তত্ত্ব ও ধারণার রাজনীতি
পরিচিতির রাজনীতি
উপস্থাপনের রাজনীতি
অনুভূতির রাজনীতি

নারীবাদের নানা কথা: ডিসিপ্লিনের ঘেরাটোপ আর লঙ্ঘনের রাজনীতি – অনির্বাণ দাশ

নারীবাদের নানা কথা : ডিসিপ্লিনের ঘেরাটোপ আর লঙ্ঘনের রাজনীতি – অনির্বাণ দাশ

রাজনীতির চরিত্র, খুব বড় করে ভাবলে, দু’রকম হতে পারে— কোন উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে, তার নিরিখে। এক, যেমনটা চলছে তাকে ধরে রাখার জন্য— সংরক্ষণশীল। দুই, তাকে বদলানোর জন্য— পরিবর্তনকামী। যদি মনে করি চলতি ব্যবস্থার ভিতরে নারীর প্রতি যে বৈষম্য, অত্যাচার কিংবা অবহেলা চলতে থাকে তাকে পালটানোর চেষ্টাই এর কর্তব্য তবে নারীবাদ ওই দ্বিতীয় ধরনের রাজনীতি। অথচ, অন্য যেকোনও রাজনীতির মতোই, তাকেও কাজ করতে হয় চলতি ব্যবস্থার ঘেরাটোপের ভিতর থেকে। এমন নয় যে ভিতরে থেকে যাওয়াটাই তার নিয়তি কিংবা বাধ্যতা। কিন্তু শুরুটা করতে হয় ওই ভিতর থেকেই। বর্তমানের ছোঁয়াচ বাঁচানো নিরালম্ব কোনও ভূমি তার নেই যেখানে পুরুষপ্রাধান্য তার কাজে প্রভাব ফেলতে অপারগ। যেখানে দাঁড়িয়ে তার কাজের শুরু সেই ভূমির টানকে, শুধু অস্বীকার নয়, পেরিয়ে যাওয়াটাই নারীবাদের চ্যালেঞ্জ। আর তাই, নারীবাদী রাজনীতির জানা-বোঝা নৈতিকতার চলন বুঝতে গেলে চোখ ফেরাতেই হবে ঘেরাটোপ আর লঙ্ঘনের পারস্পরিকতায়। লেখাপড়া আর চিন্তার পরিসরে ভাবতে হবে ডিসিপ্লিনের ঘেরাটোপ আর লঙ্ঘনের রাজনীতির টানা-পোড়েন নিয়ে।

‘নারীবাদে পুরুষেরা’ এ বিষয়ে ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত একটি বইতে দেরিদার লেখার শিরোনাম ছিল ‘মৌচাকে নারীরা: জাক দেরিদার সঙ্গে একটি সেমিনার’ (ইংরেজিতে, ‘উইমেন ইন দ্য বিহাইভ: এ সেমিনার উইথ জাক দেরিদা’)। দেরিদার লেখা লিখলাম বটে, দেরিদা কিন্তু এটি লেখেননি। তার মৌখিক সাক্ষাৎকারটির লিখিত রূপ দেন উপস্থিত ছাত্রেরা। আংশিক অনুবাদ আর সম্পাদনাও করেন তাঁরা।

একভাবে ভাবলে, যেকোনও লেখাতেই যিনি লিখছেন তাঁর লেখাটা সম্ভব হচ্ছে, হয়ে উঠছে, ভাষা আর চিন্তার উপস্থিত— পূর্বতঃসিদ্ধ— পরিসরের ভিতরে। লেখকের নাম যে স্বত্ব আর কর্তৃত্বের ছাপ দেগে দেয় একটি লেখার উপর (আমার লেখা, আমি বদলাতে পারি, বেচতে পারি, না ছাপতে পারি) তার মধ্যে একটু জোর করার উপাদান আছে। লেখকের অভিপ্রায় অতখানি নির্ধারক হয়তো নয়। সামাজিকভাবে নির্মিত ভাষার চলন ওই অভিপ্রায়কে নিয়ত প্রতিসরিত করে চলে। আমার লেখা কখনওই পুরোপুরি আমারই নয়। যা আমি নয়, যা আমার বাইরে, সেই অপর, আমার লেখাকে ক্রমাগত তৈরি করে চলে।

এর মানে এই নয় যে লেখাটা শুধুই অপরের। এটা ঠিক যে আমি যা বলতে চাইছি, চাইছি বলে ভাবছি, সেই ভাবনাটাই তৈরি হয় একটা ভাষা ব্যবস্থার ভিতরে, ভাষাকাঠামোর, ভাষার চলনের নিয়ম মেনে। ভাষা আর মতাদর্শের কাজ আমার অভিপ্রায়ের নিয়ামক। কিন্তু একমাত্র নির্ধারক নয়। আমি, এই শব্দার্থটি, এর অস্তিত্ব তো ওই ব্যবস্থারই নির্মাণ। আমার ভাবনা আর অভিপ্রায় ওই ব্যবস্থার ভিতরেই এক স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে চিহ্নিত। এই অভিপ্রায়ের ভার আমার লেখার ভিতরে অনপনেয়। আমি যা লিখি, সেই টেক্সটের ভিতরে বোনা থাকে অভিপ্রায় আর অপরের অনির্ধারণযোগ্য টানা-পোড়েন।

দেরিদার লেখা, ‘মৌচাকে নারীরা’, যেন এই টানা-পোড়েনের এক মূর্ত উদাহরণ। সাক্ষাৎকারীরা প্রশ্ন তৈরি করছেন, দেরিদা বলছেন তার উত্তর, লিখছেন ছাত্রেরা, দেরিদা লিখছেন সেই লেখা কিছু অদলবদল করে। বৈধতা আর মান্যতার স্মারক হয়ে পড়ছে দেরিদার স্বাক্ষর। অন্যসব লেখায় লেখকের স্বাক্ষরের আড়ালে নির্মাণের যে ঘটনাগুলো লুকোনো থাকে এখানে তা প্রকাশ হয়ে পড়ছে যেন। স্বাক্ষরের ছাপ যে মান্যতার ঘেরাটোপ তৈরি করে তা যে ভিতরে ভিতরে সর্বদাই, ইতোমধ্যেই, লঙ্ঘিত লেখক আর তার নানা অপরের অনির্ণেয় টানা-পোড়েনে, লেখার সংশয়দীর্ণ কাজ যে কেবলই স্থগিত করে চলে অভিপ্রায়ের পূর্ণতাকে, এ যেন তারই সূচক। অথচ, এক্ষুনি যেটা খেয়াল করার, স্থগিত করা মানে নাকচ করা নয়। অভিপ্রায়ের কাজ, লেখার ভিতরে, অপূর্ণ বটে, অনুপস্থিত নয়। তাই, এ লেখা দেরিদারও।

নারীবাদের জায়গাটা কেমন হওয়া উচিত শিক্ষায়তনের ভিতরে, ইউনিভার্সিটিতে, ভাবছেন দেরিদা, নারীবাদী মতে। সে কি হবে প্রতিষ্ঠানের ভিতরে এক স্বতন্ত্র পরিসর, উইমেনস স্টাডিজ? তার মানে কি তবে অন্যসব বিভাগের মতো আরও একটা প্রাতিষ্ঠানিক ভাগ শুধু, নারীবাদের স্বাধীন বিচরণের একটা ঘেরা জায়গা? না কি প্রত্যেক বিভাগের ভিতরে, গোটা শিক্ষায়তনের মধ্যেই চারিয়ে দেওয়া দরকার নারীবাদী চিন্তার রাজনীতি, ডিসিপ্লিনের ঘেরাটোপের বাইরে বেরিয়ে? এতটা সহজ দুটো ভাগেও কি ভাগ করে ফেলা চলে বিষয়টাকে? নানা ডিসিপ্লিনের ভিতরে নারীবাদী অনুভব তৈরি করে তোলার জন্যও কি জরুরি নয় উইমেনস স্টাডিজের স্বতন্ত্র পরিসর? যেমন জরুরি শিক্ষায়তনের ভিতরে নারীবাদী রাজনীতির এক সার্বিক প্রবাহ ওই পরিসরের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য?

এরপর প্রশ্ন ঘুরে যাচ্ছে নারীবাদী পরিসরের স্বাতন্ত্র্যের চরিত্রের দিকে। কী হিসেবে, কীভাবে এই চরিত্র আলাদা ইউনিভার্সিটির সাধারণ পুরুষতান্ত্রিক ঘরানা থেকে? ইউনিভার্সিটি নামে ওই মৌচাকের ভিতরে আর একটা নতুন খোপ? না কি এমন কিছু যা বদলে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানের চরিত্রটাই? স্বভাবে সিদ্ধ, দেরিদা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, প্রাতিষ্ঠানিকতার সঙ্গে আইন আর নিয়মতান্ত্রিকতার যোগ। প্রতিষ্ঠানের চলতি আইন লঙ্ঘন করা মানে কি কোনও মৌল অর্থে আইনের কাজ ব্যাহত করা? না কি তা শুধু নিয়মের সঙ্গে এক নতুন সম্পর্ক স্থাপন— আইনেরই এক নতুন সম্প্রসারিত খোপ? যদি প্রথমটা হয়, মানে এক মূলগত লঙ্ঘন, তবে হয়তো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পজিটিভ চরিত্রের কথা বলা হল। এর উলটোটা যে শুধু সংরক্ষণশীল সম্প্রসারণই হতে হবে তার মানে নেই। হতে পারে এক আত্মসচেতন সাবধানি পা ফেলা, যা মনে রাখে যেকোনও লঙ্ঘনের ভিতরে লুকিয়ে থাকে অবশ্যম্ভাবী, পুনরুচ্চারণ।

তবে, প্রতিষ্ঠানের নারীবাদের ভিতরে, নারীবাদের প্রতিষ্ঠানের ভিতরে, পুরনো নিয়মের লঙ্ঘন আর নতুন নিয়ম পত্তনের টানা-পোড়েনের ভিতরেই কাজ করতে পারে নিয়মহীনতার ইউটোপীয় সম্ভাবনারা। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, ইউনিভার্সিটি, প্রতিষ্ঠান কি নারীবাদী হতে পারে? নারীবাদী প্রতিষ্ঠান কি এক অসম্ভব পরিসর, ইউটোপিয়া নয়? প্রশ্নটাকে আর এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে ভাবা চলে, এ কি ইউটোপিয়া, অসম্ভব হলেও এক স্থানাঙ্ক, না কি অমীমাংসেয় দ্বন্দ্বে ছিন্নভিন্ন কূটাভাসমাত্র, অন্ধ আকাঙ্ক্ষার জোরই যার একমাত্র অস্তিত্বহীন অবলম্বন? দেরিদা যেমন বেছে নেবেন না এর কোনওটাই। মনে রাখতে বলবেন, নিয়মলঙ্ঘনকারী ইউটোপীয় পরিসরেও থেকে যায় আইনি আকাঙ্ক্ষার রেশ। আবার যুক্তিভাঙা কূটাভাসের ভিতরে, তার অ্যাবসার্ডিটির অন্দরে, কাজ করতে পারে ইউটোপিয়ার অসম্ভব সম্ভাবনা। নারীবাদের স্বতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক পরিসর আর প্রতিষ্ঠানের ভিতরে, প্রাতিষ্ঠানিকতার ভিত আলগা করা নারীবাদী রাজনীতি পরস্পর সম্পৃক্ত শুধু নয়, একে অন্যের উপরে নির্ভরশীল, একে অন্যের অঙ্গ।

এ কথা ঠিক যে নারীবাদ শুধু নারীর জন্য নয়। নারী, পুরুষ, অন্য নানা লিঙ্গপরিচয়ের মানুষ, মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণী, এমনকী অপ্রাণ প্রকৃতির মধ্যে যে সম্পর্কগুলোর জাল বিশ্বপৃথিবী গড়ে তোলে সেসব সম্পর্কের বুনোট আর ক্ষমতার স্তরভেদ নিয়েই নারীবাদের রাজনীতির বয়ান। অথচ নারীবাদী রাজনীতিতে নারী এই পরিচিতির এক মৌল গুরুত্ব আছে। নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য, শোষণ আর হিংস্রতার নির্দিষ্ট ধরনগুলো কীভাবে অন্য ক্ষমতা-সম্পর্কদের সঙ্গে অস্তিত্বগতভাবে যুক্ত, নারী-পুরুষ ক্ষমতার ধরন কীভাবে অন্য ধরনগুলোকে তৈরি করতে থাকে, নিজেরাও তৈরি হতে থাকে ক্ষমতার অন্য ধরনগুলোর অভিঘাতে, এইসব নিয়েই নারীবাদী রাজনীতির টানা-পোড়েন। তাই, একে অন্যের নিরিখে নারী আর পুরুষ এই দুই শব্দার্থের নির্মাণ এই রাজনীতির এক প্রাথমিক কনসার্ন।

অথচ অর্থনির্মাণের রাজনীতিতে শব্দেরা অন্যোন্যনির্ভর। অন্যসব শব্দের— এমনসব শব্দের যারা ছিল, আছে কিংবা থাকতে পারে— অবলম্বন ছাড়া কোনও একটি শব্দও হয়ে উঠতে পারে না। নারী কিংবা পুরুষ কোনও পরিচিতিরই স্বয়ংসম্পূর্ণ কোনও অস্তিত্ব নেই। পূর্ণ উপস্থিতির মায়ারূপের ভিতরে পরতে পরতে অন্যসব (অসম্পূর্ণ) উপস্থিতির রেশ। তাহলে নারী-পরিচিতির উপর আধারিত রাজনীতির ভিত্তি কি প্রশ্নের মুখে পড়ল? (নারী) অস্তিত্বের নিশ্চিত সংজ্ঞাকে সন্দেহ করে কি নারীবাদী রাজনীতির কথা ভাবা সম্ভব? না কি আমরা আরও একবার ফিরে এলাম লঙ্ঘন আর ঘেরাটোপ, ছেদ আর ধারাবাহিকতার যুগপত্তায়, একের থেকে অন্যকে আলাদা করতে না পেরে।

পুরুষতন্ত্র যদি আধারিত হয়ে থাকে নারী আর পুরুষ পরিচিতির পূর্ণ ছেদের উপরে, নারীবাদ তবে পুরুষতন্ত্র থেকে নারীতন্ত্রে উত্তরণমাত্র নয় যা আবারও ওই ছেদেরই উপর নির্ভরশীল। তবে কি নারীবাদের রাজনীতি ভর করে থাকে পুরুষ আর নারী পরিচিতির ধারাবাহিকতায়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষ কোনও এক ‘মানবতা’য়? ক্ষমতার জালিকার আলাদা ধাপে থাকা দুই পরিচিতির উচ্চাবচ অবস্থান কি এরকমই অবান্তর? এতখানি সহজ বোধহয় নয় আমাদের সমাধান। নারীবাদী রাজনীতির বিকল্প ভবিষ্যৎ কেমন করে ভাবা সম্ভব যদি তাকে ভাবতে হয় এমন ভাষায় যা প্রধানত পুরুষের রচনা, যা কাজ করে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর ভিতরে, যা যেকোনও কাজে প্রধানতম ভূমিকাটি তুলে রাখে পুরুষেরই জন্য?

তবে কি ভাবতে হবে ভাষার ভিতরে ঘেরাটোপ আর লঙ্ঘনের টানা-পোড়েনের কথা? পুনরুক্তি ছাড়া তো ভাষা কাজ করতে পারে না। একটা কথা যদি একবারই বলা যেত, বার বার বলার, পুনরাবৃত্তি করার সম্ভাবনা না থাকত, তবে অসম্ভব হয়ে পড়ত ভাষার চলন। অথচ মনে রাখার, এই পুনরুক্তির মানে একেবারে একই জিনিসের বার বার ঘটে চলা নয়। প্রত্যেক পুনরাবৃত্তির ভিতরে থাকে বদলের সম্ভাবনা। একই কথা যখন দ্বিতীয় বার বলা হল, ওই দ্বিতীয়টা কিন্তু হুবহু প্রথমটার মতো না হতে পারে। এই একটুখানি চ্যুতির সম্ভাবনাটাও ভাষার হয়ে ওঠার জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। পুনরুক্তির ভিতরে এতটুকু চ্যুতি, চ্যুতির ভিতরে নিহিত পুনরুচ্চারণ, এ দুয়ে মিলেই ভাষার হয়ে ওঠা। পুনরাবৃত্তির ঘেরাটোপ আর চ্যুতির লঙ্ঘন সম্ভাবনাই তো ভাষার চলতে থাকা টানা-পোড়েন।

এভাবে ভাবলে, পুরুষতান্ত্রিক ভাষার ঘেরাটোপের ভিতরেও, তার প্রতিটা পুনরুচ্চারণে, মিশে থাকে লঙ্ঘনের সম্ভাবনা। আবারও মনে রাখার, সম্ভাবনা শুধু। লঙ্ঘনের গ্যারান্টি নয়। সম্ভাবনাকে বিকল্পের দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে গেলে প্রয়োজন নারীবাদী রাজনীতির চাপ। রাজনীতির সক্রিয় কাজ ছাড়া নিহিত সম্ভাবনাকে লঙ্ঘনের ঘটনায় পরিবর্তিত করা অসম্ভব। এই অর্থেই পুরুষতন্ত্রের পুনরাবৃত্ত কাঠামোর ভিতরে জন্ম নিতে পারে, আরও অনেক কিছুর মতন, নারীবাদেরও সম্ভাবনা, আবার সে সম্ভাবনাকে চরিতার্থতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন নারীবাদী রাজনীতির।

যেহেতু, যে ব্যবস্থার ভিতরে তার জন্ম তার থেকে ভিন্ন হয়েই সে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করে, তার সংজ্ঞার ভিতরে ভিন্নতা অত্যাগসহনও, যার ভিতরে তার সৃষ্টি সেই পুরুষতন্ত্রের নিয়ম থেকে তার গতি বা প্রকৃতি আন্দাজ করা সম্ভব নয়, নারীবাদের মধ্যে তাই এক অনিশ্চিতির উপাদান থেকেই যায়। পুরুষতন্ত্রের অটুট শিকড় প্রোথিত প্রজন্ম উৎপাদনের কারখানা— পরিবারে, পিতৃকেন্দ্রিক আধিপত্যকারী সামাজিকতায়। নারীবাদের রাজনীতির কাজ ওই উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, অথচ ওই পরিসরের দাগছাপ তার গায়ে। পুরনো পরিসর থেকে ছেদের ভঙ্গিতে একটা নিশ্চিত সম্পূর্ণতা আছে। আবার ওই পরিসর থেকে বয়ে আনা চিহ্নের, সংস্কারের ছাপগুলো নারীবাদের নতুন পদক্ষেপকে খানিকটা অনিশ্চিত করে রাখে। কেউ কেউ, হয়তো অধিকাংশ রাজনীতিবিদই, মনে করেন, সম্মেলক কাজে লক্ষ্যের নিশ্চিতি একান্ত প্রয়োজন। নারীবাদের এই ধারা হয়তো রাজনীতির, যেকোনও নীতির, নৈতিকতার, অনিশ্চিত ভূমির কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়। একইসঙ্গে মনে রাখতে বলে নিশ্চিত ভূমির সন্ধান জারি রাখার কথা, অশেষ যে সন্ধানের অঙ্ককষা ছাড়া ছেদ কিংবা পরিবর্তনের চেষ্টা পঙ্গু হয়ে পড়ে। যুক্তিগতভাবে, নিশ্চিতিকে পুরোপুরি বাদ দিলে অনিশ্চিতিই নিশ্চিত হয়ে ওঠে।

ফিরে যাই, যেখানে শুরু করেছিলাম, নারীবাদ আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার টানা-পোড়েনে। আমরা দেখেছি, নারীবাদী রাজনীতির ভিতরে অনিশ্চিতির উপাদান থাকতেই হবে। অথচ, প্রতিষ্ঠান, সে শিক্ষার কিংবা গবেষণার হলেও, নির্দিষ্ট সব সংজ্ঞার খোপে মাপা। নারীর নিজস্ব পরিসর কীরকম, এ প্রশ্নের উত্তরে, ভিন্ন এক সাক্ষাৎকারে দেরিদা তুলেছিলেন নৃত্যপরিকল্পের, কোরিয়োগ্রাফির কথা। রান্নাঘরের স্থির ও নির্দিষ্ট পরিসর নয়, মেয়েদের জন্য তার কল্পনায় ছিল নৃত্যরত পায়ের তলার সরে যাওয়া ভূমি, ছোঁয়ার মুহূর্তে বদলে যেতে থাকা অবলম্বনসমূহের রেখাচিত্র। পরিবর্তনশীল এই রাজনীতি কী করে ঠাঁই পাবে ইউনিভার্সিটির সংজ্ঞানির্দিষ্ট পরিসরে? ঠাঁই পাওয়া কি সম্ভব? না কি প্রতিষ্ঠানের কাঠামোর ভিতরে যেই প্রবেশ করবে এই নৃত্যপর রাজনীতি, অবধারিত তা বদলে দেবে প্রতিষ্ঠানেরই চরিত্র? অথবা, যেমনটা হয়তো আমাদের এ-পর্যন্ত আলোচনার সঙ্গে বেশি সংগতিপূর্ণ, এ রাজনীতির প্রবেশ প্রতিষ্ঠানের চরিত্র বদলানোর অসীম সম্ভাবনা খুলে দেবে। বাস্তবে সে বদল হতে পারবে কি না তা নির্ভর করবে ওই নারীবাদের প্রকৃতি আর গতির উপর। নারীবাদ গ্যারান্টি দেয় না, খুলে দেয় অসম্ভবের কয়েকটা সম্ভাবনা।

আমাদের জানার ক্ষেত্রটাও কি এরকম ছেদ আর ধারাবাহিকতার পারস্পরিকতায় তৈরি? জানা মানেই তো অজানাকে জানা। পুরনো জ্ঞান নতুন করে ঝালিয়ে নেওয়াকে জানা বলে না। সে-অর্থে জানা মানেই জ্ঞানের পুরনো সীমা সামান্য হলেও লঙ্ঘন করা। উলটো দিক থেকে ভাবলে, ওই লঙ্ঘনটুকু ছাড়া ‘জানা’ হয় না। জানার পুরনো পরিসরটা আরও এক বার, বার বার, পুনরাবৃত্ত করাটা জানা নয়। তাই, যদি জ্ঞানের চলতি ধরনটাকে পুরুষতান্ত্রিক বলে চিনি, নতুন করে জানার যেকোনও চেষ্টাতে তবে নারীবাদী উপাদান থাকবেই। নারীবাদ শুধু জ্ঞানের প্রক্রিয়ায় যোগ করার উপাদানমাত্র নয়। ‘জানা’, এই ধারণার ভিতরেই তবে নারীবাদের কাজ নিয়ত ক্রিয়াশীল। না যদি থাকে, জানাটাও ‘জানা’ হয় না তবে। পুরনোর আবর্তনে পরিণত হয়। সহজ সমীকরণের মতো শোনাচ্ছে কথাগুলোকে। আমাদের আগের আলোচনার সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে ততটা অসংগত শোনাবে না হয়তো। দৈনন্দিনে, কিংবা একেবারে সাদামাটা সাধারণ বলে যাকে জানি তার মধ্যে, অনেক সময়েই, চলতে থাকে জানা-বোঝা-করার এইসব জটিল সম্ভাবনা। পুরুষবাদী চিন্তা, একরকম সরল আধিপত্যের বিন্যাসে ভাবতে অভ্যস্ত, এদের নাগাল পেতে শোচনীয়ভাবে অপারঙ্গম। নারীবাদী ভাবনার কয়েকটা ধারাই শুধু প্রাত্যহিকতার আধিপত্যের কাঠামোর ভিতরে লুকোনো মগ্ন উপাদানগুলোকে ছুঁতে চেষ্টা করে একান্ত অভিনিবেশে। আমাদের আলোচনার শেষে এইরকম এক আপাত সাধারণ অসামান্য মুহূর্তের মুখোমুখি হতে চলেছি।

বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনীর নাম আমার জীবন। লেখক রাসসুন্দরী। অনেক দিক থেকে অনন্য নারীর কলমে লেখা এই টেক্সট। শুধু লেখা শেখার ইতিহাসের কথা ভাবলেই বিস্ময় আর শ্রদ্ধায় রোমাঞ্চ জাগতে পারে। একেবারে ছোট রাসসুন্দরীর কানে আসে ভাইদের লেখাপড়া। অক্ষরের সংবাদে উন্মুখ বালিকার কাছে নিষিদ্ধ সে-জগৎ— মেয়েমানুষ পড়তে শিখলে বিধবা হবে এই আশঙ্কার সংস্কারে বদ্ধ সমাজ ওই অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করেছে। তবু, নিষেধ লঙ্ঘন করে, মেয়ে শেখে। শুধু শুনে। কিন্তু শোনার সময়ও ফুরোয়। বিয়ে হয়ে, শ্বশুরবাড়িতে, মেয়ে ভোলে। বারো বছর বয়সে বিয়ে, আঠেরো বছরে প্রথম সন্তান (ছেলে), পরের তেইশ বছরে এগারোটি সন্তান, মাঝে একটি গর্ভপাত, একচল্লিশ বছরে শেষ সন্তানের জন্ম। সংসারে সব কাজের দায়িত্ব তার, সঙ্গে ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা। দু’ বেলা খাওয়ার সময় নেই। কখনও কখনও এক বেলারও নয়। অথচ লেখাপড়া শেখার ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠছে—

… আমার মনের বাসনা প্রবল হইয়া উঠিল যে, আমি একান্ত লেখাপড়া শিখিয়া, পুঁথি পড়িব। তখন আমি মনে মনে মনের উপর রাগ করিতে লাগিলাম। কি জ্বালা হইল, কোন মেয়ে লেখাপড়া শিখে না, আমি কেমন করিয়া লেখাপড়া শিখিব, একি দায় উপস্থিত হইল।

তার নিজস্ব আরাধ্য দেবতা, যাকে কখনও ভালবেসে বলছেন দয়ামাধব, কখনও ডাকছেন জগদীশ্বর বা পরমেশ্বর, তার কাছে প্রার্থনা করছেন লেখাপড়া শেখানোর জন্য। অনেক চেষ্টায়, ছোটবেলায় শেখা অক্ষরগুলো মনে করছেন। মনে পড়ে যাচ্ছে, অক্ষর আর বানান। কী ঐকান্তিক মনঃসংযোগ আর অধ্যবসায় এর জন্য প্রয়োজন। অসামান্য পরিমিত প্রকাশে বলছেন,

এই প্রকার ভাবিতে ভাবিতে ঐ চৌত্রিশ অক্ষর, ফলা বানান সহিত আমার মনে হইল।

এরপর সেই ঘটনা, যাকে রোমাঞ্চকর বললে কিছুই বলা হয় না। দৈনন্দিনের আপাত সাধারণের ভিতর মহাকাব্যোচিত এক মুহূর্ত। গৌতম ভদ্রের কথা ধার করে বলা চলে, নৈমিত্তিকের ভিতর জন্ম নেওয়া অপ্রত্যাশিতের এক বার্তা। একদিন রাসসুন্দরী স্বপ্ন দেখলেন, তিনি চৈতন্যভাগবত পুথিটি পড়ছেন। ঘুম থেকে উঠে ভাবলেন পরমেশ্বর স্বপ্নেই তার ইচ্ছে পূর্ণ করেছেন, খুব আনন্দ হল। তারপর, তিনি রান্না করছেন, শুনতে পেলেন তার স্বামী ছেলেকে বলছেন, চৈতন্যভাগবত পুথিটা এখানে রাখলাম, যখন বলব তখন নিয়ে এসো। স্বামী অন্য কোথাও গেলেন। রাসসুন্দরী, পুলকে আপ্লুত, বুঝলেন এ তার ঈশ্বরের ইঙ্গিত। এ যেন তাঁকে চৈতন্যভাগবত পড়ার, পড়তে শেখার, প্রত্যাদেশ। দ্রুত গিয়ে চিনে রাখলেন পুথিটাকে।

পাঠক, ধাপগুলো লক্ষ করুন। ছোটবেলায় পড়তে শেখা। অনেক বছর পর, সব ভুলে যাওয়ার পর, আবার মনে মনে স্মরণ করা, পুনঃপরিচয় অক্ষরের সঙ্গে। তবু, পরিচয় হল কি না বোঝা যাচ্ছে না পুরো। এবার স্বপ্ন, স্বামীর অজানিত মন্তব্য। এই তো তার কাছে জগদীশ্বরের ইঙ্গিত। প্রতিটা ধাপ যেন গল্পের ক্রম, ঘটনাগুলো শুধু বিবৃত করছেন রাসসুন্দরী। এবার তার নৈমিত্তিক শ্রমের ভিতর এক অন্য আলোর ছোঁয়া। পুথির পাতাগুলো, যেগুলো আলাদা করা যায়, একটা একটা করে সংগ্রহ করেন তিনি। কাজ হয়ে গেলে একটা রেখে আর একটা নিয়ে আসেন। রান্নার সময়ে, ঘোমটার আড়ালে একটা পাতা পড়তে থাকেন। এই পড়াও তো এক স্মৃতির উদ্ধার কাজ। টেক্সট তো তার জানা। শুনেছেন কত বার। তার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া অক্ষরগুলোকে। সেটাকে মিলিয়ে নেওয়া ছোটবেলার স্মৃতির সঙ্গে। আর পাতায় লেখা ছেলের অক্ষরের সারিও তার সামনে।

ঘোমটা আর রান্নার কাজের ঘেরাটোপের ভেতর থেকে জন্ম নিতে থাকে লঙ্ঘনের মুহূর্তগুলি। এতে ওই কাজগুলোর বন্ধন আলগা হল কিংবা এল তাদের নিহিত বৈষম্যের কোনও উপশম এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। ঘেরাটোপ আর লঙ্ঘনের যুক্তি আর সংজ্ঞাগত ভিন্নতা কিছু কমে না এতে। মনে হতে পারে, তবে কি বশ্যতার মুহূর্তগুলোই মুক্তির উৎস? বার বার মনে করে নেওয়ার, ওই মুহূর্তগুলোকে লঙ্ঘন করে মুক্তির নৃত্যপর পরিসর তৈরি করে চলাই রাজনীতির কাজ। বশ্যতার কারিগরিগুলোর একঘেয়ে পুনরাবৃত্তির ভিতর থেকে চ্যুতির সম্ভাবনা চরিতার্থতায় নিয়ে যাওয়া এক অসামান্য নারীর রাজনীতির পরিণাম। প্রত্যহের, দৈনন্দিনের, পরিবার আর ব্যক্তিযাপনের নারীবাদী রাজনীতি তো এভাবেই কাজ করে।

রাসসুন্দরীর কাহিনিতে আরও অনেক মাত্রা আছে। অনেক চিন্তাবিদ সেগুলো নিয়ে গুরুত্বময় বিশ্লেষণ করেছেন। আমাদের এই আলোচনা সে বিষয়গুলো নিয়ে নয়। শুধু খেয়াল করি, তার ‘জিতাক্ষরা’ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায়, নিজেকে এক অজানা মুক্তিতে অভিষিক্ত করে তোলার সময়ে, তার আত্ম-অর্জন যে ভাষায় প্রকাশিত হচ্ছে সেটা আত্মনিবেদনের। ঈশ্বরে ভক্তি নিজেকে এতখানি লুপ্ত করে দিচ্ছে যে নিজের মুক্তি অর্জনের কাজকেও মনে হচ্ছে ঈশ্বর-আদিষ্ট। এর উলটো দিক এক আত্মপ্রতিষ্ঠা, যা এই আত্মবিলোপেরই অপর পিঠ। নিজের সব কাজকেই মনে করা যেতে পারে ঈশ্বরের নির্দেশ— আমি যা করছি তা তিনিই করাচ্ছেন।১০ ঈশ্বর চাইছেন আমি চাই, তাই আমি চাইছি। যা প্রেয় তা-ই শ্রেয়। অতএব, এ নিজের কাজ আর আকাঙ্ক্ষার জন্য খুলে দিচ্ছে অসীম সম্ভাবনা, মুক্তির আর সক্রিয়তার। অর্জন আর নিবেদনের এক কূটাভাসি জমিতে রাসসুন্দরীর মুক্তিসন্ধান।

একেবারে শেষে যে বিষয়ের কথা বলা একান্ত প্রয়োজন সেটা রাসসুন্দরীর অসামান্য পরিমিতিবোধ। বইটা লেখা হয়েছে যেন আলগা গল্প বলার ধরনে। পরের পর অধ্যায়ে জীবনের ঘটনা বিবৃত হচ্ছে। মাঝে মাঝে, সে বিবৃতিকে যেন একটুখানি অনাবশ্যক থামিয়ে, বারে বারে আসছে তার নিজস্ব ঈশ্বরের কথা, দয়ামাধব কিংবা জগদীশ্বরের প্রতি প্রার্থনা অথবা তার সঙ্গে কথোপকথন। অথচ, খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, কোথাও, অকারণে কোনও শব্দ নেই। তার গল্পের ঘটনাক্রম তার যুক্তির ক্রমকে অনুসরণ করছে, ঈশ্বরের সঙ্গে অথবা উদ্দেশে কথোপকথন কিংবা ছন্দে লেখা কবিতাগুলো বক্তব্যের এক বিস্তৃত জালিকার ছোট ছোট অংশ, ঘটনাবিবৃতির টুকরোগুলো ধীরে ধীরে গড়ে তুলছে অধ্যাত্মবিবৃতিকে। লেখা যেখানে আবেগবিহ্বল, সেও উচ্ছ্বাসকেই প্রকাশ করার জন্য। যুক্তি আর উচ্ছ্বাসের এক সম্মিলিত ইকোনমি রাসসুন্দরীর লেখার বৈশিষ্ট্য। ওই ‘ইকোনমি’, যা আপাতভাবে যেন পুরুষের, তো শুধু অর্থনীতি নয়। ইকোনমি মানে ‘সৌষম্য’ও, যা গ্রিক ‘ওইকোস’-এর হাত ধরে, ঘর গুছোনো, গৃহিণীপনা। আবারও মনে করে নিই, ঘর গুছোনোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা গৃহাভ্যন্তরের সংকীর্ণতার পুরুষবাদী অনুষঙ্গগুলো এতে নস্যাৎ হয় না। মেয়েকে ঘরনি করার কৌশল নারীবাদের উপাদান হয়ে ওঠে না।

যুক্তির এক চিত্তাকর্ষক মোচড়ের কথা ভাবা চলে। পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাকাঠামোয় যেহেতু নারীত্বকে ভাবা হয় পৌরুষের সম্পূর্ণ বিপরীতে, নারী পরিচিতির সঙ্গে জড়িয়ে যায় এমন কিছু উপাদান যা পুরুষবাদী উপাদানের একেবারে উলটো। এই উপাদানগুলো পুরুষতন্ত্রের অনুষঙ্গে নারীর উপর দমন ও আধিপত্য তৈরি করে, আবার নারীবাদের প্রেক্ষিতে হয়ে উঠতে পারে ওই প্রাধান্যকে প্রশ্নের মুখে ফেলার উপায়। মনে রাখার, রাজনীতির প্রেক্ষিত এখানে গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ব্যক্তির সদিচ্ছা কিংবা অভিপ্রায় নয়। এই উপাদানগুলো সত্তাগতভাবে স্বতঃস্ফূর্ত, নারীবাদী কিংবা পুরুষতান্ত্রিক নয়। যেমন, পৌরুষের হিংস্রতার বিপরীতে নারীর দরদি নৈতিকতা, ‘কেয়ার’। পুরুষের অত্যাচার লালন করার কাজে লাগলে ওই ‘কেয়ার’ পুরুষবাদী, অথচ তার ভিতরে নারীবাদী ভিন্নতার অপার সম্ভাবনা। সে সম্ভাবনা সক্রিয় করতে গেলে নারীবাদের রাজনীতিকে কাজ করতে হয় যুক্তি আর বিশ্লেষণের সযত্ন পরিশ্রমের সাহায্যে।

আধিপত্যকারী ঘেরাটোপ পেরিয়ে যাওয়ার সরাসরি লড়াই অবহেলা করা চলে না, জারি রাখতে হয় সবসময়। অথচ, নারীবাদী নারী, পুরুষ কিংবা অন্য কারও দৈনন্দিন অস্তিত্বের পুরোটা ওই প্রকাশ্য লড়াইয়ের নিয়মে চালিত হয় না। শুধু সচেতন ভান কিংবা অন্তর্ঘাতের কথা হচ্ছে না। যেহেতু ওই বন্ধনের ভিতরে লড়াইয়ের শুরু, পুরুষ আধিপত্যের ভিতরের জমিতেই মুক্তির কল্প-উপাদান জন্মাতে থাকে। তাতে ঘেরাটোপ আর লঙ্ঘনের ভেদ ঘুচে যায় না। লঙ্ঘনের কল্পনা, কল্পনার ভাঙনকাজ ছাড়া বাস্তবকে পালটানোর রাজনৈতিক কার্যক্রম অচল। আমাদের সচল আর ক্ষণিকের নারীবাদী রাজনীতি ধরে রাখতে চায়, সীমা অতিক্রমের সব সক্রিয় পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে, বশ্যতা পুনরাবৃত্তির ভিতরে জন্ম নেওয়া লঙ্ঘনের পুরনো আর ভবিষ্যৎ ইশারাগুলোকেও।

টীকা সূত্রনির্দেশ

. তত্ত্বভাবনার বেশ কয়েকটা সূত্র নিয়ে কাজ করেছি। যুক্তি বুনতে সাহায্য করেছে যাঁদের কাজ অথচ লেখার ভিতরে সেই সূত্রে উল্লেখ করা হয়নি, তাঁদের কয়েক জনের নাম এখানে বললাম। যে পাঠক জানেন তাঁর কাছে বাড়তি হয়তো। চিন্তার ঋণ স্বীকার করাটা লেখকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ফুটনোট, রেফারেন্স, ইত্যাদি অ্যাকাডেমিক প্রথাগুলোকে শুধুমাত্র পাণ্ডিত্য জাহির করার উপায় হিসেবে না দেখাই উচিত মনে হল। পাঠের সাবলীলতার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে লেখার শরীরে না দিয়ে নোটে দেওয়ার সিদ্ধান্ত— জুডিথ বাটলার (বিশেষত ‘পারফরম্যাটিভিটি’র ধারণা), গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক (চিন্তার সার্বিক গঠন, বিশেষত নারীবাদের প্রেক্ষিতে), জাক দেরিদা (‘আইটেরাবিলিটি’)। Judith Butler, Bodies that Matter: On the Discursive Limits of “Sex” (New York & London: Routledge, 1993). Judith Butler, Excitable Speech: A Politics of the Performative (New York & London: Routledge, 1997). Gayatri Chakravorty Spivak, ‘French Feminism in an International Frame’ in In Other Worlds: Essays in Cultural Politics (New York and London: Methuen, 1987a (1981)). Gayatri Chakravorty Spivak, ‘Feminism and Critical Theory’ in In Other Worlds: Essays in Cultural Politics (New York and London: Methuen, 1987b (1986)). Gayatri Chakravorty Spivak, ‘Not Virgin Enough to Say That [S]he Occupies the Place of the Other’ in Outside in the Teaching Machine (New York and London: Routledge, 1993a (1991)). Gayatri Chakravorty Spivak, ‘Feminism and Deconstruction, Again: Negotiations’ in Outside in the Teaching Machine (New York and London: Routledge, 1993b). Gayatri Chakravorty Spivak, ‘French Feminism Revisited’ in Outside in the Teaching Machine (New York and London: Routledge, 1993c). Jacques Derrida, Spurs: Nietzsche’s Styles, trans. Barbara Harlow (Chicago: The University of Chicago Press, 1979). Jacques Derrida and Verena Andermatt Conley, ‘Voice II’ in Boundary 2 Vol. 12 No. 2, 1984. Jacques Derrida, Limited Inc (Evanston, Illinois: Northwestern University Press, 1988). Jacques Derrida, ‘Geschlecht: Sexual Difference, Ontological Difference’ in A Derrida Reader: Between the Blinds, ed. Peggy Kamuf (New York: Columbia University Press, 1991 (1983)).

. Jacques Derrida, ‘Women in the Beehive: A Seminar’ in Men in Feminism, ed. Alice Jardine and Paul Smith (New York and London: Methuen, 1987), pp. 189-203.

. ‘পজিটিভ’ শব্দটা খানিকটা ভেবেই ইংরেজিতে রাখা হল। শুধু ইতিবাচকতা নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘পজিটিভিজ্‌ম’-এর দার্শনিক অনুষঙ্গ, অস্তিত্বকে পূর্ণ উপস্থিতির নিরিখে ভাবার ধরন। এর বিপরীতে, আমরা এ প্রবন্ধে যেমন চেষ্টা করছি, উপস্থিতি-অনুপস্থিতির টানা-পোড়েনে ঘেরাটোপ আর লঙ্ঘনের সম্পর্ক ভাবার চেষ্টা।

. Jacques Derrida and Christie V. McDonald, ‘Choreographies: Interview’ in Feminist Interpretations of Jacques Derrida, ed. Nancy J. Holland (Pennsylvania: The Pennsylvania State University Press, 1997).

বাংলায়, নারীবাদ আর বিনির্মাণের বিস্তৃত আলোচনায় কোরিয়োগ্রাফি নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ আছে ঋতু সেন চৌধুরীর এই লেখায়— ‘(সং)স্থানের রাজনীতি: নারীবাদ ও দেরিদা’, ২০০৭, বাংলায় বিনির্মাণ/অবিনির্মাণ, সম্পা. অনির্বাণ দাশ (কলকাতা: অবভাস), পৃ. ২২৪-২৩৫।

. রাসসুন্দরী দাসী, (দ্বিতীয় সংস্করণ প্রথম প্রকাশ ১৮৯৭, প্রথম সংস্করণ ১৮৭৫), আমার জীবন (কলকাতা: দে বুক স্টোর, ১৯৯৫)।

. তদেব, পৃ. ৪৮।

. তদেব, পৃ. ৪৯।

. গৌতম ভদ্র, ‘বাঙালির বাংলা বই পড়া’, ন্যাড়া বটতলায় যায় ক’বার? (কলকাতা: ছাতিম বুক্‌স্‌, ২০১১), পৃ. ৮০।

. Partha Chatterjee, The Nation and Its Fragments (Delhi: Oxford University Press, 1993), pp. 116-157; Tanika Sarkar, Words to Win: The Making of Amar Jiban: A Modern Autobiography (New Delhi: Kali for Women, 1999); গৌতম ভদ্র, ‘বাঙালির বাংলা বই পড়া’, ন্যাড়া বটতলায় যায় ক’বার? (কলকাতা: ছাতিম বুক্‌স্‌, ২০১১), পৃ. ৫৯-১০৭।

১০. অবশ্যই মনে পড়বে আর এক ভক্তিগীতির পঙ্‌ক্তি, প্রচলিত শ্যামাসংগীত থেকে— ‘তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *