তত্ত্ব ও ধারণার রাজনীতি
পরিচিতির রাজনীতি
উপস্থাপনের রাজনীতি
অনুভূতির রাজনীতি

নারীবিদ্যাচর্চা ও নারীবাদী আন্দোলন – মল্লারিকা সিংহ রায়

নারীবিদ্যাচর্চা ও নারীবাদী আন্দোলন – মল্লারিকা সিংহ রায়

উপস্থাপনা

একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করা যাক। প্রায় বছর পনেরো আগে আমার এক মাতৃস্থানীয়া আমায় একান্তে বলেছিলেন চাকরি না পেয়ে যেন বিয়ে না করি। তিনি নিজে চাকুরিরতা ছিলেন ও সংসারের নানা দায়দায়িত্ব সামলে ক্রমাগত চল্লিশ বছর নিজের অফিসের চাকরিটা চালিয়ে গিয়েছিলেন।

একবিংশ শতকের একেবারে শুরুর দিকে আমাকে দেওয়া তাঁর ওই ছোট্ট পরামর্শটুকুর মধ্যে গত শতকের বাংলায় নারীবাদী আন্দোলনের এক নির্যাস আছে। এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে যেভাবে অভিজ্ঞতার নির্যাস সঞ্চারিত হয়ে যায়, যেভাবে পারিবারিক সম্পর্কগুলির দ্যোতনা বদলাতে থাকে, যেভাবে কোনও আন্দোলনের গতিমুখ সুচিহ্নিত হয়ে যেতে থাকে— তার একটি সামান্য উদাহরণ ওই পরামর্শ। মফস্‌সল শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে আজীবন কাটানো আমার ওই মাতৃস্থানীয়া তাঁর প্রজন্মের গুটিকতক নারীর একজন যিনি মেয়ে-ইস্কুলে ছকবাঁধা চাকরির বাইরে এক বৃহত্তর কর্মজগতে পা রাখেন। মফস্‌সলের এই নারীরা অনেকেই কাজের জগতে টিকেছিলেন সমস্ত ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে অবদমিত করে। গত শতকের সাতের দশকে যখন তাঁরা চাকরির জগতে প্রবেশ করেন তখন সংসারে তাঁদের বেতনটুকুর প্রয়োজন ছিল, কিন্তু চাকরিতে উন্নতির জন্য যে ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রয়োজন সেটিকে তাঁদের সংসার প্রায়শ অগ্রাহ্য করেছে। সংসারের প্রয়োজন ও বেতনের প্রয়োজনের মাঝখানে ব্যক্তিত্বের বিকাশের বা কর্মজগতে সার্থকতা খুঁজে পাওয়ার অবকাশ ছিল না। আমার এ কথা জানা নেই যে যৌবনের শুরুতে আমার ওই মাতৃস্থানীয়াকে কেউ একই পরামর্শ দিয়েছিলেন কি না। সম্ভবত না, কারণ পারিবারিক বাধা অতিক্রম করে চাকরি করতে যাবার গল্পটি বলতে তিনি আজও ভালবাসেন। তাঁর আরও স্মৃতিচারণের মধ্যে দিয়ে এটুকু স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে চাকরিটা চালিয়ে নিয়ে যাবার জন্য পরিবারের কাছে থেকে খুব কম সক্রিয় সাহায্য পেয়েছেন। তিনি নিজে বা তাঁর সমসাময়িক কর্মরতা মহিলারা কেউই তেমনভাবে কোনও সংগঠিত নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তবুও ওই চাকরি যে মুক্তির সন্ধান তাঁদের দিয়েছিল তার নির্যাস তিনি নিজের মতো করে পরবর্তী প্রজন্মকে দিয়ে যাচ্ছেন।

ওই মুক্তিচেতনার বিকাশের জন্য যে সক্রিয় সাহায্য প্রয়োজন, পারিবারিক ও সামাজিক বলয় তার কাঠামোটি তৈরি করে। চেতনা ও কাঠামোর আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে, অর্থাৎ এই আদান-প্রদানকে যথাযথভাবে বুঝে নিতে পারলে, যুগপরিবর্তনের অভিমুখগুলি চিহ্নিত করা সম্ভব। উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতে নারীপ্রগতির আন্দোলনের উপর অনেক গবেষণা হয়েছে। সেগুলিকে নতুন করে পাঠ করে ও তার সঙ্গে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে নিয়ে এই নিবন্ধে আমি চেষ্টা করব নারীবাদীচর্চার পরিসরটিকে নিয়ে আলোচনা করতে। এক্ষেত্রে মনে রাখা এই যে, আমার আলোচনা সীমিত থাকবে বুদ্ধিচর্চার প্রেক্ষিতে নারীবাদী আলোচনা বা বলা ভাল নারীবাদী বিদ্যাচর্চার পরিসরটুকুর মধ্যেই। নারীবাদের স্থানীয় প্রেক্ষিত এবং বহু স্বরের আদর্শ গত তিন দশকে নারীবিদ্যাচর্চার প্রাঙ্গণে মান্যতা অর্জন করে নিয়েছে আপন যুক্তির বলে। এই স্থান, কাল ও পাত্র সম্পর্কে সচেতন গবেষণার মধ্য দিয়ে ক্রমশ সম্ভব হয়েছে নারীবাদী আন্দোলন ও প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চার নানা পাঠের নির্মাণ। পাঠের বৈচিত্র সম্ভব করে তুলেছে ভিন্ন ভাবনা এবং ভিন্ন লেখা, যা আমাদের লেখার, বলার ও ভাবার ভাষার কাঠামোর একমাত্রিক চলনকে অতিক্রম করে যায়। একটু দুঃসাহসী হয়ে বলা যেতে পারে, এ এক ভিন্ন ইতিহাস নির্মাণের প্রচেষ্টা। এই ভিন্ন ইতিহাস উঠে এসেছে মূলত পরিচিতির রাজনীতির সূত্র ধরে। ভারতের স্বাধীন নারী আন্দোলনের গোড়ার দিকে, অর্থাৎ গত শতকের সাতের দশকে আন্দোলন শুরু হয়েছিল একমাত্র নারী পরিচয়কে সামনে রেখে, কিন্তু দিন যাবার সঙ্গে সঙ্গে এই উপলব্ধি হল যে নারীর পরিচিতি একমাত্রিক নয়। শ্রেণি, ভাষা, ধর্ম, জাতি, বর্ণ প্রভৃতি আরও নানা পরিচয় নারীকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে ‘অপর’ রূপে প্রতিষ্ঠিত করে। এই বিভিন্নতাকে মান্যতা দিতে গিয়ে ব্যাবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে এবং বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে নতুন অনুসন্ধান শুরু হল। তার ফলাফল হিসেবে গত শতকের নয়ের দশকে যেন এক বিস্ফোরণ ঘটল নারীবিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে। ভারতের নিজস্ব পরিবর্তনগুলির সঙ্গে যুক্ত হল বৃহত্তর বিশ্বে উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্ব আর তথ্যের সম্ভার। মার্কসীয় বিশ্লেষণ ও উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্বের আদান-প্রদান এবং তর্কের সূত্র ধরে উঠে এল নারীবাদী রাজনীতির নানা প্রতর্ক যেখানে ‘পরিচয়ের রাজনীতি’ কেবলমাত্র সামাজিক পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না। তা হয়ে উঠতে থাকল বিভিন্নতার দর্শন। বহু স্বরের ঐশ্বর্য ভিন্ন ইতিহাস নির্মাণের আকর হয়ে উঠল। প্রবন্ধের পরবর্তী অংশগুলিতে ভারতবর্ষে নারীবাদী বিদ্যাচর্চার ইতিহাস, সেই ইতিহাসের সঙ্গে নারীবাদী আন্দোলনের যোগ, এবং চর্চা ও আন্দোলনের সম্পর্কের একটি সম্ভাব্য ভবিষ্যতের রূপরেখা আলোচিত হবে।

ভারতে নারীবিদ্যাচর্চার ইতিহাস

ভারতে নারীবিদ্যাচর্চার ইতিহাসকে কমপক্ষে দু’টি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোচনা করা যায়। প্রথমত নারী আন্দোলন ও নারীবাদীচর্চার আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে; দ্বিতীয়ত শিক্ষার আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে, অর্থাৎ যেভাবে নারীবিদ্যাচর্চা একটি পঠনপাঠনের বিষয় হয়ে উঠেছে। তবে এ কথা মনে রাখা ভাল এই দুই দৃষ্টিভঙ্গি পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত।

উনিশশো সত্তরের শেষ বছরগুলি স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়— সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক নানা দিক থেকে। নারীবিদ্যাচর্চার ইতিহাসেও এই সময়টির গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত টুওয়ার্ডস ইকুয়ালিটি রিপোর্ট ভারতে নারীবিষয়ক আলোচনা ও আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। এটি প্রস্তুত করেন ভারত সরকার নিয়োজিত (১৯৭২ সালে) কমিটি অন উইমেনস স্ট্যাটাস ইন ইন্ডিয়া। ভারতে লিঙ্গবৈষম্যের ভয়াবহ চিত্রটি এই রিপোর্ট তুলে ধরে ও দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক নেতৃবর্গ লিঙ্গবৈষম্যকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন। ১৯৭৪-এর পর পরই ঘটে যাওয়া আরেকটি ঘটনা নারীবিদ্যাচর্চাকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়ে পরিণত হতে সাহায্য করে। রেখা পাপ্পুর লেখায় আছে যে ভারতের সমাজবিজ্ঞানচর্চার অন্যতম কেন্দ্র ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ-এর সম্পাদক অধ্যাপক জে.পি. নায়েক ওই কেন্দ্রে কর্মরত বীণা মজুমদারকে ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার সময়ে বলেন যে, সেখানে নারীবিদ্যাচর্চা শুরু করা প্রয়োজন কারণ ওই বিভাগের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন মতপ্রকাশের একটা সুযোগ পাওয়া যেতে পারে। বীণা মজুমদার এদেশের নারীবিদ্যাচর্চার একজন অগ্রগণ্য পথিক, কাজেই তাঁর তত্ত্বাবধানে এই কেন্দ্র শুরু করা গেলে স্বাধীন মতপ্রকাশ এবং বৌদ্ধিকচর্চার এক অনন্য ক্ষেত্র তৈরি হয়ে উঠবে। বীণা মজুমদার অধ্যাপক নায়েকের কথা উল্লেখ করেছেন তাঁর নিজের একটি লেখায়— ‘I do not think the political implications of such research will be immediately understood by the powers that be. I am doubtful if we shall be permitted to do anything else.’ জে.পি. নায়েকের সিদ্ধান্তের তাই এক সুদূরপ্রসারী অভিঘাত রয়েছে ভারতে নারীবিদ্যাচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রগতির ইতিহাসে। ১৯৭৪-এ শুরু হওয়া শ্রীমতী নাথিবাই দামোদর থ্যাকারসে (SNDT) উইমেনস ইউনিভার্সিটি নারীবিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে প্রথম যুগের মার্গদর্শকের ভূমিকা পালন করে। অচিরেই ভারতের বিভিন্ন কোনায় গড়ে উঠতে থাকে নারীবিষয়ক আলোচনার গবেষণাকেন্দ্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯৮০ সালে তৈরি হওয়া ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্স, ১৯৮০ সালে দিল্লিতে তৈরি হওয়া সেন্টার ফর উইমেনস ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (CWDS) ও হায়দ্রাবাদে তৈরি হওয়া আনভেশি রিসার্চ সেন্টার ফর উইমেনস স্টাডিজ। ১৯৮১ সালে SNDT বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম নারীবিদ্যা বিষয়ক কনফারেন্স হয় ও তার থেকেই গঠিত হয় ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ উইমেনস স্টাডিজ (IAWS)। মেরি জনের মতে এইসময় থেকেই শুরু হয় ‘নারীবিদ্যাচর্চার আন্দোলন’। এই আন্দোলনের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল নারীবিদ্যাচর্চাকে সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চার অঙ্গীভূত করে তোলা। যে-সমস্ত বিষয়গত গণ্ডির মধ্যে লিঙ্গবৈষম্য বা নারীবিষয়ক আলোচনার কোনও অবকাশই ছিল না সেইসব গণ্ডিবদ্ধ কলা বিভাগ ও সমাজবিজ্ঞানের বিষয়গুলিকে নারীবিদ্যাচর্চার নিরিখে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করাটাই আন্দোলনের অভিমুখ হয়ে ওঠে। নারী আন্দোলনের কর্মীদের এই অভিমুখের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। সমর্থনের একটা কারণ অবশ্যই এই যে, নারী আন্দোলনের কর্মীদের একটা বড় অংশ নারীবিদ্যাচর্চার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন।

আটের দশকের নারী আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির এক দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রয়ে গেছে নারীবিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে। প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়গুলির গণ্ডি ভেঙে অথবা অতিক্রান্ত করে যেসব শিক্ষাবিদ নারীবিষয়ক নতুন জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান উৎপাদনের কাজ শুরু করেন তাঁরা অনেকেই তৎকালীন নারী আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন। রাধা কুমারের লেখা ভারতে বিংশশতকের নারী আন্দোলন ও নারীবাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে এই যোগাযোগটিকে চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। রাধা কুমার জানাচ্ছেন, ১৯৭৩ সাল নাগাদ নকশালবাদী আন্দোলনের প্রথম পর্ব স্তিমিত হয়ে আসে এবং অনেক নকশালবাদী ক্রমশ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে সমাজের প্রান্তিক, অধিকারহীন গোষ্ঠীগুলিকে প্রথমে আলাদা আলাদা ভাবে সংগঠিত করা প্রয়োজন। আদিবাসী, দলিত, নারী— এঁদের নিজস্ব সংগঠনগুলি শক্তিশালী হয়ে উঠলে এঁদের একত্রিত করে এক বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়া যেতে পারে। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই এঁদের শত্রু এক। কিন্তু অবিভাজিত একটি সামগ্রিক সংগঠন করতে গেলে অনেকসময়ই আন্দোলনকারীদের মধ্যে কিছুটা অজান্তেই ব্রাহ্মণ্যবাদী পুরুষতন্ত্র মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ছোট ছোট নারীসংগঠন এইভাবে ভারতের বেশ কিছু শহরে গড়ে উঠতে থাকে। কলকাতা, মুম্বাই এবং দিল্লিতে এইসমস্ত সংগঠনগুলি সমস্ত আশির দশক জুড়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে থাকে।

১৯৭৯ সালে মথুরা নামের একটি আদিবাসী মেয়েকে পুলিশি ধর্ষণের প্রতিবাদে যখন নারীবাদীদের নেতৃত্বে বেশ কিছু মানুষ পথে নামেন সেই সময়কে ভারতে স্বাধীন নারী আন্দোলনের সূচনা হিসেবে ধরা হয়। দেশের নানা মহিলা সংগঠন এই আন্দোলনে যোগ দিতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু, এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, এই মহিলা সংগঠনগুলি নারীবাদের সঙ্গে কোনও তাত্ত্বিক সমালোচনামূলক আলোচনা বা নারীবাদের রাজনীতিতে ভিন্নতা সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা সযত্নে এড়িয়ে চলত। রাধা কুমারের মতে এই সংগঠনগুলির নিজেদের মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন তাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক মতামতকে স্বীকার করে নেওয়ায় দ্বিধা ছিল। এঁরা ভয় পেতেন যে বিভিন্নতাকে স্বীকৃতি দিলেই নারীবাদবিরোধীরা তাঁদের দিকে আঙুল তুলে বলবেন যে আমরা আগেই জানতাম মেয়েরাই মেয়েদের সবচেয়ে বড়ো শত্রু, তারা কোনওদিনই একসঙ্গে কোনও কাজ করতে পারবে না। এক দিকে এই ভয় ও অন্য দিকে নারী আন্দোলনকারীর এক গভীরে প্রোথিত একচালা মূর্তি— যিনি নিজের সমস্ত সুখ-সুবিধা বিসর্জন দিয়ে এক বৃহত্তর মানুষের ভালর কাজে বলিপ্রদত্ত— ভারতের নারী আন্দোলনকে একটি সর্বজনগ্রাহ্য ছাঁচের মধ্যে ফেলে দেয়। নারী আন্দোলনের চেহারা ও আন্দোলনকারীর প্রতিরূপ আগের গাঁধীবাদী বা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের থেকে বেরিয়ে এসে নিজস্বতা তৈরি করতে অনেকটা সময় নিয়েছিল। যৌনতা, বিশেষত নারীর যৌনতা ও চাহিদা, নারীর আনন্দ ও নারীত্বের উদ্‌যাপনের মধ্যে কোনও সমালোচনামূলক তত্ত্বের সন্ধান— এই বিষয়গুলি নারীবিদ্যাচর্চার কেন্দ্রে আসতে অনেকটা সময় চলে গিয়েছিল। ১৯৭৯-তে শুরু হওয়া আন্দোলন নারীর শোষণের যে-দিকগুলির ওপর জোর দিয়েছিল— বধূহত্যা, ধর্ষণ ও নারীনির্যাতন— তার কোনওটাই নারীজীবনের লৌকিক আনন্দ বা চাহিদাকে সম্বোধন করেনি। আন্দোলন ও চর্চার কেন্দ্রে থেকে যায় নিপীড়িত নারী— অর্থাৎ নারীহিতৈষী পুরুষতন্ত্র ঊনবিংশ শতকে যার জন্য করুণায় আর্দ্র হয়েছিল, বিংশ শতকের শেষপাদে এসে নারী আন্দোলনও সেই নিপীড়িতাকে লক্ষ্য করে যাবতীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজে মন দেয়।

ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনগুলি নতুন আইন তৈরি ও পুরনো আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা সফল হয়েছিল। আটের দশকেই আইনগত পরিবর্তন শুরু হয় ও নয়ের দশকেও এই পরিবর্তনের ধারা চলতে থাকে। তবে আইনি পরিবর্তনকে সামাজিক পরিবর্তনে পরিণত করার কাজটি দেখা যায় হতাশাজনক রকমের শক্ত। নারী যদি কেবল অসহায় নিপীড়নের শিকার বা করুণার পাত্রী হিসেবে থেকে যায় তাহলে সমাজে নতুন চিন্তাধারার পথ থেকে যায় রুদ্ধ। নারীবিদ্যাচর্চার মধ্যে নয়ের দশকের মধ্যভাগ থেকে তাই জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান উৎপাদনের অভিমুখ বদলে যেতে থাকে। নারীবাদী পণ্ডিতরা, শিক্ষাবিদরা ক্রমশ উপলব্ধি করতে থাকেন যে লিঙ্গবৈষম্যের ইতিহাস, নারীদের প্রতিরোধের ইতিহাস, নারীকেন্দ্রিক সংস্কৃতির চর্চা ও নারীর যৌনতা নিয়ে চর্চা করতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিকতার মধ্যে জায়গা খুঁজে নিতে হবে। প্রথাগত বিষয়গুলির মধ্যে, যথা ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ইত্যাদির মধ্যে, নারীবিষয়ক অধ্যয়ন, পঠনপাঠন যেমন চলছে চলুক কিন্তু নারীবিদ্যাচর্চাকে একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।

যদিও ১৯৮৬ সালেই প্রথম স্বতন্ত্র নারীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্র খোলা শুরু হয়, একবিংশ শতকের দোরগোড়ায় এসে সেই উদ্যোগের পালে হাওয়া লাগে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (UGC) নারীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি নির্দেশিকা প্রস্তুত করে ও প্রতিটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শুরুতে সেই নির্দেশিকায় সংশোধন করা হয়ে থাকে। বর্তমান নব্য উদারনীতিবাদী ব্যবস্থায় মঞ্জুরি কমিশনের আয়ু কতদিন তার ভবিষ্যদ্বাণী করা অসম্ভব। সে যাই হোক, এই নির্দেশিকায় চোখ বোলালে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট হয়। শুরুর দিকে নির্দেশিকায় প্রাধান্য পেয়েছে নারীবিদ্যাচর্চাকে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক করে তোলা যায়। প্রাসঙ্গিকতাকে চিহ্নিত করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে নারী-উন্নয়নের সঙ্গে নারীবিদ্যাচর্চাকে সংযুক্ত করে কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়াই এই কেন্দ্রগুলির ক্ষেত্রে কাম্য। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পকে সমীক্ষণ ও পরীক্ষা করা, নতুন প্রকল্পের খসড়া তৈরি করা, সামাজিক রীতিনীতির বিভিন্নতা পর্যবেক্ষণ করে তালিকা প্রস্তুত ও তার সংরক্ষণ করা, এমনকী কাউন্সেলিং করাকেও নারীবিদ্যাচর্চার কেন্দ্রগুলির দায়িত্বের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। এই বিশাল কর্মকাণ্ডের মধ্যে জ্ঞানচর্চার পরিসরটি যে ক্ষুদ্র হবে এ কথা বলাই বাহুল্য। অবশ্য দশম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বলা হয়েছে যে একটি বুনিয়াদি পাঠক্রম তৈরি করাও অত্যাবশ্যক যেখানে লিঙ্গভিত্তিক আলোচনার নতুন দিকগুলি পড়ানো হবে। এইরকম দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বোঝা যায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নারীবিদ্যাচর্চাকে ঠিক গবেষণা ও পঠনপাঠনমূলক বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়নি। মেরি জন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কেবল যে বিষয়ের সমাহার তাই-ই নয় বিষয়গুলির উঁচু-নিচু সম্মান সম্পর্কেও গভীরভাবে রক্ষণশীল। এই রক্ষণশীল প্রাতিষ্ঠানিকতার মধ্যে জ্ঞানচর্চার ও জ্ঞান-উৎপাদনের ক্ষেত্র হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে নারীবিদ্যাচর্চাকে অনেক কম সময়ের মধ্যে অনেকটা পথ পেরোতে হয়েছে।

২০১১-১২ সালের হিসেব অনুযায়ী ভারতের তিরাশিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্র রয়েছে। এইসমস্ত কেন্দ্রগুলির কাঠামো কেমন তা নিয়ে দু-একটি কথা আলোচনা করে এই অধ্যায়টির ইতি টানব।

প্রথমত ভারতের চারটি এলাকা— উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম— অনুযায়ী এই বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রগুলিকে ভাগ করা হয়। এলাকাভিত্তিক কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য কার্যক্রম ও পঠনপাঠন গবেষণার মধ্য দিয়ে এমনিই গড়ে উঠেছে, তবে মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশিকা অনুযায়ী বছরে এক বার সমস্ত কেন্দ্রগুলির পরিচালকের সর্বভারতীয় একটি সমাবেশ করা হয়। এই কেন্দ্রগুলিকে নিয়মিতভাবে বার্ষিক রিপোর্ট জমা দিতে হয়। বার্ষিক রিপোর্টগুলিতে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় গৃহীত যেসব প্রকল্প এই কেন্দ্রগুলির বিকাশের জন্য নেওয়া হয়েছে সেগুলি পূরণের লক্ষ্যে কেমন কাজ এগোবে তার বিস্তারিত বিবরণ দিতে হয়। এই কেন্দ্রগুলির প্রত্যেককে একটি করে আভ্যন্তরীণ উপদেষ্টা কমিটি রাখতে হয় বাৎসরিক কাজের সমীক্ষা করার জন্য, এবং একটি স্থায়ী কমিটি রাখতে হয় কেন্দ্রের কর্মকাণ্ডকে মূল্যায়ন করার জন্য। এই কমিটিগুলিতে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপকরা থাকেন। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি, মঞ্জুরি কমিশনের প্রতিনিধি ও নারী আন্দোলনের কর্মীরা থাকেন। এইসমস্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বিদ্যাচর্চার কেন্দ্রগুলির সরকারি অনুদান ধার্য করা হয় ও কেন্দ্রগুলিতে কর্মী নিয়োগ করা হয়। শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারী, পাঠাগার, অভিলেখাগার ও তালিকা প্রস্তুতকরণের কাজের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কর্মী নিয়োগ ও নানা আলোচনা সভার আয়োজনের জন্য অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে। কেন্দ্রগুলির কাজকর্মের অগ্রগতি অনুযায়ী তাদের বিভিন্ন স্তরে অনুদান দেওয়া হয়। ২০১১-১২ সালের হিসাব অনুসারে ৪৯টি কেন্দ্র প্রাথমিক স্তরে, ২১টি কেন্দ্র দ্বিতীয় স্তরে, ১০টি কেন্দ্র তৃতীয় স্তরে ও ৩টি কেন্দ্র অগ্রসর স্তরে অনুদান পেয়ে থাকে। মঞ্জুরি কমিশনের সরাসরি আওতার বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেও বেশ কিছু নারীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্র আছে। তারা কতকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগগুলির মতোই কার্যক্রম চালায়। এমনকী মঞ্জুরি কমিশনের আওতার মধ্যে থাকা কেন্দ্রগুলিও যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই অবস্থিত তাই তাদের মঞ্জুরি কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দু’ তরফের নির্দেশিকাই মান্য করে চলতে হয়। বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র নিয়ে আলোচনায় অধিকাংশ সময়েই অনুদান ও তহবিল গঠনের মতো জাগতিক বিষয় নিয়ে সময় কম ব্যয় করা হয়। সারস্বত সাধনার আলোচনায় এগুলি বড় স্থূল বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। সম্পূর্ণ অসংগত হয়তো এই যুক্তি নয়, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক জীবনে অর্থের আনুকূল্যের গুরুত্বটা স্বীকার করে নেওয়াই ভাল। নারীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্রগুলির ভবিষ্যতের ঔৎকর্ষ নিয়ে সমালোচনার সময়ে এই বিষয়টি মনে রাখা প্রয়োজন। বর্তমান অবস্থায় নারীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্রগুলি অনেক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় তাদের অবস্থান ও অনুদানের পরিমাণ এই কারণেই তাদের ভবিষ্য নির্মাণের ক্ষেত্রে দু’টি প্রধান বিষয়।

এই অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের পর্যালোচনার লক্ষ্য ভারতে নারীবিদ্যাচর্চার সংকটকালীন পরিস্থিতি। এক দিকে ব্যাবহারিক প্রাসঙ্গিকতার কর্মসূচিতে গবেষণার ক্ষেত্রে সরকারি অনুদান সংকোচনের আশঙ্কা ও অন্য দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি গড়পড়তা বিভাগে পরিণত হওয়া— এই দুই ধারার মধ্যে দিয়ে দড়ির উপর হাঁটছেন নারীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মীরা। আশার কথা এই যে এমন সংকটের মধ্য দিয়ে উঠে আসছে নতুন জ্ঞান-উৎপাদনের প্রেরণা ও পরিকল্পনা। ক্রমাগত নিজেদের অস্তিত্ব ও কার্যক্রম নিয়ে তর্কবিতর্ক করতে করতেই তৈরি হচ্ছে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র। পরবর্তী অধ্যায়ে সেই নিয়ে দু-চার কথা বলা।

আন্দোলনের চর্চা, চর্চার আন্দোলন

আন্দোলনের চর্চা সমাজতত্ত্ব বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতো বিভাগে গবেষণার ও পঠনপাঠনের একটি স্বতন্ত্র ক্ষেত্র হিসেবে বেশ কিছুদিন ধরেই প্রতিষ্ঠিত। রাজনৈতিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক আন্দোলন নিয়ে ইতিহাস বিভাগেও চর্চা হয়ে থাকে। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বিদেশে ও গত চল্লিশ বছর ধরে ভারতে যে স্বাধীন নারী আন্দোলন চলেছে তার ফলে সমাজতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাস বিভাগে বেশ কিছু লিঙ্গবৈষম্যভিত্তিক সাড়া-জাগানো গবেষণার কাজ হয়েছে; এবং আন্দোলনের চর্চার ক্ষেত্রেও বার বার লিঙ্গবৈষম্য ও নারীবাদী তত্ত্ব সংক্রান্ত আলোচনা হয়েছে।১০ এই গবেষণার কাজগুলি অনেক ক্ষেত্রেই আন্তঃবিষয়ক। ঐতিহাসিক মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করেছেন, সমাজতাত্ত্বিক মহাফেজখানার ধুলো ঘেঁটেছেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সৌন্দর্যতত্ত্বের সাহায্য নিয়ে গবেষণার উপাদানের ব্যাখ্যা প্রস্তুত করেছেন। এইসমস্ত কাজ নারীবাদী অধ্যয়ন ও জ্ঞান-উৎপাদনকে পরিশীলিত করে তুলেছে। আন্দোলনের চর্চার ক্ষেত্রে এ জাতীয় নারীবাদী গবেষণার ফল ফলেছে ‘নারী আন্দোলন’ নামের একটি বিশেষ বিভাগ প্রস্তুত করার মধ্য দিয়ে। প্রাথমিকভাবে দেখতে গেলে মনে হয় এ একরকম নারীবাদের জয়। আন্দোলনের চর্চায় নিয়োজিত গবেষক-অধ্যাপকরা এতকাল কৃষক, শ্রমিক, আদিবাসী, ছাত্র, যুব, বা নিম্নবর্গকেই আন্দোলনের কেন্দ্রে রেখে আন্দোলনের চরিত্র বিচার করতেন। নব্বইয়ের দশক থেকে ক্রমশ ‘নারী’ একটি কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সমস্যাটা শুরু হয় এই নারীবাদের জয়কে আরেকটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে বসলে।

আন্দোলনের চর্চার সুবিধার জন্য কৃষক, শ্রমিক, আদিবাসী ইত্যাদি যে-খোপগুলি নির্মাণ করা হয় তাতে কখনওই এই বিভ্রম থাকে না যে কৃষক আন্দোলনের চর্চায় ভূমিহীন কৃষকের ‘শ্রম’ আলোচনার ক্ষেত্রে ব্রাত্য। বরঞ্চ ভূমিহীন কৃষক কীভাবে কৃষিসমাজে এক ধরনের কৃষিশ্রমিকে পরিণত হয় তা নিয়ে সূক্ষ্ম তাত্ত্বিক আলোচনা কৃষক আন্দোলনের গবেষণাকে সমৃদ্ধ করেছে। এইবারে ‘নারী’ যখন আন্দোলনের চর্চায় একটি খোপে পরিণত হয় তখন নারীশ্রমিক বা নারীকৃষক বা ছাত্রীরা বৃহত্তর শ্রমিক, কৃষক বা ছাত্র এই বর্গগুলিতে আলোচিত হয় না। কৃষক বা শ্রমিক আন্দোলনের চর্চার মধ্যে যদি প্রশ্ন তোলা হয় যে নারীরা কেন এই বর্গের আলোচনায় অনুপস্থিত তৎক্ষণাৎ রক্ষণশীল আন্দোলনচর্চার দ্বারপালরা আঙুল তুলে দেখিয়ে দেন ‘নারী’ নামাঙ্কিত খোপটির দিকে। এ যেন আগে থেকেই জানা হয়ে গেছে যে নারীসংক্রান্ত যাবতীয় আলোচনা আন্দোলনচর্চার ওই খোপটির মধ্যেই হবে আর তাহলে বাকি আন্দোলনচর্চার ক্ষেত্রকে লিঙ্গবৈষম্যের মতো একটি বিষয়ের মুখোমুখি হতে হবে না।১১ লিঙ্গবৈষম্যের প্রতি প্রথাগত অন্ধত্বের ক্ষতিপূরণ যেন ওই ‘নারী’ নামাঙ্কিত খোপটি। এইখানেই, অতএব, প্রশ্ন উঠে যায় নারীবাদের জয় প্রকৃতপক্ষে আন্দোলনের চর্চার ক্ষেত্রে নারীবাদী হয়ে উঠতে পারে কি না। নারীবিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রেও এই প্রশ্নটি অনিবার্য হয়ে ওঠে যে, এই বিদ্যাচর্চার লক্ষ্য কি তাহলে সমাজবিজ্ঞান ও মানবিক বিদ্যাচর্চার প্রতিষ্ঠিত বর্গ শনাক্ত করা এবং এইসমস্ত বর্গগুলোকে জুড়ে নিয়ে (কোনও কোনও ক্ষেত্রে জোড়াতালি দিয়ে) নারীবিদ্যাচর্চা নামক একটি বিভাগ প্রস্তুত করা?

এই প্রশ্নের কোনও সহজ উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। আর যায়নি বলেই, আন্তঃবিষয়ক অধ্যয়ন ও গবেষণার প্রয়োজনীয়তা নারীবিদ্যাচর্চার সঙ্গে যুক্ত, এ কথা সকলকে মেনে নিতে হয়। এই প্রয়োজনীয়তা অবশ্য নারীবিদ্যাচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক জন্মলাভের সময় থেকেই স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। তবে এক্ষেত্রে আন্তঃবিষয়ক অধ্যয়ন ও গবেষণা বলতে বাস্তবে কী করা সম্ভব তা নিয়ে একটু বিশদে ভাবা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশে আন্তঃবিষয়ক অধ্যয়ন ও গবেষণা কীভাবে দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের মধ্যে প্রয়োগ করা সম্ভব তা নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে পরীক্ষানিরীক্ষাগুলি কোন কোন খাতে বইছে তা নিয়ে কিছু কথা বলে অধ্যায়টি শেষ করব।

প্রথমে এই কথা মেনে নেওয়া ভাল যে ভারতবর্ষের যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীবিদ্যাচর্চার পঠনপাঠনের কার্যক্রম নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনা চলছে গত প্রায় এক দশক ধরে, সেখানে অধ্যাপক-অধ্যাপিকা অধিকাংশই প্রথাগত বিষয়গুলি থেকে স্নাতকোত্তর পাঠ নিয়ে এসেছেন। যাঁরা সরাসরি নারীবিদ্যাচর্চার বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাঠ নিয়ে এসেছেন তাঁরা প্রায় সকলেই সেই পাঠ বিদেশে গ্রহণ করেছেন। নারীবিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে তাই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের পাঠক্রম গঠনের পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীদের উপর দিয়ে। সুখের কথা যে ছাত্র-ছাত্রীরা এটা জেনেই বিভাগে পড়তে আসছেন, পরীক্ষানিরীক্ষায় সময়বিশেষে সোৎসাহে অংশ নিচ্ছেন।

পাঠক্রম গঠনের ক্ষেত্রে এই কারণে অতিরিক্ত সতর্কতার প্রয়োজন হয় ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যতের কথা মনে রেখে। নারীবিদ্যাচর্চা, অন্তত আমি যেভাবে বুঝি, ক্লাসে পড়ানোর জন্য কয়েকটি বিষয়ে পরিষ্কার ধারণার দরকার রয়েছে। যে বিস্তৃত জ্ঞানভাণ্ডার তৈরি হয়েছে লিঙ্গবৈষম্যভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে তাকে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে পৌঁছে দিতে গেলে প্রথমেই ভাবতে হবে Canon formation-এর আদৌ কোনও দরকার আছে কি না। ভাবতে হবে আন্তঃবিষয়ক গবেষণার জন্য যে-ধরনের উদ্ভাবনী প্রশ্ন ও প্রণালী প্রয়োজন হয় সেই বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের দক্ষ করে তুলতে গেলে কী ধরনের পাঠক্রমের প্রয়োজন পড়তে পারে। সঙ্গে এও ভাবতে হবে গবেষণা ও চর্চার কোন কোন প্রকরণ ক্লাসে পড়ানো অনিবার্য।

যেহেতু মঞ্জুরি কমিশন নারীবিদ্যাচর্চার জন্য একটি বুনিয়াদি পাঠক্রম তৈরি করার দিকে জোর দিয়েছেন, বিগত কয়েক বছরে বেশ কিছু আলোচনা সভা এ বিষয়ে হয়েছে। দু’টি আলোচনা সভায় আমার যোগ দেবার সুযোগ হয়েছিল। ২০১১ সালের নভেম্বরে পুণে বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্র দক্ষিণ এশীয় নারীবাদ নিয়ে একটি দু’দিনের আলোচনা সভার আয়োজন করে। এই আলোচনা সভায় যোগ দিয়ে বুঝতে পারি কত রকমের সমাজবিজ্ঞান বিষয়ক বিভাগ থেকে প্রতিনিধিরা এসেছেন দক্ষিণ এশিয়ায় নারীবাদচর্চার বিচিত্র গবেষণার সম্ভার নিয়ে। ভারতের বাইরে অবস্থিত দক্ষিণ এশীয় বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রগুলিতে নারীবিদ্যাচর্চা অনেকসময়েই একটু পিছনের সারিতে চলে যায়। দক্ষিণ এশীয় বিদ্যাচর্চা ও নারীবিদ্যাচর্চা এই দুই আন্তঃবিষয়ক চর্চার মধ্যে দোলায়িত হতে থাকে লিঙ্গবৈষম্যভিত্তিক ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে লিঙ্গবৈষম্যভিত্তিক অবস্থিত গবেষণা ও অধ্যয়ন। ভারতবর্ষে থেকে দক্ষিণ এশীয় নারীবাদ নিয়ে আলোচনায় সেই প্রথম বার আমি যোগদান করি। আলোচনা যত এগোয় ততই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে দক্ষিণ এশিয়াকে কেবলমাত্র একটি ভৌগোলিক অঞ্চলে সীমাবদ্ধ রাখা অসম্ভব। দক্ষিণ এশিয়া কয়েকটি সীমান্ত সংযোজনকারী সার্বভৌম রাষ্ট্রের জোট নয়। সীমান্ত পেরিয়ে ঐতিহাসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগকে চিহ্নিত না করতে পারলে এই অঞ্চলের নারীবাদের বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করা অসম্ভব। এই বিষয়ে পাঠক্রম গঠনের প্রশ্ন যখন ওঠে তখন নানা বিতর্কের উপস্থাপনা হয়। মোটের উপর অবশ্য সকলেই একমত হন যে পাঠক্রমে কয়েকটি মূলগত তাত্ত্বিক ও প্রেক্ষাপট নির্দিষ্ট আলোচনা থাকতেই হবে। যথা— সংস্কৃতি, জাতিগত পরিচয় ও তার সমস্যা, ধর্মবিশ্বাস ও তার দ্বন্দ্ব, হিংসার নানা স্তরের অভিজ্ঞতা, এবং রাজনীতি। এও আলোচনায় স্থির হয় যে দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিক যুগের ভৌগোলিক সীমারেখাকে ইতিহাসের বিস্তারিত পটভূমিতে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় পর্বের বাণিজ্য বা সাম্রাজ্য নির্মাণ বর্তমানের দক্ষিণ এশিয়াকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। পরিবার, আইন, শ্রম বা সংস্কৃতি— সমস্ত ক্ষেত্রেই ইতিহাসের উপাদানকে বাদ দিয়ে বর্তমানের দক্ষিণ এশীয় নারীবাদ কল্পনা করা সম্ভব নয়। এই ইতিহাস উচ্চাবচ, বন্ধুর কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত। নারীবিদ্যাচর্চার পাঠক্রমে বর্তমান ও ইতিহাসের যোগাযোগটিকে প্রাধান্য দেবার ক্ষেত্রে সকলেই একমত হন। তবে ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে সেটা কেমন দাঁড়িয়েছে তার জন্য পাঠক্রমগুলির খুঁটিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। এই প্রবন্ধে সেই সুযোগ নেই। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্র ২০১২ সালে এরকম একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। ভারতের পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ— চার দিকের নারীবিদ্যাচর্চার কেন্দ্র থেকে প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। আলোচনার শেষে ঐকমত্যে পৌঁছোতেই হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। ফলত সকলেই খোলামনে নিজের নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের বা স্বতন্ত্র কেন্দ্রের কৃতিত্ব ও বিফলতা নিয়ে বক্তব্য পেশ করেছিলেন। শিক্ষাদানের বৈচিত্র সম্পর্কে আমি তখনই প্রথম অবহিত হই। পুণে, যাদবপুর, ওয়ার্ধার মতো আবাসিক (অন্ততপক্ষে মূলত আবাসিক) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা, ইন্দিরা গাঁধী জাতীয় মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা, এবং কালিকটের বা গোয়ার মতো প্রধানত অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা তাঁদের পাঠক্রম প্রস্তুত করার ও ক্লাসে পড়ানোর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করেন। সেই আলোচনায় ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে প্রথাগতভাবে নারী আন্দোলনের ইতিহাসকে পড়ানোর কার্যকারিতা সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবা প্রয়োজন। প্রায় সকলেই বলেন নারীবিদ্যাচর্চা ইতিহাস পাঠের মধ্যে দিয়ে, বিশেষত নারী আন্দোলনের ইতিহাস, ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন কারণ তার উপরে তাদের পরবর্তী স্তরে আগ্রহ ও দক্ষতা অনেকাংশে নির্ভর করে। বিতর্ক জমে ওঠে নারী আন্দোলনের তিনটি মূলধারা— উদারবাদী, সমাজবাদী ও সংস্কারবিরোধী (Radical)— নিয়ে পাঠক্রম তৈরির আলোচনা পর্বে। আলোচনা পর্বের শেষে কোনও ঐকমত্য হয়নি কিন্তু তা থেকে চিন্তার খোরাক মিলেছিল প্রচুর। নারীবিদ্যাচর্চা ও নারী আন্দোলনের সংযোগের ব্যাখ্যা তাই এখনও এক উন্মুক্ত চর্চার ক্ষেত্র। ধরাবাঁধা পাঠক্রমের বাইরে ক্রমাগত চেষ্টা চলছে কীভাবে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এক নতুন ধরনের ইতিহাসচেতনার সঞ্চার করা যায় নারী আন্দোলনের ইতিহাস পাঠের মধ্য দিয়ে।

আন্তঃবিষয়ক অধ্যয়ন ও গবেষণার ক্ষেত্রে নারীবিদ্যাচর্চায় একটি অনন্য সুযোগ রয়েছে সক্রিয় আন্দোলন ও আন্দোলনের চর্চাকে মিলিয়ে নেবার। পাঠক্রম গঠন, ক্লাস পড়ানো, গবেষণার জন্য নতুন বিষয়ের সন্ধান— এইসমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাজের সঙ্গে সঙ্গে নারীবিদ্যাচর্চা এক আন্দোলনও বটে। আগেই বলেছি, মেরি জন একে বলেছেন ‘নারীবিদ্যাচর্চার আন্দোলন’। প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডকে সম্ভব করে তোলাই এক্ষেত্রে রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে এক দৈনন্দিন আন্দোলন। বিশ্ববিদ্যালয় তো কোনও অরাজনৈতিক পরিসর নয়, তাই সেখানে প্রাত্যহিক কর্মসূচিকে রূপায়ণ করার মধ্যে, তাকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে তোলার মধ্যে ক্ষমতার রাজনীতির বোধ গভীরভাবে প্রবিষ্ট।

এ ছাড়াও মনে রাখতে হবে যে নারীবিদ্যাচর্চা কোনও সময়েই গজদন্তমিনারবাসী সারস্বতসাধনার ক্ষেত্র হয়ে উঠতে চায়নি। এক্ষেত্রে কর্মরত মানুষদের তাই প্রতিদিন সওয়াল করতে হয় যে ‘নারী’ কোনও আমলাতান্ত্রিক উন্নয়নের বর্গমাত্র নয়, সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা নির্মাণের জন্য এক্ষেত্রে কেবল হাতে-কলমে কাজ শেখানোটাই মূল লক্ষ্য হতে পারে না, অথবা, এটি সরকারের নীতি রূপায়ণের প্রকল্পমাত্র নয়। বিভিন্ন আলোচনা সভায়, দলিলে, সম্মেলনে জ্ঞানচর্চার অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে করতে নারীবিদ্যাচর্চার সবচেয়ে অরাজনৈতিক গবেষক/অধ্যাপক/অশিক্ষক কর্মচারী/ছাত্র-ছাত্রীরাও নারীআন্দোলনের কর্মী হয়ে ওঠে।

দৈনন্দিন ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে নারীবিদ্যাচর্চাকে ‘কাজে লাগানো’র জন্য অনেকসময়েই বিশেষ বিশেষ কাজ এই বিষয়ের অধ্যাপকদের দেওয়া হয়ে থাকে। এর মধ্যে ক্রমশ যেটি প্রাধান্য পাচ্ছে তা হল কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বা শিক্ষাক্ষেত্রে যৌননিগ্রহের অভিযোগগুলির বিচার করা। এ কথা ঠিক যে লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে গবেষণা নারীনিগ্রহ, নির্যাতন ও হয়রানি বিষয়ে নতুন জ্ঞান উৎপাদন করে, নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়। কিন্তু আইনের ক্ষেত্রে, আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে এবং কাউন্সেলিং-এর ক্ষেত্রে পেশাদারদের নিয়োগ করাই সংগত। নারীবিদ্যাচর্চার অধ্যাপকদের ‘কাজে লাগিয়ে’ এইসমস্ত সমস্যার সমাধান করতে গেলে বিড়ম্বনা অনেকসময় বাড়ে বই কমে না। নারীনিগ্রহের বিরুদ্ধে পথে নামা এক ধরনের সক্রিয়তা, তা নিয়ে গবেষণা করা আরেক ধরনের সক্রিয়তা, কিন্তু তার বিচার করার জন্য পেশাগত দক্ষতা প্রয়োজন। পেশাগত দক্ষতার প্রসঙ্গটি একটু বিশদভাবে আলোচনা করা যাক। নারীবিদ্যাচর্চার সঙ্গে নারী আন্দোলনের আন্তঃবিষয়ক সখ্য আছে, কিন্তু বিচার ব্যবস্থা সেই সখ্যের বৃত্তের মধ্যে সরাসরিভাবে পড়ে না। নারীবাদী বিদ্যাচর্চা ও নারী আন্দোলনের মধ্যে এক অনন্য সম্পর্ক রয়েছে কারণ দুই ক্ষেত্রেই ক্ষমতার রাজনীতি একটি প্রধান বিষয়। নারীবাদী আন্দোলন যদি পথে নেমে অন্যায়ের প্রতিবাদ ও অধিকার অর্জনের পরিসর হয়, নারীবাদী বিদ্যাচর্চাও বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনন্দিন জীবনের ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে লড়াই ও সাময়িক আপসের পরিসর। এই পরিসরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করাটাও নারীবাদী আন্দোলনের অঙ্গ। এই কারণেই পেশাদারি দক্ষতার প্রয়োজনীয়তাকে বিশদভাবে আলোচনা না করলে আন্দোলন ও বিদ্যাচর্চার অনন্য সম্পর্কটি নিয়ে নানা সন্দেহের অবকাশ থেকে যেতে পারে।

যৌন হয়রানি বা নিগ্রহের বিচার করা এবং এই ধরনের হিংসার শিকার যাঁরা হয়েছেন তাঁদের কঠিন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য পেশাদারি জ্ঞানের প্রয়োজন আছে। আইন একটি বিষয় এবং তা একটি নির্দিষ্ট পাঠক্রমের মধ্য দিয়ে পড়ে তার প্রয়োগ করার অধিকার অর্জন করতে হয়। হয়রানি বা নিগ্রহের ফলে যে মানসিক সংকট উপস্থিত হয় তার সঠিক শুশ্রূষা করার জন্যেও মনোবিজ্ঞান পড়তে হয় এবং বিশেষ দক্ষতা অর্জন করতে হয় তার প্রয়োগের জন্য। কাজেই আইন ও মনোবিজ্ঞান প্রয়োগ করার বিশেষ দক্ষতা যাদের নেই তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে যৌন হয়রানি ও যৌননিগ্রহ সংক্রান্ত ঘটনার বিচার করতে দেওয়াটা সুষ্ঠু ব্যবস্থা হতে পারে না। বিচার করা ও বিধান দেওয়ার জন্য একটি বড় সমিতি গঠন করা দরকার যার মধ্যে শিক্ষক/কর্মী/ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আইনজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানীরাও থাকবেন। তেমন সমিতির অনুপস্থিতিতে কেবলমাত্র নারীবিদ্যাচর্চার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের ‘কাজে লাগিয়ে’ বিচার করানো দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়।

তাহলে কি ব্যাবহারিক জীবনে দৈনন্দিন নারীবিদ্বেষের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের লড়াইকেও বিচার বিভাগের আওতার মধ্যে ফেলতে হবে? ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী, গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর মধ্যে ভারতের নারীবাদী আন্দোলন সাতের দশক থেকেই আইনি অধিকার ও সুরক্ষার পথে হেঁটেছে। তার সুফল হিসেবে নারীবাদী আইনজ্ঞরা বর্তমান সমাজজীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন। আইন সম্পর্কে সচেতনতা এবং আইনের সংশোধন নিয়ে আলোচনা নারীবাদী আন্দোলনের প্রধান অংশ। স্বাভাবিকভাবেই ন্যায়বিচার ও আইন প্রণয়ন/প্রয়োগের সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে নারীবাদী বিদ্যাচর্চার মধ্যেও নতুন জ্ঞান-উৎপাদন হয়েছে। গার্হস্থ্য হিংসা, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি, সম্পত্তির অধিকার সংক্রান্ত আইনগুলি দীর্ঘ গবেষণা ও লড়াইয়ের ফল। এর সঙ্গে সঙ্গে আইন ব্যবস্থার পরিকাঠামো নিয়েও নারীবাদীরা নানা গঠনমূলক সমালোচনার অবতারণা করেছেন। আইনি অধিকার এবং অধিকার সুরক্ষা যে একটি সচল বিষয় তা এই সমালোচনার মাধ্যমে বার বার প্রতিভাত হয়েছে। এই কারণেও পেশাগত দক্ষতার সঙ্গে আন্দোলন ও বিদ্যাচর্চার সম্পর্ক নারীবাদী রাজনীতিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পথের আন্দোলন আর প্রতিষ্ঠানের গবেষণা নারীবিদ্যাচর্চার এই অনন্য সেতুবন্ধনে আবদ্ধ। পরবর্তী অংশে এই নিয়ে কিছু আলোচনা করে এই প্রবন্ধ শেষ করব।

হায় পথবাসী, হায় গৃহহারা

খ্যাতনামা নারীবাদী গবেষক ওয়েন্ডি ব্রাউন ২০০৫ সালে নারীবিদ্যাচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক রূপায়ণের বিষয়ে কয়েকটি সংগত প্রশ্নের অবতারণা করেন। ইংরেজিতে লেখা ব্রাউনের ‘এজওয়ার্ক’ থেকে স্ব-অনূদিত একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি।১২

বিগত দুই দশকে সত্তা পরিচয় ও সীমান্ত নির্দেশের ক্ষেত্রে বুনিয়াদি গবেষণায় নারীবাদী জ্ঞানচর্চা যথেষ্ট কৃতিত্ব অর্জন করেছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে নারীবিদ্যাচর্চার বৌদ্ধিক পরিসর কীভাবে নির্মিত হবে? জ্ঞানচর্চার অন্যান্য পরিসর থেকে নারীবিদ্যাচর্চা নিজেকে আলাদা করবে কীভাবে? কীভাবেই-বা নারীবিদ্যাচর্চার সীমানা নির্দেশিত হবে?১৩

এই প্রশ্নগুলি, ব্রাউনের কথামতো, কেবলমাত্র অলংকার বা বিমূর্ত নয়। এগুলি দৈনন্দিন ব্যাবহারিক জীবনের সমস্যা। এই প্রশ্নগুলি নিয়ে আগের অধ্যায়ে কিছু আলোচনা করেছি। ব্রাউনের প্রশ্নগুলির বৈশিষ্ট্য হল যে এগুলি তোলা হচ্ছে এক বিশেষ হতাশার প্রেক্ষাপটে। এই হতাশা, ব্রাউনের সামগ্রিক আলোচনায়, তৈরি হয়েছে নারীবাদের মুক্তি আকাঙ্ক্ষার রাজনীতি বর্তমান নারীবিদ্যাচর্চায় হারাতে বসায়। ব্রাউন জানাচ্ছেন যে, ১৯৬০ ও ৭০-এ নারীবাদ এক মুক্তির দর্শনে বিশ্বাসী ছিল, এক বৈপ্লবিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নারীবাদীদের চালিত করত। এই বৈপ্লবিক দর্শন ১৯৮০-র থেকে ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে। নানা কূটতর্কে জর্জরিত হয়ে, প্রাতিষ্ঠানিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে মুক্তির দর্শন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গত তিরিশ বছর ধরে। ব্রাউনের মতে প্রাদেশিকতা, জাতিসত্তার রাজনীতি ও যৌনতার রাজনীতি ক্রমশ নারীমুক্তি ও নারীস্বাধীনতার প্রাথমিক লক্ষ্যকে কুয়াশাচ্ছন্ন করে তুলেছে। তিনি বলছেন, ‘তৃতীয় বিশ্ব’ ‘জাতিসত্তা’ বা ‘যৌনতা’ (যা কেবল যৌনহিংসা নয়) নিয়ে সমালোচনামূলক গবেষণা ক্রমশ মুক্তিকামী দর্শনকে প্রথম বিশ্বের সাদা মানুষদের (মূলত নারীদের) আত্মপ্রশ্রয়কারী এক হঠকারী চিন্তাধারা বলে দাগিয়ে দিয়েছে। এর ফলে নতুন যুগের নারীবিদ্যাচর্চায় নিয়োজিত গবেষকের দল লিঙ্গবৈষম্যকে কতভাবে স্থাপন করা হয়, কতভাবে তার মোড় ঘোরানো যায়, কতভাবে তার বৃদ্ধিকে চিহ্নিত করা যায়, তার রূপান্তরটাকে বুঝে ওঠা যায়— তা নিয়ে আলোচনা করে, কিন্তু কী করে তা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় সেই সম্পর্কে আশ্চর্যরকমভাবে নীরব থাকে।

ব্রাউনের প্রশ্নগুলি ভারতে নারীবিদ্যাচর্চার প্রেক্ষিতে এক অন্য ধরনের তাৎপর্য গ্রহণ করে। নারীবিদ্যাচর্চার সঙ্গে নারী আন্দোলনের সম্পর্ক বা আন্দোলনের চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে নারীবাদী নিরীক্ষণ এই প্রশ্নগুলিকে চালিত করেছে বলে আদৌ মনে হয় না। প্রশ্নগুলি তাই প্রাসঙ্গিক হয়েও বার বার মনে করিয়ে দেয় নারীবাদের রাজনীতির মধ্যে নিহিত ক্ষমতার বৈষম্যের কথা। ব্রাউনের প্রশ্নগুলি তাই হতাশার খেদোক্তি হয়ে ওঠে, নতুন ভাবনা ভাবার কাজে অনুপ্রেরণা জোগায় না। ব্রাউন তাই যখন ‘Impossibility of Womens’ Studies’ নামে প্রবন্ধ লেখেন সেটি প্রথম বিশ্বের নারীবাদের মুক্তির দর্শনের শ্রাদ্ধবাসরে পরিণত হয়। ব্যাবহারিক জীবনে নিত্যনতুন লড়াইয়ে ব্রাউনের স্বপ্নের নারীমুক্তির কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই।

প্রথম বিশ্বের নারীমুক্তির দর্শনের বেলুনটিকে ফুটো করে দিয়েছিল আটের দশকে লেখা বেশ কিছু যুগান্তকারী গবেষণাপত্র। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক ১৯৮১ সালে লেখেন ‘French Feminism in an International Frame’। এই প্রবন্ধে ইউরো-আমেরিকান নারীবাদকে প্রবল সমালোচনা করা হয়। প্রথম বিশ্বের সাদা নারীবাদীদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয় যে তারা নব্য সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাধারায় আচ্ছন্ন।১৪ ১৯৮৮ সালে চন্দ্রা তালপাড়ে মোহান্তির ‘Under Western Eyes’ পশ্চিমি প্রথম বিশ্বের নারীবাদকে চিহ্নিত করে সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক চিন্তাধারার বাহক রূপে।১৫ এই গবেষণাপত্রগুলি জোর দিয়ে বলে, পশ্চিমি নারীবাদকে স্বীকার করে নিতে হবে যে পশ্চিমি জ্ঞানচর্চার বাইরেও নারীবাদের ব্যাখ্যা সম্ভব, স্বীকার করে নিতে হবে যে নারীমুক্তির দর্শন পশ্চিমি প্রথম বিশ্বের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়।

যতই নারীমুক্তির দর্শনের পশ্চিমি আধার ভেঙে পড়তে থাকে ততই রক্ষণশীল পশ্চিমি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত নারীবাদীরা হতাশায় ডুবতে থাকেন। বিভিন্নতাকে মেনে নিয়ে নতুনভাবে স্বাধীনতার আলোচনা করতে তাঁরা অক্ষম হয়ে পড়েন। ব্রাউনের নারীমুক্তির একটি বাঁধাধরা পথ ছিল এবং পথের শেষে কাম্য মুক্তির একটি মূর্তি ছিল। অর্ধেক পথ অতিক্রম করার পর যখন তাঁদের দেখিয়ে দেওয়া হল যে বাঁধাধরা পথটি ভুল এবং পথের প্রান্তে কোনও মুক্তির নিশ্চিন্ত আশ্বাস নেই, তখন তাঁদের অনেকেই নতুন দিক্‌নির্দেশের কাজে শামিল হতে পারলেন না। নারীবাদের ইতিহাস ব্যাখ্যার সময় জোয়ান স্কট এই হতাশার মনোভাবকে Melancholia-র সঙ্গে তুলনা করেছেন। স্কট লিখেছেন,

এমন এক ঘরের জন্য মন কেমন করা, যেটা আগে কখনও ছিলই না, তাকেই বলে Melancholia। আমরা অদূর অতীতে নারীকেন্দ্রিক রাজনীতির যে তীব্র অভিজ্ঞতাকে ঘিরে বেঁচেছি তাকে পুজো করতে গিয়ে বর্তমানে যে নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভাবন হয়েছে তাকে স্বাগত জানাতে ভুলে গিয়েছি… বিগত যুগকে ফিরে দেখার প্রয়োজন আছে বর্তমানের স্থিতাবস্থাকে নাড়িয়ে দেবার জন্যে… অভাবনীয়কে সম্ভব করে তোলার জন্য।১৬

স্কটের উক্তি ব্রাউনের হতাশার সুরের বিপরীতে অবস্থিত। নারীবাদের মধ্যে অন্তর্নিহিত এই বিভিন্ন স্বরকে মর্যাদা দেওয়াকেই গত দু’ দশকের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। নারীমুক্তির তত্ত্ব, দর্শন এবং নারী আন্দোলনের ইতিহাস পঠনের মধ্যে বিভিন্ন স্বরকে মনে রাখা এই কারণেই জরুরি। পথের প্রান্তের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের বদলে পথে নামার ও পথ চলার উত্তেজনাকে নারীবিদ্যাচর্চার মূল অনুপ্রেরণা বলে ভেবে নিতে পারলে প্রাত্যহিক সমস্যার সঙ্গে যুদ্ধ করাটাও অনেক সহজ হয়ে যাবে। গৃহের গণ্ডি ভেঙে পথে নেমে পড়ার পর যদি কেবলই ফেলে আসা সাময়িক আশ্রয়গুলির জন্য মন কেমন করে, হতাশায় ভারাক্রান্ত হয়ে পথের সঙ্গীদের দোষারোপ করা শুরু হয়— তা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু তা কাম্যও নয়। গৃহহারা পথবাসী নামটি শিরোধার্য করে নিতে পারলে আন্দোলন, চর্চা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বার বার নূতন সম্পর্ক তৈরি করার কাজটাও হয়তো দুর্লঙ্ঘ্য মনে হবে না।

উপসংহার

জাক দেরিদা ১৯৮৪ সালে পেমব্রোক সেমিনারে বলেছিলেন, ‘যতদিন না নারীবিদ্যাচর্চা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিকতাকে প্রশ্ন করবে, ততদিন তারা বিশ্ববিদ্যালয় নামক মৌচাকের একটি খোপ হয়েই থেকে যাবে।’ বিশ্বখ্যাত পণ্ডিতের সাবধানবাণীর মূল্য অপরিসীম, বিশেষ করে নারীবিদ্যাচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক সংকট নিয়ে দুশ্চিন্তা করে যাদের দিন কাটে তাদের কাছে। সাফল্য আর ব্যর্থতার নাগরদোলায় চড়ে মুহুর্মুহু উঠতে-নামতে থাকাটা নারীবিদ্যাচর্চার সঙ্গে যুক্ত সকলের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা। ঠিক যেমন জোয়ান স্কট স্মরণ করিয়ে দেন অনতি অতীতে নারীবাদীচর্চা আর নারী আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলি ১৯৬০-৭০-এর সোনার সময়, তেমনই আজকের টালমাটাল দিনে প্রত্যহ লড়াই করে নারীবিদ্যাচর্চার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি ছিনিয়ে নেওয়াটাও এই পর্বের সোনার সময় হয়ে একদিন হয়তো স্মৃতির পাতায় ঠাঁই পাবে। স্মৃতিকে উজ্জ্বল করে রাখার দায়িত্ব কাঁধে নিতে গেলে সবসময় মনে রাখতে হয় বাঁধাগর্তে যেন পড়ে না যাই। আবার এও ভাবতে হয় যে, ছন্নছাড়া উত্তরাধিকার আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রেখে গেলে তারা কি আমাদের ক্ষমা করবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সিস্টেম’-এ নারীবিদ্যাচর্চাকারীরা একইসঙ্গে বহিরাগত ও অন্তর্ভুক্ত। এই নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই চালিয়ে যেতে যেতে মনে রাখতে হয় সামগ্রিক মুক্তির রাজনৈতিক দর্শনকে, মনে রাখতে হয় জ্ঞানচর্চার গজদন্তমিনারকে ভেঙে ফেলে তার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতিকে। অবশ্য এই নিয়ে অনুযোগ করতে গেলে দেরিদার সাবধানবাণী মনে করিয়ে দেয়— জ্ঞানচর্চার নারীবাদী নিরীক্ষণ আর আন্দোলনের সঙ্গে নারীবিদ্যাচর্চার সম্পর্কের নতুনতর ব্যাখ্যা যে সহজ কাজ নয়, এই সহজ কথাটা কি জানা ছিল না?

পরিশেষে, বহুচর্চিত সান্ত্বনাবাণীকে একবার স্মরণ করি— এই সমস্যার সমাধান রাতারাতি হবে না, বা কোনও জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় সঠিক পথের হদিশ মিলবে না। প্রজন্মের পর প্রজন্মে আদর্শ, চিন্তাধারা ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসূচির পরিবর্তন ঘটবে। পরিবর্তন ঘটাই কাঙ্ক্ষিত। বর্তমানে দাঁড়িয়ে ভারতের নারীবিদ্যাচর্চার যদি কোনও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে হয় তাহলে বলা ভাল যে প্রতিটি প্রজন্ম তাঁর পরবর্তী প্রজন্মকে নিজেদের অভিজ্ঞতার নির্যাস দিয়ে যায়, তার কতটা কাজে লাগবে সেটা যারা ব্যবহার করবে তাদের ভাবতে দেওয়াই ভাল। হারিয়ে যাওয়া ‘সোনার সময়’-এর জন্য শোকপ্রস্তাব নারী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ হতে পারে না। সে-কারণে ভুল স্বর্গের জন্য খেদোক্তি নারীবিদ্যাচর্চার পথচলার সম্বল হতে পারে না। পরিবর্তনকে সত্য মেনে নিয়ে মিশেল ফুকোর এই উক্তিটি উদ্ধৃতি করার লোভ সামলানো গেল না—

Do not ask me who I am and do not ask me to remain the same: leave it to our bureaucrats and our police to see that our papers are in order. At least spare us the morality when we write.১৭

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

. তনিকা সরকারের অনেক উল্লেখযোগ্য গবেষণার মধ্যে দু’টি গ্রন্থ প্রায় অপরিহার্য, Words to Win: The Making of Modern Autobiography (New Delhi: Kali for Women, 1999) এবং Hindu Wife, Hindu Nation: Community, Religion, and Cultural Nationalism (New Delhi: Permanent Black, 2003)। উমা চক্রবর্তীর গবেষণা গ্রন্থগুলির মধ্যে Gendering Caste: Through a Feminist Lens (Kolkata: Stree, 2003) অবশ্য পাঠ্য। নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রমের লিঙ্গবিভেদ সংক্রান্ত বহু গবেষণাপত্র, শমিতা সেনের Women and Labour in Late Colonial India: The Bengal Jute Industry (Cambridge: Cambridge University Press, 1999), রাজেশ্বরী সুন্দর রাজনের Real and Imagined Women: Gender, Culture and Postcolonialism, (London: Routledge, 1993) এবং The Scandal of the State: Women, Law, Citizenship in Postcolonial India (Durham: Duke University Press, 2003), মেরি জন ও জানকি নায়ার সম্পাদিত A Question of Silence: The Sexual Economies of Modern India (New Delhi: Kali for Women, 1998) ভারতে নারীবিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে কয়েকটি দিক বদল করা কাজ।

. Rekha Pappu, ‘Constituting a Field: Women’s Studies in Higher Education’, Indian Journal of Gender Studies, 2002, 9 (2): 221-34.

. Vina Mazumder, Women Studies in India. Ed. Bharati Ray, Women’s Studies in the Emergent Indian Scenario, (Calcutta: Calcutta University Press,1990), p. 5.

. মেরি জন তাঁর সম্পাদিত Women’s Studies in India: A Reader (New Delhi: Penguin. 2005, pp. 1-19)-এর ভূমিকায় এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

. রাকা রায়ের Fields of Protest: Women’s Movements in India (New Delhi: Kali for Women, 2000) গ্রন্থে সাতের দশকের শেষে কলকাতা এবং মুম্বাইয়ের নারী সংগঠনগুলি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে। এই দুই শহরের নারী আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির তুলনামূলক আলোচনা করে রাকা রায় দেখিয়েছেন যে, এইসময় থেকে নারী সংগঠনগুলি তাদের স্থানীয় রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে নারীবাদী আদর্শ ও আন্দোলনকে ব্যাখ্যা করা শুরু করে। নারীবিদ্যাচর্চাও এই বিভিন্নতার যৌক্তিকতা মেনে নিয়েই শুরু হয়।

. ভারতের স্বাধীন নারী আন্দোলনের ইতিহাস জানার জন্যে পাঠক-পাঠিকা পড়তে পারেন কল্পনা কান্নাবিরন ও রিতু মেনন সম্পাদিত From Mathura to Manorama: Resisting Violence Against Women in India (Delhi: Women Unlimited, 2007)।

. Radha Kumar, The History of Doing: An Illustrated Account of Movements for Women’s Rights and Feminism in India, 1800-1990 (New Delhi: Kali for Women, 1993), p. 110.

. Flavia Agnes, ‘Protecting Women Against Violence? Review of a Decade of Legislation, 1980–89’, Economic and Political Weekly, 1992, 27 (17): WS19–WS33.

. উৎসাহী পাঠিকা এই দলিলটি দেখতে পারেন: http://www.ugc.ac.in/oldpdf/xiplanpdf/womenstudies.pdf (লিঙ্কটি ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ শেষবার খুলে দেখা হয়েছিল)।

১০. আন্দোলনের চর্চা বলতে আমি ইংরেজিতে যাকে ‘সোশ্যাল মুভমেন্ট স্টাডিজ’ বলে তা বোঝাতে চাইছি। চার্লস টিলি, সিডনি টারো, ডাগ ম্যাকঅ্যাডাম, ফ্রাঞ্চেস্কা পলেত্তা, ডেভিড স্নো গত শতকের নয়ের দশক থেকে এই বিষয়ে অনেক নতুন আলোচনার রাস্তা খুলে দিয়েছেন। এই বিষয়টি এখন সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে রীতিমতো চর্চিত হয়ে থাকে।

১১. ঐতিহাসিক জোয়ান স্কটের দু’টি প্রবন্ধ, ‘On Language, Gender and Working-Class History’, International Labour and Working-Class History, 1987, 31, pp. 1-13 এবং ‘Gender: A Useful Category of Historical Analysis’, The American Historical Review, 1986, 91, 5, pp. 1053-1075 এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিত জানার জন্যে অপরিহার্য। স্কটের Gender and the Politics of History (New York: Columbia University Press, 1988) গ্রন্থের একটি অধ্যায় (Women in The Making of English Working Class) ই.পি. টমসনের বিখ্যাত গবেষণাগ্রন্থটির একটি সুচারু নারীবাদী সমালোচনা আমাদের উপহার দেয়। এই অধ্যায়টি অগ্রবর্তী অধ্যাপকের পুরুষপ্রধান আলোচনার ভঙ্গি নির্ভুলভাবে দেখিয়ে দেয়, তাঁর গবেষণার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই।

১২. পরবর্তীতে এই বই থেকে যা উদ্ধৃতি দেব সবগুলিই আমার অনুবাদ করা। অনুবাদের কারণে মূল লেখার গভীরতা কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ণ হয়। তারজন্য আগাম ক্ষমাপ্রার্থনা করে রাখছি।

১৩. Wendy Brown, Edgework: Critical Essays on Knowledge and Politics (Princeton: Princeton University Press, 2005), p. 117.

১৪. Gayatri Chakravorty Spivak, ‘French Feminism in an International Frame’, Yale French Studies, 1981, 62: 154-84.

১৫. Chandra Talpade Mohanty, ‘Under Western Eyes: Feminist Solidarity and Colonial Discourses’, Feminist Review, 1988, 30: 61-88.

১৬. Joan W Scott, ‘Feminism’s History’, The Feminist History Reader, ed. Sue Morgan (London: Routledge, 2006), p. 393.

১৭. Michel Foucault, Archaeology of Knowledge, trans. A.M. Sheridan Smith. (London: Routledge, 2002.), p. 19.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *