না, মাসি। ওরকম ভুতুড়ে বাড়ির গল্প আমি অনেক পড়েছি। শুধু দেখতেই যা বাকি! তো শানুদা যদি হেলপ করে তা হলে সেই বাকিটুকুও আর থাকবে না।’

কথা শেষ করে টুনটুন মুড়ি-তেলেভাজায় মন দিল।

বাইরে ঝমঝম শ্রাবণের বৃষ্টি। শুরু হয়েছে সেই দুপুর থেকে—আর এখন সন্ধে সাতটা। আকাশের যা হাঁকডাক আর জলের যা তোড় তাতে মনে হয় না এ-বৃষ্টি মাঝরাতেও থামবে।

না থামুক ক্ষতি নেই। কারণ, টুনটুন জানে, বৃষ্টি-ঝমঝম সন্ধেবেলাতেই ভূতের গল্প-টল্প ভালো জমে। তাই ও চেয়ারে নড়েচড়ে বসে বেশ আশা নিয়ে পলকহীন চেয়ে রইল শানুর দিকে। ওর নজরে একটা বেপরোয়া ভাবও ছিল। সেই ভাবটা যেন বলতে চাইছে, এসো, কত ভয় দেখাবে দেখাও। পরীক্ষা করেই দ্যাখো আমি ভয় পাই কি না।

বিকট শব্দে বাজ পড়ল বাইরে। কাচের জানলার নীলচে সাদা আলো ঝিলিক মারছে বারবার। সেদিকে একপলক দেখে অনিতা শানুর দিকে তাকিয়ে বেশ চিন্তার গলায় বললেন, ‘তোর বাপিকে কতবার করে বললাম, এখন বেরিয়ো না। জেদ ধরে সেই গেলই। ছাতাতে কি এ-বৃষ্টি আর আটকায়! দেখিস একেবারে ভিজে কাক হয়ে ফিরবে…।’

টুনটুনের মেসো গেছেন ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে খবর দিতে। কারণ, ফ্রিজের গায়ে হাত দিলে নাকি শক মারছে। টুনটুন আজ বিকেলে শক খেয়েছে বলেই মেসোর চিন্তাটা হয়েছে আরও বেশি। সকালে এসে পৌঁছেছে যে-অতিথি সে কি না বিকেলের মধ্যেই শক খেয়ে বসে আছে!

টুনটুন যতই মেসোকে বুঝিয়েছে যে, শকটা হালকা চিনচিনে—ওর তেমন কিছু লাগেনি, মেসো ততই জেদ ধরে বলেছেন, ‘ইলেকট্রিক শক মানে ইলেকট্রিক শক। তাকে কখনও খাটো করে দেখা উচিত নয়…।’

শানু ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে কাঁচুমাচু মুখে আবদার করে বলল, ‘মা, প্লিজ, ওকে শর্টে কালো বাড়ির ব্যাপারটা একটু বলি। ও তো ভয় পাবে না বলছে। তা ছাড়া ও এখানে নতুন। ওকে একটু অ্যালার্ট না করে দিলে কখন কী হয়…।’

অনিতা নিমরাজি হলেন: ‘বললে বল। এরপর রাতে যদি ও ভয় পায়…।’

টুনটুন তেলেভাজা চিবোতে-চিবোতে তাড়াহুড়ো করে বলে উঠল, ‘না, না, মাসি। তুমি শুধু-শুধু ভয় পাচ্ছ। আমার..।’

শানুও তাল মিলিয়ে বলল, ‘রাতে ও ভয় পাবে কী করে? ও তো তোমার আর আমার সঙ্গে শোবে…।

শেষ পর্যন্ত অনিতা হার মানলেন। ওদের জন্য আরও কয়েকটা বেগুনি ভাজতে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলেন।

শানু মুড়ি-তেলেভাজা খেতে-খেতে বলল, ‘তোকে ব্যাপারটা বলছি…কিন্তু বাপির সামনে এ নিয়ে একটা কথাও বলবি না।’

টুনটুন ঘাড় নাড়ল। কয়েকবার পা দুলিয়ে শানুর দিকে ঝুঁকে এল।

টুনটুন এবার মাধ্যমিক পাশ করেছে। শুধু পাশই করেনি, চারটে লেটার এবং স্টার পেয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওর মন ভরেনি। রেজাল্টটা আরও ভালো হবে আশা করেছিল। ওর স্কুলের টিচাররাও এই রেজাল্টে কিছুটা হতাশ হয়েছেন। ফলে রেজাল্ট বেরোনোর পর টুনটুন ক’টা দিন বেশ মনমরা হয়েছিল। তাই দেখে মা আর বাপি দুজনেই ঠিক করলেন, ও মাসির বাড়ি ক’দিন ঘুরে আসুক।

টুনটুনের মেসোর বদলির চাকরি। মাসছয়েক আগে বদলি হয়ে এসেছেন তিলকপুরে। সুতরাং টুনটুনের মন ভালো করতে মাসির বাড়িতেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ওকে।

আজ সকালেই বাপি ওকে পৌঁছে দিয়ে কলকাতায় ফিরে গেছেন। সাত-আটদিন পর এসে আবার নিয়ে যাবেন।

বাপি চলে যাওয়ার পর টুনটুনের কিছুক্ষণ মনখারাপ লেগেছিল, কিন্তু শানু ওর সঙ্গে গল্পে মেতে উঠতেই মনখারাপের ব্যাপারটা ওর মাথা থেকে উবে গেল। আর তারপরই শুরু হল বৃষ্টি।

শানু টুনটুনের চেয়ে বছর চারেকের বড়। ও বি. কম. পড়ছে বটে, কিন্তু পড়াশোনা ওর ভালো লাগে না। সবসময় অ্যাডভেঞ্চার খুঁজে বেড়ায়। ওর জন্য চিন্তা করে-করে মাসি নাকি রোগা হয়ে গেছে।

টুনটুন এসব কথা মায়ের মুখেই শুনেছে। শুনে-শুনে ‘শানুদা’কে ও অপছন্দ করতে শুরু করেছিল। কিন্তু এখানে এসে শানুর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর, গল্প করার পর, ‘শানুদা’কে ওর দারুণ পছন্দ হয়ে গেছে।

কত গল্পই যে করতে পারে শানু!

শানুর গল্পের জন্যেই টুনটুনের এখনই মনে হচ্ছে মাসির বাড়িতে ও এসেছে ক-ত দিন যেন হয়ে গেছে। অথচ ও এসেছে আজ সকাল ন’টায়—আর এখন সবে সন্ধে সাতটা।

তেলেভাজা-মুড়ি খেতে-খেতে কালো বাড়ির কাহিনি শোনাল শানু। শুনতে-শুনতে টুনটুনের মনে হল, শানুদা বোধহয় বইয়ে পড়া কোনও ভূতের গল্প ওকে শোনাচ্ছে। টুনটুন অসংখ্য ভূতের গল্প পড়েছে, আর সেগুলো যে ‘গল্প’ সে নিয়ে ওর মনে কোনও সন্দেহ নেই। ও ভূতের গল্পের পোকা হলেও ভূতে ওর একফোঁটা বিশ্বাস নেই। কারণ, মাধ্যমিক পরীক্ষায় অঙ্কে যে নিরানব্বই আর ফিজিক্যাল সায়েন্সে চুরানব্বই পায় ভূতে তার বিশ্বাস থাকবে কেমন করে!

সুতরাং বেশ মন দিয়ে শানুর গল্প শুনল টুনটুন। শুনতে-শুনতে একটু যে গা-ছমছম করেনি তা নয়। কিন্তু ভূতের কোনও গল্প পড়ার পর বেশ ভয়-ভয় লাগুক এটাই তো টুনটুন চায়!

রাতে মাসি ঘুমিয়ে পড়লে শানুর সঙ্গে অন্য অনেক গল্প করেছে ও। কিন্তু ওই কালো বাড়ির গল্পটা কিছুতেই মাথা থেকে যায়নি। ও অন্ধকারে চুপচাপ শুয়ে ওই বাড়িটার কথা ভেবেছে। কারা থাকত ওই বাড়িতে? তারা এখন কোথায়? কেন ওই বাড়িটা পোড়োবাড়ি হয়ে পড়ে আছে?

বাইরে বৃষ্টি এখনও বেশ ভালোই পড়ছে। তবে সন্ধেবেলা যেমন ঘনঘন বাজ পড়ছিল এখন সেরকম নয়। মাঝে-মাঝে টিউবলাইটের মতো সাদা আলো জানলার কাচ ভেদ করে ঝলসে যাচ্ছে ঘরের দেওয়ালে।

টুনটুনের ঘুম আসছিল না কিছুতেই। একটু ভয়-ভয়ও করছিল। কিন্তু শানুর কাছে সেটা ধরা পড়ুক ও চাইছিল না।

অন্ধকারে চোখ খুলে বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর ও চাপা গলায় ডেকে উঠল, ‘শানুদা…।’

কোনও সাড়া নেই।

‘শানুদা—।’ আবার চাপা গলায় ডাকল ও।

‘উঁ…।’ ঘুমজড়ানো চোখে সাড়া দিল শানু, ‘বল, কী?’

‘ওই বাড়িটার গল্প তুমি কি আমাকে শর্টে বললে?’

শানু এবারে পাশ ফিরল টুনটুনের দিকে। একটা হাই তুলল: ‘এই মাঝরাত্তিরে কীসব কোশ্চেন শুরু করলি! বল কী বলছিস।’

টুনটুন আবার একই প্রশ্ন করল।

শানু একবার ঘুমন্ত মায়ের দিকে দেখল। তারপর আবার হাই তুলে বলল, ‘যেটুকু জানি সেটুকুই বলেছি। তবে এই এরিয়ার আরও অনেকে অনেক কিছু জানে—সবসময় বলতে চায় না।’

‘কারা থাকত ওই বাড়িতে, শানুদা?’

‘আরে সে অনেক ব্যাপার। কাল দেখা যাবে। এখন ঘুমো তো।’

‘কাল একটু খোঁজখবর করে দেখলে হয়। আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে…ওই কালো বাড়ির পুরো গল্পটা…শর্টে নয়…লঙে।’

‘বললাম তো কাল সব হবে। এখন প্লিজ, আমার কাঁচা ঘুমটা ঘেঁটে দিস না—।’

শানু আবার ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।

ঘরের দেওয়ালে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। তারপরই বাজ পড়ার শব্দ।

টুনটুন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ঘুমোতে চেষ্টা করল।

পরদিন বিকেলে শানুর সঙ্গে তিলকপুর দেখতে বেরোল টুনটুন। বেরোনোর সময় অনিতা জোর করে ছেলের হাতে একটা ছাতা গুঁজে দিয়েছেন।

টুনটুন আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে কালো মেঘ। কিন্তু সেই কালো মেঘের মাঝে-মাঝে ছোট-ছোট নীল জানলা—আকাশ দেখা যাচ্ছে। চারিদিকে কত যে গাছ! তারা সব সবুজ হাত তুলে আকাশকে যেন ডাকছে।

দেখতে-দেখতে টুনটুনের মনে হল, ও কারও আঁকা একটা ছবি দেখছে। কলকাতায় এরকম ছবি দেখতে পাওয়া যায় না। ইস, মা-কে এই ছবিটা দেখাতে পারলে ভীষণ ভালো লাগত ওর।

হাঁটতে-হাঁটতে ওরা দুটো পুকুর পেরিয়ে গেল। তারপরই একটা বিশাল খেলার মাঠ। মাঠে ছেলেরা ফুটবল খেলছে। জল-কাদায় ওদের ভূতের মতো লাগছে।

শানু বলল, ‘এই মাঠে আমরা খেলি। ওই যে, আমার বন্ধুরা সব খেলছে। পরশু থেকে আমার জ্বর-জ্বর মতন হয়েছে বলে মা ক’দিন খেলতে বারণ করেছে। এই মাঠটা পেরোলেই আমাদের ক্লাব ”বিপ্লবী সংঘ”।’

কথা শেষ হতে-না-হতেই শানুর পকেটের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। ফোন বের করে পরদার দিকে একপলক তাকাল শানু। কে ফোন করেছে দেখল। তারপর বোতাম টিপে ফোন কানে লাগিয়ে বলল, ‘এই তো, ক্লাবের কাছে এসে গেছি। মাঠ পেরোচ্ছি। আমার সঙ্গে আমার মাসতুতো বোন আছে। আমাদের বাড়িতে ক’দিনের জন্যে বেড়াতে এসেছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ—এক্ষুনি ঢুকছি।’

মাঠের পাশ দিয়ে ওরা এগোতে লাগল। মাটির ওপরে ইটের খোয়া ছড়ানো রাস্তা। তার জায়গায়-জায়গায় জল-কাদা জমে আছে। রাস্তার পাশে বড়-বড় ঘাস, আর কয়েকটা বিশাল গাছ। তার পাশেই ঢালু জমি নেমে গেছে। সেখানে বৃষ্টির জল জমে ছোটখাটো পুকুর হয়ে গেছে। ব্যাঙের দল ডাকছে।

একটু পরেই ওরা ক্লাবঘরের সামনে এসে দাঁড়াল।

ইটের দেওয়াল। সাদা রং করা। মাথায় টিনের চাল। তার ওপরে গাছের ঝরাপাতা ছড়িয়ে আছে।

ক্লাবঘরের দেওয়ালে ছোট্ট সাইনবোর্ড। তাতে লেখা: ‘বিপ্লবী সংঘ’।

খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল ওরা।

ঘরে টিভি চলছে। মেঝেতে রঙিন চাদর পাতা তার ওপরে বসে তিনজন ছেলে টিভিতে ফুটবল খেলা দেখছে।

তিনজনের সঙ্গে টুনটুনের পরিচয় করিয়ে দিল শানু। অঙ্কিত, রোশন, আর রাজর্ষি। ওরা টুনটুনকে বসতে বলল। তখন শানু বলল, ‘না রে, এখন বসব না। ওকে কালো বাড়ি দেখাতে নিয়ে যাব। অন্ধকার হয়ে গেলে প্রবলেম জানিস তো!’

তিনজনের মধ্যে দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে সবচেয়ে বড়সড় অঙ্কিত। ও হেসে বলে উঠল, ‘না, না—ওকে দেখাস না। ভয় পেয়ে যাবে…।’

টুনটুন পালটা হাসল, ‘ভয় পাই পাব। আমার ওই বাড়িটা খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। তা ছাড়া ভয়-টয় পেলে তোমরা তো আছ…।’

‘তা হলে আর দেরি করে লাভ কী!’ অঙ্কিত উঠে দাঁড়াল: ‘চল, আমিও তোদের সঙ্গে যাই…।’

শানু বলল, ‘টুনটুন বলছে ওর নাকি হেভি সাহস। এবার সেটা প্রমাণ হয়ে যাবে।’

রোশন আর রাজর্ষিকে বলে ওর ক্লাবঘর থেকে বেরিয়ে এল। অনেকগুলো গাছপালার সারি পেরিয়ে একটা পুকুরকে পাক দিয়ে ভাঙাচোরা একটা রাস্তায় এসে পড়ল।

আকাশে চাপা গুড়গুড় শব্দ হল। হাঁটতে-হাঁটতেই ওরা মুখ তুলে আকাশে তাকাল। একটু আগের দেখা ছোট-ছোট নীল জানলাগুলো আবছা কালো ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে।

অঙ্কিত বলল, ‘তাড়াতাড়ি পা চালা—বৃষ্টি আসতে পারে।’

সঙ্গে-সঙ্গে ওরা প্রায় ছুটতে শুরু করল।

কাঁচা রাস্তায় জল-কাদা। দুপাশে ছোট-খাটো বাড়ি-ঘর। কোনওটা পাকা বাড়ি, কোনওটা টিনের চাল, আর কোনওটা স্রেফ মাটি আর চাটাই দিয়ে তৈরি। বাড়ির উঠোনে লাউ-কুমড়োর মাচা আর আম-কাঁঠাল-পেয়ারা গাছ।

দু-মিনিট যেতে না যেতেই বাঁ-দিকে একটা ফাঁকা জমি পাওয়া গেল। জমিতে আগাছার জঙ্গল। আর জমি পেরিয়ে বিশাল একটা সবজির খেত। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে কয়েকটা বড়-বড় গাছ।

সেগুলো ছাড়িয়ে চোখ মেললেই দু-চারটে ছোট-ছোট বাড়ি, আর তার মাথায় আকাশ। কিন্তু ডানদিকে পঁচিশ কি তিরিশ ডিগ্রি মতন চোখ সরলেই আকাশটা আর দেখা যাচ্ছে না।

কারণ, তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে রয়েছে কালো বাড়িটা।

ওরা তিনজন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। টুনটুন অবাক হয়ে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল।

কালো রঙিন বিশাল একটা ডাইনোসর যেন গুড়ি মেরে বসে আছে। পড়ন্ত দিনের মেঘলা আলোয় বাড়িটার দিকে তাকিয়ে টুনটুনের মনে হল ওটা যেন অন্ধকার দিয়ে তৈরি। শরীরটাকে গুটিয়ে ছোট করে রেখেছে। প্রতিটি পেশিতে অসম্ভব তেজ ও শক্তি। শুধু ওটার মাথাটা যে কোথায় সেটাই ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে না।

একটা বাড়ির আকার যা-ই হোক না কেন আকাশের পটভূমিতে তার সীমানা সবসময়েই সরলরেখা দিয়ে তৈরি হয়—অন্তত টুনটুন এতদিন তাই জানত। কিন্তু এই কালো বাড়িটার যে সীমারেখা আকাশের গায়ে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে সেটার বেশিরভাগই বাঁকা রেখা দিয়ে তৈরি। এর কারণ হতে পারে খসে পড়া ইট পলেস্তারা, কিংবা বাড়ির নানান জায়গায় লেপটে থাকা কালচে সবুজ শ্যাওলা।

বর্ষার জোলো বাতাস হু-হু করে বইতে শুরু করল। টুনটুন, শানু আর অঙ্কিতের চুল উড়তে শুরু করল। ঝোড়ো হাওয়ায় দিশেহারা পতাকার মতো ঝাপটা মারতে লাগল গালে, কপালে।

টুনটুন বাড়িটার দিকে আরও দু-চার পা এগিয়ে এল। ওর দেখাদেখি পা বাড়াল বাকি দুজন।

তখনই ছাতাধরা জিনিসের গন্ধটা টুনটুনের নাকে এল। বর্ষাকালে বহুদিন আলো-বাতাস না পাওয়া জামাকাপড়ের গায়ে যে বিশ্রী গন্ধটা টের পাওয়া যায়, ঠিক সেইরকম।

গন্ধটা নাকে আসতেই মুখে বিরক্তির শব্দ করে নাক টিপে ধরল টুনটুন।

শানু চাপা গলায় বলল, ‘বাড়িটার গা থেকে সবসময়েই এরকম বাজে গন্ধ বেরোয়।’

‘কেন?’ টুনটুন জিগ্যেস করল। কিন্তু বাড়িটার দিক থেকে চোখ সরাল না।

অঙ্কিত ওর প্রশ্নের জবাব দিল, ‘কেউ জানে না কেন…।’

বহুকাল আগে বাড়িটার রং কালো ছিল কি না কে জানে। কিন্তু এখন তার সারা গায়ে ময়লা আর শ্যাওলা জমে বলতে গেলে কালো রংটাই বসে গেছে। ভালো করে নজর করলে সেই কালোর ওপরে ছাতাধরা সাদা ছোপ-ছোপ দাগ বেশ দেখা যায়।

কালো বাড়িটার বিশাল চৌহদ্দি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। আর সেই পাঁচিলের চেহারাও বাড়ির সঙ্গে মানানসই। সর্বত্র ভাঙাচোরা—কোথাও আছে, কোথাও নেই। আগাছার জঙ্গলে পাঁচিলটার অনেক জায়গাই ঢাকা পড়ে গেছে।

পাঁচিলের একজায়গায় প্রায় দশফুট উঁচু বিশাল লোহার গেট। বাতাস আর বর্ষায় জং ধরা। গেটের পাল্লা দুটো ফুট দুয়েক ফাঁক হয়ে আছে। বড়-বড় ঘাস আর আগাছা গেটের নীচের দিকটা ঢেকে ফেলেছে। ভেতরে যতটা চোখ যায় শুধু ছোট-বড় গাছ আর হরেকরকম আগাছার জঙ্গল। সদর দিয়ে ঢুকে বাড়ির দিকে এগোনোর পথটাও আগাছায় প্রায় ঢেকে গেছে।

বাড়ি আর তার লাগোয়া জমির বহর দেখে মনে হয় বাড়িটা এককালে কোনও বড়লোকের বাগানবাড়ি ছিল।

টুনটুন লক্ষ করল, কালো বাড়িটার আশেপাশের জমিতে বড়-বড় ঘাস-পাতার মধ্যে দুটো গোরু চরে বেড়াচ্ছে আর বাড়িটার কাছ থেকে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ মিটার দূরে দুটো ছোট মাপের আধাখ্যাঁচড়া বাড়ি রয়েছে। আধাখ্যাঁচড়া বলতে একতলা তৈরির পর দোতলা তৈরি হতে-হতে কনস্ট্রাকশনের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তারপর পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকলে যা হয়!

সেই বাড়ি দুটো দেখিয়ে টুনটুন অঙ্কিতকে জিগ্যেস করল, ‘ওই বাড়ি দুটোয় কারা থাকে?’

‘কেউ না।’

‘কেন?’

‘সে প্রায় বিশ বছরের পুরোনো কেস। বাবার মুখে শুনেছি। দু-বন্ধু দুটো বাড়ি তৈরি করছিল। তাদের ফ্যামিলি একতলায় থাকত। দোতলা তৈরির কাজ চলছিল। এক বর্ষার সিজনে দু-ফ্যামিলির সাতজন মেম্বার বাজ পড়ে একসঙ্গে খতম।’ বড় করে শ্বাস ছাড়ল অঙ্কিত: ‘তারপর থেকে কালো বাড়িটার কাছাকাছি আর কেউ বাড়ি তৈরির চেষ্টা করেনি..।।’

অঙ্কিতের কথাগুলো টুনটুন শুনছিল, কিন্তু ও স্থিরচোখে তাকিয়ে ছিল কালো বাড়িটার দিকে। এক অদ্ভুত ভয় আর মুগ্ধতা ওর মধ্যে কাজ করছিল।

কিছক্ষণ চুপ করে থাকার পর অঙ্কিত আবার বলল, ‘কালো বাড়িটার চারপাশে ওই যে সব গাছ দেখছ, ওতে মাঝে-মাঝে পিকিউলিয়ার সব ফুল হয়—নানান রঙের ফুল…খুব অ্যাট্রাকটিভ। শুনেছি, ওই ফুলের লোভে দুজন কালো বাড়ির বাগানে ঢুকে পড়েছিল—আর বেরোতে পারেনি। তাদের আর কোনও খোঁজও পাওয়া যায়নি। সেই থেকে ওই ফুলের ফাঁদে আর কেউ পা দেয় না।’

পাখির মিহি ডাক কানে এল ওদের। টিয়ার ঝাঁক ‘ট্যাঁ-ট্যাঁ’ করতে-করতে মেঘলা আকাশের একদিন থেকে অন্যদিকে উড়ে গেল।

কালো বাড়িটার দিকে অবাক চোখে চেয়ে থেকে টুনটুন জিগ্যেস করল, ‘অঙ্কিতদা, এই বাড়িটায় ঢুকে আবার বেরিয়ে এসেছে এমন কেউ নেই?’

প্রশ্নটা শুনে অঙ্কিত একটু দোটানায় পড়ে গেল যেন। টুনটুনের দিকে তাকাল। জবাব দেবে কি দেবে না কয়েক সেকেন্ড ভাবল।

তখন শানু ওকে বলল, ‘বল না, মনিরুল চাচার কথা বল—।’

‘কে মনিরুল চাচা?’ টুনটুনের প্রশ্নের যেন আর শেষ নেই।

‘ওই ওদিকে বটতলায় চায়ের দোকান ছিল।’ হাত তুলে একদিকে নিশানা করল অঙ্কিত: ‘পাঁচ-ছ’বছর হল ওর ছেলে কামাল দোকান চালায়—আর চাচা চুপচাপ দোকানের একপাশে বসে থাকে।’

‘মনিরুলচাচা এই বাড়িটায় ঢুকেছিল?’

‘হ্যাঁ—’ কালো বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আনমনাভাবে বলল অঙ্কিত, ‘আবার বেরিয়েও এসেছিল…।’

‘তারপর?’

‘তারপর কী হয়েছিল সেটা চাচার মুখ থেকেই শুনবি। তোর বাড়ি দেখা শেষ হয়েছে? তা হলে চল, এখনই বটতলায় যাই।’

এর মধ্যেই আলো বেশ কমে এসেছে। আশপাশের জলা থেকে ভেসে আসা ব্যাঙের ডাক জোরালো শোনাচ্ছে। বড়-বড় গাছের পাতার ঝাঁকের আড়ালে ঘরে ফেরা পাখিদের কিচিরমিচির শুরু হয়ে গেছে।

কমে যাওয়া আলোয় কালো বাড়িটাকে ওত পেতে থাকা এক অপার্থিব জন্তুর সিলুয়েট বলে মনে হল টুনটুনের। মনে হল, যেই ওরা পিছন ফিরে হাঁটা দেবে অমনি যেন সেই জন্তুটা ওদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

টুনটুন শানুকে বলল, ‘শানুদা, এখন বটতলায় গেলে মাসি কিছু বলবে?’

‘না, না, মা কিছু বলবে না। ও আমি ম্যানেজ করে নেব। যদি বাই চান্স দেরি হয় ফোন করে দেব। তুই এখানে বেড়াতে এসে সবসময় কি ঘরে বসে থাকবি না কি?’

ওরা তিনজন ফিরে চলল। কালো বাড়িটা পিছনে পড়ে রইল। কিন্তু টুনটুনের মনে হল, বাড়িটা যেন অদৃশ্য সুতোয় ওকে পিছনদিকে টানছে।

ওরা তিনজন যখন মনিরুলচাচার দোকানে এসে পৌঁছল তখন অন্ধকার গাঢ় হয়েছে, আর সেইসঙ্গে টিপটিপ করে বৃষ্টিও শুরু হয়েছে।

মনিরুলচাচাকে দেখে বেশ অবাক হল টুনটুন।

শানুদা আর অঙ্কিতদা বলেছিল মনিরুলচাচার বয়েস সত্তর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু চাচার মাথার চুলগুলো সব দাঁড়কাকের মতো কালো। চেহারা ভাঙাচোরা হলেও বাদামি চামড়ায় এই বয়েসেও চকচকে ভাব আছে। চোখে চশমা, থুতনিতে দাড়ি।

চায়ের দোকানটা বাঁশের খুঁটি আর টিনের চাল দিয়ে তৈরি, কিন্তু মাপে বেশ বড়। দোকানের বাইরে সার দিয়ে ক’টা ব্যাটারির বাক্স উপুড় করে রাখা—খদ্দেরদের বসার জন্য। এখন বৃষ্টির জন্য সিটগুলো সব খালি। আর ভেতরে জোড়াতালি দেওয়া একটা বড় টেবিল, তার দুপাশে দুটো ফাটল ধরা লম্বা বেঞ্চ।

দোকানের একপাশে পাতা উনুনে আগুন জ্বলছে। চাচার ছেলে কামাল ব্যস্ত হাতে চা-বিস্কুটের জোগান দিতে হিমসিম খাচ্ছে। ওর গায়ে গেঞ্জি আর প্যান্ট। পোক্ত হাতে সসপ্যানে চামচ নাড়ছে। তাতে অদ্ভুত ছন্দে ‘বাজনা’ বাজছে।

দোকানটার আলো বলতে দুটো বালব। সেই অলোয় উদ্ভট চেহারার কতকগুলো ছায়া তৈরি হয়েছে।

চাচা দোকানের একপাশে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে একটা টুলে বসেছিল। অঙ্কিত চাচার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, বলল, ‘চাচা, ভালো আছ তো?’

চাচা কাগজ থেকে মুখ তুলল, ‘কে, আঙ্কু? বসো—চা খাবা নাকি?’

‘হ্যাঁ, চাচা, খাব। আজ সঙ্গে আমার এক বন্ধু এসেছে।’ গলার স্বর খাদে নামিয়ে অঙ্কিত বলল, ‘আপনার সেই কালো বাড়ির কেসটা আপনার মুখ থেকে শুনতে চায়…।’

‘ওঃ—’ বলে হাসল চাচা: ‘এই গল্প কতজনের যে কইসি! ওই শয়তান বাড়িডা য্যামন ছিল ত্যামনই রইয়া গেল। আমাগো কপাল পোড়া…।’

ওদের তিনজনের জন্য তিনটে চা বলল অঙ্কিত। দোকানের ভেতরে তিনজন খদ্দের বসে চা খাচ্ছে, খোশগল্প করছে।

টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ হচ্ছিল। চাচা যেদিকটায় টুলে বসে সেদিকটায় দোকানের চাল সামনে হাত তিনেক বাড়ানো। ওরা ব্যাটারির বাক্স টেনে নিয়ে চাচার কাছ ঘেঁষে বসে পড়ল।

মুখ মুছে দাড়িতে হাত বুলিয়ে মনিরুলচাচা তার অভিজ্ঞতার কথা শোনাল। চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে-দিতে টুনটুনরা চাচার গল্প শুনতে লাগল।

বহুবছর আগের কথা। সময়টা শীতকাল। মনিরুলচাচা তখন সদ্য জোয়ান। একদিন সন্ধের পর স্টেশন থেকে ঘরে ফেরার পথে হঠাৎ বাঁশির শব্দ চাচার কানে আসে। বাঁশি তো নয়, যেন বুকফাটা সুরেলা কান্না। বাঁশি শুনে চাচার মনটা কেমন যেন হয়ে যায়। চাচার মনে হচ্ছিল, বাঁশির সুরটা যেন চাচাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কানের কাছে ফিসফিস করে কেউ যেন বলছে, ‘আয়…চলে আয়…।’

চাচা তখন বাজার পেরিয়ে সবে দশ কি বারো কদম এগিয়েছে। চারপাশটা অন্ধকার হলেও পথে দু-চারজন লোক চোখে পড়ছে। কিন্তু সেই মন-ভোলানিয়া বাঁশির সুর মনিরুলচাচা ছাড়া আর কেউ যেন শুনতে পাচ্ছিল না।

তখন চারপাশে এত আলো ছিল না। এত দোকানপাট ছিল না। এত বাড়ি-ঘরও ছিল না। শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। চারপাশে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক আর জোনাকির মিটমিটে আলো।

বাঁশির সুর মনিরুলচাচাকে যেন ‘হাত ধরে’ ডেকে নিয়ে চলল।

কেমন এক অলৌকিক নেশার ঘোরে চাচা পৌঁছে গেল সেই কালো বাড়িটার কাছে। বাড়ির বাগানের ফুলগুলো তখন রঙিন আলো হয়ে জ্বলছে। অদ্ভুত আভা ফুটে বেরোচ্ছিল ওগুলোর ছোট-ছোট শরীর থেকে। যে-টানটা মনিরুল চাচা তখন টের পেয়েছিল সেটা সমুদ্রের জোয়ারে ভেসে যাওয়ার টান। সেই টানে চাচা জং ধরা লোহার গেটের ফাঁক দিয়ে বাড়িটার চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়েছিল।

তারপর…।

তারপর সেই বাঁশির সুর চাচাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল। চাচা ঢুকে পড়েছিল অন্ধকার বাড়িটার ভেতরে।

অন্ধকারে দিকভ্রম হয়ে গিয়েছিল। সময়ের হিসেবও ওলোটপালট হয়ে গিয়েছিল। চাচাকে নিয়ে কারা যেন ভয় পাওয়ানোর খেলায় মেতে উঠেছিল। বৃষ্টি-ভেজা শরীরের মতো ঘামে ভিজে উঠেছিল চাচার শরীর। একটা প্রচণ্ড ভয় চাচাকে কুঁকড়ে দিয়েছিল। চিন্তাভাবনা, মন, সব অসাড় করে দিয়েছিল। ভয়ের গোলকধাঁধায় চাচা দিশেহারা হয়ে ঘুরপাক খেয়েছিল।

শুধু এইটুকুই চাচার মনে আছে।

ওই বাড়ি থেকে বাইরে বেরোনোর পর চাচাকে সদর হাসপাতালে ভরতি করতে হয়েছিল। চারদিন পর চাচা সেরে ওঠে। তখন লোকজনের কাছ থেকে জানতে পারে একটা গোটা রাত চাচা ওই কালো বাড়িতে কাটিয়েছিল। কারণ, গাঁয়ের লোকরা চাচাকে পরদিন ভোরবেলা বাড়ির সদরের লোহার গেটের কাছে পড়ে থাকতে দ্যাখে। চাচার জামাকাপড় ছেঁড়া ছিল, সারা গায়ে রক্তের দাগ ছিল। কপালে, হাতে, আঘাতের চিহ্ন ছিল।

কিন্তু সেরে উঠে চাচা কিছুই বলতে পারেনি। বাড়ির ভেতরকার ব্যাপার-স্যাপার সব ভুলে গেছে। ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে স্লেটের লেখা মোছার মতন সেই ভয়ংকর স্মৃতিগুলো কেউ যেন মুছে দিয়েছে।

সেরে ওঠার পর প্রায় একমাস চাচা ঘেঁটে যাওয়া মন দিয়ে কষ্ট পেয়েছে। তারপর পুরোপুরি ভালো হয়ে উঠলেও মনে-না-পড়ার সেই অস্বস্তিটা এত বছর পরেও যায়নি।

চাচার গল্প শুনতে-শুনতে বৃষ্টি আরও বেড়ে গিয়েছিল। মাঝে-মাঝে পলিথিন শিটের ছাদনা দেওয়া সাইকেল রিকশা প্যাঁক-প্যাঁক করতে-করতে চলে যাচ্ছে। রাস্তার ধারে লাগানো একটা টিউবলাইট মিইয়ে যাওয়া আলো ছড়িয়ে অন্ধকার হটাতে চেষ্টা করছে। ব্যাঙের ডাকের একটানা ছন্দ কেটে দিয়ে একটা মোটরবাইক ছুটে গেল।

চা খাওয়া অনেকক্ষণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। কামালের হাতে পয়সা দিয়ে শানুরা উঠে পড়ল।

বৃষ্টির ধরন দেখে টুনটুন ভাবছিল দোকানের চালার নীচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি কমার জন্য অপেক্ষা করবে। কারণ, শানুর কাছে একটিমাত্র ছাতা—আর ওরা তিনজন। কিন্তু শানু আর অঙ্কিত অপেক্ষা করার পাত্র নয়। বিশেষ করে অঙ্কিত একটু যেন বেপরোয়া। বলল, ‘দুর! এই বৃষ্টিতে ভিজলে কিস্যু হবে না।’

শুধু বলল নয়, বলতে-বলতে নেমে গেল রাস্তায়। মনিরুলচাচাকে হাত নেড়ে বলল, ‘আসি, চাচা…।’

বাড়ির দিকে তাড়াতাড়ি পা চালাতে-চালাতে টুনটুন জিগ্যেস করল, ‘চাচার কিছুই মনে নেই।’

‘শুনলে তো—’ অঙ্কিত বলল।

‘ওই বাড়িটায় যারা ঢুকে আবার বেরিয়ে আসে তাদের আর কিছু মনে থাকে না—’ আপনমনেই বলল টুনটুন, ‘কিন্তু যে-দুজন লোক ঢুকে আর বেরোয়নি—তাদের?’

শানু হেসে বলল, ‘আজব তো! ওই লোকদুটোর কী হয়েছে আমরা কী করে জানব।’

অঙ্কিত বলল, ‘তুমি ওই বাড়িটায় ঢুকে পরীক্ষা করে দেখতে পারো তোমার সবকিছু মনে থাকছে কি থাকছে না—।’

কথাগুলো বলে অঙ্কিত হাসল। শানুও ওর সঙ্গে যোগ দিল।

কিন্তু টুনটুন হাসল না। ও তখনও চাচার কথাগুলো ভাবছিল। চাচার সারা গায়ে রক্তের দাগ ছিল। জামাকাপড় ছিল ছেঁড়া। কপালে-হাতে আঘাতের চিহ্ন ছিল।

ওগুলো হল কেমন করে? তা হলে বাড়িটার ভেতরে কি কোনও হিংস্র জানোয়ার আছে?

পরদিন বিকেল চারটে থেকে বিপ্লবী সংঘের ফুটবল ম্যাচ। শানুর সঙ্গে টুনটুন সময় মতো বেরিয়ে পড়ল। শানুর জ্বর কমে গেছে। বাড়িতে মা-কে বারবার করে বলে এসেছে যে, ও খেলতে নামবে না—মাঠের ধারে টুনটুনের সঙ্গে বসে শুধু খেলা দেখবে। কিন্তু মাঠে এসে জার্সি পরা বন্ধুবান্ধব আর সাদা ফুটবলটা দেখে শানুর মাথাটা বিগড়ে গেল। ও টুনটুনের পাশ থেকে ছুটে চলে গেল অঙ্কিতের কাছে। অঙ্কিত আর তিনটে ছেলের সঙ্গে কীসব কথাবার্তা বলে ও জার্সি পরে তৈরি হয়ে গেল খেলার জন্য।

টুনটুন ‘শানুদা, শানুদা’ করে ডাকতেই ও ছুটে চলে এল মাঠের ধারে। চাপা গলায় বলল, ‘অ্যাই, মা-কে বলবি না কিন্তু। তোকে বেণুদার রেস্টুরেন্টে ফিশ ফ্রাই খাওয়াব—।’

টুনটুন জবাবে হাসল। ফুটবল খেলা ওর ততটা পছন্দের না হলেও ওর মনে হচ্ছিল জার্সি আর কেডস পরে ছেলেদের সঙ্গে মাঠে নেমে পড়ে।

একটু পরেই রেফারি বাঁশি বাজিয়ে ম্যাচ শুরু করল। বিপ্লবী সংঘ বনাম রক্তিম ইউনাইটেড। একদিকে লাল-সাদা জার্সি, অন্যদিকে নীল-হলুদ। জল-কাদা ভরা মাঠে কাদা-মাখা ফুটবলটা ছোটাছুটি করতে লাগল, আর তার সঙ্গে-সঙ্গে প্লেয়াররাও। থেকে-থেকে রেফারির বাঁশি বাজতে লাগল।

কোথা থেকে যেন কিছু দর্শকের দল জুটে গিয়েছিল। খেলার ওঠা-নামার তালে-তালে তাদের চিৎকারও উঠছে-নামছে। কেউ-কেউ প্লেয়ারদের নাম ধরে চেঁচিয়ে নানান নির্দেশ দিচ্ছে। টুনটুনের মনে হল, স্রেফ মুখে-মুখেই ওরা তীব্র উত্তেজনাময় ফুটবল খেলে চলেছে।

দর্শকদের মধ্যে চার-পাঁচজন মেয়েকে চোখে পড়ল। তার মধ্যে একটি লম্বামতন মেয়েকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহী মনে হল। অঙ্কিতের পায়ে বল গেলেই ও উত্তেজিতভাবে চিৎকার করছে। ‘দাদাভাই, দাদাভাই’ বলে চেঁচিয়ে ডেকে ওর মূল্যবান পরামর্শ ছুড়ে দিচ্ছে।

মেয়েটি ফরসা। লম্বাটে মুখ। চোখদুটো বড়-বড়। মাথার চুল হর্সটেইল করে বাঁধা। পরনে সবুজ-কালো ছাপ-ছাপ একটা চুড়িদার। দেখে মনে হয় ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়ে।

টুনটুনের মনে হয়েছিল মেয়েটি অঙ্কিতের বোন হতে পারে। শুধু ‘দাদাভাই’ শব্দটা ছাড়াও অঙ্কিতের মুখের সঙ্গে মেয়েটির মুখের বেশ মিল খুঁজে পেল ও। তবে একেবারে সুনিশ্চিত হওয়া গেল হাফটাইমের সময়।

অঙ্কিত মাঠের ধারে আসতেই মেয়েটি ওর পরামর্শ আর বকুনি নিয়ে ‘দাদাভাই’-এর ওপরে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল। অঙ্কিত হেসে ওর চুল টেনে দিয়ে সব টরচার সহ্য করতে লাগল।

হঠাৎই ও মুখ ফিরিয়ে টুনটুনের দিকে তাকিয়ে ওকে কাছে ডাকল, বলল, ‘এদিকে এসো। এই যে—আমার ছোট বোন দিশা—ইন্ডিয়ার প্রথম লেডি ফুটবল কোচ। অবশ্য জানি না ওর আগে কেউ আছে কি না। ও আসলে আমার ছোট বোন নয়—দিদি…আবার দিদিমাও বলতে পারো…।’

টুনটুন হাসল দিশার দিকে তাকিয়ে ততক্ষণে অঙ্কিত সংক্ষেপে টুনটুনের পরিচয়ও দিয়ে ফেলেছে। বলেছে, তিলকপুরের গেস্ট। এখানে সবে বেড়াতে এসেছে। কালো বাড়িটার ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড।

এটুকুই বোধহয় যথেষ্ট ছিল। হাফটাইমের পর খেলা শুরু হতেই দিশা টুনটুনের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওর ডানদিকে টুনটুন, আর বাঁদিকে অন্য বন্ধুরা।

দিশা বলল, ‘আগে খেলাটা শেষ হোক, তারপর তোমাকে কালো বাড়িটার ব্যাপারে বলছি। আমার মা বলে বাড়িটা ভীষণ জাগ্রত—মানে জীবন্ত।’

টুনটুন ভেবে পাচ্ছিল না একটা বাড়ি কেমন করে জাগ্রত হতে পারে। মায়ের কাছে বেশ কয়েকবার শুনেছে জাগ্রত মা-কালীর কথা। কিন্তু…?

একটু পরেই ওর মনে হল, কোনও ‘কিন্তু’ নেই। দেবতা যদি জাগ্রত হতে পারে তা হলে অপদেবতা কেন নয়!

ফুটবল খেলা নিয়েও অনেক বকবক করছিল দিশা। খুব ছোট থেকেই ও ফুটবলের পোকা। তখন ও ছেলেদের সঙ্গে জোট বেঁধে মাঠ বল পেটাপিটি করত। এখন টিভির খেলা আর পাড়ার খেলা দেখে সাধ মেটায়।

বিপ্লবী সংঘ তিন গোল দিল, রক্তিম ইউনাইটেড দিল একটা। অঙ্কিতদের প্রতিটি গোলের সময় দিশা হাততালি দিয়ে পিংপং বলের মতো লাফাচ্ছিল আর চিৎকার করছিল। টুনটুনের মনে হচ্ছিল, গোলগুলো যেন ওই তিড়িং-বিড়িং মেয়েটাই দিয়েছে।

খেলার শেষের দিকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। তখন বড়জোর আর মিনিট পাঁচ-সাত বাকি। সঙ্গে-সঙ্গে কোথা থেকে খুলে গেল একরাশ কালো আর রঙিন ছাতা। টুনটুনের সঙ্গে ছাতা ছিল না। কিন্তু দিশার সঙ্গে ছিল। ও টুনটুনকে ওর ছাতার নীচে ডেকে নিল।

খেলা ভাঙার পর দিশা টুনটুনকে বলল, ‘আমাদের বাড়ি চলো। তুমি গেলে মা-বাবা খুব খুশি হবে।’

টুনটুন শানুর কথা বলতেই দিশা বলল, ‘ওদের দেরি হবে। তার চেয়ে দাদাভাইকে বলে দিই শানুদাকে নিয়ে চলে আসবে। তারপর তুমি আর শানুদা একসঙ্গে ফিরে যেয়ো—।’

দিশার কথাবার্তার মধ্যে কেমন একটা সরলতা আর মোলায়েম আদেশ মিশে ছিল। যার জন্য ওর যে-কোনও প্রস্তাবে ‘না’ বলা কঠিন। টুনটুন ওকে দেখছিল আর ভাবছিল এত টগবগে এনার্জি মেয়েটা পায় কোথা থেকে!

ওদের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পথে কালো বাড়িটা নিয়ে নানান গল্প শোনাল দিশা। ওর স্কুলের বন্ধুরাও এরকম অনেক গল্প বলে। তবে গল্পগুলো সত্যি কি মিথ্যে বলা কঠিন।

টুনটুন বলল, ‘গল্পগুলো শুনতে কিন্তু খারাপ লাগছে না। বইয়ের গল্পের মতন। আসলে বাড়িটা ওইরকম দেখতে বলে এতরকম ছমছমে গল্প তৈরি হয়েছে। পরে হয়তো দেখা যাবে বাড়িটা খুব ভালো—প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল…।’

দিশা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘তা হলে মনিরুলচাচার গল্পটা?’

ওটা নিয়েই টুনটুনের একটু অসুবিধে হচ্ছিল। ও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘ওটা ঠিকমতো এক্সপ্লেইন করতে গেলে আরও খবর দরকার। কেউ যদি বাড়িটার ভেতরে ঢুকে একটু ইনভেস্টিগেট করত তা হলে…।’

‘ওরে বাবা! তোমার তো দেখছি সাহস কম নয়!’

টুনটুন হেসে বলল, ‘না, আমার সাহস কম। আমার বাপির সাহস আমার চেয়ে অনেক বেশি—।’

‘তাই?’ চোখ বড়-বড় করল দিশা। তারপর সামনের একটা সুন্দর দোতলা বাড়ি দেখিয়ে বলল, ‘এই যে—এটা আমাদের বাড়ি।’

অঙ্কিতদের বাড়িতে গিয়ে হইহই করে অনেক সময় কেটে গেল। চারজনে মিলে তুমুল তর্কবিতর্ক আর আলোচনা হল। বিষয় কালো বাড়ি আর আজকের ফুটবল ম্যাচ।

ওদের বাড়ি থেকে টুনটুন আর শানু যখন রওনা হল তখন রাত প্রায় আটটা। ওদের পায়ের নীচে আঁকাবাঁকা পিচের রাস্তা। তার নানান জায়গায় ছাল ওঠা। ইটের টুকরো বেরিয়ে পড়েছে। এখানে-ওখানে জল জমে আছে। আর আলো বলতে ধুলোর আস্তরে মলিন হয়ে যাওয়া টিউবলাইট। লাইটগুলো এত দূরে-দূরে যে, একের আলো অন্যকে ছুঁতে পারছে না।

ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। ওদের সঙ্গে একটা ছাতা ছিল বলে অঙ্কিতদের বাড়ি থেকে আরও একটা ছাতা ধার নিয়ে এসেছে।

শানু হঠাৎ রাস্তা ছেড়ে তেরছাভাবে বেরিয়ে একটা কাঁচা পথ ধরল। ছোট্ট করে বলল, ‘এটা শর্টকাট, বুঝলি?’

শর্টকাট সবারই পছন্দের। কিন্তু চারপাশটা যেন বড় বেশি অন্ধকার। তার সঙ্গে এলোমেলো গাছপালা, বড়-বড় ঘাস আর একঘেয়ে ব্যাঙের ডাক।

জল-কাদায় পা ফেলতে-ফেলতে টুনটুনের মনে একটা অচেনা ভয় চারিয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, সঙ্গে একটা টর্চ থাকলে ভালো হত।

বেশ কিছুটা এগোনোর পর একটা বিশাল পুকুর দেখতে পেল ওরা। এখানে মেঘ আর অন্ধকার এত গাঢ় যে, ঝিরঝির করে বৃষ্টি না পড়লে পুকুরটাকে পুকুর বলে বোঝা যেত না।

চলতে-চলতে টুনটুন পুকুরটার দিকে দেখছিল। সেটা লক্ষ করে শানু বলল, ‘এটা কালু হালদারদের পুকুর। এই এলাকার বেশিরভাগটাই ওদের জমি। শুনেছি এককালে ব্যাপক বড়লোক ছিল—এখন শুধু কয়েক বিঘে জমিজমা পড়ে আছে…।’

শানু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সেটা আর বলা হল না। একটা চাপা বাঁশির সুর ওকে থামিয়ে দিল।

শুধু কথা নয়, চলাও থামিয়ে দিয়েছিল শানু। ওর দেখাদেখি টুনটুনও থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। এ কি সেই বাঁশির সুর—যে বাঁশির সুরের কথা শানুদা বলছিল? যে-বাঁশির টানের কথা গতকাল মনিরুলচাচা গল্প করেছে?

শানু চাপা গলায় বলল, ‘ওই বাঁশি বাজছে! চল, আমরা ফিরে যাই—।’

টুনটুন জিগ্যেস করল, ‘কেন, বাঁশির আওয়াজে ভয় কীসের?’

‘যদি টেনে নেয়? তোকে সেদিন বলছিলাম না—।’

‘কোনদিকে টানবে?’

টুনটুনের দিকে ঘুরে তাকাল শানু: ‘কেন, কালো বাড়িটার দিকে। মনিরুলচাচা কাল বলল শুনিসনি?’

বাঁশির সুরটার মধ্যে অপার্থিব কিছু ছিল না। তবে চোস্ত হাতে কেউ বাঁশিটা বাজাচ্ছিল। চাচা ঠিকই বলেছিল—বুকফাটা সুরেলা কান্না। অতল গহ্বরের কোনও কারাগার থেকে কয়েকশো বছরের পুরোনো কোনও বন্দি আকুল হয়ে মুক্তি চাইছে। তার তোলা বাঁশির সুর কোমল আর্তিতে যেন আকাশে, বাতাসে, গাছের পাতায়, পুকুরের জলে মাথা খুঁড়ে মরছে।

ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে বাঁশির সুরটা অদৃশ্য এক সরীসৃপ হয়ে মোলায়েম সাবলীল গতিতে অলসভাবে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। সবকিছুকে যেন এক অলৌকিক প্রবল আকাঙ্ক্ষায় জড়িয়ে ধরতে চাইছিল।

টুনটুনের সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল। বাঁশির সুরটা ঠিক কোনদিক থেকে ভেসে আসছে সেটা ও কিছুতেই ঠাহর করতে পারছিল না। বৃষ্টির মধ্যেই ও চোখ সরু করে চারপাশটা খুঁটিয়ে নজর করে লুকিয়ে থাকা অলৌকিক বাঁশিওয়ালাকে খুঁজছিল।

শানু আবার বলল, ‘চল, ফিরে চল। এই রাস্তায় আর এগোব না—রিসক হয়ে যাবে। তা ছাড়া তুই সঙ্গে আছিস। কোনও একটা কেস হয়ে গেলে…’

ঠিক তখনই টুনটুনের চোখ একটা জায়গায় আটকে গেল। সেদিকে তাকিয়ে ও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

ওদের কাছ থেকে তিরিশ-চল্লিশ মিটার দূরে পুকুরপাড়ে একটা বিশাল অন্ধকার গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে। গাছটা পুকুরের দিকে অনেকটা ঝুলে রয়েছে। বহুদূর থেকে ছিটকে আসা টিউবলাইটের আলো হালকা জ্যোৎস্নার মতো গাছের ভিজে পাতা আর ডালে লেপটে আছে।

পুকুরের দিকে ঝুলে পড়া একটা বড়সড় ডাল টুনটুনের নজর কেড়েছিল। ওর মনে হল, সেই ডালে কিছু একটা যেন পাকে-পাকে জড়িয়ে আছে।

ও শানুর জামা ধরে টান মারল: ‘শানুদা, ওটা কী দ্যাখো তো—।’ আঙুল তুলে গাছটার দিকে দেখাল টুনটুন।

শানু ভালো করে নজর চালিয়ে দেখল। তারপর বলল, ‘হ্যাঁ রে, ওই ঝুলে পড়া ডালটায় কী একটা যেন জড়িয়ে রয়েছে—।’

‘সাপ-টাপ হতে পারে?’

‘উঁহু—বৃষ্টির মধ্যে সাপ অত কষ্ট করে ওপরে বেয়ে উঠে গাছের ডাল জড়িয়ে থাকবে কেন? ওটা অন্য কিছু—।’

শানুর কথা শেষ হতে-না-হতেই টুনটুন একটা কাণ্ড করে বসল। পায়ের কাছে এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটা বড় ঢিল কুড়িয়ে নিল। ছাতাটা খোলা অবস্থাতেই পাশে নামিয়ে রাখল। তারপর গায়ের সমস্ত শক্তি জড়ো করে ঢিলটাকে গাছ লক্ষ্য করে ছুড়ে মারল।

ঠিক লক্ষ্যভেদ না হলেও ঢিলটা কাছাকাছি পাতা বা ডালে গিয়ে ঠোক্কর খেল। কারণ, সংঘর্ষের চাপা শব্দটা ওরা শুনতে পেল।

আর ঠিক তখনই বাঁশির সুর থেমে গেল। যেন অলৌকিক বাঁশিওয়ালাকে ঢিল মেরে কেউ থামিয়ে দিয়েছে।

ঝুঁকে পড়ে ছাতাটা তুলে নিল টুনটুন। দেখল, সেই গাছের ডাল থেকে কী একটা যেন সরসর করে নেমে যাচ্ছে।

শানু হঠাৎই ওর হাত ধরে টান মারল, বলল, ‘চল তো, একটু এগিয়ে দেখি—।’

এগিয়ে দেখি! তার মানে?

টুনটুন এই কথাগুলো ভাবতে না ভাবতেই শানু আবার ওর হাত ধরে টানল। তারপর চটপটে পা ফেলে সামনে এগিয়ে গেল।

তখনই ওরা স্পষ্ট দেখল গাছের ডাল বেয়ে অনেকটা নেমে এসে সেই ‘কী একটা যেন’ পুকুরের জলে লাফিয়ে পড়ল।

‘ঝপাৎ’ শব্দ হল। ঢেউ উঠে ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে।

পুকুরের দিকে তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে রইল শানু আর টুনটুন।

জল নড়ছে, ফুলে উঠছে, নামছে—কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ঝিরঝিরে বৃষ্টির ফোঁটা জলের ওপরে সূক্ষ্ম নকশা বুনে চলেছে।

সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর টুনটুন জিগ্যেস করল, ‘শানুদা, জলে ঝাঁপ দিল, ওটা কী? সাপ?’

‘সাপের মতো…কিন্তু সাপ জলে ঝাঁপ দিলে ওরকম ঢেউ ওঠে না। ওটা অন্য কিছু। আগে কখনও আমি দেখিনি…কেউ দেখেনি।’

‘তুমি খেয়াল করেছ, ঢিল ছোড়ার সঙ্গে-সঙ্গে বাঁশি থেমে গেছে। তা হলে কি ওই জিনিসটাই বাঁশি বাজাচ্ছিল?’

‘জানি না—আমি কিছু জানি না।’

টুনটুন চাপা গলায় জানতে চাইল, ‘কালো বাড়িটা এখান থেকে কতদূরে, শানুদা?’

শানু হাত তুলে একদিকে দেখাল: ‘বেশ দূরে। ওইদিকে।’

বেশ কিছুক্ষণ ওরা পুকুরের কাছে দাঁড়িয়ে রইল। পাড়ের দিকে নজর রাখতে লাগল— পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়া প্রাণীটা জল থেকে ওঠে কি না।

কিন্তু আর কিছু দেখতে পেল না।

একসময় শানু বলল, ‘এবার চল—রাত হয়ে যাচ্ছে।’

তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ফেরার পথে শানু আবার বলল, ‘এসব কথা কাউকে বলিস না, বুঝলি?’

টুনটুন বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় নাড়ল।

ঠিক তখনই বৃষ্টিটা আরও জোরে নামল।

কী করে যেন কালো বাড়িটা টুনটুনের মাথায় চেপে বসতে লাগল। বারবার ওর মনে হতে লাগল, বাড়িটা ওকে টানছে। চোখের সামনে বসে আছে একটা জমাট রহস্য, অথচ সেটা কেউ তলিয়ে দেখতে চাইছে না। বাড়িটাকে এত ভয় পায় সবাই!

শানু আর অঙ্কিতের সঙ্গে এ নিয়ে অনেক কথা বলেছে টুনটুন। একদিন রাগ করে এ-কথাও বলেছে, ‘শানুদা, তোমরা তোমাদের ক্লাবের নামটা পালটে ফ্যালো। নাম রেখেছ ”বিপ্লবী সংঘ” অথচ ওই বাড়িটায় ঢুকতে ভয় পাও। তোমরা…।’

‘শোন—’ শানু বলল, ‘আমরা ভয় ঠিক পাই না—তবে…মানে, শুধু-শুধু বাড়িটাকে ডিসটার্ব করে কী লাভ! বাড়িটা যেমন আছে থাক না নিজের মনে…।’

‘শুধু বাড়ি কেন?’ পালটা তর্কে মেতে উঠল টুনটুন। কপালে নেমে আসা চুল সরিয়ে বলল, ‘সেদিন রাতের কেসটা কী হল? ওই যে, গাছ থেকে সাপের মতো জিনিসটা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল…বাঁশির আওয়াজ থেমে গেল…।’

অঙ্কিত অবাক হয়ে শানুর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘কী ব্যাপার রে?’ ওর ভুরু কুঁচকে গেল।

তখন শানু আমতা-আমতা করে ঘটনাটা জানিয়েছে। অঙ্কিত টু শব্দ না করে একমনে শানুর কাহিনি শুনেছে। শুনতে-শুনতে আপনমনেই কীসব বিড়বিড় করেছে।

টুনটুনের উৎসাহ আর খোঁচায় কালো বাড়িটা নিয়ে নানান খোঁজখবর নিতে শুরু করল শানু আর অঙ্কিত। জানা গেল, ঠিক ওইরকম একটা অদ্ভুত প্রাণীকে এলাকার আরও দু-একজন দেখেছে। তবে তারা প্রত্যেকেই কোন এক অপদেবতার ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে চেয়েছে।

কালো বাড়ি ছাড়া তিলকপুরে আরও যা কিছু দেখার আছে সেসব টুনটুনকে ক’দিন ধরে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল শানু। যেমন, দেড়শো বছরের পুরোনো একটা শিবমন্দির—যেখানে শিবরাত্রির সময় অসংখ্য মানুষের ভিড় হয়। আশপাশের বহু এলাকা থেকে দলে-দলে সবাই আসে শিবের পুজো দিতে।

তারপর তিলকপুরের স্কুল, বাজার, রবিবারের পশু-পাখির হাট, ফুলচাষের বাগান—কিছুই দেখাতে বাকি রাখল না।

সব দেখানো শেষ হলে শানু বলেছিল, ‘তবে আমাদের এখানে সবচেয়ে বিখ্যাত জিনিসটা তুই সবার আগে দেখে ফেলেছিস। কালো বাড়ি। কিন্তু এটার কথা কেউ ডিসকাস করে না—যদিও প্রায় সবাই জানে।’

রবিবার বেলার দিকে হাটে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ওরা তিনজন। বিশাল এলাকা জুড়ে হাট বসেছে। জায়গাটা একটা ফাঁকা মাঠ। তার মাঝে-মাঝে বড়-বড় গাছ, আর কয়েকটা চালাঘর—টিন অথবা চাটাইয়ের ছাউনি দেওয়া।

হাটে বেশ ভিড়। বিক্রির আশায় অনেকেই তাদের গোরু-বাছুর, ছাগল, কুকুর নিয়ে এসেছে। এ ছাড়া আছে নানান রঙের পাখি। খদ্দেররা ঘুরে-ঘুরে পশু-পাখি পরখ করে দেখছে। চারপাশে কিচিরমিচির ট্যাঁও-ট্যাঁও করে হরেকরকম পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। তার সঙ্গে কখনও-কখনও ছাগলের ডাক বা গোরুর হাম্বা রব।

টুনটুনের অদ্ভুত লাগছিল।

বর্ষার ছাই-রঙা আকাশ। বেলা বারোটার সময়েই গোধূলির আলো ছেয়ে আছে। মানুষজনের ভিড়। পশু-পাখির ডাক। সবমিলিয়ে এক জ্যান্ত ছবি।

ওরা পাখি দেখছিল। হঠাৎই প্রচণ্ড শোরগোল শুনে চমকে ফিরে তাকাল।

দেখল হাটের লোকজন দিশেহারা হয়ে উদভ্রান্তের মতো ছুটছে। আর পাগলের মতো চিৎকার করছে।

ওদের তিনজোড়া চোখ এই ডামাডোলের কারণ খুঁজছিল। কয়েক সেকেন্ড পরই দেখতে পেল একটা স্বাস্থ্যবান কালো বলদ খেপে গিয়ে এলোমেলো দৌড়চ্ছে। তারই গুঁতোর ভয়ে লোকজনের ছত্রভঙ্গ অবস্থা।

ওরা তিনজন ছুটে পিচের রাস্তায় চলে এল। একটা দোকানের সামনের রোয়াকে লাফিয়ে উঠে পড়ল।

রোয়াকে আরও দু-চারজন মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের জিগ্যেস করে জানা গেল ওই এলোমেলো ছুটে বেড়ানো কালো বলদটার নাম মনু। ওটা বদন ঘড়াইয়ের বলদ। প্রচণ্ড গরমে মাঠে লাঙল দিয়ে-দিয়ে নাকি পাগল হয়ে গেছে। ওকে সারিয়ে তোলার জন্য বদন অনেক ঝাড়ফুঁক করিয়েছে। কবিরাজের সালসা আর মোদক খাইয়েছে। এখন কী একটা ইনজেকশান দিয়ে চিকিৎসা চালাচ্ছে।

বদন প্রতি সপ্তাহের হাটে বলদটাকে বিক্রি করার জন্য নিয়ে আসে। কিন্তু কপাল খারাপ—এখনও বিক্রি হয়নি।

মনু তখনও লেজ খাড়া করে দৌড়চ্ছে। আর রোগা-সোগা টাকমাথা একজন লোক তার পিছন-পিছন মরিয়া হয়ে ছুটছে, আর মাঝে-মাঝেই থমকে দাঁড়িয়ে নিজের লুঙ্গি সামাল দিচ্ছে।

জটলার মধ্যে একজন আঙুল তুলে সেদিকে দেখিয়ে বলল, ‘ওই যে…মনুর পেছনে দৌড়চ্ছে…বদন ঘড়াই…।’

লোকজন দৃশ্যটা দেখছিল, হাসাহাসি করছিল। আর নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল যে, এই খ্যাপা বলদটা গোটা এলাকাকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে। এটাকে দূরের কোনও গ্রামে চুপিচুপি ছেড়ে দিয়ে এলে বদল ভালো করত। তার জবাবে কে যেন বলল, সেটা হওয়ার নয়। কারণ, মনুকে বদন দারুণ ভালোবাসে।

এসব কথাবার্তার মধ্যেই মনু এবং তার মালিক হাটের লন্ডভন্ড এলাকা ছাড়িয়ে দূরে গাছাগাছালির মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে গেল।

হাট থেকে ফেরার পথে শানু ঠাট্টা করে বলল, ‘যাক, ফ্রি-তে একটা সিনেমা দেখা হয়ে গেল। সিনেমাটার নাম ”পাগলা বলদ”।’

টুনটুন আর অঙ্কিত হেসে উঠল। কিন্তু একইসঙ্গে টুনটুনের মনে হচ্ছিল, স্নেহ-ভালোবাসা বড় মারাত্মক জিনিস। বোধহয় সবকিছুর চেয়ে বড়।

ঘটনাটা ঘটল ঠিক দু-দিন পরে। বিকেলে।

সেদিন বৃষ্টি ছিল না—তবে আকাশে সাজানো-গোছানো মেঘ ছিল। টুনটুন আর দিশা হেঁটে যাচ্ছিল অঙ্কিতদের বাড়ির দিকে। অঙ্কিত আর শানু ওদের সঙ্গে ছিল না। ওরা গেছে সাইকেলের দোকানে—অঙ্কিতের সাইকেলের বেয়ারিং সারাতে। অঙ্কিত বলেছে, ‘তোরা এগো— আমরা একটু পরেই তোদের পথে ধরে নেব…।’

টুনটুন ওর স্কুলের কথা বলছিল। বলছিল ওর স্যারদের কথা। স্কুলের অ্যানুয়াল স্পোর্টস-এর সময় কীরকম হুইহুল্লোড় আর মজা হয় সেসব কথা শোনাচ্ছিল।

ওদের পাশ দিয়ে বেল বাজিয়ে দু-একটা সাইকেল যাচ্ছিল। একটা মোটরবাইক কানে তালা ধরিয়ে আঁকাবাঁকা রেখায় কায়দা দেখিয়ে ছুটে গেল। দিশা বলল, ‘ওটা বিকাশদা। দারুণ বাইক চালায়…।’

ওরা হাঁটতে-হাঁটতে আরও খানিকটা এগোতেই টুনটুন বহুদূরে কালো বাড়িটাকে দেখতে পেল।

ও বলল, ‘চলো, ওটার কাছ দিয়ে যাই।’

দিশা ওর দিকে তাকিয়ে একটু দেখল। বলল, ‘খুব ইন্টারেস্ট, না?’

‘হ্যাঁ—তা একটু আছে।’

‘তুমি ভূতুড়ে বাড়ি ভয় পাও না?’

‘কে জানে! বাড়ির বাইরে থেকে তো পাই না।’ মাথা ঝাঁকাল টুনটুন: ‘ভেতরে ঢুকলে ভয় পাব কি না সেটা ডিপেন্ড করছে…।’

দিশা আর কিছু বলল না। ওকে নিয়ে বাঁ-দিকের একটা কাঁচা রাস্তায় ঢুকে পড়ল।

এমন সময় দূর থেকে টুনটুনের নাম ধরে কেউ ডাকল।

ওরা পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল অঙ্কিত আর শানু—হাসছে, হাত নাড়ছে। ইশারায় বলল, ‘তোরা এগিয়ে যা—আমরা পেছনে আছি।’

টুনটুনরাও হাত নাড়ল। তারপর এগিয়ে চলল।

পথের দুপাশে কাছে-দূরে ছোট-বড় অনেক গাছ। তারই মাঝে এখানে-ওখানে কয়েকটা বাড়ি। বেশিরভাগই একতলা। কয়েকটা বাড়ির মাথায় টিনের বা টালির চাল।

পথের ওপরে বাচ্চারা ছুটোছুটি করে খেলা করছে। দুটি মেয়ে টিউবওয়েল থেকে কলসিতে জল ভরছে। গাছের আড়ালে কোথায় যেন একটা কোকিল ডাকছিল।

টুনটুন অবাক হয়ে এসব দেখছিল। শহরের চেয়ে কত আলাদা! কী মোলায়েম!

একটু পরেই ওরা কালো বাড়িটার কাছাকাছি চলে এল। সামনেই ফাঁকা জায়গা। গাছপালার রাজত্ব। সেগুলো পেরিয়ে জং ধরা লোহার গেট।

দিশা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎই পিছন থেকে কয়েকজন মানুষের চেঁচামেচি হইচই কানে এল। তার মধ্যে দু-চারজন বাচ্চার গলাও মিশে আছে।

ব্যাপারটা কী? পিছনে ফিরে তাকাল টুনটুন।

তাকিয়েই ভয়ে ওর প্রাণ উড়ে গেল। ওদের দিকে পাগলের মতো ধেয়ে আসছে একটা কালো পাহাড়। মনু। বদন ঘড়াইয়ের সেই খ্যাপা বলদটা।

‘দিশা—ছোটো!’ বলে চিৎকার করে যেদিকে দু-চোখ যায় ছুটতে শুরু করল টুনটুন।

দিশা চমকে উঠে পিছনে তাকিয়ে আঁতকে উঠল। এই খ্যাপা বলদটার কথা ও টুনটুনের মুখে শুনেছে।

ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল দিশার। ও চিৎকার করে দিশেহারা হয়ে এলোমেলো ছুটতে শুরু করল। বলদটা দিশারই পিছু নিল।

অনেকটা ছুটে যাওয়ার পর টুনটুন পিছন ফিরে দেখল। দিশা চিৎকার করছে, ছুটছে।

কিন্তু এবার টুনটুন আরও বেশি ভয়ে পেল। কারণ, মনুর ভয় পাগল হয়ে দিশা কালো বাড়িটার দিকেই ছুটে যাচ্ছে। বলদটার আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য। ওর সামনে আর কোনও আড়াল নেই, আশ্রয় নেই।

আগাছার জঙ্গলের মধ্যে টুনটুন দাঁড়িয়ে পড়ল। ও কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। এবং ওর অবাক চোখের সামনে লোহার দরজার দু-পাল্লার ছোট ফাঁক দিয়ে দিশা কালো বাড়ির চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়ল।

বলদটা প্রবল আক্রোশে ছুটে গেল সেই লোহার সিংদরজার দিকে। মাথা নীচু করে শিং বাগিয়ে দড়াম করে আছড়ে পড়ল দরজার পাল্লার ওপরে। সংঘর্ষের ধাতব শব্দ বাতাস কাঁপিয়ে দিল।

দিশা আরও জোরে ভয়ংকর এক চিৎকার করে ঢুকে পড়ল কালো বাড়ির খোলা দরজা দিয়ে।

টুনটুন কেঁপে উঠল। শিরশির করে একটা স্রোত বয়ে গেল ওর শরীরের ভেতর দিয়ে। ও ‘দিশা! দিশা!’ করে ডেকে উঠল।

বলদটা আরও দুবার দরজায় ঢুঁ মারল। তারপর ছুট লাগাল পাগলের মতো। ঝোপজঙ্গল খেত চিরে দৌড়তে লাগল।

ততক্ষণে মানুষজনের ভিড় জমে গেছে। কালো বাড়ির কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে ওরা নিজেদের মধ্যে গুঞ্জন তুলছে, বাড়িটার দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে।

টুনটুন ছুটে গেল ওদের কাছে। চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘দিশাকে বাঁচান! একটু পরেই সন্ধে হয়ে যাবে। ওকে যে করে হোক সেভ করুন। পুলিশে খবর দিন। ফায়ার ব্রিগেডে খবর দিন। কিছু একটা করুন—প্লিজ!’

কে একজন বলল, ‘এখানে ফায়ার ব্রিগেড কোথায়? থানায় খবর দিতে পারো, তবে বড়বাবু আসবে বলে মনে হয় না…।’

আর একজন মন্তব্য করল, ‘ও বাড়িতে ঢোকা মানে জান বন্ধক দেওয়া।’

‘মেয়েটা মরতে ও-বাড়িতে ঢুকতে গেল কেন? পাশ দিয়ে ঘুরপাক খেয়ে পালাতে পারল না?’

‘একটু পরেই তো সব আঁধার হয়ে যাবে। তারপর কি আর ও-বাড়ি থেকে বেরোতে পারবে?’

এসব মন্তব্য শুনতে-শুনতে টুনটুন যেন পাগল হয়ে যাচ্ছিল। ও চট করে আকাশের দিকে তাকাল। সন্ধে নামতে এখনও বোধহয় আধখণ্টাখানেক বাকি। আকাশে মেঘ না থাকলে হয়তো আরও দশ-পনেরো মিনিট পাওয়া যেত। কিন্তু…।

তা হলে কি ও থানায় ছুটে যাবে?

আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। তারপরই শোনা গেল মেঘের গুড়ুম-গুড়ুম।

তখনই শানু আর অঙ্কিতকে দেখতে পেল টুনটুন। ও ছুটে ওদের কাছে গেল। বলল বদন ঘড়াইয়ের খ্যাপা বলদ মনুর কথা। আর দিশার কথা।

বলতে-বলতে টুনটুনের চোখে জল এসে গেল। অঙ্কিত ভীষণ ঘাবড়ে গেল। আর শানু বুঝে উঠতে পারছিল না কী করবে।

অঙ্কিত পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে বাড়িতে ফোন করল। মা-কে দিশার খবরটা দিয়ে বলল, ওর বাবা যেন এক্ষূনি থানায় খবর দেন।

শানুও মোবাইল ফোনের বোতাম টিপতে লাগল। মা ফোন ধরতেই বলল, ‘অঙ্কিতের ছোট বোনটা ভীষণ বিপদে পড়েছে। আমি আর টুনটুন এখানে আছি। ফিরতে দেরি হবে।’

অনিতা জিগ্যেস করলেন, ‘কী বিপদ হয়েছে?’

‘দিশা—অঙ্কিতের বোন—কালো বাড়িতে ঢুকে পড়েছে।’

‘কালো বাড়িতে? বলিস কী!’

শানু আর কথা না বাড়িয়ে আচমকা ফোন রেখে দিল।

অঙ্কিত ততক্ষণে দুটো ছেলেকে থানায় রওনা করে দিয়েছে। বলেছে, বড়বাবুকে ব্যাপারটা বলে যেমন করে হোক স্পটে নিয়ে আসতে।

টুনটুন লক্ষ করল, অঙ্কিতের মুখ ফ্যাকাসে, দিশেহারা। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না।

ও শানুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শানুদা, শিগগির চলো। এখনও আলো আছে। বাড়িটার ভেতরে ঢুকে দিশাকে নিয়ে আসি। এরপর সন্ধে হয়ে গেলে…।’

অঙ্কিত ইতস্তত করতে লাগল। দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে যেন পরামর্শ শুনতে চাইল।

টুনটুন অঙ্কিতের কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে টান মারল: ‘অঙ্কিতদা, জলদি করো! দেরি হয়ে গেলে দিশার যদি কিছু একটা হয়ে যায়…প্লিজ…।’

টুনটুনের গলা ভেঙে গেল। চোখে জল এসে পড়ল।

তখনই ও খেয়াল করল, অঙ্কিতের চোখও শুকনো নেই।

এমন সময় শানু আর অঙ্কিত দুজনেরই মোবাইল বাজতে শুরু করল। ওরা চটপট ফোন ধরে কথা বলতে শুরু করল।

কথা শুনে টুনটুন বুঝতে পারল ওরা ওদের বাবার সঙ্গে কথা বলছে।

অঙ্কিত ফোনে কথা বলতে-বলতে কেঁদে ফেলল। বলল, ‘তোমরা যা করার তাড়াতাড়ি করো। এদিকে আমরা দেখছি…।’ তারপর ফোন কেটে দিল।

শানুও একই ধরনের কথা বলে ফোন শেষ করল।

অঙ্কিত চোখ মুছল। নিজেকে সামলে নিতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিল। তারপর বলল, ‘চল—।’ বলে কালো বাড়িটার দিকে এগোল।

টুনটুন আর দেরি করল না। শানুর হাত ধরে এক টান মেরে অঙ্কিতের সঙ্গে এগোল।

জনতার ভিড় থেকে রব উঠল, ‘যেয়ো না! ও-বাড়িতে ঢুকো না! আগে পুলিশ আসুক…।’

অঙ্কিত একপলকের জন্য পিছনে ফিরে তাকাল শুধু। কোনও কথা বলল না। উৎকণ্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে দেখল। দিশা ওর ছোট বোন—ওদের নয়।

আবার কালো বাড়িটার দিকে পা চালাল অঙ্কিত। সঙ্গে শানু আর টুনটুন।

জল-কাদা আর ঘাস মাড়িয়ে ওরা বেশ কষ্ট করে এগোতে লাগল। টুনটুন কান পেতে শুনতে চাইল দিশার চিৎকার।

শানু বলল, ‘পুলিশ এখুনি এসে পড়বে।’ ওর কথাটা অনেকটা ভরসা খোঁজার মতো শোনাল।

একটু পরেই ওরা বাড়ির সিংদরজায় পৌঁছে গেল। অঙ্কিত দিশার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকল। তারপর পালা করে টুনটুন আর শানুও চেঁচাল। কিন্তু দিশার কোনও উত্তর পাওয়া গেল না।

অঙ্কিত আচমকা একটা সাহসের জোয়ার দেখিয়ে গটগট করে ঢুকে পড়ল বাড়ির এলাকায়। টুনটুন আর শানুও দেরি করল না।

বাড়িটার এত কাছে এসে শ্যাওলা ধরা দেওয়ালগুলো আরও ভালো করে দেখতে পাচ্ছিল টুনটুন। ভিজে চকচকে জমাট শ্যাওলা। সেইসঙ্গে ছাতা ধরা গন্ধটা ভয়ংকর তীব্র হয়ে নাকে আসছিল।

এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে ওরা খোলা জায়গাটা পেরিয়ে গেল। সামনেই কালো বাড়ির কালো রঙের বিশাল সদর দরজা। দরজার পাল্লায় বেশ কয়েকটা লোহার গজাল বসানো। ওগুলোর মাথা বিষফোঁড়ার মতো উঁচু হয়ে রয়েছে। পাল্লা দুটোর নানান জায়গায় ফাটল ধরা। এখানে-ওখানে কাঠের চটা উঠে গেছে। ধুলো আর ময়লায় দরজাটা মলিন। দরজার ফ্রেমের কোনা থেকে ছোট-বড় গাছ বেরিয়ে গেছে।

দরজার পাল্লা দুটো বেশ খানিকটা ফাঁক হয়ে আছে। এই ফাঁক দিয়েই দিশা বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেছে। ওরা নজর চালিয়ে বাড়ির ভেতরটা দেখতে চেষ্টা করল। কিন্তু নিকষ অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়ল না।

অঙ্কিত দরজার ফাঁকের কাছে মুখ নিয়ে চিৎকার করে ডাকল: ‘দিশা—! দিশা—!’

কোনও সাড়া নেই।

টুনটুন দিশার নাম ধরে ডাকল দুবার।

কোনও উত্তর নেই।

‘চল—’ বলে দরজার একটা পাল্লা ঠেলে দিল অঙ্কিত। তারপর কালো বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল।

ওর পিছন-পিছন শানু আর টুনটুনও ঢুকে পড়ল।

ওরা তিনজনে গলা ফাটিয়ে দিশার নাম ধরে ডেকে চলল। সেই চিৎকারের মধ্যে মনের ভয় তাড়ানোর চেষ্টাও খানিকটা মিশে ছিল। ওদের চিৎকারের উত্তরে ফাঁপা প্রতিধ্বনি ফিরে এল বারবার।

এমনসময় আকাশের মেঘ ডেকে উঠল। বিকট শব্দে বাজ পড়ল কোথাও।

কালো বাড়ির সদর দরজাটা হঠাৎ নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল।

দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে ওরা তিনজন চমকে ফিরে তাকাল। শানু আর টুনটুন ছুটে গেল দরজার দিকে। দরজাটা টেনে খোলার চেষ্টা করল। কিন্তু ভেতর থেকে ধরে টানার মতো কোনও কড়া কিংবা হাতল খুঁজে পেল না।

তখন ওরা দরজার পাল্লায় জোরে-জোরে কয়েকবার ধাক্কা মারল, কিন্তু ভারী দরজাটা সে-ধাক্কাকে পাত্তা দিল বলে মনে হল না।

শানু আর টুনটুন অঙ্কিতের কাছে এসে দাঁড়াল। শানু একটু ভয় পাওয়া গলায় বলল, ‘দরজাটা কে বন্ধ করল বল তো? আমরা তো আর এ-বাড়ি থেকে বেরোতে পারব না…!’

অঙ্কিত কোনও উত্তর দিল না। বাড়ির ভেতরটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিল।

গোটা বাড়িটায় এক অদ্ভুতরকমের আলো ছড়িয়ে আছে। গোধূলির আলোর সঙ্গে একটু নীলচে রং মিশিয়ে দিলে বোধহয় এইরকম আলোই পাওয়া যাবে। কিন্তু আলোটা কোথা থেকে আসছে সেটা বোঝা গেল না।

ওরা যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছে সেটা একটা চওড়া করিডর মতন। তার দুপাশেই খাড়া কালো রঙের দেওয়াল। দেওয়ালে শ্যাওলার ছোপ আর ছাতা ধরা গন্ধ।

করিডর ধরে ওরা আরও একটু এগোল। অঙ্কিত দিশার নাম ধরে ডাকল দুবার, এবং যথারীতি কোনও সাড়া পেল না।

ওরা একটা সিঁড়ির সামনে এসে পড়ল। চওড়া কালো পাথরের সিঁড়ি। এবড়োখেবড়ো ধাপগুলো দোতলার দিকে উঠে গেছে।

নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ওরা ওপরে উঠতে শুরু করল। আর ঠিক তখনই ওরা খেয়াল করল, কোথা থেকে যেন একটা হালকা শব্দ ওদের কানে আসছে। শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দের মতো। খুব ঢিমে তালে কেউ যেন শ্বাস নিচ্ছে, আবার ছাড়ছে।

‘কীরে, কোনও মেশিন-টেশিন চলছে নাকি?’ অঙ্কিতের দিকে তাকিয়ে শানু জিগ্যেস করল।

‘কে জানে!’ ঠোঁট ওলটাল অঙ্কিত: ‘কামারশালায় যেরকম শব্দ হয় অনেকটা সেই টাইপের—না?’

‘হ্যাঁ—।’

ওরা দোতলায় উঠে এল। এবার বাড়ির ভেতরের চেহারাটা ওদের কাছে স্পষ্ট হল।

একতলায় ওরা কোনও ঘরের দরজা দেখেনি। অবশ্য সেভাবে খোঁজেওনি। কিন্তু দোতলায় এসে অনেকগুলো দরজা চোখে পড়ল। আরও বুঝতে পারল, বাড়িটা মাপে বিশাল।

বাড়িটার ভেতরের রকমসকম অনেকটা পুরোনো দুর্গের মতো। দোতলার লম্বা বারান্দাটা একটা প্রকাণ্ড বর্গক্ষেত্রের পরিসীমা বরাবর পাক খেয়ে গেছে। বারান্দা থেকে নীচে তাকালে একটা খোলা জায়গা চোখে পড়ে। সেই চাতালের ঠিক মাঝখানে একটা চৌকো পুকুরের মতো। পুকুরটার পাড় বাঁধানো। আর পুকুরে নামার জন্য চারদিকেই পাথরের সিঁড়ি রয়েছে। পুকুরের চারকোণে চারটে বড়-বড় থাম। তার গায়ে নানান নকশা। তবে জায়গায়-জায়গায় সিমেন্ট খসে গেছে। শ্যাওলা ও ময়লা জমে নকশা চাপা পড়ে গেছে। এ ছাড়া থামগুলোয় জড়িয়ে রয়েছে নানান গুল্মলতা।

পুকুরের জলের রং যা-ই হোক, এখন সেটা কালো দেখাচ্ছে। আর বারান্দা থেকে ঝুঁকে পুকুরের দিকে তাকিয়ে ওরা কোনওরকম প্রতিফলন দেখতে পেল না।

জলে আকাশের ছায়া না দেখতে পেয়ে ওপরদিকে তাকাল টুনটুন। না, সেখানে খোলা আকাশ নেই। বরং রয়েছে ছাতার মতো একটা প্রকাণ্ড ঢাকনা। সেই ঢাকনার কোথাও-কোথাও ফাটল কিংবা গর্ত রয়েছে। সেই ফাঁক দিয়ে আকাশের শেষ আলো চোখে পড়ছে।

ওরা তিনজন প্রথমে বারান্দাটা একটা চক্কর দিয়ে ফেলল। ‘দিশা! দিশা!’ করে বারকয়েক ডাকল। উত্তর দিল প্রতিধ্বনি।

অঙ্কিত বলল, ‘চল, এবার ঘরগুলো খুঁজে দেখি। তারপর তিনতলাটা দেখব।’

শানু আর টুনটুন ওর কথায় সায় দিল।

দোতলায় ওটার সময় সিঁড়ির ধাপ যে আরও ওপরদিকে উঠে গেছে সেটা ওরা খেয়াল করেছে। তবে টুনটুনের মনে প্রশ্ন জাগছিল, কালো বাড়িটা ক’তলা? বাইরে থেকে বাড়িটাকে দেখে ওর কখনও মনে হয়নি ওটা দোতলার বেশি। কিন্তু বাড়ির ভেতরে ঢুকে ঘোরাঘুরি করে ওর মনে হচ্ছে, তিনতলা কেন, বাড়িটা চারতলাও হতে পারে। তবে বাড়িটাকে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ ও এখনও পর্যন্ত খুঁজে পাচ্ছিল না। শুধু শ্বাস-প্রশ্বাসের ওই চাপা শব্দটা একটা অস্বস্তি তৈরি করছে। ওটা এখনও হয়ে চলেছে। টুনটুন ভাবল, সবক’টা ঘর তল্লাশি করে দেখলেই ওটার রহস্য ভেদ করা যাবে। হয়তো জানলা দিয়ে জোলো বাতাস ঢুকে ওরকম অদ্ভুত শব্দ তৈরি করছে।

দিশার নাম ধরে ডাকতে-ডাকতে ওরা তিনজনে তিনটে ঘরের দরজা লক্ষ্য করে দৌড়ল।

বাড়ির ভেতরে কোথাও কোনও ইলেকট্রিক বালব, টিউবলাইট কিংবা পাখা ওদের চোখে পড়েনি। শুধু তাই নয়, কোনও ওয়্যারিং বা সুইচবোর্ডও নেই। মনে হয়, এসব ব্যবস্থা এ-বাড়িতে কোনওকালেই ছিল না। তা হলে কি বাড়িটা মোমবাতি-হ্যারিকেন কিংবা প্রদীপ-কুপির যুগে তৈরি?

এসব কথা ভাবতে-ভাবতে টুনটুন একটা ঘরে ঢুকে পড়ল।

ঘরটা বেশ বড়। ঘরে একটা প্রকাণ্ড কাঠের আলমারি। তার পাল্লার ওপরে দুটো লম্বা- লম্বা আয়না লাগানো। আর একদিকে একটা একমানুষ সমান আলনা। তাতে বেশ কয়েকটা নোংরা ছেঁড়া কাপড় ঝুলছে। আলনার উলটোদিকের দেওয়াল ঘেষে একটা বড় পালঙ্ক। পালঙ্কে এলোমেলোভাবে পড়ে আছে দুটো বালিশ আর দুটো কোলবালিশ। দু-একটা বালিশের খোল ফেটে তুলো বেরিয়ে এসেছে। বিছানায় একটা সাদা চাদর পাতা রয়েছে। তার প্রান্তটা পালঙ্কের দুপাশে পরদার মতো ঝুলছে।

গোটা ঘরের সর্বত্র ধুলো আর ধুলো। আর তার সঙ্গে পুরোনো ছাতা ধরা গন্ধ।

টুনটুন দেখল, ওর মুখোমুখি দেওয়ালে দুটো জানলা হাট করে খোলা।

ও খুব অবাক হল। কারণ, আগে যখনই ও কালো বাড়িটাকে দেখেছে তখন একটা জানলাও ওর নজরে পড়েনি। কিংবা এমন হতে পারে, জানলা সব বন্ধ ছিল এবং শ্যাওলার পরত জানলার পাল্লা আর দেওয়ালকে এমনভাবে ঢেকে দিয়েছে যে, আলাদা করে আর চেনা যায়নি।

কী এক কৌতূহলে জানলার কাছে ছুটে গেল টুনটুন। চোখ মেলে বাইরে তাকাল। তারা ভরা আকাশ ওর নজরে পড়ল।

হঠাৎই ওর খেয়াল হল, কোনও গাছপালা, বাড়িঘর কিংবা আলোর বিন্দু—কিছুই ওর চোখে পড়ছে না। সবটাই শুধু রাতের আকাশ—মেঘহীন, পরিষ্কার। দেখে মনেই হয় না, এই আকাশ ক’দিন ধরে কী বৃষ্টিই না দিয়েছে!

কিন্তু এই অল্প সময়ে আকাশটা কী করে এত ঝকঝকে হয়ে গেল?

এ-কথা ভাবতে-ভাবতে ও নীচের দিকে তাকাল। আর তাকিয়েই ওর মাথাটা কেমন টলে গেল।

এ কী দেখছে ও? নীচের দিকে তাকিয়েও সেই রাতের আকাশ!

আকাশটা কি এই বাড়িটাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে? এমনকী নীচ থেকেও?

টুনটুনের মাথাটা পাক খেয়ে গেল। ওর চারপাশটা কেমন দুলে উঠল। তাড়াতাড়ি দেওয়াল ধরে ও সামলে নিল। কিন্তু একইসঙ্গে ভয় পেয়ে গেল। এ-বাড়ি থেকে ওরা বেরোবে কেমন করে? দরজা বন্ধ। জানলা দিয়ে তাকালে তিলকপুরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না—শুধু আকাশ আর আকাশ।

টুনটুনের সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল। পুলিশের লোক এসেই বা কী করে ওদের উদ্ধার করবে? লোকজন জোগাড় করে ওরা কি এই বাড়িটাকে ভেঙেচুরে একেবারে শেষ করে দিতে পারবে?

এমন সময় রক্ত হিম করা একটা চিৎকার টুনটুনকে পাথর করে দিল।

চিৎকারটা লম্বায় অনেক বড়। গলার স্বর এতটাই কর্কশ যে, মনে হল, ভাঙাচোরা গলা নিয়ে কেউ বাঁচার আকাঙ্ক্ষায় চরম চিৎকার করছে।

হয় শানু, নয় অঙ্কিত। টুনটুনের মনে হল, চিৎকারের মালিক ওদেরই কেউ একজন। যদি তাই হয় তা হলে ওর সঙ্গে টুনটুনের কি আর দেখা হবে!

আর দেরি করল না ও। মাথার চক্কর সামলে নিয়ে চেঁচিয়ে ডেকে উঠল, ‘শানুদা! অঙ্কিতদা!’ তারপর ঘরের দরজা লক্ষ্য করে তীব্র ছুট লাগাল।

ঠিক তখনই বিছানার সাদা চাদরটা ভেসে উঠল শূন্যে। সমুদ্রের জলের মতো ঢেউ তুলে ধীরে ধীরে নেমে এল ঘরের মেঝেতে। ঠিক যেন প্যারাশুটে ভর করে অদৃশ্য কেউ ঘরের মেঝেতে ‘ল্যান্ড’ করল।

ব্যাপারটা এমন আচমকা ঘটে গেল যে, আর-একটু হলেই টুনটুনের পা চাদরের ওপরে পড়ছিল। ছুটন্ত গাড়ি যেভাবে ব্রেক কষে অনেকটা সেভাবেই নিজেকে কোনওরকমে থামিয়ে দিল ও।

আর তখনই ওকে অবাক করে দিয়ে চাদরের ঠিক মধ্যিখানটা ফুলে উঠতে শুরু করল। এবং ফোলা জায়গাটা ক্রমেই খাড়াভাবে উঁচু হয়ে উঠতে লাগল। চাদরে ঢাকা একটা ফুটবল শূন্যে ভেসে উঠলে যেমন হয়।

টুনটুনের মনে হল, চাদর ঢাকা একটা মানুষ কীভাবে যেন মেঝেতে লেপটে ছিল—এবার অদ্ভুতভাবে মাথা চাড়া দিয়ে ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াচ্ছে।

ও চিৎকার করতে চায়নি। কিন্তু চিৎকারটা নিজে থেকেই বেরিয়ে এল বাইরে। সহজে থামতে চায় না এমন চিৎকার। আর সেই চিৎকারের স্বরটাও এমন যে, টুনটুনের মনে হল, ও নয়, অন্য কেউ চিৎকার করছে।

চাদরের অবয়বটা খাড়া স্তম্ভের মতো টুনটুনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, আর ওর চিৎকার চলছিল—একবার, দুবার, তিনবার।

চার নম্বর চিৎকার শুরু হতেই সাদা চাদরটা ধীরে-ধীরে ফিকে হয়ে গিয়ে শূন্যে মিলিয়ে গেল।

টুনটুন কুলকুল করে ঘামতে শুরু করেছিল। হাঁপাচ্ছিল হাপরের মতো। ঘরটার চারপাশ সতর্ক চোখে দেখছিল। নীলচে গোধূলি আলো আর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দটা এখন ওকে বেশ ভয় পাইয়ে দিচ্ছিল। ও কোনওরকমে পাশের ঘরের দিকে রওনা হল। যাওয়ার সময় পালঙ্কের দিকে ভয়ের চোখে তাকাল বেশ কয়েকবার।

বারান্দায় এসেই ও অঙ্কিতকে দেখতে পেল।

এ কী উদভ্রান্তের মতো চেহারা হয়েছে ওর! মাথার চুল এলোমেলো। টি-শার্টে কালির দাগ। চোখে আতঙ্ক।

‘শানুদা কোথায়?’ টুনটুন হাঁপাতে-হাঁপাতে জিগ্যেস করল।

‘জানি না। ও তো ওদিকের ঘরটায় ঢুকেছিল…।’ আঙুল তুলে দূরের একটা ঘর দেখাল অঙ্কিত।

‘তুমি কি একটু আগে চিৎকার করছিলে?’

‘হ্যাঁ। ও-ঘরটায় একটা পিকিউলিয়ার ব্যাপার আছে—।’ সামনের একটা ঘরের খোলা দরজার দিকে দেখাল ও: ‘ঘরের দেওয়ালগুলো হঠাৎ কাঁপতে শুরু করেছিল। তারপর…একবার ফেঁপে উঠছিল, আর-একবার চুপসে যাচ্ছিল। বেলুনের মতো। তা ছাড়া দেওয়ালের গা বেয়ে একরকম কষ বেরিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। সেসময় একটা দেওয়াল ফুলে উঠে আমাকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরে দেয়। তারপরই দেখি আমার টি-শার্টের পিঠটা দেওয়ালে আটকে গেছে—কিছুতেই ছাড়াতে পারছিলাম না। তখন ভয়ে…।’

‘দিশা…দিশা…কোথায়?’

‘জানি না। চলো, আমরা দুজনে মিলে একটু খুঁজে দেখি। আমার…আমার ভীষণ ভয় করছে…।’ কথা বলতে-বলতে হঠাৎই অঙ্কিতের খেয়াল হল টুনটুন হাঁপাচ্ছে। তাই ও জিগ্যেস করল, ‘তোমার কী হয়েছে? এরকম হাঁপাচ্ছ কেন? চোখ-মুখ কেমন হয়ে গেছে…।’

টুনটুন অঙ্কিতের হাত আঁকড়ে ধরল। বলল, ‘এ-ঘরটায় আমিও কতকগুলো বিচ্ছিরি ব্যাপার দেখেছি। বিশ্বাস হচ্ছে না, কিন্তু নিজের চোখে দেখেছি। চলো, বলছি…।’

যে-ঘর থেকে টুনটুন একটু আগে বেরিয়ে এসেছে সেদিকে ভয়ের চোখে তাকিয়ে ও ঘরের দরজাটা একরকম দৌড়ে পেরিয়ে গেল। অঙ্কিতের সঙ্গে সিঁড়ির দিকে যেতে-যেতে ও সব বলল—বাড়িটাকে ঘিরে থাকা রাতের আকাশের কথা, বিছানার চাদরের কথা।

অঙ্কিত হঠাৎই অসহায় গলায় বলে উঠল, ‘টুনটুন, আমরা কি আর এ-বাড়ি থেকে বেরোতে পারব না?’

টুনটুন চারদিকে চোখ বুলিয়ে বিচিত্র বাড়িটাকে দেখল, বলল, ‘বেরোতে হবেই…যে করে হোক। বাড়িটা যতই ভয় দেখাক…আমরা…।’

টুনটুনের কথা আটকে-আটকে যাচ্ছিল। হঠাৎই ও দিশা আর শানুর নাম ধরে ডাকতে শুরু করল।

অঙ্কিত বুঝল, এটা ভয় তাড়ানোর একটা চেষ্টা। তাই ও আর দেরি করল না—টুনটুনের সঙ্গে গলা মেলাল।

কয়েকবার ডাকাডাকির পর ওরা থামল। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল।

টুনটুন জোর করে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করছিল যে, ভয় পেয়ে কোনও লাভ নেই। কারণ, ইচ্ছে করলেই এ-বাড়ি থেকে ওরা বেরোতে পারবে না। তা ছাড়া দিশার খোঁজ করতে হবে, শানুর খোঁজ করা দরকার। এত বড় বাড়ি! কে জানে, এর কোন ঘরে কোন আনাচেকানাচে ওরা হারিয়ে গেছে।

তিনতলায় এসেই টুনটুন আর অঙ্কিত অবাক হয়ে গেল।

ওদের সামনে সেই চৌকো পুকুর। তার চারকোণে চারটে-স্তম্ভ। দোতলা থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে ওরা পুকুরটাকে দেখেছিল। তাই পুকুরটা একতলায় বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে ওটা তিনতলায়!

ওপরদিকে তাকাল টুনটুন। ছাতার মতো সেই প্রকাণ্ড ঢাকনা।

ওর মাথা গুলিয়ে গেল। অঙ্কিতকে বলল, ‘এ-বাড়িটার দিকগুলো কেমন যেন জট পাকানো। এই যে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলাম—সেটা কি উঠে এলাম, নাকি নামলাম?’

অঙ্কিত বলল, ‘আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। ওই দ্যাখো, জলের মধ্যে কী!’

টুনটুন অঙ্কিতের ইশারা লক্ষ্য করে তাকাল। পুকুরের কালচে জলে আলোড়ন। কিছু একটা জলের ওপরে এসে শরীরটা আবার পাক খাইয়ে জলের গভীরে তলিয়ে গেল।

টুনটুন পুকুরের ঘাটের কাছে এগিয়ে গেল। আলোটা এখন আরও কমে গেছে বলে মনে হল। তারই মধ্যে ও নজর চালিয়ে দেখতে চেষ্টা করল। কোথায় গেল প্রাণীটা? যদি ওটা সত্যিই কোনও প্রাণী হয়।

একটু পরে প্রাণীটাকে দেখতে পেল টুনটুন। একটা নয়—অন্তত চার-পাঁচটা। জলে ঝটাপটি তুলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে। তবে মাছের মতো নয়—সাপের মতো। মাথায় কালো রঙের চুল বা সেরকম কিছু রয়েছে। লম্বা তেলা মাছের শরীর। দুপাশে দুটো পাখনার মতো। আর লেজও একটা নয়—দুটো।

টুনটুন আর অঙ্কিত অবাক হয়ে প্রাণীগুলোকে দেখতে লাগল। সাপের মতো, অথচ সাপ নয়। এ কোন আশ্চর্য সরীসৃপ!

ঠিক তখনই ওরা দেখল, উলটোদিকের ঘাটের সিঁড়ির ধাপ বেয়ে ওপরে উঠছে দুটো সরীসৃপ। ভেজা ন্যাকড়ার মতো নরম ওদের শরীরে সিঁড়ির ধাপের আদলে ভাঁজ পড়েছে।

ওদের বিস্ময় ভরা চোখের সামনে সরীসৃপ দুটো এগিয়ে গেল একটা স্তম্ভের কাছে। ওটার গায়ে পাক খেয়ে লেপটে রইল।

টুনটুনের মনে পড়ে পেল সেই রাতের কথা। দিশাদের বাড়ি থেকে ও আর শানু যখন বৃষ্টির মধ্যে ফিরছিল। গাছ থেকে সাপের মতো কী একটা যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পুকুরের জলে।

টুনটুন বলল, ‘অঙ্কিতদা, এরকম একটা পিকিউলিয়ার সাপ আমি আর শানুদা দেখেছিলাম। সেদিন রাতে তোমাদের বাড়ি থেকে ফেরার সময়…।’

‘এটা আবার কী টাইপের সাপ রে! দুটো লেজ…মাথায় চুল…।’

‘কী জানি!’

এমন সময় একটা মেয়েলি চিৎকার শুনতে পেল ওরা। কিন্তু কোনদিক থেকে চিৎকারটা এল সেটা ঠিক বুঝতে পারল না।

অঙ্কিত আর টুনটুন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারপরই ওরা ছুটতে শুরু করল সিঁড়ির দিকে।

কিন্তু কোথায় সিঁড়ি!

ভয়ে কাঁটা হয়ে ওরা দুজনে সিঁড়িটাকে খুঁজতে শুরু করল।

একটু পরেই অবাধ্য সিঁড়িটাকে খুঁজে পেল ওরা। যে-সিঁড়িটাকে ডানদিকের দেওয়াল ঘেঁষে খুঁজে পাওয়ার কথা সেটাকে পাওয়া গেল একেবারে বাঁ-প্রান্তে। এটুকু সময়ের মধ্যে পাথরের সিঁড়িটা যে কী করে নড়েচড়ে সরে এল সেটা কে জানে!

ওরা সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল। চিৎকারটা তখনও নীচ থেকে ভেসে আসছে।

নীচে এসে ওরা দেখল দোতলার চেহারাটা আর আগের মতো নেই। সেখানে এখন বিশাল মাপের একটা হলঘর। তার সিলিং-এ কয়েকটা বালব জ্বলছে। কী করে জ্বলছে সেটা বোঝা মুশকিল—কারণ, কোথাও ওয়্যারিং বা সুইচের কোনও চিহ্নমাত্র নেই।

হলঘরের দূরের কোণে একটা মেয়ে ভেজা বেড়ালের মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। দু-হাত বুকের কাছে জড়ো করা। আর প্রকাণ্ড হাঁ করে প্রবল চিৎকার করছে।

দিশা! দিশাকে খুঁজে পেয়েছে ওরা। কিন্তু দিশা ওদের দেখতে পেল না। কারণ, ও তখন ঘরের মেঝের দিকে তাকিয়ে একটানা চিৎকার করে চলেছে। হলঘরের মেঝেতে চলে-ফিরে বেড়োচ্ছে অসংখ্য কালো ছায়া। ছায়াগুলোর চেহারা নানান রকমের। ওরা মেঝেতে লেপটে চলে বেড়াচ্ছে। কিন্তু যে-কায়া থেকে ছায়াগুলো তৈরি হয়েছে তাদের কোনও হদিস নেই। শুধু মেঝেতে আর দেওয়ালে চলন্ত ছায়া কিলবিল করছে।

‘দিশা! দিশা!’ চিৎকার করে উঠল অঙ্কিত। ছায়াগুলো মাড়িয়ে ও ছুট লাগল দূরের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় মেয়েটার দিকে। টুনটুনও মরিয়া হয়ে দৌড়ল ওর পিছনে।

সঙ্গে-সঙ্গে ছায়াগুলো মিলিয়ে যেতে লাগল পটাপট। আর ঘরের বাতাসে এক অলৌকিক ঝড় উঠল। ঘন বাতাস ঘূর্ণিপাক তুলে হলঘরের মধ্যে তাণ্ডব নৃত্য নেচে বেড়াতে লাগল। মাথার ওপরে ঝুলন্ত বালবগুলো পেন্ডুলামের মতো দুলতে লাগল।

অঙ্কিত ছুটে গিয়ে পাগলের মতো জাপটে ধরল দিশাকে। আনন্দে কাঁদতে শুরু করল। দিশাও ‘দাদাভাই! দাদাভাই!’ বলে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

টুনটুন দিশাকে ভরসা দিয়ে বারবার বলতে লাগল, ‘ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না। আমরা এসে গেছি…।’

ভাই-বোন একটু সামলে নেওয়ার পর টুনটুন জিগ্যেস করল, ‘শানুদা কোথায়?’

ঘরের মধ্যে ঝড় সাঁইসাঁই আওয়াজ তুলছিল। ঝোড়ো বাতাসে সকলের চুল উড়ছিল।

দিশা ফুঁপিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘শানুদা কোথায় জানি না। দোতলা না তিনতলায় যেন একবার দেখেছিলাম। কীসের ভয়ে পাগলের মতো ছুটে পালাচ্ছে।’

দিশাকে অবাক চোখে দেখছিল টুনটুন।

কী চেহারা হয়েছে ওরা! চোখের কোলে কালি। গাল দুটো বসে গেছে। চুড়িদার এখানে-ওখানে চেঁড়া। যেন একটা সাইক্লোন বয়ে গেছে ওর ওপর দিয়ে।

অঙ্কিত বলল, ‘এ-বাড়িটার ঘর, সিঁড়ি—কিছুই ঠিকঠাক বোঝা যাচ্ছে না। চলো, আমরা একসঙ্গে থেকে এলোমেলো এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াই। দেখি, বেরোনোর দরজাটা খুঁজে পাই কি না। এইভাবে হয়তো শানুর খোঁজও পেয়ে যেতে পারি—।’

ওরা তিনজন আর দেরি করল না। হলঘরের একটা বড় দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। তারপর যেদিকে দু-চোখ যায় সেদিকেই চলতে শুরু করল। কখনও সিঁড়ি, কখনও বারান্দা, কখনও অলিন্দ ধরে ওরা ছুটতে লাগল, আর মাঝে-মাঝেই শানুর নাম ধরে ডাকতে লাগল।

এইভাবে বাড়িটার গোলকধাঁধায় পাক খেতে-খেতে ওরা একটা বিশাল ঘরে ঢুকে পড়ল। ঘরটা মাপে যেমন বড় তেমনই তার ছাদ তিরিশ ফুট উঁচুতে। ঘরে অনেকগুলো বালব জ্বলছে।

ঘরটায় একটা প্রকাণ্ড মাপের যন্ত্র বসানো। যন্ত্রটার হাজাররকম পার্টস। এবং নানানরকম শব্দ করে সেগুলো নড়ছে, কারণ যন্ত্রটা চলছে। অনেকগুলো সরু-সরু কাচের নল দিয়ে রঙিন কেমিক্যাল বয়ে চলেছে। কোনও-কোনও ইস্পাতের নল দিয়ে ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। একটা বিরাট ফাঁপা চামড়ার বল যন্ত্রের শব্দের তালে-তালে ফুলে উঠছে, চুপসে যাচ্ছে। তা থেকে ফোঁস-ফোঁস শব্দ হচ্ছে। এই শব্দটাই ওরা মাঝে-মাঝে শুনতে পাচ্ছিল। শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দের মতো মনে হচ্ছিল।

‘এটা কীসের যন্ত্র?’ বিশাল যন্ত্রটা জরিপ করতে-করতে অঙ্কিত বলল।

টুনটুন বলল, ‘কে জানে! পাইপে-পাইপে একেবারে জট পাকিয়ে গেছে।’

দিশা বলল, ‘সময় নষ্ট করে লাভ নেই, দাদাভাই। শানুদার খোঁজ করতে হবে যে…।’

ওরা ঘরটা থেকে বেরিয়ে আসতেই একটা চিৎকারের শব্দ কানে এল। কোনদিক থেকে শব্দটা আসছে সেটা ঠাহর করার চেষ্টা করতে-না-করতেই চিৎকারটা আবার শোনা গেল। ওরা তিনজনে সেদিক লক্ষ্য করে ছুটল।

দুটো ঘর পেরিয়ে তিন নম্বর ঘরে গিয়েই ওরা শানুকে দেখতে পেল। ওকে নিয়ে অদৃশ্য কারা যেন ছিনিমিনি খেলছে। অনেকটা ভলিবল খেলার ঢঙে ওকে নিয়ে লোফালুফি চলছে। কিন্তু সেই শক্তিশালী ‘খেলোয়াড়’-দের কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।

শানু ভয়ে চিৎকার করছিল। ওকে ওইরকম অবস্থায় দেখে অঙ্কিতরাও ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল।

সঙ্গে-সঙ্গে খেলোয়াড়রা বোধহয় থেমে গেল। কারণ, শানু ধপাস করে খসে পড়ল পাথরের মেঝেতে। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল।

ওরা ছুটে গেল শানুর কাছে। ওকে ধরে তুলল। ওর কপালে বেশ খানিকটা কেটে গেছে, রক্ত পড়ছে। হাতে দু-জায়গায় ছড়ে গেছে। জামাকাপড় ছিঁড়ে গেছে বেশ কয়েক জায়গায়। বড়-বড় শ্বাস ফেলে হাঁপাচ্ছে। যন্ত্রণায় ‘উঃ! আঃ!’ করছে।

ওরা শানুকে নিয়ে ঘরের বাইরে চলে এল। টুনটুন জিগ্যেস করল, ‘শানুদা, তুমি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে?’

‘জানি না। আমি তো সারাক্ষণ তোদের খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। এই বাড়িটা যেন কেমন। সবকিছু গুলিয়ে যায়।’

অঙ্কিত বলল, ‘চল, সবাই মিলে এবার বেরোনোর চেষ্টা করি—।’

ওরা দল বেঁধে রওনা হল। নীল আলোয় বেরোনোর পথ খুঁজতে লাগল।

ঠিক তখনই একটা বাঁশির সুর ভেসে উঠল বাতাসে। অদ্ভুত মিঠে সুরটা গোটা বাড়িটায় কেঁপে-কেঁপে ঘুরে বেড়াতে লাগল।

ওরা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

‘কে বাঁশি বাজাচ্ছে?’ টুনটুন বলে উঠল।

‘জানি না।’ অঙ্কিত বলল,’তবে এই বাঁশির সুরটা সবাইকে টেনে নেয় বলে শুনেছি।’

‘টেনে নেয় মানে?’

‘মানে, হিপনোটাইজ বা ওরকম কিছু একটা করে বলে শুনেছি। বাঁশির এই সুরের ফাঁদে পড়ে অনেকে নাকি এই বাড়িটায় ঢুকে পড়েছে—আর বেরোতে পারেনি। তাদের আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি…।’

শানু ভয়ে-ভয়ে বলল, ‘আমাদের কী হবে?’

দিশা বলল, ‘ভয় পেলে চলবে না, শানুদা। যে করে হোক, এ-বাড়ি থেকে আমাদের বেরোতে হবে।’

ওরা আবার চলতে শুরু করল। কখনও সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল, কখনও নামতে লাগল। নানান ঘরে ঢুকতে লাগল—যে-কোনও দরজা পেলেই সেটা দিয়ে ঢুকে পরীক্ষা করতে লাগল বেরোনোর পথ পাওয়া যায় কি না। একইসঙ্গে অদ্ভুত বাড়িটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল।

হঠাৎই একটা বড় মাপের ঘরে ঢুকে ওরা অবাক হয়ে গেল।

ঘরটা কোনতলায় ওরা জানে না। কারণ, এ-বাড়িতে ‘একতলা, দোতলা, তিনতলা’ শব্দগুলোর যে কোনও মানে নেই সেটা এতক্ষণে ওরা হাড়ে-হাড়ে বুঝে গেছে।

ঘরটায় ঝকঝকে আলো। একেবারে আধুনিক ড্রইংরুমের ধাঁচে সাজানো। লম্বা-লম্বা সোফা। মাঝে বড় মাপের সেন্টার টেবিল। টেবিলে ফুলদানি। রঙিন সুগন্ধি ফুলে সাজানো। ছাতা ধরা গন্ধটা আর টের পাওয়া যাচ্ছে না।

সোফাগুলোয় ছ’জন মানুষ বসে রয়েছে। তাদের বয়েস নানারকম। তবে সবচেয়ে বেশি বয়েসি মানুষটির মাথায় ধবধবে সাদা চুল, গালে সাদা দাড়ি, চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। কেতাদুরস্ত পোশাকে ফিটফাট মানুষটি উচ্চতায় খাটো। তার ফরসা চামড়ায় অসংখ্য ভাঁজ।

ওদের দেখতে পাওয়ামাত্রই হাসি মুখে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। হাত সামনে বাড়িয়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে-আসতে বলল, ‘ওয়েলকাম টু দ্য অ্যামেজিং ওয়ার্ল্ড অফ স্পেস-টাইম অ্যান্ড সুপারন্যাচারাল…।’

থতমত খেয়ে ওরা চারজনই ভদ্রলোকের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল। কিন্তু অবাক চোখে হাঁ করে তাকিয়ে রইল তার দিকে।

ভদ্রলোক বলল, ‘আমার নাম ডক্টর শিলাদিত্য সেন। লেখাপড়ার ডাক্তার। বহু বছর ধরে এই সময়ের ফাঁদে আটক রয়েছি। কবে ছাড়া পাব জানি না।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ডক্টর সেন: ‘নেহাত ভাগ্যচক্রে তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। নইলে এই বাড়িটার যা কারবার! কখন যে থ্রি ডায়মেনশনে থাকে আর কখন যে ফোর ডায়মেনশনে চলে যায় তার ঠিক নেই। এসো, এসো—বোসো—।’

একটা খালি সোফা দেখিয়ে ওদের বসতে বলল শিলাদিত্য সেন। ওরা চুপচাপ বসে পড়ল।

ওদের মন থেকে ভয়টা ধীরে-ধীরে সরে যেতে লাগল। আর একইসঙ্গে পেটের খিদে টের পেল ওরা। এই অদ্ভুত বাড়িতে ওদের কত সময় কেটে গেছে কে জানে!

ডক্টর সেন হাসি মুখে কথা বলতে-বলতে নিজের জায়গায় গিয়ে বসল। হাতে তালি দিয়ে হাত ঝেড়ে বলল, ‘এবারে বলো দেখি, তোমাদের গল্পটা শুনি। এ-বাড়িতে তোমরা ঢুকলে কবে?’

শানু, অঙ্কিত, টুনটুন আর দিশা পালা করে ওদের কথা বলতে শুরু করল। কথা বলতে-বলতে ওরা একটু-একটু করে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল, ওদের স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পাচ্ছিল।

ওদের কাহিনিতে শেষের রেশ টেনে অঙ্কিত বলল, ‘…তারপর এ-ঘরে ঢুকে আপনাদের দেখা পেলাম।’

‘হ্যাঁ, দেখা পেলে।’ হেসে বলল শিলাদিত্য সেন, ‘তবে আমাদের নাও দেখা হতে পারত। অনেকেই আছে যারা অনেক বছর আগে এ-বাড়িতে ঢুকে পড়েছে— কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়নি।’ ঠোঁট উলটে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ডক্টর সেন বলল, ‘হয়তো আর কোনওদিন দেখা হবেও না।’

‘কেন? দেখা হবে না কেন?’ শানু জানতে চাইল।

‘দেখা হবে না, কারণ, এই বাড়িটা থ্রি ডায়মেনশন আর ফোর ডায়মেনশনের মাঝে যাতায়াত করে…ছুটোছুটি করে বেড়ায়…’

‘থ্রি ডায়মেনশনের মানে না হয় বুঝলাম…’ অঙ্কিত বলল, ‘কিন্তু ফোর ডায়মেনশন?’

‘হ্যাঁ-ফোর ডায়মেনশন।’ হাসল ডক্টর সেন: ‘ওই ফোর্থ ডায়মেনশনটাই যত গোলমেলে ব্যাপার। ফোর্থ ডায়মেনশনটা আসলে হল টাইম—সময়। থ্রি ডায়মেনশনাল ওয়ার্ল্ডে শুধু তিনটে ডায়মেনশন—মানে, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর উচ্চতা—দিয়ে বোঝা যায় একটা জিনিস আমাদের চোখের সামনে আছে কি নেই। কিন্তু ফোর ডায়মেনশনাল ওয়ার্ল্ডে একটা বাড়তি ফ্যাক্টর—মানে, বাড়তি ডায়মেনশন—এসে যায়: সময়। সেই কারণেই আমাদের থ্রি ডায়মেনশনাল ওয়ার্ল্ডের সব কনসেপ্ট সেখানে খাটে না। স্পেস-টাইমের কারসাজি আর কী! এর বেশি তোমাদের বোঝানো মুশকিল।

‘এই বাড়িটা সেই কারণেই অদ্ভুত। এর ঘরগুলো মাপে, সংখ্যায় আর চেহারায় বারবার পালটায়। এর সিঁড়িগুলো উলটেপালটে যায়। এর যে-কোনও ঘরের জানলা দিয়ে তাকালে বাইরে যে-দৃশ্য দেখা যায় তার সঙ্গে আমাদের কনসেপ্টের কোনও মিল নেই। পুরো ব্যাপারটাই একেবারে অন্যরকম।

‘যদি তোমরা এই ঘর থেকে বেরিয়ে একটু পরেই আবার ফিরে আসো তা হলে হয়তো দেখবে এই ঘরটাই আর খুঁজে পাচ্ছ না—পুরো ভ্যানিশ হয়ে গেছে। আমাদের সঙ্গে তোমাদের আর কখনও হয়তো দেখাই হল না। এটাই হল বাড়িটার ক্যারেকটার…।’ দু-হাত দুপাশে ছড়িয়ে থামল শিলাদিত্য সেন।

‘কিন্তু অন্য সব ব্যাপারগুলো?’ একসঙ্গে প্রশ্ন করে ফেলল দিশা আর টুনটুন। একে অপরের দিকে তাকাল একপলক। তারপর: ‘ওই যে সব ভূতুড়ে ব্যাপারগুলো! চাদরে ঢাকা মূর্তি। ঘরের দেওয়াল ফুলে ওঠা, চুপসে যাওয়া। ওই পুকুরের জলে সাঁতরে বেড়ানো সাপের মতো জিনিসগুলো। তা ছাড়া বাঁশির শব্দ…।’

হাসল ডক্টর সেন। সকলের মুখের ওপরে একপলক নজর বুলিয়ে বলল, ‘বলছি—সব বলছি। আমার যেটুকু জানা আছে সেটুকু অন্তত ঠিকঠাকভাবে বলার চেষ্টা করছি। দ্যাখো, প্রথমেই বলেছি, ”ওয়েলকাম টু দ্য অ্যামেজিং ওয়ার্ল্ড অফ স্পেস-টাইম অ্যান্ড সুপারন্যাচারাল…। এর মধ্যে স্পেস-টাইমটা যতটা সহজে পেরেছি এক্সপ্লেইন করেছি—বাকিটা সুপারন্যাচারাল—মানে, অলৌকিক—এলাকার ব্যাপারস্যাপার।’ গলার স্বর সিরিয়াস করে ডক্টর বলে চলল, ‘তোমরা কি জানো, এ-বাড়িতে ঢোকার পর কত লোক এখানে মারা গেছে? এই অদ্ভুত স্পেস-টাইমের মধ্যে সেইসব বন্দি প্রেতাত্মারা ঘুরে বেড়ায়। কখনও তাদের দেখা যায়—কখনও যায় না। এ ছাড়া সবশেষে রয়েছে এই প্রাগৈতিহাসিক বাড়িটা। তোমরা কি বললে বিশ্বাস করবে, এই বাড়িটা জীবন্ত! যে-যন্ত্রপাতির ঘর তোমরা দেখেছ ওটা আসলে বাড়িটার হার্ট-লাংস—আর এনার্জির সোর্স। বাড়িটার শ্বাস নেওয়ার শব্দ তোমরা সর্বক্ষণ শুনতে পাচ্ছ। যে-ঘরে অঙ্কিত দেওয়ালের গায়ে আটকে গিয়েছিল, ওটা এই বাড়িটার স্টমাক—পাকস্থলী।

‘আমি জানি, এগুলো অবিশ্বাস্য সব ব্যাপার—কিন্তু সত্যি। একটা জীবন্ত প্রাচীন বাড়ি, যেটা ভূতুড়ে, স্পেস-টাইমে থ্রি ডায়মেনশনাল ওয়ার্ল্ড আর ফোর ডায়মেনশনাল ওয়ার্ল্ডের মধ্যে হরবখত যাতায়াত করে! তোমরাই বলো, এরকম একটা বাড়ির সঙ্গে লড়াই করে পারা যায়!

‘আর ওই যে বাঁশির ব্যাপারটা। ওই বাঁশিগুলো সব হাড় দিয়ে তৈরি। কীভাবে ওগুলো বাজে, কে বাজায়—সেটা আমি আজও ঠিকঠাক উদ্ধার করতে পারিনি। তবে ওই বাঁশির আওয়াজে সম্মোহনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। সেই ঢেউ চুম্বকের মতো শিকারকে টেনে নিয়ে আসে এই বাড়িতে। তার শরীর থেকে কী এক কায়দায় সব হাড় বের করে নেওয়া হয়—বাড়িটাই বের করে নেয়—অথচ মানুষটা তখনও বেঁচে থাকে। জলে সাপের মতো সাঁতার কাটে, গাছপালার ডালে শরীরটাকে জড়িয়ে রাখে। আমার ধারণা, বাড়িটা নিজে বাঁশি বাজায়। তার সঙ্গে ওই সরীসৃপ-মানুষগুলোও কখনও-কখনও বাজায়। এইভাবে বেশ কিছুদিন বেঁচে থাকার পর একদিন…একদিন ওরা আমার মতো…’ সোফায় বসে থাকা নানান বয়েসি পাঁচজন মানুষের দিকে ইশারায় দেখাল ডক্টর সেন, ‘…বা আমাদের মতো হয়ে যায়।’ একটা লম্বা শ্বাস ফেলে ঘরের ছাদের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল। কিছুক্ষণ পর মুখ নামিয়ে টুনটুনদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমরাও এককালে সাঁতার কাটতাম, বাঁশি বাজাতাম। বাড়িটার বাঁশি তৈরির নেশা থেকেই যত সমস্যা।’

‘এতসব কথা আপনি জানলেন কী করে?’ দিশা ডক্টর সেনকে প্রশ্ন করল।

বিষণ্ণভাবে হাসল ডক্টর সেন। বলল, ‘আমি এখানে আছি বহুবছর। আমার স্টাডিরুম আছে এ-বাড়িতে। কিন্তু ওই ডায়মেনশনের গন্ডগোলের জন্য ঘরটা এখন দেখাতে পারছি না। আমি এই বাড়িটার ব্যাপারে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে স্টাডি করেছি, রিসার্চ করেছি—তারপর ধীরে-ধীরে সব জানতে পেরেছি। এককথায় বলতে গেলে এই বাড়িটা একটা জাদুকর। নানারকম ইলিউশান তৈরি করতে পারে ও।’

‘কী করে এই বাড়ি থেকে বেরোনো যায় আপনি জানেন না?’ দিশা জানতে চাইল।

‘না, জানি না। শুধু এটুকু বলতে পারি—চোখের সামনে যা দেখছ তা সবসময় সত্যি নয়—আসলে একটা ইলিউশান। এ-কথাটা মনে রেখো। এই যে আমরা ছ’জন তোমাদের সামনে রয়েছি—আমরা আসলে নেই—বহুদিন আগেই ”নেই” হয়ে গেছি। আমরা একসময় বাঁশি বাজাতাম…একসময়…।’

ডক্টর সেনের কথাগুলো ধীরে-ধীরে প্রতিধ্বনির মতো শোনাতে লাগল। একটা ঝোড়ো ঘূর্ণিপাক কোথা থেকে যেন আচমকা এসে ঘরে ঢুকে পড়ল। ওদের চোখের সামনে ডক্টর সেন আর তার পাঁচ সঙ্গী পাউডারের মতো গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে ঝরে গেল, মিলিয়ে গেল। আর একইসঙ্গে ঘরের আলোগুলো সব নিভে গেল।

টুনটুনরা দেখল, অন্ধকার ঘরে আবার সেই নীলচে গোধূলি-আলো। ঘরের শেষ প্রান্তের দেওয়ালে চারটে খোলা জানলা। জানলা দিয়ে রাতের আকাশ চোখে পড়ছে। তারায় ভরা ঝকঝকে গাঢ় নীল আকাশ।

কী ভেবে টুনটুন সবাইকে ডেকে নিয়ে ছুটে গেল সেই খোলা জানলাগুলোর কাছে। একটা জানলা দিয়ে মুখ বের করে তাকাল।

সেই একই দৃশ্য। ডাইনে, বাঁয়ে, ওপরে-নীচে শুধু আকাশ আর আকাশ। তারা আর তারা। ফোর ডায়মেনশন। ওলটপালট।

ডক্টর সেনের কথা মনে পড়ল ওর।

‘চোখের সামনে যা দেখছ তা সবসময় সত্যি নয়—আসলে একটা ইলিউশান।’

এই তারা ভরা আকাশ কি তা হলে ফোর ডায়মেনশনের মায়া? কী আছে এই আকাশের আড়ালে? বাঁচার পথ নেই তো?

টুনটুন ভেতরে-ভেতরে পাগল হয়ে যাচ্ছিল। কিছু একটা তো করতে হবে। হবেই। নইলে এই বাড়িতে প্রেতাত্মার সংখ্যা বাড়বে শুধু।

মা-বাপির কথা মনে পড়ল ওর। চোখে জল এসে গেল। কিন্তু সামনে তো আর কোনও পথ খোলা নেই। ভয় পেলে চলবে না।

ও চোখের জল মুছে নিল। শানুদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শানুদা, যদি একটু পরে নীচের দিক থেকে আমার ডাক শুনতে পাও তা হলে সঙ্গে সঙ্গে তোমরা সবাই জানলা দিয়ে লাফিয়ে পড়বে—।’

‘কী বলছিস তুই?’ শানু চেঁচিয়ে উঠল।

‘কী করছ? কী করছ? পাগলামো কোরো না—।’ অঙ্কিত।

‘টুনটুনদা! টুনটুনদা!’ দিশা।

কিন্তু তার আগেই টুনটুন খোলা জানলা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে শূন্যে।

নীচের তারা ভরা আকাশ ওর জন্য আঁচল পেতে রয়েছে। ঠিক এই কথাটাই মনে হল টুনটুনের। ও যেন খোলা প্যারাশুটের মতো ভাসতে-ভাসতে নীচে নামতে লাগল।

একটু পরেই ভেজা গাছপালা আর জল-কাদায় ওর শরীরটা আছড়ে পড়ল। কানে এল ব্যাঙের ডাক।

পৃথিবীটা এত সুন্দর আগে কখনও মনে হয়নি টুনটুনের। মনে হয়নি ব্যাঙের ডাক এ-ত মিষ্টি।

ও পাশ ফিরে তাকাল চারপাশে। বেশ খানিকটা দূরে তিনটে সার্চলাইট জ্বেলে অনেক মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

টুনটুনের গায়ে আলো এসে পড়েছিল। ওকে দেখতে পেয়েই লোকজন হইহই করে লাফিয়ে উঠল।

টুনটুন শরীরের সব শক্তি জড়ো করে চেঁচিয়ে উঠল, ‘দিশা। অঙ্কিতদা! শানুদা!’

তারপরই ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *