১.
নারী দিবসের সকালে কিছু ফোন পেলাম। সকলে বললো, ‘হ্যাপি উইমেন’স ডে’। ঠিক যেমন করে তারা বলে ‘হ্যাপি ভ্যালেনটাইন’স ডে’ অথবা ‘হ্যাপি মাদারস ডে’। ভ্যালেনটাইন’স ডে বা মাদারস ডে-তে হ্যাপিনেসের বা সুখের ব্যাপার থাকে। প্রেমিক-প্রেমিকা বা মায়েদের আনন্দ উৎসব করার জন্য মূলত ওই দুটো দিন। কিন্তু নারী দিবসের তো একই উদ্দেশ্য নয়। নারী দিবস শুরুই হয়েছিল নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্যগুলো দূর করার আন্দোলনের জন্য। এখনও একই কারণে নারী দিবস পালন করা হয়। এই দিবস নারীর আনন্দ উৎসবের দিবস নয়। এই দিবসের উপস্থিতি প্রমাণ করে নারী আজও অত্যাচারিত, অসম্মানিত, নারী আজও বঞ্চিত, লাঞ্ছিত। সে কারণেই এই দিবসে আজও নারীরা প্রাপ্য অধিকারের জন্য দাবি জানায়।
‘নারী দিবস’ জিনিসটি আমাকে কখনও আনন্দ দেয় না। আনন্দ দেয় না কারণ দিনটি আমার কাছে অত্যন্ত দুঃখের দিন। দুঃখের দিন কারণ মৌলিক অধিকার পাওয়ার জন্য আজও আমাদের কাঁদতে হচ্ছে, চিৎকার করতে হচ্ছে, সভা-সেমিনার করতে হচ্ছে, রাস্তায় নামতে হচ্ছে, মিছিলে যেতে হচ্ছে।
সেই কতকাল আগে, সম্ভবত ১০৫ বছর আগে, নির্যাতিত, নিপীড়িত, অত্যাচারিত ও অসম্মানিত না হওয়ার অধিকার চেয়েছিল নারী। সেই থেকে আজও বছর বছর এই দিনটিতে একই অধিকার চাওয়া হয়, চাওয়া হয় কারণ আজও নারীরা নারী হয়ে জন্ম নেওয়ার অপরাধে নির্যাতিত, নিপীড়িত অত্যাচারিত, অসম্মানিত। আজও আমরা নারীরা বঞ্চিত, লাঞ্ছিত। যেদিন সমানাধিকার পেয়ে যাবো, সেদিন থেকে এই দিবসটির অস্তিত্ব আর থাকবে না। সর্বান্তকরণে দিবসটির বিলুপ্তি চাই আমি।
২.
আমি তো সবসময় বলি, বছরের ৩৬৪ দিন পুরুষ দিবস, ১ দিন নারী দিবস। নারী আর পুরুষের মধ্যে যে হাজারো বৈষম্য, সেগুলো হটিয়ে দিলেই নারী দিবস করার প্রয়োজন পড়বে না। নারীবিদ্বেষী কিছু পুরুষ যে ‘পুরুষ দিবস’ পালন করার আয়োজন করছে, সেটিও রোধ করতে হবে। নারী পুরুষ উভয়ে যেন ঘটা করে ‘মানব দিবস’ উত্যাপন করতে পারি।
৩.
নারী দিবসে কি ধর্ষণ ঘটেনি? নারীর ওপর অত্যাচার বন্ধ ছিল একদিনের জন্যও? মেয়েশিশু পাচার হয়নি, শিশু কিশোরীদের যৌনদাসী বানাবার জন্য পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়নি? নারী দিবসে নারী-হত্যা বন্ধ ছিল? নারীকে কি পুড়িয়ে মারা হয়নি নারী দিবসে? সত্যি কথাটা খুলেই বলি, বিশ্বজুড়ে নারী-নির্যাতন চলেছে নারী দিবসে।
১টি দিনের জন্যও নারীকে রেহাই দেওয়া হয় না। জানি না বছরের ৩৬৫ দিন কী করে রেহাই পাবে নারী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আমাদের, এ সমাজে পুরুষের গায়ে ফুলের টোকা পড়ে না তা নয়। পুরুষও এই সমাজে অত্যাচারিত, তবে পুরুষরা পুরুষ হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে অত্যাচারিত নয়। যেসব কারণে পুরুষ ভোগে, সেসব কারণে নারীও ভোগে। দারিদ্র্য নারী পুরুষ উভয়কেই ভোগায়। কিন্তু নারী হওয়ার কারণে নারীকে বাড়তি ভুগতে হয়। পুরুষ হওয়ার কারণে পুরুষকে ভুগতে হয় না। বরং যেসব আরাম আয়েশ, আর বাড়তি সুবিধে পুরুষ পায়, সে পুরুষ হওয়ার কারণেই পায়।
৪.
আমার নারী দিবসটা কেটেছে অন্য সাধারণ দিনের মতোই। এই দিন আমি কোনও আনন্দ উৎসবে যোগ দিই নি। কোনও বক্তৃতা বিতর্কও করি নি। মনে অর্ধেক দিন কষ্ট দিচ্ছিল বড় একটি পত্রিকায় ছাপা হওয়া খবর। খবরের শিরোনাম : ‘মহিলাদের গোপনাঙ্গের দুর্গন্ধের ৮টি কারণ’। নারী দিবসে নারীদের জন্য পুরুষের প্রতিষ্ঠান থেকে চমৎকার এক উপহার বটে!
নারীকেই চিহ্নিত করা হয় ডাইনি বলে, অপয়া বলে, অমঙ্গল বলে, নরকের দ্বার বলে, নোংরা আর দুর্গন্ধের আধার বলে। যেন নারীরা লজ্জায় সংকুচিত হয়, ভয়ে সিটিয়ে থাকে, যেন আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, যেন নিজেকে ঘৃণা করতে শেখে।
এ তো গেল অর্ধেক দিনের কথা। আমার মন খারাপের কথা। বাকি অর্ধেক দিন নিজেকে লজ্জা আর ভয় থেকে মুক্ত করেছি, আত্মবিশ্বাস যতটুকু হারিয়েছিল, ততটুকু ফেরত এনেছি, নিজেকে ঘৃণা করার বদলে নিজেকে ভালোবেসেছি। বাকি অর্ধেক দিন আমি ভালো ছিলাম। যে মেয়েরা নিজেকে ঘৃণা করছে, যেহেতু সমাজ শিখিয়েছে মেয়েদের ঘৃণা করতে, তাদের বলছি ঘৃণা বন্ধ করতে। ঘৃণা করলে সামনে যেতে নিজেরাই নিজেদের বাধা দেয়। ঘৃণা করলে পিছু হঠতে থাকে মানুষ। ষড়যন্ত্র করে মেয়েদের পেছনে রাখা হয়েছে, তারপরও মেয়েদের আরও পেছনে যাওয়ার ঝোঁক। অনেক আগেই দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে তাদের। দেয়ালে পিঠ ঠেকলে মানুষ সামনে যায়। সামনে যা কিছু থাক, ভেঙেচুরে আরও সামনে যায়। নিরাপদ দূরত্বে যায়। মেয়েরা কবে মানুষ হবে?
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১০ মার্চ, ২০১৬