সান্টা বারবারায় এইতো কিছুদিন আগে বাইশ বছরের একটা ছেলে ছ’জন মানুষকে মেরে ফেলেছে, নিজেকেও মেরেছে। ঘরের মধ্যে তিনজন রুমমেটকে কুপিয়ে মেরেছে, আর বাকিদের মেরেছে ঘরের বাইরে, গুলি করে। খুনীর নাম এলিয়ট রজার। এলিয়ট রজার অনেকদিন ধরে ছক কষচিল মানুষ মারার, বিশেষ করে মেয়েদের। একশ চলি্লশ পৃষ্ঠার একটা ইস্তেহারও দীর্ঘদিন ধরে লিখেছে সে, ভিডিওও পোস্ট করেছে ইউটিউবে তার খুন করার সাধ-আহলাদ বর্ণনা করে। তার ভাষ্য হচ্ছে, বাইশ বছর বয়স, এখনও কোনও মেয়ের সঙ্গে তার সেঙ্ হয়নি, মেয়েরা তার সঙ্গে প্রেম করছে না, তার সঙ্গে শুচ্ছে না। অথচ অন্য পুরুষদের সঙ্গে দিব্যি সবই করছে। তার নিঃসঙ্গতা, তার একাকীত্ব, তার প্রেম এবং যৌনসম্পর্ক না জোটার জন্য সমস্ত দোষ সে মেয়েদের দিয়েছে, সুতরাং সব মেয়েদের সে খুন করবে, পুরুষদেরও সে খুন করবে, কারণ পুরুষগুলোই ছিনিয়ে নিয়েছে সব মেয়েদের, যে মেয়েদের পাওয়ার অধিকার তার ছিল। পুরুষ হিসেবে সে এত আকর্ষণীয়, তারপরও মেয়েরা তাকে আকর্ষণীয় বলে মনে করছে না। এর শোধ সে নেবেই নেবে।
এলিয়ট যদি সুযোগ পেতো তাহলে আরও মানুষকে সে হত্যা করতো। কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখে নিজের ওপর গুলি চালিয়েছে, সুতরাং তার আর মানুষ মারা হয়নি। এখন খুনীদের বেলায় যা সাধারণত খোঁজা হয়, তা হলো মানসিক অসুস্থতা আছে কি না। এলিয়টের ক্ষেত্রেও মানসিক অসুস্থতার কথা বলা হচ্ছে। মানসিক অসুস্থ রোগীটি কিন্তু তিন তিনটে বন্দুক এবং শত শত গুলি কিনে ফেলেছে যদিও ক্যালিফোর্নিয়ায় অত সহজ নয় বন্দুকের লাইসেন্স পাওয়া। পুলিশও কয়েক মাস আগে দেখে এসেছে, ছেলে নাকি রীতিমত ভদ্র, সজ্জন, আর বলা বাহুল্য, ভীষণই সুস্থ। খুন করার পরই মাথা ঠিক কী ঠিক নেই, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। মাথা ঠিক না থাকলে সাত খুন মাফ। এলিয়ট নিজেকেসহ সাতটি খুনই করেছে। আর তার ‘সাত খুন মাফ’ করার উদ্দেশে তার মানসিক ভারসাম্যহীনতাকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। ছেলেটার দোষ নেই, দোষ তার মাথার গণ্ডগোলের, সে কারণেই মানুষ মেরেছে। এরকমই বলতে চাইছে লোকে। কিন্তু মানসিক অসুস্থতার কারণে সে মানুষ খুন করেনি। মানসিক রোগীরা মানুষ খুন করে না। মানসিক রোগীরা যদি খুন করেই থাকে, তবে যত তারা খুন করে, তার চেয়ে সহস গুণ বেশি খুন করে মানসিকভাবে সুস্থ লোকেরা। ভয়টা সুস্থ লোকদের নিয়েই।
এলিয়টের খুন করার পেছনে আছে তার নারীবিদ্বেষ, নারী-ঘৃণা। এই নারীবিদ্বেষের উৎস হলো পুরুষতন্ত্র। যে সমাজে এলিয়ট জন্ম নিয়েছে, বেড়ে উঠেছে, সেই সমাজ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের স্থান পুরুষদের নিচে। এই সমাজে নারী পুরুষের সমতার কোনও স্থান নেই। এই সমাজে নারীরা পুরুষের ভোগের বস্তু ছাড়া আর কিছু নয়। এই সমাজ যারা তৈরি করেছে এবং আজ অবধি টিকিয়ে রাখছে, তারা নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাস করে না। নারীবিদ্বেষীরাই নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাস করে না, নারীকে ঠিক মানুষ বলে গ্রাহ্য করে না। এলিয়ট নারীদের ভোগের বস্তু বলে মনে করেছে। বলেছে, নারীদের চেয়ে সে ‘সুপিরিওর’। এ নিতান্তই পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বাস। পৃথিবীর প্রায় সব পুরুষের ধারণা বা বিশ্বাস এটিই। এলিয়ট কোনও ব্যক্তিক্রম নয়। এই নারীবিদ্বেষের কারণে সে খুন করেছে। এই নারীবিদ্বেষের কারণে রাম শ্যাম যদু মধু সবাই নারীকে খুন করে অথবা নির্যাতন করে, অথবা নারীকে ঘরে বাইরে ধর্ষণ করে, নারীকে পাচার করে, নারীকে বেশ্যালয়ে বিক্রি করে, পাথর ছুড়ে হত্যা করে, বধূ হত্যা করে, কন্যাশিশুকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলে, কিশোরীর মুখ পুড়িয়ে ফেলে এসিডে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এসব খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এসব ঘটনা ঘটাতে যা প্রয়োজন তা হলো নারী বিদ্বেষ এবং নিজেদের পৌরুষ। পৌরুষের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে আছে পুরুষ হওয়া দম্ভ।
এলিয়টের হয়তো কোনও মানসিক অসুস্থতা ছিল, কিন্তু আমি মনে করি না সেই অসুস্থতা তার নারী বিদ্বেষের, এবং নারী হত্যার সিদ্ধান্তের জন্য সামান্যও দায়ী। এর আগেও অনেক পুরুষ একই কাজ করেছে। হয় নাগারে নারী হত্যা করেছে, নয়তো একের পর এক নারী ধর্ষণ করেছে। তাদের কিন্তু মানসিক রোগী বলে চিহ্নিত করা হয়নি। এখনও যে পুরুষেরা ঘরে ঘরে নারী নির্যাতন চালায়, তাদেরও তো মনোরোগে আক্রান্ত বলে মনে করা হয় না, কেউ কেউ তাদের মন্দ লোক বলে। আবার কোনও কোনও সমাজে তাদের পুরুষের মতো পুরুষ বলে বাহবা দেওয়া হয়। বলা হয় : ‘পুরুষরা তো শাসন একটু করবেই।’ নারীর চেয়ে পুরুষ বেশি মেরেছে বলে অনেকে বলছে এলিয়ট নারীবিদ্বেষী ছিল না। যারা বলছে এমন কথা, তারা নিশ্চয়ই এলিয়টের পোস্ট করা ভিডিও দেখেনি অথবা তার একশ চলি্লশ পাতার ইস্তেহার পড়েনি। ওসবে উথলে উঠছে নারীর প্রতি তীব্র ঘৃণা। স্পষ্ট করেই বলা আছে যে সে মেয়েদের খুন করবে কারণ মেয়েরা তাকে ভালোবাসেনি, এবং সেই ছেলেদেরও খুন করবে কারণ মেয়েরা তাদের ভালোবেসেছে। কী ভয়ংকর নারীবিদ্বেষ!
দু তিনবছর আগে বলা নেই কওয়া নেই এলিয়ট রজার একটা চুম্বনরত দম্পতির ওপর গরম কফি ছুঁড়ে মেরেছিল। মেয়েরা তার সঙ্গে না শুয়ে অন্যের সঙ্গে শুচ্ছে, এটা তার সহ্য হতো না। নারীর অধিকারে এলিয়ট কখনও বিশ্বাস করতো না। বিশ্বাস করলে নারীদের যে অধিকার আছে তাকে পছন্দ না করার, সেটায় সে বিশ্বাস করতো। আড়াই বছর ধরে সে কলেজে যাতায়াত করছে, কিন্তু এখনও মেয়ে নামক ভোগের বস্তু জোটেনি, এই রাগ তার গিয়ে পড়েছে ভোগের বস্তুর ওপর। ঘরে ঘরে স্বামীদেরও তো একই রাগ, আমি স্বামী, আমিই তো সেঙ্রে জন্য তোমার শরীরে জোর খাটাবো নাকি অন্য লোক খাটাবে? আমারই তো অধিকার আছে যখন খুশি তোমাকে ভোগ করার! তা না হলে আমি স্বামী কেন! আবার ওদিকে বেশ্যালয়েও একই অধিকার পুরুষের, খরিদ্দারের অধিকার, ‘তোরা বেশ্যা, তোদের যেমন ইচ্ছে ভোগ করার অধিকার আমাদের, তোদের মুখ বুজে সইবি বলেই তো তোরা বেশ্যা।’ আবার রাস্তা ঘাটে মেয়েদের যৌন নির্যাতন করার অধিকারও রাস্তার পুরুষের একশ ভাগ আছে বলে ভাবা হয়। মেয়েরা পৃথিবীর কোথাও নিরাপদ নয়। ধরা যাক এলিয়টের সত্যিই মানসিক অসুস্থতা ছিল। ছিল বলেই সে কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় আরও খুন, আরও নির্যাতন, আরও অত্যাচার চালিয়ে যেতে পারেনি। যদি মানসিক অসুস্থতা না থাকতো, তাহলে ওই ছ’জনকে মেরেই সে আত্দসমর্পণ করতো না। বরং আরও মারতো। অথবা অন্যভাবে মারতো, মারার কোনও চিহ্ন রাখতো না। মানসিক অসুস্থতা না থাকলে সে নির্দোষ_ এই ভাব দেখাতো, ইউটিউবে নারীবিদ্বেষী ভিডিও পাঠাতো না, নারীবিদ্বেষী ইস্তেহারও লিখতো না, বরং এখানে সেখানে নারীর সমানাধিকারে সেও বিশ্বাস করে, এরকম বলে বেড়াতো।
অসুস্থতা থাকার কারণে এলিয়ট ছিল কম ভয়ংকর। আসলে এলিয়ট রজাররা আমাদের চারপাশেই বাস করছে। তাদের সঙ্গেই ওঠা বসা করছি, প্রতিদিন তাদেরই দেখছি, তাদের সঙ্গেই কথা বলছি, তারাই আমাদের বন্ধু, আত্দীয়। পুুরুষতান্ত্রিক সমাজের সমস্ত পুরুষেরই প্রতিনিধি এলিয়ট রজার। মাথায় অসুস্থতা ছিল বলেই তাকে অকালে মরতে হল। অসুস্থতা না থাকলে একই কাজ যা সে করেছে, অথবা এর চেয়েও বড় কাজ দক্ষ হাতে করতে পারতো। কেউ ধরতেই পারতো না।