1 of 2

নার্গিস আসর খানম ওরফে সৈয়দা খাতুন-কে

নার্গিস আসর খানম ওরফে সৈয়দা খাতুন-কে

106 Upper Chitpur Road

‘Gramophone Rehearsal Room’

Calcutta.

1-7-37

কল্যাণীয়াসু!

তোমার পত্র পেয়েছি — সেদিন নববর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে। মেঘ-মেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝরছিল। পনের বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি বারিধারার প্লাবন নেমেছিল — তা তুমি হয়তো স্মরণ করতে পারো। আষাঢ়ের নব মেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার। এই মেঘদূত বিরহী যক্ষের বাণী বহন করে নিয়ে গিয়েছিল কালিদাসের যুগে, রেবা নদীর তীরে, মালবিকার দেশে, তাঁর প্রিয়ার কাছে। এই মেঘপুঞ্জের আশীর্বাণী আমার জীবনে এনে দেয় চরম বেদনার সঞ্চয়। এই আষাঢ় আমার কল্পনার স্বর্গলোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্ত স্রোতে। যাক, তোমার অনুযোগের অভিযোগের উত্তর দিই।

তুমি বিশ্বাস করো, অমি যা লিখছি তা সত্য। লোকের মুখে শোনা কথা দিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা করে থাকো, তা হলে আমায় ভুল বুঝবে — আর তা মিথ্যা।

তোমার ওপর আমি কোনো ‘জিঘাংসা ’ পোষণ করি না — এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কী গভীর ক্ষত, কী অসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি — তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না — আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। তোমার যে কল্যান-রূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথমে দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালোবাসার অঞ্জলি দিয়েছিলাম সে-রূপ আজও স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মতো চির-অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে। অন্তরের আগুন বাইরের সে ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি।

তুমি ভুলে যেও না, আমি কবি — আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। অসুন্দর, কুৎসিৎ সাধনা আমার নয়। আমার আঘাত বর্বরের কাপুরুষের আঘাতের মতো নিষ্ঠুর নয়। আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কি জান বা শুনেছ, জানি না) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোনো অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবীও নেই।

আমি কখনো কোনো দূত প্রেরণ করিনি তোমার কাছে। আমাদের মাঝে যে অসীম ব্যবধানের সৃষ্টি হয়েছে, তার ‘সেতু’ কোন লোক তো নয়ই — স্বয়ং বিধাতাও হতে পারেন কিনা সন্দহ। আমায় বিশ্বাস করো, আমি সেই ‘ক্ষুদ্র’দের কথা বিশ্বাস করিনি। করলেও পত্রোত্তর দিতাম না। তোমার ওপর আমার কোনো অশ্রদ্ধাও নেই, কোন অধিকারও নেই, — আবার বলছি। আমি যদিও গ্রামোফোনের ট্রেড মার্ক ‘কুকুরে’র সেবা করছি, তবুও কোন কুকুর লেলিয়ে দিই নাই। তোমাদেরই ঢাকার কুকুর একবার আমায় কামড়েছিল আমার অসাবধনতায়, কিন্তু শক্তি থাকতেও আমি তার প্রতিশোধ গ্রহণ করিনি — তাদের প্রতি-আঘাত করিনি।

সেই কুকুদের ভয়ে ঢাকায় যেতে আমার অভাবের উল্লেখ করেছ, এতে হাসি পেল। তুমি জান, ছেলেরা (যুবকেরা) আমায় কত ভালোবাসে। আমারই অনুরোধে আমার ভক্তরা তাদের ক্ষমা করেছিল। নইলে তাদের চিহ্নও থাকত না এ পৃথিবীতে। তুমি আমায় জানবার যথেষ্ট সুযোগ পাওনি, তাই এ কথা লিখেছ.. যাক তুমি রূপবতী, বিত্তশালিনী, গুণবতী, কাজেই তোমার উমেদার অনেক জুটবে — তুমি যদি স্বেচ্চায় স্বয়ংবরা হও, আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই। আমি কোন অধিকারে বারণ করব — বা আদেশ দেব? নিষ্ঠুরা সমস্ত অধিকার থেকে আমায় মুক্তি দিয়েছেন।

তোমার আজকার রূপ কি, জানি না। আমি জানি তোমার সেই কিশোরী মূর্তিকে, যাকে দেবীমূর্তির মতো আমার হৃদয়-বেদীতে অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ করলে না। পাষাণদেবীর মতই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদী-পীঠ। ….জীবন ভরে সেইখানেই চলেছ আমার পূজা-আরতি। আজকার তুমি আমার খাছে মিথ্যা, ব্যর্থ, তাই তাকে পেতে চাইনে। জানিনে হয়ত সে রূপ দেখে বঞ্চিত হব, অধিকতর বেদনা পাব, — তাই তাকে অস্বীকার করেই চলেছি।

দেখা? না-ই হল এ ধূলির ধরায়! প্রেমের ফুল এ ধূলিতলে হয়ে যায়া ম্লান, দগ্ধ হতশ্রী। তুমি যদি সত্যই আমায় ভালবাস, আমাকে চাও, ওখানে থেকেই আমাকে পাবে। লায়লী মজনুকে পায়নি, তবু তাদের মত করে কেয় কারো প্রিয়তমকে পায়নি। আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরাতন কথা হলেও পরম সত্য। আত্মা অবিনেশ্বর, আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারে না। প্রেমের সোনার কাঠির স্পর্শ যদি পেয়ে থাক তা হলে তোমার মতো ভাগ্যবতী কে আছে? তারি মায়াস্পর্শে তোমার সকল কিছু আলোয় আলোময় হয়ে উঠবে। দুঃখ নিযে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে গেলেই সেই দুঃখের অবসান হয় না। মানুষ ইচ্ছে করলে সাধনা দিয়ে তপস্যা দিয়ে ভুলকে ফুল-রূপে ফুটিয়ে তুলতে পারে। যদি কোন ভুল করে থাক জীবনে এই জীবনেই তার সংশধোন করে যেতে হবে ; তবেই পাবে আনন্দ, মুক্তি ; তবেই হবে সর্ব দুঃখের অবসান। নিজেকে উন্নত করতে চেষ্টা কর। স্বয়ং বিধাতা তোমার সহায় হবেন। আমি সংসার করছি, তবু চলে গেছি এই সংসারের বাধাকে আতিক্রম করে ঊর্ধ্বলোকে — সেখানে গেলে পৃথিবীর সকল অসম্পূর্ণতা সকল অপরাধ ক্ষমাসুন্দর চোখে পরম মনোহর মূর্তিতে দেখা দেয়।

হঠাৎ মনে পড়ে গেল পনের বছর আগেকার কথা। তোমার জ্বর হয়েছিল, বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র সুন্দর ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল; তোমার সেই তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজও অনুভব করতে পারি। তুমি কি দেখেছিলে? আমার চোখে ছিল জল, হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা, অন্তরে শ্রীবিধাতার চরণে তোমার আরোগ্য লাভের জন্য করুণ মিনতি। মনে হয় যেন কালকার কথা। মহাকাল সে স্মৃতি মুছে ফেলতে পারলে না। কী উদগ্র অতৃপ্তি, কী দুর্দমনীয় প্রেমের জোয়ারই সেদিন এসেছি! সারা দিনরাত আমার চোখে ঘুম ছিল না।

যাক — আজ চলেছি জীবনের অস্তমান দিনের শেষ রশ্মি ধরে ভাটার স্রোতে। তোমার ক্ষমতা নেই সে পথ থেকে ফেরানোর। আর তার চেষ্টা করো না। তোমাকে লেখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক। যেখানেই থাকি বিশ্বাস করো, আমার অক্ষয় আশীর্বাদ কবচ তোমায় ঘিরে থাকবে। তুমি সুখী হও, শান্তি পাও — এই প্রার্থনা। আমায় মন্দ বলে বিশ্বাস কর, আমি তত মন্দ নই — এই আমার শেষ কৈফিয়ৎ। ইতি —

নিত্য শুভার্থী —

নজরুল ইসলাম

P.S

আমার ‘চক্রবাক’ নামক কবিতা-পুস্তকের কবিতাগুলো পড়েছ? তোমার বহু অভিযোগের উত্তর পাবে তাতে। তোমার কোনো পুস্তকে আমার সম্বদ্ধে কটূক্তি ছিল।

ইতি —

‘Gentleman’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *