নারী ও শ্রীরামকৃষ্ণ
একালে একটি কথা উঠিয়াছে—শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দ নারীবিদ্বেষী ছিলেন। একালের শিক্ষিতা, বিশেষ এক রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী কিছু মহিলা, যাঁহারা নিজদিগকে ‘নারীবাদী’ অভিধায় ভূষিত করিয়াছেন তাঁহারাই ঐরূপ বলিতেছেন। এই বিদুষীগণ ধর্মবিশ্বাসী নন। ঈশ্বরকে তাঁহারা দুর্বলের অবলম্বন বলিয়া মনে করেন। ঈশ্বর বলিয়া কেহ নাই। ঈশ্বরবিশ্বাস—ইঁহাদের মতে—বিতর্কিত মধ্যযুগীয় অন্ধবিশ্বাস। ঈশ্বরবিশ্বাস, ইঁহারা মনে করেন, গুরুশ্রেণীর একদল অলস মানুষের শোষণের শালগ্রাম শিলা। ইঁহারা বলেন— ঈশ্বর, ধর্ম ইত্যাদি লইয়া মাথা ঘামাইবার প্রয়োজন নাই। উৎপাদন কর, মজুরি বুঝিয়া লও, জীবনসংগ্রামে লিপ্ত হও, আহার-বিহার করিয়া মরিয়া যাও। জন্মের পূর্বেও কিছু ছিল না। মৃত্যুর পরেও কিছু নাই। ব্যবহারিক পৃথিবীতে ব্যবহারিক জ্ঞানই জ্ঞান। তুমি আমাকে ব্যবহার কর, আমি তোমাকে ব্যবহার করি, রাষ্ট্র আমাদিগকে ব্যবহার করুক। প্রত্যক্ষ সম্পদই সম্পদ; অপ্রত্যক্ষ যাহা তাহার জন্য অকারণ সাধনায় সময়ের অপচয় রাষ্ট্রীয় ক্ষতি ভিন্ন আর কিছু নহে। তুমি আসিয়াছ রাষ্ট্রের জন্য, তুমি মরিবেও রাষ্ট্রের জন্য।
ইহাও একটি মতবাদ। আস্তিকের গোঁড়ামির মতো নাস্তিকের গোঁড়ামি। কলম্বাস-পূর্ব পৃথিবীতে ইউরোপের মানুষের জ্ঞানে আমেরিকা নামে কোন মহাদেশের অস্তিত্ব ছিল না। দূরবীন যখন আবিষ্কৃত হয় নাই তখন আমাদের মহাবিশ্বের পরিধি সঙ্কীর্ণ ছিল। আদি জ্যোতির্বিদ্রা মনে করিতেন, পৃথিবী একটি থালার মতো। এত কথা বলিবার উদ্দেশ্য, হাজার হাজার বৎসর পূর্বে যাহা অবাস্তব, অলীক ছিল আজ তাহাই বাস্তব। আজ যাহা অবাস্তব হাজার বৎসর পরে তাহাই বাস্তব হইবে।
অতএব ঈশ্বরের অস্তিত্ব যাঁহারা অবিশ্বাস করেন, যাঁহারা জীবনের পাশব ব্যাখ্যায় সুখী থাকিতে চাহিতেছেন তাঁহাদের সহিত আমাদের কোন দ্বন্দ্ব নাই। ‘আমরা’ বলিতে আমি বিশ্বাসীদের কথাই বলিতেছি, অবিশ্বাসীরা যাঁহাদের দুর্বল বলিতেছেন। দুর্বল বলিতে তাঁহারা অবশ্যই দেহবলের ইঙ্গিত করিতেছেন না। তাঁহাদের ব্যাখ্যায় কাম-কাঞ্চনবিমুখ ব্যক্তিরাই দুর্বল। আর
“জঁহা রাম তহাঁ কাম নহী,
জঁহা কাম তহাঁ নহীঁ রাম।
ছুঁহু মিলত নহী
রব রজনী নহী মিলত একঠাম।।”
গীতায় শ্রীভগবান বলিলেন—
“যা নিশা সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্তি সংযমী।
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশ্যতো মুনেঃ।।”
—সর্বজীবের কাছে যা রাত্রিস্বরূপ অর্থাৎ অজ্ঞাত, সেই ব্রহ্মে স্থিতপ্রজ্ঞ জাগ্রত থাকেন অর্থাৎ সর্বদা ব্রহ্মদর্শন করেন। আর যে অজ্ঞানরূপ রাত্রিতে ভূতগণ জাগ্রত থাকে, অর্থাৎ সংসার দর্শন করে স্থিতপ্রজ্ঞের পক্ষে তা রাত্রিস্বরূপ অর্থাৎ তিনি সংসার অনুভব করেন না।
ইহার ব্যাখ্যায় উদাহরণস্বরূপ বলা যাইতে পারে, যেমন পেচক প্রভৃতি প্রাণীর পক্ষে দিনই রাত্রি এবং রাত্রিই দিন হয় এবং অন্যান্য প্রাণী, যথা মানুষ দিনকে দিন, রাত্রিকে রাত্রি দেখে, সেইরূপ বিবেকিগণ পরমার্থ বিষয়ে জাগ্রত এবং জাগতিক বিষয়ে নিদ্রিত; আর মূঢ়গণ পরমার্থ বিষয়ে উদাসীন ও ঐহিক বিষয়ে সদা তৎপর।
যে উঁহারা বলিলেন, আগেও কিছু নাই পরেও কিছু নাই, ইহা হইতে দুইটি জীবনধারা জন্ম লইল। যে-ধারাটি স্ফীত তাহা ভোগবাদ। ইন্দ্ৰিয়বাদ। ভোগ করিয়া, ক্ষতবিক্ষত হইয়া, ক্লান্ত হইয়া, ইন্দ্রিয়সকল শিথিল হইয়া, অনুগামী জীবনের পদাঘাতে মরিয়া যাও। ইহাই নিয়ম, ইহাই তোমার পরিণতি, অনিবার্য নিয়তি। ইহা হইতে শিক্ষাগ্রহণ করিবার কিছু নাই। পরিণতির কথা ভাবিয়া ভোগের বর্তমানটিকে পরিত্যাগ করিও না। দার্শনিক হইও না। দর্শন ব্যতীত জীবন তো চলিতে পারে না, যেমন দন্ত ব্যতীত খাদ্যবস্তু চিবানো যায় না। দৈত্যেরও গুরু থাকেন। অতএব দর্শনের নূতন ধরন লইয়া যুগাকাশে আসিলেন সোরেন কির্কেগাড়। তিনি বলিলেন, মানবের অস্তিত্বই জীবনের মুখ্য দর্শন। তুমি আছ, তোমাকে থাকিতে হইবে। তুমি এবং তুমিই। সমাজ-সংসার তোমাকে গ্রাস করিতে চাহিবে, তোমাকে বৃহতের একটি অংশ করিতে চাহিবে। আইন, সংস্কার, শৃঙ্খলা দ্বারা বাঁধিয়া তোমার স্বাধীনতা, স্বকীয়তা হরণ করিতে চাহিবে, তোমার অস্তিত্বরক্ষার প্রয়াসই হইবে তোমার ধর্ম। জীবন মানে ভয়—মৃত্যুভয়, অস্তিত্ব মুছিয়া যাইবার ভীতি। ব্যক্তিমানবকে যাহা লইয়া বাঁচিতে হয় তাহা হইল একরাশ নেতিবাচক চিন্তা, দুশ্চিন্তা। কেমন করিয়া আমি বাঁচিব! ‘From the cradle to the grave’ আমাকে হাঁটিয়া যাইতে হইবে। এই পথটুকু তাহাকে যাবতীয় ভয় লইয়াই পাড়ি দিতে হইবে। এইটিই তাহার জীবনদর্শন।
শ্রীভগবান অন্তরে মৃত্যুভয়ে ভীত অর্জুনকে বলিলেন : “অজো নিত্য শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।”
অর্থাৎ আত্মা জন্ম ও মৃত্যুরহিত, অপক্ষয়হীন এবং বৃদ্ধিশূন্য, শরীর নষ্ট হইলেও আত্মা বিনষ্ট হন না—এই শাশ্বত সত্যে অস্তিত্ববাদীরা বিশ্বাসী নহেন। ইতিবাচক অথবা ‘পজিটিভ ফিলিংস’ কাহারো কাহারো ব্যক্তিগত বিশ্বাস হইতে পারে, জগতের জাগতিক বিশ্বাস ‘নেগেটিভ ফিলিংস’। চতুর্দিকে আমাকে মুছিয়া ফেলিবার আয়োজন, তাহার মধ্যে আমাকে আমার অস্তিত্ব বজায় রাখিতে হইবে। কির্কেগাড়ের বিখ্যাত উক্তি—’Existence precedes essence.’ সর্বাগ্রে অস্তিত্ব, তাহার পরে স্বরূপের বোধ। ‘আমি’ আছে, ‘আমাকে’ থাকিতে হইবে। কোথায় আছি, কেন আছি, কি কারণে আছি, অস্তিত্বের চরিত্র নির্ধারণের প্রয়োজন নাই। “কোথা হতে আসি কোথা ভেসে যাই”—ইহা চিন্তার সৌখিনতা ভিন্ন কিছু নয়।
মৃত্যু সর্বকালে, সর্বদেশে নানাভাবে আলোচিত হইয়াছে। মৃত্যুই দার্শনিকতার উৎস। শ্রীভগবান যুদ্ধকাতর পার্থকে বলিতেছেন : “জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।” দেহধারী জীব মরিবে, মরিতে বাধ্য; কারণ প্রবাহিত সময়—’Passage of time’। “দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা।” পাশ্চাত্যের অস্তিত্ববাদীরাও মৃত্যুসচেতন। দুই চিন্তার পার্থক্য কোথায়? শ্রীভগবান এই চিন্তার সহিত একটি বিশ্বাস জুড়িয়াছেন—দেহান্তর প্রাপ্তি। একবার নহে বারে বারেই বলিতেছেন। পুনর্জন্মের কথা বলিয়া তিনি বলিতেছেন—
“অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত।
অব্যক্তনিধনান্যেব তত্র কা পরিদেবনা।।”
পূর্বেও তুমি ছিলে না, পরেও তুমি থাকিবে না, তোমার জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যভাগে জীবনের যে সবুজ উপত্যকাটি, সেটিকে তোমার নিষ্কাম কর্মে ভরিয়া তোল। কোন্ মন লইয়া তুমি বিচরণ করিবে? “সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ।” তুমি নিষ্কাম হও এবং ঈশ্বরার্থ কর্ম কর। “নিস্ত্রৈগুণ্যো ভবার্জুন।” “নির্দ্বন্দ্বো নিত্যসত্ত্বস্থো নির্যোগক্ষেম আত্মবান্।।” তুমি সুখ-দুঃখাদি দ্বন্দ্বরহিত ও সদা সত্ত্বগুণাশ্রিত হও এবং যোগ ও ক্ষেমের আকাঙ্ক্ষারহিত এবং অপ্রমত্ত হও।
ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে একই কথা বলিতেছেন – মৃত্যুকে সর্বদা স্মরণ রাখিয়া কর্ম করিবার উপদেশ—”মৃত্যুকে সর্বদা মনে রাখা উচিত। মরবার পর কিছুই থাকবে না। এখানে কতকগুলি কর্ম করতে আসা। যেমন পাড়াগাঁয়ে বাড়ি—কলকাতায় কর্ম করতে আসা। বড় মানুষের বাগানের সরকার বাগান যদি কেউ দেখতে আসে, তা বলে এ-বাগানটি আমাদের, এ- পুকুর আমাদের পুকুর। কিন্তু কোন দোষ দেখে বাবু যদি ছাড়িয়ে দেয় তার আমের (আমকাঠের) সিন্দুকটা লয়ে যাবার যোগ্যতা থাকে না। দারোয়ানকে দিয়ে সিন্দুকটা পাঠিয়ে দেয়।”
প্রাচ্যের আধ্যাত্মিকতায় মৃত্যু এক অন্য পথের দিশারী। শুদ্ধিকরণের প্রয়াসী। প্রথমে ভাবিতে হইবে–আমি থাকিব না; অতএব কেন আমি আগ্রাসী, আত্মপর, ইন্দ্রিয়সেবী, প্রমত্ত, উন্মত্ত মানুষ হইব! “না ঘর মেরা, না ঘর তেরা, দুনিয়া সবসে বসেরা।“ আমার পাশব প্রবৃত্তিসমূহকে সংযত করিয়া, অভিনিবেশ সহকারে বুঝিবার চেষ্টা করিব—’আমি কে?’
কেন আমি আসিয়াছি? মানব বোধসম্পন্ন প্রাণী। আহার, নিদ্রা, মৈথুন, গোষ্ঠীবর্ধন ও সংরক্ষণ, অধিকারের জন্য সংগ্রাম পশুও করিয়া থাকে, তাহা হইলে মানুষের গর্বটা রহিল কোথায়! মানব তাহার সত্তার অন্বেষণ করিতে করিতে খণ্ড হইতে অখণ্ডে যাইবার চেষ্টা করিবে। বিষয়ানন্দ হইতে পরমানন্দে উপনীত হইয়া ইন্দ্রিয়াদির চক্রান্তকে ব্যর্থ করিবে। মায়াকে জয় করিবে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন : “পাশবদ্ধ জীব, পাশমুক্ত শিব।” পাশমুক্ত হইয়া হীরা-জহরত নয়, আনন্দলাভ করিতে হইবে।
শ্রীভগবানের কথা—”বশে হি যস্যেন্দ্রিয়াণি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।” শ্রীরামকৃষ্ণ বলিলেন : “মন নিয়ে কথা। মনেতেই বদ্ধ, মনেতেই মুক্ত। মন যে-রঙে ছোপাবে সেই রঙে ছুপবে।” শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের ভিতর সাত্ত্বিক পুরুষকার জাগ্রত করিতেছেন এই বলিয়া–”মনেতেই বদ্ধ, মনেতেই মুক্ত।” মনে মনে দৃঢ়ভাবে বলিতে থাক : “আমি মুক্ত পুরুষ; সংসারেই থাকি বা অরণ্যেই থাকি, আমার বন্ধন কি? আমি ঈশ্বরের সন্তান, রাজাধিরাজের ছেলে; আমায় আবার বাঁধবে কে? যদি সাপে কামড়ায়, বিষ নাই—জোর করে বললে বিষ ছেড়ে যায়! তেমনি—আমি বদ্ধ নই, আমি মুক্ত—এই কথাটি রোখ করে বলতে বলতে তাই হয়ে যায়। মুক্তই হয়ে যায়।” “এষা ব্রাহ্মী স্থিতিঃ পার্থ নৈনাং প্রাপ্য বিমুহ্যতি।” হে পৃথাপুত্র, এই অবস্থাই ব্রাহ্মীস্থিতি। এই অবস্থা লাভ করিলে কেহ মোহগ্রস্ত হন না। শ্রীরামকৃষ্ণ আবার বলিতেছেন : “যে- ব্যক্তি ‘আমি বদ্ধ, আমি বদ্ধ’ বলে, সে শালা বদ্ধই হয়ে যায়।”
শ্রীরামকৃষ্ণ আদৌ নারীবিদ্বেষী ছিলেন না, নারীহিতৈষী ছিলেন। তাঁহার সর্বাধিক প্রিয় শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দও তাঁহার গুরুর মতোই নারীজাগরণের জন্য আন্দোলন করিয়া গিয়াছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ নারীদের স্বার্থেই পুরুষের ঘর সামলাইবার জন্য তাহাদের মান-হুঁশ করিতে চাহিয়াছিলেন। যে-সমাজে নারীকে বধূ হইয়া, মাতা হইয়া, কর্মী হইয়া, সাধিকা হইয়া বিচরণ করিতে হইবে, সেই সমাজে যদি ভোগী, ইন্দ্রিয়পরায়ণ, কাম-কাঞ্চনকীট পুরুষ ঘুরিয়া বেড়ায় তাহা হইলে মানবসভ্যতা কিসের গৌরবে গৌরবান্বিত বোধ করিবে! সেই সমাজে নারী চিরকালই ভোগ্যপণ্যের ন্যায় ব্যবহৃত হইতেই থাকিবে, হইতেই থাকিবে। পশ্চিমের ভোগবাদী উন্মাদ সভ্যতা, অস্তিত্ববাদী জীবনদর্শন হিন্দুধর্মের প্রাচীরে আঘাত হানিয়া তাহার শান্ত জীবনছন্দকে ব্যাহত করিতে চাহিবে। আবার দুয়ার খুলিয়া বিশ্বের সহিত যোগস্থাপন না করিলে কূপমণ্ডুক হইবার সম্ভাবনা। প্রাচীর ভাঙিতেই হইবে। বিরোধী চিন্তার সংস্পর্শে আসিতেই হইবে। শত প্রলোভনের কিরণে বাহির হইতেই হইবে; কিন্তু ভাসিয়া না যাইবার মন্ত্রটি আয়ত্ত করিতে হইবে। মিশিব, কিন্তু গুলিয়া যাইব না! ধ্বংস হইব না। ইহাই তো সমর, ইহারই নাম কুরুক্ষেত্র। শ্রীভগবানের নির্দেশ :
“তানি সর্বাণি সংযম্য যুক্ত আসীত মৎপরঃ।
বশে হি যস্যেন্দ্রিয়াণি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।”
ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করিতে হইবে। আত্মস্থ, সমাহিত হইতে হইবে। ইন্দ্রিয় যাঁহার বশীভূত তিনিই ঋতন্তরা, বিবেকজা, প্রতিষ্ঠিত প্রজ্ঞা অর্থাৎ তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ।
নরেন্দ্রনাথ বলিয়াছিলেন : “যতক্ষণ আমার কাম, ততক্ষণই স্ত্রীলোক; তা নাহলে স্ত্রী-পুরুষ ভেদ বোধ থাকে না।” সুতরাং কামজয়ী হওয়ার প্রয়োজন; কিন্তু কামকে তো জয় করা যায় না। তাহা হইলে কি হইবে? শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন উত্তম বৈদ্য। কামজয়ী হও, বৈরাগ্য অবলম্বন কর, সংসার ত্যাগ করিয়া শ্মশানে ত্রিশূল-হস্তে চলিয়া যাও। নারীর মুখদর্শন করিও না। সংসার ভাঙিয়া দাও। নারী একদিকে, পুরুষ একদিকে হইয়া যাও। মধ্যে প্রাচীর তুলিয়া দাও আর যতপ্রকার ব্যভিচার ও ধর্মের নামে কদাচারের শিকার হইয়া মনুষ্যসমাজকে কলুষিত কর। না, তিনি ইহা বলিলেন না। চিকের দিকে তাকাইয়া পুরুষদিগকে বলিলেন, ব্রহ্মানন্দে মাতিয়া থাকিলে চিকের ওধারে যাহারা বসিয়া আছেন তাহাদের কি হইবে! সচ্চিদানন্দ সাগরে একেবারে নিমজ্জিত হইও না। একবার করিয়া ডোব, একবার করিয়া ওঠ। ঈশ্বরকোটি পুরুষ ব্যতীত সর্বদাই সমাহিত অবস্থায় থাকা সম্ভব নহে। মহামায়ার এমনি মায়া! তাহা হইলে? শ্রীরামকৃষ্ণ-মননে আধুনিক পরিবারের জন্ম হইল, যে-কারণে তাঁহাকে ‘গৃহীর ভগবান’ বলা হইয়া থাকে।
ব্রাহ্মভক্ত প্রশ্ন করিলেন : “স্ত্রীজাতি খারাপ, না আমরা খারাপ?”
নারী সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণের ব্যাখ্যা অসাধারণ, অনন্য।
তিনি বলিতেছেন : “তিনি মহামায়া। জগৎকে মুগ্ধ করে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন। তিনি অজ্ঞান করে রেখে দিয়েছেন। সেই মহামায়া দ্বার ছেড়ে দিলে তবে অন্দরে যাওয়া যায়। বাহিরে পড়ে থাকলে বাহিরের জিনিস কেবল দেখা যায়—সেই নিত্য সচ্চিদানন্দ পুরুষকে জানতে পারা যায় না। তাই পুরাণে কথা আছে—চণ্ডীতে। মধুকৈটভ বধের সময় ব্রহ্মাদি দেবতারা মহামায়ার স্তব করছেন।” অপূর্ব সেই স্তব—
“ত্বং স্বাহা ত্বং স্বধা ত্বং হি বষট্কারঃ স্বরাত্মিকা।
সুধা ত্বমক্ষরে নিত্যে ত্রিধা মাত্রাত্মিকা স্থিতা।।”
ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ সেই আদ্যাশক্তি মহামায়া হইতে জগৎ-কারণে প্রবেশ করিতেছেন : “শক্তিই জগতের মূলাধার। সেই আদ্যাশক্তির ভিতরে বিদ্যা ও অবিদ্যা দুই আছে—অবিদ্যা মুগ্ধ করে। অবিদ্যা—যা থেকে কামিনী-কাঞ্চন মুগ্ধ করে। বিদ্যা—যা থেকে ভক্তি, দয়া, জ্ঞান, প্রেম—ঈশ্বরের পথে লয়ে যায়।”
এই ব্যাখ্যার পর তিনি মানবীতে নামিতেছেন, বলিতেছেন : “মেয়েরা এক- একটি শক্তির রূপ! পশ্চিমে বিবাহের সময় বরের হাতে ছুরি থাকে, বাংলাদেশে জাঁতি থাকে—অর্থাৎ ঐ শক্তিরূপা কন্যার সাহায্যে বর মায়াপাশ ছেদন করবে। এটি বীরভাব। কন্যা শক্তিরূপা। বিবাহের সময় দেখ নাই—বর- বোকাটি পেছনে বসে থাকে! কন্যা কিন্তু নিঃশঙ্ক।”
ইহার পর তিনি আরেকটু গুটাইয়া আসিয়া বক্তব্য আরো স্পষ্ট করিতেছেন। ব্রাহ্মভক্তের প্রশ্নটিকে ধরিয়া বলিতেছেন : “বিদ্যারূপিণী স্ত্রীও আছে আবার অবিদ্যারূপিণী স্ত্রীও আছে। বিদ্যারূপিণী স্ত্রী ভগবানের দিকে লয়ে যায়, আর অবিদ্যারূপিণী ঈশ্বরকে ভুলিয়ে দেয়, সংসারে ডুবিয়ে দেয়।”
অবিদ্যারূপিণীকে বিদ্যারূপিণী করিবার দায়িত্ব কাহার? পুরুষের। নারীকে ভোগের জন্য ভোগের পথ ধরাইলে সাময়িক সুবিধা হইতে পারে; কিন্তু পরিশেষে বিশালাক্ষীর দহে মজিতে হইবে। ভবনাথকে বলিতেছেন, বিবাহ করিয়াছিস ভাল করিয়াছিস, কারণ, সাধারণ মানুষের সংসারে থাকাই শ্রেয়ঃ।
“ত্যাগ তোমাদের কেন করতে হবে? যেকালে যুদ্ধ করতেই হবে, কেল্লা থেকেই যুদ্ধ ভাল। ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে যুদ্ধ, খিদে-তৃষ্ণা—এসবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। এ-যুদ্ধ সংসার থেকেই ভাল। আবার কলিতে অন্নগত প্রাণ, হয়তো খেতেই পেলে না। তখন ঈশ্বর-টীশ্বর সব ঘুরে যাবে। তোমরা ত্যাগ কেন করবে? বাড়িতে বরং সুবিধা। আহারের জন্য ভাবতে হবে না। সহবাস স্বদারার সঙ্গে, তাতে দোষ নাই। শরীরের যখন যেটি দরকার কাছেই পাবে। রোগ হলে সেবা করবার লোক কাছে পাবে।”
সেই কারণে ভবনাথ যাহা করিয়াছেন, ঠিকই করিয়াছেন; কিন্তু যাহা করিতে হইবে তাহা শিখাইতেছেন : “খুব বীরপুরুষ হবি। ঘোমটা দিয়ে কান্নাতে ভুলিসনে। শিকনি ফেলতে ফেলতে কান্না। ভগবানেতে মন রাখবি; যে বীরপুরুষ সে রমণীর সঙ্গে থাকে, না করে রমণ! পরিবারের সঙ্গে কেবল ঈশ্বরীয় কথা কবি!”
তুলসীদাস যেমন বলিয়াছিলেন : “রাজা করে রাজ্যবশ, যোদ্ধা করে রণ জই। আপনা মন কো বশ করে সো, সব কো সেরা ওই।” তিনি যেমন উপদেশ দিয়াছেন, সেইরূপ কঠোর ভাষায় চাবকাইয়াছেন। বলিতেছেন : “বিষয়ী লোকগুলোর পদার্থ নাই। যেন গোবরের ঝাড়। সংসারী লোকগুলো তিনজনের দাস, তাদের কি পদার্থ থাকে? মেগের দাস, টাকার দাস, মনিবের দাস।”
শিক্ষিতা, আলোকপ্রাপ্তা মহিলারা যে-প্রকার সম্ভ্রান্ত, সজ্জন পুরুষ পছন্দ করিবেন, সেইপ্রকার পুরুষসমাজের নির্মাতা হইতে চাহিয়াছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।
তিনি চাহিয়াছিলেন আদর্শ পুরুষ। নরেন্দ্রনাথ চাহিয়াছিলেন আদর্শ নারী।